কাইয়ুম চৌধুরী : মানুষ ও শিল্পী

আনিসুজ্জামান

জীবনের শেষ বক্তৃতায় কাইয়ুম চৌধুরী আন্তরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন জয়নুল আবেদিনকে। বলেছিলেন, বাংলাদেশের চিত্রকলা আজ যে-প্রাণচঞ্চল রূপ ধারণ করেছে, তা সম্ভবপর হয়েছে জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বের ফলেই। ঢাকায় আর্ট ইনসটিটিউট স্থাপন করে, শিল্পীদের সংগঠিত করে, এদেশে শিল্প-আন্দোলনের সূচনা করে তিনি যে-ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা-ই কার্যকর হয়েছে আমাদের শিল্পকলার আজকের সমৃদ্ধিতে। ঠিক এই ভাষায় তিনি কথাগুলো বলেননি, কিন্তু তার মর্ম ছিল এমনই।

কাইয়ুম এসব কথা বলেছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশন-আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ রজনীতে। সেখানে জয়নুল আবেদিনের প্রসঙ্গ ওঠার কথা ছিল না। চিত্রকলার সংগঠনে জয়নুলের সক্রিয়তার সঙ্গে তিনি তুলনা করেছিলেন উচ্চাঙ্গসংগীতের ক্ষেত্রে আমাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব বা ঔদাসীন্যের এবং সাম্প্রতিককালে আবুল খায়েরের সংগঠিত প্রয়াসের। কাইয়ুম কথা বলছিলেন জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে। গুরুর প্রতি শিষ্যের কালোচিত শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবেও তা গণ্য হতে পারে।

কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন আর্ট ইনসটিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। স্বভাবতই জয়নুলের প্রতি তিনি ঋণী। গুরুর কাছ থেকে তিনি শিল্পের যে-পাঠ নিয়েছিলেন, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল লোকজীবন ও লোকশিল্পের প্রতি গুরুর ভালোবাসা। বাংলাদেশের লোকজীবন ও লোকশিল্প থেকে উপাদান গ্রহণ করেছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী – বাস্তবের হুবহু অনুকরণ করে নয়, তাকে স্টাইলাইজ বা রীতিবদ্ধ করে। কাইয়ুমের ছবিতে আমরা যেসব নরনারী বা প্রাণী দেখি, যেসব বাড়িঘর বা যানবাহন দেখি, প্রকৃতির যে-রূপ দেখি, তা বেশির ভাগ এসেছে আমাদের গ্রামজীবন থেকে। একজন আধুনিক চিত্রশিল্পীরূপে লোকশিল্পের পুনর্নির্মাণ তিনি করেননি, প্রেরণা নিয়েছেন সেখান থেকে, আভাসে-ইঙ্গিতে তার প্রাণবস্ত্তটি তিনি নিয়ে এসেছেন আমাদের সামনে। তাঁর কৃষক, ডুরেশাড়ি-পরা রমণী, মাথায় গামছা-বাঁধা মুক্তিযোদ্ধা, নৌকা, পালকি, পশু, পাখি – দেখলেই বোঝা যায়, এরা যেমন একান্তভাবে কাইয়ুমের, তেমনি একান্তভাবে গ্রামবাংলার। বস্ত্ততে তারা গ্রামজীবনের, ভঙ্গিতে কাইয়ুম চৌধুরীর। লোকশিল্পের লাল, নীল, হলুদের অজস্রতা আছে কাইয়ুমের ছবিতে। আবার আধুনিক শিল্পীর সম্পূরক রঙের সমারোহ রয়েছে সেখানে – লালের পাশে সবুজ, নীলের সঙ্গে কমলা, হলুদের সঙ্গে লালচে – রক্তবর্ণ, তবে লাল নয়, ইংরেজিতে যাকে বলে পার্পল। এইসব রঙিন ছবির – কিংবা সাদা-কালোরও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে জ্যামিতিক নকশা – কাইয়ুমের অন্তর-গত আধুনিকতার বিশিষ্ট প্রকাশ। অবিচ্ছেদ্য বলাটা হয়তো ঠিক হলো না –  কেননা সব ছবিতে তা নেই, অধিকাংশ ছবিতে আছে। অনেক ছবিতে আবার কোনো বস্ত্তই ধারণ করেছে নকশার রূপ – কলাগাছ বা তার দু-একটা পাতা, একটা পাখি কিংবা নদীপারের কোনো কিছু। তবে সব ছবিতেই যা চোখে পড়ে, তা কাইয়ুমের শক্তিশালী ড্রইং – জয়নুলের ড্রইংয়ের সামর্থ্যকে যা মনে করিয়ে দেয়।

অজস্র ছবি এঁকেছেন কাইয়ুম চৌধুরী – নানা মাধ্যমে : সাদা-কালো, জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিক। সব মাধ্যমেই তাঁর নিজস্বতা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ছবিতে শিল্পীর স্বাক্ষর না থাকলেও তা চেনা যায় কাইয়ুমের কাজ বলে, ছবির সর্বাঙ্গেই তাঁর হাতের অনপনেয় ছাপ।

কাইয়ুম চৌধুরী কোনো নির্লিপ্ত শিল্পী ছিলেন না। যৌবনকাল থেকেই তিনি ছিলেন সমাজসচেতন। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে পোস্টার এঁকেছেন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের রেখাচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের অজস্র ছবি। গণ-অভ্যুত্থানের একটি  সাদা-কালো ছবি আমার কাছে অবিস্মরণীয় : বাঁশের লাঠি বা এমনি উপকরণ নিয়ে মানুষের মিছিল, থমকে আছে, তার সামনে কিছুটা সাদা জমিন, তার প্রান্তে সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী – সবটা দেখা যায় না, অনেকটা আভাসে প্রতীয়মান। সংঘাত নেই, তবু এটা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ছবি – দর্শকও অনুভব করে টানটান উত্তেজনা, উপলব্ধি করে এখনই গুলি চলবে, জনতার কয়েকজনের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়বে মাটিতে, ওই সাদা জমি লাল হয়ে যাবে। কাইয়ুমের মুক্তিযোদ্ধা এদেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি, তাকে মনে হয় কৃষকসন্তানই, তার অবয়বই বুঝিয়ে দেয়, এদেশে একদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল যার নায়ক ছিল অনন্য জনতা।

কাইয়ুম রাজনীতি করেননি। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়পর সমাজের স্বপ্ন দেখতেন আজীবন এবং তার বাস্তবায়নের নানা প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। জীবনের শেষার্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান।

শিল্পীজীবনের শুরুতে প্রচ্ছদ-অঙ্কনে ও অলংকরণে ঝুঁকেছিলেন তিনি। বড়ো চিত্রশিল্পী হয়ে যাওয়ার পরেও এই কাজ থেকে বিরত হননি। কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা প্রচ্ছদপটের অত্যন্ত সমাদর ছিল লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে। তার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে তাঁদের প্রায় ধৈর্য হারানোর অবস্থা হতো। আমরা কেউ অনেক সময়ে তাঁকে হুমকি দিয়েছি, আর দেরি করলে অন্যকে দিয়ে প্রচ্ছদ আঁকিয়ে শিল্পী হিসেবে তাঁর নাম ছেপে দেবো। বইয়ের বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রচ্ছদ-অঙ্কনের অপূর্ব ক্ষমতা তাঁর ছিল। বর্ণের বিন্যাস ছিল মোহনীয়। বর্ণ বলতে রং ও হরফ দুই-ই বোঝানো যায়। বাংলা লিপির শৈল্পিক রূপায়ণে কাইয়ুমের জুড়ি পাওয়া ভার। তাঁর তয়ের শুঁড়টা বাঁদিকে অনেকদূর প্রসারিত হতো; হ্রস্ব-ইকারের মাথাটা বর্ণের মাথায় ছাতার মতো সবটা বেষ্টন করে ঝুঁকে পড়তো ডানদিকে; হ বা ই লুডুখেলার সাপের মতো বক্রাকৃতি নিয়ে পাশের হরফগুলোর চেয়ে নিচে নেমে আসতো। এসব শুধু দৃষ্টিনন্দন ছিল না, স্বতন্ত্র এক নান্দনিকতা নিয়ে উদ্ভাসিত হতো। বাংলাদেশ সরকার একবার বৈদ্যুতিক বাংলা টাইপরাইটারের কথা ভেবেছিলেন। তার কি-বোর্ডে বর্ণের বিন্যাস স্থির করে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলা একাডেমিকে। সে-সময়ে আমার অনুরোধে কাইয়ুম বাংলা বর্ণমালার তিন সেট নকশা তৈরি করে দিয়েছিলেন, সবগুলিই ছিল নান্দনিকতাপূর্ণ। তিনি যে প্রচ্ছদের জন্যে একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন, সে তো এমনিতে নয়। আমার মুনীর চৌধুরী বইটির প্রচ্ছদের জন্যে কাইয়ুম পুরস্কৃত হয়েছিলেন। মুনীর চৌধুরী নতুন করে বাংলা টাইপরাইটারের কি-বোর্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই অনুযায়ী টাইপরাইটার তৈরি হয়েছিল পূর্ব জার্মানিতে। মুনীর চৌধুরী শহিদ হওয়ার পরে সে-টাইপরাইটারের নাম দেওয়া হয় মুনীর অপটিমা। মুনীর অপটিমার বর্ণগুলো একটু ছোটোবড়ো আকারে সারা পৃষ্ঠাজুড়ে বসিয়ে তার ওপরে বইয়ের ও লেখকের নাম হাতে লিখে দিয়েছিলেন কাইয়ুম। উদ্ভাবন-নৈপুণ্য ও দৃষ্টিগ্রাহ্য সৌকর্যের জন্যে সেটা অসাধারণ হয়েছিল।

অলংকরণেও কাইয়ুমের বিশিষ্টতা প্রকাশক্ষমতায় ও সংযমে। ঊনোক্তি-অত্যুক্তি তাঁর স্বভাব নয়। অত্যুক্তির আভাস ছিল তাঁর এক সময়ের আঁকা কার্টুনে, তবে কার্টুন তিনি বেশিদিন আঁকেননি। যাওবা এঁকেছেন, তা সচিত্র সন্ধানীর জন্যে। এটি যখন অনিয়মিত প্রকাশনা ছিল, তখন তো বটেই, নিয়মিত সাপ্তাহিক হয়ে যাওয়ার পরে একে ঘিরে ছিল কাইয়ুমের নানাধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরে কাইয়ুমের এ-ধরনের সেবা পেয়েছিল প্রথম আলো, আরো পরে কালি ও কলম এবং শিল্প ও শিল্পী। এসব ক্ষেত্রে পেশাগত দায়িত্বপালনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ভালোবাসা। তাই তাঁর কাজ কখনো দায়সারা হয়নি, তার সঙ্গে সবচেয়ে যোগ ছিল তাঁর মনের।

কাইয়ুমের মনকে কেবল চিত্রশিল্প দখল করেনি। সাহিত্য, সংগীত ও চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল প্রবল। তাঁর গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়। সব ধরনের বাংলা গান এবং ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত ছিল তাঁর প্রিয়। এসব সংগীতের শিল্পীদের সম্পর্কেও তাঁর জানাশোনা ছিল প্রচুর। বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি চলচ্চিত্রের তিনি শুধু নিবিষ্টচিত্ত দর্শক ছিলেন না, সমালোচকের দৃষ্টি দিয়ে তিনি ছায়াছবি দেখতেন, ঐতিহাসিকের কৌতূহল নিয়ে তার এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করতেন। পঞ্চাশের দশকেই চলচ্চিত্র-বিষয়ে একটি সংকলনের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি, একটা বড়ো খাতায় তার জন্যে কিছু স্কেচও করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাটা বাস্তবায়িত হয়নি।

কাইয়ুম ছিলেন অসাধারণ বন্ধুবৎসল মানুষ। অন্তরঙ্গদের কাছে অনায়াসে তিনি মনের অর্গল খুলে দিতেন। বন্ধুত্বের মূল্য তাঁর কাছে ছিল অপরিসীম। যার মধ্যে কিছুমাত্র গুণ দেখতেন, তারই প্রশংসা করতেন, তার শ্রীবৃদ্ধি কামনা করতেন। বন্ধুদের সান্নিধ্যে নানাকথায় আসর জমিয়ে রাখতেন। আর্ট ক্যাম্পগুলোয় তিনি থাকতেন সবকিছুর কেন্দ্রে। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ছিলেন। সেই মানুষটি এভাবে চলে যেতে পারেন, তা কখনো ভাবতে পারিনি। অনেকেই বলেছেন, তিনি কাউকে কষ্ট দেননি, নিজেও কষ্ট পাননি – এমনি করে যাওয়াই সবচেয়ে ভাল। কিন্তু তাঁর কাছের যাঁরা রয়ে গেলেন, তাঁদের কষ্ট আসলে লাঘব হওয়ার নয়।