কালাপীর

 

লঞ্চ তখনো ছাড়েনি। কেবিনে শুয়ে জোসেফ ক্যাম্পবেলের পাওয়ার অব মিথ পড়ছিল নেহাল। অর্ধেকের বেশি পড়া হয়ে গেছে, এ-ভ্রমণেই পুরোটা শেষ করার ইচ্ছা। বই বন্ধ করে মোবাইলটা হাতে নিল। ফেসবুক ওপেন করে দেখল সমরকান্তির মেসেজ। লঞ্চে উঠেই চর কুকরী-মুকরী যাত্রার কথা জানিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিল। সেটা দেখে সমরকান্তি লিখেছে, ভোলা হয়ে যাস। লঞ্চঘাটে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।

নেহালের মনেই ছিল না সমরকান্তি এখন ভোলায়। দেখা হয়েছিল প্রায় এক বছর আগে, ঢাকার র‌্যাডিসন হোটেলের এক অনুষ্ঠানে, সমর যখন ঝালকাঠির এসপি। ভোলায় বদলি হওয়ার সম্ভাবনার কথা সমর বলেছিল সেদিন। নেহাল জনপ্রিয় দৈনিকের ব্যস্ত সাংবাদিক, প্রতিদিন কত সচিব-উপসচিব-ডিসি-এসপির সঙ্গে তার দেখা হয়, কথা হয়, কজনের কথা আর মনে থাকে।

অবশ্য সমরের কথা আলাদা। দশজনের সঙ্গে তাকে মেলানো যায় না। ভার্সিটির যে কজন ব্যাচমেটের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল সমর তাদের একজন। একদিন আগে জানলেই লঞ্চের টিকিট বাতিল করে দিত নেহাল। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ঢাকার সদরঘাট থেকে ছেড়ে নিউ সাব্বির লঞ্চটি পরদিন সকাল নটা-সাড়ে নটায় ভোলার ঘোষেরহাট পৌঁছায়। ভোলা শহরে যেতে হলে লঞ্চ পালটাতে হবে। লঞ্চ ছাড়তে মাত্র আধাঘণ্টা বাকি, এখন কি আর তা সম্ভব? চাইলেই তো হুটহাট লঞ্চ পালটানো যায় না। ভিআইপি কেবিন পাওয়া তো এত সহজ নয়। সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণেই কি না কে জানে, দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ এখন লঞ্চকেই নিরাপদ মনে করে। বরিশাল-ভোলা-খুলনা-মোরেলগঞ্জ রুটে চাইলেই ভিআইপি কেবিন পাওয়া যায় না। মোরেলগঞ্জ রুটের এমভি বাঙালি বা এমভি পারাবতের কেবিন তো মন্ত্রী-এমপি-সচিবের ফোন ছাড়া সম্ভবই না। নিউ সাব্বিরের কেবিন অবশ্য খালিই থাকে। বিশেষ করে শীতের দিনগুলোতে যাত্রী থাকেই না বলতে গেলে। সবে মার্চের শুরু। তবু অজ্ঞাত কারণে প্রথমে নেহালকে কেবিন দিতে রাজি হলো না কাউন্টার ম্যানেজার। কেবিন নাকি খালি নেই। কিন্তু নেহাল তার পেশাগত পরিচয়টা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ম্যানেজারের সুর গেল পালটে। কেবিন খালি আছে, কিন্তু এসি নষ্ট। নেহাল বলল, সারিয়ে নিন, এখনো দুদিন বাকি। ম্যানেজার আর কথা বাড়ায়নি।

নেহাল যাচ্ছে অফিসের কাজে। ভোলা জেলার সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ এলাকা চর কুকরী-মুকরী। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, খুন, ফেনসিডিল, ইয়াবা ব্যবসা, ম্যানগ্রোভ বনের গাছ কাটা, হরিণ শিকার – হেন অপরাধ নেই যা ঘটছে না। পুলিশ-কোস্টগার্ড কোনোভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। দৈনিক কালাকালের চরফ্যাশন প্রতিনিধি সপ্তাহে দশটি নিউজ পাঠালে পাঁচটিই থাকে চর কুকরী-মুকরীর। জেলা প্রতিনিধিও এ-দ্বীপের ওপর একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছে। অথচ প্রশাসন নির্বিকার।

সেদিন পত্রিকার সাপ্তাহিক মিটিংয়ে সম্পাদক চর কুকরী-মুকরীর প্রসঙ্গ তুললেন। ব্যাপারটা আসলে কী? মাত্র চল্লিশ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট একটা ইউনিয়ন কন্ট্রোল করতে পারছে না প্রশাসন! আরেকটা পুলিশ ফাঁড়ির দাবিতে এলাকাবাসী নাকি উপজেলা সদরে মানববন্ধন করেছে, ডিসি বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে অথচ কেউ তো আমলেই নিচ্ছে না। স্থানীয় সংসদ সদস্যও নিশ্চুপ।

চিফ রিপোর্টার বললেন, আমি চরফ্যাশন করসপন্ডেন্টের সঙ্গে এ-বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছি। আরেকটা পুলিশ ফাঁড়ি ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কন্ট্রোলে রাখা আসলেই অসম্ভব। কিন্তু সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় নতুন পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের যাবতীয় কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত।

সম্পাদক বললেন, হোম মিনিস্ট্রিতে কথা বলেছ?

হ্যাঁ, মিনিস্টারকেই ফোন দিয়েছিলাম, তিনিই জানালেন।

নেহালের ঠিক বিশ্বাস হয় না। সে ভেবে পায় না চর কুকরী-মুকরীর অবস্থা এতটা খারাপ হয় কী করে। তার মনে পড়ে পঁচিশ বছর আগের স্মৃতি। বয়স তখন মাত্র বাইশ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। কৈশোর থেকেই তার বাড়িপালানোর স্বভাব। মাত্র তেরোতে লোকালে চড়ে চলে যায় চট্টগ্রাম শহরে। তাতেই সাহস গেল বেড়ে। তারপর থেকে হাতে টাকা-পয়সা এলেই বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে চম্পট দিত। কখনো চট্টগ্রাম, কখনো কক্সবাজার, কখনো-বা ঢাকা।

সেবার আন্তঃনগর এক্সপ্রেসে ঢাকায় এসে উঠল কমলাপুর সর্দার কলোনিতে, গ্রামের দূরসম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের মেসে। থাকল দুদিন। তৃতীয় দিন ফেরার জন্য কমলাপুর স্টেশনে গেলে তার মনে হলো, লঞ্চ-ইস্টিমারের কথা কেবল বই-পুস্তকে পড়েছে, জীবনে কখনো চোখে দেখেনি, এবার না দেখে ফিরবে না। মুহূর্ত দেরি না করে রিকশায় গুলিস্তান গিয়ে চড়ে বসল সদরঘাটের বাসে। লঞ্চে উঠে ঘুরে ঘুরে মনের সাধ মিটিয়ে ডেক, কেবিন, মাস্টার কেবিন, ছাদ সব দেখতে লাগল। ভুলে গেল নামার কথা। হঠাৎ লঞ্চ দিলো ছেড়ে। একটুও মন খারাপ হলো না তার। ছেড়ে দিয়েছে তো কী হয়েছে, লঞ্চ তো আর সাগরে ডুব দেওয়ার জন্য যাচ্ছে না। পকেটে টাকা যা আছে তাতে অনায়াসে আরো দশ-বারোদিন চলা যাবে। ভেবেছিল চাঁদপুর নেমে যাবে, কিন্তু চাঁদপুর ঘাট ধরল না লঞ্চ। পরদিন সকালে পৌঁছল ভোলায়। ডেকে খাতির জমিয়ে তুলেছে চর কুকরী-মুকরীর এবাদুল নামে এক যাত্রীর সঙ্গে। ঢাকার টঙ্গী থেকে ফিরছিল এবাদুল। ঘাটে নামার পর এবাদুল বলল, চলুন না আমাদের বাড়ি। নির্দ্বিধায় নেহাল বলল, আমার কোনো আপত্তি নেই।

মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় জেগে ওঠা নয়নাভিরাম দ্বীপ চর কুকরী-মুকরীর হদিস তখনো পর্যটকরা পাননি। পেলেও দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কেউ যেত না। দ্বীপজুড়ে ছিল নারিকেল, বাঁশ, বেত, সুন্দরী, গেওয়া ও পশুরের বন। বনে ছিল বানর, শেয়াল, উদবিড়াল, বনবিড়াল, গুঁইসাপ, বেজি, কচ্ছপ ও সাপ। আর ছিল বক, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েলসহ নানা প্রজাতির পাখি। চর কুকরী-মুকরী তো নয়ই, চরফ্যাশনেও তখনো বিদ্যুৎ যায়নি। কোনো হোটেল-মোটেলও ছিল না। কখনো কোনো পর্যটক গেলে তাঁবু গেড়ে রাত কাটাতেন। জনসংখ্যা তখন বড়জোর হাজারখানেক; মাছ ধরাই ছিল যাদের একমাত্র পেশা।

এবাদুলের বাড়িতেই উঠেছিল নেহাল। এখনো মনে আছে তার আতিথ্যের কথা। দেশ-বিদেশের কত জায়গায় ভ্রমণ করেছে নেহাল, কত মানুষ দেখেছে, কিন্তু এবাদুলের মতো এমন অতিথিপরায়ণ মানুষ দ্বিতীয়টি দেখেনি। শুধু এবাদুল কেন, চর কুকরীর-মুকরীর প্রতিটি মানুষের কাছে অতিথি-মেহমান ছিল সৌভাগ্যের প্রতীক। বাড়িতে অতিথি আসা মানে কোনো-না-কোনো সুসংবাদ আসা। তুলে রাখা শীতলপাটিটি বিছিয়ে দিত, কুঁড়ের সবচেয়ে বড় মোরগটি জবাই দিত, একটু সামর্থ্যবান হলে খাসিটির মায়াও ছেড়ে দিত। মাছ তো তখন চরবাসীর কাছে কচুপাতা। পুকুর-খাল-নদী-সমুদ্রে কেবল মাছ আর মাছ। ইয়াবার তো তখনো জন্মই হয়নি, ফেনসিডিল তো দূরস্থ, চরবাসীর কেউ কোনোদিন চোলাইমদের নাম শুনেছে কি না সন্দেহ। খুনের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। ছিনতাই-চুরি-ডাকাতি তো ছিলই না, এসবের কথা জিজ্ঞেস করলে বলত, কালাপীরের চরে কেউ চুরি-ডাকাতি করবে, তার কি প্রাণের মায়া নেই? দ্বীপজুড়ে দিন-রাত চরছে গরু-মোষ, কখনো চুরি হয়েছে এমন নজির নেই। কে করবে চুরি? করলেও চুরির মালটি নিয়ে তো তাকে নদী পাড়ি দিয়ে পালাতে হবে। তখন কি কালাপীর ছাড়বে? ডুবিয়ে মারবে না? কেউ মিথ্যা কথা বলবে? ঘুমের ঘোরে কালাপীর এসে তার জিবটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবে না? ফাঁড়ির পুলিশদের কোনো কাজ ছিল না। কেউ তাদের কাজের কথা জিজ্ঞেস করলে ঠাট্টা করে বলত, বসে বসে মশা মারাই আমাদের ডিউটি।

নেহালের মনে আছে, যেদিন সে চর কুকরী-মুকরী গেল তার পরদিন সকালে এবাদুল চলে গেল সাগরে। ঘরে মেহমান রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না তার। কিন্তু না গিয়ে উপায় ছিল না। টানা সাতদিন সে ঢাকায় ছিল। ঘরে নুন আছে তো মরিচ নেই হাল। যাওয়ার সময় নেহালকে বলে গেল, কোনো চিন্তা করবেন না, আমি সন্ধ্যার আগে ফিরে আসব, আপনি যতটা পারেন চরটা ঘুরে দেখুন।

আলুভর্তা দিয়ে একবাসন পান্তাভাত খেয়ে এবাদুলের ছোটভাই রফিকের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল নেহাল। সমুদ্রে তখন ভাটা। ভাড়ানি খালে কাদা আর কাদা। সাঁকো পার হয়ে হরিণ দেখার আশায় দুজন ঢুকে পড়ল কালীর চরের জঙ্গলে। ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরির পর পেশাব করতে বসল নেহাল। উঠে দেখে রফিক উধাও। নেহাল তাকে উত্তরে খোঁজে। নেই। দক্ষিণে খোঁজে। নেই। পুবে-পশ্চিমে খোঁজে। নেই। কোথায় গেল রফিক? তার নাম ধরে ডাকতে পারে। কিন্তু ডাক শুনে যদি দস্যু-ডাকাতরা হাজির হয়! এবাদুল যতই বলুক, এই ঘোর জঙ্গলে দুস্য-ডাকাত না থেকে পারে না।

রফিককে খুঁজতে খুঁজতে এবাদুল পৌঁছে গেল জঙ্গলের পূর্ব সীমানায়, যেখানে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। জোয়ার শুরু হয়ে গেছে তেতক্ষণে। নোনাপানি ধুয়ে দিচ্ছে গেওয়া-সুন্দরীর শাঁসমূল। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি, ঢেউ আর ঢেউ। জেলে নৌকাগুলো ভাসছে, গাংচিলেরা উড়ছে। দূর্বায় ঢাকা মাঠে গেওয়ার একটা গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসল নেহাল। শরীরে এমনই ক্লান্তি, খানিকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।

দুপুর প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে রফিকের ডাকে তার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখে, চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে রফিক তার দিকে তাকিয়ে। নেহাল ভাবে, তাকে খুঁজে পাওয়ায় বুঝি রফিক বিস্মিত। কিন্তু না, তার বিস্ময় কালাপীরের কেরামতি দেখে। কালাপীর এভাবেই বনে-জঙ্গলে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন।

ঘুমানোর আগে নিশ্চয়ই ফুলের গন্ধ পেয়েছিলেন? জানতে চাইল রফিক।

নেহাল বলল, বাগানে ফুলের গন্ধ পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

না না ভাইজান, মোটেই স্বাভাবিক নয়। ওই ঘ্রাণ কালাপীরের।

নাদান রফিকের নাদানি দেখে নেহালের হাসি পায়। তবে হাসির অন্তরালে খানিক ভয়ও জাগে। তার ধারণা, কালাপীর বুঝি চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার দরবার শরিফের পীরের মতো বড় কোনো পীর, যার খানকা এ-জঙ্গলেই। সে জানতে চাইল, কালাপীর কোথায় থাকেন?

দ্বিগুণ বিস্ময়ে রফিক বলল, আপনি দেখি কিচ্ছু জানেন না! আশপাশে নিশ্চয়ই কোথাও কালাপীর আছেন। আপনার কথা তার কানে গেলে তিনি গোসসা করবেন।

গোসসা করার কী আছে! আমি তো খারাপ কিছু বলিনি।

নেহালের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল রফিক। এক হাতে নেহালের মুখটা চেপে ধরে আরেক হাতের তর্জনীটা নিজের ঠোঁটের ওপর খাড়া করে ফিসফিসিয়ে বলল, চুপ! রফিকের কাণ্ড দেখে নেহালের ভয় গেল বেড়ে। সেসঙ্গে বাড়ল কৌতূহল – কালাপীর আসলে কে? তিনি থাকেন কোথায়? রফিককে নিয়ে সে তার খানকায় গিয়ে দেখা করতে চায়।

তার কথা শুনে রফিক খিলখিলিয়ে হাসে। হাসবে না? কালাপীরের সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার কথা শুনে তো চর কুকুরী-মুকরীর নেংটা পিচ্চিটাও হাসবে। কালাপীরকে কেউ কোনোদিন দেখেছে? রফিক তো নয়ই, তার বাপ-দাদারও তো সেই সৌভাগ্য হয়নি। শুধু তার বাপ-দাদা কেন, চর কুকরী-মুকরীর কেউ কোনোদিন কালাপীরকে দেখেনি। কীভাবে দেখবে? তিনি তো গায়েবি পীর। পানি হয়ে পানির সঙ্গে, হাওয়া হয়ে হাওয়ার সঙ্গে আর গাছ হয়ে গাছের সঙ্গে মিশে থাকেন। পাখি হয়ে উড়ে বেড়ান, হরিণ হয়ে ঘুরে বেড়ান, গরু হয়ে দুধ দেন, সাপ হয়ে দংশন করেন। চর্মচক্ষে তাঁকে দেখার সাধ্য কি মাটির মানুষের! তাঁর দাদা তো সেদিন পটুয়াখালীর হরিপাড়া থেকে এখানে এসেছেন। কালাপীর আসেন বহু বছর আগে, চর কুকরী-মুকরী যখন ফিরিঙ্গিদের দখলে। ফিরিঙ্গিরা তো দস্যু ছিল। তাদের শায়েস্তা করতে সমুদ্রের ওপর দিয়ে হেঁটে আসেন দয়াল বাবা কালাপীর। তাঁর পদচ্ছাপে তুফান ওঠে সমুদ্রে। সেই তুফানে তলিয়ে যায় তামাম চর। ফিরিঙ্গিরা ভেসে যায় উত্তাল স্রোতে।

কিন্তু কালাপীর তো দয়ার সাগর। তাঁর রোষ তো ফিরিঙ্গিদের ওপর, চরের গাছবিরিক্ষি-পশুপাখির ওপর তো নয়। তাই বহু বছর পর তিনি আবার এলেন। একইভাবে সমুদ্রের ওপর দিয়ে হেঁটে। তাঁর আঙুলের ইশারায় আবার জেগে উঠল চর। তাঁর হুকুমে মাটি থেকে উঠে এলো একজোড়া কুকুর আর একজোড়া মেকুর। ধীরে ধীরে আসতে লাগল অন্য পশুপাখিও। এই যে এখন জঙ্গলে এত হরিণ, এত শেয়াল, এত সাপ – সবাই তাঁর হুকুমের গোলাম। এ-কারণেই হরিণ মেরে খাওয়ার সাহস করে না মানুষ, মানুষকে দংশনের সাহস করে না সাপ। এই যে সারাবেলা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াল নেহাল-রফিক, জঙ্গলে এত এত সাপের বসবাস, কই, একটা সাপ কি দেখা গেছে?

নেহাল বলল, এসব কি সত্যি কথা?

চোখজোড়া কপালে তুলে রফিক বলল, আশ্চর্য মানুষ তো ভাই আপনি! আমি মিথ্যা বললে রাতের বেলায় ঘুমের ঘোরে কালাপীর এসে একটানে আমার জিবটা টেনে ছিঁড়ে সমুদ্রের মাছেদের খেতে দেবেন না!

খিদায় পেট জ্বলছে দুজনের। হরিণের আশা বাদ দিয়ে তারা বাড়ির পথ ধরল। হাঁটতে হাঁটতে নেহাল বলল, জোহরের ওয়াক্ত হয়েছে, আপনি নামাজ পড়বেন না?

একগাল হেসে রফিক বলল, আমরা ভাই গরিব মানুষ, সারাদিন পেটের ধান্ধায় থাকি, নামাজ পড়ার সময় কোথায়?

দ্বীপের কোথাও তো মসজিদ দেখলাম না।

না না, মসজিদ আছে দুটি। তবে পাঞ্জেগানায় মুসল্লি তেমন হয় না। বোঝেন না, সবাই তো কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে। তবে জুমার নামাজে কিন্তু দুই কাতার পূর্ণ হয়।

নামাজ না পড়লে আল্লাহ শাস্তি দেবেন না?

কী যে বলেন ভাই! কালাপীর আছেন কী জন্যে? হাশরের দিনে তিনি নবীপাকের অনুমতি নিয়ে গেওয়া গাছের তক্তা দিয়ে মস্ত একটা নৌকা বানাবেন। সেই নৌকা আকাশে উড়তে পারে, জলে ভাসতে পারে, মাটিতে চলতে পারে। সেই নৌকায় চড়ে তিনি তাঁর ভক্তদের পুলসিরাত পার করে দেবেন।

বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নেহাল। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে, সূর্য যখন পাটে। দিনের ঘুমের কারণে রাতে আর ঘুম আসে না। বহু চেষ্টা করেও ঘুমাতে না পেরে সে বাইরে নামে। চাঁদ ধুয়ে দিচ্ছে চরাচরের অন্ধকার। সে হাঁটতে থাকে। রফিক তাকে বলেছে রাতের বেলায় মানুষ আর পশুপাখিরা যখন ঘুমায়, বন থেকে বেরিয়ে আসেন কালাপীর। রাতভর তিনি গ্রাম পাহারায় থাকেন। একবার ডাকাত ঢুকেছিল গ্রামে। কালাপীরের এমনই কেরামতি, পরদিন ভাড়ানি খালে পাওয়া গেল তাদের লাশ। সেই থেকে বাইরের চোর-ডাকাতরা এখানে আসার সাহস পায় না। কালাপীরকে এক নজর দেখার আশা জাগে নেহালের। হাঁটতে হাঁটতে সে দ্বীপের পশ্চিম মাথায় চলে যায়। ঘুরে আবার যায় পুব মাথায়। খানিক ভয় ভয় করে তার। সত্যি সত্যি কালাপীর যদি তার সামনে এসে দাঁড়ায়! ভয়টা চাড়া দিয়ে উঠলে এই বলে ভয় তাড়ায়, কালাপীর তো আর বাঘ-ভালুক নন যে দেখা মাত্রই তাকে গিলে ফেলবেন। রফিক তো বলেছে কালাপীর দয়ার সাগর।

নেহালের মনের কথা বুঝি টের পেয়েছিলেন কালাপীর। নইলে হঠাৎ করে চাঁদটা কোথায় গিয়েছিল? ধবধবে জ্যোৎস্নায় এমন অন্ধকার নেমেছিল কেন? অন্ধকারে পথ খুঁজে পাচ্ছিল না নেহাল। কোথায় নারিকেল বাগান, কোথায় চর কুকরী-মুকরী বাজার, কোথায় প্রাইমারি স্কুল, কোথায় ভাড়ানি খাল, কোথায় লঞ্চঘাট, কোথায় এবাদুলদের বাড়ি – কিছুই ঠাওর করতে পারছিল না। অন্ধকারে হাতড়ে কাটা ধানের মাঠে নেমে খড়ের একটা গাদায় শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিয়েছিল। সকালে ঘটনা শুনে এবাদুলের ছোট বোন লিপি তো হাসতে হাসতে সারা। বলেছিল, আপনি কি পাগল! রাতের বেলায় কেউ ঘর থেকে বের হয়? আহা, কী যে সুশ্রী ছিল লিপি! চৌদ্দো-পনেরো বছরের শ্যামলা তরুণী। প্রথম দিন বেড়ার ফোকরে বারবার উঁকি দিয়ে নেহালকে দেখছিল। কতবার যে উঁকি দিয়েছে হিসাব নেই। রাতে ভাত-তরকারির বাটি নিয়ে তার সামনে এলো। পরনে পুরনো সালোয়ার-কামিজ। বেগানা পুরুষের সামনে এসে কোনো দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। বাটিটা রেখেই নেহালের মুখের দিকে তাকাল। নেহাল তাকাতেই মুচকি হেসে ভেতরের ঘরে চলে গেল। কী যে ছিল সেই হাসিতে, বহু বছর হাসিমাখা মুখখানা সে ভুলতে পারেনি। মাস্টার্স শেষ করে রাশিদার প্রেমে না পড়লে হয়তো আরো বহু বছর মনে থাকত।

সম্পাদক ও চিফ রিপোর্টারের কথা শুনতে শুনতে খড়ের গাদায় কাটিয়ে দেওয়া রাতের কথা ভেবে নেহালের হাসি পায়। কত বোকাই না ছিল তখন! নিশ্চয়ই সে-রাতে মেঘে ঢাকা পড়েছিল চাঁদ। কিংবা সেদিন পূর্ণিমা ছিল না, নবমী বা দশমী ছিল। নবমী-দশমীতে তো সারারাত থাকে না চাঁদ। চাঁদ না থাকলে অন্ধকার তো নামবেই। অথচ সেই অন্ধকারকে কালাপীরের কেরামতি মনে করে কী ভয়ই না পেয়েছিল!

নেহাল বলল, আমি সরেজমিন যেতে চাই।

সম্পাদক বললেন, খারাপ হয় না। যাও, ঘুরে আসো।

লঞ্চ ঘোষেরহাট পৌঁছল পৌনে দশটায়। ঘাটে থামার সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠল নেহালের মোবাইল ফোন। অচেনা নম্বর। রিসিভ করতেই বলল, আপনি কি নেমেছেন? আমি চরফ্যাশন থানা থেকে, এসপি স্যার পাঠিয়েছেন।

সমর এতটা করবে আশা করেনি নেহাল। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, যাওয়ার পথে নয়, ফেরার পথে ভোলা হয়ে যাবে এবং তখন দেখা হবে। চর কুকরী-মুকরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা জানিয়ে সাবধানে থাকতে বলেছিল সমর। আর বলেছিল, এলাকার মানুষ নতুন একটা পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের দাবি জানাচ্ছে। একটা ফাঁড়ি তো আছেই, আরেকটা ফাঁড়ির আদৌ প্রয়োজন আছে কি না নেহাল যেন সার্বিক পরিস্থিতি অবজার্ভ করে তাকে জানায়। দুষ্টুমি করে নেহাল বলেছিল, আমি কি ব্যাটা পুলিশের লোক? ফাঁড়ির প্রয়োজন আছে কি নেই তার কী বুঝব আমি? সমরও কম যায় না। সে বলেছিল, তুমি তো খোকাবাবু, ফিডার খাও। সকালে তোমার জন্য ফিডার পাঠিয়ে দেবো এক বোতল।

একটা মাইক্রোবাস পাঠিয়েছে সমর। সঙ্গে ড্রাইভার ও দুই কনস্টেবল। নেহালকে নিরাপদে কচ্ছপিয়াঘাটে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ তাদের ওপর। ঘাটের এক হোটেলে চা-পরোটা খেয়ে গাড়িতে উঠল নেহাল। সাড়ে এগারোটার মধ্যে পৌঁছে গেল কচ্ছপিয়ায়। স্পিডবোট ঘাটেই ছিল, থানা থেকে ফোন করে আগেই ঠিক করে রাখা। ভাড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে এক কনস্টেবল বলল, ভাড়া লাগবে না স্যার।

কেন কেন?

আপনি ওঠেন তো স্যার। আমি দিয়ে দিচ্ছি।

না! একদম না! ভাড়া আমি দেবো।

কনস্টেবল হেসে বলল, ওকে স্যার। আমার নম্বরটি রাখুন। কোনো প্রবলেম হলে রিং দেবেন। আমি চর কুকরীর ইনচার্জকে আপনার কথা বলে রেখেছি।

এই তো সর্বনাশটা করলেন।

কেন স্যার?

পুলিশ প্রটোকলে থাকলে তো দ্বীপের পরিস্থিতির কিছুই বুঝতে পারব না। আপনি এক্ষুনি ফোন করে বলে দিন আমি যাচ্ছি না, জরুরি কাজে প্রোগ্রাম বাতিল করেছি।

কনস্টেবল তাই জানাল। কেননা স্যারের বন্ধুর কথা মানে তো স্যারেরই কথা। নেহাল বোটে উঠলে কনস্টেবল জানিয়ে দিলো যে, ফেরার দিনও তারা ঘাটে অপেক্ষা করবে এবং এই গাড়িতে করেই নেহালকে ভোলায় পৌঁছে দেবে। আপত্তি করল না নেহাল। কারণ কচ্ছপিয়া থেকে ভোলার দূরত্ব কম নয়, প্রায় দেড়শো কিলোমিটার। তাও ডাইরেক্ট কোনো বাস নেই। কচ্ছপিয়া থেকে অটোরিকশায় চরফ্যাশন, তারপর বাস। এত ঝামেলার চেয়ে মাইক্রোবাসই ভালো।

মাত্র পঁচিশ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছে গেল স্পিডবোট। ভাড়ানি খালে তখন জোয়ার। ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ঘাটে নামল নেহাল। তার মনে পড়ে, পঁচিশ বছর আগে এবাদুলের সঙ্গে ঠিক এ ঘাটেই লঞ্চ থেকে নেমেছিল। ঘাটে তখন দোকানপাট কিছুই ছিল না, এখন পাঁচ-সাতটা দোকান, পাকা মসজিদ, টিনশেড খারেজি মাদরাসা, মোবাইল কোম্পানির দুটি বিশাল টাওয়ার। রাস্তাঘাট তখন ছিল কাঁচা, এখন পিচঢালা। তখন যানবাহন বলতে ছিল শুধুই সাইকেল, এখন রাস্তা দখল করে আছে অটোরিকশার বহর। বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর ওপর ব্রিজটা হবে হবে করেও হচ্ছে না। হলে তো আর কথাই নেই, বাস-ট্রাক-লরি সব সাঁই সাঁই করে ঢুকে পড়বে।

হাঁটতে হাঁটতে রিসোর্টের গেটে আসে নেহাল। চারতলা বিশাল ভবন। স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপে এমন বিলাসবহুল রিসোর্ট থাকার কথা সে ভাবেনি। রিসোর্ট বুকিং দিয়েছেন পত্রিকার চরফ্যাশন প্রতিনিধি। ভালোমন্দ কিছু জিজ্ঞেস করেনি নেহাল। ভ্রমণে গিয়ে থাকা-খাওয়া নিয়ে তার এত ভাবনা নেই। রাত কাটানোর মতো একটা জায়গা আর বেঁচে থাকার মতো দুটো ডাল-ভাত হলেই তার চলে।

তাকে রুমে নিয়ে গেল কেয়ারটেকার। বিশাল কক্ষ। সেগুনের খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, টি-টেবিল, চেয়ার, সোফা, এসি – কী নেই? শুধু বিদ্যুৎটা নেই। তার বদলে সোলার প্যানেল। হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে বিদ্যুৎও পৌঁছে যাবে। নেহাল ভাবে, দেশটা আসলেই উন্নত হয়েছে। কোথায় কতদূরের বঙ্গোপসাগরের ছোট্ট দ্বীপ চর কুকরী-মুকরীতেও কি না আছড়ে পড়ছে উন্নয়নের ঢেউ!

ডাইনিংয়ে খাবার প্রস্তুত ছিল। খেয়ে রুমে ফিরে শুয়ে শুয়ে খানিকক্ষণ পাওয়ার অব মিথের কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে বেরিয়ে পড়ল এবাদুলের খোঁজে। বাড়িটা চিনতে অসুবিধা হলো না। শনের বদলে ঘরের চালে এখন টিন উঠেছে, কুপির বদলে বসেছে সোলার প্যানেল। উঠোনে দাঁড়িয়ে এবাদুলের নাম ধরে ডাক দিলো। ভেতর থেকে কারো সাড়া-শব্দ পেল না। রফিকের নাম ধরে ডাক দিলো। এবার দরজার একটা কপাট খুলে গেল। কপাটের আড়াল থেকে এক মহিলা জানাল, রফিক বাড়ি নেই। নেহাল ভাবল, মহিলা নিশ্চয়ই এবাদুলের বউ। না কি রফিকের বউ?

আপনি কি ভাবি? মানে এবাদুল ভাইয়ের ওয়াইফ?

জি। মহিলার ক্ষীণকণ্ঠের জবাব।

এবাদুলভাই কোথায়?

বরিশাল গেছেন, জালালপুরী মাওলানার ওয়াজ মাহফিলে।

নিজের পরিচয় দেয় নেহাল। পঁচিশ বছর আগে এই বাড়িতে আসার কথা জানায়। মহিলা নিশ্চুপ। নেহাল ভাবে, নিশ্চয় তার কথা ভুলে গেছে এবাদুলের বউ। যাওয়ারই কথা। পঁচিশ বছর কি কম সময়? এবাদুলের বউকে এক নজর দেখার খুব ইচ্ছে জাগে তার। সে কয়েক পা এগিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে এবাদুলের বউ খানিকটা পিছিয়ে যায়। ফলে আর আগায় না সে। লিপি কেমন আছে, বিয়ে হয়েছে কোথায়, ছেলেমেয়ে কজন ইত্যাদি জানতে চায়। ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয় মহিলা। নেহাল কিছু কথা শোনে, কিছু তার কান এড়িয়ে যায়। এড়িয়ে যায়, কারণ তার অবাক লাগে, বাইরে সে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে অথচ এবাদুলের বউ কি না একটিবার তাকে ভেতরে বসার কথা বলছে না! বাড়িতে পুরুষ কেউ নেই বলেই কি অচেনা মানুষকে ঘরে বসতে বলার সাহস পাচ্ছে না সে? হতে পারে। কিন্তু এমন তো ছিল না সে। নেহাল তো সেবার পাঁচদিন ছিল। এক রাতেও তো দরজার সিটকিনিটা লাগানো হয়নি। কী যে আন্তরিক ছিল এবাদুলের বউ! নিঃসংকোচে তার সামনে এসেছে, ভাত-তরকারি বেড়ে দিয়েছে, বাপের বাড়ির গল্প করেছে।

তখন উত্তরে-দক্ষিণে-পুবে-পশ্চিমে বেজে উঠল মাইক। অসংখ্য মসজিদে শুরু হলো আসরের আজান। এবাদুলের বউ জানাল, সে এখন নামাজে যাবে। এবাদুল কবে ফিরবে জানতে চাইল নেহাল। জবাব না দিয়ে চট করে কপাটটা লাগিয়ে দিলো এবাদুলের বউ। নেহাল আর দাঁড়াল না, উঠোন পেরিয়ে পাকা রাস্তায় উঠল। রাস্তাটা চলে গেছে পুবে বেড়িবাঁধের দিকে। সেদিকেই হাঁটতে লাগল সে। একটা নৌকা ভাড়া করে কালীর চর যাবে, যে-চরের জঙ্গলে একদিন রফিককে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিকেলটা ওখানেই কাটাবে। রফিক তাকে বলেছিল কালীর চরের বিকেল নাকি খুব মনোরম।

নেহাল বেড়িবাঁধে উঠলে সামনে দাঁড়াল একটা লোক। হাতে দুই হালি জ্যান্ত বক। বকগুলো নেহাল কিনবে কি না জানতে চাইল। নেহালের অনীহা দেখে বাজারের দিকে হাঁটা ধরল লোকটি। নেহালও আবার হাঁটা ধরে। পঁচিশ বছর আগের এমনই এক বিকেলের কথা মনে পড়ে তার। এক জেলে জঙ্গল থেকে একটা কোয়েল ধরে এনে বেড়িবাঁধে বসে তার পায়ে একটা সুতলি বাঁধছিল। কোয়েলটা চিঁচিঁ করে ডাকছিল আর মুক্তির আশায় ছটফট করছিল। নেহালের মায়া হলো খুব। সে বলল, পাখিটা কষ্ট পাচ্ছে ভাই, ছেড়ে দিন। নইলে কালাপীর গোসসা হবেন। মুহূর্তও দেরি না করে ছেড়ে দিলো লোকটা। তার মুখের দিকে তাকাল নেহাল। উড়ন্ত পাখিটার দিকে তাকিয়ে লোকটা হাসছে। চোখে-মুখে অনাবিল প্রশান্তি।

মাঝির সঙ্গে দরদাম ঠিক করে নৌকায় উঠে গলুইয়ে গামছাটা বিছিয়ে বসল নেহাল। মাঝিকে বলল প্রথমে যেন নারিকেল বাগান যায়, তারপর কালীর চর। মাঝি জানায় যে, ওই চরের নাম এখন চর জালাল। বছরপাঁচ আগে খোদ মাওলানা এনায়েত আলি জালালপুরী নিজের নামে এই চরের নাম রেখেছেন। নেহালের কৌতূহল জাগে। মাঝির কাছে সে জালালপুরীর কথা জানতে চায়। জালালপুরীর সংক্ষিপ্ত একটা পরিচয় দেয় মাঝি।

নৌকা চলতে থাকে। নেহালের চোখ খালের দিকে। পানিতে ভাসছে ডাবের অসংখ্য খোসা, মিনারেল ওয়াটারের বোতল আর চিপসের প্যাকেট। হায়! হায়! মাথা দোলায় আর আফসোস করে নেহাল। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা অন করে ছবি তোলে। মাঝি তাকে হুঁশিয়ার করে যে, সঙ্গে মোবাইল আনা উচিত হয়নি। দেখে মনে হচ্ছে দামি সেট। এনেছে যেহেতু পকেটেই রাখুক। দস্যু-ডাকাতদের তো বিশ্বাস নেই। মাঝির কথা গুরুত্ব দেয় না নেহাল। গলুইয়ে দাঁড়িয়ে সে ছবির পর ছবি তোলে।

সব ঘুরেটুরে ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে গেল। রাস্তাঘাট অন্ধকার। মোবাইল ফোনের টর্চই ভরসা। রিসোর্টের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার ধারে একটা ঘুমটি দোকান দেখে থামল নেহাল। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে খুব। ভেতরে সতেরো-আঠারো বছরের তরুণ দোকানি। উচ্চস্বরে কথা বলছে মোবাইল ফোনে। বাইরে বাঁশের মাচায় বসল নেহাল। ছেলেটার কথা শেষ হলে এককাপ চা দিতে বলল। পানি গরম ছিল। ঝটপট চা করে দিলো ছেলেটা। খেতে খেতে তার নাম জানতে চাইল নেহাল। ছেলেটা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। হয়তো কারো নম্বর খুঁজছে। খানিক পর মোবাইলটি ক্যাশবক্সে রেখে সে বাইরে তাকাল। নেহাল বলল, তোমার বাড়ি কি এখানেই?

তো উড়িচ্চর? রুখু গলায় পালটা প্রশ্ন করল তরুণ। নেহাল ভাবল, ছেলেটা হয়তো কারো ওপর রেগে আছে, ফোনে হয়তো এতক্ষণ তাকেই বকাঝকা করেছে। কাপ খালি করে মানিব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে বাড়িয়ে ধরে বলল, আচ্ছা, তুমি কি কালাপীরের নাম শুনেছ?

কালাপীর আবার কেডা? আগের মতোই ছেলেটার রুখু গলা।

মা-বাবার কাছে কালাপীরের নাম শোনোনি?

না। আমার বাবা ওসব পীর-ফকিরে বিশ্বাস করে না।

ছেলেটার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। নেহাল আর দাঁড়ায় না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। তারাভরা আকাশ। একটু পর ষষ্ঠদশী চাঁদ উঠবে। হঠাৎ পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। গায়ে শার্ট, পরনে লুঙ্গি, মুখে কালো দাড়িঅলা মধ্যবয়সী একটা লোক তার কাছে গ্যাসলাইটার আছে কি না জানতে চায়। নেহালের সন্দেহ জাগে। দোকানের সামনেই তো গ্যাসলাইটার সুতায় ঝোলানো, ওটা দিয়েই সিগারেট ধরাতে পারে লোকটা, তার কাছে চাইছে কেন? নিশ্চয়ই কোনো মতলবে আছে। তবু পকেট থেকে লাইটার বের করে তার সিগারেটটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সিগারেটে টান দিয়ে লোকটা ধোঁয়া ছাড়ে। তার যাওয়ার অপেক্ষা করে নেহাল। লোকটি নড়ে না। মনের সন্দেহটা দূর করে তার সঙ্গে আলাপ শুরু করে নেহাল। বলে যে, আজই সে ঢাকা থেকে এসেছে, চারদিন থাকার ইচ্ছা। তার কথার দিকে লোকটির খেয়াল নেই। ভাবটা এমন, নেহাল ঢাকা থেকে এসেছে, না দিল্লি থেকে এসেছে, তাতে তার কী?

নেহাল বলল, আপনার নামটা কি জানতে পারি?

ইলিয়াস। বলেই আবার সিগারেটে টান দিলো।

আচ্ছা ভাই, আপনি কি কালাপীরের নাম শুনেছেন?

বাপ-দাদার মুখে শুনেছি। বোগাস কথা।

বোগাস কথা!

তা ছাড়া কী? ওসব আগের দিনের গাঁজাখোরি গল্প।

পঁচিশ বছর আগে চর কুকরী-মুকরী ভ্রমণের কথা জানিয়ে নেহাল বলল, তখন তো এখানকার মানুষ কালাপীরের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা রাখত, তার নামে শিরনি দিত।

খানিক হেসে ইলিয়াস বলল, সেদিন কি আর আছে ভাইসাব? মানুষ এখন শিক্ষিত হয়েছে না?

নেহালের কানের কাছে মশারা ভনভন করে। আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না তার। ইলিয়াসের কাছে জানতে চায় সে চর কুকরী বাজারে যাবে কি না। ইলিয়াস বলে যে, সে ওদিকেই যাবে। দুজন হাঁটতে থাকে বাজারের দিকে। এশার আজান শুরু হয় মসজিদে মসজিদে। কথা বলতে বলতে তারা বাজারে পৌঁছে। নেহালকে অপেক্ষা করতে বলে মসজিদের দিকে হাঁটা ধরে ইলিয়াস। অপেক্ষা করে রিসোর্টে ফিরে গেল নেহাল। কেয়ারটেকারকে ডেকে নটার মধ্যে খাবার রেডি করতে বলে দিলো। কেয়ারটেকার জানাল যে খাবার রেডি, নেহাল চাইলে এখনি ডাইনিংয়ে গিয়ে খেয়ে আসতে পারে। দেরি করল না নেহাল। ডাল, করলা ভাজি, কোরাল মাছ আর দেশি মোরগ দিয়ে পেট ভরে খেল। একটা নৌকা ঠিক করে রাখতে বলেছিল কেয়ারটেকারকে। ভোরে ভোরে বেরোতে হবে কাল। দ্বীপের চারপাশটা একবার ঘুরে দেখবে। আবার কবে আসবে তার তো ঠিক নেই। আশপাশে দেখার মতো যত জায়গা আছে সবখানে যাবে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আসল কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। কেয়ারটেকার জানাল যে, মাঝির সঙ্গে সে পাকা কথা বলে রেখেছে। ভোর ঠিক পাঁচটায় সে ভাড়ানি খালের মুখে থাকবে।

ছাদে উঠে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল নেহাল। বারোটার আগে এসির জেনারেটর চালু হয় না। সারাদিনে মাত্র চার ঘণ্টা চলে এসি – রাত বারোটা থেকে চারটা। সারারাত জেনারেটর চালাতে গেলে অনেক তেল লাগে। তাতে পোষায় না। ঠিক বারোটায় রুমে ফিরে এসিটা ছেড়ে পাওয়ার অব মিথ নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসল। ২২০ পাতা পড়া হয়ে গেছে, আর মাত্র ১০০ পাতা বাকি, রাতেই শেষ করার ইচ্ছে। পড়তে পড়তে, রাত প্রায় দেড়টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙল সকাল সোয়া ছটায়। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অচেনা নম্বরের এগারোটি মিসডকল। নিশ্চয়ই মাঝির ফোন! খেয়ালই ছিল না মোবাইলটা যে সাইলেন্ট করা ছিল। উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। শান্ত-স্নিগ্ধ ভোর। মার্চের সূর্য ধীরে ধীরে তাতছে। শূন্যদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে। কে জানে কী ভাবে। হয়তো মাঝির কথা, হয়তো এবাদুল বা লিপির কথা। হঠাৎ তার দৃষ্টি যায় দূর দক্ষিণে ভোরের রোদে চিকিয়ে ওঠা সমুদ্রের দিকে। সাদা আলখাল্লা পরা একটা লোক হেঁটে চলেছে পানির ওপর দিয়ে। হাঁটছে তো হাঁটছেই। একটিবার পেছনে তাকাচ্ছে না। কে লোকটা? কালাপীর? নেহালের হাসি পায়। সব মনের ধন্দ। মন কত কী যে ভাবে! সেসব ভাবনা কি না দৃশ্য হয়ে চোখেও ভাসে!

খাটের কম্বলটা সরিয়ে পাওয়ার অব মিথ বইটা হাতে নেয়। নেড়েচেড়ে দেখে। দেখতে দেখতে হঠাৎ কী যে খেয়াল হয়, মোবাইলটা হাতে নিয়ে চরফ্যাশন থানার সেই কনস্টেবলের নম্বরে ফোন দেয়। ভেবেছিল এত তাড়াতাড়ি বুঝি জাগেনি কনস্টেবল। না, রিসিভ করল সে। নেহাল জানাল যে, সাড়ে নটা নাগাদ সে কচ্ছপিয়াঘাটে থাকবে, সম্ভব হলে মাইক্রোবাসটি যেন পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তারপর ব্যাগটা গুছিয়ে মুখ ধুয়ে ডাইনিংয়ে গিয়ে নাস্তা করল। বিলের কাগজ রেডি করতে বলল কেয়ারটেকারকে। কেয়ারটেকার ভেবে পায় না চারদিন থাকার কথা বলে দ্বিতীয় দিনেই কেন ফিরে যাচ্ছে নেহাল। মনের মতো সেবা পায়নি বুঝি! সে খানিক ঘাবড়ে যায়। সাংবাদিক মানুষ নেহাল। যদি রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ করে, তখন চাকরিটা থাকবে কি না সন্দেহ। শঙ্কিত গলায় সে বলল, কিন্তু স্যার, মাঝি তো বসে আছে, ঘুরতে যাবেন না?

না। নেহালের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

সাড়ে আটটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল নেহাল। কনস্টেবল মাইক্রোবাস নিয়ে যথাসময়েই হাজির। ভোলায় পৌঁছল প্রায় তিনটায়। বাসায় তার জন্য অপেক্ষা করছিল সমর। সেও খুঁজে পাচ্ছিল না এত তাড়াতাড়ি নেহালের ফিরে আসার কারণ। নেহাল বাসায় ঢুকতেই সে কারণটা জানতে চাইল। উত্তর না দিয়ে নেহাল তার প্রচণ্ড খিদের কথা জানাল। সমর কি আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করে! বন্ধুকে নিয়ে সোজা ডাইনিং টেবিলে চলে গেল। খেতে খেতে নেহাল বলল, একটি নয় সমর, চর কুকরী-মুকরীতে অন্তত আরো তিনটি পুলিশ ফাঁড়ির প্রয়োজন।