অনুবাদ : সারোয়ার জামীল
মুখবন্ধ : অনূদিত ‘কাফির’ গল্পটি বিখ্যাত সাহিত্যিক ইসমত চুঘতাইয়ের লেখা বাচপান (‘ছেলেবেলা’) নামক উর্দু ছোটগল্প সংগ্রহের প্রথম গল্প। ব্রিটিশ ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি ছোট শহরের এক হিন্দু ব্রাহ্মণের ছেলে ও এক মুসলমান মেয়ের প্রেমের ওপর ভিত্তি করে এই গল্প রচিত।
কাফির
‘এই পুস্কার, তোর মহাদেবজীকে দেখতে একটা দৈত্যের মতো লাগছে। রাতে একে কেউ দেখলে তার গায়ে জ্বর উঠবে’, খুব ঘৃণার স্বরে আমি কথাগুলো পুস্কারকে বললাম।
‘আর তোর ভূতের মতো দেখতে মাস্তানশাহজী পীর যে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার তোদের বাড়িতে দোয়া করতে আসে তাকে দেখতে তো একটা ডাকাতের মতো লাগে। তাকে দেখলেই আমার গালি দিতে ইচ্ছা করে’, বলল পুস্কার।
আমি একজন মৌলভি সাহেবের মতো তাকে বললাম, ‘তুই একটা কাফির। তুই দোজখে যাবি। ওখানকার ফেরেশতারা গরম লোহার শিক দিয়ে গুঁতিয়ে তোর শরীর ঝাঁজরা করে দেবে আর আগুনের চাবুক দিয়ে তোকে পেটাবে। রক্ত আর পুঁজ হবে তোর খাবার।’
‘এই অসভ্য মেয়ে, তোর কথা শুনে আমার বমি আসছে। তোর ফেরেশতাদের আমি পিটিয়ে তুলাধুনা করবো। আর আমি যদি কাফির হই তুই কাফিরনি। তুই সেদিন বাবুজিকে বলছিলি, তুই আমাকে বিয়ে করবি। তাহলে দোজখে আমার সঙ্গে তোরও পেটাই হবে।’
‘এই! আমি হলাম মুসলিম আর তুই হিন্দু। আরে মশাই, শুনুন, সব মুসলমানেরা বেহেশতে যাবে। আমরাও তরতর করে ওখানে চলে যাবো। তুই দেখে নিস, তুই পেছনে পড়ে থাকবি।’
‘পেছনে পড়ে থাকব? তুই দেখিস, আরে আমি তোর চেয়েও ভালো স্বর্গে যাবো। তুই মুসলমানতি, তুই নরকে যাবি এবং সেখানে আগুনে জ্বলবি।’
‘এই শুয়োরের বাচ্চা, তোর কী সাহস যে তুই আমাকে মুসলমানতি বললি? তুই … তুই একটা মেথর।’
‘তাহলে তুই একটা মেথরনি এবং কাফিরনি’, পুস্কার জোর গলায় বলল।
আমি তাকে কষে একটা চড় দিলাম। কিন্তু সেও দমবার পাত্র নয়। বদলে সে আমাকে দুটো চড় মারলো। আমি তার হাতের কব্জিতে নখ দিয়ে এমন চাপ দিলাম যে মাংস কেটে রক্ত বেরিয়ে গেল। আমাদের হইচই শুনে ওর মা ঘর থেকে দৌড়ে এসে আমাদের ঝগড়া বন্ধ করলেন।
‘এই ছেলে, তোর বাবুজি আসুক, তোকে এমন পিটুনি দেবে না!’ পুস্কারের দিকে হাত তুলে ওর মা বললো। পুস্কার ছাদ-বারান্দায় বসে মুখ ভেংচি দিচ্ছিল।
আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘চাচি, এই জানোয়ারটাকে আমি বিয়ে করতে পারব না।’
‘তোর মতো কালো পেত্নিকে কে বিয়ে করে? ও আমাকে রক্ত আর পুঁজ খেতে বলে’ – এটা বলে সে এমন চেহারা বানালো যেন এখনই বমি করবে।
‘হায় রাম! তুই একটা ম্লেচ্ছ হয়ে গেছিস, চুপ কর’, ওর মা বললো।
‘আমি সত্যি বলছি, মা। ও বলে সব হিন্দু নরকে যাবে আর মুসলমানেরা স্বর্গে যাবে।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে জোর গলায় বললাম, ‘না, চাচি নরকে যাবে না, বাবুজি আর ভাইয়াও যাবে না। শুধু এই পেঁচাটা যাবে নরকে।’
‘আমাকে যদি নরকে যেতে হয় আমি চ্যাঙদোলা করে তোকেও সেখানে টেনে নিয়ে যাব’, পুস্কার বললো।
‘তোর তো সাহস কম নয়! আমি তোকে এমন হিংস্রভাবে কামড়াবো যে তুই বাঁচবি না।’
এটা শুনে চাচি হাসতে হাসতে খুন। বললেন, ‘তোদের এই ঝগড়া কি নরকে গিয়েও চলবে? মুন্নী, তুই যদি ওকে খুন করিস তাহলে সে নরকে যাবে না।’
‘আপনি দেখে নেবেন চাচি সে তারপরেও নরকে যাবে। ওর যা ছোট মন।’
পুস্কার বললো, ‘দেখো মা, মুন্নী যদি এভাবে কথা বলে আমি ওর গায়ে পাথর ছুড়ে মারব।’
এই সময় বাবুজি বাড়িতে ঢুকে বললেন, ‘কী হচ্ছে সব?’
চাচি হাসতে হাসতে বললেন, ‘হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা।’
বাবার গলার শব্দ শুনেই ভীতু পুস্কার দৌড়ে পালালো। চাচি চুপচাপ আমাকে ঘরের ভেতর নিয়ে কিছু মজাদার চানাচুর খেতে দিলেন। চাচি মুসলমানের মতো, শুধু পুস্কারই কাফির।
দীপাবলি এসে গেল। পুস্কারদের পুরো বাড়িতে প্রদীপ জ্বালানো হলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে ফেললাম। আমরা দুজনে সারাদিন প্রদীপের সলতে বানালাম আর খেলনার আকারের মিষ্টি খেলাম। চাচি ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই মুন্নী, তুই সলতের সুতোতে জট পাকিয়ে সুতো নষ্ট করে ফেলছিস।’ আমি তাঁর কথায় কান দিলাম না। সন্ধ্যায় পুস্কার অনুষ্ঠানের জন্য সেজেগুজে বের হলো, সাদা ফাঁপানো ধুতি ও লাল রঙের পাঞ্জাবি পরে। খুব পরিপাটি করে সিঁথি কাটল আর কপালে দিলো একটা লাল সিঁদুরের টিপ। চাচি লাল রঙের বেনারসি শাড়ি পরে দু-হাতে প্রদীপ নিয়ে যখন ঘুরছিলেন তখন পায়ের নূপুরগুলো টুং-টাং আওয়াজ করছিল। পুস্কার ঘরের প্রতিটি জিনিসের ওপর নজর রাখছিল। সেদিন সে একজন গোঁড়া হিন্দু হয়ে গেল এবং আমার স্পর্শ এড়াতে লাগল। এটা কী সেই পুস্কার যে কতবার আমার আধা খাওয়া আম চেটে চেটে খেতো! আজ সে বহুদূর থেকে হাত বাড়িয়ে আমাকে একটা কচুরি দিচ্ছে। রাগে আমার সমস্ত শরীর রিরি করছে।
‘পুস্কার, আমার কপালে চন্দনের টিপ এঁকে দে’ – পুরনো বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনার জন্য আমি তার কাছে মিনতি করলাম।
দম্ভের সঙ্গে মাথা নেড়ে সে বলল, ‘না, তুই হিন্দু না।’
‘না পুস্কার, এই মুহূর্তে আমি হিন্দু, আমার আম্মাকে বলিস না যেন।’
তার মনটা নরম হলো। সে আমার কপালে চন্দনের টিপ এঁকে দিলো।
কিন্তু আমি ঈদের দিন এর শোধ নিলাম। আমি তাকে আবার কাফির বললাম এবং ওর সঙ্গে ঝগড়া করলাম। কিন্তু যখন আমার হাতে ও পায়ে মেহেদি লাগাচ্ছিলাম তখন আকুলভাবে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সে এসেছিল কিন্তু আমি উষ্মার সঙ্গে আমার হাত দুটো হাঁটুতে রেখে স্থির হয়ে বসে ছিলাম।
‘বাহ, মুন্নী তোর হাত-দুটো কী সুন্দর লাল হয়ে গেছে। আমাকে একটু দেখতে দিবি?’ আমি ঝটকা মেরে হাত-দুটি সরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ভাগ এখান থেকে। ঈদ আমাদের, তোদের না। তুই কি রোজা রেখেছিস? মুসলমানেরা রোজা রাখে, সেজন্য ঈদ তাদের জন্য।’
‘তুই রোজা রাখিস?’ পুস্কার জিজ্ঞাসা করল।
‘হ্যাঁ, কয়েক ঘণ্টার জন্য রেখেছি তো।’
‘মিথ্যা বলবি না। সারাদিন তোর মুখ চলে। এটাই যদি রোজা রাখা হয় ওইরকম রোজা আমিও রাখতে পারি।’
‘এই, তুই একটা হিন্দু’, আমি জোর গলায় বললাম।
সে রেগে গিয়ে বলল, ‘তাতে কী
আসে-যায়?’
শরীরটা দুলিয়ে মুখ বেঁকিয়ে আমি বললাম, ‘কাল আমি নতুন জামাকাপড় পরবো।’
‘আমিও আমার নতুন ফতুয়া পরবো’, পুস্কার বলল।
‘এই, তুই হিন্দু। তুই কেন ঈদের দিনে নতুন জামাকাপড় পরবি? আমি তোকে সেমাই খেতেও বলবো না।’
‘তাহলে তুই দীপাবলির দিন অতোগুলো মিষ্টি খেলি কেন? আমি তোর কপালে চন্দনের টিপ পরিয়ে দিলাম। তুই বাবুজির কাছ থেকে কিছু খেলনাও খসিয়ে নিলি আর এখন তুই এসব বলছিস? তুই আস্ত একটা মিথ্যুক আর ছোটলোক।’
আমি তার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে ওকে তাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু নতুন কাপড় পরে ভাবলাম, এটা ওকে দেখাতেই হবে।
আমি জরির কাপড় পরে পুতুলের মতো সেজে যখন ওদের বাড়িতে ঢুকলাম তখন শুধু যে তার সমস্ত রাগ পড়ে গেল তা না উলটো সে আমার প্রশংসা শুরু করলো। কিন্তু আমি তাকে বারবার বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, সে হিন্দু এবং আমাদের ঈদে তার খুশি হওয়ার কোনো অধিকার নেই।
সে অগত্যা বললো, ‘ঠিক আছে আমি মুসলমান হয়ে যাবো, কিন্তু সেটা কাউকে বলবি না।’
কিন্তু সে একটা প্রতারক প্রমাণিত হলো। সে আবার কাফিরের রূপ নিল। আমার অনেক অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও সে আমাকে হোলিতে রং দিয়ে খেলতে দিলো না।
আমাকে বলল, ‘তুই মুসলমানতি।’
‘ঠিক আছে। ঈদ আসুক’, আমি মাথা ঝাঁকানি দিয়ে বললাম, ‘তোকে আমি এমন শিক্ষা দেবো না তোর সারাজীবন মনে থাকবে।’
পণ্ডিতজি তখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে, তুই হিন্দু হয়ে যা।’
‘বেশ, আমাকে তাহলে চকচকে সিঁদুর দাও।’
‘তুই আমাকে সেদিন বললি শরীরের যে-অঙ্গে রং লাগে সে-অংশ দোজখে জ্বলবে। তাহলে এখন সিঁদুর পরতে চাস কেন?’
কোনো প্রকার ভণিতা না করে আমি বললাম, ‘আমি এখন হিন্দু হয়ে গেছি।’
‘কী বিরাট একটা ভণ্ড তুই! যখন সুবিধা হয় তখন হিন্দু আবার পরে মুসলমান হয়ে যাস। আগে প্রতিজ্ঞা কর তুই আবার কখনো মুসলমান হবি না।’
‘ঠিক আছে’, আমি বললাম।
‘তাহলে তুই আমাকে বিয়ে করবি। করবি তো? বল।’ পুস্কার বলল।
আমি এই শর্তও মেনে নিলাম। অবশ্য ঈদের অনেক আগে মহররমের সময় আমি আবার মুসলিম ধর্মে ফিরে এলাম এবং ওকে এজিদ ডাকলাম। এমনিতে সে তো কাফির এবং তার জায়গা দোজখে।
পণ্ডিতেরা সচরাচর একটু সরলমনের হয়ে থাকে, বিশেষ করে কাশ্মিরি পণ্ডিতেরা তো দেবতার মতো। আমি পুস্কারকে মাঝে মাঝে মারতাম; কিন্তু সে কিছু মনে করতো না। সে এতোটাই ভীতু ছিল যে একবার একটা ছাগল জবাই করতে দেখে সে কান্না শুরু করলো। অনেক ক্ষোভের সঙ্গে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোদের পরিবার এতো ছাগল জবাই করে কেন?’
আমি বিজ্ঞের মতো উত্তর দিলাম, ‘আরে বোকা এটা সওয়াবের কাজ।’
‘সওয়াবের কাজ! ছাগল জবাই করা সওয়াবের কাজ?’
‘কেন নয়? মরার পর হাশরের দিন আমরা এই ছাগলের পিঠে চড়ে পুলসিরাত পার হবো। আমরা তরতর করে সেই সেতু পার হয়ে যাব; কিন্তু তুই পুস্কার পেছনে পড়ে থাকবি।’
‘আমি আমার সাইকেল দিয়ে পার হবো’, পুস্কার জোর গলায় উত্তর দিলো।
আমি রাগতস্বরে বললাম, ‘মশাই, পুলসিরাত চুলের চেয়েও সরু এবং ক্ষুরের মতো ধার।’
‘আমি তোর ছাগলের পিঠে চড়ে তরতর করে পার হয়ে যাব’, পুস্কার বললো।
‘আমি তোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবো।’
‘আমিও তোকে চেপে ধরবো।’
‘তোর সাহস তো কম নয়’, বলে আমি তাকে একটা থাপ্পড় মারলাম। কিন্তু আমি কিছু করার আগে সে আমার হাতের কব্জিটা চেপে ধরে আমাকে দুটো কিল দিয়ে দৌড়ে ভাগলো।
আমার ভাঙা কাচের চুড়িগুলো দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না এবং এমন উচ্চৈঃস্বরে কান্না শুনে বাবুজি বাধ্য হয়ে আমাকে বাজারে নিয়ে নতুন চুড়ি কিনে দিলেন।
আল্লাহই জানেন এর মধ্যে কত ঈদ আর হোলি চলে গেল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চিন্তাধারারও পরিবর্তন হলো। মনে হচ্ছিল, আমরা ধর্মের আসল দর্শন বুঝতে পেরেছি। পুস্কার প্রতিটি হোলিতে এসে আমার গায়ে রং মাখতো।
জন্মাষ্টমীর দিন সে আমাকে কৃষ্ণের একটা মর্মরের মূর্তি উপহার দিলো। ওটার নিচে একটা ফ্রেমে পুস্কারের একটা ছবি ছিল। আমি ছবিসহ মূর্তিটা আমার টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখেছিলাম এবং মাঝেমধ্যে ওগুলোর মধ্যে হারিয়ে যেতাম।
এরপর পুস্কার পড়ালেখার জন্য বেনারস চলে গেল আর আমি চলে গেলাম আলিগড়ে। আমাদের দুজনের স্কুলের ছুটি একই সময়ে হতো না। কাজেই আমরা একজন আরেকজনের দেখাই পেতাম না, এমনকি ঈদ বা হোলির সময়ও নয়। ডিসেম্বর আল্লাহর খুব প্রিয় মাস। এই মাস সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনে। আমি বারান্দায় শুয়ে শুয়ে কী জানি একটা পড়ছিলাম। এমন সময় বাইরে ডাক শুনতে পেলাম, ‘এই মুসলমানতি!’ বুঝতে পারলাম পুস্কার এসেছে। আমিও তাকে এই ‘কাফির’ বলে পাল্টা সম্বোধন করলাম। সে আমার মুখে আবিরের রং মেখে দিলো।
আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘তুই ডিসেম্বর মাসে হোলি খেলতে এসেছিস?’
‘হ্যাঁ, আমি তোর জন্য এই রংটা হোলির সময় থেকে উঠিয়ে রেখেছি। তুই আমাকে সেমাই খাওয়াবি না?’
‘না, তুই একটা কাফির।’
‘তুই একটা কাফিরনি। কেন ভুলে গেছিস হোলির দিন তুই কী কথা দিয়েছিলি?’
‘কোন কথা?’
‘ভুলে গেলি? তুই না বলেছিলি আমাকে বিয়ে করবি?’
‘চুপ, বদমাশ কোথাকার।’
‘তুই একটা আস্ত পাগল’, পুস্কার বললো।
আমরা দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
আমার কালো গায়ের রঙের জন্য খোঁচা মেরে পুস্কার বললো, ‘শুনলাম মুসোলিনি নাকি তোর জন্য অনেক সমস্যা তৈরি করছে?’
‘এই সাদা ইঁদুর, সাবধানে কথা বলবি। আমি শুনলাম একটা সাদা ইঁদুর ধরতে পারলে এক আনা পুরস্কার দেওয়া হবে’, আমি তার ফর্সা গায়ের রং নিয়ে টিটকারী মারলাম।
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে কথা বলতে বলতে আমি ওকে বললাম, ‘তুই হিন্দু, তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালা। তুই যদি ছুরি বা ধারালো কিছু দিয়ে আমাকে জখম করতে চাস আমি কী করতে পারবো?’
‘তোরা হচ্ছিস কসাই। আমি ভীতু ছাগলের বাচ্চা। তোর পেটে কয়েকশো ছাগলের মাংস গেছে।’
‘কিন্তু পুস্কার, তুই হচ্ছিস একটা বিরাট বলদ, ছাগল না।’
সে এতো জোরে আমার বাহু চেপে ধরলো যে আমি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম।
‘তুই যদি কয়লার মতো কালো না হতি আমি অবশ্যই তোকে বিয়ে করতাম।’
‘পুস্কার তুই খুব অন্যায় কথা বলছিস, আমি অতোটা কালো নই।’
তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে বললো, ‘তাহলে আমি তোকে বিয়ে করতে পারি।’
‘চুপ কর, কাফির!’
পুস্কার বলল, ‘তুই জানিস কবিরা ‘কাফির’ শব্দটা দিয়ে কী বোঝাতে চায়?’
‘সেই কাফির ভিন্ন, এটা হিন্দু গাধা।’
‘হিন্দু গাধারা কী মুসলিম গাধা থেকে ভিন্ন? আর ইহুদি গাধারা কেমন?’ পুস্কার হাসিচ্ছলে জিজ্ঞাসা করলো।
গাধাকে কীভাবে বিভিন্ন ধর্মের ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা যায় এই নিয়ে তর্ক করতে করতে আমাদের সময় বেশ মজায় কেটে গেল।
দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর কেটে গেল। পুস্কার আমাদের পাশের জেলায় ডেপুটি কালেক্টরের চাকরি পেল। প্রতি রোববার সে তার গাড়িতে করে চলে আসতো।
অনেকবার সে আমাকে হোলির দিনে তাকে কী কথা দিয়েছিলাম সেটা মনে করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে বোঝাতাম ওটা নিছক ছেলেমানুষি ছিল আর ও যেন এসব কথা আর কখনো না বলে।
‘তুই আমাকে এভাবে ভয় দেখাচ্ছিস?
আমি আজই তোর মায়ের কাছে একথা তুলবো। দেখা যাক কী হয়। আমি ভয় পাই না। তুই একটা আস্ত ভীতু।’
‘পুস্কার, তোকে জুতাপেটা করা হবে। আব্বা তোর মাথা ভেঙে দেবে।’
‘আমি মোটেই ভয় পাই না। আর কতদিন আমরা এভাবে অপেক্ষা করব এ-আশায় যে, একদিন আকাশ থেকে ফেরেশতা এসে আমাদের সাহায্য করবে।’
‘তুই ফালতু কথা বলছিস। আমাদের মধ্যে একটা বিশাল ব্যবধান আছে, সেটা হলো ধর্ম।’
‘আরে ধর্ম জাহান্নামে যাক। ধর্ম কি আমাদের সাহায্য করার জন্য, না শহিদ বানাবার জন্য সৃষ্টি হয়েছে?’
‘আমার আব্বা আর চাচার বহুদিনের বন্ধুত্বের কথা চিন্তা কর। ভেবে দেখ আমরা বিয়ে করলে তাদের মুখে কালি পড়বে। পত্রিকাগুলো মুখরোচক মজাদার খবরের অপেক্ষায় বসে আছে। ওরা এটা জানলে ছবিসহ ফলাও করে ছাপাবে এবং দোষ দেবে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে। ওরা আমাদের জীবনটাকে দুর্বিষহ করে ফেলবে। ভিন্নধর্মে বিবাহ কোনো অপরাধ নয়; কিন্তু এটা দাঙ্গার রাস্তা খুলে দেবে। আমাদের ধর্মের ছেলেদের হিন্দু বা খ্রিষ্টান মেয়ে বিয়ে করায় কোনো বাধা নেই; কিন্তু কোনো মুসলমান মেয়ে অন্য ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করবে – সেটা তারা মেনে নেবে না। তারা জোর গলায় বলে, মুসলমান মেয়েরা খ্রিষ্টান ছেলে বিয়ে করতে পারবে না। আমি জানি না তাদের এই গর্ব কতটা সত্য।’
‘ঠিক আছে, আমি মুসলমান হতে রাজি আছি’, পুস্কার বললো।
‘এতে কী এসে-যায়? তাছাড়া আমি নিজেও এটা সমর্থন করি না। আমার কাছে তুই মুসলমান হোস না হোস কিছুই
আসে-যায় না। তুই তো আগের মতোই থাকবি। পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘তাহলে তুই হিন্দু হয়ে যা’, পুস্কার বললো।
‘সাবধানে কথা বলবি। আমি মহল্লার লোকদের যদি বলি তুই আমাকে হিন্দু বানাতে চাচ্ছিস তাহলে ওরা তোকে কেটে কিমা বানিয়ে ফেলবে। আর আমি যদি হিন্দু হয়ে যাই, তাহলে আমার গায়ের চামড়া থাকবে না। পুস্কার, আমরা সমাজের দাস, আমাদের নিজেদের জীবনের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সমাজ এটাকে চালায়। এই সমাজ যা ইচ্ছা তা করতে পারে; কিন্তু আমরা ওটা নিয়ে কিছুই করতে পারি না।’
‘এটা সত্যি অন্যায়। আমার মাথায় এটা ঢোকে না। তোর ভাই ঘরে বউ থাকার পরেও ইউরোপিয়ান মেম নিয়ে এসেছে। সে তো খ্রিষ্টান! আমি তাকে নিয়মিত গির্জায় যেতে দেখি। সঙ্গে তোর ভাইও যায়।’
‘পুস্কার, সে মেমসাহেব আর তুই ব্রাহ্মণ। আর আমিও তুই যেমন ডাকিস মুসলমানতি। তুই পার্থক্যটা বুঝতে পারছিস?’
পুস্কার অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগলো। ‘আমি এই সমাজকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। শোন, চল আমরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি।’
‘কী লাভ এসব বাড়াবাড়ি করে। তুই জানিস আব্বা ভীষণ আঘাত পাবেন আর তোকেও সবাই সমাজচ্যুত করবে।’
‘আমি কী করবো তাহলে? সত্যি করে বল, তুই আমাকে ছেড়ে ওই হামিদ ব্যাটাকে বিয়ে করবি? আমি তাকে এমন শিক্ষা দেব যে তার বাপের নাম ভুলে যাবে। দেখ, আমরা যদি সবসময় সমাজের ভয়ে চুপ করে থাকি তাহলে আমাদের নিজেদের জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।’
‘তুই একটা আস্ত পাগল। আমি একটু ভেবে দেখি। হয়তো আল্লাহ একটা পথ বের করে দেবে।’
‘আমি তোকে বলছি’, পুস্কার বললো, ‘আল্লাহ তো সেটা করেই দিয়েছেন। কোতোয়ালি থানার ডান পাশ দিয়ে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে।’
‘হ্যাঁ, তারপর ফিরে এসে আব্বার হাতে নির্ঘাত জুতাপেটা।’
‘ফিরব কেন? সেখান থেকে আমরা অনেক দূরে চলে যাবো।’
‘লোকে বলবে – আমি ঘর থেকে পালিয়েছি।’
‘না, তারা বলবে – আমি তোকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছি। এখন চল, সময় বেশি নেই। ও হ্যাঁ, তোরা মোহরানা না কী জানি বলিস, সেটা এখনই দিতে হবে? আমি বিয়ে রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা করবো।’
‘আমি তোকে মোহরানা দেবো। আমার বেতন তোর বেতনের চেয়ে সামান্য কম।’
‘ঠিক আছে, এখন ওঠ এবং আমাকে ওটা দে’, পুস্কার বললো।
‘কিন্তু আমরা যখনই চাই তালাক নিতে পারবো।’
‘সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তুই প্রতি মিনিটে মিনিটে ঝগড়া করবি। ঘণ্টায় আমাকে সাতবার তালাক দিবি। এখন ছাড়তো ওইসব ফালতু আলাপ। তোর শাড়ি বদলে নে।’
‘আর তোর থ্যাবড়া নাক?’ আমি বললাম।
‘ঠিক আছে, তোর জন্য একটা খাড়া নাক নিয়ে আসব। তোরটা তো এমনিতেই চ্যাপ্টা।’
দরজাটা শক্ত করে ধরে আমি বললাম, ‘আমি যাবো না।’
‘তোর কথা সবসময় চলবে না’, এটা বলে পুস্কার আমাকে টেনে নিয়ে চললো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা থানার ডানপাশ দিয়ে সোজা বড় রাস্তাটা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।
আমি পুস্কারের কানে কানে বললাম, ‘এখনো সময় আছে, চল ফিরে যাই।’
‘সত্যি?’ সে খুব গম্ভীরভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো।
আমি মাথা নাড়লাম। আল্লাহই জানেন সেটা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’।
পুস্কার আমার ঘাড়ে একটা বিরাট ঝাঁকুনি দিলো।
‘কাফির!’ আমি তার হাতের কব্জিতে নখ দিয়ে চাপ দিয়ে চিৎকার করে বললাম।
‘কবিদের কাফির’, সে বললো।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
লেখক-পরিচিতি ইসমত চুঘতাই ভারতীয় উপমহাদেশে একজন দুঃসাহসী, বিতর্কিত এবং প্রগতিশীল মুসলিম নারী-লেখক ছিলেন। ১৯১৫ সালে (যদিও অনেকে মনে করেন তাঁর আসল জন্মবছর ১৯১১) ভারতের উত্তর প্রদেশের বদায়ুন শহরে তাঁর জন্ম। বাবা কাসিম বেগ চুঘতাই ছিলেন একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চাকরির সুবাদে তিনি ভারতের বিভিন্ন শহরে বাস করেছেন। অত্যন্ত ছোট বয়স থেকেই ইসমত ভীষণ সাহসী ছিলেন। তাঁর বাবা যখন রাজস্থানে চাকরিরত ছিলেন তখন বাবার সঙ্গে জেদ করে তিনি একা আলীগড়ে লেখাপড়া করতে চলে যান। ১৯৩৩ সালে আলীগড়ের ইসাবেলা থোবার্ন কলেজে পড়ার সময় তাঁর মধ্যে প্রগতিশীল ভাবধারার উন্মেষ ঘটে। তিনি ডারউইন, তলস্তয়, চেখভ, মোপাসাঁ, বালজাক, জোলা – এদের লেখনী দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত এবং ভিন্নধর্মী লেখায় উদ্বুদ্ধ হন। তাঁর প্রথম লেখা ফাসাদি (‘ঝগড়াটে’) নামে একটি উর্দু নাটক ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৪০ সালে তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস জিদ্দি লেখেন, যেটা পরে হিন্দি সিনেমায় রূপায়িত হয় এবং বিখ্যাত নায়ক দেবানন্দ এতে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অধিকাংশ লেখা ছিল উর্দুতে এবং উত্তর ভারতের তৎকালীন সমাজব্যবস্থার ওপর রচিত। বিদগ্ধ লেখনীর মাধ্যমে তিনি তাঁর সমসাময়িক বিখ্যাত উর্দু লেখক সাদত হাসান মান্টো, রাজিন্দর সিং বেদী, কৃষণ চন্দর – এঁদের মাঝে স্থান করে নিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ২৪শে অক্টোবর তিনি ভারতের মুম্বাই শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.