কালিদাস কর্মকারের রাগ ক্ষোভ ভালোবাসাময় জীবন

স্বাধীনতা-স্বাধিকার-মানবতার শিল্পী কালিদাস কর্মকারের প্রয়াণে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যথিতই শুধু হইনি; রিক্ত হয়েছি। হারিয়েছি ছাত্রজীবন থেকে এযাবৎকালের প্রিয় অভিভাবককে। তিনি নিমগ্নতার শিল্পী। তাঁর শিল্প কতটা মননশীল, পাওয়া যায় তাঁর কথায়-কাজে। একবার তিনি আদরের ভাঁজে ভাঁজে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের মানুষের মন পলির মতোই নরম। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার লড়াই, বঞ্চনার শিকার এই মানুষের মন মরে যাচ্ছে। কিন্তু এত অস্থিরতার পরেও শেষ পর্যন্ত সেই মানুষ জেগে উঠছে তার স্বকীয়তায়। তার আদি চরিত্রে। জীবনের এই কথাই তুলে আনতে চেয়েছি আমার এতদিনের প্রদর্শনীগুলোতে। এবারের ‘পাললিক প্রাণ-মাটি-প্রতীক’ শীর্ষক এ-প্রদর্শনীতে সেই দীর্ঘ যাত্রারই একটি চলমান প্রয়াস।’

কথার মতো তাঁর চিত্রেও আবহমান বাংলার রূপবৈচিত্র্য ধরা পড়েছে। উচ্ছ্বাস, বেদনা, স্মৃতি, একাকিত্ব নিয়ে শিল্পীর এ-পাললিক যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। আজ নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারের মতো করে বলতে ইচ্ছে করছে – ‘কালিদাস সবসময় চমক দিতে পছন্দ করেন। নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন। ক্যানভাসে এক ধরনের রহস্যময়তা সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তিনি তাঁর চিত্রকর্মে মানুষের যাত্রাকে গুরুত্ব দেন না। বরং প্রত্যাবর্তনকে গুরুত্ব দিয়েছেন।’ সেই হিসেবে কালিদাস আবার ফিরে আসবেন। ২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি তাঁর বাহাত্ততম জন্মদিন উদ্যাপন করেন দেশি বাদ্যযন্ত্রের সুরের সঙ্গে আর বিশাল ক্যানভাসে ৭২ মিনিটে ছবি এঁকে খোলা মঞ্চে দর্শকদের সামনে। কত স্মৃতি! তেমন কালিদাস কর্মকারের শিল্পপ্রণয় অনন্তকাল বিজয়ের আবহমান হয়ে থাকবে বলেও আমি বিশ্বাস করি। কিছুদিন আগের কথা। বাহাত্তরে পা রাখার পর শিল্পী কালিদাস কর্মকারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে নতুন কয়েকটি কাজ সম্পর্কে বলেন, দেখান নিজের অলৌকিক কয়েকটি কাজও। সেই শুভ দিনটিতে দেশি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সুরের ছন্দে বিশাল ক্যানভাস রাঙিয়েছিলেন তিনি। ৭২ মিনিটের সেই সুরের মূর্ছনায়, রেখার গতিময়তায় স্পন্দিত হয়ে উঠছিলেন শিল্পী। সুরের ছন্দময়তায় ক্যানভাসে তাঁর রেখার গতি যেন পালটে যাচ্ছিল। কিন্তু সব রেখাই পূর্ণতা পাচ্ছিল মানুষের মুখের আকৃতি নিয়ে, কখনো ছন্দোবদ্ধ বিন্যাসে, কখনোবা পাখি। আর ওই মাহেন্দ্রক্ষণটি উন্মুক্ত মঞ্চে উপস্থিত দর্শকরা অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করেন অন্যরকম মুগ্ধতায়।

শিল্পী কালিদাস কর্মকারের জন্মদিন উপলক্ষে ‘পাললিক ছন্দ’ নামে যুগলবন্দি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর। আহা! সে কি মুগ্ধতা! শুদ্ধতা! এমন শুদ্ধতার পথে অগ্রসর হতে হতে তিনি বলেছিলেন, ‘শিল্প তখনই সমৃদ্ধ হয় যখন তা অন্য মাধ্যমগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করে।’ সে-কারণেই গানের সুরে তবলার বোলের সংযোগে এই প্রয়াস। জন্মদিন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারে ঘটা করে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ নেই। তারপরও কেউ উদ্যাপন করলে ভালো লাগে।’ আমার কাছে মনে হয়েছে – সত্যিই তিনি সবসময় চমক দিতে পছন্দ করেন। নানা মাধ্যমে কাজ করেন এই শিল্পী। ছবি আঁকার পাশাপাশি অন্য কাজও করেন। তাঁর ছবিও বৈচিত্র্যময়। অলৌকিক ছবি আঁকেন। ক্যানভাসে এক ধরনের রহস্যময়তা সৃষ্টি করেন। ক্রমাগত তিনি নতুনভাবে কাজ করতে চান। সবসময় নতুন কাজে উন্নতি ও পরিবর্তন লক্ষ করি আমরা। তিনি মানুষের যাত্রাকে গুরুত্ব দেন না। বরং প্রত্যাবর্তনকে গুরুত্ব দেন। শিল্পীর সব প্রদর্শনীর সঙ্গে ‘পাললিক’ শব্দটি জড়িয়ে থাকে। পলিমাটির এই দেশ তাঁর চিন্তায় মিশে থাকে সবসময়, তারই প্রকাশ এই শব্দের মধ্য দিয়ে। তিনি এমন এক শিল্পী যিনি চিত্রকলার সব ধরনের টেকনিক রপ্ত এবং তা ক্যানভাসে ব্যবহার করতে চান। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের একজন শিল্পী তিনি।

একজন পরীক্ষিত শিল্পী হিসেবে আলাদা করে আজো একক অবস্থান ধরে আছেন কালিদাস কর্মকার। সুনিপুণ শৈল্পিক দক্ষতায়, দার্শনিক মনোভাব, দুঃসাহসিক গতানুগতিক উপকরণ এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সকলকে মুগ্ধ করেছেন তিনি। কালিদাস কর্মকার একজন সুনিপুণ গ্রাফিক শিল্পীও। তিনি ফরাসি একাধিক রঙের শিল্পকর্মের (সান্দ্রতা প্রক্রিয়া) মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে বিশ্বখ্যাত শিল্পী এস ডবিস্নউ হেটারের সঙ্গে, যিনি ১৯৩০ সালে প্যারিসের আটলায়ার-১৭-তে সান্দ্রতা কৌশল আবিষ্কার করেন। তাঁর ছবির শেকড় গাঁথা এ-জনপদের মাটিতে। এ-ভূখ–র যাপনপ্রণালি, নানা ধর্মের সমন্বয়, লোকশিল্পের নানা প্রতীক উপাদান হিসেবে এসেছে তাঁর চিত্রকলায়। ছবির অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে তাবিজ-কবজ আর কড়ি। কাগজের ম–র পটভূমিতে কখনো ধরা পড়েছে মুক্তিযোদ্ধার যন্ত্রণাকাতর হাতের ইঙ্গিত। পাশাপাশি আবহমান বাঙালির জীবনের গল্প বলে চলে তাঁর ছবি।

একথা সত্য যে, জীবনময় বৈচিত্র্য পছন্দ করতেন শিল্পী কালিদাস কর্মকার, যে-কারণে তাঁর একটি প্রদর্শনীর উদ্বোধনী পর্ব শুরু হয়েছিল দেশি বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন কিছু। রঙে, তুলির আঁচড়ে, রেখার টানে শব্দ যেন শরীর পেল। কবিতা আবৃত্তির আশ্রয়ে ছবি আঁকলেন তিনি। আবৃত্তিশিল্পীরা একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করলেন আর কালিদাস কর্মকার তার সঙ্গে রাঙালেন ক্যানভাস। এখানেই শেষ নয়, জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত কালিদাস কর্মকারের ‘পাললিক প্রাণ, মাটি ও প্রতীক’ শীর্ষক সেই শিল্পকর্ম-প্রদর্শনীর সমাপনী আয়োজনে ‘কবিতার ছন্দ ও রেখাঙ্কন’ শিরোনামে এই ভিন্ন ধাঁচের আয়োজন ছিল। আয়োজনটি শিল্পরসিকদের মন কাড়ে। অনুষ্ঠানে আরেক আকর্ষণ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি শোনান তিনি। এছাড়া আবৃত্তিতে অংশ নেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাস্কর রাশা, ডালিয়া আহমেদ, সাবেক সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস ও সামিউল ইসলাম পোলাক। শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ সরকারসহ বিভিন্ন কবির কবিতা পাঠ করেন। এ-কথা সত্য প্রমাণ করেছিলেন যে, ‘কালিদাস শিল্পী হিসেবে বাঙালি জাতির গৌরব। তাঁর ছবি একইসঙ্গে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মাত্রাকে স্পর্শ করে। চিত্রকর্মের সঙ্গে পারফর্মিং আর্ট যুক্ত হয়ে এ প্রদর্শনী ভিন্নমাত্রা অর্জন করেছে। এ শিল্পী শিল্পের সব শাখাকে সমন্বয় করে নতুন কিছু যোগ করছেন। তাঁর এই নিরীক্ষাধর্মী কাজই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁকে পরিচিত করে তুলেছে।’

কালিদাস কর্মকার বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী যিনি নিরীক্ষাধর্মিতার জন্য বিখ্যাত। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। শৈশবেই তিনি আঁকতে শুরু করেন। স্কুলজীবনশেষে ঢাকা ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস থেকে তিনি ১৯৬৩-৬৪ খ্রিষ্টাব্দে চিত্রকলায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীকালে কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট থেকে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান নিয়ে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতার ঘরানার শিল্পী। বরেণ্য চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হলে তিনি বলেছিলেন – ‘আমি শিল্পকে সাধনা ভাবি, যেমন দেশকে ভাবি মা।’ হয়তো এ-কারণেই তাঁর রাগ ছিল রাজনীতির অন্ধকার নিয়ে, ক্ষোভ ছিল দুর্নীতি নিয়ে আর ভালোবাসা ছিল সম্ভাবনা নিয়ে।

আমার শিল্পিত পথচলায় কেবলই মনে হয়েছে যে, কালিদাস কর্মকারের শিল্পকর্ম যেন যন্ত্রণাকাতর এক যাত্রা। যার উদ্দেশ্য সুন্দরকে স্পর্শ করা। সেই যাত্রা যন্ত্রণাদীর্ণ মানুষের দিকে, সেই যাত্রা শিল্পের দিকে, সেই যাত্রা সভ্যতা সৃষ্টিময়তার দিকে। তাঁর অ্যাক্রিলিক, মিশ্রমাধ্যম, গোয়াশ, কোলাজ, ওয়াশ, মেটাল কোলাজ, ড্রইং, ডিজিটাল লিথো, মিশ্রমাধ্যমের স্থাপনা শিল্প-প্রত্যয়ে অগ্রসর হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে আমার মতো অসংখ্য তরুণকে। যে কারণে আমি বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি শিল্পে-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে এবং রাজনীতিতে। বারবার মনে হয়েছে, এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে ছাড়িয়ে অনেক দূর। এই যাত্রাপথে তিনি যতবার আমাকে দেখেছেন, বলেছেন – নোংরা রাজনীতিকে ধুয়ে-মুছে সাফ করতে হলে শিল্পী প্রয়োজন। অতএব, বাংলাদেশ শিল্পের রাজনীতিতে শিল্পীর রাজনীতিতে তৈরি হতে পারে যদি দিনরাত এক করে লেগে থাকা যায়। প্রায় একই কথা বলেছেন বরেণ্য রাজনীতিক, আমার প্রিয় অভিভাবক প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক ও রাজনীতিক-কলামিস্ট জেডএম কামরুল আনাম।

মানুষ চলে যায়; থেকে যায় স্মৃতি-কথা আর কর্ম।  কালিদাস কর্মকারের নানা ধরনের পাথর, কড়ি, প্রবাল, লাভা খ-, পোড়া কাগজ, মুক্তা, বিভিন্ন ধরনের কোরাল, কাচ প্রভৃতির দ্বারা ব্যতিক্রম কাজগুলো ভিন্ন নান্দনিকতা সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে রহস্যময়তায় আবদ্ধ করে শিল্পরসিকদের। স্মৃতিকাতর আমি শিল্পী দিলীপ দাসের ক্ল্যারিওনেটের সুরে যেমন হারিয়ে যাই, তেমনি মুগ্ধতায় ডুবে যাই তাঁর শিল্পের অতলে। বাংলাদেশের মানুষ সংস্কৃতি রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছে। এখনো শিল্পের জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে। দেশে বারবার সংস্কৃতির ওপর আঘাত এসেছে, মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপর আঘাত এসেছে। কিন্তু সংস্কৃতির প্রতি আমাদের তীব্র ভালোবাসা ও সাহস শিল্পের অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারেনি। হয়তো এ-কারণেই মনে হয়েছে – তাঁর মাঝে এক ধরনের যন্ত্রণাবোধ রয়েছে। তাঁর ছবির ভাষা, উপকরণ, রঙের ব্যবহার – সবকিছুই নান্দনিক। কিন্তু নান্দকিতার চাইতে তাঁর মাঝে যন্ত্রণাবোধটাই বেশি কাজ করে। সেটা সৃষ্টিশীলতার যন্ত্রণা।

তাঁর মতে, ফরাসি দেশে শিল্প বিপস্নব ঘটেছে। বাংলাদেশে তেমনটা দেখা যায় না। আমরা যদি সব শিল্পের সম্মিলন ঘটাতে পারি তবে তা নতুন কিছু সৃষ্টি করবেই। এভাবেই বাংলার শিল্পধারা
বৈশ্বিক মাত্রা পেতে পারে। আর তাতে করে আলোকিত হবে বাংলাদেশ। যে-বাংলাদেশ স্বপ্নবীজ বুনেছে ষাটের দশকে, সেই  বাংলাদেশের আলো-মানুষকে নিয়ে বলতে চাই, যেহেতু ষাটের দশক হলো সোনালি অধ্যায়। ওই সময়টাতে আমরা জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক জাগরণসহ সার্বিক জাগরণ পেয়েছি, যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ওই আন্দোলনের আসল নায়ক জনসাধারণ, যাদের নাম ইতিহাসে লেখা হয় না। কিন্তু তাদের কথা বলার
জন্য কেউ না কেউ তো আছেই। শিল্পে-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এমন আলো-মানুষ শিল্পী কালিদাস কর্মকারের হঠাৎ চলে যাওয়া আমাকে কেবল ব্যথিতই করেনি; করেছে অভিভাবকশূন্যও।

যে-অভিভাবক বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছবি এঁকে মুগ্ধতা তৈরি করেছেন। যখন দেখেছিলাম এক আয়োজনে – মঞ্চে এলেন দুজন বাঁশিবাদক আর দুজন ঢুলি। একজন বাঁশিবাদক সুর ধরলেন – ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’। পরিবেশনা শেষ হতেই শুরু হলো ঢোলের তাল। এরই মধ্যে
প্রস্ত্তত শিল্পী কালিদাস কর্মকার। বিশাল ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করলেন রং দিয়ে। তুলির ব্যবহার ছাড়া হাতে রং তুলে নিয়ে ক্যানভাসে ছিটিয়ে শুরু হলো তার আঁকা। কালিদাস কর্মকার অবশ্য বলেছিলেন, ‘শিল্প তখনই সমৃদ্ধ হয় যখন তা অন্য মাধ্যমগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করে। সে কারণেই গানের সুরে ঢোলের তালের সংযোগে এই প্রয়াস। আমাদের পরিবারে ঘটা করে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ নেই। তারপরও কেউ উদ্যাপন করলে ভালো লাগে।’

শিল্পে আধুনিকতার বড় সুবিধা হলো, আমরা যেভাবেই তাকে দেখি, প্রকাশ করি শিল্পসম্মত ভাব ও উপস্থাপনা করা হলে এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও শিল্প-পদবাচ্য বলতে কেউ দ্বিধা করবেন না। চারুশিল্পের দৃশ্যচিত্রের ক্ষেত্র বেড়েছে, উপাদান প্রয়োগও বিসত্মৃত হয়েছে। গত শতকের আশির দশক থেকে আমাদের চিত্রকলায় দেখতে পাচ্ছি চিত্রপটে রং ছাড়াও নানা উপাদানের সংযুক্তি। শিল্পী কালিদাস কর্মকার এক্ষেত্রে অগ্রণী। তাঁর ক্যানভাসে আমরা বরাবর দেশীয় অনেক উপাদানের সংযুক্তি দেখি। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখেছি – তিনি পাললিক বাংলার বিষয়-আশয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, ছবি আঁকছেন। বাংলা ব-দ্বীপ গড়ে উঠেছে হাজার বছর ধরে নদীবাহিত পলিমাটি জমে-জমে। এজন্যই আমাদের দেশের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাললিকতা। এই সত্যটি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন শিল্পী কালিদাস কর্মকার। কৃষিভিত্তিক এই দেশের সর্বংসহা
মাটির বৈচিত্র্যময় রূপ আর তার শরীরে প্রোথিত ফলবান বীজ থেকে বৃক্ষের উদ্গম, মাটির বুকে নানা আচার-অনাচার, আরোপ-বিলোপের সবকিছু যেন উঠে আসে কালিদাসের চিত্রপটে। চলমান এ-সময়ের জটিল ও বিচিত্র মানবিক সম্পর্কের ভাষা মূর্ত হয়ে ওঠে শিল্পী কালিদাসের ছবিতে। তাঁর ছবির শেকড় প্রোথিত এ-জনপদেরই মাটিতে। এ-ভূখ–র জীবনযাপন প্রণালি, নানা ধর্মের সমন্বয়, লোকশিল্পের নানা প্রতীক উপাদান হিসেবে উঠে এসেছে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের চিত্রকলায়। তাঁর চিত্রকলায় এ-জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন আন্দোলনের অনুষঙ্গে এসেছে তাবিজ, কবজ আর কড়ি। কাগজের ম–র পটভূমিতে কখনো চকিতে ধরা পড়েছে মৃত্যুমুখে পতিত মুক্তিযোদ্ধার যন্ত্রণাকাতর হাতের ইঙ্গিত। শিল্পী কালিদাসের চিত্রকলায় এসেছে আবহমান বাঙালির টোটেম বিশ্বাস। যুগ-যুগান্তরের পূর্বপুরুষের শ্বাস-প্রশ্বাস যেন ছড়িয়ে আছে তাঁর চিত্রপটে। শিল্পীর উচ্ছ্বাস, অভিব্যক্তি, শুদ্ধতা, বেদনা, স্মৃতি আর একাকিত্ব – এ সবকিছু নিয়েই যেন তাঁর এই পাললিক অনুভব। যে-যোদ্ধার জীবন কেবল লোভ-মোহহীনই নয়, ত্যাগের মহিমায় আলোকিত, এমন যোদ্ধা জীবন ছিল একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারের। তিনি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন দেশ-মাটি-মানুষ-শিল্প ও সাধনা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চিত্রশিল্পী তাঁর চিত্রকর্মে আবহমান বাংলার স্বরূপ প্রকাশের পাশাপাশি নিরীক্ষাধর্মী শিল্পকর্মের জন্য শিল্পীমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছেন। তাঁর কর্ম নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে। দেশে আধুনিক চিত্রকর্মে কালিদাস কর্মকার অন্যতম এক নাম। ১৯৪৬ সালে বৃহত্তর ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কালিদাসের বাবা হীরালাল কর্মকার ও মা রাধারানী কর্মকার। শৈশব থেকেই তিনি চিত্রকলার সঙ্গে যুক্ত। একসময় ভর্তি হন তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউটে। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান নিয়ে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশ-বিদেশে আয়োজিত শিল্পী কালিদাসের একক চিত্র-প্রদর্শনীর সংখ্যা ৭২টি। ভারত, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চতর ফেলোশিপ নিয়ে সমকালীন চারুকলার নানা মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি একুশে পদক, শিল্পকলা পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। নির্মাণ করেছেন স্বকীয় অবস্থান। আজ যদিও তিনি নেই, আছে তাঁর কাজ। রয়ে যাবে হাজার বছর পরাবাস্তব আঙ্গিকে নিসর্গ ও জনপদ পুনর্নির্মাণ; জলরঙে অনবদ্য পরাবাস্তব নিসর্গ ও নগরদৃশ্য কিংবা নারীচরিত্র। আর এসব দেখে কেবলই মনে হয়েছে – তাঁর সকল কাজে জীবন ফিরে পাওয়া আমাদের রাজনীতি-রাজপথ থাকবে বিনয় আর ভালোবাসার দখলে …।