কবিতায় স্বাধীনতা ও স্বদেশের স্মারক

শ্রেষ্ঠ কবিতা l দুলাল সরকার l কবি প্রকাশনী l ঢাকা, ২০১৮ l ২৫০ টাকা

কি দিয়ে কবিতা করেন কবি, কি তাকে ভাবায় ? তার ভাবনার সাথে কি কি বিষয় অন্বিত হয়ে থাকে? সময় সভ্যতা দিনযাপন কিংবা ব্যক্তিগত এষণার রেখাপাত নিয়ে কি তিনি বাক্যবলয় তৈরি করেন? সব সময় তাকে কবি হয়ে থাকা বা ভাবনাজারিত হয়ে থাকা জরুরি কিনা? বোদলেয়ার যেমন বলেছিলেন সবসময় অতলে থাক, তোমার সময়কে শুষে নিতে থাক, সব সময় কবি হয়ে থাক সেটা কবিতায় বা গদ্যে। আবার কবিময় হয়ে থাকার জন্য কোনো পরিবেশের দ্বারস্থ হতে হয় কিনা? কিংবা কবি নিজেই কোনো কাব্যময় পরিবেশ নিজের ভেতরে কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে পারেন কিনা? কবিকে তার সময়ের সবচেয়ে নির্মম সাক্ষী হতে হয়, সেই সব সাক্ষ্যকে তিনি কখনো কখনো কবিতায় প্রণোদণা হিসেবে ব্যবহার করেন,তাকে ব্যবহার করার জন্য নিজস্ব ম-ণক্রিয়া থাকে, থাকে বোধের নানা রঙ আর বাহিত কাব্যপরম্পরা তাকে কিছু শৈলীর সংশ্লেষ করতে শেখায় আর এসবের সম্মিলিত সংযোজনায় যা আমাদেও সামনে প্রতিভাত হয় তাই হয়তো কবিতা। কবির নিজস্ব অভিজ্ঞতার সারাৎসার এবং তার কিছু প্রতীকী অবয়ব কবিকে সামনে আনতে হয় যা জীবনের সংবেদের সাথে অন্বিত যা অন্যের সঙ্গে সংশ্লেষ তৈরি করে। এটাই বোধ করি কবিতার প্রধান কাজ। অনেক সময় ভাবা হয় যে জীবনের  গভীর সব কথাবার্তা কবিতার আশ্রয় থেকে আসে  আবার বিপরীতভাবে জীবনের গভীর মর্মসার থেকে কবিতার উৎপত্তি হয়। তবে প্রচলিত স্থূল ভাবনা বা আবেগজাত অভীক্ষা যে কবিতা নয় সেটা তো প্রকৃত কবির জানা কথা।

বাংলাদেশের কবিতায় এই চিৎপ্রকর্ষের গভীর আবেদন নিয়ে বা বৈচিত্র্য নিয়ে কবিতা রচনা করার রীতি তেমন দেখা যায় না, ফলত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নতুন কোনো চিন্তা বা  প্রকরণগত অভিনবত্ব আমাদের চোখে পড়ে না; একধরনের আবেগমথিত ব্যক্তিগত এষণার ফলাফল কবিতার পঙক্তিতে আমরা সহজে পেয়ে যাই। কবি এই সব চরণ লিখে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন; করতেই পারেন। তবে এভাবে বেশিরভাগ কবিরা যখন সামনে এগুতে থাকেন ভুল পথ থরে তখন সত্যিকার অর্থে একটি জাতির কাব্যশক্তির দৈন্য খুব উৎকটভাবে চোখে পড়ে। বলা বাহুল্য, সবাই কবিতার গভীর সৌকর্যের পথে থাকতে পারবেন এমন আশা করাও ঠিক নয়। তবু আমাদের ভাষা  সাহিত্য সংস্কৃতি সভ্যতা ও জীবনাচরনের ইতিহাস বিবেচনায় নিলে আমাদের আরো সমৃদ্ধধারার কবিতা রচনা করার কথা। সেটি আমরা পারিনি।

স্বাধীনতার পর আমাদের চেতনার মূলে একটি দীপ্র আলোড়ন আসে; সব জাতির মতো আমরাও আত্মগৌরবে উজ্জীবিত হতে থাকি আর প্রাণের প্রসরতা বাড়তে থাকে। সেই তীব্র চেতনা আমাদের সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই উপস্থিত হতে থাকে; সব সময় তাকে মানসম্পন্নরূপে দেখা না গেলেও আমরা প্রতিনিধিত্বমূলক  লেখক বা কবিদের পেয়ে যাই। মহান স্বাধীনতা আমাদের আগের সতত প্রবাহে নতুন ধারা সংযোজন করে। এই শক্তি সম্ভাবনার কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী কবিতা স্বকীয় অবয়ব তৈরি করতে থাকে। এভাবেই আমরা যে কবিদের পাই তারা আমাদের আবহমান বাংলার ছবিকে নতুনভাবে চিনতে থাকে, কেউ সরাসরি যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে শিল্পময় করে তোলেন, কেই চিরায়ত কাব্যবোধের আলোকে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেন। সত্তর বা আশির দশকে অনেক কবিদের কবিতায় ব্যক্তিগত বিষয়ের চেয়ে সে কারণে দেশের স্বাধীনতা, মুক্তি ও সার্বভৌমত্ব ও স্বদেশ-প্রকৃতি বড় হয়ে ওঠে। সত্তরের কবি দুলাল সরকার বেলায়, তার কবিতা পড়ার সময় বার বার পাঠকের এই কথা মনে হবে। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন বলেই হয়তো দেশ তার কাছে বিপুল কাব্যের উৎস হিসেবে ধরা দিয়েছে। দেশকে কবিতার বিষয় করার ক্ষেত্রে অনেকে যে আবেগে ভেসে গিয়ে কবিতার মূল সূত্রকে ভুলে যায় তিনি সেটা যাননি বরং কবিতাকে সত্যিকার অর্থে কবিতা করে তোলার চেষ্টা লক্ষ করা যায় সব সময়। মুলত রোমান্টিক কবি  বলে দেশ, প্রকৃতি, নিসর্গ এবং যাপিত জীবনের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে  তিনি রোমান্টিক আবহ তৈরি করতে পেরেছেন সহজে, তবে এক্ষেত্রে অন্যদের বেলায় যা হয় অর্থাৎ কবিতা শুধু বিবৃতি হয়ে ওঠে তিনি তা থেকে দূরে থাকতে পেরেছেন। ব্যক্তিগত প্রেম-প্রণয়ের প্রসঙ্গ তার কবিতায় থাকলেও স্বদেশের প্রতি প্রেমই বেশি গভীরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। একটি গন্ধরাজ কবিতায় তিনি লিখেছেন :

 ফুটাতে পারিনি হাসি বিষণ্ন মায়ের,

/ শিশিরের জল দিয়ে ধুইনি ক্রূরের চোখ/

 অস্ত্র দিইনি তুলে মিছিলে মিছিলে;

/ অনাচার, ব্যভিচার, পশুশক্তি রুখতে পারি নি/

 অথচ মানুষ এত শুভ্র ছিল – সত্য ছিল/

তাই এত দ্বিধা ছিল অস্ত্র হাতে নিতে। (পৃ ১৬-১৭)

অন্যত্র তিনি লিখেছেন :

আজ কিছুতেই তুমি হলুদ শাড়িটি পরে বাইরে এসো না

বাইরে অনেক প্রজাপতি – মিছিলের ডাক

তোমার কাপড়ে এসে বসবেই

তুমি ওরকম করে বাইরে এসো না

বাইরে অনেক পাখি শিশিরের দাগ

তুমি এড়াতে পারো না

কিছুতেই লুকাতে পারো এমন শাড়িতে তুমি তোমাকে ঢেকো না; (পৃ ১৯)

লক্ষণীয় যে রোমান্টিকতার সাথে যুদ্ধ বিপ্লব মিছিল কীভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন কবি, কত সতর্কতার সাথে। কবিতা হয়ে-ওঠার নিজস্ব সক্ষমতা কবির তৈরি না হলে তিনি ব্যর্থতাকে বরণ করবেন বার বার। ভালো কবিতার কাছে পৌঁছাতে পারবেন না। কবি দুলাল সরকার বাংলাদেশের কবিতায় খুব বেশি আলোচিত হতে পারেননি, সেটা তার ব্যর্থতা নয় বরং আমাদের সামগ্রিক সাহিত্য আলোচনা বিশ্লেষণ-পাঠ বা আমাদের মিডিয়ার দুর্বলতা। স্বাদেশিকতার সাথে দেশ মাতৃকা কৃষিসভ্যতা বা আমাদের গ্রামীণ জীবনের গভীর আশ্লেষকে তিনি উপজীব্য করে তুলেছেন কবিতায়। এটা তার শক্তি ও কাব্য চেতনার সূক্ষ্ম প্রাগসর সম্ভাবনাকে সাক্ষ্য দেবে। ‘জীবন যেভাবে হবে’ নামের একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন: এরকম কোনো জীবন হবে না …

জীবন মানেই হবে যৌথ খামার

কৃষিজাত উৎপাদিত মাঠ

জীবন মানেই হবে চকের উপরে চিৎ নীলাভ আকাশ

একজন কৃষকের মাঠ চৈতি শ্রমজ স্বভাব

বিরাট বিশাল হবে মানুষের বোধ

নিরাময়ে আকাশের হাত –

অরণ্য আকাশ প্রান্তে চোখ ভরে দেখা

মানুষের প্রিয় বুকে কে বাজায় – বাজায় কে বাউল দোতারা। (পৃ ২২)

আগেই বলেছি স্বদেশ তার কবিতায় এসেছে নানাভাবে; কৃষকের ক্ষেত যেমন তেমনি বিজয় মিছিলের সাথেও তিনি  রোমান্টিকতা করেন। তিনি বিজয় মিছিলে যেতে চান না কারণ তার মাঠে অনেক কাজ পড়ে আছে। ফসলের মাঠ তাকে ডাকে বার বার, এই আমন্ত্রণের চেয়ে বড় কিছু নেই কবির কাছে। আবার আকাশে তারা কবির কাছে জানতে চায় ধান-পান কেমন হয়েছে। মূলত কবির কাছে যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশ গঠনের স্বপ্ন, সেই স্বপ্নকে বুকে করে ছেলেরা যুদ্ধে গিয়েছিল, ফিরে এসেও তার বার মনে হয় নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়াই আসল কাজ। সাধারণ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাই আসল স্বপ্ন। ‘ক্ষত’ নামের কবিতায় কবি লেখেন : একাকী হলেই রাতে উঠোনে একটি তারা/ এসেই জানতে চায় ধান-পান কেমন হয়েছে/ জমি জমা কতটা নিড়ানো হলো/ যেভাবে জঙ্গল উঠে ক্ষেত ভরেছে, ঘরের ইঁদুরে আর বাঁধ তো কাটে না/ এসব জানাতে চেয়ে তারাটির খুব লোভ … দুই ভাই হিন্দু মুসলমান এরা একান্নবর্তী তো/ নাকি এখনো কলহে করে কাটায় সময়/ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যারা/তারা বিশ্বাস করে ‘জয় বাংলা’মন্ত্রের ক্ষমতা : (পৃ ২৭-২৮)।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা স্বদেশচেতনায় মুগ্ধ কবি খুব কমই এর থেকে বের হয়েছেন; বলা যায় বের হতে চান বরং নিজের জীবনকে, জীবনের সব আকাক্সক্ষাকে মাতৃভূমির নানা অনুষঙ্গের সঙ্গে লীন করে দিয়েছেন। একেও সমালোচক হয়তো রোমান্টিকতা বলবেন শাস্ত্রমতে তবে এর বৈচিত্র্য আমাদের পুলকিত করে; আউশের গরম ভাত খেয়েছ বলেই তুমি/ এতটা সুন্দর/ এতটা নরম মুখ মমতাময়. থোড়ের সবুজ/ মেঘে-প্রিয় ময়ূর হৃদয়/এতটাই মানবিক. প্রজাপতি পাখার আনন্দে/ এত খুশি – সুখী সুখী চেহারায়/ আউশের নরম ভাত নেড়ে নেড়ে/ হাতের আঙুলে তাই চন্দনের ঘ্রাণে/ দুর্লভ ব্যাকুল আর মানবীয় হয়েছে – (পৃ ৪৪)। এই জাতীয় কবিতার নতুন একটি দ্যোতনা দেখা যায় নদীকে বুঝিয়ে বলেছি’ কবিতায়। এখানেও  অভিমানি মুক্তিযোদ্ধার মুখ ভেসে ওঠে অলখে, তবে তিনি যে স্বপ্ন বুনে চলেন অবিরাম এবং যে স্বপ্ন দেখাতে চান স্বদেশবাসীকে তার এক নান্দনিক ছবি এখানে ফুটে ওঠে – ফুঠে ওঠে নিটোলে নদীর জলে কবিতাময় পঙ্ক্তিতে। বাংলার নদী বাংলার নারী কত মোহনভাবেই না প্রতিভাত হতে পারে বাংলা শব্দজালে তার একখ- মনোময় রূপ ধরা পড়ে এই কবিতায় :

নদীকে বুঝিয়ে বলেছি,আমার আরো কিছুদিন দেরি হবে যেতে

মাথায় এবং পিঠে, দুই গালে বুলিয়ে বিশ্বস্ত হাত, বলেছি নদীকে

তুমি গিয়ে বিকেলের গ্রাম থেকে

ঘুরে এসো যেখানে গেরুয়া বিকেল

গারাদিন কাজ শেষে কিষাণী মেয়েরা

আরেকবার নাইদে নেমে পরম নির্জনে

জলের গুহার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে আরেক সুন্দর;  (পৃ ৬৩)

দেশমাতৃকা, দেশের প্রকৃতি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু, একুশে ফেব্রুয়ারি, পনেরই আগস্ট, স্বাধীনতার অর্জন নিয়ে খেদোক্তি, এবং সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ইত্যাদি নানা বিষয় কবি দুলাল সরকারের কবিতার বিষয়বস্তু; কখনো একই বিষয় বারবার ফিরে এসেছে। কবি শব্দবোধের স্বকীয়তার কারণে  হয়তো এইসব বিষয়গুলো কবিতা বলে মনে হয়। তবে স্বীকার করতে হবে প্রকৃত কবি আরো এগিয়ে থাকেন তার চিন্তারাজ্যেও সীমানা নিয়ে; ব্যক্তিজীবনের গভীর ঘণপিনদ্ধ-সংহত অথচ সূক্ষ্ম সংবেদ নিয়ে নতুন অবয়বের কবিতা  কবিকে এগিয়ে রাখে অন্যদেও চেয়ে – এখানেই তাকে স্বতন্ত্র মনে হয়। অভিজ্ঞতার সারাৎসার, উইট, হিউমার বা এবং প্রকরণের নতুনত্ব কবিকে নিয়ে নিজস্ব ভূমে। চিরায়ত বোধ বা মানবিক উত্তেজনাও কবিতাকে স্বকীয় করে তোলে এবং উত্তীর্ণ চরণ আমাদের সেই সাবলিমিটির দিকে নিয়ে যায় আর সেটাকে সবাই প্রকৃত কবিতার উদাহরণ হিসেবে নেয়। শুধু শোভন শব্দবলয় বা কিছু ধারাবাহিক আকর্ষণীয় বর্ণনাকে আমরা আপাতভাবে কবিতা বলি তবে অচিরেই তার মৃত্যু হয়। সমসাময়িক বিষয়বস্তু বা দেশজ বা রাজনৈতিক বিষয়বস্তু নিয়ে মানসম্পন্ন কবিতা লেখা সহজ নয় সেটা কবিতার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই স্বীকার করবেন।

দুলাল সরকার কবিতায় শোভন ও নান্দনিক বোধ নিয়ে বেশ সচেতন এবং এই সচেতনতা তার কবিতার শরীরে স্পষ্ট। তবে  তিনি কবির ব্যক্তিগত চিন্ময় চৌহদ্দী নিয়ে কবিতা লিখতে চাননি; কেন চাননি সে-ব্যাখ্যা আমাদের জানার কোনো দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা তো ঠিক যে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভিঘাত, সংশ্লেষ থাকে; বেশিরভার কবির বেলায় সেই সংশ্লেষের উপলব্ধিজাত অধীরতা থেকেই চরণের জন্ম হয়। স্বদেশ-প্রকৃতিও তাকে সন্দিগ্ধ করে তোলে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটা তো ঠিক গভীর ও আধুনিক কবিতা তো মন্ময় হয়ে তাকে, তন্ময়তার ছোঁয়া সেখানে থাকলেও তাকে কবি মন্ময় করে তোলেন। কবির শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের কবিতাগুলোকে বিবেচনায় রেখে বলা চলে তিনি মন্ময়তাকে প্রাধান্য দিতে চান না, না চাইলেও কবিতার নতুন বাকভঙ্গি না নতুন বক্তব্য  সমবায়ে তাকে অনন্য করে তোলার দিকে দৃষ্টি দিতে হয়।

বাংলাদেশের কবিতায় পঞ্চাশ বা ষাটের কবিদের প্রভাবের চেয়ে ত্রিশের কবিদের প্রভাব বেশি বলে অনেকের ধারণা; সেই ধারণার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে। যারা প্রচল ধারায় অবগাহন করেননি বা এ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন তাদেও শক্তি-সম্ভাবনা নিয়ে সবাই সমীহ করেন। বলতে দ্বিধা নেই দুই বাংলাতেই এই ধারার মৌলিক কবির সংখ্যা কম। যারা আলোকিত তারা সবাই ভালো কবিতা লিখেছেন এমন নয়, তবে সাহিত্য আন্দোলন বা কাব্য আন্দোলন ও মিডিয়ার সৌজন্যে এমনটা হয়েছে কখনো। কবিতা বা কবিকে আলোচিত করে তোলার জন্য যে সাংস্কৃতিক বা সাহিত্যক প্রেক্ষাপট দরকার সেটাও আমাদেও দেশে নেই বলা চলে। কলকাতায় কিছুটা আছে তাতে আবার অসুস্থতা লক্ষ করা যায়। পাঠকহীন সমালোচনাহীন আলোচনাহীন কবি বা তার কাব্য নিয়ে বর্তমান সুখপ্রদ কোনো খবর দেওয়া সম্ভব নয়। তবু কবিতা লেখা হচ্ছে, হবে, প্রাণের আকুতি আর তার বর্ণময় বৈচিত্র্যকে প্রকাশ করার জন্য। সবটা আবেগ নয়, অনর্থক নয়। কবি দুলাল সরকারের সমগ্র কবিতা পড়ে আমার মনে হয়ে কবির শক্তি তার মধ্যে পুরো মাত্রায় রয়েছে। তবে কবিতার যাপনের সাথে ধারাবাহিক সমন্নতিকে সমন্বয় করতে হয় কবিকে। সেদিকে তিনি খুব নজর দেননি।

ত্রিশের পরে যারা লিখেছেন তারা জীবনানন্দ আক্রান্ত এরকম বলা হয়; এটা হয়তো একটি মামুলি কথা। দুলাল সরকারে কবিতা পড়তে গিয়েও পাঠক কখনো এই আক্রান্ত হবার উদাহরণ দেখতে পাবেন। ‘তুমি এক নগ্ন প্রজাপতি’ নামক কবিতায় তিনি লিখেছেন:  প্রথম পোয়াতি হলে যে বছর, মনে পড়ে?/ নিয়ে যাই মাঠে, নৌকার চালিতে দুজন:/ চারিদিকে রাত, নিশি রাত. পাখিরাও ঘুমে,/ শুধু ডাগর নীলাভ জল ফুঁড়ে/ আউশের থোড় আসা ক্ষেতের ভিতর/ তোমাকে অনাবৃত করতে সম্মতি জানালে :  … নিখুঁত তুলিতে তোলা জলগন্ধী গাভীন সুন্দর/ সুডৌল সুনীল ত্বক, ফোঁটা ফোঁটা/ শিশির গড়িয়ে পড়া স্বর্ণাভ গতর চুইয়ে/ তোমার অজ্ঞাতে এক মৌন বিষাদ/ পানার উপরে শোয়া বর্ণনাতীত/ তুমি ধ্রুপদী ভঙ্গিমা/ ভয়ঙ্গও ফুটেছিলে সেই তুমি উলঙ্গ গতরে : (পৃ ৫৬) ধরে নেওয়া যায় এটি  একটি মৌলিক ও সম্ভাবনাময় কবিতা। কবির নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর আকাক্সক্ষাকে চিত্রকল্পময় কওে তুলেছেন, বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন আর পাঠকের ভাবনার বা বোধের অলিন্দ খুলে দিয়েছেন কবি। জীবনানন্দীয় আবহ বাদ দিলেও কবির নিজস্ব কিছু থাকে কিনা সেটা পরখ দেখা যেতে পারে। তুমি নগ্ন প্রতিমা বা নগ্ন প্রজাপতিকে কবি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা নিঃসন্দেহে সুন্দর, সূক্ষ্ম ও পরিপাটি। প্রশ্ন হতে পারে শুধু বর্ণনা দেওয়াই কি কবির একমাত্র কাজ? নিশ্চয় নয়। বস্তু বা দৃশ্য নিয়ে দৃশ্যকল্প তৈরি করা কবির সাধারণ কাজ, তাকে আরো কাজ করতে হয়, এই বিশেষ ভঙ্গি বা দৃশ্যকে নির্বিশেষ কওে তোলাও কবির প্রধান কাজ।

তবে কবি অনেক যায়গায় আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন গভীরভাবে। সেখানে তিনি উড়ে যাবার পাখা পেয়ে যান তার গন্তব্যে পৌঁছতে; পাঠকের যে আকাঙ্ক্ষা থাকে তার সাথে তিনি সাযুজ্যের পথ খুঁজে পান : তোমার আসার পথে উঁকি দিয়েছিল কিছু/ অক্ষত হরিতকি – জলের মিষ্টতা বাড়ে এমন সুরুচি/ গাঢ় হয়ে উঠেছিল ফলের সুপক্ব ত্বকে/ এমন মসৃণ এক স্তনের মুকুর/ যুক্ত হয়েছিল আরো কিছু পথের দোতারা/ এক সাথে বেজে ওঠে অক্ষয় সান্ত্বনা সুরধ্বনি।

আঞ্চলিক ভাষায় কিছু কবিতায় তিনি নিরীক্ষা করেছেন সেটাতে তেমন নতুনের গন্ধ নেই। তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন আর স্বদেশের সাথে লীন বিষয় নিয়ে তার বেশিরভাগ কবিতা লিখেছেন; এখানে তিনি সাবলীল। সেখানে তিনি বেশ গতিমান এবং নিজস্ব একটা প্রকরণ তৈরি করতে পেরেছেন ধরে নেওয়া যায়। ‘স্বাধীনতা’ নামে কবিতাটির কথা ধরা যাক : তাহলে কি আকাশকেও অনুমতি নিতে হবে/ কতটা বিস্তৃত হবে সে? অথবা নদীকেও/ চলতে চলতে পথ শিখতে হবে ধ্বনি,/ দিগন্তের স্বাধীন পরিধি কতটা সুদূরে মিলাবে তাও?/ পাখির উড়াল বিষয়ে তোমাদের অনুমতি নিতে হবে -/তালবিধি নীরবে দাঁড়িয়ে কী কথা/ রৌদ্র হাওয়ার সাথে কবে – বালুচর নদীর ভেতরে/ জলের আবর্তে কীভাবে উঠবে জেগে -/ অথবা সমুদ্র? আপন মন্থনে অন্তস্থ ব্যথায়/ কী কৌশলে শঙ্খে বিবর্ত হয় তার নীল শব্দের ভাষায়/ বালুতটে গ্রন্থিত শৈবাল? স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বোঝানোর জন্য কবির এই সব উদাহরণ এবং তার ব্যঞ্জনা নিয়ে এই কবিতা। দুলাল সরকার আমাদের দেশের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা, প্রকৃত স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে তার কবিতার আয়োজন করেছেন। তার ভূমে তিনি বেশ সপ্রতিভ এবং খানিকটা প্রগলভ। কবিতার পাঠক তার কবিতায় এক ধরণের মোহময় ভঙ্গি পাবেন, পাবেন শব্দবোধের ও তার ব্যবহারের নিপূণ আয়োজন। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’নামক তার এই সংকলন গ্রন্থে তার সব কবিতা নেই, তবে যা আছে তা তাকে ভালোভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। গ্রন্থটি চমৎকারভাবে ছাপা, প্রায় নির্ভুল। সত্তরের এই কবিকে একজন পাঠক হিসেবে আমি প্রণতি জানাই; তিনি তার কবিকৃতির উপযুক্ত স্বীকৃতি পান সেটা আশা করি।