কয়েকটি লেখা মোতাহের হোসেন চৌধুরী

এখানে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কয়েকটি অগ্রন্থিত লেখা সংগ্রথিত : একটি কবিতা, দুটি গান, একটি পত্র ও দুটি পত্রাংশ।

তিনি ভাবুক মননশীল চিন্তাবিদ প্রাবন্ধিক রূপে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে সুপরিচিত। প্রথম যৌবনে কবিতা লিখেই সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর পদার্পণ। পরিণত বয়সে কবিতা লেখায় ভাটা পড়লেও গান লিখতেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ জানিয়েছেন, তাঁর গানের রেকর্ডও বেরিয়েছিল, বেতারেও প্রচারিত হতো গান। তাঁর জ্ঞাতি ভ্রাতা ওসত্মাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু তাঁর অধিকাংশ গানে সুরারোপ করতেন।

দৈনিক আজাদের ঈদ সংখ্যায় (কলকাতা, নভেম্বর ১৯৪১) প্রকাশিত ‘মাধুরীলোকে’ নামে একটি চতুর্দশপদী কবিতা পাওয়া গিয়েছে। এটি  মোতাহের হোসেন চৌধুরীর গান ও কবিতা সংগ্রহে (চট্টগ্রাম, ২০০২) কিংবা রচনাবলীতে (১৯৯৫) অথবা অন্য কোনো সংকলনে গ্রন্থভুক্ত হয়নি। শফিউল আলমের ধারণা, বিভিন্ন সাহিত্যপত্রে তাঁর বিপুল কবিতা প্রকীর্ণ হয়ে আছে। কাব্যমূল্যের জন্যে না হলেও ঐতিহাসিক কারণেই এসব কবিতার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এখন পর্যন্ত তাঁর মাত্র আটত্রিশটি কবিতা (কয়েকটি অনুবাদ) সংকলনভুক্ত হয়েছে।

নবলব্ধ  ‘মাধুরীলোকে’ এখানে সংকলিত হলো :

 

মাধুরীলোকে

 

আমার চোখের আগে হাসিতেছে অনন্ত আকাশ,

সপ্তরঙা মেঘগুলি ‘দুলে, দুলে’ ডাকে ইশারায়,

প্রকৃতির গুপ্তপুরে কে যেন গো বাঁশরী বাজায়,

মনের গহনে মরি, কাঁপে তারি সুরের আভাস।

দুয়ারে বসিয়া একা, মৃদুমন্দ বহিছে বাতাস,

কেতকী গুণ্ঠন খুলি’ দিকে দিকে সুরভি বিলায়;

পুলক বেপথুভরা শেফালীরা মুখ তুলে চায়,

জীবনে উৎসব জাগে – বিধাতার পরম বিলাস।

ধরণী সাজিছে বধূ, টলমল যৌবন পাথার;

মুগ্ধ আখি ঢুলু ঢুলু, অকারণে শুধু চেয়ে রয়;

ভাঙা বুকে কোথা হ’তে এলো রাঙা রূপের বাহার,

তিক্ততার অবসান – চিত্ত আজি হলো মধুময়।

ক্ষণের মাধুরীলোকে বাজে বাঁশি উৎসব আকুল,

হৃদয়ের ভাঙা শাখে ফুটে রাঙা জীবনের ফুল।

গান

আমরা তাঁর দুটি গান খুঁজে পেয়েছি। গানদুটি আজতক্ কোনো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অপরিজ্ঞাত এই দুটি গান ডা. মোহাম্মদ ওমর-সম্পাদিত চট্টগ্রামের সত্যবার্ত্তায় (ঈদ সংখ্যা, ১৩৪৪ ও ১৩৪৬) প্রকাশ পায়; এ দুটি ‘গান’ শিরোনামে মুদ্রিত। প্রথম প্রকাশের কালানুক্রমে গান দুটি গ্রথিত হলো :

 

এক

ডাকলে কোকিল রোজ সকালে মাঠের বাটে যাই।

আমার        মানস-সরে সোনার কমল

ফুটলো না আর’ ভাই।

আমি                        ব্যাথার গীতি গাই।

আমার প্রাণে আলোর জ্যোতিঃ

ঢাল্লো না আর আলোকপতি,

আমি           অন্ধকারের আঁচল দিয়ে

মু’খানি লুকাই।

আমি                    ব্যথার গীতি গাই \

আমি          আলোর আশায় ছিলেম ব’সে

খু’লে সকল দ্বার;

আমার              ভোরের আকাশ মলিন ক’রে

নাম্লো আঁধিয়ার।

(ও ভাই, নামলো আঁধিয়ার)

অন্ধকারের পাষাণ পুরে

আলোর আশায় বেড়াঁই ঘুরে’,

তারে                পাইনে খুঁজে জীবন মাঝে,

পরাণ কাঁদে তাই।

আমি                        ব্যথার গীতি গাই।

 

দুই

আলোর বাঁশি বাজিয়ে দিয়ে

সোনার সুরে

কে এলো আজ প্রাণের পুরে।

তার         চরণ ছোঁয়ায় হিয়ার শাখে

ফুল ফুটে যে লাখে লাখে,

তার      উজল চাওয়ায় মনের আঁধার

যায় যে দূরে।

আমি             রি তরে প্রাণের ফুলে

 

মালা গাঁথি,

আমার         হিয়ার দেশে জ্বলে তারি

প্রেমের বাতি।

গোপন প্রাণের গানের ধারা

তারি লাগি বাঁধন হারা,

তারি           চরণ-ফুলে নয়ন-ভ্রমর

যায় যে উড়ে \

 

চিঠিপত্র

বাংলা সাহিত্যের শিল্পীরা উনিশ শতকে খুব বেশি চিঠিপত্র লিখতেন বলে মনে হয় না। কেউ কেউ লিখলেও সেগুলো হয়তো নেহাত কেজো চিঠি ছিল। আর তার বেশিরভাগই সংরক্ষিত হয়নি।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মোট চিঠি পাওয়া গেছে ত্রিশটি – এগারোটি বাংলায় আর উনিশটি ইংরেজিতে।  এ-তথ্য অবিদিত নেই যে, বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে সর্বাধিক চিঠির রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ; তাঁর চিঠির সংখ্যা নিরূপণ – আক্ষরিক অর্থেই-অসম্ভব। তাঁর পরের পত্রকার হিসেবে যাঁদের কথা উলেস্নখযোগ্য তাঁদের মধ্যে রয়েছেন – প্রমথ চৌধুরী, অমিয় চক্রবর্তী, মোহিতলাল মজুমদার, দিলীপকুমার রায়, কালিদাস রায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ।

বাঙালি মুসলমান লেখকরা সাহিত্যের অন্যান্য আঙ্গিকের মতো পত্র-রচনায়ও যথারীতি পিছিয়ে। মীর মশাররফ হোসেনের কোনো চিঠি খুঁজে পাননি আবুল আহসান চৌধুরী। বিশ শতকের প্রথমার্ধে নজরুল, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মুজফফর আহমদ, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখের চিঠিপত্র গ্রন্থে বা সাময়িকপত্রে প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আবুল ফজল পর্যন্ত অনেক লেখককেই সুফিয়া কামাল চিঠি লিখতেন। তবে আবুল ফজল ছাড়া অন্যেরা সেসব রক্ষা করতে পারেননি। তাঁকে লেখা কিছু চিঠি সাময়িকপত্রে মুদ্রিত হলেও বেশিরভাগই এখনো অপ্রকাশিত।

১৯২৬-এ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের কাজী আবদুল ওদুদের চিঠি লেখার প্রবণতা ছিল। আবদুল কাদিরও বহু চিঠির লেখক। শিখা-গোষ্ঠীর মোতাহের হোসেন চৌধুরী সাময়িকপত্র সম্পাদক ও সমসাময়িক লেখকদের সঙ্গে পত্রবিনিময় করলেও সেসব রক্ষিত হয়নি। তাঁর চিঠি সম্পর্কে মাহবুব-উল আলম জানিয়েছেন, ‘তাঁর পত্রগুলি হতো দীর্ঘ, এক একটি রীতিমত বৈঠক। … শুধু ভাবের কথা দিয়ে তাঁর চিঠি ভরপুর হতো।’ কায়সুল হককে লেখা চিঠিটি তো বলা যায় প্রমথ চৌধুরী বিষয়ে একটি নিবন্ধ। কাজী আবদুল ওদুদকে লেখা দীর্ঘ পত্রপ্রবন্ধটি ‘অহমিকা – সৌন্দর্যচেতনা – রবীন্দ্রনাথ’ নামে মুদ্রিত। সৈয়দ আবুল মকসুদ-সম্পাদিত মোতাহের হোসেন চৌধুরী  রচনাবলীতে  (প্রথম খ-, ১৯৯৫ ) ছয়টি (একটি আনিসুজ্জামানের জীবনী থেকে গৃহীত), মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম-সম্পাদিত সংস্কৃতি-সাধক মোতাহের হোসেন চৌধুরী (২০০৭) সংকলনে আরো ছয়টি চিঠি (ষষ্ঠটি রচনাবলিতে সংকলিত কায়সুল হককে লেখা চিঠির সংশোধিত পাঠ) স্থান পেয়েছে। এখানে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে লেখা একটি চিঠির পুরো বয়ান :

দারোগাবাড়ী

কুমিল্লা

১৭/৯/৩৫

শ্রদ্ধাস্পদেষু

আপনার চিঠিখানা যথাসময়ে আমার হস্তগত হয়েছিল। কিন্তু আমার উপর নানা কাজ ন্যস্ত থাকায় বিশেষ ক’রে আমার মানসিক অশান্তির দরুণ চিঠির উত্তর দিতে বিশ্রীরকম দেরী হয়ে গেল, ক্ষমা করবেন। আপনি ঠিকই বলেছেনঃ আমি আপনার ভক্ত। এই যুগে যে-কয়েকটি আলোকাভিসারীর নাম মনে জাগে আপনি তাঁদের অন্যতম। আপনি অত্যন্ত সহজ ভাবেই বুঝেছিলেন, আরব-তুরাণ-মিশর-ইরানের গৌরবকীর্ত্তনে আমাদের মুক্তি নেই, বরং জড়ত্ব ও অহংকারের রজ্জুতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে তা আমাদের মৃত্যুকে অনিবার্য্য করে তুলবে। তাই আপনি মুসলমান রচিত বাংলা সাহিত্যে আপনার দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন এবং সেদিকে দাবিদার [?] ন্যায় কঠোর সাধনায় ব্রতী হন। ফাঁকি দিয়ে জীবন কাটানোতে আনন্দ নেই, জীবনে লাবণ্য ফোটাতে হলে সাধনার প্রয়োজন, অতীত যুগে যে অল্প কতিপয় সাধক এ-কথা সম্যক রূপে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন, সেই সব শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আপনিই আজ পর্য্যন্ত জীবিত। তাই আপনার চরণে তরুণ মাত্রেরই শ্রদ্ধা নিবেদিত থাকবে। এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই।

আপনার ‘আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ আমার অনুরোধে স্কুলে রাখা হয়েছে। কুমিল্লা কলেজে, ঈশ্বর পাঠশালাতে পাঠাতে পারেন। উক্ত কলেজ ও স্কুলের কর্তৃপক্ষর অনুরোধে গ্রন্থাগারে রাখা যাবে। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে কেউই রাখবার নেই। মুসলমান সমাজে সাহিত্য আর সাহিত্যিকের কোন কদর নেই। এত বড়ো Militine [?] সমাজ করে কিনা সন্দেহ।

যাক, আমি বইখানার কিয়দংশ পূবের্বই পত্রিকায় পেয়েছি। আমার কাছে বেশ ভালোই লেগেছিল। অবশ্যই সম্পূর্ণ না পড়ে মতামত দেওয়া অন্যায়; তাই বর্ত্তমানে চুপ করে যেতে হল। কোনো ফাঁকে সম্পূর্ণ পড়ে ফেলবার চেষ্টা করব। সমালোচনা করা যাবে। আমি এক প্রকার শারীরিক ভালই, মানসিক জড়ত্ব নেই, আপনার মঙ্গল কামনা করি।                                                                                                                                                           বিনীত

মোতাহের হোসেন

 

চিঠিটি নেহাল করিম-সম্পাদিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে লেখা পত্রাবলী (২০১৮) থেকে গৃহীত। আশুতোষ চৌধুরী
(১৮৮৮-১৯৪৪) ও ওহীদুল আলম-সম্পাদিত (১৯১১-৯৮) পূরবী পত্রিকায়  (পৌষ-মাঘ, ১৩৪৪) তাঁর দুটি চিঠির অংশ ছাপা হয়েছিল। প্রাপকদের নাম উলেস্নখ নেই; সম্ভবত পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক ওহীদুল আলমের অগ্রজ মাহবুব-উল আলমকে লেখা হতে পারে। প্রথমটিতে তারিখ নেই, দ্বিতীয়টির তারিখ ২০/১১/১৯৩৭।  পূরবীর ওই সংখ্যায় অন্নদাশঙ্কর রায় ও কাজী আবদুল ওদুদের পত্রাংশও উদ্ধৃত হয়েছে।

মুদ্রিত চিঠির দুটি অংশ ‘পত্রাবলী’ শিরোনামে এখানে উদ্ধৃত হলো :

 

পত্রাবলী

আপনাদের রচনা পড়ে ও শ্রদ্ধেয় ওদুদ সাহেবের কাছে আপনাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্বদ্ধে জানতে পেরে যা বুঝলুম তাতে মনে হ’ল দেশের অন্তর্জীবন গঠনই আপনাদের লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কেননা জাতীয় উন্নতি ও প্রগতির জন্য এর প্রয়োজন আমি অনিবার্য্য মনে করি। জীবনের কুশ্রীতা ও সঙ্কীর্ণতা দূর করতে হ’লে অন্তর্জীবন গঠনের তাগিদ যে সবর্বাগ্রে, চিন্তাশীল মাত্রেই তা স্বীকার করেন। আমাদের তরুণ সমাজ সসত্মা রাজনীতির দিকে না ঝুঁকে এদিকে যতো আকৃষ্ট হয় ততোই দেশের ও তাঁদের নিজের মঙ্গল। কেননা রাজনীতিতে মন সৃষ্টিধর্ম্মী না হয়ে হুজুগধম্মী হ’য়ে উঠে, আর অন্তর্জীবন গঠন মানেই সৃজন ধর্ম্মী হওয়া। অতএব চাই এমন এক দল তরুণ, শার্লেটান না হয়ে যাঁরা হবেন  নিষ্ঠাবান সাধক, যাঁরা বর্ত্তমানের কারাগারে বন্দী না হয়ে ভবিষ্যৎকে ভালবাসতে শিখবেন আর নীটশের মতো বলতে পারবেন আমি বর্ত্তমানের জন্য জীবন ধারণ করিনে, ভবিষ্যতের জন্য বাঁচি, সন্তান সন্ততির দেশ আমার দেশ, সন্তান সন্ততিদের কাল আমার কাল। – ( সত্যি কথা, বর্ত্তমানের পূজা অন্তরে সঙ্কীর্ণতার সৃষ্টি করে, আর ভবিষ্যতের তপস্যা ঔদার্য্যের ভিত্তি ভূমি। একটা বড় সঙ্কীর্ণতা মুক্ত সমাজের কথা ভাবতে হ’লে ভবিষ্যতের পানে না তাকিয়ে উপায় নেই। বর্ত্তমান উদার স্বপনপিয়াসি আত্মাকে পীড়া দিতেই জানে) ভাবতে ভালো লাগে, খোদার ফজলে আমাদের সমাজে ধীরে ধীরে দু’একটী ক’রে তেমন লোকের আবির্ভাব হচ্ছে। মাথায় তাঁদের কাঁটার মুকুট তবু তারা উন্নতশির।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী

 

‘খা বাহাদুর নাসির উদ্দীন সাহেব সম্বন্ধে এই বলা চলে যে, তাঁর মতো সংস্কৃতি সম্পন্ন ও সজাগ মনের লোক তাঁর সমবয়সী লোকদের মধ্যে বিরল। অন্ধকার গগনে তিনি দীপ্তিমান তারকার মতো বিদ্যমান ছিলেন। সে দীপ্তিতে হয়তো সমাজের পথ চলার সহায়তা ততটা হয়নি, তা না হোক, কিন্তু তাঁর নিজের এবং পাশ^র্বর্ত্তী অনেক লোকের পথ চলার সুবিধা যে হয়েছিল, একথা নির্বিববাদে বলা যায়। … অহঙ্কার ও অলঙ্কার বর্জ্জিত সেই সাদা মানুষটি, বুকে যাঁর রয়েছে জ্ঞান ও প্রেমের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা আর বৃদ্ধ বয়সেও তারুণ্যের প্রতি বিশ্বাস যাঁর অবিচল।’

 

মোতাহের হোসেন চৌধুরী

২০/১১/৩৭