রোমান, বাইজানটাইন ও অটোমান স্থাপত্যশিল্পের শহর ইস্তাম্বুল। হোটেলে ব্যাগেজ রেখেই বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে। পিয়ার লোচি (Pierre Loti) পাহাড় থেকে দু-মিনিটে মজার কেবল কারে চড়ে পৌঁছে গেলাম ঐতিহাসিক বসফরাস নদীর ফেরিঘাটে। বসফরাস ৩০ কিলোমিটার লম্বা ও ৪ কিলোমিটার চওড়া – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গমস্থল। একদিকে এশিয়া আর অন্যদিকে ইউরোপ। নদীটি গিয়ে মিশেছে কৃষ্ণসাগরে। এর মোহানাই বিখ্যাত ‘গোল্ডেন হর্ন’। আসলে এটি দেখতে হরিণের শিঙের মতো। তুরস্কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। খাঁড়িপথের মুখটি বিশাল শেকল দিয়ে আটকে রাখা, যেন অবাঞ্ছিত জাহাজ ঢুকে পড়তে না পারে।
একটা চমৎকার গন্ধে মনোজগতে বিচরণ থমকে গেল। ঝলসানো চেস্টনাটের গন্ধে ম-ম করছে ঘাট। বাদাম খেতে খেতে বোটে উঠছি, বোটের দরজার মুখে একটা ছোট্ট প্যান্ট্রি চোখে পড়ল। স্তূপীকৃত টাটকা কমলালেবু। পাশে জুসারে জুস হচ্ছে। আর একজন স্যান্ডউইচ বানাচ্ছে। নদীর পার জুড়ে রয়েছে অসাধারণ স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন – দোলমাবাচে প্রাসাদ, ব্লু মস্ক, প্রাচীন সুদৃশ্য বাড়ি ও কেল্লা। রয়েছে অতি আধুনিক আপাদমস্তক কাঠের তৈরি চমৎকার বাংলো। কিছু লোক ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। চলন্ত বোটে তাজা কমলালেবুর রস ও অনন্য স্বাদের টাটকা মাছের স্যান্ডউইচ জীবনেও ভুলব না। নদীর ওপর উড়ন্ত সিগালের পাখায় নিভে এলো দিনের আলো। অস্তমিত সূর্যের রং জলে পড়ে সোনালি আভায় ছেয়ে গেছে – চোখ ফেরানো মুশকিল। সার্থক নাম – ‘গোল্ডেন হর্ন’।
ইস্তাম্বুলে প্রায় তিন হাজার মসজিদ রয়েছে। রমজান মাস সারাদিন দোকানপাট, হোটেল, রেস্তোরাঁ খোলা। উদারহস্ত – প্রচুর সস্তায় খাবার ও পসরার ছড়াছড়ি। নেই কোনো ধর্মের গোঁড়ামি। ব্লু মস্ক বা Sultanahmet ইস্তাম্বুলের অন্যতম মসজিদ। নীল পাথরের কারুকার্যই শুধু নয়, ছয়টি অসাধারণ মিনার অন্য মসজিদগুলো থেকে এটিকে বিশিষ্ট করে রেখেছে। একদিকে অটোমানদের এই শিল্পশৈলী আর তার মুখোমুখি বহু প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের বাইজানটাইনদের আয়া সোফিয়া (Ayasofya/ Hagia Sophia) খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের। ইতিহাস বলে, প্রায় ২৭০ ফুট লম্বা ও ২৪০ ফুট চওড়া আয়া সোফিয়া গড়তে ১০৪টি কলাম মিশরের আরটেনিস মন্দির ভেঙে আনা হয়েছিল। বছর পাঁচেকের মধ্যে রায়টে আয়া সোফিয়ার অনেক ক্ষতি হয়। ১৪৫৩ সালে অটোমানদের কাছে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ চার্চকে মসজিদে পরিণত করেন। তিনবার ভাঙাগড়ার মধ্যেও আয়া সোফিয়ার গুরুত্ব কিন্তু এতটুকু ক্ষুণ্ন হয়নি। ১৯৩৪ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক, তুরস্ক রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠাতা, আয়া সোফিয়াকে মিউজিয়ামে পরিণত করেন। আধুনিক তুরস্ক সারা পৃথিবীতে ধর্মনিরপেক্ষ দেশের মর্যাদা পায়। একই ছাদের নিচে চার্চ ও মসজিদ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আশ্চর্য হতে হয় সুদৃশ্য টাইলসের দেয়ালে মাতা মেরি ও কোলে শিশুপুত্র আর চারদিকে আলো করা যিশুর ম্যুরাল পেইন্টিং দেখে।
পাথুরে রাস্তা পেরিয়ে ‘ওবিলিকসে’র সামনে দাঁড়ালাম। ভাবতে অবাক লাগে, বিশাল উঁচু এই স্তম্ভটি খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে মিশরের ফারাওদের কর্নক মন্দির থেকে রোম সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়স কীভাবে ইস্তাম্বুলে এনে স্থাপন করিয়েছিলেন! চোখের সামনে জীবন্ত ইতিহাস। ওবিলিকসের পাদদেশে অসংখ্য চেয়ার-টেবিল পাতা ইফতারের জন্য। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যোগ দেওয়া হলো না গাইডের তাড়ায়। পৌঁছে গেলাম বহু পুরনো ঐতিহ্যপূর্ণ গ্র্যান্ড বাজারে। বিশাল জায়গা জুড়ে দোকানপাট। পোর্সিলিন, কার্পেট, ঝাড়বাতি, মশলা, হরেকরকম খাদ্যসম্ভারে সমৃদ্ধ। কিন্তু হাতে এতো কম সময় যে চোখ ধাঁধানো দু-ধারের দোকানে চোখ বোলানো ছাড়া উপায় ছিল না। কার্পেট, পোর্সলিনের রং ও কারুকাজে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একটু সময় বেশি লাগল। হাতঘড়িতে চোখ পড়তেই বাস ধরতে ছুটলাম।
সম্রাট, সুলতানদের বিলাসবহুল প্রাসাদ ‘টোপকাপি’। এর নির্মাণপর্ব শেষ হয়েছিল ১৪৬৫-তে। মাত্র তেইশ বছরের অটোমান সুলতান প্রাসাদটিকে নিজের বাসস্থানই শুধু নয়, প্রশাসনিক দফতরও বানিয়েছিলেন। প্রায় ৪০০ বছর ধরে চলেছিল এই ব্যবস্থাপনা। পরবর্তীকালে এই প্রাসাদে নিত্যযাপনের আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় ‘দোলমাবাচে’ প্রাসাদটি তৈরি হয়। এ-নামের অর্থ ‘বাগানে পরিপূর্ণ’। সত্যিই তা-ই! বসফরাসের দুরন্ত হাওয়া আর ম্যাগনোলিয়ার অপূর্ব গন্ধ মাতিয়ে রেখেছে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণ। প্রাসাদের প্রতিটি তলায় রয়েছে স্থাপত্যশিল্পের চমক এবং অত্যাধুনিক নিত্যযাপনের আরামদায়ক ব্যবস্থা। দর্শনীয় ক্রিস্টালের সিঁড়ির রেলিং আর রানি ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার বিশাল ৭৫০টি আলোর ঝাড়বাতি। তুরস্কের স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর যোদ্ধা কামাল আতাতুর্ক কেবল গ্রীষ্মকালে এই প্রাসাদে থেকে তাঁর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর ঘরটির সামনে দাঁড়াতেই গায়ের রক্ত টগবগিয়ে উঠল। আপনমনেই বলে উঠলাম – ‘দস্যুগুলোয় সামলাতে যে এমনি দামাল কামাল চাই।/ কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!/ হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!’
দিনের শেষে টাক্সিম স্কোয়ারে জিরোতে এলাম। সামনেই ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিসৌধ’। সব ক্লান্তি উধাও। অনেকটা দার্জিলিং ম্যাল মনে করিয়ে দেয়। সামান্য নেমে দোকান, বাজার। রকমারি খাবার-দাবার। মনোলোভা ‘বার্কলাভা’। অমনটি আর কোথাও খাইনি। প্রাণভরে খেলাম বেশ কয়েকটি টার্কিশ পদ ও মিষ্টি। মনোরম পার্কে বসে দেখছি, খানিক দূরে, রাস্তায় ছোট্ট ট্রাম এঁকেবেঁকে চলেছে। অসংখ্য পায়রা চত্বরে দানা খুঁটে খাচ্ছে। মায়েরা শিশুদের নিয়ে চলন্ত দোকানে খাবার কিনছে। যেন মেলা বসেছে। এই তো সেদিন তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালতের কলমের এক খোঁচায় সারা পৃথিবীর দর্শনীয় ‘আয়া সোফিয়া’ আর মিউজিয়াম রইল না। আর তার ‘National Heritage’-এর মর্যাদা?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.