ক্রুফোর সিনেমায় সংকটের প্রতিচ্ছবি

সুরঞ্জন রায়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইতালি ও ফ্রান্সে মুক্তিযুদ্ধে শামিল প্রতিরোধ বাহিনী বিপস্নবের যে-স্বপ্ন দেখিয়েছিল, যুদ্ধ শেষ হতে-না-হতেই বেজে উঠল তার মৃত্যুঘণ্টা। ইতালির মতই ফ্রান্সও বিপস্নবের ঝটিকাকেন্দ্র থেকে ক্রমে হয়ে ওঠে ধনবাদী ব্যবস্থার পরীক্ষাগার। সমসময়ের ইতালির সমাজ-রাজনীতিকে অনুধাবন করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, এর জন্য ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির দায় যেমন স্পষ্ট, তেমনি তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা দ্য গ্যাসপেরির ইতিহাসের গতিকে চাতুর্যের সঙ্গে আপন কাজে লাগাবার অসামান্য ক্ষমতা। এরই পাশে-পাশে আমেরিকান দাক্ষেণ্যের বরাভয়! মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ নিপুণ হাতে রচনা করা হল – মার্শাল পরিকল্পনার চতুর প্রয়োগে ইতালির অর্থনীতিতে যেমন মিরাকলের পর মিরাকল ঘটতে শুরু করল, আবছা হয়ে এল PCI-এর ভূমিকা। ফ্রান্সের অর্থনীতিতেও তেমনি দ্য গলের নেতৃত্বে সংঘটিত হল একের পর এক উন্নয়নের বিস্ফোরণ – PCF-এর ভূমিকা ক্রমে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল মধ্যশ্রেণিভুক্ত মানুষের আশা-আকাঙক্ষার মধ্যেই।

যুদ্ধপূর্ব ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির সসংকোচ বিসত্মৃতি আমাদের দেশের সে-সময়কার মার্কসবাদী আন্দোলনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মধ্যশ্রেণিনির্ভর পার্টির একান্ত স্তালিন-আনুগত্য একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে অসমর্থ হতে থাকল, অন্যদিকে তেমনি প্রয়োগ-কৌশলের ভ্রামিত্ম ‘জনযুদ্ধের’ নীতিকে বিকশিত হতে দিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সের জনগণকেও বিভ্রান্ত করেছিল স্তালিন-হিটলারের অনাক্রমণ চুক্তি। যদিও ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ ঘোষিত হলে অবস্থার দ্রম্নত পরিবর্তন ঘটে এবং প্রতিরোধ বাহিনীর নেতৃত্বে চলে আসে কমিউনিস্ট পার্টি। এরই ফলে যুদ্ধশেষে এক বিশাল দল হিসেবে আবির্ভূত হয় PCF, যদিও ইতিহাসের নির্দেশে ঘটনা বইতে শুরু করেছিল সম্পূর্ণ এক ভিন্ন খাতে। ইতোমধ্যে জেনারেল দ্য গলের নেতৃত্বে খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাট (CD), সোশ্যালিস্ট (SFIO) ও কমিউনিস্টদের (PCF) নিয়ে গড়ে ওঠা যুক্তফ্রন্ট সরকারের অনুসৃত সাম্রাজ্যবাদী নীতি, বিশেষত ইন্দোচীন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের সচেতন মানুষকে হতাশ করেছিল। ইতিহাসের বিদ্রূপে ফ্রান্সের কমিউনিস্টরা তখন ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী এক যুদ্ধে শামিল। এতে PCF-এর ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ণ হল অনেকটাই, তেমনি চরম বামপন্থীদের সমালোচনাও তাদের বিব্রত করল কিছুটা। অবশেষে ১৯৪৭ সালের গ্রীষ্মে তারা যুক্তফ্রন্ট ভেঙে বেরিয়ে এসে মার্শাল পস্ন্যানের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে এবং ওই বছরেরই হেমন্তে ইতালির মতোই ধর্মঘটে-ধর্মঘটে বিপর্যস্ত করে দেয় জনজীবনকে। ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ের তুহিন শীতলতায় স্তব্ধপ্রায় তখন বিশ্বের শামিত্মকামী মানুষ। অবশ্য এতে পার্টির মধ্যে কিছুটা প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিলেও জনগণের ওপর প্রভাব বাড়ে না খুব একটা, কেননা একদিকে স্তালিনের মৃত্যু ও হাঙ্গেরির প্রতিরোধ যুদ্ধের পরও
PCF-এর সোভিয়েত লাইন থাকে অবিচলিত, অন্যদিকে আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামকে স্বাগত জানিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে না-পারার ব্যর্থতা তাদের জনগণ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে বহুদূর।

এসময় কমিউনিস্ট পার্টি যতটা-না জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল সোশ্যালিস্টরা। একে তো PCF-এর মতো প্রতিরোধকালের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল না SFIO-এর, তার ওপর যুদ্ধশেষে PCF-এর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠায় তারা ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছিল দক্ষিণপন্থী দলগুলোর দিকে। অন্যদিকে, খনিজ তেলের অন্ধকার-হাতছানিতে তীব্র হয়ে ওঠে আলজেরিয়ার ওপর ঔপনিবেশিকতার ফাঁস। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সচেতন মানুষ, নষ্ট হয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের শরিক দলগুলোর ভাবমূর্তি।

যাহোক, দ্য গল ও স্তালিনের মধ্যে বারতা বিনিময়ের ফলে কমিউনিস্ট পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা হঠাৎই যেন সিত্মমিত হয়ে গেল। যুদ্ধের সময় রাশিয়ায় অবস্থানরত পার্টি নেতা মরিস থোরেজের দেশে ফেরার পর তাঁরই নির্দেশে পশ্চাদরত জার্মান সৈন্যদের থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্রশস্ত্র কমিউনিস্টদের সমর্পণ করে দিতে হল। এছাড়া প্রতিরোধ বাহিনীর সংগ্রামরত সেনানায়কদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ফলে এবং যারা কমিউনিস্ট নেতাদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করল না, তাদের পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হল। উলটো দিকে থোরেজ তাদেরই ক্ষমতার অলিন্দে নিয়ে এলেন, যাদের প্রতিরোধ সংগ্রামে না-ছিল কোনো বীরত্বের ইতিহাস, না-ছিল নেতৃত্বের কাছে কোনো বশংবদ ভূমিকা। এটা সম্ভব হয়েছিল যুদ্ধ সময়কালীন অস্পষ্ট ইতিহাসের অধিকারী জর্জ মাচের্সির মতো লোক যখন পার্টি আমলাতন্ত্রের প্রধান হয়ে উঠলেন।

(D.S. Bell & Eric Shaw [ed.], THE LEFT IN FRANCE : Spokesman, 1983, p 132)

 

দুই

সাধারণ মানুষ যেদিন শামিল হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে তার পরেই বিশ্বযুদ্ধে পরাভব ঘটেছিল ফ্যাসিশক্তির। নয়া-বাস্তববাদের সিনেমাগুলোতেও তাই উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছিল সাধারণ মানুষের বিগ ক্লোজআপ! সমাজ-দ্বন্দ্বের নিয়মেই সেদিন প্রবল প্রতাপ মুসোলিনির ইতালিতে গোপনে-গোপনে বেড়ে উঠেছিল নয়া-বাস্তববাদের পূর্বপ্রস্ত্ততি। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে, ওই ভয়ংকর অজ্ঞতাকে পেরিয়ে আসার পরও মানুষের মন থেকে কেন সম্পূর্ণ নির্মূল হল না ফ্যাসিবাদের ক্যানসারাস ভাইরাস? মনে হয়, মানুষের স্বভাবের মধ্যেই নিহিত আছে এর পাতালছায়া। মাঝে-মাঝেই তাই এর মর্মভেদী হুংকার চুরমার করে দিতে চায় আমাদের স্বপ্নকে। প্রতিরোধের সময়ের শিল্পী-সাহিত্যিকরা এ-কারণেই সাধনা করেছিলেন আত্মময়তা থেকে বেরিয়ে আসার। পল এলুয়ার (১৮৯৫-১৯৫২) প্রায় স্বগতোক্তির মতোই গাঢ় স্বরে উচ্চারণ করেন –

আমি বেঁচেছি এক ছায়ার মতো

তবুও সূর্যের গান গাইতে পেরেছি

সমগ্র সূর্য যে নিঃশ্বাস নেয়

প্রত্যেক বুকে আর সমস্ত চোখে

অকপটতার বিন্দু যা অশ্রম্নশেষে চকচক করে।

(অনুবাদ : অরুণ মিত্র।)

মানুষের প্রেরণার উৎসারণ ঘটেছিল একদিন সংগীতেরই বিভঙ্গ-উলস্নাসে, তাই প্রতিরোধ-সংগ্রামে কবিতাই হয়ে ওঠে মানুষের প্রবল প্রেরণা! আধুনিক ফরাসি কাব্যের পুরোধা যদিও শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-৬৭), কিন্তু তাঁর অগ্রজদের মধ্যেই অনুভব করা গিয়েছিল এর প্রথম পদসঞ্চার। গদ্যের মাধ্যমে রুশো (১৭১২-৭৮) এবং শাতোব্রিয়াঁর (১৭৬৭-১৮৪৮) শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে উচ্চকিত হয়েছিল যে-জীবন, কবি লামার্তিন (১৭৯০-১৮৬৯) ও ভিক্তর য়্যুগোর (১৮০২-৮৫) মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হল তার রামধনু আকাশ। ধ্রম্নপদী যুক্তিবাদিতা থেকে চেতনাকে মুক্ত করে কল্পনার জগতে তাকে বিচ্ছুরিত করা, আপন মনের মাধুরী মিশায়ে বস্ত্ত-প্রকৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার যে রোমান্টিক আদর্শ তাকেই এঁরা নিয়ে এলেন সৃষ্টি ও তার প্রকাশের গভীরতর স্তরে। পাশ্চাত্য ধ্রম্নপদী সংগীতের মূর্ছনায় তখন অনুরণিত পশ্চিমের আকাশ-বাতাস, আর সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্বের বজ্র নির্ঘোষের প্রস্ত্ততি তখন চলছে গোপনে-গোপনে। সাহিত্য অবধারিতভাবেই হয়ে উঠল অন্তর্মুখী। বোদলেয়ার এই অন্তর্মুখীনতারই কবি। তাঁর হাতে কাব্য ও জীবনের ভেতরকার ব্যবধান গেল ঘুচে। স্ববিরোধিতায় ভরা আধুনিক মানুষের জটিল মন  হল তাঁর একমাত্র ধ্যান।

বিপরীত শক্তির ঘেরে তাৎপর্যম–ত হয়ে ওঠে জীবন। উনিশ শতকের শেষভাগে ফরাসি সাহিত্যে বোদলেয়ার-বিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সিত্মফান মালার্মের (১৮৪২-৯৮) বিশুদ্ধ কাব্যের গবেষণা। বোদলেয়ার কিন্তু কখনো তাঁর মানুষী সত্তাকে ভুলতে পারেননি; অন্যদিকে মালার্মে, ভেয়ারলেইন (১৮৪৪-৯৬) এবং কিছু পরে পল ভ্যালেরি (১৮৭১-১৯৪৫) নিজের নিজের অসিত্মত্বকে মুছে প্রাণপাত করেছেন নির্বিকল্প আইডিয়ার সন্ধানে। দ্বন্দ্বমথিত ফরাসি সাহিত্যজগতে উঁকি দেয় নতুন সম্ভাবনার বীজ। জীবনের বিচিত্র উপাদান থেকে গিয়োম অ্যাপোলিনিয়ের (১৮৮০-১৯১৮) তুলে আনতে চান কবিতার সারাৎসার। যুগ ও জীবনের অভিনবত্বের সঙ্গে একাত্ম হতে-হতে তিনি কামানের গোলাবর্ষণের রাতকে তাঁর কবিতায় করে তুললেন উৎসবের রাত, আর ছুটন্ত গোলার আগুনে খুঁজে পেলেন চাঁদের রংকে। এই অভিনবত্বকেই চরমে নিয়ে গেলেন স্যুররিয়ালিস্ট কবিরা। আঁদ্রে ব্রেতঁ (১৮৯৬) তাঁর ইস্তাহারে জানালেন –

আমি বিশ্বাস করি যে, বাহ্যত বিরোধী এই দুই দশা অর্থাৎ স্বপ্ন ও বাস্তব অপসৃত হয়ে তাদের থেকে উদ্ভূত হবে এক নতুন ধরনের বাস্তব, এক স্যুররিয়ালিতে।

যে-জগৎ মানুষের যুক্তিবাদী অসিত্মত্বেই শুধু বিশ্বাস করে, অর্থাৎ মানুষের খাপ খাইয়ে চলার প্রবণতা, তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতা, স্যুররিয়ালিস্ট কবিরা সেই জগৎ সম্পর্কে জানিয়েছেন তাঁদের ঐকামিত্মক ঘৃণা। সমাজের এই চেহারাটাকে পালটাতে চেয়েই তাঁদের কবিতায় ফুটে উঠেছে একটি বিদ্রোহের সুর। সমাজ-বিপস্নবের চেহারা তাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পল এলুয়ার, ত্রিস্তান ৎজারা (১৮৯৬), লুই আরাগঁর (১৮৯৭) কবিতায়।

অতি আধুনিক ফরাসী কাব্যের চারিত্র্যকে একটা খাতে ফেলা সম্ভব নয়। তবু হয়তো বলা চলে সে আজ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধ ফরাসী কাব্যে তেমন কিছু ছাপ রাখেনি, কিন্তু আজ স্যুপেরভিয়েল, ঝুভ, এল্যুয়ার, আরাগঁ, ৎজারা, প্রেভের, শার প্রমুখ প্রায় সমস্ত প্রধান কবির কাব্যেই যুদ্ধের স্পর্শ। অবশ্য তার প্রকাশ বিভিন্নভাবে, কিন্তু তা রয়েছে। বাস্তবের অনুলিপি নয়, বাস্তবের সাক্ষ্য, এই এখনকার মূল কথা। বহুরকমের পলায়ন, বহুরকমের আত্মগোপনের পর কবিতা এখন সকলের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। এ জন্যে কেউ

কেউ ফর্মের অভিনবত্ব বর্জন করে প্রথাগত পদ্ধতি অবলম্বন করতেও ইতস্তত করছেন না। বোধগম্যতার প্রশ্ন এখন ফরাসী কবিদের সামনে খুব বড় প্রশ্ন। আধুনিক ফরাসী প্রাবন্ধিকের ভাষায় : আমি থেকে আমরায় যাওয়া। কিন্তু এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কি কখনো পাওয়া যাবে?

(অরুণ মিত্র, ফরাসী সাহিত্য প্রসঙ্গে, প্রমা, ১৯৯৫, পৃ ১৪৮।)

প্রথম মহাযুদ্ধের পর ফরাসি সাহিত্যে যে-আন্দোলনের জন্ম তার হোতা ফরাসি কবিরাই। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফরাসি সাহিত্যে যে-তরঙ্গোচ্ছ্বাস দেখা দিল তার আবির্ভাব সে-দেশের গদ্যলেখকদের হাত ধরেই। চলিস্নশ থেকে ষাট সাল পর্যন্ত সাহিত্যের স্রোত নতুন মোড় নিয়েছে উপন্যাসে এবং নাটকে, সৃষ্টি হয়েছে প্রবল অভিঘাত। যদিও আমরা দেখেছি নাৎসি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে কবিতাই হয়ে উঠেছিল প্রধান প্রেরণা, তবু সে-সময় বহু আশ্চর্য গল্প-নাটকও রচিত হয়েছে – সঞ্চারিত হয়েছে প্রেরণা। কিন্তু সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে অসিত্মবাদ। যদিও এ এক দর্শনতত্ত্ব, তবু একে ঘিরে সাহিত্যে যে-ফসল ফলেছে, তা বিস্ময়কর! অসিত্মবাদী দর্শনের প্রাণপুরুষ জ্যঁ পল সার্ত্র জার্মান দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন যৌবনে।

অসিত্মবাদী দর্শনে গাঢ়তর হয়ে আছে নৈরাশ্যবাদের ছায়া – এ-কথা কারো-কারো মনে হলেও এর মধ্যে রয়েছে কর্মের এক আহবান, সার্ত্র তাই এর মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন আশাবাদেরই এক অদৃশ্য হাতছানি – যা তাঁর ব্যক্তিজীবনের সংগ্রামী আচরণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই দর্শন মনে করে, মানুষের অসিত্মত্বই একমাত্র গ্রাহ্য বস্ত্ত, অথচ এ-অসিত্মত্বের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই, আর নেই বলেই তার স্বাধীনতা সীমাহীন। এ-স্বাধীনতার জোরেই মানুষ আপন অভিরুচি অনুসারে নির্ধারিত করে নিতে পরে তার
হয়ে-ওঠার সাধনাকে। সার্ত্রের ধারণায় বিশ শতকের পৃথিবী থেকে ঈশ্বর ও যুক্তিবাদ উধাও হয়ে গেছে, মানুষকে তাই উপলব্ধি করতে হবে স্বাধীনতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে এবং স্বনির্ধারিত কাজের মধ্য দিয়েই পেরিয়ে আসতে হবে জীবনের ‘অ্যাবসার্ড’ অবস্থানকে।

ধনবাদী ব্যবস্থার কদর্য চেহারাটা আত্মপ্রকাশ করে ফ্যাসিবাদের মধ্য দিয়ে; মুক্ত দুনিয়ার স্বপ্নে উন্মন মানুষরাও প্রতিরোধে-প্রতিরোধে গড়ে তোলে ব্যারিকেড। সার্ত্র-ক্যামু-বোভোয়ারের লেখায় তাই এই অনুজ্জ্বল, বিবর্ণ পৃথিবীটাকে প্রত্যাখ্যানের দুঃসাহসিক ঘোষণা!

 

তিন

যুদ্ধশেষে রিক্তপ্রায় ফ্রান্স সর্বশক্তি নিয়োগ করল তার পুনর্গঠনের কাজে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে ইউরোপের মানের সঙ্গে তাল মিলিয়েই তার গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট বা GDP-এর বার্ষিক হার বাড়ল ৪৬ শতাংশ করে। অন্যদিকে, জনসংখ্যার হার তখন বাড়ছিল ১.২ শতাংশ করে – ১৯৩৮ সালের ৪১ মিলিয়ন জনসংখ্যা ১৯৬৭ সালে এসে পৌঁছায় ৫০ মিলিয়নে। ফ্রান্সের সমৃদ্ধি ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিল। অগ্রগতির জোয়ারে যদিও ভেসে যেতে চাইছিল ফ্রান্স, কিন্তু সমস্যার অন্ধকার জমছিল
ভেতরে-ভেতরে। যেহেতু প্যারিসসমেত গোটা উত্তরাঞ্চলেই গড়ে উঠছিল শিল্প-উৎপাদনের কেন্দ্র, তাই জনকু-লায়নের সমস্যা প্রবল আকার ধারণ করল এখানে। মার্শাল পরিকল্পনার নির্দেশে কৃষির চেয়ে শিল্পায়নেই জোর পড়ল বেশি। শ্রেণিবৈষম্যের প্রবল পাপ ঘনিয়ে উঠল ফ্রান্সের আকাশে-বাতাসে। জীবনধারণের মান তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে গ্রাস করতে এগিয়ে এল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকেই। ওদিকে ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ের পরিম-লে সন্দেহের বিষবাষ্প শামিত্মপ্রিয় মানুষের শ্বাসরোধ করে দিতে চাইল। ‘আন আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিজে’র অভিযোগে এতদিনের প্রিয় বাসভূমিও ছেড়ে যেতে হল চ্যাপলিনকে। অভিযুক্ত হল আরো বহু-বহু সহৃদয় মানুষ। হলিউডের কর্মকা–র মধ্যেও ফুটে উঠল এই ভয়ংকর অমানবিক টেনশনের চাপ। সে-সময়কার আমেরিকান ছবিগুলোতে ভালেবাসার নষ্টতার যে-চেহারা ফুটে উঠল তারও উৎসমুখ ঘোরানো ছিল পারস্পরিক সন্দেহজাত তিক্ততার দিকেই। নারী-পুরুষের ক্ষণভঙ্গুর সম্পর্কের হাই অ্যাঙ্গেল শট মার্কিনি ছবিতে স্পষ্ট হয়ে উঠলেও ইউরোপ কিন্তু শঙ্কা-জড়ানো চোখে তাকিয়েছিল নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ জীবনের দিকে। সেখানকার পর্দায় তাই ফুটে উঠল অসহায় শিশুর যন্ত্রণাকাতর মুখের বিগ ক্লোজআপ। মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্পের আগ্রাসী নীতি তখন সমগ্র ইউরোপীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকেই গ্রাস করে নিতে উদ্যত –

Hollywood may have been unnerved by Cold War, but it was to be overwhelmed and eventually ruined by a number of more immediate difficulties. The most urgent of these problems was also one of the easiest to solve; the need to recapture European markets. Fortunately for the film industry, the US State Department, acknowledging the propaganda value of Hollywood movies as part of a package deal which included trade and cash concessions. Leon Blum weakly defended the Blum-Byrnes agreement of 1946, one section of which stipulated that seventy percent of French screen-time should be devoted to American films, by arguing that the Italians had negotiated a far worse settlement. The French film industry once more seemed on the point of collapse, studios closed, and unemployed being Bresson, Becker, Gremillon, Autant-Lare and Carne. (Eric Rhode, A History of the Cinema, Pelican, 1974, p 437)

ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী মহলের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের সাহায্যে ফরাসি সিনেমা পেরিয়ে আসতে চায় দুঃসময়ের অন্ধকার। আঁদ্রে জিদের গল্প থেকে গড়ে ওঠে কত Symphonic Pastorale (১৯৪৬), অর্জন করে প্রচ- জনপ্রিয়তা। সার্ত্রের লেখা Les Jeux Sont Faits (১৯৪৭)-এর চিত্রনাট্যে অসিত্মত্বের সমস্যাকে ছাপিয়ে ফুটে ওঠে কাম-ভালবাসা ও আনুগত্যের মধ্যে অগ্রাধিকারের প্রশ্ন। বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট নতুন সাজে উপস্থিত হয় জ্যঁ ককতের La Belle et La Bete (১৯৪৬) ছবিতে। ককতের বিস্ট মুহূর্তেই জয় করে নেয় দর্শকচিত্ত। সিনেমার সম্ভাবনা নিয়ে সে-সময় অনুসন্ধান চালানো হল দেশি-বিদেশি ধ্রম্নপদী সাহিত্যের মধ্যেও। সত্মাঁদালের গল্প থেকে সৃষ্টি হল একটি চমৎকার বিনোদনের ছবি – La Chartreuse de Parme (১৯৪৮)। ভিক্তর য়্যুগোর নাটক Ruy Blas অবলম্বনে ১৯৪৮ সালে তোলা ছবিতে ককত যেমন সম্পূর্ণ স্বসিত্ম লাভ করতে পারলেন না, কার্নেও তেমনি এমিল জোলার উপন্যাসের প্রতি সম্পূর্ণ সুবিচার করতে পারলেন না তাঁর Thérèse Raquin (১৯৫৩) ছবিতে। অন্যদিকে দস্তয়েভস্কির উপন্যাস অবলম্বনে প্রস্ত্তত L’ idiot (১৯৪৬) সাফল্য অর্জনে সমর্থ হলেও রেনে ড্রেয়ারের মতো শক্তিশালী পরিচালক কিন্তু ব্যর্থ হলেন গ্যেটের ফাউস্ট অবলম্বনে Beauté du Diable (১৯৫০) ছবিটি করতে গিয়ে; যদিও শক্তিমান অভিনেতা গেরার্ড ফিলিপের ফাউস্ট ও মিচেল সিমনের মেফিস্টোফিলিসের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় দর্শকদের অভিভূত করতে সমর্থ হয়।

এরই পাশে জ্যঁ রেনোয়া, রেনে ক্লিমেন্ট, ম্যাক্স ওফুলাসদের মতো প্রতিভাবান পরিচালকদের হলিউড-অভিজ্ঞতা ফরাসি সিনেমাকে সমৃদ্ধ করে তুলল। যুদ্ধোত্তর শীর্ণ চেহারাটাকে সরিয়ে দিয়ে ফরাসি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রাণের আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শোষণের চেহারাটা ক্রমেই তীব্র, তীক্ষন হয়ে উঠছিল বিভিন্ন সামাজিক স্তরে। আর এই সমাজ-দ্বন্দ্বের ফলেই একদিন শুরু হয় নবতর জীবনের সন্ধান! পঞ্চাশের দশক শেষ হয়ে ছুঁই-ছুঁই করে ষাটের দশক – ফ্রান্সের মানস-দিগন্তও সম্ভাবনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কিছুদিন আগে।

ফ্রান্সে একটি দল ধরা পড়ে, তাঁরা ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামরত স্বাধীনতাকামী আলজেরিয়ানদের গোপনে সাহায্য দিচ্ছিলেন; এই গুপ্ত দলের সঙ্গে সার্ত্রের সংযোগ ছিল। ফ্রান্সের সামরিক আদালতে ধৃতদের বিচার আরম্ভ হয় এবং প্রসঙ্গক্রমে সার্ত্রের নামও ওঠে। তিনি সে-সময় দক্ষিণ আমেরিকায় ভ্রমণরত ছিলেন। তাঁর কথা উঠেছে জেনে তিনি সেখান থেকে সামরিক ট্রাইব্যুনালের সভাপতির কাছে এক পত্র লেখেন। পত্রটি পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন, কী দারুণ সেই পত্র! ভাষায় ও ভাবে শাণিত তলোয়ারের মতো। ফরাসি সরকারের গর্হিত সাম্রাজ্যবাদী আচরণ এবং যে-সব কথাকথিত বিপস্নবী কার্যকালে আলজেরিয়ানদের সাহায্য দিতে পরাঙ্মুখ তাদের আচরণ তিনি কঠিন আঘাতে জর্জরিত করেন এবং নিজের অটুট সংকল্প ব্যক্ত করেন; পরিশেষে সামরিক বিচারকর্তাকে এ-কথা মনে রাখতে বলেন যে, বিচারকর্তার ভূমিকায় তিনি এক প্রহসনে অভিনয় করছেন, যে-রকম প্রহসন ইতিহাসে অনেকবার অভিনীত হয়েছে। (অরুণ মিত্র, ফরাসী সাহিত্য প্রসঙ্গে, প্রমা, পৃ ৯২-৯৩।) ওদিকে ক্রিশ মার্কারের ক্যামেরা দ্রম্নতলয়ে বন্দি করে নিতে চায় উদয়াসেত্ম ফুটে ওঠা প্যারিসের অগ্নিগর্ভা জীবন। সেই ক্রামিত্মকালে তোলা Le Joli Mai সিনেমায় আমরা দেখতে পাই আলাপচারিতায় মগ্ন এক মানুষকে – মাকড়সা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় তার জ্যাকেটের ওপর। আলজেরিয়ার সংকটের প্রশ্নে প্রগাঢ় উচ্চারণ শুনি – as long as prisons exist you are not free. …ফুটে ওঠে সাম্রাজ্যবাদের চাপে সাধারণ প্রাণের বিশুষ্ক চেহারাটা। আপাতরম্য জীবনে আবিষ্ট মানুষ তবুও খোঁজে উত্তেজনার আঁচ।

১৯৫৮ সাল। স্বেচ্ছানির্বাসন ছেড়ে দ্য গল আবার ফিরে এলেন ক্ষমতায়। অবমূল্যায়ন ঘটল ফরাসি ফ্রাঁর – দ্রম্নততালে নেচে উঠল উন্নতির সূচক। এর অভিঘাত এসে ধাক্কা দিল ফরাসি সিনেমার প্রাঙ্গণকেও। আঁদ্রে বাঁজার প্রেরণায় গদার-ত্রম্নফো-রিভেট-রোমার-স্যাব্রলদের অর্চনায় প্রস্ত্তত হল ‘নিউ ওয়েভে’র ব্যাপক পটভূমি – সিনেমার এই নতুন আন্দোলনের মধ্যেও দেখা দিল সমাজ-দ্বন্দ্বের প্রবল চেহারাটা।

The metaphor of the ‘New Wave’, then was surprisingly apt: the wave had been building for a long time before it burst on cinematic shores. It was a result of the mutual reinforcement of a variety of wavelets – technological, theoretical, philosophical, critical – and its reverberations are still being felt. The New Wave has left us with a cinema forever changed, enlarged, more powerful, more eloquent, more acute. (James Monaco, The New Wave, Oxford University Press, NY, 1976, p 11.)

আমেরিকা ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সেও সিনেমা দেখার লোকের সংখ্যা কমছিল অতি দ্রম্নতগতিতে। এছাড়া বড় বাজেটের ছবিতে মূলধন বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা প্রযোজকদের করে তুলেছিল অতি সাবধানী, ফলে ফরাসি সিনেমা-জগতে ঘনিয়ে উঠল এক সংকট। অ্যালান রেনে, ক্রিশ মার্কার বা অ্যাগনাস ভার্গার মতো বামপন্থী পরিচালকরা এবং ‘কাহিয়ে দ্যু’র সিনেমা করিয়েরা এ-অবস্থাটাকে অতিক্রম করার জন্য স্বল্প বাজেটের ছবি বানানোর কথা ভাবছিলেন গভীরভাবে। এরই ফলে হলিউড মডেলকে প্রত্যাখ্যান করে ১৬ মিলিমিটারের হালকা ক্যামেরায় হাতে ধরেই ছবি তুলতে-তুলতে গাড়ির ভেতর থেকে আর বাড়ির ভেতর যত্রতত্র শুটিং করতে-করতেই ছবি তোলার যে আদর্শ গড়ে উঠল তাতে ফরাসি সিনেমায় দেখা দিল এক নব-তরঙ্গ!

১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে প্রায় ১৭০ জন নতুন পরিচালক সুযোগ পেলেন তাঁদের প্রথম ছবি করার, লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্যই যেহেতু এইসব ছবি-করিয়েরা তাঁদের পদ্ধতিগুলোকে পালটে নিচ্ছিলেন তাই এঁদের ছবিতে ক্রমশই ফুটে উঠল এক অনভিপ্রেত রূপনির্ভরতা – অস্পষ্ট হতে থাকল জাতীয় সংকটের চেহারাটা। গোদারের ছবিতেই একমাত্র দেখা দিল রাজনীতির এক তাৎপর্যময় রূপ।

১৯৩২ সালে প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন ত্রম্নফো। ফ্রান্সের সমাজ-অর্থনীতির পক্ষে সময়টা খুব একটা সুবিধেজনক ছিল না। তাঁর দুরন্তপনায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাবা-মা; তাই ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন সংশোধনাগারে। যার চাপ স্পষ্ট ধরা আছে তাঁর সিনেমা ফোর হানড্রেড বেস্নাজে (১৯৫৮)। সংশোধনাগার থেকে ছাড়িয়ে তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন আঁদ্রে বাঁজা। ক্যাহিয়ে দ্যু সিনেমার প্রাণপুরুষ বাঁজা ত্রম্নফোকে পিতৃস্নেহে মানুষ করতে-করতে শুরু করলেন সিনেমা নিয়ে পঠন-পাঠন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই সিনেমা-সমালোচক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। ত্রম্নফোর কথায়, ‘From that day in 1948 when he got me my first film job, working alongside him, I became his adopted son.’ তিনি আরো বললেন, ‘Thereafter, every pleasant thing that happened in my life I owed to him.’ (quoted in C.G, Crisp-Francoise Truffaut. p 57). ত্রম্নফোর সিনেমা আর জীবন বরাবরই চলেছে হাত ধরাধরি করে। প্রথমেই আঁতোয়া ডয়েনেলকে নিয়ে আত্মজীবনীর ছোঁয়ায় জারিত করে চারটি ছবির একটা সিরিজ তৈরি করলেন তিনি, যাতে ধরা পড়ল বেড়ে-ওঠা একটা মানুষের শৈশব-কৈশোর-যৌবন ও বিবাহিত জীবন। যার প্রথম ছবি ফোর হানড্রেড বেস্নাজ। ১৯৫৯ সালে কান চলচ্চিত্রোৎসব থেকে জিতে নিল শ্রেষ্ঠ পরিচালকের শিরোপা। এ-ছবির জন্য শিশু অভিনেতা হিসেবে তিনি খুঁজে পেলেন লডকে। ছবিগুলোতে আঁতোয়ার বয়স বেড়ে-বেড়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ থেকে ১৮, তারপর ২০ এবং ২২। সঙ্গে-সঙ্গে লডও পালস্না দিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ থেকে ১৮ এবং ২৪-২৬। চরিত্রটির বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অভিনেতা লডেরও অভিজ্ঞতা বেড়েছে, অভিনয়ক্ষমতায় সে দর্শকমন জয়ে সমর্থ হয়েছে। অবশ্য এই চারটি ছবির মাঝে-মাঝেই আরো অনেক ছবি করেছেন ত্রম্নফো। ১৯৬২ সালে তিনি জুলস এবং জিম নামে একটি অনন্যসাধারণ ছবি তৈরি করলেন। এই ছবিতে যৌনজীবনে স্বাধীনতার প্রশ্নটি তুলেছেন ত্রম্নফো। জুলস এবং জিম দুই বন্ধুকেই পছন্দ করে ক্যাথরিন। একজনকে বিয়ে করলেও অন্যজনের অঙ্কশায়িনী হতে দ্বিধা বোধ করে না সে। শেষ পর্যন্ত তাই ট্র্যাজেডিকেই বরণ করে নিতে হয়। হিচকক এ-ছবি দেখে ছাত্রের পারদর্শিতায় মুগ্ধ না-হয়ে পারেননি!

সত্যজিৎ রায়ের একটা লেখায় পাচ্ছি, ‘সিনেমার আদি যুগ থেকেই যে ফ্যানটাসি ও বিজ্ঞানভিত্তিক ছবি তোলা হয়ে আসছে সে কথা অনেকেই জানেন না। ফ্রান্সে আজ থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে জর্জ মেলিয়ে তুলেছিলেন A Trip to the Moon – একেবারে খাঁটি ফ্যানটাসি, যদিও তার সুর ছিল ব্যঙ্গরসাত্মক। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বহু সায়ান্স ফিকশন ও ফ্যানটাসি ছবি বিদেশে তোলা হয়েছে। 1932/33 সনে ব্রিটেনে তোলা এইচ.জি. ওয়েলসের কাহিনী অবলম্বনে Alexander Korda-র The Shape of Things to Come আমার আজও মনে আছে। Hollywood সেই ১৯২২ সনের Dr Jekyll & Mr. Hyde থেকে শুরু করে ক্রমাগতই এ ধরনের ছবি তুলে এসেছে। কোন কোন পরিচালকও এ বিষয়ে রীতিমতো বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছেন বললেও ভুল হবে না।

কিন্তু এতকাল পৃথিবীর মধ্যে যাঁরা সেরা পরিচালক পর্যায়ভুক্ত তাঁদের কেউই এদিকে এগোননি। সম্প্রতি এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। গত বছরের বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব  Godard-এর  Alphaville ছবি পেয়েছিল প্রথম পুরস্কার। এ সম্মান  SF ছবির ভাগ্যে এর আগে কখনো জোটেনি। Alphaville ছবির পরিচালকের প্রধান কৃতিত্ব ছিল, একটিও কৃত্রিম সেট তৈরি না করে, আজকের দিনের প্যারিস শহরে রাস্তাঘাটে হোটেল অফিস ইত্যাদিতে ছবি তুলে, কেবলমাত্র আলো ও ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ নির্বাচনের চাতুরীর জোরে ভবিষ্যতের বিজ্ঞান-শাসিত এক প্যারিসের চেহারা ছবিতে এনে ফেলেছিলেন। কলাকৌশলের দিক থেকে এ ছবি অবিস্মরণীয় সে কথা বলতে দ্বিধা নেই। ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া ত্রম্নফো ও আমেরিকার স্টানলি কুব্রিকের আশ্চর্য প্রতিভার পরিচয় আমরা একাধিক মার্কিন ও ফরাসি ছবিতে পেয়েছি। সম্প্রতি এঁরা দুজনেই লন্ডনের এলষ্ট্রি স্টুডিওতে প্রায় পাশাপাশি ফ্লোরে কাজ করে দুজন নামকরা SF লেখকের কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে দুটি ছবি তুলেছেন। ত্রম্নফো তুলেছেন Fahrenheit 451, ও কুব্রিক তুলেছেন তাঁরই অনুরোধে এবং সহযোগিতায় আর্থার ক্লার্ক রচিত 2001 : A Space Odyssey.’

১৯৬৬ সালে রে ব্র্যাডবেরির গল্প-অবলম্বনে তৈরি করলেন ফারেনহাইট ৪৫১। প্রথম রঙিন ছবি হলেও এর দৃশ্যগত মান দর্শকদের গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেল। এ-ছবির নায়ক একজন দমকলকর্মী। তবে এ-দমকল আগুন নেভানোর কাজ করে না, করে বই পোড়ানোর কাজ। ছবি শুরুর মুহূর্তকাল পরেই আমাদের স্মৃতিকে আলোড়িত করতে থাকে ১৯৩৩ সালের ৮ এপ্রিলে হিটলারের বই পোড়ানোর অনুষঙ্গ। বউয়ের সঙ্গে সুখে দিন কাটাতে-কাটাতেই একদিন খবর আসে তার পদোন্নতির। আমরা অনুভব করতে পারি কাজের প্রতি তার অনুরক্তির চেহারাটা। বই পোড়াতে-পোড়াতেই একদিন তার হাতে এসে যায় ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড বইটি। চুরি করে সে বইটি নিয়ে আসে ঘরে। রাত জেগে বউয়ের অলক্ষেই সে-পড়তে থাকে বইটি। কেমন যেন নেশা ধরে যায় তার বই পড়ায় – পড়ে চলে একটার পর একটা বই। চকিতে আমাদের মনে পড়ে যায় যারা আগুন লাগায় নামের নাটকটির কথা। পঞ্চাশের দশকে লেখা ম্যাক্স ফ্রিশের নাটক। নাটকটিতে আছে দুজন রহস্যময় লোক, যারা ফেরিওয়ালা সেজে শহরে বাড়িতে-বাড়িতে যায়, বাসিন্দাদের কথায় মুগ্ধ করে, কখনো-বা স্রেফ ভয় দেখিয়ে বাড়িতে রাতের আশ্রয়টুকু চেয়ে নিয়ে তারপর সকলের অগোচরে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেটে গেলে ম্যাক্স ফ্রিশ ইউরোপের মানুষকে সচেতন করতে নাটকটি লিখেছিলেন। তিনি এ-নাটকের মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছিলেন, মানুষের অসতর্ক মুহূর্তে কীভাবে ফ্যাসিবাদের বিপদ গৃহস্থের দরজায় পৌঁছে যায়। এ-নাটকের নির্দেশক সুমন মুখোপাধ্যায় মূল নাটকটিকে না-পালটে শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্র বিডারম্যানকে ব্যবসায়ী থেকে সরিয়ে করেছেন দমকল বিভাগের প্রধান। শেষ পর্যন্ত আগুন লাগে তার বাড়িতেই। ফারেনহাইট ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র গেস্টাপোরা একদিন টের পেয়ে যায়। ফায়ারমেনদের লাগানো আগুনের শিখা তার পুরো বাড়িটাকেই গ্রাস করে নিতে চায়। গেস্টাপোদের হাত থেকে সে পালিয়ে বাঁচতে চায়। ছুটতে-ছুটতে সে চলে আসে একদল মানুষের সান্নিধ্যে, যারা বইয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। আমরাও স্বসিত্মর নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচি!

১৯৭৩ সালে সিনেমা বানানো নিয়েই ছবি করলেন Day for Night (La Nuit americaine)। ছবিতে ত্রম্নফো অভিনয় করেছেন পরিচালক ফেরান্ডের ভূমিকায়। সিনেমাতে যে-ছবি তিনি বানাচ্ছেন তার নাম Meet Pamela. পামেলার ভূমিকায় অভিনয় করতে এসেছে ব্রিটিশ নায়িকা জুলি বেকার (জ্যাকুলিন বিসেট)। আমরা দেখতে পাই ছবি বানাতে গিয়ে পরিচালককে ঘিরে আছে কত-না সমস্যা। ছবিতে জ্যাকুলিন বিসেটের অভিনয় বেশ দুর্বল। নায়িকার যে-চেহারা আমরা সিনেমায় দেখি, তাকে চরিত্র আখ্যা দেওয়া মুশকিল। প্রতীক হিসেবে তাকে মেনে নেওয়া চলতে পারে। ধরে নিলাম সে রূপকথার রাজকন্যার একটি আধুনিক নাগরিক সংস্করণ; রূপকথা হিসেবে সার্থকতা পেতে গেলে নায়ককেও প্রতীক হওয়া দরকার। কিন্তু নায়ককে আমরা কীসের প্রতীক হিসেবে দেখব? আমাদের সামনে ফুটে ওঠে পরিচালকের দ্বিধামনস্ক ছবিটা। আমরা দেখতে পাই ছবি বানাতে গিয়ে পরিচালককে ঘিরে আছে কত-না সমস্যা। ছবির শেষ দৃশ্যের শুটিং সম্পন্ন হওয়ার আগেই আলেকজান্ডার গাড়ি-দুর্ঘটনায় মারা যায়। Meet Pamela ছবিতে আলফনসকে বিয়ে করে জুলি শ্বশুরবাড়ি এসেছে ঘর করতে। কিন্তু অচিরাৎ স্বামীকে নয়, শ্বশুরকেই ভালবেসে ফেলে জুলি। শ্বশুর আলেকজান্ডারও (জ্যঁ পিয়ের আমন্ত) আকৃষ্ট হয় জুলির দিকে। ছবির উপান্তে এসে ছেলের হাতে নিহত হয় বাবা। আলেকজান্ডারও গাড়ি-দুর্ঘটনায় মারা যায়। জুলি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি, মানসিক অবসাদ থেকে সেরে উঠতে গিয়ে সে তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় চিকিৎসকেরই প্রেমে জড়িয়ে পড়ে আর শেষ পর্যন্ত পরিণতি লাভ করে বিয়েতে। অন্যদিকে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র আলফনস (জ্যঁ পিয়ের লড) জড়িয়ে পড়ে এক মহিলা ক্রুর প্রেমে। কিন্তু মেয়েটি এ-ছবিতে কাজ করতে আসা এক ব্রিটিশ স্টান্টম্যানের সঙ্গে পালিয়ে যায়। ভেঙেপড়া মনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারে না আলফনস, সে কাজ ছেড়ে দেওয়ার ভাবনাই ভাবতে থাকে। জুলি জানতে পেরে তার শয্যাসঙ্গী হয়। এতদিনে সত্যিকারের প্রেমের দেখা পেয়েছে ভেবে কিছুটা শামিত্ম খুঁজে পেয়ে আলফনস আরেকটা ছেলেমানুষি করে ফেলে, – সে ড. বেকারকে টেলিফোন করে জানায় তার দুষ্কৃতির কথা। ঝামেলা আরো ঘনীভূত হয় যখন দেখা যায় ইউনিটের এক অভিনেত্রী অমত্মঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। আমরা ছবিতে দেখি পরিচালক ফারান্ড হিয়ারিং এইড ব্যবহার করছেন। তবে কি পরিচালকের অন্য ইন্দ্রিয়গুলো একটু বেশিমাত্রায় প্রখর? রাত্রে যখন ঘুমের মধ্যে দেখা দেয় ‘সিটিজেন কেনে’র দৃশ্যাবলি, তখন আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার অবচেতন মনের আকাঙক্ষাগুলো। ক্রমশ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে পরিচালকের এক বিভ্রান্ত মুখচ্ছবি।

১৯৮১ সালে লাস্ট মেট্রোতে এসে পরিচালক ত্রম্নফো সিনেমা থেকে মুখ ফেরালেন নাটকের দিকে। ইতিহাস ঘেঁটে আমরা জানতে পারি, নাজি অধ্যুষিত প্যারিসের শেষ ঘণ্টা বেজে উঠবে আর কিছুকাল পরেই। তার আগে শেষ মেট্রো ছেড়ে যাওয়ার পরপরই প্যারিসে নেমে আসে কারফিউর কালো রাত্রি। এই সময় জ্বালানির অভাবে কবোষ্ণ ছাউনির সন্ধানে নাগরিকরা এসে ভিড় জমাতেন নাটকের হলগুলোতে। ছবির শুরুতেই আমরা দেখতে পাই অনুজ্জ্বল প্যারিসের গলিঘুঁজিতে নাট্যকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি চরিত্র, যার নাম বার্নাড গ্র্যাঞ্জার (জরার্ড দেপারদ্যু)। ধীরে-ধীরে আমরা জানতে পারি, ইহুদি নাট্য পরিচালক হেনজ বেন্নেট (লুকাচ স্টেইনার) নাজিদের চোখে ধুলো দিয়ে এখানে একটি থিয়েটার হলের সেলারে লুকিয়ে নাটকের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আর স্ত্রী মারলন স্টেইনার (ক্যাথরিন ডেনেয়্যুভ) মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন, এবং পাশে-পাশে থিয়েটারের অন্যান্য কাজ সামাল দেন, থিয়েটারকে বাঁচাতে তিনি গুজব ছড়িয়ে দেন যে, তার স্বামী পালিয়ে গেছেন দক্ষিণ আমেরিকায়। সতর্ক থাকতে হয়, মাঝে-মাঝেই জার্মান সৈন্যরা এসে তদারক করে যায়। আমরা অনুভব করি, একটা বিপন্ন সময়ের চাপে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষজনের জীবনযাত্রা! নতুন থিয়েটারের মহলা শুরু হয় – নানা রকম প্রস্ত্ততি নিয়ে সকলে মেতে আছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনেতা হিসেবে বার্নাডকে নিযুক্ত করা হয়। একটি কমবয়সী মেয়ে থিয়েটারে অভিনয় করার জন্য মুখিয়ে আছে। একজন বয়স্কা মহিলাকেও দেখা যায় অভিনয়ের জন্য এগিয়ে আসতে। এর মধ্যে ওদের নাটক দেখতে এসে উদয় হয় কুখ্যাত নাট্য-সমালোচক ডাক্সিয়াট (জ্যঁ লুই রিচার্ড)। নাজিদের টিকটিকি হিসেবে সব নাট্যকর্মীই একে সমীহ করে চলে – যে-কোনো সময়েই এর কোপে পড়লে এর এক কলমের খোঁচায় নাটকের প্রদর্শন খারিজ হয়ে যেতে পারে, আর তার সঙ্গে ধরপাকড় তো আছেই। একদিন স্টেইনারকে এসে ভয় দেখায় ডাক্সিয়াট – সে জানায়, তার কাছে প্রমাণ আছে লুকাচ এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে। ওদের কথার মধ্যেই পাওয়ার কাট হয়ে যায়। বোমার ভয়ে সকলকে ভূগর্ভস্থ ট্রেঞ্চে গিয়ে লুকাতে হয়। মারলন বেশ ভয় পেয়ে যায়। সে ভাবে, লুকাচকে অবিলম্বে এ-দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। একদিন ডাক্সিয়টের লেখা ওদের নাটক নিয়ে সমালোচনা বেরোয় কাগজে। সমালোচনা পড়ে ক্ষুব্ধ হয় নাটকের দলের সকলে। ক্ষুব্ধ বার্নাড মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে ডাক্সিয়টের সঙ্গে। অসন্তুষ্ট মারলন দলকে বাঁচাতে ছুটে যায় জার্মান শিবিরে। এদিকে বার্নাড মারলনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে। মহলার সময়-সময় অন্তরঙ্গদৃশ্যে মারলনকে কিছুটা সতর্ক থাকতে হয়। ছবিতে আমরা দেখতে পাই জার্মানির পরাভবের পর অনেক নাটকের অভিনয় বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুতের অভাবে। ওদের নাটক কিন্তু চলতেই থাকে। পরবর্তী নাটক আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সকলেই খুব আনন্দে মিশে যায় নাটকের সঙ্গে।

ধনবাদী ব্যবস্থার চাপে বিভ্রান্ত হয়েছেন ফ্রান্সের শিল্প-সাহিত্যিকরা। সে-দোলাচলের ছবিই ফুটে উঠেছে ত্রম্নফোর শেষ দিকের
ছবিগুলোতে। যে-প্রতিবাদের শানিত প্রকাশে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ, তার অভাবে ত্রম্নফোর শেষ দিকের ছবিতে দেখা
দিল এন্টারটেইনমেন্টের সঙ্গে হাত মেলানো এক বিভ্রান্ত শিল্পীর মুখচ্ছবি।