কিস্সা বলেন শেহ্রজাদে

রবিশংকর বল

\ ১২ \

 

বেশ কিছুদিন হলো, মাঝে-মাঝেই কিছুক্ষণের জন্য ঘুম ভেঙে যায় রঘুপতির। জেগে উঠে কখনো আকাশে চক্কর মারা যুদ্ধবিমানের শব্দ পায়, তারপরই
কোথাও একটা বিস্ফোরণ। শোবার ঘরটাকে বাঙ্কারের মতো মনে হয় তার। আবার কখনো অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাতের শব্দ শোনা যায়, যেন দীর্ঘ সময়জুড়ে সে শুয়ে আছে আর মাসের পর মাস কেটে যেতে থাকে, বৃষ্টি পড়েই যায়। মাঝে-মাঝে তার একটা নদী ও শ্মশানের কথা মনে পড়ে। নদীর ওপরে ভেসে থাকা কুয়াশা আর শ্মশানের চিতার ধোঁয়া মিলেমিশে যায়।

আর ঘুমের ভেতরে এসে হানা দিতে থাকে স্বপ্নরা। অনেকদিন সে স্বপ্ন দেখত না। মৃত্তিকাকে এ-নিয়ে বেশ কয়েকবার বলেও ছিল। মৃত্তিকা হেসে বলেছে, ‘তাহলে ভেতরে-ভেতরে তুমি ঘোর বাস্তববাদী হয়ে গেছ।’ তাই কি? বাস্তববাদী হাওয়া মানে কি স্বপ্ন মরে যাওয়া? হবেও-বা। স্বপ্ন কেন জন্মায়, কেনই-বা মরে যায়, তার কতটুকু আমরা জানি? ফ্রয়েড, ইয়ুংরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেছেন; কিন্তু স্বপ্ন কি করে জন্মায়, তা কি বলতে পেরেছেন?

এখন আবার ঘুমের ভেতরে স্বপ্নেরা আসে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বেশিরভাগ স্বপ্নে রঘুপতি কখনো নিজেকে দেখতে পায় না। পুরনো, বার্ধক্য-জর্জরিত অনেক মুখ সে দেখতে পায়, স্বপ্নে তাদের চিনতেও পারে, কিন্তু ঘুম ভেঙে গেলে সেসব মুখ মনে করতে পারে না, কয়েকটা রেখা পড়ে থাকে, কবে, কোথায় তাদের দেখেছিল, মনেও পড়ে না। অথচ স্বপ্নে আবার মুখগুলো ফিরে আসে, রঘুপতির দিকে নীরবে, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন তারা কোনো কথা জানতে চায়। কী জানতে চায়, তা কখনো বলেনি, যেন গভীর কোনো ট্রমা তাদের মূক করে দিয়েছে।

কিছু স্বপ্নে নিজেকে দেখতে পায় রঘুপতি, কিন্তু সেই আলো-আঁধারিতে নিজের মুখ সে সহ্য করতে পারে না। তখন ঘুম ভেঙে গেলে, সে লক্ষ করেছে, নিজের শরীরের দিকে তাকাতেও ভয় করে, যেন সে আর রঘুপতি নয়, অন্য কিছু হয়ে গেছে। তখন সে দেখতে পায়, ঘরজুড়ে উড়ছে কয়েকটা চামচিকে। পোড়োবাড়িতেই তো চামচিকেরা এসে হানা দেয়, তাদের বাসস্থান তৈরি করে। মৃত্তিকাকে ডাকতে গিয়েও তার গলা থেকে শব্দ বেরোয় না। শুধু অনুভব করে, বোবা এক আর্তনাদ সেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে।

একদিন টেলিফোন বেজে উঠল। পুরনো দিনের সেই কালো টেলিফোন। হ্যাঁ, স্বপ্নেই। বাস্তবে এখন আর সেই টেলিফোন কোথায়? নাকি হারানো বাস্তব হিমশৈলের চূড়ার মতো জেগে উঠছে। রঘুপতি ‘হ্যালো, হ্যালো’ করে যায় আর ওপাশ থেকে একটানা কাশির শব্দ ভেসে আসে। এই কাশির শব্দ তার চেনা, কিন্তু নাম মনে পড়ে না কেন? কাশির দমক থামলে ওপাশ থেকে প্রশ্ন শোনা যায়, ‘রঘু, আমার কঙ্কালটা কি আইছে?’

– কে?

– আমি হরিশচন্দ্র।

– ও, বাবা –

– আমাকে চিনতে পার নাই?

– স্বপ্নে চেনা লোকও অচেনা হয়ে যায়, বাবা।

– তুমি আমারে স্বপ্নে দেখতাছো বুঝি?

– তাই তো মনে হয়।

– তাহলে আমি তোমার পাশে বসে আছি কী করে?

বিছানার চারপাশে হরিশচন্দ্রকে খোঁজে রঘুপতি।

– কোথায় আপনি?

– এই তো –

– তাহলে টেলিফোন করলেন কেন?

– টেলিফোন লাগে।

– কেন?

– নইলে আমার কথা শোনবা ক্যামনে? টেলিফোনের ভেতর দিয়া শোনা যায়। কিন্তু আমার কঙ্কালটা –

হরিশচন্দ্র তার দেহ দান করে গিয়েছিল। তাই মৃত্যুর পর তার দেহ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ডোমের হাতে তুলে দেওয়া হয়। একটা বড় ঠান্ডা বাক্সের ভেতরে আরো অনেক দেহের ভিড়ে হরিশচন্দ্রও মিশে যায়। এরপর ডাক্তারির ছাত্ররা তার শরীর কাটাছেঁড়া করে দেখবে, হরিশচন্দ্র একটা কঙ্কাল হয়ে হাসপাতালে থেকে যাবে। হাসপাতালের একটি প্রায়ান্ধকার হলঘরে অনেক কঙ্কাল ঝুলে থাকতে দেখেছিল রঘুপতি।

বাবার মৃত্যুর পর মাসদুয়েক প্রায়ই হাসপাতালে চলে যেত রঘুপতি। সেই হলঘরে গিয়ে খুঁজত, বাবার কঙ্কাল এলো কিনা। দুয়েকজন ডাক্তার, ডোমকেও কয়েকবার জিগ্যেস করেছিল। কিন্তু হরিশচন্দ্রের কঙ্কাল কোথায়, কেউ বলতে পারেনি। হয়তো কঙ্কালদের রাখার জন্য কোনো গুদাম আছে, সেখানে হরিশচন্দ্রের কঙ্কালও ডাঁই হয়ে আছে। কঙ্কালের ওপর কঙ্কাল, তার ওপর কঙ্কাল, কঙ্কালের সত্মূপ – হিটলারের নাৎসি ক্যাম্পে, সোভিয়েত রাশিয়া, কোরিয়ার লেবার ক্যাম্পে ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে রঘুপতির। বা সেই ডিটেনশন সেন্টারের কথা ভাবো, যেখানে প্রসেনজিৎ বসু নামের এক নকশাল যুবককে জেরা করার নামে পিটিয়ে মারা হয়, তারপর তার ও আরো অনেকের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় একটি কারখানায় : ‘মিট প্রোডাক্টস্ অব ইন্ডিয়া’। সেখানে শুয়োর, মুরগির মাংস দিয়ে সালামি, সসেজ, মিট বল এবং আরো মাংসজাত খাদ্যপণ্য তৈরি হয়। শুয়োরদের ঘরের ভেতরে লাশগুলো ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়… শুয়োররা চিৎকার করছে, ঝাঁপিয়ে পড়ছে লাশগুলোর ওপর… মাংস ছেঁড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে… ওরা চিবোচ্ছে… যুবকদের মাংস… তারপর কী পড়ে থাকবে? কয়েকটি কঙ্কাল।

– আমার কঙ্কালটার তাহলে কী হবে? হরিশচন্দ্র বলে।

– আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।

– হ্যাঁ, খুঁজে দ্যাখো। হরিশচন্দ্র বিরক্তির স্বরে বলে, ‘মানুষ তো এত অশ্রদ্ধা নিয়া মরতে পারে না। কঙ্কালটারও যদি কোনো হদিস না পাওয়া যায় – ।’

– কী হবে তাহলে? রঘুপতি হেসে বলে।

– এই আত্মা কি তাইলে আর শান্তি পাবে? হরিশচন্দ্রের গলায় হতাশার বালি ঝরে পড়ে।

– আমি খুঁজব বাবা। আপনি চিমত্মা করবেন না।

আবার কয়েকদিন পরে হরিশচন্দ্র এলো। তার মাথায় ক্লাউনদের মতো টুপি, হাতে একটা চোঙ, যা দিয়ে অনেক অনেকদিন আগে হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে নানা ঘোষণা করা হতো।

– চোঙ দিয়ে কী করবেন?

– কথা বলার জন্য। নাইলে তো আমার কথা শোনতে পাবা না।

– আর আপনার টেলিফোন?

-সে তো অনেক আগের কথা। আমি এহন আরো পেছনে চলে গেছি। তা আমার কঙ্কালের কী হলো?

– খুঁজে পাওয়া যায়নি।

– তুমি খুঁজেছিলে?

– একদিন গিয়েছিলাম হাসপাতালে।

-একদিন? হরিশচন্দ্র বড়-বড় চোখে তাকায়।-একদিনে কি অত কঙ্কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যায়? অনেক চেষ্টা করে, তবেই না-

– আবারো যাব।

– হ্যাঁ, যাও। সহজে কি সব পাওয়া যায়? তোমার বাপের কঙ্কালটা খুঁজে বের করা তোমার দায় নয়? আজকাল যে কী হইছো তোমরা।

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে হরিশচন্দ্র চলে যায়। রঘুপতি আবার ঘুমিয়ে পড়ছিল, কিন্তু তখনই নারী-পুরুষের কথোপকথন শোনা যায়। পাশের ঘর থেকেই তো ভেসে আসছে তাদের কথা।

পুরুষ : বাবাকে আমি ভালো করে জানতাম না, কিন্তু আমার মনে তিনি বেঁচে আছেন… খুব ছোট বয়সেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম…বাবা যুবক বয়সেই মারা যান… তখন আমি অনেক দূরে। কিন্তু মনে পড়ে, তিনি আমাকে কখনো নির্দেশ নিতেন না, এটা করো, ওটা করো না। তাঁর মতে, সবদিক চিমত্মা করে যে-কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তোমার বোন একদিন আমাকে এসে বলল, সে একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। আমি শুধু বলেছিলাম, ‘আমি তোমার ইচ্ছের বিরোধী নই, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দলের মানুষদের চিনে নিও। তাদের সঙ্গে সময় কাটাও, তারা কী পছন্দ করে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী, তারা কী করছে, বুঝে নিও। তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কয়েক মাস পরে ও ফিরে এসে বলল, ‘আমি কনভিন্সড নই; তাই সিদ্ধান্ত বদলালাম।’ বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখনো আমাকে উদ্বেল করে। আমি তাঁকে ভালো করে চিনিনি, তাঁর মৃত্যুর খবরে কাঁদিওনি… কেন জানি না… কিন্তু সময় যত চলে যাচ্ছে, ততই গভীরভাবে তাঁর কথা ভাবি, চোখ জলে ভরে যায়। এখন বুঝতে পারি, বাইরেটা কঠোর হলেও, ভলো বন্ধু ছিলেন তিনি। চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারি এ-কথা। তিনি এখন যেন সবসময় আমার সঙ্গে আছেন।

নারী : ভাইবোনেদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন? সহজ, না মধ্যে খাদ আছে? যেহেতু তুমি একজন কবি আর অনেক দূরে থাকো। পারিবারিক সম্পর্ক কি সেই দূরত্ব মুছে দেয়?

পুরুষ : আমার এমন অনেক আত্মীয় আছেন, যাঁদের সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি, আমি তাঁদের চিনিই না। তাঁদের সঙ্গে আমার ব্যবহার ভাসা ভাসা হবেই। কিন্তু ভাইবোনেদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আলাদা। আমি তাদের সঙ্গে বেঁচেছি, তাদের সঙ্গে আমার বন্ধন ভালোবাসার। তাদের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে, আমার ক্ষমতার মধ্যে থাকলে, আমি সাহায্য করি; তারা আমার জীবনের অংশ। তাদের সঙ্গে আমার চিমত্মার মিল না থাকলেও, তারা আমার কবিতা পছন্দ না করলেও আমরা একই মায়ের সমত্মান। তাই তাদের প্রতি আমার দায়িত্ব আছে।

নারী : এরকম পরিবারের সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। দিনের শেষে মনে হয়, তাদের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে পারছি না। এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধ তৈরি হয়। কিন্তু অনেক বন্ধুর ওপর আমার বিশ্বাস আছে। কয়েকজন বন্ধুই আমার সত্যিকারের পরিবার, যাদের আমি বেছে নিয়েছি, তাদের পাশে থেকেছি, কখনো কখনো ত্যাগও করেছি…

পুরুষ : আসলে রক্তের সম্পর্ক কী, তুমি জানো না। দিনে-রাতে কখনো তো তাদের সঙ্গে থাকোনি। একদিন তুমি অন্যভাবে অনুভব করবে। জীবনের পথে যতই এগোবে, মনে হবে, কী যেন নেই;    প্রকৃতি, গ্রাম, তোমার পূর্বপুরুষ… এ সবই তোমার অংশ। এখন তুমি যেভাবে আছো, সেখানে জীবন তোমাকে এসব থেকে দূরে নিয়ে গেছে। কিন্তু একদিন তুমি অন্যরকম ভাববেই।

নারী : আমার পছন্দ-অপছন্দের কোনো ব্যাপার নেই? তুমি যা বলছ, তা ঘটবেই?

পুরুষ : মানুষের সঙ্গে মেলামেলা খুব জরুরি। শেষ বিচারে, ওটাই আমাদের জায়গা। তারা কী ভাবে, কীভাবে বেঁচে আছে, এসব জানা, তাদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করা খুব জরুরি।

নারী : তবে প্রকৃতি থাকতেই হবে প্রেক্ষাপটে। তা যেন গাছহীন কোনো শহর না হয়। মানুষ সবসময় তাদের শেকড়ে ফিরছে, এই ভাবনা আমার খুব পছন্দের নয়। আমি বিশ্বাস করি, নিজেদের    পৃথিবী আমরা নিজেরাই তৈরি করতে পারি।

পুরুষ : নিজের শেকড়ে ফেরা গুরুত্বপূর্ণ, এ-কথা বলা মানে, ওখানেই থেমে থাকা নয় বা সেই শেকড়ে লীন হয়ে যাওয়াও নয়। নতুন জগৎ আবিষ্কার করা মানুষের দায়িত্ব, সে-পথে তো আমাদের এগোতেই হবে। যে-ফেরার কথা বলছি, তার মধ্য দিয়ে আমাদের শুরু ও আজকের দূরত্ব মেপে নেওয়া যায়, নিজেকে জানতে সাহায্য করতে পারে…। বলতে পারো, এ হলো ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন।

নারী : আমার একটা পরিবার আছে, যা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে তৈরি।

পুরুষ : বন্ধুরা তোমার পরিবারের বিকল্প হতে পারে না। তোমাদের ভাবনাচিমত্মা, আধ্যাত্মিকতার মধ্যে যতই মিল থাক, শরীর, ইতিহাস, রক্তের সম্পর্ক এসবের তাৎপর্য আলাদা। বন্ধুত্বের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাপারটা শেখা যায় না, তোমাকে বুঝতে হবে।

নারী : এখন বন্ধুত্বই আমার কাছে বিকল্প। যে-সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই, তার সঙ্গে আমি কীভাবে যুক্ত হব? দুপক্ষের মতো আলাদা, জীবনযাপন আলাদা…

পুরুষ : তুমি কারো ভাবনার সঙ্গে একমত হতেই পারো, যদিও জানো, তোমরা দুজনে এক জগতের নও। অনেক মানুষের চিমত্মাভাবনার প্রতি আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু তাদের জীবনের সঙ্গে আমি কখনো নিজেকে মেলাতে পারব না। গ্রামে তোমার পরিবারের কথা ভাবো। তারা কীভাবে বেঁচে আছে, তোমাকে খুঁজে দেখতে হবে। জীবনে এই অভিজ্ঞতা তোমাকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারে। নিজেকে জানার জন্যই তাদের জানতে হবে। যদি তাদের ভালোভাবে না জানো, তাহলে তাদের থেকে তোমার দূরত্ব, তাদের সঙ্গে তোমার যোগসূত্র ধরতেই পারবে না।

আমার দু-একটি কথা মন দিয়ে শোনো, মেয়ে।

ধরো তুমি কোনো অরণ্যের ভেতরে বসে চারপাশের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছো। পাখিদের খুঁজে পেতে, তারা কীভাবে ঘর বানায় বুঝতে, বাতাসের শব্দ শুনতে, আকাশ ও জ্বলন্ত নক্ষত্ররাজি দেখতে অন্তত তিনদিন সময় লাগবে। গাছেদের দেখতে পাবে, সারি সারি, পাশাপাশি, কিন্তু প্রত্যেকে স্বতন্ত্র। কখনো তারা নিজেদের আলিঙ্গন করে, কখনো ঝগড়া করে, অন্যের জল নিয়ে নেয়… যেন আমাদের সমাজেরই ছোট সংস্করণ। প্রকৃতির শান্তি, রাত্রির স্তব্ধতা তুমি অনুভব করবে… এই নির্জনতা তোমাকে পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত করবে, মহাবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করবে; শহর এমন গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। শহরে তো নানারকম কারখানা, সেখানে প্রকৃতি নেই। মানুষের প্রয়োজন প্রকৃতি। প্রথম শহরে গিয়ে আমি তোমার মতোই বিস্মিত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম, গ্রামের পশ্চাৎপদ জগতে কখনো ফিরব না। গ্রামে ফেরা মানে যেন কবরে নেমে যাওয়া। কিন্তু সময় আমার অনুভবকে বদলে দিলো। এখন  প্রকৃতির কাছে ফিরে মনে হয়, কবর থেকে উঠে এলাম।

এখন আবার সেই নদী দেখা যাচ্ছে। রঘুপতি দেখল, নদীর তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধ; তাঁর হাত ধরে আছে এক তরুণী। তারা মাঝে মাঝে হেসে উঠছে, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে। রঘুপতি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

– আপনি কে?

– আলী আহমেদ সয়ীদ। এটি আমার কন্যা, নিনার এসবার। বহুদিন বাদে দেখা হলো।

নিনার হেসে বলল, ‘আলী আহমেদ নয়। আমার বাবা কবি অ্যাডোনিস।’

– কিন্তু আমার বাবা-মার দেওয়া নাম, আলী আহমেদ…

– আলী বললে কে তোমাকে চিনবে, বাবা?

– কেন, তোমরা। সেটুকুই এখন আমার কাছে জরুরি।

– সিরিয়া… লেবানন…। রঘুপতি বিড় বিড় করে। – এক দেশের পর আরেক দেশ… এমন নির্বাসিতের জীবন কি আপনি চেয়েছিলেন?

অ্যাডোনিস মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি। নিজের মনেই বলেন, ‘নির্বাসনের অনুভূতি খুবই জোরালো। সবাই তা অনুভব করতে পারে না। নির্বাসন সম্পর্কে সচেতন মানুষ জানে, এ-অবস্থা তাকে পেরিয়ে যেতেই হবে।’

-আর আপনি? আপনার অনুভব-

নিনারও একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘দেশ… ভাষা… নিজের শরীর…  কোথায় তুমি নির্বাসনের অনুভূতি দেখতে পাও, বাবা?’

অ্যাডোনিস তর্জনী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শূন্যতার ভেতরে ছবি এঁকে চলেন। বলতে থাকেন, ‘সারাজীবন অনুভব করেছি, যে-পথে আমি চলেছি, তা একজন নির্বাসিতের পথ। সিরিয়াতে থাকার সময় থেকেই নিজেকে নির্বাসিত মনে হতো : আমার গ্রাম, আমার সমাজ, আমার সাহিত্য, সমসাময়িক চিমত্মাভাবনার ভেতরে আমি বহিরাগত। প্রান্তে আমার জায়গা – কিনারায় – কখনোই কেন্দ্রে নয়, আর সেজন্যই হয়তো আলাদা কিছু আমি তৈরি করতে পেরেছি। আমার জীবনের গতি এভাবেই নির্ধারিত হয়েছে : গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে রাজধানীতে, দামাস্কাস থেকে বেইরুটে। লেবাননের মধ্যেও এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে আমি ঘুরে ফিরেছি। আমার সারাজীবনটাই নির্বাসনের মধ্য দিয়ে, নির্বাসনের দিকে যাত্রা… নির্বাসন আমার আরবিতে ছাপ রেখে গেছে… তাই যা কিছু চলতি, যাকে বলে প্রধান স্রোত, আমি তার বাইরে চলে গেছি… কেন্দ্র থেকে ছিটকে গেছি… আমার প্রান্তিক পথ খুঁজে পেয়েছি।

অ্যাডোনিসের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল, কিন্তু রঘুপতি দেখল, কন্যা নিনারের হাত ধরে তিনি অনেকদূর এগিয়ে গেছেন।

অফিস থেকে বেরিয়ে এলোমেলো হাঁটতে-হাঁটতে রঘুপতি খেয়ালও করেনি, কখন সে হাসপাতালের ডেডবডি ডিসেকশন বিভাগের মর্গের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এ-দিকটা নির্জন, বুনো ঝোপঝাড়ে ভরা। সে দেখল, কয়েকটি ডোম বসে তাস খেলছে।

– কাউকে খুঁজছেন সাব? একজন জিগ্যেস করল।

কী বলবে সে? হরিশচন্দ্রের কঙ্কাল খুঁজতে এসেছে।

– ভেতরে একবার যাওয়া যাবে?

– এখন তো কেউ নেই। আপনি কাকে খুঁজছেন?

– একটা কঙ্কাল এসেছে কিনা…

লোকগুলো এর-ওর মুখের দিকে তাকাল।

– কার কঙ্কাল?

-আমার বাবা। হরিশচন্দ্র-

-আপনার বাবার নাম হরিশচন্দ্র? একজন হেসে উঠল।

– রাজা হরিশচন্দ্র শেষে ডোম হয়েছিল, সাব, জানেন তো?

রঘুপতি ভাবল, রাজা হরিশচন্দ্রের গল্পটা এতদিন তার মনেও পড়েনি। তার বাবার নামের সঙ্গে কত পুরনো কাহিনি জড়িয়ে আছে।

– হলঘরে অনেক কঙ্কাল আছে না…। রঘুপতি মরিয়ার মতো বলে।

– ওখানে যদি –

– ওসব বড়লোকদের – পয়সাওয়ালাদের কঙ্কাল, সাব। সবার কঙ্কাল তো ঝোলানো হয় না।

কঙ্কাল হয়ে ঝোলার জন্যও তাহলে পয়সাওয়ালা হতে হয়? কত কিছুই যে জানার আছে!

সেদিন রাতে হরিশচন্দ্র আবার এলো। এবার তার হাতে জন্তুর শিং দিয়ে তৈরি শিঙা। – আমার কঙ্কালটা পেলে?

– খুঁজতে যাব বাবা। রঘুপতি ক্লান্ত স্বরে বলে।

– কোথায়?

– মাটির নিচে।

– কে নিয়ে গেল সেখানে?

– গরিব লোকদের কঙ্কাল সেখানেই থাকে, বাবা। মাটি তো সবাইকেই আশ্রয় দেয়।

– তা বটে, তা বটে। তবে খুঁজে দেখো।

হরিশচন্দ্র চলে যেতে পরের স্বপ্নের আগে রঘুপতির ঘুম ভেঙে যায়। r (চলবে)