কায়েস আহমেদের পরাণকথা

কায়েস আহমেদের আত্মহত্যাকে এখন আর ‘অভাবনীয় ও বেদনার বিষয়’ বলে অন্তত আমাদের কাছে মনে হয় না। ছোটগল্পের দুটি সংকলন, দুটি ছোট উপন্যাস, একটি জীবনীগ্রন্থ, একটি গ্রন্থ-সম্পাদনা আর কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ – এই তো তাঁর রচনাকর্ম। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি সাধারণ পাঠকের কাছে যতটা পরিচিতি পেয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি বোধহয় তাঁর জুটেছিল আত্মহত্যার কারণে। দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষক্ষক পত্রিকাগুলোতে কায়েস আহমেদের আত্মহত্যার খবর বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কামাল বিন মাহতাব হয়তো সে-কারণেই লিখেছিলেন, ‘বেঁচে থাকতে যে মানুষটিকে কখনো তার প্রাপ্য মনোযোগ দেয়া হয়নি, আজ তাকে প্রচারের বন্যায় ভেসে যেতে দেখে… উল্টো দেখছি আমার মধ্যেও মাঝে মাঝে স্বেচ্ছামৃত্যুর ব্যাপারে একধরনের মোহ সৃষ্টি হচ্ছে।’ অবশ্য প্রচারের এ-বন্যা বেশিক্ষণ টেকেনি, টেকার কথাও নয়। এখন আবার ‘স্বাভাবিক নিয়মেই… আমাদের উৎসাহ সিত্মমিত।’ সত্যিই তো, কায়েস আহমেদের মতো লেখককে নিয়ে আর কত উৎসাহ দেখানো যায়? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-সুশান্ত মজুমদার তো অনেক করেছেন। কায়েস আহমেদ সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কায়েস আহমেদ : নিরাবেগ বোঝাপড়ার মতো মূল্যবান একটি সংকলন। অনেকেই আমরা আশা করেছিলাম কায়েস আহমেদের একটি জীবনীগ্রন্থ হয়তো বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে বের হবে, যেটি কিনা ‘জাতির মননের প্রতীক’, সেটি অবশ্য হয়নি; আর হবে বলে আশাও করি না। কেননা, আমরা জেনে গেছি, এমন দুরূহ-আশা এখন নিছক কপটতারই শামিল।

 

দুই

এসবের বিপরীতে কায়েস আহমেদ অনেকটাই ‘স্থিত’ ছিলেন। স্কুলে পড়িয়েছেন; কিন্তু বাড়তি উপার্জনের আশায় কখনো ‘টিউশনি’ করাননি। অন্যদিকে, তাঁর উপন্যাস-গল্প আর যা-ই হোক, দিবাস্বপ্নে-মগ্ন পাঠক কিংবা ‘উত্তর-চলিস্নশ পৌরস্ত্রী’দের মনোরঞ্জনের জন্য লেখা হয়নি। এমন ব্যক্তির কি লেখকের আমাদের এ-সমাজে টিকতে পারার কথা নয়? খানিকটা উলটো করেও বলা যায়, এমন একজন সংবেদনশীল ব্যক্তি এই সমাজে আত্মহত্যা করে বিদায় নেবেন না – এমনটি ভাবাই তো অযৌক্তিক, এমন ভাবাটা একধরনের বোকামিই বটে। কায়েস আহমেদ আর যা-ই হোন, বোকা ছিলেন না, অসৎ তো নয়ই। নিজের কাছে নিজের সৎ থাকার মতো লেখকের সংখ্যা আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। কায়েস সেই সংখ্যালঘুদেরই একজন ছিলেন। সে-কারণেই জীবনের যাবতীয় অযৌক্তিকতাকে, উদ্ভট ব্যাপারগুলোকে নিজের হাতে সরিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সাহস অর্জন করতে পেরেছিলেন। আলবেয়ার কাম্যু বলেছিলেন – ‘There is but one truly serious philosophical problem and that is suicide.’ সেইসঙ্গে কাম্যু এও জানিয়েছিলেন, ‘Suicide is solution to the absurd.’

 

তিন

এবার কায়েস আহমেদের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে একটু মোটাদাগে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে জন্ম। পিতার চাকরিসূত্রে তাঁর সঙ্গে ঢাকায় আসেন। এখানেই স্কুল-কলেজের সীমানা অতিক্রম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলা বিভাগে। পড়াশোনাটা অসমাপ্ত রেখেই জীবিকার তাগিদে জীবনযুদ্ধে নামলেন। বলা উচিত, নামতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সূত্রে জানতে পারছি : কায়েস আহমেদ ‘ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর থেকে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন, স্বাধীনতার পরেও একটি দৈনিকে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কাগজেই তাঁর ভালো লাগেনি। কোনো জায়গাতেই আপোশ করার মানুষ তিনি নন। পেশা হিসেবে কায়েসের প্রিয় ছিল শিক্ষকতা। ১৯৮০ সালে ঢাকার একটি প্রথম শ্রেণির স্কুল তাঁকে যেচে চাকরি দেয়। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন, ছেলেমেয়েরাও তাঁকে খুব ভালোবাসতো, সহকর্মীদের সম্মানও পেয়েছিলেন। ডিগ্রির অভাবে সেখানে কর্মচ্যুত হওয়ার ভয় ছিল বৈকি!’ ইলিয়াসের মতে, এরকম অনিশ্চিত জীবনযাপনই যেন কায়েস আহমেদের কাম্য ছিল। ইলিয়াস আরো বলেছেন, ‘একটু উদ্বেগ না থাকলে তিনি বাঁচবেন কী করে? শেষ কয়েক বছর আর্থিক অনটন ছিল নিদারুণ। কিন্তু স্কুলে কাজ নেওয়ার পর হাজার চাপ সত্ত্বেও প্রাইভেট টুইশনি করলেন না।’ এই তো গেল কায়েসের আর্থিক চাপের প্রসঙ্গ। অন্যদিকে, মানসিক চাপও তাঁর কম ছিল না। দেশভাগজনিত কারণে সৃষ্ট চাপের দাম অন্য আরো অনেকের মতো কায়েসকেও দিতে হয়েছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জানিয়েছেন, ‘১৯৬৯ সালে কায়েসের বাবার মৃত্যু হলো তাঁদের গ্রামে। ঐ সময় বাড়ি যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু পাসপোর্ট করতে গিয়ে দ্যাখা গেল তিনি যে পাকিসত্মানের নাগরিক তার কোনো প্রমাণ নেই – কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবার দশা। যেতে পারলেন না।’ দরদি ইলিয়াসের কাছ থেকে এও জানতে পারি, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গেলেন, ঐ বছর অনেকটা সময় কাটিয়েছেন নিজের গ্রামে মায়ের সঙ্গে। মনে হয় একটু বড়ো হওয়ার পর থেকে ঐ কয়েকটা দিন তিনি শীতল ছায়ায় কাটিয়েছেন। কিন্তু মায়ের ভালোবাসার ছায়ায় থাকা তাঁর কি পোষায়? যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই কায়েস ঢাকায় ফিরে এলেন, নিজের গ্রামে আর কোনোদিন যাননি।’ মায়ের কাছে তিনি থাকেননি আবার মাকে ছেড়ে কায়েস যে আকুল হতেন সেটিও জানিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : ‘বড়োতাজপুর গ্রামে তাঁদের পুরনো নোনাধরা বাড়ির খিড়কির দুয়ারে শেফালি গাছের নিচে মোড়া পেতে বসে ছেলের জন্যে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়ের চোখে ছানি পড়ে গেলো – এই দৃশ্যটা মনে হলেই কায়েস বড্ডো অস্থির হয়ে পড়তেন।’ শুধু কায়েস একাই নন, এরকম একটি বিবরণ পাঠের পর, আমরাও খুব একটা সুস্থির থাকতে পারি না। কিন্তু যাকে বলে জীবনের জটিলতা, সেটি যেন কায়েসকে ছাড়তেই চাইত না। এসব সংকটের পাশাপাশি কায়েস আহমেদের জীবনে যুক্ত হয়েছিল এক অন্যরকম দাম্পত্য-সংকট। এই সংকটের চেহারা এমনই যে, তার জন্য কায়েস বা তাঁর স্ত্রী কেউই সেই অর্থে দায়ী নন। এ-সম্পর্কে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন, ‘কায়েসের বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিজের। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ তো ছিলই না, সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুদের কথাতেও কর্ণপাত করলেন না। এখানে জিজ্ঞাসা এসেছে বিশ্বাসের চেহারা নিয়ে, তা হলো এই : প্রেম দিয়ে স্ত্রীর দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধি নিরাময় করতে পারবে না কেন?’ এত উদ্বেগের মধ্যে থেকেও নিজের জীবনকে নিয়ে এমন দুঃসাহসিক অভিযাত্রার সাহস কায়েস কীভাবে নিজের মধ্যে সঞ্চিত রাখতে পারতেন, সেটি ভেবে বিস্মিত হতে হয়। ইলিয়াস জানিয়েছেন : ‘প্রায় দশটি বছর ধরে স্ত্রীর সেবা করলেন, ভালোবেসে গেলেন কিশোর প্রেমিকের মতো, যত্ন করলেন মায়ের হাত দিয়ে, আগলে রাখলেন বাপের চোখ দিয়ে। কিন্তু স্ত্রীর ঝাপসা, অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য যন্ত্রণা ও সুখ তিনি শেষ পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারলেন না। হৃদয় ও বিজ্ঞানের শোচনীয় ব্যর্থতায় একটু দমে গিয়েছিলেন বৈকি! কিন্তু এই ভয়ংকর ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যেও কায়েস তাঁর জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজেই গেছেন।’

চার

কায়েস আহমেদ সম্পর্কে যতটুকু জানা যাচ্ছে তা থেকে একটি জিনিস পরিষ্কারভাবেই বুঝে নিতে পারি যে, নিজের যাবতীয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অস্থিরতাকে তিনি গোটা জীবন ধরে একাকী বয়ে বেড়িয়েছেন। এমনকি খুব ঘনিষ্ঠজনকেও পুরোটা জানতে দিতে চাননি। হয়তো বুঝতে দিতেও চাইতেন না। তিনি মানসিকভাবে যে অত্যন্ত দৃঢ়, শক্তিমান ছিলেন – এটি স্বীকার করেও বলা যায়,  কোনো মানুষই একরোখাভাবে সে-শক্তি সবসময় বজায় রাখতে পারেন না। তাছাড়া প্রাকৃতিক নিয়মে শক্তিমান বীরও তো একসময় শারীরিকভাবে জরাগ্রসত্ম হয়ে পড়েন। মানসিক-শক্তির বেলায়ও তার অন্যথা হবে কেন? তাহলে তো বলাই যায় যে, একটানা একা-একা নানারকম বিপন্নতার সঙ্গে লড়াই করতে-করতে কায়েস আহমেদও মানসিকভাবে অন্তত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই অবসাদ তাঁকেও ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলেছিল। মুখে আমরা যতই বলি ‘বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী’; কিন্তু বাসত্মবে জীবনের প্রতিকূলতার সঙ্গে একা-একা আর কতইবা লড়াই করা যায়? জীবনের অন্ধকারে মানুষ তো কাউকে না কাউকে পাশে চায়, তার দরকারও হয়। সে যদি ‘মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’ নাও হয়, তবু তো কাউকে কাউকে প্রয়োজন হয় মানুষের জীবনে। কায়েস আহমেদ জীবনের সেই প্রয়োজনটাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও স্বীকার করেছিলেন যে, কায়েস আহমেদকে ‘আর্থিক অনটন, উত্তেজনা ও উদ্বেগ – সবই বহন করতে হয়েছে একা একা।’ আর এই একাকিত্বই সম্ভবত তাঁকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়েছে। শুধু বহির্জীবনের তাগিদ থেকে নয়, অন্তর্জীবনের উৎকণ্ঠার তাগিদে, জীবনের অন্ধকার-দুঃস্বপ্ন থেকেও কায়েস আহমেদ খুব আন্তরিকভাবে মুক্তি চেয়েছিলেন। মুক্তি চেয়েছিলেন তাঁর জীবনের সমসত্ম হতাশা থেকে।  নিৎশে যেমন বলেছিলেন, ‘pessimism and suicide belong together’। কায়েস আহমেদের সাহিত্যকর্মের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই জীবনের দুঃস্বপ্ন আর দুঃসহ বাসত্মবতার এক যৌথ আলোড়ন-বিলোড়ন। কথাসাহিত্যিক শওকত আলী খুব সংগতভাবেই বলেছিলেন, কায়েসের ‘শিল্পের বিষয় মানুষের অন্তর্লোক ও বহির্লোক। মানুষের হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, অসহায়তা এসবই তাঁর রচনায় ঘুরে ঘুরে দেখা দেয়।’ কেমন তার চেহারা সেটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আবারো একটু দেখে নেওয়া যাক।

 

পাঁচ

কায়েস আহমেদের লাশকাটা ঘর গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পের নাম  ‘পরাণ’। একটি জেলেপলিস্নর মানুষজনকে নিয়ে লেখা গল্প। কায়েস আহমেদ সেই জেলেপলিস্নর বিবরণ দিয়েছেন এভাবে : ‘মেঘলাল রাজবংশীর বাড়িটি জেলে পলস্নীর শেষ মাথায়। গোটা চলিস্নশেক পরিবারের গ্রামটির পেছনে ডাঙাজমি সামনে খাল। খালটি বুড়িগঙ্গা থেকে বেরিয়ে গ্রাম বাজার বিল মাঠ পেরিয়ে ধলেশ্বরীতে গিয়ে থেমেছে। যাদের অবস্থা ভালো তারা নৌকা নিয়ে এই খাল বেয়ে মাছ ধরতে চলে যায় ধলেশ্বরীতে কি মেঘনায়। যাদের জাল, নৌকো কেনার সঙ্গতি নেই তারা এদের মজুর খাটে, খালে ধর্মজাল ডুবিয়ে ছোট মাছ ধরে। উত্তর দক্ষক্ষণে লম্বা গ্রামটির খাল-ঘেঁষা গাছপালার আবেষ্টনী একাধারে ভিটের স্থায়িত্ব এবং আবরু রক্ষা করে। বাড়িগুলোর নির্দিষ্ট সীমানা আছে, সীমান্ত নির্ধারক কৃত্রিম বেড়া নেই।’ এই তো গেল একদিক। অন্যদিকে লেখক জানিয়েছেন – ‘যে তরণী মাঝি গত মৌসুমে ৭০ হাজার টাকা লাভ করেছিলো, কিংবা যে পরমেশ হালদার এক ছেলেকে জগন্নাথ হলে রেখে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে তার সঙ্গে তার নৌকোয় মজুরখাটা কানাই, শিবু, হাবুলদের বাড়ির চেহারাগত তেমন পার্থক্য নেই।’ এসব বিবরণ পাঠ করতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির কথা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে পড়ে। মানিক তাঁর উপন্যাসে জেলেপাড়ার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছিলেন : ‘পুবদিকে গ্রামের বাহিরে জেলেপাড়া। চারিদিকে ফাঁকা জায়গার অন্ত নাই কিন্তু জেলেপাড়ায় বাড়িগুলোর বাড়িগুলি গায়ে গায়ে ঘেঁষিয়া জমাট বাঁধিয়া আছে। প্রথম দেখিলে মনে হয় এ বুঝি তাহাদের অনাবশ্যক সংকীর্ণতা, উন্মুক্ত উদার পৃথিবীতে দরিদ্র মানুষগুলি নিজেদের প্রবঞ্চনা করিতেছে। তারপর ভাবিয়া দেখিলে ব্যাপারটি বুঝিতে পারা যায়। স্থানের অভাব এ জগতে নাই তবু মাথা গুজিবার ঠাঁই এদের ওইটুকুই। সবটুকু সমতল ভূমিতে ভূস্বামীর অধিকার বিসত্মৃত হইয়া আছে, তাহাকে ঠেলিয়া জেলেপাড়ার পরিসর বাড়িতে পারে না। একটি কুঁড়ের আনাচে কানাচে তাহারই নির্ধারিত কম খাজনার জমিটুকুতে আরেকটি কুঁড়ে উঠিতে পায়। পুরুষানুক্রমে এই প্রথা চলিয়া আসিতেছে। তারই ফলে জেলে পাড়াটি হইয়া উঠিয়াছে জমজমাট।’ জেলেপাড়ার বাইরের আপাত এই মিলটুকু ছাড়া কায়েস আহমেদের সঙ্গে মানিকের মিল খুব সামান্যই। দুটোর কাহিনি শুরু থেকেই দুইদিকে ছড়িয়ে গেছে।

 

ছয়

‘পরাণ’ গল্পে আমরা দেখি জেলেপাড়ার মানুষগুলোর মধ্যে  ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য তাদের বাড়ির বাইরের চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। ধনী-দরিদ্রের সেই পার্থক্য এখানে নিরূপিত হয় কার-কার নিজের-নিজের মাছ-ধরার নৌকো আছে, জাল আছে আর কার-কার সেসব নেই – এই দিয়ে; কে এখানে মহাজন আর কে মজুর খাটে – তা-ই দিয়ে। সেইসঙ্গে আছে নিজেদের মধ্যে ‘দলাদলি’। কোন সময়ের কথা এখানে বলা হয়েছে? কীভাবে বুঝে নিতে পারি এখানে একাত্তরের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কথা বলা হয়েছে? লেখকই জানিয়েছেন : ‘একাত্তুরের গন্ডগোলের পর জেলেপাড়ার মানুষগুলোর কারো কারো ভেতর… নাড়া খেয়ে গোড়া কেমন আলগা’ হয়ে গিয়েছে। এই আলগা হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে তৎকালীন আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। শহীদ রুমীর আম্মা জাহানারা ইমাম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন : ‘সেই সময় বাহাত্তরের শেষদিক থেকে তিহাত্তরে খুব অরাজকতা বেড়ে গিয়েছিল। অশান্ত অবস্থা, সাধারণ সন্ত্রাস অনেক বেড়ে যায়।… খুন, জখম, রাহাজানি, হাইজ্যাক খুব বেড়ে গিয়েছিল। সাধারণ অপরাধীরাও খুব সাহসী হয়ে অপরাধগুলো করছিল।’ শুধু শহরে নয়, দেশের গ্রামগুলোতেও এসবের প্রভাব পড়তে দেখা যায়। দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের জীবন থেকে সুখ-শামিত্ম-স্বসিত্ম যেন একেবারে হারিয়ে যায়। কায়েসের এই গল্পেও দেখি হরেন্দ্র মাঝি মনের ক্ষক্ষাভ নিয়ে বলছে – ‘না, এই দ্যাশে আর থাকন যাইবো না। শ্যাক সাব্রে ভোট দিলাম সুখে থাকনের লেইগ্যা। নয়টা মাস কুত্তা বিলাইয়ের মতন পরাণ লইয়া পলাইয়া পলাইয়া কাটাইলাম। দ্যাশ স্বাদীন ওইলো। অহন দ্যাখতাছি চোর দাউরের রাজত্ব। খাইয়া সুখ নাই, পিন্দা সুখ নাই, ঘুইরা ফিইরা সুখ নাই।’ শুধু এইটুকুতেই হরেন্দ্রর মনের ক্ষক্ষাভ শেষ হয় না। সে আরো বলে : ‘মানুষের চোখগুলাও কেমুন ব্যাকা ওইয়া গেছে। রাইতে জাউল্যা মাছ মারতে যাইবো নদীতে, মন পইরা থাকবো গরে, কি জানি গরের বউ মাইয়া পোলারে ডাকাইতে মাইরা তুইয়া গেলো কিনা। আর নদীতে কি নিশ্চিমিত্ম আছে!’ হরেন্দ্র মাঝিদের জীবনে ‘নিশ্চিমিত্ম’ নেই। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। দেশত্যাগ করে ভারতে যাবে? তাতেও কি জীবনে স্বসিত্ম ফিরে আসবার নিশ্চয়তা আছে? তাদের গ্রামেরই পরমেশ হালদারের মতো বিত্তবান মানুষ স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের দেশে রেখে, বিকল্প জীবন-যাপনের সন্ধানে ভারতে গিয়েছিল। শেষমেশ তাকেও খালি হাতেই ফিরে আসতে হয়। এমন ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখে হরেন্দ্র-নিতাই-ফণীরা দেশত্যাগ করতেও ভরসা পায় না। সে-কারণে বাধ্য হয়েই তারা ‘তাদের ভগবানের ওপর সব ভার দিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে আছে।’ তাই বলে তাদের জীবনের গতি কি থেমে আছে, না থেমে থাকে? এসবের মধ্য দিয়েই জীবনপ্রবাহ চলতে থাকে জীবনের নিয়মে। জীবনের সামঞ্জস্যসূত্রের ধারণা এখানে নিপুণভাবে প্রয়োগ করেছেন কায়েস আহমেদ। নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও জেলেপাড়ার জেলেদের জীবনে ‘পুজো-পার্বণ আছে, যাত্রাগান, কীর্তনের আসর আছে, দীননাথতলার চৈত্র-সংক্রামিত্মর মেলা আছে, জেলেদের ঘরে ঘরে লাভ-লোকসান, অভাব-দারিদ্র্য, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ আছে। উৎসব আনন্দ প্রেম ভালোবাসা আছে; মোহনগঞ্জ, গোবিন্দপুর, ভৈরবনগর, কানাইপুরের সাতশো জেলের একখানা সমিতি নিয়ে একদিকে পরমেশ হালদার, লক্ষ্মণ দাস, রামপ্রসাদ, অন্যদিকে ভৈরবনগরের হরকেষ্ট বর্মণ, ঠাকুর দাসের কোন্দল দলাদলি তা-ও আছে। সব আছে, তবু ভেতরে ভেতরে কেমন আলগা হয়ে গেছে মানুষগুলো।’ এই আলগা হয়ে-যাওয়াটাকেই তুলে ধরেছেন কায়েস আহমেদ। দেখিয়েছেন শুধু অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে নয়, নিত্যদিনের নানান অসংগতির সামগ্রিক হতাশাবোধ থেকে জেলেপাড়ার মানুষগুলো তাদের জীবনের সবকিছু থেকে ক্রমে ক্রমে আলগা হয়ে যায়। সেই যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একবার বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়টা তো চরম হতাশার’, তারই শিল্পিত রূপায়ণ যেন দেখি কায়েসের এই গল্পে।

 

সাত

জেলেপাড়ার মানুষগুলোর জীবনের পুরনো মূল্যবোধগুলো এখন আর আগের মতো নেই। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সেগুলোও দ্রম্নত পালটে যেতে থাকে। জেলেরাও এসব বিষয় বুঝতে পারেন। হয়তো সকলেই ততটা গভীরভাবে বোঝেন না; কিন্তু জীবনের বাসত্মবতাই তাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে দেয় যে, আজকের জীবন আর আগের মতো নেই। আজকের জীবন মোটেই সহজ নয়, সরল নয়, সহজ-সরলও নয়। জেলেপাড়ার গোবর্ধন মনে করত : ‘জাউল্যার গতর ঠিক আছে, জাল নৌকা ঠিক আছে তো সব ঠিক আছে; ভগবান শরীলটা দিছে, জলে মীন দিছে, জাউল্যার দুঃখু কিয়ের।’ এইটা শুধু সে মুখেই যে বলত তা নয়, মনে-মনে বিশ্বাসও করত। লেখকের হিসাবে, ‘নির্বোধ গোবর্ধনটা এ-বিশ্বাস নিয়ে তিন কুড়ি সাত বছর কাটিয়ে দিয়ে গেছে।’ অন্যদিকে, গোবর্ধনের ছেলে মেঘলাল ‘যতোই সরল সিধে হোক’, সে তার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারে, ‘জাউল্যার সাধ ইচ্ছার নিয়মের সঙ্গে জগতের নিয়মের গরমিলটা মোটেই সরল নয়।’ প্রাণপণ চেষ্টা করেও সে পিতার বিশ্বাসটুকু ধরে রাখতে পারে না, পারার উপায়ও নেই। এভাবেই আগের প্রজন্মের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের হিসেবের গরমিলের শুরু। যাকে লেখক বলেছেন জেলেদের ভেতরে-ভেতরে আলগা হয়ে যাওয়া, তার শুরুটাও বোধকরি সেখান থেকেই। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় গোটা জেলে-সমাজটাই যেন দুলতে থাকে। আর তারই অভিঘাতে তাদের জীবন থেকেও সুখ-শামিত্ম-স্বসিত্মগুলো ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যেতে থাকে। দূরে সরে যায় বলেই, জেলেপাড়ার কীর্তনের আসর, ভক্তিগানের আসর কারণে-অকারণে বারবার ‘চিৎকার’ আর ‘গ-গোলে’ রূপ নেয়। কায়েস আহমেদের এই গল্পে যতবারই গানের আসরের প্রসঙ্গ এসেছে, তার সঙ্গে যেন অনেকটা অনিবার্যভাবেই ‘চিৎকার’ শব্দটি ফিরে ফিরে এসেছে। গল্পকারের শব্দ-ব্যবহারের এই নৈপুণ্য অত্যন্ত তাৎপর্যময় :

ক.          ‘ভাবের পাগল এলো নদীয়া আ আ আয়- প্রবল চিৎকারে আসর ফাটিয়ে

চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে নেড়ে গান গায় নীলকদম।’

খ.          ‘সমসত্ম আসর তার গানের পদটি ধরে নিয়ে চিৎকার করে।’

যারা গান শুনতে এসেছে, গানের আসরে দেখা যায়, গান শোনার চাইতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাতেই তারা যেন বেশি মনোযোগী। এটি নারী-পুরুষ সবার মধ্যেই কমবেশি দেখা যায়। পুরনো কালের ভক্তিগানের কথা-সুর-তাল-লয়- এসবের কোনোটাই

যেন জেলেপাড়ার এই মানুষগুলোকে আর নিবিড়ভাবে নিমগ্ন রাখতে পারছে না। আসরের কেউ-কেউ যদিও-বা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে- ‘কি তোমাগো এত কথা? গান শুনতে আইছো গান হুন।’ তবে তাতে কোনো কাজ হয় না। লেখকের বর্ণনায় পাচ্ছি : ‘মানুষগুলো কথার ভেতর চলে যায় আবার।’ পাঠক হিসেবে প্রশ্ন জাগে, কৌতূহলও হয় যে, মানুষগুলোর এত কী কথা? কায়েস জানাচ্ছেন- ‘পুরনো দিনের কথা, বর্তমান কালের সঙ্গে সেই হারানো দিন এবং হারানো মানুষের তুলনা, গ্রামে বারবার যে ডাকাতি হচ্ছে, এমনি করে কি চিরকাল মুখ বুজেই সহ্য করতে হবে? সমিতির নির্বাচন আসন্ন, কিন্তু খাল যে বুঁজে আসছে তার কী হবে, কিংবা নদীতে যে বাইরের লোকের লোভের চোখ পড়েছে তারই বা কি ব্যবস্থা হচ্ছে? মানুষের গলা চড়ে যায়, গানের আসর তর্কের আসরে রূপান্তরিত হতে থাকে।’ সংগীতের আসরও এইসব মানুষ আর তাদের সংবেদী মনকে কিছুমাত্র যেন স্পর্শ করতে পারছে না। অথচ আমরা তো সাধারণত এরকমই ভেবে থাকি যে, জীবনের মাত্রাহীন সন্ত্রসত্মতা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ অনেক সময় শেষ পর্যন্ত সংগীতের কাছেই আশ্রয় নেয়। দার্শনিক নিৎশে যেমন ভাগনারের সংগীতের জগতে আশ্রয় নিতেন। এ-বিষয়ে নিৎশের বয়ান – ‘If one wants to rid oneself of an unbearable pressure, one needs hashish. Well then, I needed Wagner.’ কিন্তু জীবনের রূঢ় বাসত্মবতা কোনো নিয়ম মেনে চলে না।

কায়েস আহমেদ নিজেও যেন জেলেপাড়ার গানের আসরটাকে আনন্দের আসর হিসেবে নয়, বরং জীবনের ভয়াবহ অসুখের আসর হিসেবেই পাঠকের কাছে উপস্থাপন করতে চাইছেন এবং এখানে তাঁর সাফল্য, এককথায় অবিশ্বাস্য। এটি তিনি জোর করে তাঁর গল্পের ওপরে চাপিয়ে দেননি কিংবা এ-প্রক্রিয়ায় আমরা গল্পের আঙ্গিকে কোনো অস্বাভাবিকতাকে দেখতে পাই না। খুব স্বাভাবিকভাবেই জেলেজীবনে সংগীত আর স্বসিত্মর এই আপাত বিরোধকে গল্পকার ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। আরেকটু উদাহরণ দেওয়া যাক- ‘নীলকদমের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আসরের আরো দশ বারোজন মানুষের সম্মিলিত আওয়াজ, খোল, করতাল এবং হারমোনিয়াম ছাপিয়ে বীভৎস হাহাকারের মতো মেঘলালের উঠোন, নিথর কালো জেলেপলস্নী, খাল সমসত্ম কিছুকে গেঁথে ফেলতে থাকে।’

 

 

আট

কায়েস আহমেদ দেখিয়েছেন যে, জেলেপাড়ার নারী-পুরুষরা তাদের সমসত্ম উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ ও আশঙ্কা নিয়ে এক অযৌক্তিক আর উদ্ভট জীবনযাপনে অভ্যসত্ম হতে শুরু করেছে। আর এরও তো কারণ রয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার বছরদুয়েকের মধ্যেই যারা বারদশেক ডাকাতির শিকার হয়, স্ত্রী-কন্যার সম্ভ্রম-রক্ষায় যাদের রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিতে হয়, সশস্ত্র ডাকাত এলে যাদের বাড়িঘর ফেলে জঙ্গলে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়, তারা তো এক আশাহীন জগতের নির্বাসিত বাসিন্দা। স্বাধীন দেশের ক্ষমতাসীনদের ‘রাজনীতি’ থেকে শুরু করে রামপ্রসাদদের হাতে নিয়ন্ত্রিত ‘সমিতি’ – কোনোকিছুই তাদের জীবনে সামান্যতম নিশ্চয়তার আশ্বাসটুকু দিতে পারে না। জেলেপাড়ার মানুষগুলোর এই অনিশ্চয়তাবোধের কারণ শুধুই মনসত্মাত্ত্বিক নয়, এর বাসত্মব কারণও রয়েছে। গানের আসর চলাকালেই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত ডাকাতের আক্রমণে জেলেপাড়ার মানুষগুলো জীবন-মান বাঁচাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। লেখকের বর্ণনায় : ‘চিৎকার করে ওঠে রবীন্দ্রের বোন, ডাকাইত ডাকাইত… মুহূর্তে হতচকিত রান্নাঘর এবং রকের মধ্যে হুলস্থূল পড়ে যায়, আসরের মানুষ তখনো শ্রীচৈতন্য এবং নিত্যানন্দদের অবলোকনে নিবিষ্ট, কিন্তু ক্ষণকালের মধ্যেই মহিলাবৃন্দ ডাকাইত ডাকাইত ধ্বনি দিয়ে আসরের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পঞ্চদশ শতাব্দীর এই সুখচিত্রকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে আসরটি দাঁড়িয়ে যায়।’ যখনই জেলেপাড়ার মানুষগুলো ধর্মগানে নিবিষ্ট, ঠিক তখনই ডাকাতের আক্রমণ। জেলেপাড়ার মানুষগুলোর নিজেদের মধ্যে দলাদলি আছে, চিৎকার, ঝগড়া আছে, রাগারাগি আছে – কিন্তু এই চরম সংকটের সময় কেউ কোনো প্রতিরোধের কথা ভাবে না। নিজেদের মধ্যকার নিত্যদিনের এসব বিভেদই হয়তো তাদের একতাবদ্ধ হতে বাধা দেয়। সবাই যে-যার মতো ঘরবাড়ি ফেলে নিরাপদ স্থানে সরে পড়ে। ‘হুড়োহুড়ি কলরবের মধ্যে পেছন থেকে নিতাইয়ের চিড়-খাওয়া গলা শোনা যায় : এমুন কইরা বাইচ্যা কী ওইবো।’ নিতাই তবু ওই প্রশ্নটুকু করতে পারে, বাকিদের যেন সেই ক্ষমতাটুকুও নেই। ডাকাতের আক্রমণে পর্যুদসত্ম জেলেপাড়ার গোটা পরিস্থিতি কায়েস আহমেদ প্রকৃতির পটভূমিকায় অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন : ‘সরষে ফুলে ভরা বিসত্মৃত উঁচু ডাঙার বাঁদিকে সেনপাড়া, সামনে গোবিন্দপুর, চাইনপাড়া, ডানদিকে বাঁক নেওয়া খাল, তার পাশে হু হু করা দিগন্ত ছোঁয়া নীচু মাঠের বিসত্মার কুয়াশা এবং অন্ধকারে স্থির হয়ে আছে।’ প্রকৃতির বিবরণ-দেওয়া এই সামান্য কয়েকটি বাক্যের মধ্য দিয়ে বিপর্যসত্ম জেলেদের জীবনের স্বরূপটুকু যেন সম্পূর্ণ ফুটে উঠেছে।

জেলেদের দুর্ভোগ বা দুর্ভাগ্য যাই বলি না কেন, এখানেই শেষ হয় না। ডাকাতরা শুধু জেলেপাড়ার মানুষগুলোর সম্পদই লুট করে না, তাদের সম্ভ্রমও কেড়ে নেয়। ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচতে পদ্মচরণের উনিশ বছরের মেয়ে আলোরাণী মর্মভেদী চিৎকার করে ওঠে। আলোর চিৎকারে সাড়া দিয়ে জেলেপাড়ার কেউই এগিয়ে আসে না। কারো অতটা ঝুঁকি নেওয়ার সাহস নেই। প্রকৃতির অন্ধকারই যেন তাদের সব সাহসকে শুষে নিয়েছে। আলোর মায়ের শত অনুনয়-বিনয় বৃথা যায়। আর বাবা অসহায় পদ্মচরণ? লেখকের বর্ণনায় – ‘পদ্মচরণ গোয়ালের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে থাকে, গোয়ালঘরে গরুর লেজ ও পায়ের আওয়াজ, মশার ভন্ভনের মধ্যে হারিকেনের আলোয় কালো একটি ঝোপের মতো মনে হয় তাকে।’ এই ঝোপ শুধুই অন্ধকারের নয়; হতাশার, ব্যর্থতার এবং বেদনারও বটে। ডাকাতরা একসময় চলে যায়। আর লেখক যেন পাঠকের স্নায়ুতে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত দেওয়ার জন্যই এরকম বর্ণনা দেন – ‘চাপা ফিস ফিস এবং সরব বিলাপের মধ্যে আরও কিছুক্ষণ চলে যাবার পর ভয়ঙ্কর উত্তেজনায় একজন বলে ওঠে, ‘ছারছে, ছারছে’। এই অশস্নীল শব্দ পদ্মচরণের কানে এলে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সেই শব্দকে উড়িয়ে দেবার জন্যেই যেন-বা বলে – ‘দীনবনধুউউ…’। কায়েস আহমেদ আমাদের স্নায়ুতে আঘাত করেন ঠিকই, আবার পদ্মচরণের ‘দীনবন্ধু’ উচ্চারণকে সামনে এনে সেই বিবশ স্নায়ুতে খানিকটা শুশ্রূষাও দেন। এভাবেই গল্পের এই কাহিনিতে একটা ভারসাম্যের উপাদান যুক্ত হয়। গল্পটা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কোনোদিকেই একটুও হেলে পড়ে না। গল্পটি শেষ হচ্ছে এভাবে – ‘পিঠে ধুলো, লুটানো অাঁচল, বিস্রসত্ম চুল নিয়ে স্খলিত পদক্ষক্ষপে আলোরাণী টলতে টলতে আসতে থাকে।’

 

নয়

কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক মহীবুল আজিজ এই গল্প সম্পর্কে বলেছেন, ‘পদ্মচরণের মেয়ে আলোরাণীর ধর্ষণের সিকুয়েন্স দিয়ে গল্প শেষ হয়। কিন্তু বোঝবার উপায় নেই গল্পটি কোথায় শেষ হচ্ছে। মনে হতে পারে গল্পটি আরো আগেই শেষ হয়ে যেতে পারতো কিংবা আরো কিছু তারও পরে যুক্ত হলে ক্ষতি ছিলো না।’ এবং আমরা মনে করি, গল্পকার হিসেবে এখানেই কায়েস আহমেদের কৃতিত্ব। পাঠককে তিনি কোনো অবস্থাতেই কোনোরকম ‘তৃপ্তি’ দিতে নারাজ। ফলে, ভাবাবেগের সঙ্গে তাঁর কখনো কোনো আপসরফা হয় না। স্থূল আবেগের সামান্যতম অংশও এই গল্পের রক্তে-মাংসে নেই। জেলেপাড়ার সবার পাপ, সবার দায়
একা-একা বহন করে অন্ধকার ঘরে ফিরে এসে আলোরাণী শুধু মাতা মেরি নয়, একই সঙ্গে যেন যিশু হয়ে ওঠে। গল্পের শেষাংশ শুধু জেলেপাড়ার মানুষগুলোকেই নয়, সেইসঙ্গে গল্পের পাঠককেও আরো একবার নির্মম সত্যের মুখোমুখি হতে বাধ্য করে। গল্পকার হিসেবে কায়েস আহমেদের যে-সফলতা, তার নেপথ্যে রয়েছে তাঁর
সাহিত্যিক-পরিশ্রম আর জীবন-উপলব্ধির অপূর্ব সংমিশ্রণ। যে-কারণে তাঁর গল্প মানেই জীবনের এক আত্মসচেতনতার উন্মোচন। কায়েস আহমেদের সাহিত্যিক সততার কথাও এখানে উলেস্নখ করতে হয়। এই সচেতন কথাসাহিত্যিক মনে করতেন : ‘শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থেকে নিজের সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা বিষয়ে নিরাবেগ বোঝাপড়ার মাধ্যমে এগোতে হবে আজকের লেখককে। খুঁজে দেখতে হবে কোথায় লেগেছে ঘূর্ণির টান, সে টানে কেমন করে পাড় ভাঙছে, নতুন ধারা কোথায় বাঁক নিচ্ছে। শহর, গ্রাম – যাঁর যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য সেই-সেই ক্ষক্ষত্রে অনুসন্ধান চালাতে হবে। বলা বাহুল্য, এ অনুসন্ধানের কোনো সহজ উপায় নেই, এক্ষক্ষত্রে একমাত্র হাতিয়ার লেখকের প্রখর চেতনা ও সামগ্রিক সততা।’ যার কথা বলেছেন তিনি, লেখকের সেই প্রখর চেতনা ও সামগ্রিক সততা কায়েস আহমেদের নিজেরও ছিল। সে-কারণেই জীবনের মতো মৃত্যুকেও তিনি বন্ধুর মতো জড়িয়ে ধরতে পেরেছিলেন। কবি অরুণ মিত্রের ধরনে আমাদেরও ভাবতে ইচ্ছা করে – আত্মহত্যার ঠিক পূর্বমুহূর্তে কায়েস আহমেদ হয়তো রিলকের এই পঙ্ক্তিটি মনে মনে উচ্চারণ করেছিলেন : ‘Super numerous existence wells up in my heart.’

 

দশ

কায়েস আহমেদের আত্মহত্যার জন্যে যেমন, তেমনি তিনি এত কম লিখেছিলেন বলে আমাদের মনে অন্তত কোনো খেদ নেই।