কার্তিকের নীল কুয়াশায়

রাত দশটা। চা-বাগানের অফিস। ম্যানেজার কৈয়ারীলাল হেড টিলাবাবু আনোয়ারকে সজোরে ধমকে দিলেন। তার পর যা আসে মুখে তাই বললেন। পাতা কমে যাওয়ায় দোষারোপ করলেন। শীতের এই সময়ে চা-পাতা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসে। কিন্তু তিনি মানতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, এখানে হেড টিলাবাবুর গাফিলতি আছে। তাই নিজের আক্রোশটা ঝেড়ে দিলেন তার ওপর। বিরূপ আবহাওয়া, শ্রমিক সংকট এসব তিনি মানতে নারাজ। টার্গেট পূর্ণ না হলে তার বেতনের সঙ্গে বাড়তি মোটা অংশটা এবার যোগ হবে না, সেটা তিনি হতে দেবেন না। আসলে কৈয়ারীলাল চান না এই লোকটা হেড টিলাবাবু পদে থাকুক। এখানে তিনি যোগ্য বিবেচ্য করেন তরুণ এহসানউদ্দিনকে।

আনোয়ারবাবু চোখ তুলে তাকাতে পারলেন না। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। মালিক আবদুল জববার সাহেব তাকে পুত্রবৎ  স্নেহ করতেন। কাজপাগল লোকটির সহজেই সবার মন জয় করে নেওয়ার অদ্ভুতক্ষমতা ছিল। তিনি নেই আজ। তার বাগানেই বাকিটা জীবনক্ষয় করে দিলেন আনোয়ারবাবু। এখন এসব ব্যথার কথা কাউকে বলার নেই। চা-বাগানের স্টাফদের সবাই তাকে বাবু বলেই ডাকে। আর ম্যানেজারকে সাহেব।

এই মুহূর্তেই যদি মৃত্যু আসতো, তবে ভালো হতো। আনোয়ারের এমনটি মনে হলো। তার অধীনস্থ স্টাফরা যারা তাকে খুব মান্যগণ্য করে, তারা কী ভাবছে? হয়তো ভাবছে, যে সব সময় তাদের ওপর খবরদারি করে বেড়ায়, তার আজ এমন দৈন্যদশা!

মনে মনে হয়তো ওরা পুলকিত হচ্ছে। হতেই পারে। ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ওরা কেউ কি মূল ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না? ম্যানেজারের হুমকি-ধমকিতে ওরা নিশ্চয়ই মজা নিয়েছে। নিতেই পারে। তার জন্য কেউ কি একটুও ব্যথা অনুভব করেনি? করেছে করেছে, ওদের চোখে ব্যথার নীল কুয়াশা দেখেছেন তিনি। অবশ্য এটা তার নিজস্ব ধারণা।

ম্যানেজার সাহেব চেম্বারে ঢুকে গেলেন। সবাই চুপচাপ বস পড়ল আসনে। প্রোগ্রাম শেষ হয়েছে। সারাদিন খাটুনির পর, বাসায় ফিরে চারটে খেয়ে পরের দিনের শক্তি সঞ্চয় করা তাদের জন্য নিত্যদিনের রুটিন। কিন্তু যে ঘটনাটা ঘটে গেল তার জন্য কেউই প্রস্ত্তত ছিল না। সবাই কানাঘুষা করছে। কী থেকে কী হলো। ম্যানেজার সাহেব কারণ ছাড়া এমন ক্ষেপে গেলেন কেন? 

আনোয়ারবাবু একাই তো এই বাগানের ফিল্ডকে আগলে রেখেছেন। তার জন্যই তো বাগানের সবকিছু ঠিকঠাক আছে। না হয় এমন কী করেছেন ওই ম্যানেজার কৈয়ারীলাল!

যা হোক, এখন সবাই আনোয়ারবাবুর দিকে তাকিয়ে আছে।

বাবুল তরুণ স্টাফ। আনোয়ারবাবু তাকে অনেক স্নেহ করেন। বাবুলের বাবা একসময় আনোয়ারবাবুর সঙ্গে চাকরি করেছেন। বাবার চাকরির সুবাদেই বাবুল এই বাগানে চাকরি পেয়েছে। তাই বাবুল একটু ভিন্ন চোখে আনোয়ারবাবুকে মূল্যায়ন করে।

বাবুল বলল, ‘বাবু, মন খারাপ করবেন না। আমরা সবাই আপনার সঙ্গেই আছি। এখানে আপনার কোনো দোষ নেই। ম্যানেজার শুধু শুধুই আপনার ওপর ক্ষেপেছেন। ওনার চামচাটা এসে নালিশ করেছে মনে হয়।’

অশ্বিনী ত্রিপুরা বলল, ‘বাবু একদম মাথা থেকে ঝেড়ে দিন ব্যাপারটা। না হয় শাস্তি পাবেন না। এ-বাগানের
ছেলে-বুড়ো সবাই জানে, এ চা-বাগানের জন্য আপনার কী অবদান। এই চা-বাগানের প্রতিটি গাছের গোড়ায় আপনার অবদান আছে। সে-কথা বেইমান মানুষ না জানলেও গাছগুলো অন্তত জানে। মন খারাপ করবেন না।’

আনোয়ারবাবু চোখ তুললেন। অপমানে চোখ দুটো কেমন লাল হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কাঁদেন। হঠাৎ মায়ের কথাই মনে হলো। মা একটা গান করতেন প্রায়ই – ‘কাঁদলে নাকি যায়রে দুঃখ মন থেকে চলে/ আমি কাঁদলে যায় না দুঃখ যাবে কিরে মইলে।’

ম্যানেজারের সহচর এহসান। হেড টিলাবাবু হওয়ার জন্য লালায়িত সে। এখন কোনাচোখে পরখ করছে আনোয়ারবাবুকে। হয়তো আবার কোনো কৌশলে আনোয়ারবাবুকে সে সবার সামনে লজ্জায় ফেলবে। আসলে এহসানের ধারণা, এই আনোয়ারবাবুর জন্যই তার প্রমোশন বন্ধ রয়েছে। একদিন সে ঠিকই হেড টিলাবাবু হবে। তখন যারা তার বিরোধিতা করেছে, সকলকেই সে দেখে নেবে। একবার শুধু তার হাতেক্ষমতাটা আসুক। তাহলে যারা আনোয়ারবাবুর সাগরেদ আছে সব বেটাকে নাকের পানি চোখের পানি এক করে দেবে। তাকে খুব সস্তা ভেবেছে। সে জানেক্ষমতা কীভাবে নিতে হয়। ম্যানেজার কৈয়ারীলালের লালসা কোথায় তা সে জানে, দিনের পর দিন সে সব জোগান দিয়ে যাচ্ছে। ম্যানেজার সাহেব কি তার কথা রাখবে না? একটিবারও কি তার দিকে টানবে না? টানতেই হবে – সে-ব্যবস্থা সে তাড়াতাড়ি করছে। 

দুই

রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি ঘরে ঢুকলেন। মুখটা থমথমে। স্ত্রীকে ম্যানেজারের অপমানের কথা বলতে পারলেন না। শহর থেকে ছেলেরা ফোন করলে হা, হু  করে উত্তর দিলেন। মুখে ভাত তেমন রুচল না। তিনি শুধু তরকারিকে দোষারোপ করলেন। স্ত্রী সবকিছুই খেয়াল করলেন। ঘুমানোর আগে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে, তোমার মনটা এত খারাপ কেন?’

‘না তো কিছু হয়নি, এমনিতেই শরীরটা ভালো লাগছে না।’

‘ছেলে কি বলল? পাসপোর্ট হয়েছে?’

‘না, এখনো হাতে পায়নি। আমার মনে হচ্ছে আমি আর চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে পারব না। গত কয়েকদিন থেকে মাকে স্বপ্ন দেখছি।’

আনোয়ারবাবুর স্ত্রী চমকে উঠলেন। ‘কী বলো? মা কি তোমাকে নিতে এসেছিলেন?’

‘না, মা তেমন কিছু বলে নাই! তবে স্বপ্নে মাকে বেশ খুশি খুশি মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মা যেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন, তাই এত খুশি।’

স্ত্রীর দুর্ভাবনা দেখে আনোয়ারবাবু বললেন, ‘বাদ দাও, এসব নিয়ে চিন্তা করো না। একদিন সবাইকে যেতে হবে। আগে আর পরে।’

টিনের চালে পাতা ঝরার শব্দ। রাতের শিশির টুপটাপ। সে-শব্দে দুশ্চিন্তায় কখনো কখনো ঘুম হয় না। চালের নিচে বেড়ার ছাদ আছে। দমদমা। তারপরও একটা পাতা ঝরলেও টের পাওয়া যায়। রাত বাড়ে নিঃশব্দে। স্বামী-স্ত্রী কারোই ঘুম আসে না। না বললেও দুজনের ভেতরে একটা চিন্তার দেয়াল বেড়ে ওঠে। আর সেই চিন্তার রেশ
ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে কুকুরের কান্না। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায়। সে-শব্দ আফসোসের নাকি হতাশার বোঝা যায় না।

আনোয়ারবাবু শুয়ে শুয়ে ছেলেবেলার কথা ভাবতে থাকেন। ছেলেবেলার কষ্টের দিনগুলো তার কাছে পরম মমতার। বন্ধু দুলালের কথা মনে হয়। একবার মনে মনে ভাবেন, যদি চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান সেখানে আকস্মিকভাবে কি দুলালের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে না? ছেলেবেলার খুব কাছের বন্ধুকে পেয়ে দুলাল কেমন অবাক হয়ে যেত। ওর চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠতো। বিশ্বাসই করতে পারতো না তিনি যে আনোয়ার। জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত এক ক্লান্ত সৈনিক। দুলালের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। মনের ভেতর আনন্দবান লাফিয়ে ওঠে।

তার অসুখের কথা শুনে খুব কষ্ট হবে দুলালের। তারপর না হয় ডাক্তার দেখিয়ে দুলালের মা-বাবাকে দেখে আসবে। দুলালের বাবা-মা কি আর এতদিন বেঁচে আছে? সেই পঞ্চাশ সালে তারা এদেশ ছেড়ে গেছে। আহা, না হয়  বেঁচেই থাক। তাকে দেখে কি যে খুশি হবেন তাঁরা। দুলাল তো বিশ্বাসই করতে পারবে না। ওর জানেজিগার দোস্ত এদেশ থেকে ওদেশে তাকে খুজতে চলে এসেছে। দুলালের বউ দেখতে কেমন হয়েছে? তার ছেলেমেয়েরা কত বড় হয়েছে? দুলাল না থাকলে তো আনোয়ারের লেখাপড়াই হতো না। দুলালের বই নিয়েই তো তিনি পড়াশোনা করেছেন। দুলালের মা কখনো ভিন্নচোখে দেখেননি। কিংবা মুসলমান বলে কখনো ঘেন্নাপিত্তিও করেননি। কী যে মায়াময় ছিল সেসব দিন।

সে-কথা ভাবতেই আনোয়ারের মনটা খুশি হয়ে গেল। ম্যানেজারের কুমড়োমুখো তিক্ত কথাগুলো আর মনে পড়ল না। কিন্তু এমন আকাশপাতাল ভাবনা বেশিক্ষণ চালাতে পারলেন না তিনি। মনটা আবার তার খারাপ হয়ে উঠল। ছোটবেলা থেকে নিজের ওপর কম ফাঁড়া যায়নি। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবেন তো! এ-অসুখ ভালো হবে তো? ডাক্তার কি যেন রোগটির নাম বললেন, ও হ্যাঁ, এনিয়ারিজম। বুকের মাঝ বরাবর রক্তধমনিটা ফুলে গেছে। রক্ত চলাচলে বাধা পড়ছে। পায়ের দিকে রক্ত কম নামছে। পঁয়ষট্টি সালে একবার তার টিবি ধরা পড়েছিল। সবাই তাকে এ চা-বাগান থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। বলল, ছেলেটার এত অল্প বয়সে টিবি হয়ে গেল। বাঁচবে না। তার চেয়ে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও। জববার সাহেবও তাতে সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু ছোটসাহেব বললেন, ‘এটা তো ভালো দেখায় না। ছেলেটার বাপ নেই। একটা এতিম ছেলে। এখন তো টিবির চিকিৎসা হয়। ওকে শহরে নিয়ে টিবির চিকিৎসা করালে হয় না। ও সুস্থ হয়ে আবার বাগানে চাকরি করবে?’ ছোট সাহেবের কথা সবার পছন্দ হয়। তখন কোম্পানি আনোয়ারকে শহরে নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে টিবি ভালো করায়। সেবারও বেঁচে গিয়েছিলেন সবার দোয়ায়। এবার কি শেষ রক্ষা হবে?

তার বয়স জানি কত!

সত্তরের ঘর তো অনেক আগেই পার হয়ে এসেছেন। চাকরিটা ছাড়তে পারেননি। অনেক অনেক শ্রমিকের মুখের দিকে তাকিয়ে কোথাও যাওয়া হয় না। যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি। যেতে হলে কোনোদিকে না তাকিয়ে চলে যেতে হয়। একসময় অনেকেই ছিলেন তার সঙ্গে। তারা কেউ নেই। তার মধ্যে আবুল ম্যানেজার, বাবুর আলি, নায়েব আলি, মানিক সিকদার মারা গেছেন।

এখন কি তার পালা? মনটা এমন করছে কেন? মন কি মানুষকে মৃত্যুর আগে জানান দেয়? আজ কেন তার শুধু মৃত মানুষের কথা মনে পড়ছে? তবে মৃত্যু কি তার খুব কাছে?

অবশ্য মৃত্যু মানুষের কাছাকাছি থাকে। সময় কখন কার হবে, কে জানে! যুধিষ্ঠির দশমীর দিনেই চলে গেল। আর রামরু পান তাঁতি?

হালকা-পাতলা মানুষটা মৃদুভাষী। গায়ে এক ছটাক মাংস নেই। শুধু মনে হয় হাড়গুলো জেগে আছে। কোনো কথা নেই, ‘খারাপ লাগছে’ বলল। তারপর আর বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারল না। মিঞ্জিরগাছের তলাতেই শেষ হয়ে গেল। আপাতদৃষ্টিতে কী সহজ মনে হয় এই মৃত্যু। মৃত্যু সহজ, নাকি যন্ত্রণার? এ-যন্ত্রণার স্বাদ সকলকেই নিতে হবে একদিন। কী অমোঘ সত্য! কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

তিন

কদিন আগেই পূজা শেষ হয়েছে। পূজার পরেই প্রকৃতিজুড়ে এমন কুয়াশা নেমে আসে। মনে হয় নীল কুয়াশা। সকালের রোদে গ্রাম-গ্রামান্তর, গাছপালা সব মমতায় ঘিরে রাখে। এ-সময় মক্তব-মাদ্রাসার ছেলেদের মধ্যে একধরনের চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দেয়। ছোট ছোট ছেলের গলার স্বর অনেক উচ্চগ্রামে বাজতে থাকে। কুয়াশায় প্রকৃতি ঢেকে থাকে। সকালে রান্নাঘরের চালার ওপর দিয়ে ধোঁয়ার রিং উঠতে থাকে ওপরের দিকে। ধনীরাম কিংবা অটল বুড়োর হাঁকানিতে লাইন সরগরম হয়। সকাল সকাল সবাইকে কাজে বেরিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেয় ওরা। সকাল ছয়টার ঘণ্টা বাজার শব্দ যেন অনেক শব্দে বাজে।

বুকের ভেতর ভাবনাগুলো বেশ নড়াচড়া শুরু করে। আর কত বছর তিনি চাকরি করবেন? চাকরির বয়স যখন সাতান্ন হলো তখন তিনি আস্তে আস্তে ভেতরের দুর্বলতা টের পেতে শুরু করেন। মনে হচ্ছে, যে-কোনো সময় তিনি ফুরিয়ে যেতে পারেন।

সেই দিন এই চা-বাগান তাকে কি মনে রাখবে?

কত শ্রমিক, কত মানুষ তিনি দেখলেন। ছোট্ট এই বুকে কত ব্যথার কাহিনি লুকিয়ে আছে। তা তো কাউকে বলতে পারেননি। এই চা-বাগানের জন্য তিনি মার খেয়েছেন। পিঠের রক্ত ঝরিয়েছেন। আর কেউ কি করেছে? না করেনি। করবেও না। চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। এখন যারা আছে সবাই ফাঁকিবাজ। সকাল আটটা বাজলেও ঘর থেকে বের হয় না। বাইক নিয়ে টিলায় যায়। ঘুরে চলে আসে। তার মধ্যে দু-একজনের বাড়ি বাগান থেকে একটু দূরেই। সময়-অসময়ে তারা চলে যায় বাড়িতে। বাইকের পেছনে বউবাচ্চা ঝুলিয়ে তাদের যেতে কোনো প্রস্ত্ততি লাগে না। শুধু তারই মনে হয় যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। মনে হয়, তিনি মৃত্যুর পরও রয়ে যাবেন এই

চা-বাগানে। তার জন্মভিটায় কোনোদিন ফেরা হবে না আর। তার মায়ের কবরের পাশে আর দাঁড়ানো হবে না। এসব ভাবনা তিনি ভাবতে চান না। কীভাবে যেন চলে আসে। ভাবনার কোনো সময়-অসময় নেই।

চার

শিশুবালার ঝকঝকে হাসি। গ্রাম থেকে হালদা পেরিয়ে কাজে আসেন। আধাত্মিক মনমানসিকতা মহিলার। শুভ্র হাসি আর কাপড়ে সবাইকে ভালোবাসেন। সকালবেলাতেই আনোয়ারের মুখোমুখি হোন। আনোয়ারবাবুই আগে কথা বলেন, ‘কী পাগলির মা, কী খবর?’

‘বাবু ভালো আছি, বউমা ভালো আছেনি?’

‘আছে।’ একথার পর যে যার কাজে চলে যায়। ঘাসের ডগায় তখনো শিশির জমে আছে। কিছু দূর গেলেই আবার দেখা হয় বলরাম সরকারের সঙ্গে। তার হাত একটা কলমছুরি। বলরাম হন্তদন্ত হয়ে আদাব দিয়ে চলে যায়। গাড়ির জন্য অফিসে আসতেই হয় আনোয়ারবাবুকে। গতরাতের মন খারাপটা এখনো চেপে আছে মনে। চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অজিত ঠাকুর আর ফ্যাক্টরি ইনচার্জ সুমিত কথা বলছিলেন। আনোয়ারবাবুকে দেখে তারাও কুশলবিনিময় করেন। রাতের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। কৈয়ারীলালের এমন দুর্ব্যবহারের কথা ভুলে যেতে বলেন। আনোয়ার কিছু বলেন না।

দূর অফিসের বেলগাছটার তলে কাকে যেন দেখতে পান তিনি। চোখটা কেমন ঘোলা ঘোলা মনে হচ্ছে। পরিষ্কার করে আবার দেখেন। সত্যিই সত্যিই যেন দাঁড়িয়ে আছেন আবুল ম্যানেজার। এ চা-বাগানের শুরুর দিকে তিনিই ছিলেন, তিনিই একে দাঁড় করিয়ে গেছেন। মৃত মানুষ এভাবে ফিরে আসে বুঝি!

কেন মৃত মানুষদের এত আনাগোনা তার চারপাশে? আনোয়ারবাবুকে বেশ চিমিত্মত দেখাল। অজিত ঠাকুর আর সুজিত দাশ আনোয়ারবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাদের চোখে কিছু একটা অস্বাভাবিক আচরণ ধরা পড়েছে।

পেছন দৌড়ে এলেন সুজিত দাশ। বললেন, ‘বাবু আপনার যদি খারাপ লাগে আজকে ফিল্ডে যাওয়ার দরকার নাই। বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন।’

অজিত ঠাকুরও এগিয়ে এসেছেন। ‘হ যানগা না বাসায়। আপনার শরীরডা মনে হয় ভালা নাই আইজকা।’

‘না না ঠাকুরদা, ঠিক আছে। সমস্যা নাই। যাই, অনেক কাজ আছে। লোকজন এত সময় হাউকাউ শুরু কইরা দিছে মনে হয়।’ এবার আনোয়ার বেলগাছের তলায় তাকালেন। না, কোথাও আর আবুল ম্যানেজারকে দেখা যাচ্ছে না। 

কিছুক্ষণ পরেই একটা বাইকে আনোয়ারবাবু চলে গেলেন বাগানের দিকে।

গুনতিশালায় লোকসমাগম প্রচুর। কিন্তু আজ আনোয়ারবাবুর সেদিকে খেয়াল নেই। তাকে কেমন বিস্মৃত মনে হচ্ছে। চা-গাছের পাতার ওপর রাতের শিশির রোদ লেগে কেমন হিরের মতো জ্বলছে। তাতে মাকড়সা জাল বুনে অদ্ভুত এক আচ্ছাদন তৈরি করেছে। সেদিকেই তাকিয়ে আছেন আনোয়ারবাবু। তার ভাবনায় একটি কথাই বারবার ফিরে আসছে। ঘুরেফিরে কেন মৃতদের কথা মনে পড়ছে? কেন তাদের প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভাসছে? মনের কোণে একটু ভয় ভয় ভাবটা উঁকি দিলো।

বাবলু বলল, ‘বাবু, আমরা যাচ্ছি। কাজ ধরিয়ে দি।’

‘যাও। আমি ওদিকে ঘুরে আসি।’

আনোয়ারবাবু আজ বাগানের আনাচে-কানাচে অনেক জায়গাতেই ঘুরলেন। যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা হয় না, তাদের সঙ্গেও দেখা করলেন। মনটা বড় নিঃস্ব হয়ে আছে। কিছুতেই তিনি শাস্তি পাচ্ছেন না। বারবার শুধু মায়ের চেহারা ভেসে উঠছে চোখে। তারপর কাজের ভেতর ডুব দিলেন। যথারীতি বাগানের কাজ শেষ করে রাতে অফিসের কাজও শেষ করলেন। নিজের টেবিলে বসে আজ কেমন নিজেকেই অচেনা মনে হলো। অফিস থেকে ফেরার পথে দেখলেন কুয়াশারা জমাট বেঁধেছে। রাস্তায় শিশির পড়ে কেমন ভিজে আছে।

বাসায় ফিরে খেয়েদেয়ে যখন শুলেন কেমন নির্ভার মনে হলো নিজেকে। কখন তিনি ঘুমের দখলে চলে গেলেন, বুঝতে পারলেন না। কিন্তু সকালবেলা লোকজনের চিৎকারে আনোয়ারবাবু আর জেগে উঠতে পারলেন না। স্ত্রীর কান্নায় তিনি কোনো রকম সান্ত্বনা দিতে জাগলেন না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি কিছুই করতে পারলেন না। মা তার হাত ধরে সবার মাঝখান থেকে নিয়ে চললেন। তিনি বারকয়েক পেছনে ফিরে সবার কান্নার ধ্বনি শুনলেন। মা তার হাতটি ধরে আস্তে আস্তে নীল কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকলেন। একবার তিনি ফিরে যেতে চাইলেন। মা মৃদু হেসে, মাথা এপাশ-ওপাশ করে নিষেধ করলেন। ফিরে যাওয়া হবে না। মা তাকে কোথায় নিয়ে চলেছেন? তাহলে তিনি কি আর বেঁচে নেই!