কালি ও কলমে প্রকাশিত রবিউল হুসাইনের কয়েকটি কবিতা

মানুষ কী অসামান্য প্রাণী

অনর্থ এই সময়ের সাবলীল স্রোতে বয়ে যায় নিঝুম দুপুর,
নিঃসঙ্গ আর্তনাদে চারিদিক মগ্ন-দগ্ধ, তুমুল উত্তাপে অসহায়
জনপদ পুড়ে যায় নগরীর দাপটে, ব্যক্তিবর্গ অহঙ্কার-অসুখে
মহামারি-আক্রান্ত, প্রতিটি মানুষের বাহুমূলে জমেছে নোনা
ঘাম বিন্দু বিন্দু সমুদ্রের বৃষ্টি সফেন, এইভাবেই অপরাধ
জমা হয় গোপন বিচারে, আকাশ থেকে নেমে আসে ওই
সহস্র রাতের কাহিনি Ñ বোবাকান্না, কী ছিল সেই শূন্য সংসারে,
পরিপূর্ণ জলে কীসের সাঁতার, শুধু শুধু ভেসে থাকা যেহেতু
নিজস্ব পুকুরে কোনওভাবেই ডোবা যায় না, উদ্বাহু ঝাঁপ দিয়ে
অন্যের জলে জলকেলি খুবই সহজ ক্রীড়া, জলের নীরব চিৎকার
জলহীনতার ঢেউয়ে ঢেউয়ে, সত্যিই মানুষ কী অসামান্য প্রাণী,
মানুষের মৃত্যু হ’লে কেউ না কেউ বুক চাপড়িয়ে কাঁদে আর
বাতাসকে দায়ী করে। শোকের মধ্যে মানুষের মাথার ওপরে
এক ধরনের পাথর এসে পড়ে, কেন্দ্রত্যাগী যারা অদৃশ্য ছিল
তারাই আজ চুপি চুপি সামনে এসে দাঁড়ায়। সামনের অগাধ
সময়ের অভ্যন্তরে প্রকৃত সময় খুঁজে বেড়ায়, গাছের সামনে
এসে হাঁটু ভেঙে মাথা নিচু করে প্রার্থনা করে Ñ হে বৃক্ষশ্রী
তুষারের মধ্যে জলের যে-রূপ দেখা যায় প্রকৃত জলের সঙ্গে
তার কী প্রভেদ কিংবা বৃষ্টির সঙ্গে শিশিরের, পাতার সঙ্গে
শিকড়ের, বাতাসের সঙ্গে স্মৃতির, বেদনার সঙ্গে সূক্ষ্ম বোধের,
পরিপূর্ণতার সঙ্গে গভীর জলাশয়ের, মানুষ যেহেতু নিজেকে
কিছুতেই জানতে পারে না তাই তার জীবন চিরকাল উদ্দেশ্য আর
উদ্দেশ্যহীন হয়েই থেকে গেল Ñ এই চিরাস্তিত্ব বন্দোবস্তের মাঝে
তাকে আজীবন মরণের পরেও রয়ে যেতে হবে। নিজেকে বারবার
বদলিয়ে বদলিয়ে সাবানের মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় আর শূন্যে
ভাসে বৃত্তাবদ্ধ বুদ্বুদ্গুলো। তার মধ্যে মানুষের অবিশ্বাসী
মন বিশ্বব্রহ্মা-ের অলীক রামধনু রং প্রজাপতির পাখা
হ’য়ে আকাশময় অসংখ্য উড়ে যেতে থাকে অন্ধকারের ভেতরে।

জুন ২০০৪

মানুষের মন সেই বিশ্বব্রহ্মা-

মানুষের জন্ম কিংবা মৃত্যু বাতাসবাহিত পরম নিঃশ্বাসে
ওই যে ঠেলাগাড়ি তার পিঠে পুরনো আসবাবপত্র জীর্ণ বিশ্বাসে
মলাট-ছেঁড়া বই-পত্তর সাময়িকী কবেকার কল্পকাহিনি মাননীয়
মালিকের ছেলেমেয়ে পাড়া-পড়শি আত্মীয়-কুটুম সব দেখে যাবতীয়
বিবর্ণ আকাশে চাঁদ-তারা গ্রহ-নক্ষত্র-সূর্য অবিরত ঘুরে ঘুরে নিঃশব্দে
শূন্যতার ভেতর ভাসমান ওজনহীন ঐশ্বর্যে নিজস্ব জগতের শূন্যদ্বন্দ্বে
মানুষের মন সেই বিশ্বব্রহ্মা- কিছু স্বপ্ন বিশ্বাস দুঃখ ওই গ্রহ-নক্ষত্র
ঘূর্ণায়মান একই পথে আবিষ্কারহীন ভিন্ন-ছিন্ন ছড়ানো-ছিটানো সর্বত্র
এইভাবে জীবন আলোমুখী সূর্যের বিশুদ্ধ ছায়ায় আসে নিজস্বতায়
আঁধারময় অখ- সময়ে বুকে হাত দিয়ে জেনে যায় স্বপ্নশূন্য নির্মমতায়

ফেব্রুয়ারি ২০১০

ছয়টি চার পঙ্ক্তির পদ্য

এক.
নিজের আমার কিছুই নেই
ব্যক্তিত্বহীন আমি-র
দেহ তৈরি পিতামাতার
মনটি অন্তর্যামীর

দুই.
পরিখাটি চারিদিকে
প্রাচীর প্রাসাদ ঘিরে
তবু আসে শত্রু
বারে বারে ফিরে

তিন.
মাঝরাতে বাজ পড়ে
ঠাঠা Ñ বিদ্যুতায়িত
কর্ণকুহরে পৌঁছুলেই
সবকিছু সত্যায়িত

চার.
পাঁচমিশালি পাঁচে নয়
অগণন তার সংখ্যা
হয়তো দুই-তিনে মেশে
নেই কোনো ব্যাখ্যা

পাঁচ.
আকাশে মেঘ নেই
তবু নামে বৃষ্টি
ঝরঝর ঝরে যায়
এ কী অনাসৃষ্টি

ছয়.
পিপাসায় বুক ফাটে
আকাশে জল নেই
মেঘ শুকিয়ে তুলো
শুধু আকাশগঙ্গা নামেই

মে ২০১৫

জলের ভেতর মেঘ ডাকে

আজকাল তপোবনে বসে কেউ ধ্যান করে না, কাছেই জলাশয়,
জলে মাছ সাঁতরায় জলজ গাছ-গাছালি লতা-পাতায়, শুধু
মানুষের নিঃস্ব নিঃশ্বাস দূরে, আকাশ হাঁটু ভেঙে সেই ভঙ্গিতে
মুখ ডুবিয়ে তৃষ্ণা নেভায় যেমন করে মানুষেরা জলপান করে,
একটু কাছে এলেই গেরো খুলে যায়, সব এলিয়ে পড়ে যত্রতত্র,
মাটিতে আছাড় খেলে ব্যথা লাগে না, আঘাতটি পাখি হয়ে ওড়ে।
এপাশে পিঁপড়ের সারি, তারা একটি ফড়িংয়ের লাশ বয়ে নিয়ে কোথায়
যে যাচ্ছে কেউ বলতে পারে না, তবে মেঘের মধ্যে জল-পিঁপড়েরা বাস করে,
তারাই মূলত দায়ী বৃষ্টি-বাদলের, মানুষের সঙ্গে জলের অনেক পার্থক্য,
জলের ভেতর মানুষ ডুবে মরে যায়, যদিও তার আগে সাঁতার কাটে,
কিন্তু শেষে কোনো লাভ হয় না, নিচে তলিয়ে যায় অনায়াসে, অন্য
দিকে মানুষের মধ্যে জলের কিছুই হয় না, জল মানুষকে ধুয়ে ভিজিয়ে
দেয়, সুখে-দুঃখে বিষণœতায়, নাভিতে কস্তুরী মিশালে রাস্তা পরিষ্কার হয়,
আর পাতালের ঝর্ণাধারায় জলপ্রপাতের শব্দ শোনা যায়, দৈবাৎ
কেউ খুশি হলে দুঃখরা দুঃখিত হয়, সারাদিন বিফলে যেতে যেতে
বিকেলে শরীরের সঙ্গে অন্যের শরীর যোগ করলে গণিতশাস্ত্র হাসে,
নিমেষে অবমুক্ত হলে পাখিরা ডানা ভেঙে পড়ে যায়, বাতাসের গলিতে
খুব সস্তায় বিভিন্ন ধরনের ফল শাকসবজি বিক্রি হয়, তবে দাম অনেক,
আজ কোনো বারে পড়ে না খঞ্জ ভিখিরি হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বহুবার
পথ পাড়ি দেয়, আশেপাশে কেউ নেই, তবে অনেকের ভিড় এড়িয়ে
একাকী হওয়া যায় না, ইলেকট্রিক যদি বিদ্যুৎ হয় তবে কম্প্যুটার
বৈদ্যুতিন, মাথার ভেতর আকাশের ব্যাপ্তি, সমুদ্রের গভীরতা,
সেখানে হিমালয়ের পাঁচ মাইল উঁচু পাহাড়ও ডুবে ডুবে ম্লান
করে, মাথাটি উঁচু না করেও মাছের সঙ্গে সাঁতারে যায়, লতা-গুল্মে
জড়িয়ে জড়িয়ে খাবি খায় আর তখনই জলের ভেতর মেঘ ডাকে
বিদ্যুৎ চমকায়, মানুষ ভয় পায়, আসলে মানুষের কোনো বিশ্বাস
নেই, তারা যে-কোনো মুহূর্তে জন্মায়, মৃত্যুবরণ করে আর প্রতিবাদ
করতে করতে শূন্যতায় জলমগ্নতায় নিজেকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ বাধায়

আগস্ট ২০১০

নদী ও কবিতা

এদেশের মানুষ উর্বর পলিমাটি তাদের বুকের ওপর দিয়ে আকুল
নদীগুলো সাগরের দিকে বয়ে চলেছে কুলকুল উন্মূল
কূলে কূলে শস্যাদি ফসল ফলফুল প্রজাপতি দূরে
রঙিন পাখা মেলে ওড়ে বাতাসের শূন্য পরিসরে

ডানায় ডানায় প্রতিসাম্যের বর্ণালী চিত্রকলাসম্ভার
কারা এইসব সৃষ্টির মৌলিক শিল্পী এত যে অপূর্ব অভিন্নতার
প্রতিটিই স্বয়ংসম্পূর্ণ অথচ ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে অসাম্যের
সমন্বয়ে অনন্য নির্মল নিয়মে নদীগুলোও প্রাকৃতিক অর্জনের

বন্ধনে বাঁধা প্রতিটির পরিচয় কী যথাযথ নামের পরিপূর্ণতায়
এমত আহ্বানে নদীদের শাশ্বত নান্দনিক নামকরণের মমতায়
কবিতার শিরোনামে নদীগুলো কবিতাসম কবিতাও সহস্র
উৎস-নদী হয়ে জলের অগাধ শব্দসমুদ্র নিয়ে অগণন অজস্র

পঙ্ক্তিস্রোতে গড়িয়ে গড়িয়ে বোধানুভবে নিঃসীম আকাশগঙ্গায়
নীরব নিঃশূন্যতা স্বাগত সাবলীলতা তাই নদী ও কবিতা একই পথিক বহির্সীমায়

ফেব্রুয়ারি ২০১৪

প্রকৃতি জীবন এমনই বুঝি

আকাশ চলেছে শূন্যের বুকে
নদী বয়ে যায় সাগরে
এখন উল্টো করে
শূন্য যদি আকাশে যায়
সাগর যদি নদীর টানে
তাহলে কী উপায়

মানুষ চলেছে জীবনের দিকে
বৃক্ষগুলো মাটির আঁধারে
এখন উল্টো করে
জীবন যদি মানুষের বেশে
মাটি যদি বৃক্ষ-শিকড়ে
তাহলে কী অবশেষে

বাতাস চলেছে পাহাড়ের দিকে
পথগুলো সব পায়ের ভেতরে
এখন উল্টো করে
পাহাড় যদি বাতাস-বাদলে
পাগুলো সব পথের বাঁকে
তাহলে কী ফলাফলে

দুঃখ চলেছে স্বপ্নের দিকে
প্রজাপতিটি ফুলের ওপরে
এখন উল্টো করে
স্বপ্ন যদি দুঃখের শোকে
ফুলের ভারে প্রজাপতিটি
তাহলে আর কী থাকে

এমনি করেই চলছে সবই
উল্টাপাল্টা সোজাসুজি
পথ ও উদ্দেশ সব একই
প্রকৃতি জীবন এমনই বুঝি
মে ২০০৫

সই মেলা আর দুই সতীর্থ

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

এমন তো নয় দু’বন্ধু এই জীবনে প্রথম
উদ্বোধনের প্রদীপ জ্বালাতে এখানে এসেছি
Ñ না এলে দারুণ অনর্থ হতো, বলা বাহুল্য,
নবনীতা সবই করে দিত খুব ল-ভ- Ñ
তবু দুজনেই কমবিস্তর নার্ভাস আছি,
চৌদিক থেকে সই-মেলা জুড়ে অঙ্গনা যত
আমাদের এই অপ্রতিভতা উপভোগ করে,
আলোকচিত্রী ডেকে নিয়ে এসে
পাশে দাঁড়াচ্ছে লাবণ্যে ঘেঁষে,
তবে কি এটাই দুই বন্ধুর শেষ বসন্ত?

এমন তো নয় আমরা এখনো তারুণ্যময়,
ভুরুর দুধারে কাশফুল এসে আরেক সময়
বুনে দিয়ে গেছে যাতে মিশে আছে পুণ্য ও পাপ
Ñ একজন চুপ, অন্যের মুখে মদির প্রলাপ Ñ
একই ঘরানার শরিক হয়েও সলতে জ্বালাতে
দুরুদুরু ভয়, নিউরোলজিস্ট গতকাল রাতে
বলে দিয়েছেন আমাদের দুই হাতেই এখন
সন্তর্পণে শুরু হয়ে গেছে পারকিনসন।

এবার প্রদীপ সূচনার পালা। আমার বন্ধু
এগিয়ে দিলেন দক্ষিণ হাত … হাতটা কাঁপছে
লক্ষ করেই আমি হাত রাখি হাতের উপরে
আর তক্ষুনি দেখি আমাদের দুজনের হাত
থিরথির করে আকাশে উড়ছে নীল প্রজাপতি…
সই-মেলা দ্যাখে, বুঝতে পারে না, এ সন্ধ্যারতি।

সইমেলা : বইমেলার অনুষঙ্গে নবনীতা দেব সেন প্রতিষ্ঠিত নারীকেন্দ্রিক সাহিত্য সংস্থা
দুই বন্ধু : শঙ্খ ঘোষ ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত