কবিতায় পাঁচ কবিকে হৃদয়ের অর্ঘ্যদান

‘ঐ  মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে’ – দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানটি মনের এক চিরতৃষ্ণার কথা বলে, মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসা সুর কৌতূহলী মানুষের সংবেদী মন উপেক্ষা করতে পারে না। কবি পিয়াস মজিদের কলম এবার সাড়া দিলো সে দূরাগত ধ্বনিতে। এক বিশ্বদর্শী স্বদেশি এবং চারজন ভিনদেশি ভিনভাষী কবিকে নিয়ে লেখা পাঁচটি দীর্ঘ কবিতা দুই মলাটে বন্দি হয়ে নাম নিল মির্জা গালিব স্ট্রিট, বের হলো ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে। কবি জীবনানন্দ দাশের দোহাই দিয়ে বলতে হয়, ‘মানবের সাথে মানবের প্রাণ বিনিময়ে অবিনয়’, যেমন করে আমাদের হৃদয়ে গান করে ‘নিখিলের শাদা চাতকের মত প্রাণে’, ‘অপার সূর্যশালিনী মহাপৃথিবীর অনুরাগে’।

একজন কবি প্রায়শ কবিতায় ভৌগোলিক কিংবা কালিক সীমানাকে মেনে চললেও সে-কবিতার পঠন এহেন সীমানা মেনে চলতে নারাজ। মির্জা গালিব স্ট্রিটে ভিন্ন ভিন্ন ভূগোলের, ভিন্ন ভিন্ন কালের পাঁচ কবির প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন পিয়াস মজিদ।

এককালে প্রতাপশালী মোগল সাম্রাজ্য যখন ‘বাক্যপ্রান্তে আছে ছায়াপ্রাণ’, সেই নিভু নিভু রাজসভার রাজকবি মির্জা গালিব পেলেন কবির প্রথম অর্ঘ্য। আলোচ্য ভিনদেশি কবিদের মাঝে গালিবই সবচেয়ে কাছের ভূগোলের, তবে সবচেয়ে দূরের সময়ের। যদিও দিল্লির বিল্লিমারান গলির সে-সময়কার আলস্য আজকের ঢাকার কারওয়ান বাজার অথবা চকবাজারে খুঁজে পাওয়া যাবে না, তথাপি গালিব নিজকে যেমন আবিষ্কার করেছিলেন ‘নিজেরই ভেঙে পড়ার শব্দরূপে’ [ম্যায় হুঁ আপনি শিকস্ত কি আওয়াজ], তা দেখি আমাদের প্রতিটি মনোক্ষুণ্ন ভাবুক নাগরিকেরই আবিষ্কার। ছেঁড়া ছাতা আর রাজছত্র মিলেমিশে এক হয়ে যে বৈকুণ্ঠের দিকে চলে গেছে, সেখানে আকবার বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো পার্থক্য নেই।

পিয়াস লেখেন, ‘একটি শতাব্দী শেষ হয়ে যায় মারীতে, আরেকটি যুদ্ধে’, তবু এর মাঝে ‘মানুষের মেহনতি মাংস ফেটে শিল্পের শেয়ারবাজারের সুরভি ফেয়ার। তার উত্থান ও দরপতনই আজকের বড় খবর।’ তবুও কি অটুট নেই সন্ধ্যার পানশালার তুমুল হট্টগোল? আজো কি সন্ধ্যারাতের প্রত্যেক মাতাল হয়ে ওঠে না একেকটি গালিব? পিয়াস মজিদ লেখেন, ‘যখন চোখের চরাচরে ফুরিয়ে এসেছে রঙের ধারণা, তখন কী করেই বা মালুম হতে পারে খয়েরি খোঁপা’ (প্রেয়সীর), বরং আজকের পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর মচ্ছবে গালিবই যেন এক সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হয়ে ফুটিয়ে তোলেন ‘প্রেম’ নামের লাল গোলাপ। বৈষয়িক দালানকোঠায় জায়গা না পেয়ে আমাদের আত্মার ঠাঁই হয় রিফিউজি কলোনিতে। মহামারিক্লিষ্ট পৃথিবীর মানুষের ক্ষত-আত্মার জন্য ওষুধ হিসেবে গালিবের কবিতা যে অমোঘ, তারই পুনরাবিষ্কার করলেন ‘লকডাউনে’ আটক

কবি-নাগরিক; গালিবকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার এ-চেষ্টা তাই পুরনো কাঁসুন্দি ঘাঁটার মতো লাগবে না পাঠকের। 

প্যারিসের পানশালার অভিমানী কিশোর আর্তুর র্যাঁবোর কথা মনে পড়ে আমাদের। জীবনের সকালবেলাতেই একদা তিনি বিশ্বকে জানিয়েছিলেন নরকে এক ঋতু কাটাবার কথা। এই মহামারিকালে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বিপর্যস্ত পৃথিবীর মানুষ বলতেই পারে, ‘এই দ্যাখো, নরকে সব কটি ঋতুই আমাদের কাটানো হয়ে গেল।’ কবির ভাষায়, ‘অমিল অক্ষরের আনন্দে বেড়ে ওঠা’ আমরা যেন ‘বাড়িয়ে চলেছি নিজেরই ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা।’

অনেক অল্প বয়সেই র্যাঁবো লাভ করেছিলেন কবিত্বের ঐশী শক্তি, স্বল্পায়ু কিন্তু ঘটনাবহুল জীবনের মদ তিনি গলায় ঢেলেছিলেন জীবনের সুরাপাত্র উপুড় করে। বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ দেবী/ পদাবলির আশীর্বাদমুক্ত আমি/ পাত্রে পাত্রে পান করি/ মধুর মাটির দুধ … যিশু তাঁর রক্ত-মহান রাস্তায় আমারই জন্য রেখে যায় প্রাণের পেরেক।’

দুটি মাত্র কবিতার বই লিখে কবিতাপ্রেমীদের মাঝে সাড়া ফেলে দিয়ে কিশোরকবি হঠাৎ হলেন কবিতা তথা শিল্পবিমুখ। সকল শিল্পের যথার্থতাকে এককথায় নাকচ করে দিয়ে যেন ঘোষণা দিলেন, ‘শিল্প তো অপরিমেয় অতীতের শহীদ/ এখন যা আছে/ শিল্পের কোট আর বুট/ শিল্পের শুমারিতে নাম নেই তোমার?’

‘নরকে, র্যাঁবোর সঙ্গে’ কবিতাটিতে কবি পিয়াস একাধিকবার র্যাঁবোর কবিতারই কথাটা উল্লেখ করেছেন, ‘আমি হচ্ছে অন্য কেউ’। র্যাঁবোর জীবনের বিস্তীর্ণ ভূগোলে জায়গা হয়ে যায় প্যারিসের পানশালার কবিতার হুল্লোড়, কবি-বন্ধুর পিস্তলে ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হাত নিয়ে ‘লিরিক প্রস্রাবকারীদের সরাইখানা থেকে পালিয়ে বাঁচা’, মার্সেই বন্দরে জাহাজে চড়ে কায়রো হয়ে আবিসিনিয়া পৌঁছেছিলেন যে-কবি, জীবনে আর একছত্রও কবিতা না লিখে জীবন থেকে নন্দনতত্ত্বের শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলে নাম লিখিয়েছিলেন

দাস-ব্যবসায়, মানব পাচারে। কবির ভাষায়, ‘শতাব্দীর চুল্লীতে যথাযথ দগ্ধ এক র্যাঁবো’ বারবার দুনিয়ার সম্মুখে হাজির হয়েছেন একজন ‘আমি হচ্ছে অন্য কেউ’ হিসেবে।

বয়স কুড়ি পেরোনোর কিছু পরেই র্যাঁবো কবিতা লেখা ছাড়লেও আয়ু পেয়েছিলেন সাঁইত্রিশ বছরের। ঠিক একই দৈর্ঘ্যরে জীবনকাল পাওয়া আরেক কবি স্প্যানিশ তরুণ ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা এসেছেন কবি পিয়াসের তৃতীয় কবিতার উপজীব্য আর উপলক্ষ হয়ে। কবিতাটির নাম ‘ওই নিভে আসে, আন্দালুসিয়া’। স্বৈরশাসক ফ্রাংকোর সৈন্যদের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে লোরকার জীবনদীপ শেষ হওয়ার আগেই তিনি দেখে নিয়েছিলেন আন্দালুসিয়ার জিপসিদের উদ্দাম জীবনের প্রাণপ্রাচুর্য। লিখে গিয়েছেন ‘চন্দ্রগাথা’ (‘ব্যালাড অব দ্য মুন’); কিন্তু ফ্রাংকোর এ-সত্য জানা ছিল না যে, বিপ্লবী কবিকে আসলে হত্যা করা যায় না। শহিদ সংশপ্তক কবি স্বৈরশাসকের বুলেট বুকে নিয়ে বেঁচে থাকে জৈবিক জীবনের বহুগুণ।

আমাদের ইতিহাস আয়নার আখ্যান হয়ে ওঠে। তাই আমাদের চলার কোনো মাঝামাঝি পথ নেই, লোরকার কবিতা মাঝামাঝি কোনো পথে না হেঁটে বিপ্লবের পথেই হাঁটল। পিয়াস লেখেন –

এক একটি শব্দের পেছন

এক লক্ষ ফ্যাসিস্ত

ওঁৎ পেতে থাকে,

তুমি তাকে এড়িয়ে যাবে কোন দুর্জ্ঞেয় বিক্রমে?

তখন আমাদের বুকে হতশ্বাস বাজে যে, আমাদের প্রায় সকল শাসক নামে-বেনামে একেকজন ফ্রাংকো হয়ে থাকলেও আমাদের ভূমিতে এখন আর হয় না কোনো লোরকার জন্ম। আন্দালুসিয়ার জিপসিদের মতো আমাদের বেদে-সাঁওতাল-ওঁরাও-কাওরা-কৈবর্তের জীবনের গহিন গান কেন উঠে আসেনি আমাদের নগর-কবির পঙ্ক্তিতে?

এককালে লোরকার স্পেন ছিল পৃথিবীর বড় ঔপনিবেশিক শক্তি। তাদের নাবিক-সেনাপতিরা আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে বড় বড় গণহত্যার কুশীলব। কিন্তু লোরকা দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ। নিপীড়নের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান সুদৃঢ়। স্প্যানিশ ভাষায় এর আগে কেউ গায়নি তার মতো মরমি গাথা, শোনেনি ‘দুই শামুকের কথোপকথন’ –

হেরে যাওয়াই জরুরি কথা

বুলফাইটের জিন্দেগিতে …

বেঁচে থাকা প্রতিটি জোচ্চোরের মুখে

আমাকে টেনে হিঁচড়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার

ধূসর দাগ লেগে আছে।

আমাদের দুনিয়াটা যখন কবি পিয়াসের ভাষায়, এক ‘ঠুঁটো স্বর্গের স্বপ্ন’ যেখানে ‘প্রেম মানে প্রতারক ধ্বনি’ আর ‘সঙ্গী মানে যথার্থ অবিশ্বাসী’, সেখানে ‘প্রতিটি কবিতাই কবির বেহিসেবি মৃত্যুর রোজনামচা।’ পৃথিবীর অনন্ত আন্দালুসিয়া লোরকাকে মøান হতে দেবে না।

বইয়ের পরের কবিতায় কবি চলে যান আটলান্টিক মহাসমুদ্রের ওপারে। কবিতার অর্ঘ্য দেন রোদসি সিলভিয়া প্লাথকে। বলেন, ‘একমাত্র মৃত্যুই শিল্পের সমান’ বাকি যা কিছু সব বাস্তবের কালিঝুলিতে স্বপ্নের শক্তি সঞ্চালন। আয়ুর দিক দিয়ে মাত্র একত্রিশ বছরের হ্রস্ব জীবন কবির। স্বামী কবি টেড হিউজের খ্যাতির ইমারত নির্মাণের আড়ালে চাপা পড়ে তাঁর ভেঙে পড়তে থাকা সুখের ইমারত। তাঁর হয়তো জানাই ছিল যে, ‘কবির জন্য কুরুক্ষেত্র সবই/ সংসারের আলোছায়া/ কবিতার কুয়াশা।’ কবি পিয়াসের পঙ্ক্তি  বলে –

চাইনি কবিতার শোভিত সিন্দুক,

শুধু অস্তমিত কুসুমের ছায়ার উদয় থেকে

নীল নাচের ভাষা কুড়োতে কুড়োতে

রাত্রিকে আমারই হাতে বোনা নদীতে ফেলে আসি।

আমেরিকা মহাদেশ ছেড়ে আটলান্টিক পেরিয়ে পড়াশোনা করতে কবি এলেন বেনিয়ার বন্দর লন্ডনে, থেকে গেলেন। সমুদ্র ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে দেখেন যে, ‘তার দুঃখের সমানও সে পাহাড় উঁচু নয়।’ কবিতায় কবির ভাষায় সিলভিয়ার সমসময়ের ক্ষয়িষ্ণুতার গান বাজে –

পুষ্ট কবিতার বাক্সে

ভরে গেছে বাণিজ্য চরাচর

এই সফল সমতলে থেকে পাবে না

কাটা-পোড়া আমার আত্মার দুর্গম, বন্ধুর শিখর।

সিলভিয়া প্লাথের জীবন হয়ে ওঠে ততোধিক কবিতা, বিষণ্নতায় ঝাপসা। স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবন পাওয়া এই রোদন-রূপসী কবির প্রতি পিয়াসের রায় –

মৃত্যু তো মৃত্যু নয়

মৃত্যু এক কবিতাকৌশল

কবিতার শুষ্ক সারণি, সমীকরণ

ফুরিয়ে এলে

এসে দেখে যেও স্বয়ং

কবিতার এই অমৃত কফিন

কবিতাগ্রন্থের শেষ নৈবেদ্য জীবনানন্দ দাশের প্রতি। পিয়াসের প্রায় সব কবিতার বইয়ে কবি জীবনানন্দ কোনো না কোনো প্রসঙ্গে বারবার আসেন। স্বভাবে চুপচাপ, নির্জনতাপ্রিয় কবি জীবনানন্দ তাঁর ‘অন্তর্গত রক্তের’ প্রবাহে কী করে মহাসিন্ধুর কল্লোল ধারণ করেছিলেন তা আমাদের মনে ‘বিপন্ন’ না হলেও এক নিখাদ ‘বিস্ময়ে’র জন্ম দেয়। এই গ্রন্থে জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা ‘রক্তের নির্জন কল্লোল’ আদতে জীবনানন্দ-জীবনের ঘটনাপঞ্জির ধারাবাহিক আখ্যান। কবিকে নিয়ে আরেক কবির কবিতা লেখা বিরল কোনো ঘটনা নয়। জীবনানন্দ দাশ রবি-পথে পা না ফেললেও তাঁর অন্তত তিনটি কবিতার শিরোনাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। ‘রক্তের নির্জন কল্লোল’ কবি কাব্যোপন্যাস নামে লেখা শুরু করলেও চরিত্র-সৃষ্টি ইত্যাদি করেননি বিধায় কবিতাটি উপন্যাস হয়নি। কবিতা হিসেবে লেখা হলে হয়তো সেটি আরো সবল কবিতা হতে পারত।

মির্জা গালিব স্ট্রিটের কবিতাগুলোর মূল উপজীব্য মৃত্যু। তবে সেই মৃত্যু হাজির হয় জীবনের বাইনারি হিসেবে। কবিতাগুলোর রচনাকাল তথা কোভিড মহামারিকালে মৃত্যু আমাদের মাঝে সবচেয়ে ‘ট্রেন্ডিং’ ছিল। আলোচিত পাঁচ কবির মাঝে একমাত্র গালিব ছাড়া বাকিদের জীবন ছিল হ্রস্ব, কবিজীবন ছিল হ্রস্বতর। সিলভিয়া, লোরকা, র্যাঁবো কেউই চল্লিশ বছর পর্যন্ত জীবন পাননি। কিন্তু তাঁরা কেউই জীবনকে সময়কাল দিয়ে যাপন করেননি। যাপন করেছেন জীবনবোধের, জীবনতৃষ্ণার তীব্রতা দিয়ে। তাঁদের প্রতি একজন মুগ্ধ পাঠকের যথার্থ নৈবেদ্য মির্জা গালিব স্ট্রিট।