করোনা কথা

শিশির ভেবেছিল ওর হবে না। শেষমেশ ওরও হলো।

সামান্য খুসখুসে কাশি আর না-বলার মতো জ্বর। একশর নিচে ওটা কি কোনো জ্বর ?

তবু সে বরাবরই সচেতন মানুষ। তিন মাস আগে ডি ভিটামিন খেয়ে রেখেছে পেটপুরে। স্ক্যাবো, লং-চা, লেবুর সরবত, হোমিও ওষুধ – কোনটা নয়?

মাস্ক-শিল্ডের আভরণে চেহারা চেনা দায়, মধ্যযুগের বর্ম পরা সৈনিক যেন সে। পুলিশের পিস্তলের মতো সারাক্ষণ সঙ্গে রয়েছে স্যানিটাইজারের কাচের শিশি, মেখে মেখে চামড়া তুলে ফেলছে হাতের তালুর। বিশ সেকেন্ডের জায়গায় দুই-তিন মিনিট ধরে অবিরাম সাবান-জল দিয়ে হাত ধুয়েছে সে। এসব করতে গিয়ে এমন হয়েছে যে আতশ কাচ ছাড়া জ্যোতিষীর পক্ষেও হস্তরেখা বোঝা মুশকিল এখন। প্রায়ই চুলকায় হাতের তালু, ফাঙ্গাসের ফ্যাকাশে ছায়া পড়ে গেছে সেখানে, তবু অদৃশ্য শত্রুভাবাপন্ন এই ভাইরাসটিকে পরাস্ত করার নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছে সে।

অফিস থেকে ফিরে আসামির মতো হাত উঁচু করে সোজা ঢুকে গেছে মেসের বাথরুমে। সাবান-সোডা-স্যাভলনে তছনছ করতে চেয়েছে ভাইরাসের আবাসস্থল। কী যে এক আক্রোশ আর প্রতিহিংসা ওর মনে! অদম্য সেই আক্রোশের ঘোরে ঘরের চারকোনায় জীবাণু-ধ্বংসকারী তরল ছিটিয়েছে সুযোগ পেলেই; যত পিচকারি মেরেছে তত প্রতিহিংসার আগুন ধিকিধিকি জ্বলেছে অন্তরমহলে। মনে মনে দাঁতে দাঁত চেপে কাকে যেন প্রতিনিয়ত বলেছে, ‘দেখি ক্যামনে আমার দিকে ঘেঁষছ? দেখি তোর শক্তি? হগলরে সোজা ভাবছস? হগলেই পাটকাঠি?’ খানিকটা পাগলের মতোই আচরণ ওর। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে এক তীব্র আত্মবিশ্বাস – শিশিরের কিছু হবে না!

ইরার ফোন নম্বরটা দেওয়া ছিল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সকালে নাকের সর্দি নিল তুলোর বাডে করে। নাকের ছেঁদায় তীক্ষè খোঁচার চোটে আরেকটু হলে পিপিই মোড়ানো মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীর ইজ্জতেই হাত পড়ে যেত যন্ত্রণাকাতর শিশিরের! দাঁতে দাঁত খিঁচে কোনোরকমে নিজেকে সংবরণ করেছে সে-সময়।

সন্ধ্যায় ফোন, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পক্ষ থেকে সরাসরি ইরার কাছে।

‘আপনার কী হয়?’

ওপাশে ইরা নিরুত্তর। সবে অফিস থেকে ফিরেছে। জামাকাপড়ও বদলানো হয়নি পুরো। এরই ভেতর এই উটকো আপদ। ফের জিজ্ঞাসা, ‘কিছু হয় না?’

‘না।’ ভাবলেশহীন গলা ওর। কিছু হওয়া মানে তো অনেক কিছু; একসঙ্গে মিনিমাম তিরিশ বছর থাকার দাম্পত্য প্রতিশ্রুতি। ওটা কে দেবে? এর চেয়ে মুখের ওপর না বলে দরজা বন্ধ করে ফেলা বুদ্ধিমতীর কাজ।

‘মানে? সত্যি বলছেন?’ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকটির গলায় বিস্ময়।

ইরা উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ।’

ঘড়িতে তখন মোটে সন্ধ্যা ৭টা। ওর ফর্সা নাকের ডগায় ঠিকঠাক রিডিংগ্লাসটাও পরা হয়নি। নিজের বেডরুমে পা দিলে, পড়ার মতো হাতে কিছু না থাকলেও, সে গ্লাসটা পরে বড় সুখ পায়। কারণ এটা ওর প্রথম বয়ফ্রেন্ডের দেওয়া, খুব স্টাইলিশ জিনিস। যদিও ওকে ফাঁকি দিয়ে রোমেল কানাডার টরন্টোতে বউ-বাচ্চা নিয়ে পরম সুখে বসবাস করছে, তবু পুরনো স্মৃতির মতো এই গ্লাসটা বড়ই আরামের। কেমন একটা সুখ-সুখ কষ্ট মেশানো আছে এর সঙ্গে। এরকম একটা নিজস্ব সময়ে এত কিছু?

‘তাইলে এই নম্বর-ঠিকানা এগুলো কী?’ প্রশ্নকারী লোকটা রীতিমতো বিরক্ত।

এর চেয়েও মহাবিরক্ত ইরা নিজে। সে মিডিয়া-হাউজ থেকে ফেরার পর থিতু হয়ে এ-সময়টায় নিজের রুমে মোবাইলে গেম খেলে, ঘুমায় কিংবা নতুন কোনো হলিউডি-বলিউডি ছায়াছবি খুলে বসে ল্যাপটপে। বুয়া এক ফাঁকে চা-নাশতা টেবিলের ওপর রেখে নীরবে চলে যায়। বাড়তি কোনো কথা থাকে না মুখে। ওদিকে রোখসানা বেগম ড্রয়িংরুমে বুয়ার হাতের চায়ে চুমুক দিতে দিতে টেলিভিশন নিয়ে মজে থাকেন, কিংবা স্বামীর সঙ্গে ম্যারাথন কথা শুরু করে দেন সারাদিনের সমাচার নিয়ে। ফিরেও তাকান না মেয়ের দিকে। অথচ এখনই খোঁচাখুঁচি!

‘আরে ভাই, আপনি কি ডিবিতে কাজ করেন? শিশির আমার অফিস-সহকর্মী। আমাদের ফ্ল্যাটের কাছেই সে একটা মেসে থাকে। আমার নম্বর দিয়ে রেখেছে আপনাদের, দ্বিতীয় নম্বর হিসেবে। তাতে অসুবিধা কোথায়? এই রিপোর্টটা কি চেকের পাতা? যেরকম করতেছেন মনে হচ্ছে আর কারো হাতে পড়লে ভাঙাইয়া খেয়ে ফেলবে? রিপোর্টটা কী? পজিটিভ তো?’

‘জি। ম্যাডাম খুবই ইন্টেলিজেন্ট। প্লিজ মাইন্ড করবেন না। প্লিজ!’ লোকটির গলা নরম হয়ে এলো।

‘ঠিকাছে, রাখলাম।’ বলে একটুক্ষণ থামে ইরা।

‘পেশেন্টের জন্য কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন এ-সময়। আমাদের কোভিড টিম রয়েছে নিজস্ব। এক্সপার্ট সব ডাক্তার। মাত্র ষোলশো টাকা চার্জ। খুবই অল্প ম্যাডাম।’ লোকটি এক নিশ্বাসে নিজের দায়িত্ব উজাড় করে দেয় ক্লায়েন্টের কাছে। বড় একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসে লোকটার হৃদয় ফুঁড়ে। মোবাইলে স্পষ্ট ধরা পড়ে সেটি।

‘ঠিকাছে। জানিয়ে দেব। এখন মেহেরবানি করে ফোনটা রাখুন।’ বলেই ইরা নিজের ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিলো বিছানার একপাশে। তারপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সেখানে। ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে আসছে ওর; সহসা কী ভেবে অভ্যাসবশে কানে মোবাইলের হেডফোনটা লাগিয়ে নিল ইরা। তারপর যথারীতি ঘুমিয়ে পড়ল। মোবাইলে অবিরল গান চলছে, আরতি মুখোপাধ্যায়!

রাত ৯টায় শিশিরের কর্কশ ফোনের শব্দে ওর ঘুমটা ভেঙে গেল। অধীর আগ্রহে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিরে, ওরা ফোন করল?’

‘হ্যাঁ করেছে তো।’ ঘুমজড়ানো গলা ওর। মা-বাবার একমাত্র আদরের কন্যা সে; সারাক্ষণ ন্যাকামো যেন খেজুরের রস হয়ে চুঁইয়ে পড়ছে ওর প্রতিটি আচার-আচরণে।

‘রেজাল্ট কী? বলবি না?’ উত্তেজনায় শিশির টগবগ করছে।

‘পজিটিভ। বুঝিস না? তাতে কী? অ্যাজিথ্রোমাইসিন, ডক্সিক্যাপ, ডক্সিভা, মোনাস, ফেক্সো, প্যারাসিটামল, জিংক, রিভারক্স ১০ – সবই তো মেসভর্তি করে রেখেছিস। খেতে শুরু কর।’

‘ইয়ার্কি রাখ। সত্যি বলছিস ইরা? আমার পজিটিভ?’ শেষদিকে কেমন কাঁদো কাঁদো শোনাচ্ছে ওর কণ্ঠস্বর। এত কিছুর পরও এই করুণ পরিণতি – বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুতেই।

ইরার মায়া হলো। সঙ্গে খানিকটা ক্ষোভও। কীভাবে যেন শিশিরের ভেতর একটা ধারণা জন্মে গেছে, কোভিড ওর জন্যে নয়। লেবু-লং-এলাচদানা আর ডি-ভিটামিন দিয়ে ভাইরাসের দফারফা করে ছাড়বে সে – সারাক্ষণ এমনি কথাবার্তা ওর। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। মনে মনে বেচারা বলে ওর প্রতি করুণা প্রকাশ করল সে।

একসময় শিশিরের প্রতি বেশ খানিকটা আকর্ষণই বোধ করত ইরা। মিথ্যা নয়, সত্যি! উঁচু-লম্বা গড়ন। ধবধবে ফর্সা গায়ের রং। শুদ্ধ বাংলা বলার চেষ্টা করে চিবিয়ে চিবিয়ে; প্রথমদিকে কথা বলার সময় কেমন একটা চিল ফিলিং হতো ইরার ভেতর। কিন্তু একসঙ্গে দীর্ঘদিন রিকশায় যেতে যেতে ওর প্রতি সেই মোহটা কীভাবে যেন কেটে গেল। রইল না কিছুই।

একদিন শিশিরের ভীষণ পেট খারাপ। রিকশায় পাশে বসে বিশ্রী গন্ধযুক্ত পাদ মারছে সমানে। অন্যবার মুখের সামনে মুখ এগিয়ে কথা বলতে এসে চুনা ঢেঁকুর একটা বের হয়ে এলো ওর মুখগহ্বর থেকে। কী যে কটু দুর্গন্ধ সেই নিশ্বাসে – ভাবলে এখনো বমি চলে আসে। তাছাড়া যখন-তখন নাকঝাড়া, যেখানে-সেখানে দলা-দলা কফ-থুথু ফেলা, সারাক্ষণ নাক খুঁটে চলা এবং সেসব সর্দি মেশানো ময়লা কাপড়-জামা-আসবাবে সংগোপনে মুছে ফেলার অত্যন্ত  কদর্য অভ্যাস সব ওর।

আচরণের দিক থেকেও ওকে শেষ পর্যন্ত ইরার ভালো লাগেনি। পাঁচ টাকা নিয়ে রিকশাওলার সঙ্গে অযথা ঝগড়া বাধানো, সন্দেহবাতিক, চুকলিবাজি – ইরাকে ছ-মাসেই অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সে শিশিরকে বুঝতে দেয়নি। এখন রিকশায় অফিসে যায়-আসে বটে। তা একান্তই অর্থনৈতিক কারণে। ভাগাভাগি হলে বেশকটি টাকা বেঁচে যায়, সেজন্যে। সম্পর্ক কবেই ফসিল হয়ে পড়েছে!

একসময় শিশিরও মুগ্ধ প্রেমিক ছিল ইরার। মুগ্ধতাই ওকে কাঁঠালবাগান থেকে তেড়ে নিয়ে এসেছে রামপুরায়। কাঁঠালবাগানের ওর মেস থেকে মাত্র দশ মিনিটের রাস্তা ওদের মিডিয়া-হাউজ। দুপুরে এসে গরম গরম খেয়ে যেত বুয়ার হাতে। সুযোগ বুঝে একটুখানি বিশ্রাম। সেই আরাম তুচ্ছ করে মুগ্ধতার কারণে সে ছুটে এলো ইরাদের ফ্ল্যাটের কাছে। এখন চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করে বড়। যাতায়াতের খরচটুকু খুব বাজে বুকে। আগে ইরাকে মনে হতো ভদ্র, সভ্য, অমায়িক, উদার, শিক্ষিত – আরো কত কী। এখন একসঙ্গে রিকশায় যেতে যেতে সব উলটে গেছে। ইরা একটা ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙর ব্যাং। সারাবছর ওর সর্দি লেগে থাকে। রিকশায় উঠেই সবার আগে ‘আমার গলাটা খুসখুস করছে। অফিসে গিয়েই গরমজলে গার্গল করতে হবে’ বলবে। রিকশাওয়ালা জোরে প্যাডেল মারতে চাইলেই খেইখেই করে বলবে, ‘আরে ভাই, আস্তে চালাও। ঠান্ডা বাতাসটা গায়ে লাগছে তো?’ শিশিরের মুখের ওপর কত যে হাঁচি-কাশি দিয়েছে এই ইরা তা বলে শেষ করা যাবে না। তাছাড়া রয়েছে ওর হরমোনের সমস্যা। প্রতিদিন একটা করে থাইরল খেতে হয় নিয়ম করে। ইউরিক এসিডের কারণে প্রায়ই রিকশায় উঠতে হয় খুব কষ্টে। একইভাবে মেজাজ-মর্জিও বিশ্রী রকমের কড়া। শিশির যদি বলে চম্পাকলা তো সে অবশ্যই বলবে কাঁচকলা। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া সে বাধিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। অফিসে এসে সহকর্মীদের কাছে একই কথা বারবার করে বলে বেড়াবে আর ব্যঙ্গের হাসি হাসবে, ‘এই শুনছ, শিশির নাকি চাপাকলা খায়? হি-হি-হি। চাপাকলা খাওয়ার জিনিস অইলো? এইটুকুন এইটুকুন কলা। কে খায় বল? শিশির খায়। ওদের বাড়ির পিছনে চাপাকলার ঝোপ। তাও ল্যাট্রিনের পাশে। হি-হি-হি। ল্যাট্রিনের পাশের কলা কেউ খায়? ছিঃ! ’ সারাদিন এই নিয়ে মজে থাকবে। বিরামহীন একই কথায় ঘনঘন মুখর হবে সে। ফেরানোর কোনো উপায় জানা নেই ওর।

শিশির মনে মনে ইরার কাছ থেকে কেটে পড়েছে বহু আগে। এখন শুধু কংকালের মতো রিকশাটাই পড়ে রয়েছে। ওরা দুজন যায়-আসে। কথা হয়। জরুরি প্রয়োজনে দুজন দুজনার দিকে এগিয়ে আসে। ইরার অসুস্থ ফুপি এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। ওর বাবা চট্টগ্রামে একটা বায়িং হাউজের কর্তা। ইরার অফিস। ওর মা অতশত বোঝেন না, জানেনও না। সুতরাং এগিয়ে আসতে হবে শিশিরকেই। ওকেই অফিস কামাই দিয়ে ইরার কোমরভাঙা ফুপিকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হবে ডাক্তার আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। মেরাদিয়ার দিকে গরুর খাঁটি  দুধ মেলে সস্তায়। ওর মায়ের এক বলকের গাভীর শুদ্ধ দুধ মুখে ঢালার ইচ্ছে হচ্ছে। ইরার ভাই নেই। ছুটির দিন। অনুরোধের তীর তো শিশিরের দিকেই ছুটে আসবে – সেটাই স্বাভাবিক!

আবার ইরাদের নিজেদের ফ্ল্যাটে, ওর বাবা চট্টগ্রাম থেকে মাসে-দুমাসে একবার করে ফেরার পর, ভালোমন্দ রান্না হবে। একটা উৎসবের মতো ব্যাপার। ওর মা বা ইরা সেই কদিন খুব ব্যস্ত। সেজেগুজে থাকে সারাক্ষণ। সে-সময় শিশিরের ডাক পড়ে খাওয়ার। ওর মা হাসি-হাসি মুখে ওকে বলবে, ‘লজ্জা পাও কেন? নিজের মনে করে খাও। আমি তো তোমার মায়ের মতোই!’ শুরুর দিকে শুনে শিশিরের মন ভিজে যেত আবেগে; অতি ব্যবহারে এখন সেই আবেগও মৃত। কেমন যেন গা-সওয়া, সকালের পান্তা বলে মনে হয়।

লৌকিকতা বলতে এটুকুই বেঁচে রয়েছে ইরা আর শিশিরের ভেতর। তাই সকালে একা একা রিকশায় চড়ে বসতেই ওর মনে পড়ে গেল শিশিরের কথা। মায়া হলো খুব। সঙ্গে সামান্য জ্বলুনি। পুরো ভাড়াটা আজ আর আধাআধি হচ্ছে না। সবটুকু ইরাকেই বহন করতে হচ্ছে। নিজেদের যতই থাক, চাকরি করা কষ্টের টাকা ওর। বড় বাজে ইরার বুকে। এ-সময় স্বাভাবিক কারণেই শিশিরের কথা মনে হলো। মনে মনে খানিকটা ভয়ও পেল। ওর সঙ্গে রিকশায় গেছে-এসেছে প্রতিদিন। যদি কোভিড ওরও ঘাড় মটকায়? ভাবতেই শিউরে উঠল ইরা। অফিস থেকে শিশিরের কথা বলে কদিন ছুটি নিয়ে নেবে সে। অবশ্যই পাবে এ-ছুটিটা। কারণ কোভিডকে ভয় পায় না এমন কেউ নেই এখন অফিসে। শুনলেই ছ-হাত দূর থেকে করোনা-ছুটি দিয়ে দেবে করুণ হাসি হাসতে হাসতে। চৌদ্দ দিন তো মিনিমাম। তাতে ওর যাতায়াত খরচটা যেমন বাঁচবে তেমনি ছুটিটাও উপভোগ করা যাবে। নইলে ছুটির কথা বললে বস ইসমত আরা যেভাবে খেঁকিয়ে ওঠেন! ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে।

ওর আম্মা বের হবার সময় পইপই করে বলে দিয়েছেন, ‘খবরদার ইরা, ওই পোলারে আর রিং দিবি না। কডা দিন যাক। গ্যারামের পোলা তো। সমস্যায় পড়লে বাসায় উপস্থিত হইতে পারে গাট্টি-বোঁচকা লইয়া। আগেই সাবধান অইয়া যা।’

‘আরে বাবা, ও তো অসুস্থ। ওর মেসেই তো ছেলেপিলেরা থাকতে দেবে না ওকে। বুঝতে পারো না?’

‘সেজন্যই তো ভয়। যদি তোর কাছে আশ্রয় চায়?’

‘তাইলে কী করতে বলো?’

‘সিমডা বদলাইয়া ফেলা। নইলে রিং করলে ধরবি না। ব্যস।’

‘আচ্ছা। মনে থাকবে। তুমি না ওরে নিজের পোলা কও। সামনে অত গদগদ ভাব?’

‘ওসব দেহাইতে অয়। তোর বাপ থাহে না কাছে। মাইয়া একটা। রাইত-বিরাইতে কত কামেকাজে হেরে ডাকন লাগে। একটু সম্পর্কের দুধে না চুবাইলে কি অয়, ক?’ মায়ের চেহারায় বিব্রত হাসির ছোঁয়া।

রিকশায় বসে শিশিরের কথা কেন যেন বারবার করে মনে পড়ছে। অন্য কিছু নয়। অনেকদিনের অভ্যেস। একসঙ্গে অফিসে যায়-আসে। নিজেদের বায়োমেট্রিক অ্যাটেন্ডডেন্স কার্ড মেশিনে পরপর ঢুকিয়ে অফিসে প্রবেশ করে ওরা। শিশিরকে না দেখলে সবার আগে অন্যান্য সহকর্মী তো ওকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবে, হয়তো সেজন্যে।

‘কী খবর শিশির?’ ফোন দেয় ইরা।

‘আমি গ্রামের বাড়ি চলে এসেছি।’ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় উত্তর দেয় শিশির।

সঙ্গে সঙ্গে চুলে লেগে থাকা আঠালো চুইংগামটা যেন আপনা থেকে খুলে নিচে পড়ে গেল। যাক, অযাচিতভাবে ঘাড়ে পড়ার কোনো চান্স নেই। বাসায় ফিরে আম্মাকে আশ্বস্ত করা যাবে – ইরা ভাবল।

মুখে বলল, ‘একটাবার আমারে রিং দিলি না যে?’ অভিমানের রসালো পাস্তা মুখে নিয়ে পালটা প্রশ্ন করল ইরা।

‘তোর ফোনটা তো বন্ধ ছিল রাতে।’

‘ওহ! সরি। বল কী অবস্থা?’

‘আগে সুস্থ হয়ে নিই। তারপর।’

‘রিং দিস প্লিজ!’

‘ফোনটা খোলা রাখিস কাইন্ডলি।’

ওদের কথা শেষ। একটা ফুরফুরে আমেজ নিয়ে অফিসে পা দেয় ইরা। অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই এইচআরডি জানায় এরই মধ্যে শিশির ই-মেইল মারফত ওর কোভিড ডিটেকশনের সংবাদটি জানিয়ে দিয়েছে অফিসকে। এ-ব্যাপারে ইরার কোনো ভূমিকা নেই। ওর আসার ঘণ্টাখানেক আগেই সবার কৌতূহল মিটে গেছে; অফিসের বেশকটি আলাপচারিতা-আড্ডায় ঘুরে-ঘুরে এখন প্রায় নিঃস্ব। আপাতত একটাই সংবাদ – সুপ্রিম বস ইসমত আরা ম্যাডাম ইরাকে ডাকছেন তার রুমে।

সবার চোখ বড় বড়। এমনিতেই কোভিড পরিস্থিতির কারণে অনেক বাঁধা ব্যবসা অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে এ-প্রতিষ্ঠানের। এরই ভেতর একপ্রস্থ কর্মী-ছাঁটাই হয়ে গেছে। আরো একটি তালিকা খাতায়-কলমে আটকে রয়েছে। হয়তো যে-কোনো দিন নোটিশবোর্ডে টানানো হবে সেটি। থমথমে পরিস্থিতি অফিসে। কার গরদিশ কার ঘাড়ে এসে পড়ে – এই নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত; আগের মতো হাস্যকৌতুকে মেতে থাকার কোনো সুযোগ নেই আর। জীবনের চাইতেও ক্রমে জীবিকা হয়ে উঠছে মহামূল্যবান।

বসের রুমে পা দিতেই ইরা দেখতে পেল চরম আধিপত্যবাদী বস ইসমত আরা চোখের সামনে মিনি আয়না ধরে সমানে লিপস্টিক ঘষছেন ঠোঁটে। সেজন্যে নিরন্তর ঠোঁট-দাঁতের কসরত করে চলেছেন। মধ্যবয়স্ক চেহারায় এই কসরত মোটেই মানাচ্ছে না। কেমন রাক্ষুসী ঠেকছে ওর চোখে।

‘ম্যাডাম ডেকেছেন?’ খুব মোলায়েম করে বলল ইরা।

‘তুমি অফিসে কেন? শিশির যেখানে ইনফেকটেড সেখানে তুমি অফিসে পা দাও কী করে? তোমার অফিস করতে হবে না। এক্ষুনি বাসায় চলে যাও। কোয়ারেন্টাইনে থাকো। পরে নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে অফিসে আসবে।’ বলে তিনি নিজের মাস্কটা টেবিলে খুঁজতে থাকেন। মহিলা হয়তো ভাবছেন ওর দিকে তাকিয়ে আরেকটু বেশি কথা বললে তিনিও ইনফেকটেড হয়ে পড়তে পারেন। সেই শংকায় তিনি এলোপাতাড়ি নিজের মাস্কটা খুঁজে চলেছেন। কে জানে মারণ-ভাইরাসটার বহনকারী ইরাই কি না?

ইরার পরনে জিন্স ও ফতুয়া। মুখে সব হারানোর কাতরতা ভ্যানিশিং ক্রিমের মতো লেগে থাকলেও মনে মনে ম্যালা খুশি সে। কারণ সে যা চেয়েছিল পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে। শিশিরের বদৌলতে কদিন বিশ্রাম নেওয়া যাবে। পরেরটা পরে।

ইরার ভ্যাবাচ্যাকা ভাব লক্ষ করে ফের চেঁচিয়ে উঠলেন মাস্কপরা সদা সতর্ক ইসমত আরা, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন? কথা বুঝতে পারছ?’ সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিক শক খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।

বাসায় ফেরার পর বেশ একটা চনমনে ভাব ইরার। এটা করছে, ওটা ধরছে। মাথার ভেতর হাজারটা প্ল্যান। কোন গান শুনবে, কোন ছবি দেখবে, কোন বই পড়বে, কী কী খাবে – এসব। কিন্তু সপ্তাহখানেক কাটতেই বিরক্ত হতে শুরু করে সে। ঘরের ভেতর নিজেকে যেন ছোট বালতির ভেতর আম্মার জিয়ল শিং মাছ রাখার মতো অবস্থা বলে মনে হচ্ছে। কদিন আগেও ঘুমাতে চাইত যখন-তখন। ঘুম জিনিসটার প্রতি দুর্দমনীয় আকর্ষণ ছিল ওর। চাকরির কারণে সুখের ঘুমে চিড় ধরেছে বলে কত আক্ষেপ ওর। অথচ এখন সেই সুযোগ একেবারে হাতের মুঠোয়; তবু ঘুমাতে ইচ্ছা করে না একদম!

বাধ্য হয়ে শিশিরকে ফোন দেয়, ‘হ্যালো? কী করিস? ফিরবি কবে ঢাকায়?’

‘আমি ? কেন, তুই জানিস না? ’

‘না তো ? কেন, কী হইছে?’ উৎকণ্ঠার ভান ইরার ভেতর।

‘আমি তো অফিসে রেজিগনেশন লেটার সাবমিট করে দিয়েছি। কুরিয়ার-ডাক কিছু তো নেই। তাই ছোটভাইকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। অ্যাকসেপ্টও হয়ে গেছে। তুই-ই জানিস না?’

এবার আমতা আমতা করে ইরা উত্তর দেয়, ‘আমি কদিন রেস্টে আছি। অফিসে যাওয়া হয়নি।’

‘আমার কারণে? হা-হা-হা। তোর কোভিড হবে না। আমিও ঢাকায় আর ফিরছি না।’

‘তাহলে কী করবে?’

‘বাড়িতে প্রচুর জায়গা খালি পড়ে আছে। সেখানে অর্গানিক সবজি ফলাবো আর একটা পিকআপ ভ্যানে করে ঢাকার হাঁ-করা বাজারে পাঠিয়ে দেব। চাকরি-বাকরির চেয়ে অনেক ভালো থাকব, দেখিস।’

‘শুরু করেছিস কাজ? নাকি ঢাকায় এসে ফের চাকরি খুঁজতে হবে? ’ শ্লেষ মিশে থাকে ইরার কথায়।

‘আমরা দুই ভাই লেগে পড়েছি। হয়ে যাবে।’ শিশিরের কণ্ঠে বিন্দাস আবেগ।

‘ওহ্।’ বলে চুপ মেরে গেল ইরা।

এর ঠিক মাস-দুমাস পর ফের জেবুন্নিছা ইরা ফোন দিলো আমিনুল হক শিশিরকে। কথাই বলতে পারছে না হাসির চোটে। খিলখিল করে কেবল হাসতে থাকে ফোনে।

শিশির হতবাক। এরকম স্বতঃস্ফূর্ত হাসির গমক তো ওদের মেশামেশির প্রথমদিকে ছিল। যে-কোনো কথায় কেবল হাসতে চাইত ইরা। হাসির জন্যে অর্ধেক কথা পেটেই জমা পড়ে থাকত। সেজন্যে রিকশায় বসে কতরকম মশকরা। প্রথমেই শিশিরের প্রশ্ন, ‘হাসির জন্য পেট ফাঁপে নাই তো?’ অমনি শুরু হলো ওর হাসি। কী যে মিষ্টি দেখাত তখন। সেই হাসি হাসছে ইরা এখন। এতদিন পর? বিস্মিত শিশির। পুরনো ফাগুন কি ফিরে আসে বারবার?

সে না জিজ্ঞাসা করে পারে না, ‘কী হইছে? এত হাসছিস যে?’

‘তোর পজিশনে নতুন একটা ছেলে এসেছে।’

‘তো?’

‘থাকার জায়গা নেই তো। তাই তোর মেসে উঠেছে। আমিই বলেছি। এখন অফিসে একই রিকশায় যাচ্ছি-আসছি।হি-হি-হি। তুই কী করিস?’

‘পিকআপ ভ্যানটার ডেলিভারি হবে কাল। শসার মাচায় লতায়-লতায় ফুল ধরেছে। বেগুন ক্ষেতে বেগুনি ফুল। সবুজ পাতার মাঝখানে সাদা মরিচফুল। প্রচুর মৌমাছির গুনগুন আশেপাশে। খুব তাড়াতাড়ি ফসল ফলবে, দেখিস। স্থানীয়  কৃষি কর্মকর্তা আছে আমাদের সঙ্গে। কোনো অসুবিধা নেই।’ শিশুদের মতো আনন্দে উত্তেজিত, মাতোয়ারা সে, এক নিশ্বাসে বলে দিলো সব।

অমনি ইরা চুপ। কোনো কথা নেই মুখে। হাসিটাও সহসা থমকে গেল। রোমেলের কথা মনে পড়ল এ-সময়। সুখের জন্যে সে-ও অনেক দূরে, নাগালের বাইরে!

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর গম্ভীর গলায় ইরা প্রশ্ন করল, ‘আর তোর কোভিড? সেরে গেছে ? প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নেই?’

‘ওটা কিছু না রে। প্রকৃতির অসুখ তো, প্রকৃতিই সারিয়ে দিয়েছে। এখানকার বাতাসে গরল নেই, আপনা থেকেই সেরে উঠেছি। সেজন্যেই তো ফিরে এলাম তোদের শহর ছেড়ে? মাস্ক-শিল্ড সব ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। এখন দুই ভাই মিলে নিড়ানি দিচ্ছি জমিতে। রোদে-ঘামে একাকার। পরে কথা বলবে রে। ভালো থাকিস। সবজি হলে পাঠাব একঝুড়ি।’

সবজির কথা বলতেই ইরার জিহ্বা নিমেষে বিস্বাদে ভরে যায়। মন খারাপ করা নিস্পৃহ গলায় সে উত্তর দেয়, ‘পাঠাস। তবে আমার সবজি ভালো লাগে না খেতে। তুই তো জানিস। তবু পাঠাস। আম্মা মাঝে মাঝে খেতে চায়। ডাক্তার বলে দিয়েছে।’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ইরার বুক ফুঁড়ে। শিশিরের চোখে নির্মল হাসির ছটা।