ক্যাশলেস লাইফ

অ্যাডভান্স গ্রুপ অব কোম্পানিজের প্রধান কার্যালয়, যারে ব্যাপ্টাইজ করে আজকাল আবার করপোরেট অফিস বলা হয়, তাতে আমার পা পড়তেই পুরো রিসিপশন এরিয়া যেন সচলতায় পা দেয়। আগাগোড়া সবাই চঞ্চল হয়ে ওঠে। পিয়ন-দারোয়ান তো বটেই কাচের ঘেরাটোপ থেকে পুরোদস্তুর একজন রিসিপশনিস্ট, সাজেগোজে পুতুলের আদল নেওয়া চেহারার এক মেয়ে বের হয়ে আসে। একেবারে আমার কোলঘেঁষে দাঁড়ায় – আসুন স্যার, আসুন … 

তাদের এই চঞ্চলতায়, সচলতার বহরে আমারেও অপ্রস্তুতায় ধরে, আগাগোড়া হকচকিয়ে যাই – আমার মতো সামান্য একজন জমি-ব্যবসায়ী, কারো কারো মতে পুরোপুরি দালাল, একজনের জমি আরেকজনরে গছায়ে দিয়া মাঝখান থেকে কমিশন খাওয়া লোক, তারে নিয়া আজ এদের এতো হইচইয়ে পড়া, আদর-অভ্যর্থনার কেতাদুরস্ততার বাহারি বহরে পা দেওয়া কেন?

– চেয়ারম্যান স্যার আপনার জন্য ওয়েট করছেন …

ওহ! আজ তো আমি তাদের চেয়ারম্যান, মানে অ্যাডভান্স গ্রুপের কর্ণধার, খোদ আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী সাহেবের গেস্ট। আগাগোড়া তাঁর অতিথি। তিনি নিজে তাঁর পারসোনাল মোবাইল থেকে গত পরশু কল দেন। রোববার সকাল দশটায় তাঁর অফিসে আসতে বলেন। আর্জেন্ট আলাপ, আবার গোপনীয়ও বটে। তাই কাউকে কিছু বলা বারণ। যা কিছু আলাপ, তার পুরোটাই হবে তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি বসাবসিতে।

তাই নারায়ণগঞ্জ থেকে সাত-সকালে যাত্রা করে যানজটের সঙ্গে কোস্তাকুস্তি সেরে ঢাকার এই মতিঝিলে আসতে আসতে দেখি পাকাপাকি দশ মিনিট লেট। আমি তাই চেয়ারম্যান স্যারের কাছে দ্রুত যাওয়ার জন্য লিফটের দিকে পা বাড়াই। রীতিমতো দু-একটা কদম ফেলি।

কিন্তু রিসিপশনিস্ট মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দেয় – স্যার! বাঁদিকের লিফটে চলুন। ওটা চেয়ারম্যান স্যারের লিফট। অনলি ফর হিম। তিনি ওটাতে ওঠানামা করেন। আপনি আসামাত্র আপনাকে ওটাতে তাই নিয়ে যেতে বলেছেন।

ওমা! এ দেখি আমার জন্য রাজকীয় আয়োজন। পুরোদস্তুর বাদশাহী ব্যবস্থা। আমি তাতে পা দিয়ে রিসিপশনিস্ট মেয়েটার পিছু নিই। সে আমাকে বাঁপাশের লিফটের দরজায় নিয়ে দাঁড় করায়। তার হয়তো দায়িত্ব আমারে এস্কর্টে নেওয়া, একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান স্যারের দরজায় কিংবা তাঁর হাতের কবজায় সোপর্দ করা। তাই সে আমাকে সঙ্গে নিয়ে লিফটে ওঠে। আর আমি তাতে পা দিয়েই বুঝি – এটা স্পেশাল। আগাগোড়া খাস লিফট। কেননা বারোয়ারিগুলিতে হাজারো লোকজনের গা-গতরের গন্ধ মিলেঝুলে যে ভরপুর বোটকায় রূপ নেয়, রীতিমতো ঝেঁকে বসে, এটায় তা পুরোপুরি অনুপস্থিত। ছিটেফোঁটাও নেই।

কিন্তু চেয়ারম্যান স্যার কিংবা আগাগোড়া আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী সাহেব আমাকে এরকম হুড়মুড় করে, পুরোপুরি ইমার্জেন্সিতে চড়ে ডেকে পাঠালেন কেন? তাঁর গোপন-গাপন আলাপের বিষয়বস্তু কী? নিরিবিলি নিঃশব্দের মধ্যে লিফটে দাঁড়িয়ে আমি তা হাতড়ানোয় মন দিই। মনে মনে হিসাব মেলানোর পথ ধরি।

যেহেতু জমিজমা নিয়ে আমার কারবার, তারে উল্টেপাল্টে ভেজে খাওয়া, মানে একজনেরটা আরেকজনরে গছিয়ে দেওয়া আমার ব্যবসা। স্যারের আগাগোড়া তা জানা। তাই হয়তো কোম্পানির আরো কোনো নতুন ইউনিট খোলার জন্য জমি কেনার দরকার। তা নিয়েই নিশ্চয় আলাপে পা দেবেন। কোনো জমি কেনার কথা বলবেন।

কিন্তু সে-আলাপের জন্য তো স্যারের নিয়োগ করা, তাঁর কোম্পানির বেতন-ভাতা খেয়ে-দেয়ে মোটাতাজা হওয়া ডজনখানেক কর্মকর্তা আছে। কোম্পানির এস্টেট ডিপার্টমেন্টে ডিরেক্টর থেকে শুরু করে ডেপুটি, অ্যাসিস্ট্যান্ট তারপর সিনিয়র-জুনিয়র ম্যানেজার-অফিসারের তো কোনো অভাব নেই। তারাই তো সে আলাপের গোড়া থেকে  মাথা, শুরু থেকে শেষ অবধি টেনে নিতে সক্ষম, পুরোপুরি সেরে ফেলতে ওস্তাদ।

এখন তাদের বাদ দিয়ে, পুরোপুরি এড়িয়ে সরাসরি আমার সঙ্গে আনোয়ার আবেদীন চৌধুরীর কিংবা অ্যাডভান্স গ্রুপ অফ কোম্পানিজের কর্ণধারের আলাপ কেন? একেবারে মুখোমুখিতে বসে জমির দালাল ধরার কারণটা কী, অ্যাঁ!

আমার সে-হিসাব মেলানোর, যোগফলে থিতু হওয়ার আগেই আমাদের আপাদমস্তক খাস লিফট বিশতলায় পা দেয়। চেয়ারম্যান স্যারের ফ্লোরে গিয়ে থিতু হয়। আর তার, মানে লিফটের দরজা খুলতেই দেখি তার দোরগোড়ায় খোদ চেয়ারম্যান স্যার হাজির।

এমনিতে তাঁর সঙ্গে আগে কখনো সরাসরি দেখা হয়নি। আলাপ-পরিচয় তো দূর কি বাত। তবে পত্রপত্রিকায় তাঁর ছবি, টিভি নিউজে তাঁর প্রায় নিয়মিত হাজিরার কারণে এক নজরেই তাঁকে চিনে নিতে আমার কষ্ট করতে হয় না। কিন্তু তিনি আমাকে নবাবি কায়দায় স্বাগত জানানোয়, কোনো অনুষ্ঠানের চিফ গেস্টকে আয়োজকদের দু-হাত বাড়িয়ে ‘আসুন’ ‘আসুন’ বলে আহ্বান জানানোর মতো করে ডাকায় আমি ভড়কে যাই। রীতিমতো চমকে উঠি।

এমনকি বুঝে উঠতে পারি না যে, এটা – নিজের সিট থেকে উঠে এসে লিফটের দোরগোড়ায় তাঁর মতো এতো বড়লোকের, দেশসেরা শিল্পপতির আমাকে স্বাগত জানানো কোনো বিনয়ী ব্যবহারের নমুনা, নাকি বড়লোকি চাল, আগাগোড়া নিজের স্বার্থ নিখুঁতভাবে হাসিলের হাতিয়ার।

তবে তার ফয়সালায় পৌঁছার আগেই চেয়ারম্যান স্যারের ডাকে আমার লিফট থেকে নেমে তাঁর, আগাগোড়া আনোয়ার আবেদীন চৌধুরীর সঙ্গ নিতে, তাঁর পাশে পাশে এগোনোর পথ ধরতে হয়। আর তিনি একটা খোলামতো জায়গা পার হয়ে গিয়ে একেবারে তাঁর নিজের রুমে পা দেন।

আমি রুমের মাঝখানের সুপরিসর সেক্রেটারিয়েট টেবিলের এপাশে বসি। আমার মুখোমুখি চেয়ারে নিজের আসনে বসেই মুখ খোলেন আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী – ‘আমার নারায়ণগঞ্জ-রূপগঞ্জ এরিয়ায় কাঠা দশেক ল্যান্ডের একটা প্লট দরকার।’

যা ভেবে এসেছি এ দেখি তা-ই। একেবারে  খাপে খাপে মিল – স্যারের জমি চাই। কিন্তু মাত্র দশ কাঠা, পনেরো শতাংশের মতো, এক বিঘারও আধা। আর তার জন্য এতো আয়োজন – আমাকে ইমার্জেন্সিতে কল দিয়ে ডেকে আনা, তারপর
এ-ভবনে পা দেওয়ার পর রাজকীয় কায়দায় স্বাগত জানানো, আগাগোড়া অভ্যর্থনায় নামা, হায়!

কিন্তু এতোটুকু, আগাগোড়া দশ কাঠা জমি দিয়ে কী হবে? ইন্ডাস্ট্রির নতুন কোনো ইউনিট? অসম্ভব। কারণ এতোটুকু জায়গায় তো তার একটা পা, খুঁটিরও স্থান সংস্থান হবে না। তাহলে কোনো বাড়ি, তা তো স্যারের আছেই – গাজীপুরের আগায়, একেবারে ত্রিশ বিঘা ব্যসার্ধের সুবিশাল গার্ডেন হাউস।

তাহলে অ্যাডভান্স গ্রুপ, দেশসেরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান, আর তার চেয়ারম্যান, আগাগোড়া আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী, যাদের খাঁই নতুন কসমেটিকস ইউনিটের জন্য বিশ বিঘা, আর আবাসনের জন্য এক লপতে দুশো, তারা এই সামান্য দশ কাঠা দিয়ে কী করবে?

কিন্তু স্যার সে-জবাবে না গিয়া তাঁর চাহিদাপত্রের প্যাঁচ, একটা-দুটো শর্ত খোলার, আমার সামনে মেলে ধরার পথে পা দেন – ‘প্লটটা রোমান্টিক প্লেসে হওয়া দরকার। নদীর পাড়ে কিংবা তার ধারেকাছে হওয়া চাই। আছে এমন প্লট আপনার খোঁজে?’

স্যার বলেন কী, অ্যাঁ! বিশ-ত্রিশ বছর ধরে আমি এই লাইনে, জমিজমার দালালিতে। তাই নারায়ণগঞ্জ-রূপগঞ্জ এমনকি গাজীপুরের, মানে ঢাকা শহরের পূর্ব ও উত্তর দিকের সব এলাকার সঙ্গে আমার খায়-খাতির, তাদের জমিজমার সঙ্গে উঠবস। তাই তাদের মধ্যে কার কেমন চেহারা, দেহ-কাঠামোর ধরন-ধারণ কী রকম, তা আমার জানা। ফলে এখানে বসেই বলে দিতে পারি কার কার নদীর পাড়ে বসবাস, কে কে রোমান্টিক পরিবেশ আঁকড়ে ধরা। তারপর আবার কে যৌবনবতী, অন্যের ঘরে যাওয়ার উপযোগী, বিক্রিবাটায় পড়তে প্রস্তুত। তাই আমি অনায়াসে মাথা নাড়ি – ‘জি স্যার। একেবারে নদীর ধারে মনোরম পরিবেশের ভালো কয়েকটা প্লট আছে।’

– বাট প্লটটা আমাদের কোম্পানির কিংবা আমার নামে পারচেজ হবে না।

তাহলে কার নামে কেনা হবে? আমার কৌতূহল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আগাগোড়া বুক টান টান করে দাঁড়ায়। আমি আর সবকিছু ছেড়ে স্যারের দিকে তাকাই। তার মুখের ওপর, চেহারা-চৌহদ্দিতে নজরের ফোকাস ফেলি। তার, মানে চেহারা-সুরতের ভূগোল-ইতিহাসের ওপর শত শত প্রলেপ, দেশি-বিদেশি নামিদামি তেল-লোশনের মাখামাখি, তারপর চুলের মসলাপাতিতে, কলপ-কোলোপে কালোর ঘরে ধরে রাখার চেষ্টার পরও তাতে বয়সের বেশ আনাগোনা চোখে পড়ে। একনজরেই বোঝা যায় যে, ষাটের ঘরে তার বাস-বসতি নেওয়া সারা।

– পুরো প্লটটাই হবে মমতা মঞ্জুরীর নামে …

অ্যাঁ! তিনি আবার কে? স্যারের ওয়াইফ, দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী! না, সে-নাম তো আমার জানা। কী যেন অ্যাঁ! তিনি তো কোম্পানির একজন ডিরেক্টর, আগাগোড়া পরিচালক। খাতাপত্রে তাই তাঁর নাম সোনার আখরে হাজির। সোনারগাঁওয়ে নতুন ইউনিটের জন্য প্লটটা কেনার সময় সে-নাম লিখতে হয়। এস্টেট ডিপার্টমেন্টের লোকজন বেশ আদর-যতনে, তমিজ-লেহাজের সঙ্গে সে-নাম বসায়ে দেয়। হ্যাঁ, এবার মনে পড়ছে – রুবিনা আনোয়ার চৌধুরী।

তাহলে মমতা মঞ্জুরী আবার কে?

শুনেছি ব্যবহারে ব্যবহারে প্রথমজন জীর্ণতায় জড়ালে, বড় বয়সের কব্জায় পড়লে, আজকাল অনেকে আনকোড়া দেখে দ্বিতীয়জন নেয়। আগাগোড়া জীবনের সঙ্গী করে তোলে। তবে তাদের রাখে গাড়ি ও ব্যাংক ব্যালেন্সসমেত আলাদা ফ্ল্যাটে। মমতা মঞ্জুরী কি স্যারের তেমন কেউ?

কিন্তু তাদের জন্য তো রাজধানীর অভিজাতে মোড়া গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকার ফ্ল্যাটগুলি আছে। সেখানেই, শুনেছি তাদের অভয়ারণ্য। আগাগোড়া নিরাপদ জোন। তাই ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে তাদের আবাসন, রাস্তার ধারের মার্কেটগুলিতে
সাজানো-গোছানো শোরুমগুলিতে তাদের সঘন আনাগোনা।

তবে মনে হয় আজকাল জমানা পাল্টানোর পথে পা দিয়েছে, সকালে এক বিকালে আরেক চেহারা নিয়ে সে হাজিরায় আছে। তাই এখন আর হয়তো গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় কুলায় না। বরং শহরের একটু বাইরে খোলামেলা হাওয়ায় নদীর পাড়ে রোমান্টিক পরিবেশে তাদের আবাসনের দরকারের মুখ বাড়িয়ে খাড়া হওয়া সারা। তাই বোধহয় স্যারের এতো
গোপন-গাপনের অলিগলিতে ঘোরাঘুরি, কোম্পানির এস্টেট ডিপার্টমেন্টের লোকজনের চোখ এড়িয়ে আমাকে ডাকাডাকি।   

কিন্তু নামে তো তা মনে হয় না। কেননা শুনেছি তারা, মানে দ্বিতীয়জনরা সবার আগে সোয়ামির নামের অংশ নেয়। নিজেরটার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে দেশ ও বিদেশে দাপট চালায়। কিন্তু মমতা মঞ্জুরীর আগামাথা কিংবা মধ্যভাগের কোথাও তো চৌধুরী নেই। নেই স্যারের আনোয়ার কিংবা আবেদীনের এতটুকু ছোঁয়া। তাহলে সে দ্বিতীয়জন হয় কীভাবে? কোন রাস্তায় কিংবা গলিপথ ধরে, অ্যাঁ!

– নেক্সট উইকে ও প্লটগুলি দেখতে যাবে। যেটা ওর পছন্দ হয়, সে চুজ করে অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল সেটা পারচেজের ব্যবস্থা করবেন।

অ্যাঁ! আগামী সপ্তাহে তিনি আসবেন, জমিগুলির চেহারা-সুরত মাপবেন। তার দেহকাঠামোর রোমান্টিকায় মনোরমায় গজফিতা ফেলবেন। তাহলে তো তখনই তার আগাগোড়া পরিচয়, জন্ম, বেড়ে ওঠা এমনকি বাকিসব জীবনের খুঁটিনাটি জানা যাবে। আমি সে-আশাতেই তাই চুপচাপের ঘরে বসতি নিয়ে থাকি। আর কোনো কথায় পা না দিয়ে বরং কফির কাপে শেষ চুমুকটা সেরে নিয়ে উঠে দাঁড়াই।

দুই

নেক্সট উইকের মাঝের, মানে একেবারে কোমর বরাবরের দিন – মঙ্গলবারের প্রায় পুরোটা সময়, সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটা অবধি তার, মানে মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের সঙ্গে আমার ঘেরাঘুরি করা, একটার পর একটা প্লটরে নজরের আগায়
ছুঁয়ে-ছেনে দেখার পরও তাঁর পরিচয়, তিনি কী করেন কিংবা আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী স্যারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সুতার রং কী – লাল নীল নাকি হলুদ, তার কোনো কিছুই আমার জানা হয়নি।

কেননা দিনভর তাঁর সঙ্গে হাজারো কথা হলেও, এটা-সেটা নিয়ে দুজনে শতেকখানেক বাক্যবিনিময়য়ের পথে হাঁটাহাঁটিতে গেলেও ওসব ব্যাপারে তিনি একটা কদমও ফেলেননি। একবারও মুখে এতোটুকু আনেননি। আর আমার পক্ষে তাই তা নিয়ে জিজ্ঞাসার দরজায় একবারে এতোটুকু টোকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। সরি।

সেদিন, মানে মঙ্গলবার সকাল দশটার দিকে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। মোবাইলে কথাবার্তা, দিকনির্দেশনার আগায় তাঁর গাড়ি রূপগঞ্জের কাঞ্চন ব্রিজের গোড়ায় হাজিরা দেয়। আমার তো তার আগেই সেখানে হাজির হওয়া সারা।

তাই তাঁকে বহনকারী যন্ত্রযান দশটা দশ মিনিটে আমার সামনে এসে ব্রেক কষলে সবার আগে তাঁর বাহন, আগাগোড়া ধবধবে নীল গাড়িখানা পানে আমার নজর ধায়। দেখি তার গা-গতর একেবারে ঝকঝকে চকচকে। এতোটুকু ধুলো-ময়লার আস্তরণ তার দেহকাব্যের কোথাও নজরে পড়ে না। বরং মনে হয়, এইমাত্র তেলের ডিব্বা থেকে তুলে এনে তারে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া। ফলে তার গা-গতর পিচ্ছিলও বটে। কিন্তু তার জাত-পরিচয় কী? আদি ও অকৃত্রিম কোন গোত্রের বংশধর সে? বিএমডব্লিউ, টয়োটা, নাকি মার্সিডিজ, তা ঠিকঠাক মতো ঠাহর করার আগেই আমি যেহেতু রাহবার, পথপ্রর্দশক, তাই আমার তার, মানে চকচকে মোড়া প্রাইভেট কারটির সামনের ড্রাইভারের পাশের আসনে বসে পড়তে হয়।

কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের সিটে বসা খোদ মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের পানে তাকিয়ে ধাতস্থ হতে মোটামুটি আধা না হলেও কোয়ার্টার ঘণ্টা কাটে। কেননা আমার মধ্যস্থতায়, কারো কারো ভাষায় দালালিতে যারা প্লট কেনায় পা দেয়, তারপর তাদের মেয়ে কিংবা বউরে নিজের চোখে প্লট পরখ করতে পাঠায়, তারা সবাই পুরোদস্তুর বড়লোক। গুলশান-বনানী-বারিধারার মতো গাল ফোলানো এলাকার বাসিন্দা। ফলে তাদের মেয়ে-বউরাও স্বভাবত সাহসী সুন্দরীর কোটায় ঘোরাফেরা করে। রূপসীর আগায় বসবাসে থাকে। ফলে কখনো কখনো তাদের পানে আমাকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু এতো বছর ধরে দেখা এতো এতো সুন্দরীর সবাইকে যেন এক টোকায় মমতা মঞ্জুরীর কুপোকাত করা, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেওয়া সারা।

তাই আমার মনে হয়, উঁচু-লম্বা কিংবা সৌন্দর্যে দেশি নায়িকাকুল তো তাঁর কাছে ফেল বটেই, বলিউডেরগুলিও যেন এতোটুকু পাত্তায় পাত পাবে না। আমার চোখ তাই তাঁর পানে অপলকে পড়ে, যেন থির হয়ে রয়। তারপর ধীরে ধীরে আমি ধাতস্থ হওয়ার পথে হাঁটি। এক পা দু পা করে ফেলি। তখন, জীবনের দু-চারজন মেয়েমানুষ ছানাছানি, হাতের মুঠোয় নিয়ে কচলাকচলির অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ আমার মন যেন নিজে নিজে ঠিক করে নেয় যে, মমতা মঞ্জুরীরে রক্তমাংসে তো নয়ই, আগাগোড়া মোমেও নয়, বরং একেবারে খাঁটি ও নির্ভেজাল মাখনে গড়ে তোলা। তাই নরম তুলতুলে তার দেহকাঠামো। তার ওপর হালকা ঘিয়ে রঙের আস্তরণ, হাজারো কারুকাজ চুমকি-কারচুপিতে সমৃদ্ধ সালোয়ার-কামিজ তার জৌলুসরে আরো
দু-দশ কদম এগিয়ে নেওয়া, তাকে আগাগোড়া একেবারে রাজকীয় করে তোলা সারা।

ধাতস্থতার পথে হাঁটাহাঁটি শেষ হলে আমি ড্রাইভারকে হুকুমের পথ ধরি – গাড়ি আগাও, কদমপুরার রাস্তা ধরো।

শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় বরাবর গা-গতর মেলে দেওয়া কদমপুরা গাঁও, রূপগঞ্জের সমৃদ্ধিশালী এক জনপদ। তার
পরিবেশ-পরিস্থিতি বেশ রোমান্টিক। আগাগোড়া মনোরম। তাই মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের জন্য যে কয়টা প্লটের খোঁজখবর আমার মুঠোয় পোরা সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে মনোরমটা সে গাঁওয়ের কানায়, একেবারে নদীর কিনারায়।

আমি তাই সবার আগে সেই গাঁওয়ের প্লটটার কাছে মমতা মঞ্জুরীকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেটা যদি তার মন জয় করে নিতে পারে, তার মনে আগাগোড়া ঠাঁই পেয়ে যায়, তার পুরোদস্তুর পছন্দ হয়, তাহলে আর বাকিগুলির কাছে ধরনা দেওয়ার, ছুটে যাওয়ার পথে না নামলেও চলবে। বরং এক চান্সেই, একটা প্লট দেখানোতেই কেল্লাফতে, প্রথম বলে ছক্কা হাঁকানো হয়ে যাবে। আর আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী স্যারের কাছে আমার দালালির সাফল্যের চূড়ায় চড়া সম্ভব হবে।

তাই তার পানে সবার আগে গাড়িকে যাত্রা করতে, কদম কদম ফেলে আমার এগোতে বলা। তারপর সে, মানে গাড়ি মেইন রোড ছেড়ে গাঁওয়ের পথে পা দিলে, আস্তে-ধীরে এগোনো শুরু করলে মমতা মঞ্জুরী ম্যাডাম আমার পানে ফেরেন। কতদিন থেকে এ-পেশায় আছি, কোন কোন কোম্পানিকে সার্ভ করি, জমি-জিরাতের সুলুক-সন্ধান দিই ইত্যাদি জিজ্ঞাসার পথ ধরেন। এমনকি তার আগায় পা দিয়ে আমার ঘর-সংসার কেমন, ছেলেমেয়ের সংখ্যা কটা – এসবের পানেও ধান।

কিন্তু আগাগোড়া আনোয়ার আবেদীন চৌধুরীর সঙ্গে ম্যাডামের সম্পর্কের সুতা এতটুকু ছাড়েন না। তা যেমন নাটাইয়ে প্যাঁচানো ছিল তেমন একটার ওপর আরেকটা প্যাঁচ দেওয়াই থেকে যায়। আমি তাই ধূসর ধোঁয়ায় পড়ে থাকি। শেষে তাতে খাবি খাই – স্যারের প্রথম কিংবা দ্বিতীয়জন তো নয়, তা আগেই আমার বোঝা সারা। তাহলে কি  তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন – মামাতো চাচাতো ফুফাতো বোন? এমনকি যে-বয়স তাতে তাদের কারো ঘরের মেয়েও হতে পারে। কিন্তু দূর কিংবা কাছের যে-কোনো ধরনের আত্মজনই হোক না কেন, আমার অভিজ্ঞতায় দেখা, তারা এসেই সবার আগে সম্পর্কের ওপর চড়ে বসে। তার দাপটে হয়তো পুরো দিনই কাটায়। স্যারগো নাম করে দরকারি-অদরকারি হুকুম-আহকামের পথে পা দেয়।  

কিন্তু মমতা মঞ্জুরী তো এখন অবধি সে-পথে এতোটুকু হাঁটেননি। এমনকি মনের ভুলেও একবারের জন্যও আনোয়ার আবেদীন চৌধুরীর নাম মুখে আনার রাস্তায় পা দেননি। তাহলে মমতা মঞ্জুরী কি স্যারের কোনো বান্ধবী?

স্কুল-কলেজ কিংবা ভার্সিটির পুরনো মেট? তাই তাঁর জন্য গোপনে-গাপনে, কাউকে কিছু না জানিয়ে প্লট খুঁজে দিতে আমাকে তাঁর হুকুম, বিশতলা ভবনের সর্বোচ্চ তলায় ডেকে নিয়ে নির্দেশ দেওয়া? হবে হয়তোবা।

তবে একজনার বয়স তো দেশি-বিদেশি ক্রিম-লোশনে মুখের পাটাতন, কলপ-কোলপে চুলের বাহার অটুট রাখার শত চেষ্টার পরও অনায়াসে বলা যায় ষাটের কোটায়। আরেকজনকে দেখেশুনে তো মনে হয় তার বিশের কোটাও পাড়ি দেওয়া হয়নি। তাহলে গাছের গোড়ার আর আগার বয়সী দুজনে একই সময়ে একই স্কুল-কলেজ বা ভার্সিটিতে পা দেয় কীভাবে? তারা একজন আরেকজনের ক্লাসমেট হয়ে ওঠে কোন পথে?

আজকাল অবশ্য বন্ধু-বান্ধবীর ক্ষেত্রে অসমবয়সের গল্প-কাহিনি বেশ শোনা যায়। পত্রপত্রিকায় প্রায়ই তাদের নিয়ে খবর ডানা মেলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালের পথ ধরে। তাহলে কী স্যার, আগাগোড়া আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী আর মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের মধ্যে সে-রকম কোনো কাহিনি দানাবাঁধা, পুরোদস্তুর একখান গল্প হয়ে খাড়া?

কিন্তু অ্যাডভান্স কোম্পানি আমার ক্লায়েন্ট, পুরোপুরি কাস্টমার। তাই সব সময় তার খোঁজখবরে থাকি, পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে খুঁটিনাটিতে প্রায় সর্বক্ষণই চোখ রাখি। কই! তার কোথাও তো তার চেয়ারম্যানের এমন অসমবয়সী বান্ধবীর খবর কখনো আসেনি। আমার চোখের আগায় এতোটুকু নাচেনি।

তাহলে এই আগাগোড়া রূপসী, পুরোদস্তুর রমণী মমতা মঞ্জুরী কে? কোন সুতায় সে আনোয়ার আবেদীন চৌধুরীর সঙ্গে বাঁধা। একেবারে পুরোদস্তুর গা-গতর, অন্তরজুড়ে জাড়ানো, অ্যাঁ?

সে মীমাংসায় আমার পা দেওয়ার আগেই গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ভেদ করে বিছিয়ে রাখা চোখে দেখি আমাদের কদমপুরা গাঁওয়ে পা দেওয়া সারা। তার অন্তরে ঢুকে পড়া শুরু। তাই ড্রাইভারকে বলি – সামনের মোড় ঘুরে গাড়ি থামাও।

রাস্তার কাছেই প্লটটা। তাই গাড়ি থামলে বাঁপাশে তাকিয়ে তাকে দেখা যায়। আগাগোড়া তার গা-গতরে নজর বুলানো সম্ভব হয়।

তবে ঢাকা শহরের মতো ইট-বালু-সিমেন্টের হাতে গড়া, একটার কোলঘেঁষে দাঁড়ানো আরেকটা ভবনের বস্তি এলাকা থেকে যারা আসে, তারা এরকম বুকখোলা প্রশস্ত জায়গা দেখলেই প্রথমে উচ্ছ্বাসে ফাটে – ‘ওয়াও! কী সুন্দর, আগাগোড়া সবুজে মোড়া।’ কিন্তু মমতা মঞ্জুরী ম্যাডাম দু-চার পলক ধরে প্লটটা পানে তাকিয়েও এতটুকু উচ্ছ্বাসে মাতেন না। আগাগোড়া নির্লিপ্ততায় মুড়ে থাকেন। তাহলে কি প্লটটা তার পছন্দে পড়েনি? তা বোঝার আশায় আমি ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসা তার দিকে তাকাই। দেখি নিরুত্তাপে মোড়া তার চেহারা। ফর্সা গোলগাল মুখাবয়বে এতোটুকু উচ্ছ্বাসের আনাগোনা নেই। ফলে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই – এ-প্লট ম্যাডামকে গছানো, তার করকমলে সোপর্দ করা সম্ভব হবে না। এখন তাহলে আরেকটা পানে ছুটতে হবে। তার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সামনে তাকাতেই পেছনে থেকে শুনি মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের বাক্য – ‘চলুন, আরো কাছে গিয়ে দেখি।’

এবারে আবার আমার বুক বাতাস পায়। স্বস্তির নিশ্বাস নিতে সক্ষম হয় – নিশ্চয়ই প্লটটা ম্যাডামের পছন্দে পড়েছে। তাই কাছে গিয়ে হাতে ধরে, দরকারে গা-গতর টিপেটুপে, ঘাস-মাটি হাতে তুলে নিয়ে দেখতে চাইছেন। আমি তাই তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলে নামি। দেখি তার আগেই পেছনের দরজা খুলে ম্যাডামের নামা সারা।

আনোয়ার আবেদীন স্যারের বারবার বলে দেওয়া – কেউ যেন না জানে, যেন কারো নজরে না পড়ে। আমি তাই আমার সাঙ্গপাঙ্গদের কাউকে সঙ্গে আনিনি। এমনকি জমির আদত মালিককেও কাছে ঘেঁষতে না করে দিয়েছি। তাই আমার নিজেরই ম্যাডামকে পথ দেখাতে, আলপথ দিয়ে তাঁকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। তবে বেশি তো দূরের না, কেবল দু-চার কদমের পথ, তা পাড়ি দিয়ে আমরা প্লটটার কাছে যাই। একেবারে তার বুকের ওপর গিয়ে দাঁড়াই।

এখন দূর্বাঘাস, পুরুষের মাথার চুলের মতো ছোট ছোট সাইজের সবুজতন্তুতে ছাওয়া, তার কবলে পড়া পুরো দশ কাঠা ভুঁই। তার দাগ নম্বরে, খতিয়ানের খাতায়, দলিল-দস্তাবেজে আমার আগেভাগেই সায়ের করা, দেখেশুনে নেওয়া সারা। তাই নিশ্চিন্ততায় পা দেওয়া যে, এ জমির গা-গতর একেবারে নিষ্কণ্টক। কলঙ্ক, বিরোধ-বিসংবাদের এতোটকু আঁচড়বিহীন তার স্বভাবচরিত্র। আর মালিক শাহজাহান আলী। তার বড় ছেলে নিষ্কর্মায় পড়া। তাই তারে আরব জাহানের কোনো দেশে, মরুভূমির ময়দানে রফতানির জন্য চাই জরুরির ঘরে পোরা তোড়া তোড়া টাকা। সে-টাকা আজকে পেলে কালকেই সে প্লটটার ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিতে, দখলানা ছেড়ে দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত। তখন মালিকের আসনে মমতা মঞ্জুরীকে, আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী স্যারের সঙ্গে অজানা-অচেনা বাঁধনে বাঁধা এই রূপসী রমণীকে বসিয়ে দিতে আমার আর কোনো বাধার বগলে পড়তে হবে না।

কিন্তু প্লটটায় কয়েকটা কদম ফেলে। এমাথা ওমাথায় সায়েরের মাথায় গিয়ে ম্যাডাম আগল দেন – ‘নো, এ্যাই প্লটটা সুইট্যেবল নয়।’

অ্যাঁ! পছন্দের একেবারে তীরে এসে মমতা মঞ্জুরী ম্যাডাম এ কী বলেন? আমি তাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁর দিকে তাকাই। আনোয়ার স্যার যেরকম বলেছেন সেরকমই তো আছে প্লটটা – একেবারে নদীর গতরঘেঁষা। তার পাড় ধরে আসন নেওয়া। তারপর আবার মেয়েমানুষের মতো উঁচাধজা তার বুক। তাই এখনই তার গতরে বিল্ডিং পাতা, বাস-বসতির ভবন গড়ে তোলা সম্ভব। তাহলে সুইট্যাবল নয় কেন? তার ক্ষতটা কোথায়? মেয়েমানুষের মতো ফাটাটা কোন গাতা-গর্তে লুকানো অ্যাঁ!

– একেবারে জঙ্গলে ঘেরা …

অ্যাঁ! জঙ্গলের হাতের মুুঠোয় পোরা! তার বেষ্টনীতে ধরা হবে কেন? এ তো লোকালয়। চারিদিকেই তো লোকজনের বাসবসতি। তারপরও ম্যাডামের কথার আগায় আমি আশেপাশে তাকাই। চোখ বুলানোর পথে হাঁটি। দেখি প্লটটার পশ্চিম দিকে নদী, জলের ছোটাছুটির সুপ্রশস্ত, হয়তোবা সাতশো-আটশো ফিটের রাস্তা ঠিকই, তবে উত্তর ও দক্ষিণ পাশে একেবারে লাগোয়া দুখান বাড়ি। লোকজনের বাসবসতির আলয়। আর তার উর্বরা গতর ফুঁড়ে আকাশপানে এগোনো হাজারো গাছগাছড়া, আর তাদের ঝাঁকড়া মাথার ডালপালার সুবিশাল সভা-সমাবেশ যেনবা। আর পূর্বদিকে রাস্তা, একেবারে পাকাপোক্ত পিচে মোড়া তার গতর ঠিকই, কিন্তু তা পাড়ি দিলেই, ক্রস করে ওপারে গেলেই আবার আরেকখান আলয়। কোনো এক লোকের বসতবাড়ি। তাতেও গাছগাছড়ার বিপুল সমারোহ। ফলে প্লটটারে মনে হয় তিন দিক থেকে বনজঙ্গলের হাতে হাতে বেড় দিয়ে ধরা একটুকরো ফাঁকা জায়গা। তাই মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের পছন্দে পড়েনি। আগাগোড়া অপছন্দের ঘরে সে থিতু হয়ে গেছে। তাহলে এখন উপায়?

– আপনার খোঁজে আর কোনো প্লট নেই?

থাকবে না কেন? পুরো রূপগঞ্জ আমার হাতের মুঠোয় পোরা। তার রেখায় রেখায় বসতি নেওয়া। তাই একটা কেন, আরো পাঁচটা আছে। নদীর তীর ধরে রোমান্টিকতায় ভরপুর তারা।

আমরা তাই আবার গাড়িতে উঠে নতুন প্লটের পথ ধরি। দরিয়াপাড়া গাঁও পানে এগোই। কিন্তু সে-গাঁওয়ের প্লটটা, আগাগোড়া সাড়ে দশ কাঠার জমিটুকু আবার একেবারে খোলা জায়গায়। তার আশেপাশে বাড়িঘর, গাছপালা কিংবা ঝোপঝাড়ের কোনো বালাই নেই। বরং দূর দূর অবধি কেবল ধানিজমির জয়জয়কার। বাঙালির প্রধান খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেতের খতিয়ান। গাড়ি থেকে তার পানে তাকিয়ে মমতা মঞ্জুরী ম্যাডাম আরো খুঁত বের করেন – নদী থেকেও তো দূরে।

হ্যাঁ তাই। আগের প্লটটার মতো একেবারে নদীঘেঁষা নয়। বরং তার ওপাশে লাগোয়া আরো দু-খণ্ড খালি জমি। ভালো করে তাকিয়ে দেখি একবারে নিরীহ-নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে তারা শোয়া। তার পরে গিয়ে জলের স্রোতধারার কিনারা, তার বগলতলা শুরু।

তাই মমতা মঞ্জুরী ম্যাডাম এক বাক্যেই এ-প্লট নাকচ করে দেন। তাকে আগাগোড়া না-পছন্দের ঘরে ফেলেন। আমরা তাই পরেরটা, মানে পাতিয়ারা গাঁওয়ের প্লট পানে ছুটি। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে এগোই।

সেটা অবশ্য মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের পছন্দে পড়ে। পুরোপুরি তার মনে ধরে। আমি তাই স্বস্তিতে পা দিই। দিনভর আমাদের দৌড়াদৌড়ি সার্থকে থিতু হয়।

প্লটটা পাতিয়ারা গাঁওয়ের পশ্চিম মাথায়। রূপগঞ্জজুড়ে গজিয়ে ওঠা, যত্রতত্র মুখতোলা শখানেক রিসোর্ট, ঢাকার লোকজনের মন ভোলানোর জন্য সাজিয়ে-গুছিয়ে ও বেড়াটেরা দিয়ে রাখা নকল গ্রামগুলির একটার একেবারে লাগোয়া। আগাগোড়া তার দেয়ালঘেঁষা। বাকি তিনদিকের একটাতে যথারীতি নদী, আরেকটা এখনো খালি, তাতে কেবল দূর্বাঘাসের ঘন বসতি। আর শেষেরটায় তো আমরা গাড়ি নিয়ে হাজির। পুরোদস্তুর পিচে মোড়া রাস্তা।

মমতা মঞ্জুরী ম্যাডাম পুরো প্লটটায় একটা চক্কর, আগাগোড়া সায়ের শেষ করে তবেই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়েন। দুই হাতের বুড়ো আঙুল বাগিয়ে ধরে পুরো শরীরে একটা ঢেউ খেলিয়ে মুখ খোলেন – ইয়েস, ইট ইজ ওকে।

সঙ্গে সঙ্গে আমি প্লটের আদি ও অকৃত্রিম মালিক আগাগোড়া হেদায়েত আলী গাজিরে কল দিই। যেহেতু দামদস্তুর আগে থেকেই ঠিকঠাকের ঘরে পা দেওয়া, পুরোদস্তুর থিতু হওয়া, তাই তাকে বেশি কিছু আর বলতে হয় না। কেবল রেজিস্ট্রেশন, মালিকানা হস্তান্তর, গাজি থেকে মঞ্জুরীতে পা দেওয়ার দিন-তারিখ জানিয়ে দিই।

তিনি এমনিতে বুড়ো মানুষ, তারপর দেহজুড়ে হাজারো রোগ-বালাইয়ের বাহক, তাই তার চিকিৎসা, হাসপাতালের মোটাতাজা খাঁই মেটানোর জন্য ভারী অঙ্কের টাকা তাঁর দরকার। তাই আমার দুদিনের মাথার তারিখটা মেনে নেন। পুরোপুরি তাতে সম্মতি জানান।

সবকিছু ফাইনাল হয়ে গেলে আমি প্লটটার বুক বরাবর থেকে তার পুব বগলের দিকে, রাস্তার পানে পা বাড়াই। ঠিক তখন আগাগোড়া আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী স্যারের কলে আমার ফোন কেঁপে ওঠে।

অ্যাঁ! আমরা কি স্যারের ফলোতে আছি? গুগল অ্যাপের ঘাড়ে চড়ে তাঁর চোখে চোখে? তা না হলে একেবারে মোক্ষম সময়ে, সবকিছু ফাইনালে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কল এসে মোবাইলে পা রাখে কীভাবে, অ্যাঁ। আমি তাই কাঁপাকাঁপা হাতে তাঁর কল পাকড়াই – হ্যালো স্যার, বলুন স্যার …

– প্লটের পেমেন্টের টাকাটা আমার কাছ থেকে কালেক্ট করবেন। চেক রেডি করে রাখব।

তার মানে প্লট কেনার টাকাটা দেবেন স্যার, কিন্তু প্লটটা হবে মমতা মঞ্জুরীর নামে। বাহ! বেশ, তাহলে তো বলতেই হয় তাঁদের মধ্যে সম্পর্কটা অনেক গাঢ়, একেবারে গহিন-গভীরে পোঁতা। কতটা তার ঠাঁই? তা বুঝতে যাওয়ার, মাপামাপির পথে নামার কিংবা আদার বেপারি হয়ে জাহাজের খবর নেওয়ার চেয়ে আমার দরকার কমিশন, লোকজনের ভাষায় দালালির টাকা। তা তো এক-দুই টাকার মামলা নয়। বরং সোনার দামে কেনা জমি, মনোরম পরিবেশের প্লট, তাই তার দালালি কিংবা কমিশনও রুপার দামের সমতুল্য। কিন্তু তা কে দেবেন?

– আমার সঙ্গে শুধু প্লটের কন্ট্রাক্ট,  তাই তার যা প্রাইস, অনলি সে প্রাইসমানিটা আমার কাছে থেকে পাবেন…।

তার মানে আনোয়ার আবেদীন চৌধুরীর কাছে আমার কমিশনের টাকাটা পাওয়া যাবে না। তাহলে বাকি থাকে মমতা মঞ্জুরী। আমি তাই তার পানে তাকাই। তিনি অবশ্য তা দিতে একবাক্যে রাজি হয়ে যান – তা পেতে আমার সঙ্গে আপনার একটা কন্ট্রাক্ট করতে হবে। আপনার স্যার আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী সাহেব যেমন করেছেন। তাই আসুন, আমার গুলশানের বাসায়, তখন সবকিছু ফাইনাল করা যাবে।

কিন্তু কন্ট্রাক্ট! মানে চুক্তি? তা আবার কেন? কই! এতো বছর ধরে এতো কোম্পানিকে, শত শত লোকজনকে জমির এতো খোঁজখবর দেওয়া, তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা কমিশন বাগিয়ে নেওয়া সারা। তাদের কেউই তো কখনো কোনো কন্ট্রাক্টে যায়নি। চুক্তি-ফুক্তিতে সই-সাবুদের পথে পা পড়েনি। বরং গুনে গুনে নগদে কিংবা চেকে কমিশনের কাহিনি, পার্সেন্টেজের টাকাটা বুঝিয়ে দিয়েছে।

তবে কন্ট্রাক্ট করতে ম্যাডামের বাসায় গেলে নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে স্যারের রিলেশনের আগামাথা বোঝা যাবে, তার গভীরতা মাপা, ফিট-ফুট ধরে এগোনো সম্ভব হবে। সে-আশাতেই আমি ঘাড় কাতাই, পুরোপুরি সম্মতি দিই।

তিন

মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের বাসার

কাঠ-কাপড়ে গড়া সোফায় পাছা বিছিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি এদিকের দেয়ালটা পুরোপুরি কাচের, স্বচ্ছ দেহাবয়ব নিয়ে সে ওপর থেকে নিচ অবধি খাড়া। তাতে পুরো ড্রয়িংরুম হেসেখেলে বেড়ায়। আগাগোড়া প্রতিবিম্ব হয়ে দেখা দেয়। আমি তাই সে কাচের দেয়ালে নজর বিছিয়ে রেখে ম্যাডামের আগমনের, তার নগদ নগদ সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকি।

কিন্তু একি! গ্লাসের দেয়ালে কার ছায়া? আপাদমস্তক প্রতিবিম্বটা কার? ম্যাডামের নয়, তবে চেনা চেনা চেহারার আদল। শেষে নজরকে তীক্ষèতায় নিয়ে, কড়া করে তুলে তাকিয়ে দেখি – আরে এতো আমার স্যার, আগাগোড়া আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী, অ্যাডভান্স গ্রুপ অফ কোম্পানিজের কর্ণধার, পুরোদস্তুর চেয়ারম্যান। ওপরের তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বের হওয়ার দরজার পানে তার কদম।

আরো নিশ্চিত হওয়ার ঘরে থিতু হতে আমি ঘাড় ঘুরাই। সরাসরি তাকিয়ে দেখি সত্যিই স্যার বটে।  তবে ওপাশের চামড়ায় মোড়া সোফা সেটের পাশ দিয়ে তার পা বাড়ানো। বের হওয়ার দরজা পানে সে আগানো।

মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের বাসায় স্যার! তাও আবার তার অন্তর, মানে একেবারে অন্দরমহল থেকে বের হওয়া। তাহলে তো তাদের মধ্যকার রিলেশনের গোড়াঘাট অনেক গভীরে পোঁতা। একেবারে আগামাথা জুড়ে জড়ানো। কিন্তু সে রিলেশনখানার নাম কি? তারে কি বলি – স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, কিংবা আত্মীয়স্বজন? কই, তার কোনো কিছুই তো নয়। তাহলে তাদের রিলেশনের জাত-পরিচয়, বংশ-গোত্র কী হবে? কোন নামে তাকে ডাকা যাবে?

সে হিসাব করার, ঐকিক নিয়মের অঙ্কের মতো স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে গিয়ে তার ফল বের করার, তাদের মধ্যকার রিলেশনের গিঁটটা বুঝে নেওয়ার আগেই দেখি স্যারের আরো দু-কদম ফেলা সারা। তড়িঘড়ির ঘেরাটোপে ঘেরাও হয়ে দরজাপথে রীতিমতো বের হয়ে যাওয়া শেষ।

স্যার কি আমাকে দেখেছেন? তাঁর নজরের আগায় কি পড়েছি? নিশ্চয়ই নয়। কেননা তাড়াহুড়োর কবলে পড়া, তার ঘেরাটোপে ঘেরাও হয়ে কদম ফেলে এগিয়ে যাওয়া কোনো মহিরুহের পক্ষেই আশেপাশে ঘাপটি মেরে থাকা লতাপাতা, তৃণমূল পানে নজর দেওয়া, তারে চিনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি তাই নিশ্চিত হয়ে আবার ঘাড় ঘুরাই, চোখকে ফিরিয়ে নিয়ে সামনের কাচের দেয়ালে গাঁথি। তারপর আমার আজকের মূল-মহাজন – মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের আগমনের অপেক্ষায় থাকি।

তাঁর নামে গতকালই রূপগঞ্জের নদীর পাড়ের মনোরম পরিবেশের প্লটটার রেজিস্ট্রেশন, আগাগোড়া মালিকানা হস্তান্তর, গাজি থেকে মঞ্জুরীতে সোপর্দ হওয়া সারা। আমি তাই আর দেরির ঘরে থিতু না হয়ে বরং তাওয়া গরম থাকতে থাকতেই আজ সাত-সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার পানে যাত্রা করে গুলশানে এসে হাজির হই।

আমার ব্যবসার ক্ষেত-খামার, কমিশন বাগানোর লীলাভূমি ঢাকার বাইরে, তার পৌর-চৌহদ্দির হাতের নাগালের ওপারে বটে, কিন্তু আমার কাস্টমার কিংবা খদ্দের অথবা গ্রাহক – যা-ই বলেন না কেন, তাদের বেশিভাগের গুহা-গৃহ এই এলাকায়।

গুলশান-বনানী-বারিধারার দরদালানের বনজঙ্গলজুড়ে। তাই এই পায়াভারী এলাকায় আমার প্রায় নিত্য যাতায়াত। ফলে তার অলিগলি, ছিলাপথ আমার চেনাজানা, মোড়-ময়দান সব পুরোপুরি মুখস্থ। 

মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের দেওয়া ঠিকানা, তার বাড়ি ও রোড নম্বর ধরে তাই এগিয়ে গিয়ে তার বাসভবনখানা চিনে নিতে আমার কোনো বেকায়দায় পড়তে কিংবা বেহদ্দের মতো খোঁজাখুঁজিতে নামতে হয় না। বরং সে-বাড়ির সামনে হাজির হয়ে দেখি – আরে এতো ষোলো আনা লেকের পাড়ে। গুলশানের জলের আশয়ের একেবারে কোলঘেঁষে খাড়া। তন্বী-তরুণীর মতো একহারা এগারোতলা তার গড়ন। তাই তার আপাদমস্তকে একবার চোখ বুলিয়েই বুঝে যাই যে, তার গতরের পুরোটা জুড়েই কেবল ডুপ্লেক্স, দুটো করে তলা জোড়া দিয়ে গড়ে তোলা একটা করে ইউনিট, সুপ্রশস্ত ফ্ল্যাট।

মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের নাম বলতেই দারোয়ান, উর্দিতে মোড়া দেহখান নিয়ে গেট হা করে খুলে দেয়। ভেতরে পা দিয়ে দেখি – একটু খোলামতো জায়গা। গ্রাম বা মফস্বলের বাড়ি হলে তারে আঙিনা বা উঠান বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু এখানে দেখি তার মাঝখানে একটা ফোয়ারা, জলের নাচানাচি করার, আনন্দে-উচ্ছ্বাসে মাতার বিশাল রংমহল। তা পাড়ি দিয়ে এগিয়ে ভবনের বাঁ পাশেই পেয়ে যাই লিফট। তার এক বুনি টিপতেই সে আমাকে তুলে নিয়ে এক নিশ্বাসে ছ-তলায়, মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের ফ্লোরে পৌঁছে দেয়।

কাঠের ওপর কারুকাজে মোড়া দেহখান নিয়ে খাড়া দরজার কলিংবেলে হাত ছোঁয়াতেই সে হা হয়। তার ফাঁক গলে তখন এক অল্পবয়সী মেয়ে মুখ বাড়ায় – আসুন, ভেতরে আসুন।

মেয়েটার চেহারা-সুরত, কেতাদুরস্ত পোশাক-আশাক আর মাপামাপা বুলিতে তার আপাদমস্তক আমার মাপা হয়ে যায়। সে নিশ্চয়ই ম্যাডামের পিএস, আগাগোড়া পারসোনাল লোক। কিন্তু তারা তো থাকে অফিসে, বড় বড় স্যারের রুমের সামনে সমাসীন। এখানে সে কী করে, অ্যাঁ? তাহলে এটাই কি ম্যাডামের অফিস, পুরোপুরি বাণিজ্যালয়? নাকি পিএসদের প্রাদুর্ভাবের আজকাল হাত-পা ছড়ানো সারা। তাই তাদের গুলশান-বনানী এলাকার বাড়িঘরগুলিতেও গ্যাট হয়ে বসা শুরু।

তবে তার ডাকে সাড়া দিয়ে ভেতরে পা দিতেই শীতল হাওয়ারা এসে আমার গতরে গা মেলায়। কোমল পরশ বুলিয়ে দেয়। আমিও স্বস্তিতে পড়ি – যাক বাবা! এতোক্ষণে তাহলে মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের বাসায় পা দেওয়া সম্ভব হলো। নিশ্চয়ই আজ সবকিছু – মানে ম্যাডামের সঙ্গে স্যারের রিলেশনের আগামুড়া বোঝা আর আমার কমিশনের টাকাটা বাগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে দেখি – এতো এলাহি কারবার। গ্রামের স্কুলের খোলামেলা মাঠের মতো প্রায় পুরোটা ফ্লোরজুড়েই ড্রয়িংরুম। তবে তার আগামুড়া – এপাশ থেকে ওপাশ অবধি একেবারে টিপটপে সাজানো-গোছানো। তাই কোনো ফাইভ কিংবা সিক্স স্টার হোটেলের লবির মতো তার কেতাদুরস্ত চেহারা-সুরত।

এদিকে এক, মাঝখানে ওপরের তলায় গমনাগমনের সিঁড়ির ওদিকে আরেক, যেন দুই পক্ষের দুই গোলপোস্টের মতো দুই সেট সোফা ফিট করা। দেখেই বোঝা যায় ওদিকটার হাবভাব বেশ গর্জিয়াস, পুরু গদিতে গড়া, আবার ষোলো আনা চামড়ায় মোড়া। আর এদিকটার পুরোটাজুড়েই যেন ফোম আর কাঠ-কাপড়ের কারবার। তাদের হাতের মুঠোয় পোরা।

আমি সামান্য জমির দালাল, কমিশনখোর লোক, তা বোধহয় পিএসের জানা, তাই সে আমাকে কাঠ-কাপড়ের কারবারেরটার প্রতি ইঙ্গিত করে – এখানে বসুন, ম্যাডাম একটু বিজি আছেন। আপনার কথা বলেছি। ফ্রি হলেই আসবেন।

কিন্তু তার অপেক্ষায় বসতেই আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী স্যার আসেন, চোখের সামনে দিয়ে আবার চলেও যান। তারপর আর কে একজন আমার সামনে চা-বিস্কুট রেখে যায়। তাও তো শেষ। অথচ ম্যাডামের কোনো নাম-গন্ধও নাই হায়! সে এলে তার সঙ্গে কন্ট্রাক্টের আলাপটাকে ফাইনালে ফেলা, স্যারের সঙ্গে ম্যাডামের রিলেশনটার বোঝাপড়ায় যাওয়া যাবে –
এ-আশাতেই আমি চুপচাপের ঘরে থিতু হয়ে থাকি।

এইসব গুলশানি বড়লোকদের নিয়ে বড় জ্বালা। এরা যেন লোকজনকে অপেক্ষায় রাখতে মজা, বড়শিতে গাঁথা মাছ নিয়ে খেলার মতো আনন্দ পায়। তাই তাদের অফিসে আর কিছু থাক বা না থাক একটা বড়োসড়ো হাত-পা ছাড়ানো ওয়েটিংরুম, আগাগোড়া অপেক্ষাগার মুখ হা করে থাকে।

কিন্তু এ তো বাসা, এখানে আর কতক্ষণ অপেক্ষায়, তার মুঠোয় পোরা অবস্থায় আটকে পড়ে থাকতে হবে অ্যাঁ? আমাকে তাই একসময় অস্থিরতায় পায়। চার হাত-পায়ে সে যেন আমাকে আঁকড়ে ধরে। তবে অপেক্ষার পালা যতই ভারীতে পা দিক, দীর্ঘতরে রূপ নিক না কেন আমি আজ তার শেষ দেখে, মুড়ায় পৌঁছে স্যার ও ম্যাডামের মধ্যকার রিলেশনের গিঁটটা বুঝে নিয়ে, আর আমার কমিশনটা বগলদাবা করে তবেই যাব। এ সিদ্ধান্তে পাকাপাকি হয়ে আমি তাই অনড়-অটল হয়ে সোফায় বসে থাকি।

কেননা কমিশন বা দালালির – যা-ই বলেন না কেন, তার টাকাটা আমার খুবই জরুরি দরকার। কারণ বছরখানেক আগে নারায়ণগঞ্জে আমার বাড়ির কাছের একেবারে লাগোয়া একখান ভুঁই বায়নায় পোষ মানায়ে রাখা সারা। কিন্তু এখন আর সে তার খাঁচায়, বায়নার বাঁধনে আটকা পড়ে থাকতে চায় না। বরং পুরো টাকাটা নিয়ে আমার বাড়ির সঙ্গে একজোট বাঁধতে উদগ্রীব। আগাগোড়া আগ্রহী। তাই তার মালিক হায়দার আলী ঘনঘন তাগাদায় নামে। দু-চারদিন পরপর আমার কাছে বাকি টাকাটা চায়। এবারে ম্যাডামের কাছ থেকে পাওয়া কমিশনের টাকাটা তাই হায়দারের মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে সে ভুঁইটুকুরে আমার বাড়ির সঙ্গে এক লপতে বেঁধে ফেলা জরুরি।

কিন্তু ম্যাডাম কই? আমি পিএসের দিকে তাকাই।

– ওই তো আসছেন।

দেখি সত্যিই সত্যিই মমতা মঞ্জুরী ম্যাডাম ওপর থেকে নামার সিঁড়িতে। এক পা দু পা করে আস্তে-ধীরে এগোনোর পথে। শেষে আলতো পায়ে হালকা চালের কদমে এসে তিনি সোফায় পাছা বিছান। একেবারে আমার মুখোমুখিতে বসেন। আমি তাঁর দিকে তাকাই। কিন্তু তিনি সদ্য কেনা প্লটে বাড়ি বানানো, নদীর পানে মুখ করে কটেজের মতো দোতলা ভবন, আর একটা সুইমিংপুল তৈরির কাহিনি কীর্তন করেন। আগাগোড়া বলে যান। তার জন্য তার কোনো এক কনস্ট্রাকশন ফার্মের এমডির সঙ্গে কথাবার্তা ফাইনালে রূপ নেওয়া, কন্ট্রাক্টে সাই-সাবুদ হওয়ার দিন-তারিখ ঠিকঠাকের ঘরে থিতু হওয়া সারা বলেও জানান।

কিন্তু ভবন বানানো কিংবা দিন-তারিখ নির্ধারণের মতো ম্যাডামের প্ল্যান-পরিকল্পনার আলাপ যেন আমার কানে পা দেয় না। আমি ভালোমতো শুনতে পাই না। বরং বলা ভালো, আমি শুনেও না শোনার জগতে চলে যাই। তাতে বসবাস শুরু করি। কেননা আমার মনোযোগের আগাগোড়া তো বটেই, পুরোদস্তুর বলা যায়, তার সবটাই ম্যাডামের চেহারা পানে থিতু। সদ্যস্নানের পর হালকা প্রসাধনেই তার আজ এ কি রূপ? খাঁটি ও নির্ভেজাল প্রতিমার প্রতিরূপ যেনবা। আমার দেখা দুর্গাপূজা মণ্ডপের পুত্তলিকা শতভাগ।

আমি তাই তার চেহারার ওপর থেকে চোখ সরাতে, মনোযোগকে অন্য কোনো দিকে নিতে পারি না। বরং কেবল তার পানেই তাকিয়ে থাকি। ঘন নীল শাড়িতে মোড়া তার উঁচা-লম্বা দেহকাঠামোর এমাথা ওমাথায় হাঁটহাঁটিতে যাই। তাকে মনে হয় একেবারে আদি ও অকৃত্রিম এক রূপসী রমণী।

তবে তার প্রতি আমার মনোযোগের এই হুলস্থূল দাপাদাপি, তার চেহারার পানে থির হয়ে থাকা নজর – এসবের কোনো কিছুই তার কথা বলায়, সে-পথে চলায় কোনো আগল দিতে, এতোটুকু ব্যারিকেড ফেলতে পারে না। তিনি বরং আপন গতিতে আগান, একটার পর একটা বাক্যে কথার মালা গেঁথে চলেন।

কিন্তু যখন বলেন, তার কাছে কোনো ক্যাশ নেই, তিনি কোনো ক্যাশের  কারবার করেন না, বরং ক্যাশলেস লাইফ লিড করেন। তাই তিনি আমারে ক্যাশ, মানে নগদ নগদ কমিশনের টাকাটা দিতে পারবেন না। তখন আমার যেন হুঁশ হয়। তার চেহারা ও গতর পানে আমার মনোযোগে আজদাহা কোপ পড়ে। ফলে তা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর আমার কান সজাগ হয়ে ওঠে। সবকিছু মানে ম্যাডামের কথা আগামুড়া কানের দোরগোড়ায় থিতু হয়। আমিও আগাগোড়া সব বুঝতে সক্ষম হই।

হ্যাঁ, এইসব বড়লোকের আজকাল নতুন ফ্যাশনে পা দেওয়া, ক্যাশলেস লাইফে হুড়মুড় করে ঢুকে যাওয়া সারা। তাই তারা দু-চার টাকাও আজকাল হাতে রাখায়, নগদ নগদ নড়াচড়ায় যায় না। বরং সবটাই গুঁজে রাখে ব্যাংকের কার্ডের গোয়ায়। তারপর তার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে দিন-দুনিয়া সায়ের করে বেড়ায়।

ম্যাডাম কি সে-পথে নামবেন, দু-এক কম এগিয়ে গিয়ে এটিএম বুথের হাত-পা ধরে টাকা তুলে দেবেন। নাকি আরো সহজ পথ, স্মুথ ওয়েতে পা বাড়াবেন – মানিট্রান্সফারের পথে যাবেন? মোবাইলের স্ক্রিনে আঙুলের দু-চারটা পরশে আমার অ্যাকাউন্টে কমিশনের টাকা উড়াল পথে, ভার্চুয়াল ওয়েতে পাঠিয়ে দেবেন? তাতে অবশ্য আমার আরো সুবিধা। এতোগুলি টাকা বহন করে নিয়ে যেতে হবে না। বরং বাড়ির কাছের ব্যাংক থেকে অনায়াসে নিজে তুলে নিয়ে হায়দারের মুখের ওপর ছুড়ে দিতে পারব ।

কিন্তু কই! তিনি, মানে ম্যাডাম তো সে-পথে পা বাড়ান না। বরং কার কার সঙ্গে তার কন্ট্রাক্ট, আগাগোড়া চুক্তি বুক টান টান করে খাড়া, দৃঢ় পায়ে দাঁড়ানো তার হিসাব দাখিল করেন। শুরুতেই বলেন আমার স্যার, আনোয়ার আবেদিন চৌধুরীর সঙ্গে চুক্তির কথা – আপনি তো দেখেছেন, ঢাকার পাশে আমার নিজের পারসোনাল বাগানবাড়ি বানানোর জন্য মনোরম পরিবেশের প্লটটা কীভাবে বাগিয়ে নেওয়া, নিজের মুঠোয় পোরা হলো। 

হ্যাঁ, প্লটটা পছন্দে একদিন, আর রেজিস্ট্রেশনের জন্য আরেক, ব্যস, এই দুদিনের আনাগোনার মাথায় পুরো দশ কাঠার প্লটটা নিজের নামে করে তোলার ম্যাডামের ক্যারিসমা তো আমার নিজের চোখে দেখা। পাশে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আগাগোড়া সাক্ষী হওয়া সারা।

তবে আর কী কী কন্ট্রাক্ট, কার কার সঙ্গে চুক্তি খাড়া? আমি তা জানতে মমতা মঞ্জুরী ম্যাডামের পানে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাই। তিনি সোৎসাহে তার তালিকা হাজির করেন – এ্যাই যে ডুপ্লেক্স, সাজানো-গোছানো আলিশান ফ্ল্যাট, তা কেনা এক ডেভেলপার কোম্পানির এক ডাকসাইটে ডিরেক্টরের সঙ্গে কন্ট্রাক্টে। চুক্তি সই-সাবুদে মাথায় গিয়ে। বাট, এতোদিনে তার সব কিস্তি শোধ হওয়া শেষ। তাই পুরো ফ্ল্যাটটা এখন আমার নিজের নামে হওয়া সারা।

অ্যাঁ! এতো বড়, দুটো তলাজুড়ে ডানামেলা ফ্ল্যাট। নিশ্চয়ই কোটি টাকার ওপর তার দামের বহর। এতো বড় মোটাতাজা, রীতিমতো আজদাহা অঙ্কের সমুদয় টাকা শোধ! গুনে গুনে পরিশোধ করা শেষ! ম্যাডাম তো তবে টাকা-পয়সায় ভরা। কোটি কোটি মুঠোয় ধরা। তাহলে আমার টাকাটা দিতে, কমিশনটা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে তার অসুবিধা কোথায়? 

কিন্তু ম্যাডাম সে-পথে যান না, বরং অন্য পথে মুখ নাড়ান – আরো কয়েকটা কন্ট্রাক্ট এখনো চালু আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদেরটা সুপারমলের এক ইডি, মানে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের সঙ্গে। তাই তার মল থেকে নিত্যদিনের চাল-ডাল, মাছ-মাংসরা এসে আমার এই ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায় হাজিরা দেয়। তা খেয়েই তো আমার  এই বেঁচেবর্তে থাকা। মাশাল্লাহ। আর মালদ্বীপের সাগরের বুকে আসন নেওয়া কটেজে বসবাসে যাওয়ার, সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য নিজ চোখে চাখার কন্ট্রাক্ট আছে একটা এয়ারলাইন্সের খোদ মালিকের সঙ্গে। তাই নেক্সট মান্থে সে-ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান-প্রোগ্রাম ফাইনাল করা সারা।

ওমা! এতোগুলি কন্ট্রাক্ট – এ দেখি একটার পর একটা লাইন দিয়ে খাড়া। তাহলে তো ম্যাডামের লাইফ শুধু ক্যাশলেস, নগদ নারায়ণবিহীনই নয়, বরং আগাগোড়া কন্ট্রাক্টময়ও বটে।

– তাই তো আপনার সঙ্গেও আমার একটা কন্ট্রাক্টে যেতে, চুক্তিতে সই-সাবুদে থিতু হতে হবে।

কিন্তু এসব গ্রুপ অফ কোম্পানিজের রাজা-মহারাজা, ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির উজির-নাজির কিংবা এয়ারলাইন্সের খোদ মালিক-মহাজনের সঙ্গে যে কন্ট্রাক্ট, আমার, মানে সামান্য জমির দালাল, মফস্বলের বাসিন্দা, রাঘববোয়ালদের তুলনায় একেবারে চুনোপুঁটি লোক, তার সঙ্গেও তা-ই?

– হ্যাঁ, কেননা কন্ট্রাক্টের ব্যাপারে আমার কাছে তালগাছ আর বেলগাছ সব সমান। কে কোন কোম্পানির কর্ণধার, আর কে কমিশন খাওয়া লোক তা বিচার করলে আমার চলে না। কারণ আমি পেশাদার, পেশার ওপর থিতু, দৃঢ় পায়ে খাড়া।

হায় আল্লাহ! ম্যাডাম একেবারে অনড়, যেখানে ছিলেন সেখানেই খুঁটি গেড়ে খাড়া। কন্ট্রাক্ট থেকে তার এতোটুকু নড়ন-চড়ন নাই। আমার জোড়া জোড়া যুক্তি হাজির করা, হাত নেড়ে নেড়ে বোঝানো – সব তাহলে জলে যাওয়া, আগাগোড়া ব্যর্থতায় হাবুডুবু খাওয়া সারা, হায়! কিন্তু কন্ট্রাক্টের টাকা শোধ হবে কীভাবে? কোন উপায়ে?

– দেহের সঙ্গে দেহের মিলনে। যার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট তার সঙ্গে আমার দেহের বিনিময়ে। তার জন্য আমার অনেকগুলো প্যাকেজ আছে। আপনার স্যার, আনোয়ার আবেদীন চৌধুরী সাহেবের মতো যাদের সঙ্গে মোটা অঙ্কের কন্ট্রাক্ট তাদের জন্য বড় রেটের হোলনাইট প্যাকেজ। কাল রাতেই তিনি একটা নিয়ে সকালে চলে গেলেন। ফলে তার একটা মোটাতাজা অঙ্কের কিস্তি শোধ হয়ে গেল। আর আপনার মতো ছোট ছোট অঙ্কের কন্ট্রাক্টের জন্য আছে শট কিংবা ঘণ্টাওয়াইজ প্যাকেজ। সবগুলির রেট ধরা আছে। আমার পিএস তানিয়ার কাছে ডিটেইলস পাবেন। তাই ওর সঙ্গে আলাপ করে কন্ট্রাক্টটা ফাইনাল করে নিন। কোন প্যাকেজ নেবেন, কখন আসবেন সব লিখে সই-সাবুদ করে যান। বাট, আজ ছুটির দিন, তাই আজ আর কোনো শিডিউল ফাঁকা নেই। ডে অ্যান্ড নাইট সব বুকড। তাই না তানিয়া?

– জি ম্যাম! এখন এনএবি ব্যাংকের ডিরেক্টর খোন্দকার শওকত হোসেন স্যারের শিডিউল। তিনি একটু আগে কল দিয়েছেন। দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।