খাকি চত্বরের খোয়ারি

শাহাদুজ্জামান
কী নিয়ে গল্প হবে আজ?
গল্প হোক খাকি চত্বর নিয়ে। ডুবোনৌকার মতো মনের ভেতর ডুবে থাকা চোরাগোপ্তা গল্পগুলো তুলে আনা যাক। আমার হাতে খাকি চত্বরে আমার শেষদিনের ছবি। পাসিং আউট প্যারেডের দিন ছবিটি তোলা। ছবিতে খাকি পরা কতগুলো নবীন কিশোর। সবার চোখে-মুখে ভিড় করে আছে স্বপ্ন। এ-ছবিটি যখন তোলা হচ্ছে আমরা কেউ জানি না কে কোথায় গিয়ে ঠেকবো। খাকি পোশাকে আমাকে কেমন অদ্ভুত লাগছে। বেল্ট, বুট, ক্যাপের সঙ্গে চোখে চশমা, কেমন বেমানান।  আমাকে যেন কে ধরে-বেঁধে এনে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওই পোশাকটির ভেতর। ওই তো সামনের সারির বাম দিকে ইফতি। আমার চোখে ভাসছে ইফতি গিটার বাজিয়ে গাইছে, ‘সানডে মর্নিং আপ উইথ দ্য লার্ক, থিংক আই উইল টেক আ ওয়াক ইন দ্য পার্ক, হে হে হে ইটস আ বিউটিফুল ডে’। মাঝখানের সারিতে সোবহান। মনে পড়ছে চত্বরে প্রথম দিন সোবহান এসে হাত মিলিয়ে বলছে, ‘আই এম সোবহান, বাড়ি ন্যাত্রকোনা।‘ নেত্রকোনার সোবহান অবশেষে হয়েছিল দক্ষ স্কটিশ ব্যাগপাইপ বাজিয়ে। আর শেষসারির মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে রুমি। ছবিতে সে-ই একমাত্র খাকিবিহীন। পাসিং আউট প্যারেডের দিন খাকি পরার সুযোগ হারিয়েছিল সে। কোনো এক প্রেপ টাইমে নিষিদ্ধ ইশতেহারের মতো রুমি আমাদের সামনে প্রথম মেলে ধরেছিল প্লেবয় পত্রিকার রোমাঞ্চকর পাতা। পেছনের সারিতে রাজীবও। আমি দেখতে পাচ্ছি, ওই তো রাজীব বাথরুমে যাচ্ছে আর ওর হাতের সোপ কেসে বিখ্যাত ‘কসকো’ সাবান। ছবিতে মিলন নেই। মিলনের থাকার কোনো উপায় ছিল না।
দিনের শেষ আলোয় আমি আর মিলন স্থির দাঁড়িয়ে থাকতাম ফুটবলের গোলপোস্টের পাশে আর নেপথ্যে বেজে চলতো বিউগল। চোখ বুজলে বহুদিন আগে দেখা কোনো স্বপ্নের মতো খাকি চত্বরের সেই সন্ধ্যাগুলো ফুটে ওঠে আমার চোখের পাতার নিচে। আমি দেখতে পাই আমরা মাঠে-মাঠে ছোটাছুটি করে খেলছি আর সূর্য তার শেষ আলো মাঠ থেকে গুটিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। তারপর বেজে উঠছে পরিচিত সেই বিউগল। আর বিউগল বাজতেই থমকে যাচ্ছে সবকিছু। আমরা যারা তুমুল হৈচৈ করে মাঠগুলোতে খেলছিলাম, দাঁড়িয়ে পড়ছি বুক টান করে। আমাদের পায়ের কাছে পড়ে থাকছে ফুটবল, বাস্কেটবল, ভলিবল। পুরো চত্বর তখন একটা স্থিরচিত্র। গোলপোস্টের গা ঘেঁষে নীরবে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর মিলন। নেপথ্যে বিউগল বেজে  চলেছে কোনো দূরদেশী পাখির মতো। এই স্থিরতার ভেতর চঞ্চলতা শুধু
ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডটাতে। সেখানে স্ট্যান্ড সংলগ্ন দড়ি ধরে টানছে কেউ আর উঁচু থেকে একটা সরীসৃপের মতো ধীরে ধীরে নামছে পতাকা। আমার আর মিলনের চোখ তখন পতাকা ছাড়িয়ে দূরে, কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে টানা রেললাইনটির দিকে। প্রতি সন্ধ্যায় ঠিক এসময়টাতে একঝাঁক অচেনা পাখিকে আমরা উড়ে যেতে দেখতাম রেললাইন বরাবর। ঘোর নিয়মের পাঁকচক্রে বাঁধা ওই খাকি চত্বর সেসময় হঠাৎ হয়ে উঠতো অপার্থিব।

দুই
কোথায় এ খাকি চত্বর?
খাকি চত্বর সূর্য থেকে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে। কাছাকাছি শুক্র আছে, বুধ আছে। এই চত্বরে ২৪ ঘণ্টায় দিন হয় রাত্রি হয়। এখানে বর্ষা আসে, আসে হেমন্ত। পাখিও উড়ে যায় সেখানে। সত্যি বলতে এ চত্বর পৃথিবী গ্রহের ভেতরেই কিন্তু  নিজেই স্বতন্ত্র একটা গ্রহ যেন। অন্যরকম জীবন সেখানে। অন্যরকম অধিবাসী। এ চত্বরে অগণিত অর্বাচীন বালক খাকি পোশাক পরে পিঁপড়ার মতো সারিবেঁধে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। নানারকম কাণ্ড করে তারা। এখানে খুব ভোরে যখন ঘণ্টা বেজে ওঠে তখন একটা সাদা রেখা আকাশকে দিন ও রাত্রিতে ভাগ করছে। ঘণ্টা শুনে ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে বালকরা। তারা জানে যে, ঘড়িতে তখন বাজে ভোর ৫টা ৫। তাদের হাতে সময় মাত্র ২৫ মিনিট। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। আলো অন্ধকারে হাউসের করিডোর দিয়ে তারা টয়লেটের দিকে ছোটে। হাউসের সীমিত টয়লেটে তারা একজনের পর একজন ধারাবাহিকভাবে ঢোকে। একে অন্যকে ‘নেক্সট’ বলে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। তারা টয়লেট সারে, দাঁত ব্রাশ করে এবং তারপর খাকি পোশাক পরে নেয়। কড়কড়ে মাড় দেওয়া খাকি পোশাক, বেল্ট, বুট। কত দ্রুততম সময়ে তারা পোশাক পরে প্রস্তুত হতে পারে বালকেরা সেই প্রতিযোগিতায় নামে। এই প্রস্তুতিতে কারো ১৭, কারো ১৮, কারো বা ২০ মিনিট লেগে যায়। তারপর আবার একটি ঘণ্টা বাজে। ঘণ্টার আওয়াজে ভোরের পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ ঢাকা পড়ে যায়। বালকেরা তখন তড়িঘড়ি করে হাউসের সামনে গিয়ে ফল ইন করে। না, বালকেরা যুদ্ধে যায় না। তারা সৈনিকের শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ নিতে যায়। এই বালকদের ভেতর কেউ কেউ সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সৈনিক। কিন্তু আমি না। আমার ভেতর সৈনিকের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবু আমি বুট, বেল্ট, খাকি পরে ফল ইন করে দাঁড়াই হাউসের সামনে।

তিন
তাহলে আমি কী করে ওই ক্ষুদে সৈনিকদের চত্বরে গিয়ে ভিড়লাম?
নেহাতই কাকতালীয়ভাবে। ওই চত্বরে যাওয়ার আগে এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমি তখন এক ঝিমঝিম মফস্বল শহরের চশমাপরা নিরীহ বালক। স্কুলের ভালো ছাত্র। ক্লাস সিক্স পাশ করে ক্লাস সেভেনে উঠেছি সবে। ছড়া কাটছি :
ক্লাস ওয়ান – হয় দারোয়ান
ক্লাস টু – খায় গু
ক্লাস থ্রি – টানে বিড়ি
ক্লাস ফোর – জুতা চোর
ক্লাস ফাইভ – গুয়ের পাইপ
ক্লাস সিক্স – দেয় কিস
ক্লাস সেভেন – যায় হ্যাভেন
আমি তখন সেভেনে উঠে হ্যাভেনে যাওয়ার কথা ভাবছি মনে-মনে। ভাবছি এই ছড়ায় এতসব চোর-বাটপার, সিগারেট, বিড়ি, মলমূত্রের কথা কেন? স্কুল ব্যাপারটা নিয়ে যে অবচেতন ক্ষোভ, বিরক্তি আছে আমাদের, একি তারই বহিঃপ্রকাশ? কিন্তু দেখা যাচ্ছে ক্ষোভ যা কিছু তা ওই ক্লাস ফাইভ পর্যন্তই। ক্লাস সিক্সে বরং বেশ একটা              যুগান্তকারী ব্যাপার ঘটছে। ক্লাস সিক্সে উঠে কাকে যেন চুমু দেওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে কোনো ইঁচড়ে পাকা ছেলেই রচনা করেছে ছড়াটি। সিক্সের পর সেভেন তো আরো সম্ভাবনাময় বলেই মনে হচ্ছে। সেখানে অপেক্ষমাণ স্বর্গ। বলা বাহুল্য, ‘কিস’ বিষয়ক কোনো সম্যক ধারণা ছাড়াই আমি ক্লাস সিক্স পাশ করে তখন কেবল উঠেছি সেভেনে। তখনই ওই খাকি চত্বরের খবর আনলেন আমার মামা। রাজধানীতে থাকেন তিনি। দেশ-বিদেশের খবরাখবর রাখেন। তিনিই জানালেন, ওই খাকি চত্বরে যাওয়ার সুযোগ পায় শুধু ক্লাস সেভেনের বালকেরাই। আর একবার সে চত্বরে ঢুকে যেতে পারলে নিশ্চিন্ত জীবন। থাকা, খাওয়া, পড়া, ঘুম সবই ওই চত্বরে। টানা ছয় বছর। সেভেন থেকে টুয়েলভ। খরচপাতি সামান্য। মামা বললেন, খুব বেছে-বেছে বালকদের দেওয়া হয় ওই খাকি চত্বরের টিকিট। তারপর তাদের তৈরি করা হয় দেশের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে। ছেলের দেশনেতা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বাবার কোনো আগ্রহ ছিল না। বদলির চাকরি বাবার। বছর-বছর শহরবদল করতে হতো আমাদের, বছর-বছর গিয়ে আমাকে বসতে  হতো নতুন স্কুলের টুলবেঞ্চিতে। এইসব টানাহেঁচড়ার একটি নিষ্পত্তি খুঁজছিলেন বাবা। এই খাকি চত্বর একটা মোক্ষম সমাধান হিসেবে উপস্থিত হলো তার কাছে। তিনি একটি ক্রিকেট বলের মতো হাতে লুফে নিলেন মামার এই সংবাদ। মামাকে বললেন চত্বরের ঢোকার লড়াইয়ের জন্য আমাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে দিতে।  আমি বুঝলাম, সেভেনে উঠে হ্যাভেনে যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছিলাম সেটা মোটামুটি ভেস্তে যাচ্ছে।

চার
কী করে সেই খাকি চত্বরের টিকিট পেলাম তারপর?
খাকি চত্বরের টিকিট পাওয়ার দুর্গম লড়াইয়ে নামতে হলো আমাকে। লিখিত, মৌখিক, শারীরিক লড়াই। মফস্বল থেকে রাজধানীতে এলাম লিখিত লড়াইয়ে নামতে। আমার বুকপকেটে ঝরনা কলম। আমি তো ঝরনা কলমের দিনেরই বালক। তারপর আমার অজান্তেই কবে কোনদিন বলপয়েন্ট এসে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলো ঝরনা কলমকে। আমার বুকপকেটে তখন প্রিয় পাইলট ফাউন্টেন পেন। পাছে কালি শেষ হয়ে যায় এই ভয়ে সঙ্গে নিলাম পেলিকেন কালির দোয়াত। বড়-বড় হলরুম, কচি-কচি বালক আমরা। আঙুলে, শার্টে নীল কালি মাখিয়ে উত্তর দিলাম ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞানের প্রশ্নের। মফস্বলের চশমাপরা বালক আমি উত্তীর্ণ হয়ে গেলাম লিখিত লড়াইয়ে। ডাক এলো মৌখিক লড়াইয়ের। দর্জি দিয়ে বানানো নতুন শার্ট পরে নামলাম মৌখিক লড়াইয়ে। পরীক্ষাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মামার শেখানো কায়দায় হাত তুলে বললাম – ‘মে আই কাম ইন স্যার।’ ভেতরে ঢুকলে সামরিক পোশাক পরা এবং সামরিক পোশাকবিহীন গম্ভীর মানুষরা আমাকে নানাবিধ প্রশ্ন করলেন। তারা আমার কাছে চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানুষের নাম জানতে চাইলেন, পেরুর রাজধানীর নাম জিজ্ঞাসা করলেন। ‘যাব-যাব ভাবছি কিন্তু সঠিক করে বলতে পাচ্ছি না যাব কি যাব না’ এই বাক্যকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে বললেন। আমার কণ্ঠ শুকিয়ে গেল, বুক কাঁপলো। এমনিতে ভেতর-গোটানো বালক আমি। মা বলতেন, পেঁচার চোখ আমার। চশমার আড়ালে পেঁচার মতো বড়-বড় চোখে তাকিয়ে থাকি চারিদিকে। কান খোলা রাখি। নীল আর্মস্টং, লিমা ইত্যাদির খবর তাই পেয়ে যাই কীভাবে যেন। কিন্তু ‘যাব-যাব ভাবছি’ বাক্যটি নিয়ে বিপাকে পড়ি। একজন খাকি পোশাকবিহীন পরীক্ষক তখন আমার চশমার দিকে নজর দেন। বুড়োদের মতো কালো ফ্রেমের এক বিদঘুটে চশমা তখন আমার অপরিণত মুখে। তিনি আমাকে আমার চশমা বিষয়ে ইংরেজিতে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে বলেন। হোঁচট খেতে-খেতে কোনো রকম বলি, ব্ল্যাকবোর্ড দেখতে সমস্যা হয় বলে কী করে ডাক্তার আমার নাকের ওপর চড়িয়ে দিয়েছেন এই চশমা। মৌখিক লড়াইয়ের পর আমাকে তারা পাঠিয়ে দেন শারীরিক পরীক্ষার জন্য। সেখানে তারা আমার চোখ পরীক্ষা করেন। তারপর আমাকে শার্ট খুলে দাঁড়াতে বলেন। আমার বুকের দৃশ্যমান হাড়ের চারপাশে ফিতা ঘোরান তারা, আমার পলকা শরীরটাকে ওঠান ওজন মেশিনে। এরপর তারা আমাকে আমার প্যান্টও খুলতে বলেন। আমি প্যান্ট খুলে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াই। আমাকে তারা তখন কাশি দিতে বলেন। আমি কাশি দিই এবং তাতে আমার নিরীহ বাল্য পুরুষাঙ্গ কেঁপে ওঠে। ডাক্তার অতি মনোযোগের সঙ্গে সেই কাঁপা পুরুষাঙ্গ পরখ করেন। কী যে তিনি দেখেন তা রহস্যই থেকে যায় আমার কাছে। আমার শরীরের যাবতীয় যন্ত্রপাতি যাচাই হয় এভাবে।
তারপর প্রাচীন কবির সেই কবিতাটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’। হরিণের সুস্বাদু মাংসই তার শক্র। মাংসের লোভেই শিকার করা হয় তাকে। পরীক্ষকরা আমার মেধা এবং শরীর যাচাই করে দেখতে পান যে, একজন ভবিষ্যৎ নেতা হওয়ার সুস্বাদু সম্ভাবনা আমার ভেতর আছে। ফলে শিকার করা হয় আমাকে। আমাকে দেওয়া হয় ওই খাকি চত্বরের টিকিট। আর কৈশোরই তো সেই টিকিট পাওয়ার জুতসই সময়। কৈশোরই সেই আবছা সময় যখন আমরা আমাদের অস্পষ্ট মন আর শরীর নিয়ে নানা রকম সম্ভাবনা বয়ে বেড়াচ্ছি। কৈশোরই সেই সময় যখন আমরা সবেমাত্র নিজেদের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠছি, আমাদের আত্মপরিচয়ের আকাক্সক্ষা জাগছে, নানা রকম ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা ভাবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যৎ নেতা বানানোর এই কারখানার জন্য আমরা তখন মোক্ষম কাঁচামাল।

পাঁচ
টিকিট পেয়ে চত্বরে যেদিন প্রথম এলাম, সেই দিনটির কথা মনে পড়ে কি?
খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে দূরপাল্লার বাসে করে এসে বিকালে পৌঁছেছিলাম ওই খাকি চত্বরের বিশাল ফটকে। ভেতরে ঢুকেই,  ঝাঁ-চকচকে দালান, ছিমছাম রাস্তা, প্রকাণ্ড মাঠ, লাল-সাদা রঙে সেজে থাকা গাছ, সবকিছু দেখে মনে হলো বুঝিবা এলাম নতুন কোনো দেশে। নদীঘেরা যে মফস্বলে ছিলাম সেখানে এতো সাজানো কোনো জায়গা তো দেখিনি। মনে আছে বিশাল এক অডিটোরিয়ামে গিয়ে বসেছিলাম বাবা, মা আর মামাসহ। সেখানে শিকার হওয়া আমার মতোই আরো অনেক নবীন কিশোর। সবার চোখে-মুখে অনিশ্চয়তা। এরপর সেই খাকি চত্বরের প্রধান যিনি, চত্বরের অধ্যক্ষ এসে বক্তৃতা দিলেন। তিনি অভিভাবকদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনার সন্তানের দায়িত্ব এখন রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের হয়ে আমরা এখন এই চত্বরে এদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবো যাতে ওদের থাকবে একাধারে একজন সৈনিকের শৃঙ্খলাবোধ আর দৈহিক তেজ এবং একজন বুদ্ধিজীবীর মেধা আর প্রজ্ঞা। এই দুয়ের সমন্বয়ে আগামীতে রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে এরা। এরা হবে ক্রিম অব দি সোসাইটি।’ অধ্যক্ষ আরো বললেন, কিন্তু দায়িত্ব আছে বালকদেরও। কারণ ক্রিম হওয়ার পথ দুর্গম। কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে যেতে হবে সবাইকে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে তাকে বহিষ্কার করা হবে চত্বর থেকে। মনে আছে অধ্যক্ষের বক্তৃতা শুনতে-শুনতে আমি বেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। কোনো রকম ক্রিম, সৈনিক, বুদ্ধিজীবী হওয়ার সাধ আমার ছিল না। নেহাত  বছর-বছর স্কুলবদলের ঝামেলা থেকে মুক্ত হতেই গিয়েছিলাম সেখানে। একসময় বাবা, মা, মামা আমাকে ওই চত্বরে রেখে বিদায় নিলেন। বাবা মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করতে বললেন, মামা বললেন, চত্বরের নিয়মকানুন সব অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে। মা দোয়া পড়ে আমার মাথায়, বুকে ফুঁ দিলেন, আঁচলে চোখ মুছলেন। তারা চলে গেলে আমি ভীষণ অসহায় বোধ করতে লাগলাম।  এসময় আমাদের বাড়ির সেই বিড়ালটির কথা মনে  পড়লো আমার। অনেকদিন আগে আমাদের বাড়িতে চুরি করে মাছ খাওয়া দুষ্টু এক বিড়ালকে বাড়ির কাজের লোক আব্বাস নৌকা করে আমাদের শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর ভেতরের এক চরে রেখে এসেছিল। সে-নৌকায় আমিও ছিলাম।  মনে আছে, আমরা যখন বিড়ালটিকে চরে রেখে চলে এলাম বিড়ালটি তখন চরের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওই নৌকায় ফেরার জন্য অসহায়ভাবে বারবার তার সামনের পা তুলছিল। আমাকে খাকি চত্বরে রেখে সবাই চলে যাওয়ার পর নিজেকে আমার চরে ফেলে দেওয়া সেই অনাথ বিড়ালের মতোই মনে  হচ্ছিল।

ছয়
খাকি চত্বর, খাকি চত্বর বলে চলেছি অনেকক্ষণ। কিন্তু এই মানচিত্রে হঠাৎ করে এমন একটা খাকি চত্বর এলো কোথা থেকে?
সেসব ইতিহাস জেনেছি পরে। জেনেছি এইসব খাকি চত্বরের গোড়াপত্তন হয়েছিল অনেক আগে, যখন এদেশ স্বাধীন নয়। যখন এদেশের নাম পাকিস্তান। গোড়াপত্তন করেছিলেন এ-অঞ্চলের ইতিহাসের খাকি পরা এক মানুষ। তার হাত ধরেই এ অঞ্চলে শুরু হয়েছিল খাকি মানুষদের দাপট। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সামরিক শাসক হয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা নিয়ে দেশজুড়ে বইয়ে দিয়েছিলেন সামরিক হাওয়া। সেই হাওয়ার তোড়েই পড়াশোনার সঙ্গে সামরিক সংস্কৃতির মিশেল ঘটিয়ে নতুন এইসব খাকি চত্বর চালু করেন তিনি। এই চত্বরের মডেলটি তিনি নিয়েছিলেন আমাদের এককালের প্রভু ব্রিটেনের কাছ থেকে। সেখানে লর্ড, ব্যারন, নাইট, ডিউক প্রমুখ অভিজাত পরিবারের ছেলেদের ‘ডিসিপ্লিনড জেন্টলম্যান’ তৈরির জন্য যে এলিট বোর্ডিং স্কুল আছে, তার আদলকেই খানিকটা সামরিকায়ন করে তৈরি করা হয়েছিল এইসব খাকি চত্বর। কথা ছিল একটা সামরিক শৃঙ্খলার ভেতর রেখে পড়াশোনা আর পড়াশোনার বাইরের বহুমাত্রিক নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে ছেলেদের এমনভাবে তৈরি করা হবে যাতে তারা হবে চৌকস, অভিজাত একেকজন নাগরিক। ওই খাকি চত্বর থেকে বেরিয়ে তারা কেউ নেতৃত্ব দেবে সেনাবাহিনীতে, কেউ সমাজের অন্যান্য বলয়ে।
আমি যখন ওই চত্বরে ঢুকেছি তখন সবে স্বাধীন হয়েছে দেশ। বছর দুয়েক পেরিয়েছে মাত্র। চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ। বিতর্ক উঠেছে পাকিস্তানি শাসকের তৈরি এসব খাকি চত্বর এদেশে চালু রাখা হবে কিনা আদৌ। বিতর্কে জয় হয়েছে খাকি চত্বরগুলোরই। এই নতুন দেশেও প্রয়োজন নানা ক্ষেত্রের নেতৃত্ব ফলে আদলটা ঠিক রেখে খানিকটা বাংলায়ন, খানিকটা বেসামরিকীকরণ ঘটিয়ে চালু রাখা হয় এই খাকি চত্বরগুলো। কিন্তু আমাদের দেশে এতসব লর্ড, ব্যারন, ডিউক, নাইট পরিবার আর পাওয়া যাবে কোথায়? অভিজাত, অনভিজাত, ধনী, দরিদ্র সব প্রেক্ষাপটের বালকেরাই মেধার লড়াইয়ে জিতে পেয়ে যায় চত্বরে আসার টিকিট। কথিত অভিজাত, ধনাঢ্য পরিবারের না হয়েও আমি পেয়ে যাই এই চত্বরের টিকিট। তবে সিদ্ধান্ত হয়, বালকেরা সমাজের যে-প্রান্ত থেকেই আসুক না কেন, ছয় বছর তাদের ঘষামাজা চলবে নানা সামরিক আর অভিজাত কায়দায়।

সাত
ঘষামাজার সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হলো কী করে?
প্রথম দিন বাবা-মা আমাকে চত্বরে রেখে চলে যাওয়ার পর চশমার আড়ালে পেঁচার চোখ দিয়ে আমি চারপাশটা দেখছিলাম। কিছুক্ষণ পরই অডিটোরিয়াম থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাউসে, চত্বরের ক্ষুদে খাকি বালকদের বাড়ি। দেখি ক্ষুদে খাকিদের থাকার জন্য এ-চত্বরে সমান্তরাল দূরত্বে আছে তিনটি হাউস। জানতে পাই, একেক হাউসের একেকটি প্রতীকী রং। নীল, লাল, সবুজ। আমরা যারা ওই চত্বরে নতুন তাদের লাল, নীল, সবুজ হাউসে ভাগ করে দেওয়া হলো। আমি গিয়ে পড়ি নীল হাউসে। দোতলা নীল হাউসের নিচতলার একটা রুমে নেওয়া হয় আমাকে। মায়ের গন্ধবিহীন এই নতুন বাড়িতে ঢুকে কেমন ভয়-ভয় করে আমার। হাউসে জ্যামিতিক ছককাটা লম্বা-লম্বা সব ঘর, হাসপাতালের মতো সারিবাঁধা বিছানা। কোনো রুমে ১০টি বিছানা, কোনো রুমে পাঁচটি, কোনোটিতে চারটি আবার কোনোটিতে একটি মাত্র বিছানা। যত উঁচু ক্লাস তত কম বিছানার রুম। আমাদের নতুনদের জন্য বরাদ্দ ১০ বিছানার রুম। আমার জন্য বরাদ্দ নিচতলার রুমে গিয়ে দেখতে পাই প্রতিটি বিছানার সঙ্গে একটি টেবিল আর একটি আলমারি। ওই বিছানা, টেবিল আর আলমারি নিয়েই একেকজনের নিজস্ব সংসার। সেই রুমেই প্রথম দেখা হয় ইফতি, রুমি, মিলন, সোবাহান, রাজীবের সঙ্গে।
রুমে ঢুকে প্রথম কথোপকথনে ভড়কে যাই আমি। চত্বরের একজন সিনিয়র ক্ষুদে খাকি এসে আমরা যারা সেই রুমে নতুন এসেছি তাদের একলাইনে দাঁড়াতে বলেন। আমরা একলাইনে দাঁড়াই। তিনি বলেন, তিনি এই রুমের রুম-ক্যাপ্টেন। রুমের অধিবাসীদের গতিবিধি তদারকি করা তার কাজ। রুম থেকে বাইরে যেতে হলে, অন্যের বিছানার কাছে যেতে হলে, সেখানে বসতে হলে নিতে হবে রুম ক্যাপ্টেনের অনুমতি। তিনি জানান তার নাম দুলা। সেইসঙ্গে বলেন, এই চত্বরে সব সিনিয়র ক্ষুদে খাকিদের ডাকতে হবে ভাই বলে। ‘তাহলে তোমরা আমাকে কী নামে ডাকবে?’ জিজ্ঞাসা  করেন তিনি। আমরা মিনমিন করে বলি, ‘দুলা ভাই’। তিনি ধমক দিয়ে বলেন, ‘ব্লাডি ফুল’। আমাদের কী অন্যায় হয়েছে বুঝতে পারি না। তিনি বলেন, এ চত্বরে মিনমিন করে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, এই হাউসের প্রতীক রং যেমন নীল, তেমনি এর প্রতীক চিহ্ন হচ্ছে বাঘ। সুতরাং কথা বলতে হবে বাঘের মতো গর্জে। আরো জানান, এ চত্বরে কোনো সিনিয়র ক্ষুদে খাকির সঙ্গে কথা বলার সময় দাঁড়াতে হবে দুহাত শরীরের সঙ্গে লাগিয়ে বুকটান করে। আর কথার উত্তর দিতে হবে উচ্চৈঃস্বরে, বাঘের মতো গলায়। তিনি আবার আমাদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমাকে তোমরা কী নামে ডাকবে?’ আমরা দুহাত শরীরের সঙ্গে লাগিয়ে বুক টান করে বাঘের মতো গর্জে উঠি ‘দুলাভাই’। তিনি তখন বলেন, ‘এনি ওয়ে, দ্যাট ওয়াজ এ জোক।’ একথা বলে তিনি আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমরা ব্যাপার কিছু বুঝে উঠতে না পেরে চুপচাপ থাকি। তিনি তখন বলেন, আসলে তার নাম দুলা নয়, দুলাল। কারো বোনকে বিয়ে করে দুলাভাই হওয়ার কোনো সাধ তার নেই। এইসব বিচিত্র ধরনের কথোপকথনে আমি বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।
এরপর দুলাল ভাই আমাদের নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করেন। আমি আমার নাম বলি, যে-মফস্বল শহর থেকে এসেছি তার কথা বলি। ইফতি জানায়, সে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিস স্কুলের ছাত্র। জানায়, তার বাবা দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং কিছুকাল আমেরিকায় থেকেছে তারা। ঢাকার ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসেছে রাজীব আর মিলন। কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে রুমি। সোবহান বলে, সে পড়েছে ‘ন্যাত্রকোনা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে’। রুম ক্যাপ্টেন দুলাল ভাই আবার চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘ব্লাডি ফুল’। তিনি সোবহানকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘ন্যাত্রকোনা কী জিনিস? আর ইউ টকিং অ্যাবাউট নেত্রকোনা?’ সোবহান মাথা নাড়ে। দুলাল ভাই বলেন, ‘এসব ন্যাত্রকোনা, ফ্যাত্রোকনা চলবে না এখানে, মাইন্ড ইয়োর প্রোনাউনসিয়েশন’। এরপর তিনি আমাদের পোশাক পালটে সাদা শার্ট এবং প্যান্ট পরে ডিনারের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। আমরা লাইন ভেঙে যার-যার বিছানার কাছে যেতে উদ্যত হলে তিনি আবারও বলে ওঠেন ‘ব্লাডি ফুল’। আমরা বুঝতে পারি না এবার আমাদের কী অপরাধ। দুলাল ভাই জানান, সিনিয়র ক্ষুদে খাকিরা যদি জুনিয়র ক্ষুদে খাকিদের কোথাও যেতে বলে তবে সেখানে হেঁটে যাওয়া চলবে না, দূরত্ব যতটুকুই হোক না কেন যেতে হবে দৌড়ে, যে-ভঙ্গির নাম ‘ডাবল আপ’। ফলে এরপর আমরা ডাবল আপ করে যার-যার বিছানার কাছে যাই। চত্বরে আসার সময় কী-কী সঙ্গে করে আনতে হবে তার একটা তালিকা আমাদের পাঠানো হয়েছিল, তাতে সাদা শার্ট-প্যান্টের কথাও ছিল। আমরা বাড়ি থেকে যে পোশাক পরে এসেছিলাম সেগুলো পালটে সাদা পোশাক পরে নিই। ইফতি পরে এসেছিল টেট্রনের বেলবটম প্যান্ট আর লম্বা কলারের শার্ট, সেটাই ফ্যাশন তখন। অন্যদিকে  সোবহান এসেছিল পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, আর আমরা বাকিরা সব এসেছিলাম নানা রঙের সুতির শার্ট আর প্যান্ট পরে। আমরা সবাই পোশাক বদলে ডিনারের পোশাক পরে নিই। কিছুক্ষণ পর আমরা একটা ঘণ্টা শুনতে পাই এবং দেখতে পাই হাউসের সবাই গিয়ে দাঁড়িয়েছে সামনের রাস্তায়। আমরা নতুনরাও গিয়ে দাঁড়াই। হাউসের সামনে দাঁড়ানো সাদা পোশাক-পরা সেই নতুন বালকদের দেখে তখন আর বোঝার উপায় নেই কে এই বিকালেই এ-চত্বরে এসেছিল নীল বেলবটম প্যান্ট পরে, কে রং-বেরঙের সুতি শার্ট পরে আর কে পাঞ্জাবি পরে। তখন আমরা সব সাদা হয়ে আরো অগণিত সাদার সঙ্গে মিলে একাকার। ছোটবেলায় একবার নিউজপ্রিন্ট কারখানা দেখতে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, প্রকাণ্ড এক মেশিনের বিরাট গহ্বরে নানা রকম বাঁশ ফেলা হচ্ছে। তারপর সেই বাঁশগুলো দুমড়ে-মুচড়ে হয়ে পড়ছে একটা মণ্ড, এরপর আরো সব মেশিনের ভেতর দিয়ে চলাচল করতে-করতে অবশেষে সেই বাঁশগুলো পরিণত হচ্ছে টানা একটা কাগজের রোলে। তখন আর সেখানে বাঁশগুলোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবই দেখতে হয়ে গেছে একই রকমের সাদা কাগজের মাঠ। সাদা শার্ট-প্যান্ট পরা সবার ভেতর দাঁড়িয়ে তখন আমার নিজেকে সেই কারখানার মণ্ডের মতো মনে হতে লাগল। আমরা সেই কাগজের মণ্ডরা তারপর লাইন করে ঢুকি হাউস থেকে হাঁটাপথে খানিকটা দূরে ডাইনিং হলে।
ডাইনিং হলে ঢুকে খাওয়ার জটিল প্রক্রিয়া দেখে আমি আরো ভড়কে যাই। বিশাল ডাইনিং হলের ভেতর গিয়ে দেখি সারি-সারি টেবিল পাতা। দেখি খাবার ভরা টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সবাই। কিন্তু টেবিলে বসলো না কেউ, খেতেও শুরু করলো না। তারা অপেক্ষা করতে লাগলো। একপর্যায়ে শুনি ডাইনিং হলের একপ্রান্তের উঁচু টেবিল থেকে একজন বলে উঠলো, ‘বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম’। পরে জানতে পারি তিনি হচ্ছেন কলেজ ক্যাপ্টেন। তিনি বলার সঙ্গে-সঙ্গে অন্যরাও সমস্বরে বলে ওঠে – ‘বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম’। গমগম করে ওঠে ডাইনিং হল। তারপরই সবাই যার-যার আসনে বসে এবং খেতে শুরু করে। সেদিন আমাদের খাবারের মেন্যুতে ছিল স্যান্ডউইচ, সালাদ, স্যুপ, কাটলেট ইত্যাদি। দেখি সবাই ছুরি আর কাঁটাচামচ দিয়ে খাচ্ছে। ছুরি-কাঁটা দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। আমি কোনোরকম সামাল দেওয়ার চেষ্টা করি। ডাইনিং টেবিলের একজন সিনিয়র ক্ষুদে খাকি আমাকে ছুরি-কাঁটা ধরার কায়দা বলে দেন। খাওয়ার সময়টাতে ডাইনিং হলজুড়ে মৃদু গুঞ্জন আর কাঁটাচামচের টুং-টাং শব্দ চলে। এই চত্বরে আসার আগের রাতে মা আমাকে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভাত মাখিয়ে হাতে তুলে খাইয়েছিলেন, সে-কথা মনে পড়ে আমার। আমার পাশে বসেছিল সোবহান। খাওয়ার একপর্যায়ে তার হাত থেকে কাঁটাচামচ ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেলে হেসে ওঠে টেবিলের সবাই। একসময় চারদিকে কাঁটাচামচের শব্দ ক্রমশ স্তিমিত হয়ে এলে একটা ঘণ্টা বাজে। ঘণ্টা বাজতেই খাওয়া থামিয়ে দিয়ে একটা বিশেষ ভঙ্গিতে হাত টান করে ডাইনিং টেবিলেই বসে থাকে সবাই। চারদিক নিশ্চুপ তখন। এসময় আবার উঁচু টেবিল থেকে সেই কলেজ ক্যাপ্টেন একটি বেশ লম্বা দোয়া পড়েন, ‘আলহামদুলিল্লাহে লাজি আতা মানা ওয়া সাকানা ওয়া জালানা মিনাল মুসলেমিন’। সবাই তখন সমস্বরে বলে ওঠে ‘আমিন’। চশমার আড়ালে আমার সেই পেঁচার চোখ নিয়ে আমি খাবারের এইসব বিলাতি আর ইসলামি কায়দার জটিল প্রক্রিয়া দেখতে থাকি।
সেদিন রাতে ডিনার সেরে আমরা সবাই আবার যাই অডিটোরিয়ামে। সেখানে আমরা যারা নতুন এসেছি তাদের বরণ করে নিতে অনুষ্ঠান  হয় একটি। চত্বরের কালচারাল ক্যাপ্টেন আমাদের স্বাগত জানান। অন্যান্য সিনিয়র ক্ষুদে খাকি গান-বাজনা করেন। অনুষ্ঠানে কে একজন ওস্তাদি ভঙ্গিতে গাইলেন, ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা’। একজন আবৃত্তি করেন, ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে’। এরপর যে কলেজ ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণ আগে বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম বলে খাবারের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি মঞ্চের মাঝখানে গিয়ে গিটার নিয়ে দাঁড়ান। মঞ্চ অন্ধকার আর শুধু তার ওপর লাল স্পটলাইটের আলো। তিনি তুমুল গিটার বাজিয়ে মাইকে মুখ লাগিয়ে গাইলেন, ‘মাই মাই মাই ডি লায়লা, হোয়াই হোয়াই হোয়াই ডি লায়লা’। মঞ্চে দাঁড়ানো তাকে  দূরের রহস্যময় কোনো গ্রহান্তরের মানব বলে মনে হয়। চত্বরের ঢোকার পর থেকে যে গুরুগম্ভীর ভাবটা চলছিল সেটি কিছুটা হালকা হয় যেন। অনুষ্ঠান শেষে আবার আমরা ফিরে আসি যার-যার রুমে। রুমে আসার পর ঘুমের পোশাক পরে আমাদের বিছানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন দুলাল ভাই। কিছুক্ষণ পর একটি ঘণ্টা বাজতেই এক-এক করে নিভে যায় সব রুমের বাতি। বাতি নিভে গেলে বিছানায় শুয়ে পড়ি সবাই। আমার অতীতের মৃদুজীবনের সঙ্গে মিলিয়ে এই নতুন জীবনকে সব অর্থেই অভিনব মনে হয় আমার, বেশ অসহায় লাগে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না। শুয়ে-শুয়ে কাঁটাতারের ওপারের রেললাইন দিয়ে ছুটে চলা রাতের ট্রেনের শব্দ শুনি। অনেক রাতে আমার পাশের বিছানায় শুয়ে থাকা সোবহান ঘুমের ভেতর বলে ওঠে, ‘মা,  ও মা’।

আট
সোবহানও নিশ্চয়ই আমার মতো অসহায় বোধ করছিল সেদিন?
সম্ভবত আমার চেয়ে বেশি। কারণ সোবহান কোনোদিন দালানে থাকেনি। কাঁটাচামচ দূরের কথা কোনোদিন টেবিলে বসে খায়নি। মাদুর পেতে ভাত খাওয়া কৃষকের সন্তান সোবহান নেত্রকোনার প্রত্যন্ত গ্রামের মেধাবী ছাত্র। প্রতি সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে গরুকে খইল খাওয়ানো সোবহান লড়াই করে পেয়ে গেছে খাকি চত্বরের টিকিট। তার জন্য খাকি চত্বরের প্রথম দিনের অভিনবত্বের চাপ নিশ্চয়ই বেশি ছিল আরো। অথচ ইফতি প্রথম দিনই ছিল কত সাবলীল। সরকারি বড় আমলার ছেলে ইফতি বাড়িতে গলায় ন্যাপকিন লাগিয়ে নিয়মিত কাঁটাচামচ দিয়ে ডিনার খেতো। প্রথমদিন বাবার ভক্সওয়াগন গাড়িতে চড়ে চত্বরে এসেছিল সে। লম্বা চুলে পুরো কপাল ঢেকে থাকা ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর ছেলে রুমির পকেটে প্রথম দিনও ছিল কাঁচা টাকার নোট। সেদিন অবশ্য বোঝার উপায় ছিল না চত্বরের যাবতীয় অপকর্মে সে এমন মেধার পরিচয় দেবে। মিলনের চোখে-মুখে ছিল বিহ্বলতা। মিলন বলেছিল, তার বাবা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এই চত্বরে তাকে পাঠানো হচ্ছে শুধু এই কারণে যে, এখান থেকে বেরিয়ে তাকে যোগ দিতে হবে সেনাবাহিনীতে। অথচ মিলনের গায়ে ছিল অবিরাম কবিতার চাদর। সেই গায়ে খাকি চাপানোর কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। মিলন নিজের নাম দিয়েছিল ‘খাকি পরা মেঘ’। মেঘের মতোই অবিরাম উড্ডীন ছিল ওর মন। আর বাদামি চোখের রাজীব মৌনই ছিল প্রথমদিন। কথা বলেছিল সাবধানে। চত্বরে হিসাব করে চলায় জুড়ি ছিল না তার। আমরা নানা রঙের বালক, সমাজের নানা কোঠর থেকে এসে জড়ো হয়েছিলাম ওই চত্বরে।
কিন্তু চত্বরে ঢোকার শুরুতেই আমাদের সবার অতীত, স্বাতন্ত্র্য সব খসিয়ে ফেলা হলো দ্রুত। আমাদের সবার পুরনো পরিচয় ঝেড়ে ফেলে একটা নতুন জন্ম দেওয়া হলো। চত্বরে ঢোকার শুরুতেই আমাদের সবাইকে একটা করে সংখ্যা বরাদ্দ দেওয়া হলো। ক্ষুদে খাকি সংখ্যা। বলা  হলো এই সংখ্যাই এখন থেকে হবে আমাদের মূল পরিচয়, যা আমাদের নামের চেয়েও গুরত্বপূর্ণ। জানলাম, এ চত্বরে সবার আছে তেমন একটি করে নিজস্ব ক্ষুদে খাকি সংখ্যা। আমার ক্ষুদে খাকি সংখ্যাটি দাঁড়ালো ৫৭৪। বলা হলো, এই সংখ্যাতেই এখন থেকে সম্বোধন করা হবে আমাকে এবং এই সংখ্যাতেই খোদিত হয়ে থাকবে আমার যাবতীয় ইতিহাস। ফলে শুরু থেকেই আমি একটা সংখ্যায় পরিণত হয়ে গেলাম। বাড়ি থেকে আমার চিঠি এলে হাউস ক্যাপ্টেন আমার নাম ধরে ডাকেন না, বলেন ‘লেটার ফর ৫৭৪’। ক্লাসে শিক্ষকরাও ডাকেন সংখ্যা নামেই। এখনও ওই সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়েই মনে পড়ে সবার মুখ। ৫৬৭ সংখ্যাটি বললেই ভেসে ওঠে মিলনের মুখ। নৈর্ব্যক্তিক নামের সঙ্গে আমাদের পোশাকও হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক। বাড়ি থেকে আনা পোশাক বাতিল করে প্রথম রাতেই আমরা সবাই পরে নিয়েছিলাম সাদা শার্ট-প্যান্ট। এরপর আমাদের দেওয়া হলো চত্বরের বিখ্যাত মাড় দেওয়া খাকি পোশাক। আমরা সবাই একই খাকি, একই বেল্ট, একই জুতা, একই টুপির ভেতর আমাদের শরীরকে ঢুকিয়ে ফেলি। সবার অবয়বকেও যথাসম্ভব আনা হয় একই ছাঁচে। সবাইকে পাঠানো হয় সেলুনে। লম্বা, ছোট, কোঁকড়ানো, টেরি কাটা, জেল দেওয়া যাবতীয় চুলকে অতিক্ষুদ্র বাটি ছাঁটে ছেঁটে সমান করে দেওয়া হয়। সবাইকে তখন দেখতে লাগে অনেকটা গলা-ছিলা মোরগের মতো। সবাইকে কেটে, ছেঁটে, টেনে আনা হয় একই সমতলে। তারপর আমরা পরস্পর মাখামাখি করে কাটাতে থাকি দিনরাত্রি।
বিশাল ফটক আর কাঁটাতারঘেরা ওই চত্বরই ছিল আমাদের পৃথিবী। বড় গ্রহের ভেতর একটা ছোট গ্রহ। বড় দেশের ভেতর একটা ছোট দেশ। এই চত্বরের বাইরের পৃথিবী ছিল আমাদের জন্য নিষিদ্ধ জগৎ। মাসে একদিন শুধু বাইরের পৃথিবী বরং এসে হাজির হতো আমাদের চত্বরে। সেদিন প্যারেন্টস ডে, অভিভাবকরা সেদিন এ-চত্বরে এসে তাদের ছেলেদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন। আর বার্ষিক ছুটিতে সপ্তাহখানেকের জন্য বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ মিলত আমাদের। বাকি সময়টা ওই ঘেরাটোপই ছিল আমাদের একমাত্র ঠিকানা। আমাদের বাড়ির জীবন আর ওই খাকি চত্বরের জীবনচক্রে ছিল মৌলিক ফারাক। আমরা যখন বাড়িতে ছিলাম তখন যাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতাম তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম না, আবার যাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম তাদের সঙ্গে মিলে ঘুমাতে যেতাম না, একইভাবে যারা ছিল আমাদের ঘুমের সঙ্গী তারা আমাদের পড়ার সঙ্গী ছিল না। অর্থাৎ আমাদের পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলা, ঘুমানো সব ঘটত ভিন্ন-ভিন্ন জগতে। এক জগতের সঙ্গে আরেক জগতের দেয়াল ছিল। পৃথক জগতের ছিল পৃথক অধিবাসী, পৃথক নিয়ম, পৃথক অভিভাবক, পৃথক উদ্দেশ্য। কিন্তু এই খাকি চত্বরে এসে দেখলাম সেসব দেয়াল ভেঙে গেছে। সবকিছুই ঘটছে একটা জগতে। একটা কড়া নজরদারির ভেতর একই সব মুখের মুখোমুখি হয়ে আমরা একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করে চলতাম সেখানে।

নয়
সেই জীবনচক্রে একটা পৌনঃপুনিক ব্যাপার ছিল তাহলে?
কৈশোরের দুরন্ত ঘোড়াকে বশ মানানোর জন্য তাকে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ রেখে পৌনঃপুনিক একটা জীবনে অভ্যস্ত করে তোলা ছিল জরুরি। বালকেরা এখানে ভোরবেলা ঘণ্টাধ্বনিতে ঘুম থেকে জাগে। দ্রুততম সময়ে তারা কোনোদিন পরে নেয় প্যারেড, কোনোদিন পিটির পোশাক। ভোরের প্রথম আলোয় তারা কখনো মার্চপাস্ট, কখনো শরীরচর্চা  করে। তারপর আবার ঘণ্টা বাজলে তারা চলে যায় ডাইনিংয়ে। বিসমিল্লাহ, আমিন ইত্যাদি ব্রত পালন করে তারা সকালের নাস্তা খায়। তারপর তারা যায় শ্রেণিকক্ষে। শরীর শানানোর পর এবার উপস্থিত হয় তাদের মেধা শানানোর সময়। একাডেমিক ভবনের শ্রেণিকক্ষে  যার-যার জন্য বরাদ্দ পৃথক ডেস্কে গিয়ে বসে তারা। একেক করে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে এসে নানা বিষয়ে পাঠ দেন তাদের।  পাঠশেষে তারা আবার ফিরে যায় ডাইনিংয়ে। নিয়ম মেনে কাঁটাচামচে দুপুরের খাবার খায় তারা। তারপর ফিরে আসে নিজের রুমে। সেখানে তারা নীরবে শুয়ে থাকে যার-যার বিছানায়। তখন তাদের সন্ন্যাসীদের মতো মৌনব্রত পালনের সময়। এ সময়ের নাম ‘কোয়ায়েট আওয়ার’। তন্দ্রায় তাদের চোখ খানিকটা ভারি হয়ে এলে আবার বেজে ওঠে ঘণ্টা। তারা যার-যার বিছানার পাশে বসে যায় নিজস্ব পড়াশোনায়। এসময়ের নাম প্রেপ টাইম। ঢুলুঢুলু চোখে তারা পড়ে ব্যাঙের পরিপাকতন্ত্র। তারপর আবার ঘণ্টা বাজলে তারা সব ছুটে যায় চত্বরের বড়-বড় খেলার মাঠে। তাদের পায়ে, হাতে ছোটাছুটি  করে ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল। মাঠে-মাঠে তখন কলরব। তারপর একসময় বেজে ওঠে বিকালের বিউগল। বিকেলের শেষ আলোয় দূরদেশি পাখির মতো বিউগল বেজে উঠলে বালকেরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সরীসৃপের মতো ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড থেকে তখন নামে পতাকা। বিউগলের সুরে স্থির দাঁড়িয়ে বালকেরা পতাকাকে শ্রদ্ধা জানায়। এরপর তারা রুমে ফিরে গিয়ে খেলার পোশাক ছেড়ে পরে নেয় ধর্মীয় পোশাক, পাজামা-পাঞ্জাবি। এসময় তারা ধার্মিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সূর্য ডোবার পর মাগরিবের আজান শোনা গেলে পাজামা-পাঞ্জাবি গায়ে তারা চলে যায় মসজিদে। মসজিদ থেকে ফিরে এসে আবার পোশাক পালটায় তারা। দৃশ্য পালটানোর সঙ্গে-সঙ্গে মঞ্চাভিনেতার মতো তারা পালটে নেয় তাদের কস্টিউম। নামাজের পরে তারা মঞ্চে উপস্থিত হয় নতুন বেশে। এবার তারা  একেবারে খাঁটি বিলাতি। পাজামা, পাঞ্জাবি ছেড়ে তারা পড়ে নেয় সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট আর লাল টাই। তাদের ডিনার ড্রেস। অতি সামান্য কয়েকজন বালকের টাই পরার অতীত অভিজ্ঞতা আছে। ফলে টাইয়ের যথার্থ নট দেওয়া তাদের জন্য একটি বিড়ম্বনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা টাইয়ে একটি নট দিয়ে স্থায়ীভাবে ঝুলিয়ে রাখে আলমারিতে এবং ডিনারের আগে গলিয়ে দেয় গলায়। ডিনারের আগে তারা আবার শ্রেণিকক্ষে যায় আরেক দফা প্রেপ টাইমে। চলে তাদের রাতের পাঠ। এরপর ঘণ্টা বাজলে তারা ডাইনিংয়ে উপস্থিত হয় ডিনারের জন্য। নানা বৈচিত্র্যময় ডিনার সরবরাহ করা হয় তাদের আমাদের। কোনোদিন ইংলিশ ডিনার, কোনোদিন খাসির বিরিয়ানি, ভাত-মাংস কোনোদিন। দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার তারা, ফলে আমাদের পুষ্টিও একটি রাষ্ট্রীয়  বিনিয়োগ। ডিনারের পর হাউসে ফিরে খানিকটা মুক্ত সময় পায় বালকরা। এসময় তারা মেতে ওঠে আড্ডায়। বালকেরা হাউস থেকে মসজিদ, মসজিদ থেকে শ্রেণিকক্ষ, শ্রেণিকক্ষ থেকে ডাইনিং চত্বরের এইসব বিবিধ এলাকায় চলাচল করে পিঁপড়ার মতো সারিবেঁধে। রাতে বালকদের চকিত আড্ডা চলতে-চলতে ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টা স্পর্শ করলেই বেজে ওঠে দিনশেষের ঘণ্টা।এ-ঘণ্টা লাইটস অফেরা। এটি তাদের দিনশেষের সংকেত। বাস্তবিক তখন এক-এক করে নিভে যায় সব ঘরের বাতি। তারপর শুধু অন্ধকার। বিছানায় শুয়ে তারা চত্বরের বাইরের রাতের ট্রেনের শব্দ শোনে। এই এক পৌনঃপুনিক চক্রে চলে বালকদের জীবন। যেন পুতুলনাচের ইতিকথা। যেন কেউ একজন কলকাঠি নাড়ছে, ঘণ্টা বাজছে আর বালকরা পোশাক পালটে মঞ্চে উপস্থিত হচ্ছে নতুন-নতুন ভূমিকায়। অবশ্য পুতুলগুলো বেয়াড়া নয়। নিয়মমতো, শৃঙ্খলামতো ঠিক নাচে সবসময়।

দশ
চত্বরের এইসব শৃঙ্খলার পাঠ আমাদের দেওয়া হলো কীভাবে?
চত্বরের মৌল তাড়না শৃঙ্খলা। ছকেবাঁধা আমাদের দিনগুলোর প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কর্মকাণ্ড নির্দিষ্ট শৃঙ্খলায় পালিত হচ্ছে কিনা সেটি নিশ্চিত করার জন্য ছিল বিরাট বাহিনী। আমাদের রুম ক্যাপ্টেন দুলাল ভাই যেমন ছিলেন রুম তদারকির দায়িত্বে, তেমনি পুরো হাউস তদারকির জন্য ছিলেন হাউস ক্যাপ্টেন, পুরো চত্বর তদারকির জন্য কলেজ ক্যাপ্টেন। এছাড়া ছিলেন আরো নানা ক্ষেত্রে বিবিধ ক্যাপ্টেন। গেমস ক্যাপ্টেন, ডাইনিং ক্যাপ্টেন, কালচারাল ক্যাপ্টেন ইত্যাদি। তারা সবাই ক্ষুদে খাকিদের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নেতা। এই ক্যাপ্টেনদের এবং সেই সঙ্গে পুরো চত্বরের নজরদারির জন্য ছিলেন সামরিক বাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট, হাবিলদার। সামগ্রিক তদারকিতে ছিলেন প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল। এই চত্বরের শৃঙ্খলার প্রথম পাঠ আমাদের দিয়েছিলেন আমাদের রুম ক্যাপ্টেন দুলাল ভাই। সেই পাঠ তিনি শুরু করেছিলেন আমাদের রুমে প্রত্যেকের বিছানার পাশের আলমারিটি থেকে।
দুলাল ভাইয়ের ভেতর একধরনের নাটকীয়তা ছিল। আমাদের কিছু বলতে চাইলে তিনি সবসময় লাইন করে তার সামনে দাঁড়াতে বলতেন। সেভাবেই দাঁড়াতে বললেন তিনি। আমরা দাঁড়ালাম। তারপর তিনি তার বিছানার পাশের আলমারিতে হাত রেখে আমাদের জিজ্ঞাসা  করেন – ‘এটা কী?’ আমরা সবাই চোখের সামনে একটি আলমারি দেখেও এ প্রশ্নের কারণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং এটি যে একটি আলমারি সে-কথা বলতে সাহস পাই না। দুলাল ভাই তখন নিজেই বলেন যে, ‘এটা একটা আলমারি, আমরা এখানে বলি কাবার্ড। এই চত্বরে ডিসিপ্লিনের যত নিয়মকানুন আছে তার শুরু এই কাবার্ড থেকেই। সুতরাং সেই ডিসিপ্লিন শেখার প্রথম পাঠটা হবে এই কাবার্ডের মাধ্যমে’ – বলেন দুলাল ভাই। এরপর তিনি আমাদের শেখান আলমারির কোন তাকের কোন অংশে থাকবে শার্ট, কোথায় প্যান্ট, কোথায় বই, কোন কোনায় আন্ডারওয়্যার, মোজা, কোথায়ই বা টুথব্রাশ, পেস্ট। তিনি বলেন, এটি যেমন ডিসিপ্লিনের প্রশ্ন তেমনি প্রশ্ন সময়েরও। সময়ের মূল্য এ চত্বরে হীরার টুকরার মতো, ফলে যে কোনো প্রয়োজনে আলমারি খুলে মুহূর্তমাত্র সময় ব্যয় না করে চোখ বুজে হাত বাড়ালেই যাতে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসটি পেতে পারি সেটি নিশ্চিত করারও এ এক কৌশল।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই কাবার্ড পরিদর্শনও হতো। সেদিন সকালে প্রিন্সিপাল, হাউস ক্যাপ্টেন, অ্যাডজুট্যান্ট সবাই মিলে আসতেন আমাদের রুম পরিদর্শনে। আমরা যার-যার বিছানা এবং আলমারির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম ‘সাবধান’ ভঙ্গিতে আর প্রিন্সিপাল তার বাহিনী নিয়ে আমাদের রুমের পরিচ্ছন্নতা আর কাবার্ডের শৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণ করতেন। তারা যাচাই করতেন শৃঙ্খলার সূতিকাগার আমাদের বিছানার পাশের ওই কাবার্ড যথাযথ আছে কিনা। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত জুতা-মোজা পরে থাকতে হতো বলে আমাদের অনেকের মোজাতেই থাকত ঘামের ঘন্ধ। কাবার্ডের কাছে নাক এনে সেটাও পরখ করতেন অ্যাডজুট্যান্ট। এক কাবার্ড দেখার জন্য এতবড় এক পরিদর্শক বাহিনী হাস্যকরই বটে। কিন্তু প্রশ্নটা এখানে শুধু কাবার্ডের নয়। এই পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে একটি বার্তা পৌঁছানো হতো বালকদের কাছে। বার্তা এই যে, চত্বরে তোমার অস্তিত্বের কোনো অংশই নজরদারির বাইরে নয়, এমনকি তোমার মোজা এবং আন্ডারওয়্যারও নয়। কাবার্ড আমাদের ব্যক্তিত্বের একটি সম্প্রসারণ। সুতরাং কাবার্ডকে শৃঙ্খলার ভেতর আনা ছিল আমাদের ব্যক্তিত্বকে শৃঙ্খলার ভেতর আনারও একটি উপায়। সেই সঙ্গে শরীরটিকে শৃঙ্খলায় আনতেও ছিল কঠোর সব ব্যবস্থা। খাকি পোশাক, প্যারেড, পিটি – এসবই ছিল শরীরকে শৃঙ্খলায় আনার হাতিয়ার।

এগারো
সেই সব সামরিক উপসর্গের ভেতর দিয়ে যেতে কেমন লেগেছিল আমার?
সেইসব সামরিক উপসর্গের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হোঁচট খেয়েছি পদে-পদে। খাকি চত্বরে গিয়ে কিছুদিন পরই আমাদের হাতে আসে কড়কড়ে মাড় দেওয়া বিখ্যাত সেই খাকি পোশাক। আমার শরীরটাকে ওইরকম জবরজং একটি পোশাকের ভেতর ঢোকাতে হবে ভেবে খুবই অস্বস্তি বোধ করি আমি। সেই খাকি পোশাকের কত বিবিধ, বিচিত্র সব অনুষঙ্গ। কাঁধের কাছে ‘অ্যাপুলেটস’ নামের বিশেষ ভেলভেটের বাড়তি কাপড়। এমনিতে সবাই খাকিতে একাকার হলেও ওই অ্যাপুলেটসই পারস্পরিক পার্থক্য চিহ্নিত করার সূত্র। ক্লাস সেভেনের ক্ষুদে খাকির অ্যাপুলেটসে একটি দাগ, ক্লাস এইটে দুটি, যত উঁচু ক্লাস অ্যাপুলেটসের দাগ ততো বেশি। ডোরাকাটা দাগ দেখে যেমন বাঘ চেনা যায়, তেমনি অ্যাপুলেটসের দাগ দেখে বোঝা যায় কোন ক্ষুদে খাকি কোন ক্লাসের। আবার ক্যাপ্টেনদের অ্যাপুলেটসে আঁকা থাকে তারকা। হাউস ক্যাপ্টেন হলে দুই তারকা, কলেজ ক্যাপ্টেন হলে তিন। কলেজ ক্যাপ্টেনের জন্য বরাদ্দ মোটা চামড়ার বিশেষ এক বেল্ট যা তার বুকের এপাশ থেকে ওপাশে যায় ব্রাহ্মণের পৈতার মতো। পরস্পরের ভেতর উঁচু, নিচু ভেদ প্রশিক্ষণের এও এক পদ্ধতি। খাকি পোশাকের সঙ্গে আরো আছে পুরু কাপড় আর পিতলের পাত সমন্বয়ে তৈরি মোটা বেল্ট। আছে বিশেষ কাপড়ের টুপি, যার চূড়ায় প্রতীক সংবলিত এক পিতলের পাত। সেই টুপি পরারও আছে বিশেষ কায়দা। টুপির পাত এবং বাম চোখ থাকতে হবে সমান্তরালে। টুপি পরে বাম চোখের ওপর আঙুল স্থাপন করলে সে আঙুল যদি টুপির পিতলটিকে স্পর্শ করে তাহলেই বুঝতে হবে টুপি যথাস্থানে আছে। সব মিলিয়ে সেই খাকি পোশাক পরা এক জবরজং ব্যাপার।
বেল্ট এবং টুপির যে পিতলের অংশ সেটিকে ঘষে চকচকে করা ছিল আমাদের এক কঠিন সাধনা। আমাদের সবার সঙ্গে থাকত ‘ব্রাসো’ নামের পিতল ঘষার বিশেষ এক রাসায়নিক পদার্থ। একটি বিশেষ ন্যাকড়াতে ব্রাসো লাগিয়ে ঘষে-ঘষে আমরা বেল্ট আর টুপির পিতলকে চকচক করতাম। ছয় বছর অবিরাম ব্রাসো ঘষতে ঘষতে এর গন্ধ আমাদের অস্তিত্বের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খাকি পোশাকের আরেকটি প্রধান অনুষঙ্গ বুটজুতা। ওই বুটের সম্মুখভাগ আয়নার মতো চকচকে করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতাম আমরা। বাস্তবিক জুতাকে আয়নায় রূপান্তরিত করার আদেশ দেওয়া হতো আমাদের। বলা হতো, জুতার সম্মুখভাগ এতোটা স্বচ্ছ হতে হবে যাতে অ্যাডজুট্যান্ট, হাবিলদার, হাউস ক্যাপ্টেন, কলেজ ক্যাপ্টেন প্রমুখ তাদের মুখ সেখানে দেখতে পান। আমরা কঠিন কসরত করে জুতাকে আয়নায় রূপান্তরের সংগ্রাম করতাম। ‘ওয়াটার পোলিশ’ নামে বিশেষ একধরনের জুতা পোলিশে আমরা দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম। কাপড় দিয়ে ঘষে-ঘষে তারপর ভেজানো তুলার শেষ স্পর্শে চকচক করে তুলতাম বুট। সেসময় বাজারে আসেনি আজকালকার মতো শু-শাইন।
এইসব জবরদস্ত সাজসজ্জা শেষে আমরা গিয়ে দাঁড়াতাম প্যারেডে। আমাদের নতুনদের প্যারেড শিখিয়েছিলেন  হাবিলদাররা। সেনাবাহিনীর নন-কমিশনড অফিসার তারা। আমাদের গোঁফ পাকানো হাবিলদার মেজরের নাম ছিল শরীফ। আমরা তাকে ওস্তাদ ডাকতাম। ওস্তাদ শরীফ আমাদের শিখিয়েছিলেন মার্চপাস্টের সময় কীভাবে সিনা টান করে, তালে-তালে একবার ডান পা একবার বাম পা ফেলতে হয়, কী  করে বুটের গোড়ালির তীব্র আঘাতে মাথার ব্রহ্মতালু কাঁপিয়ে তুলতে হয়। মার্চপাস্টের নিয়ম অনুযায়ী হাত এগোতে হবে আমার সামনের সারির ছেলেটির কাঁধ বরাবর। এক ইঞ্চি ওপরে বা এক ইঞ্চি নিচে নামানোর উপায় নেই। সবাই মিলে এই সমান্তরাল পা ফেলতে আর হাত ওঠাতে নাভিশ্বাস উঠেছিল আমাদের। মার্চপাস্টের সময় অন্যদের সঙ্গে পা মেলাতে অপারগ হলে, শরীফ ওস্তাদ  রেগে গিয়ে বলতেন, ‘৫৭৪,  শশমা আমি তোমার ঠ্যাঙ্গে পরামু।’ আমাকে তিনি ৫৭৪-ই  ডাকতেন আর চশমাকে তিনি বলতেন ‘শশমা’। তিনি প্যারেডের ফাঁকে কী করে ‘সাবধানে’ দাঁড়াতে হয়, কী করে দাঁড়াতে হয় ‘আরামে’ তাও শেখালেন। সেনাবাহিনীর কমান্ড ইংরেজিতে বলাই ঐতিহ্য। ‘অ্যাটেনশন’, ‘স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ’, ‘ফরওয়ার্ড মার্চ’  ইত্যাদি সেনাজীবনের অনিবার্য সব শব্দ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে দেশপ্রেমের জোয়ারে এইসব কমান্ডের বাংলায়ন ঘটল। বলা হলো ‘সাবধানে দাঁড়া’, ‘আরামে দাঁড়া’, ‘এগিয়ে চল’ ইত্যাদি।  ‘সাবধানে দাঁড়াও’ না বলে ‘সাবধানে দাঁড়া’ বলাই হলো রেওয়াজ। তুই-তোকারি করে আদেশ না দিলে কমান্ডের সেই জোরটা ঠিক ফুটতো না যেন। সৈনিকদের আরো সব জটিল প্রশিক্ষণও নিতাম আমরা। আমরা অবস্ট্রাকল কোর্স করতাম। পেশাদারি সৈনিকদের প্রশিক্ষণের অংশ এটি। দ্রুততম সময়ে নানা বাধা পেরিয়ে যাওয়ার কৌশল শেখানো হতো এতে। একপ্রান্ত থেকে দৌড়ে আরেকপ্রান্তে যেতে হবে আর মাঝে থাকবে বিবিধ বাধা। একটি উঁচু দেয়াল পার হতে হবে, ঝুলিয়ে রাখা টায়ারের ভেতর শরীর গলিয়ে দিতে হবে, মাঙ্কি জাম্পে দড়ি দিয়ে তৈরি দেয়াল বেয়ে উঠে বানরের মতো টপকাতে হবে, হামাগুড়ি দিয়ে পার হয়ে যেতে হবে সুড়ঙ্গের মতো ট্রেঞ্চ, ছোট-ছোট স্তম্ভের ওপর পা রেখে হেঁটে যেতে হবে অনেকদূর। এসব জটিল কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়তাম আমি। মাঙ্কি জাম্প দিতে গিয়ে প্রায়ই আমার চশমা গড়াগড়ি যেত ধুলায়। কোনো কোনোদিন ভোরে আমরা প্যারেডের বদলে পিটি করতাম। সেদিন আমরা খাকির বদলে পরতাম সাদা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। মার্চপাস্টের বদলে পিটির সময় আমরা খাকি চত্বরের চারপাশে দৌড়াতাম, শরীরচর্চা করতাম। আমাদের সৈনিকের এসব তেজ আর শৃঙ্খলা প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধান করতেন অ্যাডজুট্যান্ট। মেজর পারভেজ তার নাম। অবিরাম ক্ষিপ্ত থাকতেন তিনি। অবিরাম সবাইকে ধমক, বকা, গালাগালি করতেন। পিটিতে প্রায়ই পিছিয়ে পড়তাম আমি। পেছন থেকে অ্যাডজুট্যান্ট পারভেজ  চিৎকার করে উঠতেন, ‘ইউ প্রেগনেন্ট ডাক।’ গর্ভবতী হাঁসের দুলে-দুলে দৌড়ানোকে বাঘের দৌড়ে পরিণত করা ছিল আমার জন্য এক দুরূহ সংগ্রাম।

বারো
চত্বরের সর্বত্রই কি ছিল এই সামরিক দাপট?
এই চত্বরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বরাবর সামরিক কর্তৃপক্ষ। ফলে প্রত্যক্ষে, পরোক্ষে চত্বরজুড়ে একধরনের সামরিক আধিপত্য ছিলই। মাঝে-মাঝে দেশের খাকি চত্বরের প্রধান মেজর জেনারেল আসতেন চত্বর পরিদর্শনে। তখন চত্বরজুড়ে শুরু হতো তুলকালাম কাণ্ড। প্রিন্সিপাল, অ্যাডজুট্যান্ট, হাবিলদার শিক্ষক সবার মধ্যে তখন সাজ-সাজ রব। সেই উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে অভিবাদন জানানোর জন্য আমরা যে বিশেষ প্যারেড করতাম তার মহড়া চলতো অনেকদিন ধরে। ‘সাবধান’, ‘সামনে চল’, ‘ডাইনে ঘোর’ এসবের মহড়া দিতে-দিতে ঘাম ঝরিয়ে ফেলতাম আমরা। যেদিন তিনি আসবেন তার আগের রাতে আমাদের মেটাল পোলিশ আর বুট পোলিশের এক মহোৎসব শুরু হতো। পরদিন সকাল থেকে আমরা গিয়ে দাঁড়াতাম প্যারেড গ্রাউন্ডে। কড়া রোদে ফল ইন করে আমরা ‘আরামে দাঁড়া’ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম সেনাকর্তার জন্য। তার আসার নির্ধারিত সময়েরও বহু আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা। তবে ওই প্যারেড গ্রাউন্ডে আরামে দাঁড়িয়ে থাকা তো আর বাস্তবিক আরামে দাঁড়ানো নয়। দুপা খানিকটা ফাঁক করে পেছনে হাত মুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা। ডানে বাঁয়ে তাকানো, নড়াচড়া করা, কথা বলা কোনো কিছুরই অনুমতি নেই সেসময়টায়। এভাবে রোদে দীর্ঘক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে আমাদের মাথা ঝিমঝিম করতো। ঘামে আমার নাক ভিজে গিয়ে চশমা চলে আসতো নাকের ডগায় কিন্তু সেটাকে যে একটু উঁচুতে তুলে চোখের কাছাকাছি নেব তার উপায় ছিল না। ফল ইনে দাঁড়িয়ে শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়ানোর অনুমতি নেই। আমি ওই ঝুলন্ত চশমা নাকের ডগাতে নিয়ে অস্বস্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাদের চত্বরের ডাক্তার শিখিয়ে দিয়েছিলেন যেহেতু শরীরের দৃশ্যমান কোনো অঙ্গ নাড়ানোর অনুমতি নেই, আমরা যেন আমাদের বুটের ভেতরের অদৃশ্য আঙ্গুলগুলো অবিরাম নাড়াতে থাকি। তা না হলে আমাদের রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হবে এবং আমরা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারি। এধরনের প্যারেডে প্রায়ই এমন ঘটতো। একজন দুজন অজ্ঞান হয়ে যেতো। আমাদের ঘাম ঝরিয়ে, অজ্ঞান করে অবশেষে বিরাট কর্তারা আসতেন। আমরা তাদের অভিবাদন জানাতাম।
যদিও আমাদের ক্লাসরুমগুলোতে ছিল বেসামরিক হাওয়া তারপরও সেখানে কখনো-কখনো ঘটতো সামরিক হানা। আমাদের বেসামরিক শিক্ষকরাও থাকতেন তটস্থ। একদিন আমরা ছিলাম আমাদের বায়োলজির আকমল স্যারের ডিসেকশন ক্লাসে। সেদিন আমরা তেলাপোকা ডিসেকশন করছি। টেবিলের ওপর ছিল তেলাপোকার জার। দেশের খাকি চত্বরগুলোর প্রধান মেজর জেনারেল আমাদের চত্বর পরিদর্শনে এসে চুপচাপ বসেছিলেন ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে। তার চোখে সানগ্লাস। আমরা হঠাৎ তাকে ক্লাসে দেখে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। তিনি সবাইকে বসতে বলে শুধু বলেন, ‘ক্যারি অন।’ আকমল স্যার, যিনি ছিলেন সরল, নার্ভাস ধরনের মানুষ, সেনাকর্তাকে ক্লাসরুমে দেখে খুবই ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এমনিতে তিনি বাংলাতেই ক্লাস নিতেন কিন্তু সেদিন তিনি ইংরেজিতে বলতে শুরু করেন, ‘ককরোচেজ আর অ্যান ইনসেক্ট অফ দি অর্ডার অব ব্লাটারিয়া।’ তার গলা কাঁপছিল। হন্তদন্ত করতে গিয়ে তার হাত লেগে একসময় টেবিল থেকে মেঝেতে পড়ে যায় তেলেপোকা ভরা জারটি। জার ভেঙে বেরিয়ে পড়ে তেলাপোকাগুলো। তারা পালিয়ে যেতে থাকে নানা দিকে। সেনাকর্তা তার সানগ্লাস একবার খুলে আবার চোখে পরলেন এবং তারপর নীরবে বেরিয়ে গেলেন ক্লাস থেকে। আকমল স্যার ধাতন্থ হয়ে বললেন, ‘তেলাপোকাগুলো বেরিয়ে গেলেও লেকচারটা তো আমি ভালোই দিচ্ছিলাম, কী বলিস?’ আমরা বললাম, ‘জ্বি স্যার, দারুণ হচ্ছিল।’ তিনি বললেন, ‘ঠিক বলছিস তো?’ ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন তিনি।
মেজর জেনারেল কদাচিৎ এ-চত্বরে এলেও চত্বরের দৈনন্দিন সামরিক মাত্রাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতেন অ্যাডজুট্যান্ট আর হাবিলদার। তাদের বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে মূল সেনাবহিনী থেকে পাঠানো হতো এই চত্বরে। কিন্তু এই চত্বরে তাদের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে একটা মৌলিক অমীমাংসা বুঝি থেকেই যেতো তাদের মধ্যে। তারা তো সকলে বস্তুত প্রাপ্তবয়স্ক সৈনিকদের তত্ত্বাবধানে অভ্যস্ত। অথচ তাদের পাঠানো হয়েছে এমন এক চত্বরে যেখানকার অধিবাসীরা সৈনিকও নয়, প্রাপ্তবয়স্কও নয়। চত্বরের কচি-কচি এইসব মানব সন্তানের ভেতর অমন যুদ্ধসাজে এসে তারা যে ঠিক কোন ভূমিকা নেবেন সেটা বোধ করি খুব স্পষ্ট ছিল না তাদের কাছে। তাদের তো কিশোর মনস্তত্ত্বে কোনো প্রশিক্ষণও ছিল না। ফলে তারা এইসব নাজুক কিশোরের সঙ্গে পেশাদার সৈনিকদের মতো আচরণ করে তাদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে ছাড়তেন। অ্যাডজুট্যান্ট মেজর পারভেজ আমাদের কাছে ছিলেন একটি ত্রাসের নাম। তিনি মৌমাছির মতো চত্বর ঘুরে বেড়াতেন কোথায় হুল ফোটানো যায় সেই আশায়। জটিল, দুর্গম জায়গায় চোখ যেত তার। কার জুতার সামনে চকচক করলেও পেছনে করছে না, কার টুপির পেছনে একটু সুতা বেরিয়ে আছে, কার কাবার্ডের একেবারে নিচের তাকের পেছনে রয়েছে ধুলা সেইসব খুঁজে-খুঁজে বের করতেন তিনি। কথায়-কথায় তিনি দিতেন কঠিন শাস্তি, এক্সট্রা ড্রিল।

তেরো
সেইসব শাস্তির স্মৃতি মনে আছে কি?
সেসব ভোলার কোনো উপায় নেই। এ-চত্বরে আমরা সারাক্ষণ ছিলাম একটা নজরদারির ভেতর ফলে যে কোনো স্খলনের জন্যই বরাদ্দ ছিল শাস্তি। কত বিবিধ, বিচিত্র কারণে যে শাস্তি দেওয়া হতো আমাদের। খাকির বোতাম না থাকা, জুতা বা বেল্টের পিতল যথেষ্ট চকচক না করা, কোয়ায়েট আওয়ারে কথা বলা, প্যারেডে দাঁড়িয়ে কথা বলা, ফল ইনে দেরি করে ফেলা,  ডিনার ড্রেসের নিচে গেঞ্জি না পরা ইত্যাদি লম্বা তার তালিকা। শাস্তিও সব ছিল সামরিক কায়দারই। লঘু শাস্তি, গুরু শাস্তি। কোয়ায়েট আওয়ারে আমার পাশের বিছানার মিলনের সঙ্গে কথা বলছিলাম বলে প্রথম শাস্তি পাই হাউস ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে। সেটি ছিল লঘু শাস্তি। আমাকে পুরো ফুটবল মাঠ ফ্রন্টরোল দিয়ে পার হতে হয়। ফ্রন্টরোল, ডিগবাজি দেওয়ারই সামরিক নাম। এছাড়া লঘু শাস্তি হিসেবে আছে  ফ্রগ জাম্প, যা মূলত দীর্ঘক্ষণ ব্যাঙের মতো লাফানো। কিংবা ক্রলিং, যাতে পাকা রাস্তার ওপর কনুই ঠেলে যাওয়া অনেকদূর। এর যে কোনো একটি বা একাধিক কসরত সহযোগে শাস্তি হতো আমাদের।  আর ছিল গুরু শাস্তি এক্সট্রা ড্রিল। অপরাধ গুরু না লঘু তা নির্ধারণ করতেন যিনি শাস্তি দিচ্ছেন তিনি। লঘু অপরাধেও গুরু শাস্তি হতে পারতো। আমাদের অ্যাডজুট্যান্টের চোখে শৃঙ্খলার যে কোনো স্খলন ঘটলেই তিনি দিতেন গুরু শাস্তি, এক্সট্রা ড্রিল। তিনি প্যারেডে এসেই প্রায়ই পরীক্ষা করতেন বালকদের বেল্ট কতটুকু টাইট। তিনি কোমর আর বেল্টের মাঝামাঝি আঙুল ঢুকিয়ে পরখ করতেন বেল্ট নিয়মমাফিক টাইট আছে কিনা। বেল্ট এবং কোমরের মাঝখানে তিল পরিমাণ ফাঁক থাকা ছিল শৃঙ্খলার স্খলন। সেখানে আঙুল ঢোকাতে সমর্থ হলেই অ্যাডজুট্যান্ট তাকে এক্সট্রা ড্রিল দিতেন। এক্সট্রা ড্রিল, আমাদের মাঝে পরিচিত ছিল সংক্ষিপ্তভাবে ইডি নামে। ক্রলিং, ফ্রন্টরোল, ফ্রগ জাম্প ইত্যাদি লঘু শাস্তির সঙ্গে ইডির ক্ষেত্রে যুক্ত হতো আরো জটিল কিছু কর্মকাণ্ড। যেমন ধরা যাক পিঠে বালুর অথবা ইটের বস্তা নিয়ে দৌড়নো, মাথা নিচে পা ওপরে দিয়ে থাকা ইত্যাদি। লঘু শাস্তি, যে কোনো সময়ই হতে পারতো কিন্তু এক্সট্রা ড্রিল হতো ঠিক গেমসের সময়টিতে। যখন সবাই মাঠে খেলবে তখন ইডিপ্রাপ্ত ক্ষুদে খাকি তার খাকি পোশাক গায়ে মাঠের পাশে সাজা ভোগ করবে। সাজার ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলার জন্যই বিশেষ করে ওই খেলার সময়টিকে বেছে নেওয়া হতো। মাঠের একদিকে চলছে আনন্দ, আরেকদিকে বিষাদ। তাছাড়া ইডির ছিল নানা আনুষ্ঠানিকতা। ফ্রন্টরোল, ক্রলিং মৌখিক আদেশে হলেও এক্সট্রা ড্রিল হতো লিখিত আদেশে। যার শাস্তি হবে তার ক্ষুদে খাকি নম্বরটি টাইপরাইটারে নোটিশ আকারে লেখা হতো। অ্যাডজুট্যান্ট তাতে সই করতেন এবং তা সব হাউসের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হতো। প্রায় সমন জারির মতোই। তারপর হাবিলদার এসে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালনা করতেন সেই শাস্তি। পুরো ব্যাপারটার ভেতর ছিল একটি নাটকীয়তা। কিশোর বয়সের অপরিণত ওই শরীরে সেইসব শাস্তি বহন করা আমাদের জন্য ছিল দুরূহ।
ক্ষুদে খাকিদের বেলায় অনেক অপরাধই ঘটতো নেহাত অমনোযোগে, অবহেলায়। কিন্তু সিনিয়র হওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষুদে খাকিরা পরিকল্পিতভাবে নিয়মভঙ্গ করতো। কথা তো এই যে, যেখানে ক্ষমতার চর্চা থাকে সেখানে ক্ষমতাকে উপেক্ষা করার একটা চর্চাও থাকে সবসময়। নিয়মের জাঁতাকলে পড়ে দুর্বলরা যখন বোঝে নিয়ম পালটানোর কোনো ক্ষমতা তাদের নেই, তখন তারা নিয়ম ভেঙে একধরনের প্রতিবাদ করে। আর যত নিয়মে বেঁধে রাখার চেষ্টা হোক না কেন, কৈশোরের দুরন্ত ঘোড়া তো লাগাম ছিঁড়ে ছোটার জন্য মুখিয়ে থাকতোই। কিছু-কিছু কাণ্ড ছিল যেগুলো চত্বরে গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হতো। সবাই পারতো না কিন্তু কেউ কেউ গুরুতর সেসব অপরাধে অংশ নিত। যেমন বালকেরা যে আর বালক নেই সেটা নিজের কাছে প্রমাণের একটা উপলক্ষ ছিল ঠোঁটে সিগারেট ধরানো। কিন্তু চত্বরের ভেতর এ-কাজ ছিল ক্ষমাহীন অপরাধ। অপরাধের আরেকটি উপলক্ষ ছিল কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি নিয়ে চত্বরের বাগানের মৌসুমি ফল চুরি করা। এও এক গুরুতর অপরাধ। আর সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ ছিল গোপনে চত্বরের কাঁটাতার পেরিয়ে বাইরের জনপদে চলে যাওয়া। এইসব অপরাধে এক্সট্রা ড্রিল তো হতোই, পাশাপাশি বাড়ি থেকে অভিভাবকদের ডেকে এনে সতর্ক করে দেওয়া হতো। বলা হতো, পরবর্তীকালে এমন কিছু ঘটলে তাকে বহিষ্কার করা হবে চত্বর থেকে। আবার এমন হয়েছে অনেক সময় আমরা দেখতাম বাক্সপেঁটরা নিয়ে কোনো এক ক্ষুদে খাকি চলে যাচ্ছে খাকি চত্বর ছেড়ে। শুনতে পেতাম তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে কিন্তু তার কারণ আমাদের কাছে থেকে যেত রহস্যময়। তারপরও এইসব কাণ্ড ঘটতো চত্বরে। বালকেরা ঘটাতো।
আমাদের ভেতর নিয়ম ভাঙার ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন ছিল রুমি। যাকে আমরা ডাকতাম বোতল বলে। তার লম্বা গলা আর ঈষৎ স্থূল শরীরের সঙ্গে যে বোতলের সাদৃশ্য আছে সে-ব্যাপারটি আমাদের কেউ একজন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। চত্বরের জীবনে লঘু, গুরু, গুরুতর সব অপরাধই করেছিল সে। অপরাধ করে ধরা না পড়ার দক্ষতা ছিল তার। যদিও শেষরক্ষা আর হয়নি। কিন্তু একবার রুমির কারণে অপরাধ না করেও আমরা অনেকেই পেয়েছিলাম এক্সট্রা ড্রিল। সেদিন ছিল শুক্রবারের জুমার নামাজের সময়। মাগরেবের মতো জুমার নামাজও বাধ্যতামূলক ছিল আমাদের। নামাজে আমাদের দাঁড়াতে হতো ক্লাস অনুযায়ী। আমরা ক্লাস নাইন ছিলাম এককাতারে, সামনের কাতারে ক্লাস টেন। ইমাম যখন আরবিতে খুতবা পড়তেন তখন তার বিন্দু বিসর্গ না বুঝে আমরা কেউ হাই তুলতাম, কেউ গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে শুনছি এমন ভাব করতাম আর কারো মাথায় ঘুরতো দুষ্টুবুদ্ধি। সেদিন রুমি গভীর মনোযোগে খুতবা শোনার ভান করে খুব সাবধানে সামনের সারিতে বসা দুই সিনিয়র ক্ষুদে খাকি ভাইয়ের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা পাঞ্জাবি একটির সঙ্গে আরেকটি গিঁট দিয়ে লাগিয়ে দেয়। আমরা আড়চোখে ব্যাপারটা দেখি এবং প্রাণপণে হাসি চাপি। তারা পরস্পরের সঙ্গে পাঞ্জাবিতে যুক্ত হয়েই নামাজ পড়েন; কিন্তু নামাজ শেষে বের হতে গিয়েই টের পান ব্যাপারটি। নামাজে উপস্থিত অ্যাডজুট্যান্টকে গিয়ে অভিযোগ জানান তারা। এটা যে  তাদের পেছনের সারির ক্লাস নাইনের কারো কাণ্ড তাতে কারো কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নামাজ শেষ হয়ে যাওয়াতে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে ফলে ঠিক কে যে তাদের পেছনে বসেছিল তারা তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না। অ্যাডজুট্যান্ট মেজর পারভেজ মসজিদ থেকে বেরোতে উদ্যত সবাইকে হাঁক দিয়ে দাঁড়াতে বললেন, যারা ক্লাস নাইনের তারা সবাই যেন মসজিদের সামনে গিয়ে ফল ইন করে দাঁড়ায়। আমরা পাঞ্জাবি পরা বালকরা সব ফল ইন করে দাঁড়ালাম। তিনি আমাদের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন কে ওই পাঞ্জাবি সংক্রান্ত ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমরা সবাই নীরব রইলাম। তিনি আবারো বললেন, দোষী নিজ থেকে বেরিয়ে না এলে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। রুমি জানে দোষ স্বীকার করলে মারাত্মক পরিণতি হবে তার। ফলে নীরব থাকে সে। আমরাও কেউ কিছু বলি না। আমাদের ভেতর তখন স্পার্টাকাস ধরনের সহমর্মিতা। আমরা ভাবি, এবার বুঝি তিনি পুরো ক্লাসকেই বড় কোনো শাস্তি দেবেন। সেটা না করে তিনি বলেন, যাকে যাকে তিনি সারি থেকে এক পা সামনে এসে দাঁড়াতে বলবেন তাদের সেদিন রাতে ডিনারের পর স্পেশাল এক্সট্রা ড্রিল হবে। এরপর তিনি সবার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলেন এবং কারো কারো সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড। এভাবে যাকে যাকে তার সম্ভাব্য অপরাধী বলে মনে হলো তাদের তিনি এক পা সামনে এসে দাঁড়াতে বললেন। কিসের ভিত্তিতে তিনি এদের নির্বাচন করছেন সেটা অবশ্য আমাদের জানার কোনো উপায় ছিল না। তাকে সেই মুহূর্তে অনেকটা নাৎসি কমান্ডারের মতো মনে হচ্ছিল, যিনি সারিবেঁধে দাঁড়ানো ইহুদিদের লাইন বরাবর হেঁটে-হেঁটে ঠিক করছেন কাকে-কাকে ওইদিন গুলি করা হবে আর কাদের রেখে দেওয়া হবে আরো একদিনের জন্য। যাদের এক পা সামনে আসতে বলা হয়েছে তাদের সবার ক্ষুদে খাকি সংখ্যাটি তিনি টুকে নিলেন। এভাবে দৈবচয়নের ভিত্তিতে অপরাধী খোঁজার যে ব্যবস্থা তিনি করলেন তাতে দুর্ভাগ্যবশত আমিও পড়ে গেলাম। সেদিন ডিনারের পর এক দুর্ধর্ষ এক্সট্রা ড্রিল হলো। এক্সট্রা ড্রিল সাধারণত হয় খেলার সময়। কিন্তু সেদিন হলো রাতে ডিনারের পর থেকে লাইটস অফের সময় পর্যন্ত। ফ্রন্টরোল দিতে দিতে আমরা অধিকাংশই সেদিন বমি করে উগরে দিলাম রাতে খাওয়া আমাদের ইংলিশ ডিনার। শাস্তি শেষে সবাইকে দাঁড় করিয়ে তিনি বললেন, ‘ইউ অল আর আওয়ার ফিউচার লিডারস। হোয়াট অ্যাই অ্যাম ট্রাইং টু ডু ইজ টু ট্রেইন ইউ অ্যাজ আ টাফ হিউম্যান বিয়িং। অ্যান্ড রিমেমবার হোয়েন গোয়িং গেটস টাফ, দ্য টাফ গেটস গোয়িং।‘

চৌদ্দ
চত্বরের কি অবিরাম এই রুদ্রমূর্তি, সেখানে কি অবিরাম এই টাফ হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ?
তা ঠিক নয়। চত্বরের ঘোর শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের ভেতরও বুদ্বুদের মতো জেগে ওঠে অবকাশ, শিথিল হাওয়া। সেসময় আমাদের সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রোববারে। সেদিন আমাদের প্যারেড নেই, পিটি নেই, ক্লাসে গিয়ে জ্ঞানার্জন নেই, ভোরে ঘণ্টাধ্বনিতে ঘুম থেকে জেগে টয়লেটে যাওয়ার প্রতিযোগিতা নেই। চত্বরের ঘড়ির কাঁটা ধরে চলা সেই জীবনে এই আলস্য ছিল মদির।  আবার কোনো সাপ্তাহিক দিনের সকালে যদি ঝুমবৃষ্টি নামতো তাহলে সে সকালটাও হয়ে উঠতো ছুটির দিনের মতো। সেদিন বাতিল হয়ে যেত পিটি, প্যারেড। কৃষক যেমন বৃষ্টি দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে চত্বরের বালকদেরও ঘুম থেকে জেগে বৃষ্টি দেখতে পেলে টগবগিয়ে উঠতো মন। বৃষ্টির সকালে আমি আর মিলন নীল হাউসের দোতলার কমনরুমে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম দূরে। দেখতাম কাঁটাতারের ওপারে সবুজ দিগন্ত ছাড়িয়ে দূরগামী রেললাইন ঝুমবৃষ্টিতে ভিজছে। অপূর্ব লাগতো সে-দৃশ্য।
চত্বরের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাগুলো ছিল আমাদের ধু-ধু মরুভূমির ভেতর মরূদ্যান। কলেজ ক্যাপ্টেন ফরহাদ ভাই ছিলেন ইংরেজি গানের সবার প্রিয় গায়ক। তিনি যখন চত্বর ছেড়ে চলে গেলেন তখন শেষ যে গানটি গেয়েছিলেন সেটি গেঁথে আছে কানে। গেয়েছিলেন, ‘লর্ড আই অ্যাম ওয়ান, লর্ড আই অ্যাম টু, লর্ড আই অ্যাম থ্রি, লর্ড আই অ্যাম ফোর, লর্ড আই অ্যাম ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস অ্যাওয়ে ফ্রম হোম। হান্ড্রেড মাইলস, হান্ড্রেড মাইলস, হান্ড্রেড মাইলস অ্যাওয়ে।’ ফরহাদ ভাই চলে গেলে চত্বরের ইংরেজি গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয় আমাদের ইফতি। বাড়ি থেকে গিটার নিয়ে আসে সে। সে গাইতো ক্লিফ রিচার্ডের গান, ‘ফল ইন লাভ, ফল ইন লাভ, ফল ইন লাভ উইথ ইউ।’ বাংলা গান গাইতেন আমাদের হাউসের চৌধুরী ভাই আর লাল হাউসের মাসুদ ভাই। চৌধুরী ভাইয়ের প্রিয় ছিল শচীন দেববর্মন, ‘দূর কোন পরবাসে তুমি চলে যাইবা, চলে যাইবা, চলে যাইবা, কবে আইবা রে।’ আর মাসুদ ভাই মঞ্চে এনেছিলেন সেসময়কার নতুন ধাঁচের গান, ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে।’ আমাদের আনন্দের রাত ছিল প্রতি শনিবার। সেদিন রাতের ডিনারে থাকতো বিরিয়ানি আর তারপর সাপ্তাহিক মুভির দিন। অডিটোরিয়ামে বসে আমরা দেখতাম নানা দেশের চলচ্চিত্র। রুশ ছবি ব্যালাড অব এ সোলজার আর ক্রেইনস আর ফ্লাইং গেঁথে আছে মনে। ব্যালাড অব এ সোলজারের সৈনিকটির সঙ্গে ট্রেনে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া সেই নিষ্পাপ চেহারার কিশোরীটির প্রেমে পড়েছি আমি আর মিলন। তিতাস একটি নদীর নাম দেখে লাইটস অফের পর মিলন গুনগুন করেছে, ‘লীলাবালি, লীলাবালি বড় যুবতী সই গো কি দিয়া সাজাইমু তরে।’ আমাদের খেলাধুলার প্রতিযোগিতায় ছিল উৎসবের আমেজে। নিয়মিত হতো আন্তঃহাউস ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। ছিল বিতর্ক, আবৃত্তি প্রতিযোগিতাও। আন্তঃহাউস এসব প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছিল আমাদের। প্রতিযোগিতার সময় আমাদের নিজ হাউসের সমর্থনে মাঠের চারপাশে নীল পতাকা উড়িয়ে চিৎকার করতাম আমরা। বাস্কেটবল মাঠের চারপাশে দাঁড়িয়ে চেঁচাতাম, ‘ব্যাক আপ ব্যাক আপ ব্লু হাউস।’ হাউস বাস্কেটবল দলে খেলতো ইফতি। চৌকস নৈপুণ্যে বল ড্রিবল করে বাস্কেট করতো ইফতি। বার্ষিক অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার দিন নতুন সাজে সেজে উঠতো চত্বর। দড়ির সঙ্গে বাঁধা লাল-নীল কাগজের পতাকা। মাঠে চুন দিয়ে তৈরি দৌড়ের ট্রাক। আমাদের সহপাঠী একই হাউসের পান্না ৪০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হতো বরাবর। তাকে কোলে নিয়ে বিজয়োল্লাস করতাম আমরা। অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার জুনিয়র আর সিনিয়র ভাগ হতো বয়স নয়, উচ্চতার ভিত্তিতে। ৫ ফুট ২ ইঞ্চির নিচে সবাই থাকতো জুনিয়র গ্র“পে আর এর ওপরের উচ্চতার সবাই সিনিয়র। আমাদের প্রথম রুম ক্যাপ্টেন সেই দুলাভাই ওরফে দুলাল ভাই যতদিন চত্বরে ছিলেন ততদিন জুনিয়র গ্র“পে শটপুট চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তিনি যখন নাইনে তখনও তিনি জুনিয়র গ্র“পে, এমনকি যখন ক্লাস টুয়েলভে তখনও তিনি জুনিয়র গ্র“পে কারণ তার উচ্চতা কোনোদিন পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির ওপরে ওঠেনি। এ ছিল আমাদের এক স্থায়ী হাসির খোরাক। যারা অন্য কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারতো না তারা নামতো গার্ডেনিং প্রতিযোগিতায়। শীতকালে বাগানে ফুল ফুটিয়ে পুরস্কার জিতে নিত তারা। বছর শেষে এই নানা রকম সব প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে একটি হাউসকে ঘোষণা দেওয়া হতো সার্বিক চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। সেই চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি পাওয়ার জন্য ছিল সবার জোর চেষ্টা। আমাদের নীল হাউস বেশ কয়েকবারই চ্যাম্পিয়ন হলো। আমরা সেই ট্রফি নিয়ে বিজয় মিছিল বের করলাম। এইসব নানা প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে হতো আমাদের দলে কাজ করার প্রশিক্ষণ। শুধু নিজের জন্য নয়, একটা হাউসের জন্য, একটা প্রতীকের জন্য কী করে লড়াই করতে হয় তার প্রশিক্ষণও হতো আমাদের। ব্যক্তি আর দলের এইসব মিথস্ক্রিয়ার সেই চত্বরে গড়ে উঠেছিল আমারদের পারস্পরিক বন্ধন, বন্ধুত্ব।

পনেরো
যাদের সঙ্গে ওই চত্বরে অবিরাম দিনরাত কাটিয়েছি তাদের সবার সঙ্গে কি বন্ধুত্ব হয়েছে?
আমরা গোটা পঞ্চাশেক নতুন বালক সে-বছর হাজির হয়েছিলাম ওই চত্বরে। তাদের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি, সম্ভবও ছিল না। চত্বরে আচরণ, চলাচলের কঠিন বিধিনিষেধের কারণে আমাদের পরস্পর মাখামাখির সুযোগ ছিল মূলত যারা আমরা ছিলাম এক হাউসে তাদের মধ্যে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে যারা কখনো না কখনো থেকেছি একই রুমে। অবিরাম পরস্পরের মুখোমুখি থাকতে থাকতে নিজেদের ভেতর যা গড়ে উঠতো সেটি সবসময় বন্ধুত্ব নয় হয়তো, হয়তো একধরনের নির্ভরশীলতা।  বস্তুত ওই বয়সটাতে আমরা সবাই যেমন অন্যের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে, তেমনি নিজের ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও বোঝাপড়ার চেষ্টা করছি। পরস্পরের ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছি। ফলে পুরো চত্বরের জীবনকালজুড়েই চলেছে নিজেদের ভেতর নানা মাত্রার টানাপড়েন। বন্যপ্রাণীরা যেমন একজোট হয়ে ঘোরে, আমরাও  একপাল জন্তুর মতো গায়ে-গায়ে মিশে ওই চত্বরে           দিন-রাত ঘুরেছি একত্রে। বাঘশিশুরা যেমন একে অন্যের সঙ্গে কপট মারামারি করে, খেলাচ্ছলে একে অন্যকে কামড়ে দিয়ে, আবার একে অন্যের সঙ্গে গা ঘষে ভবিষ্যৎ জীবনে শক্রকে মোকাবিলা করা কিংবা মিত্রের সঙ্গে আলিঙ্গন করার প্রশিক্ষণ নেয়, আমরাও ওই চত্বরে একে অন্যকে কখনো কপটভাবে কামড়ে দিয়ে, কখনোবা পালকে পালক ঘষে শক্রতা মিত্রতার মহড়া দিয়েছি। এর ভেতরই কারো-কারো সঙ্গে ঘটে যায় আত্মার যোগ। আমার যেমন ঘটেছিল মিলনের সঙ্গে। মিলন ছিল স্বল্পবাক। চারিদিকে কলরব করতে থাকা বালকদের মধ্যে থেকেও বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মৌন থাকতে পারতো সে। দলছুট থাকতো সে। কিন্তু তা নিয়ে কোনো অস্বস্তি ছিল না তার ভেতর। হঠাৎ-হঠাৎ দু-একটি বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলে চুপ হয়ে যেত সে। ওকে সবাই ডাকতো সক্রেটিস বলে। একবার আমাদের দীনিয়াত শিক্ষক মোবারক স্যারকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক জটিলতায় ফেলে দিয়েছিল মিলন। কোনো কোনো বেসামরিক শিক্ষক এই সামরিক আবহে থাকতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে ভাবতেন, তাদেরও বোধহয় অ্যাডজুট্যান্টের মতো অমন মিলিটারি ভঙ্গিতেই আমাদের শাসন করা উচিত। আমাদের দীনিয়াত শিক্ষক মোবারক স্যার ছিলেন তেমন একজন। তিনি সবসময় উগ্রমূর্তি নিয়ে থাকতেন ক্লাসে। তিনি প্রতি ক্লাসেই কারণে-অকারণে ছেলেদের নিল ডাউন করে রাখতেন। সুযোগ পেলে তিনিও সবাইকে দিতেন এক্সট্রা ড্রিল। মোবারক স্যার আরবি এবং ইসলামিক স্টাডিজ উভয় বিষয়ে  মাস্টার্স ছিলেন। তিনি নিজেকে সবসময় ডাবল মাস্টার্স বলে পরিচয় দিতেন। ধর্মবিষয়ক নানা যুক্তিবাদী আলাপ তুলতেন ক্লাসে। তিনি বলতেন, পৃথিবী এবং সূর্য উভয়েই যে মহাশূন্যে ঘোরে এ-বিষয়টির নানা প্রমাণ পবিত্র কোরানে আছে এবং তিনি এ-বিষয়ে গবেষণা করছেন। একদিন মিলন স্যারকে এক বেকায়দা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বসে, বলে ‘স্যার সৃষ্টিকর্তা কি এমন একটা পাথর তৈরি করতে পারবেন, যা তিনি নিজেই তুলতে পারবেন না? যদি না পারেন তাহলে তো প্রমাণ হবে যে তিনি সর্বশক্তিমান নন। আবার যদি পাথরটা তৈরিও করেন শর্ত অনুযায়ী তিনি তো তা তুলতে পারবেন না, তাহলেও তো প্রমাণ হবে যে তিনি সর্বশক্তিমান নন।’ মোবারক স্যার মিলনকে সারাটা ক্লাস নিল ডাউন করে রেখেছিলেন এবং সেই সঙ্গে তাকে একটা এক্সট্রা ড্রিলও দিয়েছিলেন।
মিলনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বিশেষভাবে তৈরি হয় ফুটবল খেলার মাঠে। এজন্য না যে আমরা দুজন ভালো ফুটবল খেলতাম, বরং উলটো এজন্য যে, আমরা কেউই ফুটবল ভালো খেলতাম না। চশমার কারণে সবরকম আউটডোর খেলাতেই আমার প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিন্তু আউটডোর খেলাধুলা আমাদের জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। ফলে আমি ফুটবল মাঠে ফরোয়ার্ডে খেলতাম না কখনই, খেলতাম ব্যাকে। বল নিয়ে ছোটাছুটি করতে হতো না, কখনো বল কাছাকাছি এলে লাথি মেরে সামনে না হয় মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়াই ছিল আমার কাজ। তখনও টোটাল ফুটবলের ধারণা চালু হয়নি মাঠে। ফরোয়ার্ড, ব্যাক, রাইট আউট, লেফট আউট – এসব পজিশনেই খেলতো সবাই। মিলনেরও ফুটবলে তেমন আগ্রহ ছিল না। গোলকিপার কেউ হতে চাইতো না বলে মিলন সাগ্রহে সেই দায়িত্বটা নিত। সবাই যখন মধ্যমাঠে বল নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে আমি তখন ব্যাক থেকে পিছিয়ে গোলপোস্টের কাছে গিয়ে মিলনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করতাম। মিলন একদিন বলে, ফুটবল মাঠে গোলকিপারের পজিশনটা বেশ অদ্ভুত। সে মাঠে আছে আবার ঠিক নেইও। মাঠের ভেতরে থেকেও সে একধরনের দর্শক। গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে পুরো খেলাটা সে চোখের সামনে দেখতে পায়। তারপর সে রহস্য করে বলে, ‘আমিও কিন্তু এই চত্বরে আছি ওই গোলকিপারের মতোই। তোদের সবার মধ্যে আছি আবার নাইও।’ আমার মনে হলো মিলন যেন আমার মনের কথাটিই বলেছে। আমিও ওর মতো মনে-মনে ওই চত্বরে ছিলাম আধা-উপস্থিত। ফলে তার সঙ্গে একটা নৈকট্য গড়ে ওঠে আমার। মাঝে-মাঝে অদ্ভুত ব্যাপারও করতো মিলন। একবার গেমসের সময় গেমস ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমাদের অবস্ট্রাকল কোর্সের ট্রেঞ্চের ভেতর গিয়ে শুয়ে ছিল সে। আমাকে সে পরে বলে, ‘এই চত্বরে এমন একটা জায়গা নেই যেখানে তুই কিছুক্ষণের জন্য হলেও সবার নজরের আড়ালে থাকতে পারবি। ওই ট্রেঞ্চে শুয়ে দারুণ লাগলো ভাবতে যে, এই চত্বরে আছি তবু কেউ আমাকে দেখছে না।’  তখনও টের পাইনি মিলন সামনে আরো এমন রহস্য, এমন গভীরতর প্রশ্নের জন্ম দেবে আমার ভেতর।

ষোলো
আমার হাতে খাকি চত্বরের যে-ছবি তাতে মিলন নেই। কিন্তু আর যারা আছে তাদের ভেতর থেকে কেবল সোবহান, ইফতি, রুমি, রাজীবের দিকেই চোখ যাচ্ছে কেন আমার?
হয়তো এজন্য যে, চত্বরে প্রথম দিন ওদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছিলাম আমি। ওরা আমার আত্মার বন্ধু ঠিক ছিল না কিন্তু বহুকাল আগের হাতের সেই উষ্ণতা হয়তো আমার হাতে লেগে আছে এখনও। ইফতিকে ডাকা হতো ‘ক্রিম’ বলে। সবার ধারণা হয়েছিল, প্রিন্সিপাল কথিত ‘ক্রিম অব দি সোসাইটির’ ক্রিম ভাব সবচেয়ে বেশি আছে তার ভেতরই। নেত্রকোনার সোবহানের নাম হয়েছিল ‘কুজ’। তার একটি ইতিবৃত্ত আছে। আমাদের রুম ক্যাপ্টেন দুলাল ভাই প্রথমদিন আমাদের বলেছিলেন, এই চত্বরের ম্যাজিক ওয়ার্ডগুলো শিখতে হবে আমাদের। বলেছিলেন, এ চত্বরে কাউকে কোনো প্রশ্ন করতে হলে কথার আগে বলতে হবে এক্সকিউজ মি, কিছু চাইতে হলে চাইবার শেষে বলতে হবে প্লিজ, কারো গায়ে ধাক্কা লাগলে বলতে হবে স্যরি। আমাদের তিনি এক্সকিউজ মি, স্যরি, প্লিজ ইত্যাদি জাদুশব্দ মন্ত্রের মতো আওড়াতে বলেছিলেন। সেই থেকে সোবহান যত্রতত্র শব্দগুলো ব্যবহার করতে থাকে। কোন শব্দটি কখন, বাক্যের কোন অংশে ব্যবহার করতে হবে তা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতো সে। প্রথমদিকে প্রতি ক্লাসে স্যার এসে নাম জিজ্ঞাসা করলে সে বলতো, ‘আই অ্যাম সোবহান, এক্সকুজ মি।’ ‘এক্সকিউজ’ না বলে সে বলতো ‘এক্সকুজ’। সেই থেকে ওর নাম হলো ‘এক্সকুজ’, সেটা সংক্ষিপ্ত হয়ে পরে দাঁড়ালো শুধুই ‘কুজ’। মনে আছে একবার প্যারেডের জন্য ফল ইন করে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। হাউস ক্যাপ্টেন তখনও আসেননি। আমাদের রুমের সবাই দাঁড়িয়েছি একেবারে পেছনের সারিতে। ইফতি আর সোবহান পাশাপাশি। হঠাৎ ইফতি খুব নিচু স্বরে বলতে লাগলো, ‘কুজজজজ।’ প্যারেডে ফল ইন অবস্থায় ডানে বাঁয়ে তাকানোর উপায় ছিল না আমাদের। যার-যার জায়গায় দাঁড়িয়ে হাসি চাপিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম আমরা। জিহ্বা দাঁতের সঙ্গে লাগিয়ে ইফতি অবিরাম বলতে থাকে ‘কুজজজজ।’  সোবহান ফল ইন অবস্থায় দাঁড়িয়েই হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে দেয় ইফতিকে। ইফতির ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়, হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। বলা বাহুল্য ওরা দুজনই এক্সট্রা ড্রিল পায়। এই চত্বরে নিজের একটি পরিসর তৈরি করতে নাভিশ্বাস উঠেছে সোবহানের। ওর গ্রাম্যতা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করতো অনেকেই। মনে আছে, সোবহান বাথরুম থেকে বের হলে ইফতি সবাইকে দেখাতো কীভাবে সোবহান বাথরুমের চার দেয়াল ভিজিয়েছে। তার ব্যাখ্যা ছিল, সোবহান যেহেতু সারাজীবন পুকুরে গোসল করেছে ফলে সে বাথরুমে শাওয়ারের নিচে এমনভাবে হাত-পা নাড়ে যেন পুকুরে সাঁতার কাটছে। সোবহানের  নেত্রকোনার উচ্চারণ নিয়ে সবাই ঠাট্টা করতো বলে একপর্যায়ে সে বাংলা বলাই ছেড়ে দেয়। সে আমাদের  সঙ্গে সবরকম কথাবার্তাই চালাতে থাকে ইংরেজিতে। নেত্রকোনার টানেই, ভুল ইংরেজিতে, বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে সে কথা বলতে থাকে অবিরাম। কেউ ওকে ক্ষেপালে সোবহান বলতো, ‘ইফ ইউ কাম টু মাই ভিলেজ তখন বুঝবা হোয়াট আই অ্যাম।’ সোবহান মেধাবী ছাত্র ছিল কিন্তু এই চত্বরের নানা কায়দা রপ্ত করতে এবং অন্যদের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে তাকে এতোটা তটস্থ থাকতে হতো যে পড়াশোনায় আর মনোযোগী হতে পারেনি সে। পরীক্ষায় বরাবরই খারাপ ফল হতো সোবহানের। পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা, বক্তৃতা এসব কিছুতে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে সোবহান শেষে ঠিক করে আমাদের মার্চপাস্টের ব্যান্ড দলের ব্যাগপাইপ বাজাবে সে। নেত্রকোনায় গ্রামে আড়বাঁশি বাজাতো সে। আমাদের একবার বাজিয়ে শুনিয়েছিল ‘আমায় এতো রাতে কেনে ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে।’ বংশীবাদক সোবহান এই চত্বরে তার পরিসর শেষে খুঁজে পেয়েছিল মার্চপাস্টের ব্যান্ডদলে। নেত্রকোনার এক বালক স্কটিশ ব্যাগপাইপ হাতে তারপর প্যারেড করতো খাকি চত্বরে।
চত্বরে আমার নাম হয়েছিল ‘চার চোখ’। আমার বালক মুখে ওই কালো চশমা যে আমাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে রাখে এবং আমার চশমা যে একটা আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে তাতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। ফলে আমার চশমাকেন্দ্রিক বিকল্প নাম হওয়াতে বিশেষ অবাক হইনি। চার চোখে চারপাশ দেখায় আনন্দ ছিল আমার। রাজীবের নাম ছিল ‘কসকো’। পারস্পরিক পর্যবেক্ষণের মাত্রা যে কতটা গভীর ছিল তার উদাহরণ রাজীবের নামটি। কসকো নামের স্বচ্ছ একটি সাবান বাজারে পাওয়া যেত যার গায়ে গ্রথিত করা থাকে ‘কসকো’ নামটি। রাজীব গোসলে যাওয়ার সময় নিয়মিত সোপ কেসে তার কসকো সাবানটি নিয়ে যেত। গোসল করার সময় আমরা ‘নেক্সট’ বলে বাথরুমে যাওয়ার পারস্পরিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতাম। যারা রাজীবের নেক্সটে বাথরুমে ঢুকতো তারা লক্ষ করলো মাস পেরিয়ে যায় তবু রাজীবের সাবানের গায়ে লেখা ‘কসকো’ কথাটি আর মোছে না। অতিহিসাবী রাজীব প্রতিবার সাবান ব্যবহার করতো খুবই সামান্য মাত্রায়। সেই থেকে তার নাম কসকো। চত্বরে খুব মেপে জীবনযাপন করেছে রাজীব। দলে থাকলেও নিজেরটুকু বুঝে নিয়েছে সবসময়ে। সতর্ক পদক্ষেপে শিক্ষকদের কাছে, অ্যাডজুট্যান্টের কাছে ভালো থাকতে তৎপর থেকেছে সে। পরীক্ষার ফলাফলে সে সবসময় ছিল ওপরের দিকে।
আমরা যখন সবাই প্যারেড গ্রাউন্ডে খাকি পরে দাঁড়িয়ে কিংবা যখন সবাই সাদা হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরে ছোটাছুটি করছি খেলার মাঠে তখন আমরা সব একই পালকের পাখি। আমরা তখন শ্রেণিহীন। কিন্তু কখনো-কখনো আমাদের পারস্পরিক ভেদাভেদ হয়ে উঠতো প্রকাশ্য। যেমন প্যারেন্টস ডেতে। প্যারেন্টস ডের দিন আমাদের মাঠে বিরাট প্যান্ডেল টানানো হতো। ওইদিন সবার  বাবা-মা দেখা করতে আসতেন তাদের ছেলেদের সঙ্গে। প্যান্ডেলে এসে বসতেন তারা। দেখা যেত কারো বাবা-মা আসছেন টয়োটা, ভক্সওয়াগন, ল্যান্ডরোভার গাড়িতে চড়ে, কেউ বা আসছেন বাস, স্কুটারে চেপে। কারো বাড়ি থেকে আসতো প্যাস্ট্রি, নেসেসতার হালুয়া, কারো বাড়ি থেকে চিতই পিঠা, নারকেলের নাড়–। আমার বাবা-মা থাকতেন অনেক দূরের মফস্বল শহরে, ওইদিন আসতে পারতেন না তারা। আমার বাবা-মা সেখানে উপস্থিত থাকতেন না বলে ওইদিন প্যান্ডেলে ঘুরে-ঘুরে আমি পেঁচার চোখ নিয়ে       নতুন-নতুন মুখ দেখে বেড়াতাম শুধু। খাকি আর সাদার বাইরে ওই চত্বরে সেদিন লাগতো নানা রঙের উৎসব, কারণ পরিবারের লোকজন নানা রঙের পোশাক পরে আসতেন। ওই ধূসর চত্বরে রঙের সেই বৈচিত্র্য ছিল আমাদের জন্য এক বড় দৃষ্টিসুখ। তবে ওই পোশাকের বৈচিত্র্যেও ঘটত শ্রেণিভেদের প্রদর্শনী। অনেকের মায়ের গায়ে থাকতো মূল্যবান শাড়ি, দামি অলঙ্কার, অনেকের মা আসতেন নিতান্তই সাদামাটা বেশে। এই চত্বরে অনেক সামরিককর্তার ছেলেও পড়তো। প্যান্ডেল ঘুরতে-ঘুরতে দেখতাম প্রিন্সিপাল, অ্যাডজুট্যান্ট সেই সামরিক অভিভাবকদের সঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে কথা বলছেন। কারো কারো অভিভাবক আবার নগ্ন করে তুলতেন এই শ্রেণি-তারতম্যকে। মনে আছে নেত্রকোনার সোবহানের বাবা প্যারেন্টস ডেতে আসতেন লুঙ্গি পরে। একদিন শুনেছিলাম ইফতির আমলা বাবা ইফতিকে বলছেন, ‘তোদের এখানে লুঙ্গি পরা লোকের ছেলেরাও পড়তে আসে নাকি?’ ফলে এই চত্বরে আমাদের কেটে, ছেঁটে যতই একই ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করা হোক না কেন, এই খাকি পৃথিবীতে যতই সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হোক না কেন, প্যারেন্টস ডের দিন এই খাকি পৃথিবীর বাইরের যে বৃহত্তর পৃথিবী, সত্যিকার পৃথিবী, সেই পৃথিবীর ভেদ, বৈষম্য এসে হানা দিতো আমাদের ঘেরাটোপে। অবশ্য ওইদিনটা পেরিয়ে গেলেই আমরা আবার ফিরে যেতাম আমাদের সর্বজনীন খাকিজীবনে। আমাদের প্যারেন্টস ডের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিলো রুমির ধনাঢ্য বাবা-মায়ের আনা অঢেল সুস্বাদু খাবার। প্যারেন্টস ডের রাতে হাউসের সব সহপাঠী মিলে আমরা খেতাম রুমির বাবা-মায়ের আনা প্রচুর রকমারি খাবার।

সতেরো
খাকি চত্বরের ছবিটিতে রুমিই একমাত্র খাকিবিহীন কেন?
সে-কথা বলবো যথাসময়ে। কিন্তু কথা এই যে, রুমি ছিল রাজীবের একেবারে বিপরীত। বেহিসেবি, ঝুঁকিপ্রবণ। নিয়মভাঙার খেলায় তৎপর। শিক্ষকদের বেকায়দায় ফেলতে ছিল তার গভীর আগ্রহ। মনে পড়ে বায়োলজির সরল সেই আকমল স্যারকে নিয়ে তার কাণ্ড। একদিন  ল্যাবরেটরিতে আমরা ব্যাঙের ব্যবচ্ছেদ করছি। আকমল স্যার ক্লাসে এসে চেয়ারের ওপর তার কোটটা ঝুলিয়ে রেখে কী কারণে যেন স্টাফরুমে গেলেন। রুমি এই ফাঁকে আকমল স্যারের ঝুলিয়ে রাখা কোটের নিচের দুই পকেটে দুটো জ্যান্ত ব্যাঙ ঢুকিয়ে বোতাম লাগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর এসে কোটটা গায়ে দিয়ে আকমল স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে ব্যাঙের প্রজননতন্ত্রের ছবি আঁকতে থাকেন। আমরা  আমাদের ডেস্কে বসে দূর থেকে তার কোটের পকেটে ব্যাঙের মৃদু নড়াচড়া দেখতে পাই। আমাদের পেট উগরে উঠে আসা হাসিকে চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। একপর্যায়ে কিছু একটা বের করার জন্য তিনি তার কোটের পকেটে হাত দিয়েই ‘এ্যাই এ্যাই, এটা কী? এটা কী?’  বলে চিৎকার করে ওঠেন। তার হাত থেকে চক-ডাস্টার এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সব হেসে উঠি হো-হো করে। তিনি কোটটা আবার খুলে চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখেন এবং বলেন, কোটের পকেট থেকে ব্যাঙগুলোকে বের করে আমরা যেন কোটটা তাকে আবার ফেরত দিয়ে আসি।
আমাদের বদরাগী অঙ্কের শিক্ষক আকবর স্যারকেও কাবু করেছিল রুমি। তিনি ছিলেন দীনিয়াত স্যারের মতো সামরিক ভাব নেওয়া বেসামরিক শিক্ষক। ছেলেদের প্রচুর শাস্তি দিতেন তিনি, এক্সট্রা ড্রিলও দিতেন। তিনি প্রিন্সিপালের খুব ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ছেলেরা তার নাম দিয়েছিল ‘ভেড়া’। ভেড়ার সঙ্গে যোগসূত্রটা অবশ্য অদ্ভুত। তিনি বিভিন্ন সময় বলতেন, তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে অঙ্কের ওপর বিশেষ কী এক কোর্স করেছেন। ছেলেরা বের  করে যে, অস্ট্রেলিয়ায় খুব ভেড়া পওয়া যায়। সেই থেকে তার নাম হলো ‘ভেড়া স্যার’। ক্লাসে ঘুমানোর জন্য রুমিকে একবার এক্সট্রা ড্রিল দিয়েছিলেন ভেড়া স্যার। ওই বালক বয়সে অমন ভোররাতে উঠে রীতিমতো একজন সৈনিকের সব প্রশিক্ষণের ভার আমাদের শরীর নিতে পারতো না। ফলে ক্লাসে গিয়ে শুধু ঘুম পেত আমাদের। আমরা প্রায়শই ক্লাসে ঢুলতে-ঢুলতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ক্লাসে ঘুম তাড়ানো ছিল আমাদের একটা প্রধান সংগ্রাম। রুমি ক্লাসে ঘুমানোর ব্যাপারে খ্যাতি অর্জন করেছিল। একদিন আকবর স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে একটি অঙ্ক লিখতে-লিখতে বোর্ডের দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘রুমি বোর্ডে এসে অঙ্কটা সলভ করো তো?’ রুমি ধড়মড়িয়ে ডেস্ক থেকে উঠে বলে – ‘না স্যার, আমি তো ঘুমাই না।’ আকবর স্যার রুমিকে এক্সট্রা ড্রিল দিয়েছিলেন সেদিন। রুমি অবশ্য পরে ঘুম বিষয়ে অভিনব তত্ত্ব দিয়েছিল। রুমি বলতো, সে নাকি চোখ খুলে ঘুমানোর কায়দা রপ্ত করেছে। বলতো, ক্লাসে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে বলে স্যার এখন তাকে বেশ মনোযোগী মনে করলেও আসলে সে তখন চোখ খুলে ঘুমাচ্ছে।
তো এই কড়া ভেড়া স্যারকে বোকা বানিয়েছিল রুমি একদিন। সেবার আমরা সবে কেমিস্ট্রি ক্লাসে নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করতে শিখেছি। আমরা ফেরাস সালফাইড এবং হাইড্রোক্লোরিক এসিডের বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন সালফাইড নামে যে রাসায়নিক গ্যাসটি তৈরি করতে শিখেছি দেখেছি তাতে আছে পচা ডিমের এক বাজে দুর্গন্ধ। রুমি আকবর স্যারের ক্লাস শুরু হওয়ার আগে একটি টেস্টটিউবে ফেরাস সালফাইড এবং হাইড্রোক্লোরিক এসিড ভরে ক্লাসের লেকচার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেয়। স্যার ক্লাসে ঢোকার কিছুক্ষণ পর থেকে  হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস তৈরি হয়ে তার দুর্গন্ধ ক্লাসরুমে ছড়িয়ে পড়ে। স্যার বলেন, ‘চারিদিকে খুব বাজে গন্ধ পাচ্ছি, ব্যাপার কী?’ আমরা সবাই বলি, ‘জ্বি স্যার, সম্ভবত পাশের ল্যাবরেটরিতে গ্যাস তৈরি করা হচ্ছে।’ তিনি আমাদের একজনকে পাঠান ব্যাপারটা দেখতে। সে ঘুরে এসে বলে, ‘হ্যাঁ স্যার জরুরি ভিত্তিতে কিছু হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরি করা হচ্ছে। আরো ঘণ্টাখানেক চলবে স্যার।’ আকবর স্যার কেমিস্ট্রির কিছু বুঝতেন না, তিনি বললেন, ‘এভাবে তো ক্লাস করা যাবে না। যাও আজকে তোমরা লাইব্রেরিতে গিয়ে সেলফ স্টাডি করো।’ আকবর স্যারের ক্লাস বাতিলের সাফল্যে সেদিন রুমি সবাইকে ক্যান্টিনে চমচম খাইয়েছিল।
ঐতিহাসিকভাবে এইসব খাকি চত্বরের প্রথম দিককার প্রিন্সিপাল সবাই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ বিলাতি মানুষ। পরে মূলত এদেশের বেসামরিক শিক্ষকরাই অধ্যক্ষ হয়েছেন। কখনো-কখনো সেনাকর্তারাও প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা যাকে সর্বাধিক সময় আমাদের প্রিন্সিপাল হিসেবে পেয়েছিলাম তিনি ছিলেন বেসামরিক মানুষ, ইংরেজির শিক্ষক। প্রশাসনিক দায়িত্বে ব্যস্ত থাকলেও তিনি আমাদের ইংরেজি ক্লাসও নিতেন মাঝে মাঝে। আমাদের সিলেবাসে ‘মিসেস প্যাকলেটাইড টাইগার‘ বলে একটি গল্প ছিল। সাকী ছদ্মনামের এক লেখকের গল্প সেটি। এক ব্রিটিশ মহিলার ভারতে একটি বাঘ শিকারের সাধ নিয়ে লেখা এই গল্পটি বেশ রসিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে পড়াতেন তিনি। কিন্তু ওই একটি গল্পই তিনি পড়িয়েছেন সারাটা বছর। সেই থেকে তার নাম হয়েছিল মিসেস প্যাকলেটাইড। পরবর্তীকালে সেটি সংক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়ায় প্যাকি। আমরা বরাবর প্রিন্সিপালকে প্যাকি বলেই ডাকতাম। প্রবল সামরিক আবহের ভেতর একজন বেসামরিক মানুষ হিসেবে চত্বরের ব্যবস্থাপনা চালাতে তাকে বেশ বেগই পেতে হতো। প্রচলিত ছিল, অ্যাডজুট্যান্ট মেজর পারভেজ, অঙ্কের আকবর স্যার এবং দীনিয়াতের মোবারক স্যারই নানারকম বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে প্রিন্সিপালকে চালাতেন। মনে আছে রুমি একবার প্রেপ টাইমে বোর্ডে একটা ছবি আঁকে। চারটি মাথা আঁকে সে, একটি মাঝখানে আর তাকে ঘিরে বাকি তিনটি মাথা। তার স্কেচের হাত বিশেষ ভালো ছিল না। রুমি লেবেল দিয়ে দেখায়  মাঝখানের জন প্রিন্সিপাল এবং বাকি তিনজনের একজন অ্যাডজুট্যান্ট পারভেজ, একজন আকবর স্যার আর অন্যজন মোবারক স্যার। এরপর মাঝখানের প্রিন্সিপালের মাথার সঙ্গে বিভিন্ন রকম রেখার মাধ্যমে বাকি তিনজনকে যুক্ত করে রুমি। আমরা দেখতে পাই অ্যাডজুট্যান্টের মাথার সঙ্গে প্রিন্সিপালের মাথাকে যুক্ত করা হয়েছে একটি মোটা দাগ দিয়ে, আকবর স্যারের মাথার সঙ্গে একটি চিকন দাগ দিয়ে এবং মোবারক স্যারের মাথার সঙ্গে একটি পেঁচানো দাগ দিয়ে। রুমি ব্যাখ্যা দেয় তার চিত্রকর্মের। বলে অ্যাডজুট্যান্টের ওই মোটা দাগ বোঝাচ্ছে তিনি প্রিন্সিপালকে সব মোটা বুদ্ধি দিয়ে থাকেন। তার মতে, সেনাবাহিনীর মানুষদের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। আকবর স্যারের চিকন দাগের অর্থ হচ্ছে, যত সব সূক্ষ্ম বুদ্ধি তা আসে আকবর স্যারের কাছ থেকে। আর মোবারক স্যারের প্যাঁচানো দাগ বোঝাচ্ছে জিলাপির প্যাঁচ জাতীয় বুদ্ধিগুলো আসে মোবারক স্যারের কাছ থেকেই।

আঠারো
কিন্তু চত্বরে অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকও তো ছিলেন আমাদের?
তা ছিলেন। কৌতূহলোদ্দীপক ভঙ্গিতে আমাদের ইতিহাস পড়াতেন রব স্যার। ইতিহাসের কঠিন কঠিন তথ্যগুলো মনে রাখার মজাদার সূত্র দিতেন তিনি। মনে আছে বলেছিলেন, ‘ব্যারাকে ঝাঁকা দিলো মিলী’ এই বাক্যটি মনে রাখলেই মনে থাকবে এই উপমহাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা যুদ্ধের স্থানগুলো। এই বাক্যের ভেতর লুকিয়ে আছে ব্যারাকপুর, ঝাঁসী, কানপুর, দিল্লি, মীরাট, বেরিলীর নাম। আমাদের ভূগোল শিক্ষক হাফিজ স্যার ভূগোল পড়াতে গিয়ে তুলতেন ক্রিকেটের কথা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের কথা আলাপ করতে-করতে বলতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোথায়, কোন কোন দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই অঞ্চল। ক্রিকেটের গল্প শুনতে-শুনতে আমাদের জানা হয়ে যেত ভূগোল। নীতিবান শিক্ষক ছিলেন ফিজিক্সের হক স্যার। হক স্যারকে কাবু করার কোনো উপায় ছিল না। হক স্যারের একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি প্রায়ই সাধু ভাষায় কথা বলতেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের কসকো, হিসাবী ভালো ছাত্র রাজীব সব স্যারকে খুব তোয়াজ করে চলতো। সুযোগ পেলেই স্যারদের কাছে নানা রকম প্রশ্ন নিয়ে যেত এবং সেই সুযোগে স্যারদের আমরা যাকে বলতাম খানিকটা ‘তেল‘ দিয়ে আসতো। কিন্তু হক স্যারের সঙ্গে সেটা পারতো না সে। হক স্যার কোনো তেল, তোয়াজের ধার ধারতেন না। মনে আছে একবার বার্ষিক পরীক্ষার আগে আমি আর রাজীব করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা হলো হক স্যারের সঙ্গে। সুযোগ পেয়ে রাজীব বলে, ‘স্যার দোয়া করবেন পরীক্ষার জন্য।’ স্যার তখন বলেন, ‘দোয়া হইল আঠার মতো, পরিশ্রম করিলে উহা লাগে, না করিলে লাগে না।’ রুমি চেষ্টা করেও বেকায়দায় ফেলতে পারেনি হক স্যারকে। একদিন ফিজিক্স প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে রুমি পাশের ছাত্রের সঙ্গে কথা বলছিলো বলে হক স্যার ওকে ল্যাবরেটরির এ কোনায় একটি টুলে বসতে বলেন। আমরা যখন জোড়ায় জোড়ায় বসে ল্যাবরেটরি টেস্ট করছি রুমিকে তখন একা এক কোনায় বসে কাজ করতে হচ্ছিল। রুমি ফন্দি করার চেষ্টা করছিল কী করে টুলটা বদল করা যায়। তখন শীতকাল। আমরা সবাই খাকি জাম্পার পরে আছি। একসময় বেশ কড়া রোদ ওঠে বাইরে। জানালা গলে সেই রোদ পড়ে ল্যাবরেটরিতে। রুমির টুলটি ছিল একেবারে জানালার পাশে। রোদ জানালার পাশে বসা রুমির বুক বরাবর। মওকা পেয়ে রুমি বলে, ‘স্যার, এইখানে খুব রোদ, গরম লাগছে। এখানে বসা যাচ্ছে না।’ হক স্যার বলেন, ‘জায়গা বদলের প্রয়োজন নাই, জাম্পার খুলিয়া বসো।’ বিরক্ত হয়ে জাম্পার খোলে রুমি। কিছুক্ষণ পর রোদ তার কান অবধি পৌঁছায়। রুমি বলে, ‘স্যার কান গরম হয়ে যাচ্ছে, এখানে বসতে পাচ্ছি না।’ হক স্যার বলেন, ‘জাম্পার খুলিয়াছো, কান তো খুলিতে পারিবে না। উহাকে উত্তপ্ত হইতে দাও।’ একদিন প্রেপ টাইমে সবুজ হাউসের হাবীব ফিজিক্স বইয়ের নিচে আগাধা ক্রিস্টির বই রেখে পড়ছিল। হক স্যার ধরে ফেলেন হাবীবকে। স্যার বইটা উলটেপালটে বলেন, ‘এই লেখকের বই পড়িয়া তো মগজ নষ্ট হইবে। উহার নাম আগাধা ক্রিস্টি না হইয়া হওয়া উচিত ছিল আগাছা সৃষ্টি।’ হক স্যার কোনোদিন শাস্তি দিতেন না আমাদের কিন্তু আমরা তাকে ভয় পেতাম খুব। তিনি সততার কথা বলতেন, ন্যায়ের কথা বলতেন। মিতব্যয়িতার কথা বলতেন। চত্বর কর্তৃপক্ষ আমাদের বিনা পয়সায় খাতা, পেনসিল, কালি সরবরাহ করতো। কিন্তু আবেদন করতে হতো সেজন্য। সেই আবেদন পরীক্ষার দায়িত্বে ছিলেন হক স্যার। পেনসিল ছোট হতে-হতে লেখার অযোগ্য হয়েছে কিনা, খাতার সবকটি পাতার যথাযথ ব্যবহার হয়েছে কিনা, কালির দোয়াত সবটুকু শেষ হয়েছে কিনা তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরখ করে তিনি আবেদন অনুমোদন করতেন। বলতেন, দেশের টাকায় কেনা এইসব, দায়িত্ব নিয়ে ব্যবহার করবে। নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠার কথা বলতেন তিনি বরাবর। কিন্তু শিক্ষক বিষয়ক আমাদের যাবতীয় অভিজ্ঞতার বিস্ফোরণ ঘটে বাংলার শিক্ষক শফিক স্যার চত্বরে আসার পর। কিন্তু তাকে আমরা পাই চত্বরের শেষ দিনগুলোতে, অল্প সময়ের জন্য।

উনিশ
ইতিমধ্যে চত্বরে আমাদের বিস্ময়গুলো একটু-একটু করে কেটে গেছে নিশ্চয়ই?
তা গেছে। চত্বরে আমরা একটু-একটু করে সেয়ানা হয়ে উঠেছি। পেরিয়ে গেছি একের পর এক বছর। আমাদের কাঁধের অ্যাপুলেটসে এক-এক করে বেড়েছে স্ট্রাইপের সংখ্যা। ততদিনে আমাদের পায়ের নিচে কিছুটা মাটি পেয়েছি। কেটে গেছে প্রাথমিক দ্বিধা, শঙ্কা, ভয়। খাকির সঙ্গে, বুটের সঙ্গে, বেল্টের সঙ্গে সখ্য হয়েছে আমাদের। দেমাগও তৈরি হয়েছে। আমাদের নিচে তখন আরো অনেক  ক্লাস। আমরা তখন আর শুধু ওপরেই তাকাই না, নিচে তাকানোরও সুযোগ পাই। শুধু আদেশ পালন করি না, আদেশ দিইও। এসময়ই আমাদের ভেতর চত্বরের গুরুতর নিয়ম ভাঙার প্রবণতাগুলোও এক-এক করে মাথাচাড়া দিতে থাকে।
চত্বরের নিয়ম ভাঙার ব্যাপারগুলো ঘটতো সব দলবেঁধে। অপরাধ দলবেঁধে করলে তার ভারটা কমে আসে। একটা অপরাধের ওজন যদি হয় ১০০ কেজি আর কেউ যদি একাই সেটি করে তাহলে তাকে ওই ১০০ কেজি ভারই বহন করতে হয়। অথচ যদি ১০ জনে মিলে করে তাহলে একজনের ভাগে পড়ে মাত্র ১০ কেজি। সেই অপরাধতত্ত্ব মোতাবেক চত্বরের দৃষ্টিতে যা গুরু অপরাধ সেগুলো সংঘটিত হতে থাকে আমাদের ক্লাসে। আমিও দু-একটিতে অংশ নিই। যেমন আমার সিগারেটে অভিষেক হয় ওই চত্বরেই। সেই বালক বয়সে সবার দ্রুত পুরুষ হয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা তখন। সিগারেট খাওয়া পুরুষত্বের বড় লক্ষণ হয়ে দেখা দিয়েছে তখন আমাদের মধ্যে। ইফতি তো গান গাইতো ‘সিগারেট ইন মাই হ্যান্ড, আই লুক লাইক এ ম্যান’। ক্লাস টেনে উঠে যখন আমাদের এক রুমে একই ক্লাসের সকলে থাকার সুযোগ মিললো তখনই মূলত এসব গুরুতর নিয়মভঙ্গের সাহস জন্ম নিতে লাগলো আমাদের। বরাবরের মতো রুমি ছিল আমাদের এসব অপরাধ অভিযানের নেতা। সিগারেটের আসরের আয়োজন করে সে। আমাদের চত্বরে সিগারেট পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। আনতে হতো বাইরে থেকে। আমাদের নাগালের মধ্যে যার চত্বরের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আছে তিনি আমাদের হাউস বেয়ারা জাকির ভাই। তিনি এই চত্বরের দুর্বল, ক্ষমতাহীন দলেরই একজন। অল্প বেতনের ছোটখাটো চাকুরে। আমরাও ওই চত্বরে ক্ষমতাহীন, দুর্বল একটি গোষ্ঠী, ফলে আমাদের মধ্যে একটি সহমর্মিতা ছিল বলা চলে। আমরা নির্ভয়ে আমাদের হাউস বেয়ারা জাকির ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতে পারতাম। এই জাকির ভাইয়ের মাধ্যমেই রুমি বাইরে থেকে সিগারেট আনায়। তাছাড়া বড়লোক ব্যবসায়ী বাবার ছেলে রুমির পকেটে থাকতো টাকা। জাকির ভাইয়ের আরো প্রণোদনা ছিল রুমির প্রতিশ্র“ত বখশিশ। জাকির ভাই তাই এক প্যাকেট স্টার সিগারেট এনে দিয়েছিলেন আমাদের। চত্বরের আশপাশে শুধু ওই এক ব্র্যান্ডের সিগারেটই পাওয়া যেত তখন।
আমাদের এইসব নিয়ম ভাঙার অভিযান চলতো লাইটস অফের পর যখন চত্বরে নেমে আসে অন্ধকার। আর অন্ধকারেই তো মাঠে নামে শ্বাপদেরা। আমাদের সিগারেটের ওই অভিষেক হলো এক শীতের রাতে। আমি চার চোখ, বোতল রুমি, ক্রিম ইফতি, সক্রেটিস  মিলন, ‘কুজ’ সোবহান। লাইটস অফের পর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম আমরা কিছুক্ষণ। আমাদের চত্বরের ওই কম্বলগুলো ছিল অদ্ভুত। মোটা, রোয়া ওঠা। শীত এলেই এই কম্বলগুলো হাজির হতো আমাদের চত্বরে। আমাদের মনে হতো একমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া কোনো স্বাভাবিক মানুষের ওই কম্বল ব্যবহার করা উচিত নয়।  চত্বর থেকে বেরোনার বহু বছর পরও আমরা নিজেদের মধ্যে দেখা হলে ওই কম্বলের কথা তুলতাম। আমাদের এক বন্ধু বলে, ‘ওই কম্বলগুলো হইলো বউয়ের মতো। ওইগুলি গায়ে দিলে কুটকুট করে, না দিলে ঠান্ডা লাগে। বউ ব্যাপারটাও এই রকমই।’ আমরা লাইটস অফের পর যার-যার বিছানায় সেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি। বোতল অন্ধকারে ফিসফিস করে বলে – ‘হাসান ভাই গেছে?’ সক্রেটিস বলে – ‘না।’ আমরা আমাদের তৎকালীন হাউস ক্যাপ্টেন হাসান ভাইয়ের বিখ্যাত জুতার আওয়াজের জন্য অপেক্ষা করি। হাসান ভাই লাইটস অফের পর তার জুতার ওই বিখ্যাত আওয়াজ তুলে সব রুম ইনস্পেকশন করে তারপর তার রুমে যেতেন। কিছুক্ষণ পর হাসান ভাইয়ের জুতার শব্দ পাই। সেটা একসময় মিলিয়েও যায়। এসময় আবার দূরে হুইসেল বেজে ওঠে। ‘কুজ’ বলে, ‘মনে হয় ওস্তাদ শরীফ।’ ক্রিম বলে – ‘বেটা শরীফ এখনও কী করে?’ মাঝে মাঝে হাবিলদার মেজর শরীফ রাতে হুইসেল বাজাতে বাজাতে তার নিজের কোয়ার্টারে ফিরতেন। আমাদের একটু ভয় পাওয়াতে চাইতেন হয়তো কিংবা হুইসেল বাজিয়ে তিনি হয়তো তার নিজের একঘেয়েমি কাটাতেন। আমরা অন্ধকার রুমে ফিসফিস করে কথা বলতে থাকি। কিছুক্ষণ পর প্রিন্সিপালের গাড়ির আওয়াজ শুনি। ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়েছিলেন বোধহয়, বাড়ি ফিরছেন। ধীরে-ধীরে নিঝুম হয়ে যেতে থাকে ক্যাম্পাস। আমরা আরো কিছুক্ষণ সময় নিই। চারিদিক আরো নীরব হয়ে এলে আমরা সন্তর্পণে কম্বল সরিয়ে  বিছানা থেকে উঠি। ‘বোতল’ তার ওয়াড্রবের পাল্লা দুটি খুলে সেটার চারপাশে তার এবং আমার কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়। কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা দুই পাল্লার মাঝখানে একটি গুহার মতো তৈরি হয়। সেটিই আমাদের সিগারেট খাওয়ার গোপন জায়গা। যাতে বাইরে থেকে সিগারেটের আলো কোনোভাবে দেখা না যায় সেজন্য এ ব্যবস্থা। এসবই ‘বোতলের’ বুদ্ধি। আমরা অন্ধকারে প্রেতের মতো সাবধানে কম্বল দিয়ে তৈরি আমাদের সেই গুহায় ঢুকি। একজন যখন গুহার ভেতর থাকে বাকিরা আমরা বাইরে থেকে নিশ্চিত করি কোনোরকম আলো দেখা যাচ্ছে কিনা, কারো পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কিনা। আমি সিগারেটে টান দিয়ে বেশ কেশে ছিলাম মনে আছে। সবাই আমার মুখ চেপে ধরে। মনে আছে মুখটা খুব বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল। এই সিগারেট রোমাঞ্চ রুমি চালু রেখেছিল। সক্রেটিসও ভাগ বসাতো তাতে। আমি আর যোগ দিইনি, কাজটার উত্তেজনা উপভোগ করলেও সিগারেট ব্যাপারটি আর উপভোগ করছিলাম না। আমাদের চত্বরের আশপাশে ভালো ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যেত না বলে রুমি অভিনব কায়দায় ছুটি থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিল মার্লবোরো সিগারেট। ছুটি থেকে চত্বরে ফেরার সময় আমাদের প্রত্যেকের ট্রাঙ্ক, সুটকেস চেক করা হতো। সেসময় এটি দেবের ডিকশনারি বলে একটি ঢাউস ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারি পাওয়া যেত। রুমি সেই ডিকশনারির পাতাগুলো মাঝখান থেকে কেটে কৌশলে সেখানে একটি গহবর তৈরি করে নিয়েছিল এবং সে গহ্বরে বেশ অনায়াসে গোটা দুই মার্লবোরো সিগারেটের প্যাকেট ঢুকে যেতো। ফলে মনোযোগী ছাত্রের বিদ্যার্জনের ভাবের আড়ালে রুমে চালান হয়ে যেত প্রয়োজনীয় রসদ। শেষে একদিন নামাজে না গিয়ে চুরি করে হাউসে মার্লবোরোতে সুখটান দিতে গিয়ে হাবিলদারের কাছে ধরা পড়ে রুমি। রুমির বাবা-মাকে ডেকে আনা হয় এবং তাকে লিখিত ওয়ার্নিং দেওয়া হয় যে পরবর্তীকালে  আর কোনো গুরু অপরাধে ধরা পড়লে তাকে চত্বর থেকে বহিষ্কার করা হবে। রুমি তাতে কিছুটা নিবৃত্ত হলেও নব-নব অভিযানের আগ্রহ তার কমেনি কখনই।
সিগারেটের অভিষেক ছিল আমাদের শীতকালের অভিযান। গ্রীষ্মকালের অভিযান ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। আমাদের ওই চত্বরে ছিল বেশ কিছু  কাঁঠাল গাছ। গ্রীষ্মকালে কাঁঠালে ভরে উঠতো গাছগুলো। আমাদের চোখ পড়তো ওই কাঁঠালগুলোতে। কাঁঠাল চুরি ছিল গ্রীষ্মকালের অভিযান। এই অভিযানও হতো রাতেই, লাইটস অফের পর। এই অভিযান ছিল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এতে যেতে হতো হাউসের বাইরে। ইলেভেন, টুয়েলভের উঁচু ক্লাসে উঠেই ওই অভিযানের সাহস তৈরি হয়েছিল আমাদের। গ্রামের ছেলে সোবহান হাউসে নানাভাবে কোণঠাসা হয়ে থাকতো। কিন্তু ওই কাঁঠাল চুরির অভিযানে সে হয়ে উঠতো নেতা। কাঁঠাল পাড়া বিষয়ে তার মত, জ্ঞান এবং দক্ষতা আর কারোই ছিল না বলা বাহুল্য। আমরা তার কাছেই জানতে পারি ভারি কাঁঠাল দ্রুত গাছ থেকে পাড়ার কৌশল। সোবহান আমাদের জানায়, কাঁঠালটিকে নিচ থেকে ধরে খানিকটা উঁচু করে হঠাৎ ছেড়ে দিলে সেটি তার নিজের ভারেই টুপ করে গাছ থেকে খসে পড়ে। বলা বাহুল্য এসব কৌশলের বর্ণনা সোবহান কিন্তু ইংরেজিতেই দিয়েছিল তাতে যত ভুলই থাকুক না কেন। একবার আমাদের চত্বরের সবচেয়ে বড় কাঁঠালটি ধরেছিল ডাইনিং হলের সামনের একটি গাছে। ওই কাঁঠালটির দিকে নজর ছিল সব হাউসের উঁচু ক্লাসের ছাত্রদেরই। আমরা ঠিক করেছিলাম অন্য যে কারো দখলে যাবার আগে ওই কাঁঠাল আমাদের হাউসে আনতে হবে। কিন্তু অন্য গাছগুলো আমাদের হাউসের পেছনের নানা আড়ালে আবডালে হলেও ওই বড় কাঁঠালের গাছটি ছিল ডাইনিংয়ের মতো জনসমক্ষে। ফলে ওখান থেকে চুরি করা ছিল বেশ ঝুঁকিপুর্ণ। এক ঘোর ঝড়-বৃষ্টির রাতকে আমরা বেছে নিই কাঁঠালটি চুরি করার জন্য। কারণ আমরা বুঝেছিলাম বৃষ্টি আমাদের একটা বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। অন্ধকার এবং বৃষ্টির ভেতর হাউসের বাইরে গেলে কারো দৃষ্টিতে পড়ার সম্ভাবনা ছিল কম। লাইটস আউটের পর সোবহানের নেতৃত্বে  তুমুল এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে খালি গায়ে আমরা দৌড়ে যাই গাছটির কাছে। আমি ছিলাম, রুমি ছিল, আরো কেউ কেউ ছিল যাদের মনে করতে পাচ্ছি না। আমার চশমার কাঁচে বৃষ্টির ছাঁট লেগে আমি প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবু উত্তেজনায় সঙ্গী হয়েছিলাম ওদের। সোবহান গাছে উঠে তার বিজ্ঞ কৌশলে কাঁঠালটিকে পাড়ে  গাছ থেকে আর রুমি সেটিকে কোলে নিয়ে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে দৌড় দেয়। আমরা এক দৌড়ে হাউসে ফিরে এলেও রুমি ভারি কাঁঠাল নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে কাদায় পিছলে যায়। এ সময় ঘন বৃষ্টির ভেতর আমরা চত্বরের মূল ফটকের দিক থেকে আসা একটা গাড়ির হেডলাইট দেখতে পাই। আমরা টের পাই সেটা প্রিন্সিপালের গাড়ি। রুমি কাঁঠালটা কোলে নিয়ে প্রাণপণে আবার দৌড় দেয়। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। দৌড়ে রুমি হাউসে চলে আসতে পারলেও আমাদের আশঙ্কা হয় প্রিন্সিপাল সম্ভবত তার হেডলাউটের আলোয় বৃষ্টিতে দৌড়ে যাওয়া রুমিকে দেখে ফেলেছেন। আমাদের মনে হতে থাকে প্রিন্সিপাল সম্ভবত অ্যাডজুট্যান্টকে নিয়ে এই রাতেই হাউস সার্চ করতে আসবেন। আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়ি। সোবহান তখন বুদ্ধি দেয় কাঁঠালটিকে হাউসের পেছনে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হোক। দ্রুত হাউসের স্টোর থেকে আমাদের গার্ডেনিংয়ের সরঞ্জামের ভেতর থেকে কোদাল নিয়ে আসে একজন। কৃষকের সন্তান সোবহান দ্রুত কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কাঁঠালের জন্য একটি কবর খুঁড়ে ফেলে। কাঁঠালকে কবরস্থ করে আমরা ভেজা কাপড় আমাদের কাবার্ডের কোনায় লুকিয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়। আমরা দীর্ঘক্ষণ জেগে থেকে অপেক্ষা করি এই বুঝি প্রিন্সিপাল আসেন। সৌভাগ্যক্রমে কেউ আর সে-রাতে আসে না। পরদিন সকালে পিটিতে দাঁড়ালে আমরা দেখতে পাই রুমি যে কাঁঠালটা তার বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছিল গেঞ্জির আড়ালে তার ফর্সা শরীরে তার খোঁচা খোঁচা চিহ্ন তখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। তবে সেই আপাত বসন্ত চিহ্নের রহস্য আমরা ছাড়া আর কারো জানার উপায় ছিল না। সেদিন রাতে আমরা সোবহানের নেতৃত্বে কবরস্থ কাঁঠাল উত্তোলন করি এবং কম্বলের আড়ালে মোম জ্বালিয়ে সেটাকে ভাঙি। কাঁঠাল ভাঙার জন্য আমরা হাউস বেয়ারা জাকির ভাইয়ের কাছ থেকে আগেই সরিষার তেল সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। অন্যান্য রুমে অবস্থিত আমাদের ক্লাসমেটরাও পা টিপে-টিপে আমাদের রুমে এসে অন্ধকারে কাঁঠালে ভাগ বসায় সেদিন।

বিশ
আমরা যখন চত্বরে এইসব ছেলেমানুষি করছি বাইরের পৃথিবীতে তো তখন নানা তুলকালাম কাণ্ড ঘটছে, সেসব কি টের পেতাম আমরা? জানতাম?
আধো-আধো জানতাম। পৃথিবীর রাজনীতিতে কী ঘটছে তার আবছা কিছু ধারণা আমরা পেতাম। কিন্তু ঠিক কী ঘটছে সে ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। আমাদের একটি কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ক্লাব ছিল। তারা মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান করে পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে সেগুলো জানাতো আমাদের। আমরা তাদের কাছে শুনতে পেতাম প্যালেস্টাইনের যুদ্ধের কথা, ভিয়েতনামের যুদ্ধের কথা। কিন্তু দেশের রাজনীতির ব্যাপারে কোনো কথাবার্তার সুযোগ ছিল না আমাদের। দেশের রাজনীতি সেসময় আমাদের কাছে ছিল অস্পষ্ট। তবে মাঝে মাঝে নানা ঘটনায় টের পেতাম চত্বরের বাইরে দেশে চলছে নানা জটিলতা, সংকট, দুর্ঘটনা। মনে আছে একবার আমাদের চত্বর থেকে তিনটি রাইফেল চুরি হলো। আমাদের যারা সেনাবাহিনীতে যেতে ইচ্ছুক তারা অনেকেই মিলিটারি সায়েন্স বলে একটি বিষয়ে পড়াশোনা করতো। তাদের ডেমনস্ট্রেশনের জন্য চত্বরে কয়েকটি সত্যিকার রাইফেল ছিল। একদিন শুনলাম রাতের অন্ধকারে স্টোর ভেঙে কারা যেন সেই অস্ত্র চুরি করেছে। এর দুদিন পরেই আমাদের হাউসের কালচারাল ক্যাপ্টেন টুয়েলভ ক্লাসের হারুন ভাইকে চত্বর থেকে বহিষ্কার করা হলো। আমরা শুনতে পেলাম, ওই অস্ত্র লুটের সঙ্গে তিনি জড়িত। পরে জানলাম তিনি সর্বহারা পার্টি নামে একটি গোপন দলের সদস্য ছিলেন। ব্যাপারটা তখন খুব রহস্যময় ছিল আমাদের কাছে।
এই কালপর্বেই একসময় দেখলাম আমাদের ডিনারের বিলাসবহুল মেন্যুতে পরিবর্তন এসেছে। ডিনারে আমাদের সাধারণত ভাত, পোলাও, ইংলিশ ডিনার ইত্যাদি দেওয়া হতো। একপর্যায়ে আমরা দেখতে পেলাম ডিনারে প্রতিদিন আটার রুটি দেওয়া হচ্ছে। জানতে পেলাম দেশে দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে সুতরাং খাওয়ার মেন্যুতে পরিবর্তন আসবে। খাবার তালিকার এই পরিবর্তনে আমরা বেশ বিরক্তই হলাম। মনে আছে একবার ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের রাতে আমাদের রুটি দেওয়া হলো। সবাই খুব ক্ষুব্ধ। পরদিন প্রেপ টাইমে রুমি বোর্ডে আরেকটি ছবি আঁকে। এবার বোর্ডে প্রিন্সিপালের ছবি এঁকে তার গলার চারপাশে সে এঁকে দেয় একটি দড়ি। ছবি আঁকা শেষ করে করিডোরে গিয়ে এক ফাঁকে দেখে আসে ডিউটি স্যার আসছেন কিনা।  তারপর সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি এই রায় ঘোষণা করছি যে, প্রিন্সিপালকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক।’ তারপর সে বক্তৃতার মতো করে বলে, ‘যে ভাতের জন্য আমরা লড়াই করে এদেশের বিজয় ছিনিয়ে এনেছি সেই বিজয় দিবসে আমাদের কিনা খেতে দেওয়া হলো পাকিস্তানিদের খাওয়া রুটি? এটা দেশদ্রোহিতার শামিল, ফলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।‘
আমাদের একজন আর্টের শিক্ষক ছিলেন যিনি প্রায়ই চত্বরের বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের স্কেচ করে আনতেন। সেখানে থাকতো দুর্ভিক্ষপীড়িত মুখ। তিনি আমাদের দেশের দুরবস্থার কথা বলতেন। আমরা আঁচ করতাম দেশের অবস্থা ভালো নয়। তবে সপ্তাহে একবার ওই রুটি খাওয়া ছাড়া এই চত্বরে অভাবের ছোঁয়া তেমন ছিল না। আমরা যে কালপর্বে চত্বরে ছিলাম সে সময়ই দেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় পটপরিবর্তন হলো। নিহত হলেন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। চত্বরে বসে আমরা বিশেষ ধারণা পাইনি ঠিক কী ঘটছে বাইরে। সেদিন হঠাৎ ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল আমাদের। আমরা হাউসে ফিরে রেডিওতে শুনতে পেলাম শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। থমথমে পরিবেশ ছিল কদিন। কিন্তু এ নিয়ে কোনো কথা বলা, এর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটটি জানার সুযোগ হয়নি আমাদের। পুরো ঘটনার তাৎপর্যও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আমাদের যথারীতি ব্যস্ত রাখা হয়েছিল প্যারেড, ফুটবল, ভলিবলে। সেসময় আমরা চত্বরে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু অচেনা মুখের আনাগোনাও দেখেছিলাম।  অ্যাডজুট্যান্ট  পারভেজের সঙ্গে একজন সেনাকর্তাকে ঘুরতে দেখেছি কিছুদিন। কানাঘুষা শুনেছি, তিনি শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের একজন। কদিন পরই অবশ্য চত্বর থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মিলন আর আমার কৌতূহল হতো পুরো ঘটনা জানার। কিন্তু উপায় ছিল না। আমরা হাউসের ছাদে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করতাম দেশের ব্যাপারগুলো নিয়ে কিন্তু সবকিছু তখন ঘোলাটেই থাকতো আমাদের কাছে। আমাদের হাউসে সাপ্তাহিক বিচিত্রা বলে একটি পত্রিকা আসতো। সেটি পড়ার সময় খুব একটা পেতাম না আমরা। কিন্তু আমি আর মিলন সুযোগ পেলেই বিচিত্রার পাতা ওলটাতাম। বাইরের পৃথিবীর কিছুটা ধারণা আমরা পেতাম সেই পত্রিকা থেকে। তবে আমাদের মূলত ফার্মের মোরগের মতো নিরাপদ গণ্ডির ভেতর রেখেই নানারকম পুষ্টি দেওয়া হতো। যদিও বাইরের পৃথিবী অবিরাম হাতছানি দিয়ে ডাকতো আমাদের। আমাদের নিকটস্থ বাইরের পৃথিবী ছিল পাশের গ্রামের প্রান্তর আর তার বুক চিরে যাওয়া রেললাইন। আমাদের ভেতর মিলনই প্রথম কাঁটাতার ডিঙিয়ে সেই বাইরের পৃথিবীতে যাওয়ার দুঃসাহসিক অভিযান করেছিল।

একুশ
কে এই মিলন? কী তার রহস্য?
মিলন ছিল আমাদের ভেতর আধা উপস্থিত আধা অনুপস্থিত এক বালক। আমাদের সঙ্গে পিটি, প্যারেড, গেমস সবই করছে সে তবু একটা একাকিত্বের কুয়াশা ঘিরে থাকতো ওকে। নিজেকে সে বলতো খাকি পরা মেঘ। মেঘের মতোই দূর-দূরান্তে উড়ে বেড়াতো তার মন। মায়াকোভস্কির এক কবিতা পড়ে এমন একটা নাম নিয়েছিল সে। দেশ-বিদেশের জানা-অজানা কবিদের কবিতা পড়তো সে। পকেটমানি বাঁচিয়ে ছুটিতে গেলে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কবিতার বই কিনতো সে। আমরা যখন ক্লাস টেনে তখন মিলনকে পেয়ে বসলো জীবনানন্দ। উত্তেজিত হয়ে সে আমাকে বলতো, ‘জীবনানন্দ যা লিখেছে সেসব তো আমারই কথা।’ আবৃত্তি  করে সে,
আলো অন্ধকারে যাই মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয় শান্তি নয় ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়।
বিরতি নিয়ে আবার মিলন বলে,
আমি বলি এ হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।
এসব আবৃত্তি করতো মিলন অবিরাম। কোনো কোনোদিন লাইটস অফের পর বিছানায় শুয়ে একা-একা পড়ে যেত কবিতা। একদিন পড়ছিল,
গভীর হাওয়ার রাত ছিলো কাল
অসংখ্য নক্ষত্রের রাত
সারারাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারীতে খেলেছে
মশারীটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের                                 মতো,
কখনো বিছানা ছিঁড়ে নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে
এক একবার মনে হচ্ছিল আমার আধো ঘুমের ভিতর হয়তো মাথার উপরে মশারী নেই আমার
স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের                              মত উড়ছে সে
কাল এমন চমৎকার রাত ছিলো।
অন্যপাশের বিছানা থেকে ইফতি বলে উঠতো, ‘উড ইউ প্লিজ স্টপ দিস সক্রেটিস? এটা একটা কবিতা হলো? কি সব মশারি টশারির কথা।’ কিন্তু আমার কান খোলা ছিল মিলনের জন্য। আমি ছিলাম তার কবিতার একনিষ্ঠ শ্রোতা। আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে মিলনের। একদিন ক্রস কান্ট্রি দৌড়াতে-দৌড়াতে মিলন তার পরিবারের অনেক ভেতরের কথা বলে আমাকে। ক্রস কান্ট্রি মিলন আর আমার দুজনেরই প্রিয় ছিল। এই দীর্ঘ দৌড় প্রতিযোগিতায় আমরা সুযোগ পেতাম চত্বর থেকে বাইরে বেরোবার। চত্বরের সব ক্লাসের সব ক্ষুদে খাকি একসঙ্গে চত্বর থেকে বেরিয়ে গ্রামের পথঘাট, মাঠের ভেতর দিয়ে মাইল পাঁচেক দৌড়াতাম আমরা। এই মিনি ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতায় চত্বরের ৩০০ বালকের ভেতর কে কোন স্থান দখল করলো সেটি নির্ধারণ করা হতো। আমি আর মিলন সবসময় পাশাপাশি দৌড়াতাম। গ্রামের পথ দিয়ে নানা দৃশ্য আর জীবনস্রোত দেখতে-দেখতে দৌড়াতাম আমরা।
মিলন বলতো, ‘দূরপাল্লার দৌড়ের ভেতর একধরনের ধ্যানের ব্যাপার আছে, ১০০ মিটার দৌড়ের মতো শুধু ছুটে যাওয়ার ব্যাপার এটা নয়। ধীরে-ধীরে একটু-একটু করে নিজের অবস্থানটাকে বুঝে দূরত্বটা পার করা যায়, আশপাশের পৃথিবীকে দেখতে-দেখতে যাওয়া যায় এটাই ক্রস কান্ট্রির বৈশিষ্ট্য।’
বলতো ১০০ মিটার নয়, ক্রস কান্ট্রি রেসের মতোই জীবনে চলতে চায় সে। দৌড়ে প্রথমদিকে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের ছিল না। আমরা সবার মাঝামাঝি থেকে গল্প করতে-করতে দৌড়াতাম। অন্যান্য ভালো দৌড়বিদ বালক আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেত। একবার ক্রস কান্ট্রি দৌড়াতে-দৌড়াতেই মিলন আমাকে জানায় ওর মা নেই। মারা গেছেন অনেক আগে। ওর বাবা বিয়ে করেছেন দ্বিতীয়বার। মিলনের ধারণা, তার সৎমায়ের পরামর্শেই বাবা তাকে এই চত্বরে পাঠিয়েছে। মিলন তার বাবার কড়া শাসনের কথা জানায়। জানায় বাবা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এই চত্বর থেকে বেরিয়ে তাকে অবশ্যই সেনাহিনীতে যোগ দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোথাও পড়ার সুযোগ তিনি দেবেন না। কিন্তু মিলন কিছুতেই যেতে চায় না সেনাবাহিনীতে। কবিতায় ভরা শরীরটাকে সারাজীবন ইউনিফর্মে ঢুকিয়ে রাখতে হবে – একথা ভাবলেই চিন্তা অসাড় হয়ে আসে তার। আমরা গ্রামের প্রকৃতি দেখতে-দেখতে দৌড়াতাম। মিলন আবৃত্তি করতো, ‘যে জীবন ফড়িং-এর দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।’
সেই নেহাত কিশোর বয়সে নানা গভীর, গভীরতর সব প্রশ্ন দিয়ে তাড়িত হয়েছিল মিলন। চত্বরে এই যে আমাদেরকে জীবনের লড়াকু সৈনিক হিসেবে তৈরি করা, এই যে অবিরাম সাফল্যের তাগাদা দেওয়া, নেতৃত্বের বহুমাত্রিক গুণাবলি অর্জনের আয়োজন করা – এগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো সে। আমাকে বলতো, ‘জীবন কি শুধুই জয়ের জন্য, একটা কোনো জীবিকার জন্য? এর বাইরে আর কিছু নেই, আর কোনো অর্থ নেই।’ মিলন বলতো, আমাদের সহপাঠীরা সবাই জীবনকে এত ছোট জায়গায় দেখে, এত উপরিতলে দেখে যে কারো সঙ্গে মেলে না তার। মিলন জানতো না জীবনের এই গণ্ডির বাইরে ঠিক কোথায় সে যেতে চায়, কী করতে চায়। শুধু জানতো, তার বাবা আর সৎমার বলয় থেকে বেরোতে চায় সে। বাবার আদেশমতো সেনাবাহিনীতে যেতে চায় না সে। কিন্তু কী করে একটা বিকল্প জীবন তৈরি করবে তা জানা ছিল না তার। ফলে ভেতরে-ভেতরে অবিরাম একটি ছটফটানি ছিল মিলনের।
আমাদের এসএসসি পরীক্ষা, যাকে আমরা তখন ম্যাট্রিকই বলতাম, যত এগিয়ে আসতে থাকে আমরা ততো ব্যস্ত হয়ে পড়ি পড়াশোনায়। আমাদের জন্য চত্বরের নিয়মকানুন তখন অনেকটা শিথিল। আমরা লাইটস অফের পরও বাতি জ্বালিয়ে পড়ার অনুমতি পাই। শেষের দিকে পিটি-প্যারেড থেকেও অব্যাহতি পাই। রাত জেগে পড়ার ধুম তখন। রুমি ডাইনিং বয় সাত্তার ভাইয়ের সঙ্গে খাতির করে গোপনে বাড়তি ডিম, কলা হাউসে আনার ব্যবস্থা করে। রাত জেগে পড়ার ক্ষেত্রে সেসব আমাদের রসদ জোগায়। সে-সময় আমরা যখন রাত জেগে পড়ছি মিলন প্রায়ই লাইটস অফের ঘণ্টার পরপরই চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তো বিছানায়। এ-সময় আমাদের মধ্যে কে একজন ছড়ায় যে মিলন আসলে মানুষ না, সে জিন। বলে অনেক জিন নাকি মানুষ হয়ে পৃথিবীতে পড়াশোনা করতে আসে। মিলন সেরকম কেউ একজন। জিনরা তাকে পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দিয়ে গেছে, তাই সে পড়াশোনা করে না। কেউ-কেউ ওর কাছে আসে সত্যিই সে ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রশ্ন জানে কিনা জানতে। মিলন অভিমানে সবার সঙ্গে কথা বন্ধ রাখে। একদিন রাতে হাউসের ছাদে দাঁড়িয়ে মিলন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুইও কি মনে করিস আমি জিন?’
আমি হেসে বলি, ‘দেখি তো তোর পা দেখা। জিন-ভূতের পা নাকি উলটা দিকে থাকে?’
মিলন বলে, ‘শোন আমারও কিন্তু মাঝে-মাঝে মনে হয় আমি বোধহয় মানুষ না, মানুষরা তো অন্যরকম। একদিন সত্যিই হয়তো দেখবি আমার পা উলটে গেছে, পাখা গজিয়েছে আমার, আমি উড়ে যাচ্ছি কোথাও।’
এরপর মিলন ছাদে পায়চারি করতে করতে এক-এক করে আবারো আওড়ায় জীবনানন্দ :
রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন পথে যাবো?
বলে :
মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো
এইখানে
পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।
তাদের সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই
তাদের হৃদয়ে কোন সভাপতি নেই।
বিড়বিড় করে বলে :
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।
এইসময় একদিন মিলন দুঃসাহসে ভর করে রাতে লাইটস অফের পর কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে চলে যায় চত্বরের বাইরে। আমাদের হাউসের ছাদের পেছনের পাইপ বেয়ে নেমে কাঁটাতারের বেড়ার এক ফাঁক দিয়ে চত্বরের বাইরে চলে যাওয়া যেত। এক শনিবার রাতে সবাই যখন অডিটোরিয়ামে মুভি দেখছে মিলন তখন পাইপ বেয়ে নেমে কাঁটাতার পেরিয়ে চলে যায় বাইরে। শুধু আমি জানতাম ওর পরিকল্পনার কথা। মিলন বলেছিল, চত্বরের ঘেরাটোপে কেমন দমবন্ধ লাগছে তার। সে শুধু বাইরের রেললাইন বরাবর কিছুক্ষণ হেঁটে আসবে। মুভি দেখে হাউসে ফিরে দেখি মিলন তখনও ফেরেনি। খুব উদ্বিগ্ন হয়ে থাকি। রুমের অন্যদের বলি। তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। লাইটস অফের ঘণ্টা বাজে। সব রুমের বাতি নিভে যায়। আমরা ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী বলে রুমে বাতি জ্বালিয়ে রাখি। পড়ায় মন বসে না আমার। বেশ অনেক রাতে ফেরে মিলন। তাড়াহুড়া করে কাঁটাতার দিয়ে ঢুকতে গিয়ে তারের খোঁচায় কেটে গেছে ওর কনুই। সাদা ডিনার ড্রেসের শার্ট ছিঁড়ে গেছে কনুইয়ের কাছে, রক্ত বেরোচ্ছে। আমি তুলা দিয়ে ওর রক্ত বন্ধ করি। মিলন জানায়, সে যখন কাঁটাতারের কাছে তখন এক দারোয়ান টর্চ ফেলে দেখে ফেলেছে তাকে। কিছুক্ষণ পর রাতের অন্ধকারে হাবিলদারের বাঁশির আওয়াজ শুনি আমরা। বুঝতে পারি দারোয়ান হয়তো খোঁজ দিয়েছে হাবিলদারকে। সবাইকে ঘুম থেকে উঠে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে যেতে বলা হয়। হাউসের সবাই তখন গভীর ঘুমে। ওই মাঝরাতে কেন এভাবে ঘুম থেকে তোলা হচ্ছে বুঝতে পারে না কেউ। চোখ ঘষতে ঘষতে ডিনার ড্রেস গায়ে চাপিয়ে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে দাঁড়ায় সবাই। বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বাকিরা সব অবাক হলেও আমাদের রুমের সবাই জানি কী ঘটেছে। মিলন তাড়াতাড়ি শার্ট পালটে কনুইয়ে তুলা পেঁচিয়ে গিয়ে গ্রাউন্ডে দাঁড়ায়। আমরাও সুবোধ বালকের মতো গিয়ে ফল ইন করি। এরপর অ্যাডজুট্যান্ট মাঠে এসে বলেন, তার কাছে রিপোর্ট এসেছে কেউ একজন চত্বর থেকে বাইরে চলে গেছে। আমরা বুঝি দারোয়ান হয়তো ভেবেছে রুমি পালিয়ে গেছে, মিলন যে তখন ভেতরে ঢুকছিল সেটা টের পায়নি সে। অ্যাডজুট্যান্ট সবার হেড কাউন্ট করেন। তিনি হেড কাউন্ট করে দেখতে পান সংখ্যা ঠিকই আছে। তিনি তখন বেশ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। বলেন, ‘কেউ হয়তো চেষ্টা করেছিল পালিয়ে যাওয়ার কিন্তু আমাদের স্টাফ দেখে ফেলাতে ফিরে এসেছে আবার। কিন্তু এরপর আর যদি কেউ তেমন চেষ্টা করে তবে তাকে অন দি স্পট চত্বর থেকে এক্সপেল করা হবে।’
অ্যাডজুট্যান্ট যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন আমি লক্ষ করছিলাম আমার পাশে দাঁড়ানো মিলনের শার্টের কনুয়ের জায়গাটা একটু একটু করে রক্তে ভরে উঠছে। সাদা ডিনার ড্রেসে দেখা দিচ্ছে লাল ছোপ। সে-যাত্রায় রক্ষা পায় মিলন। আমরা আবার সব হাউসে ফিরে যার-যার বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমাকে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে মিলন বলে, ‘কাঁটাতার পেরিয়ে রেললাইনের ধারে বসে সিগারেট টেনেছি একটা। তারপর রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি বহুদূর। তোর মনে আছে অবস্ট্রাকল কোর্সের ট্রেঞ্চের ভেতর গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম একদিন? কাঁটাতারের বাইরে, রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতেও তেমন অনুভূতি হচ্ছিল  আমার। সবার নজরের বাইরে থাকার একটা অনুভূতি। ভীষণ একটা মুক্তির স্বাদ।’ ওই মুক্তির স্বাদ নিতে চত্বরের বাইরে আরো গেছে মিলন।
এরই মধ্যে চলে আসে আমাদের ম্যাট্রিকের দিন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে বাইরের ছেলেমেয়েদের পরিবারে কতরকম প্রস্তুতি, আনুষ্ঠানিকতা থাকে। মা দুধের গ্লাস নিয়ে পড়ার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরীক্ষার দিন সকালে ডিম খেতে দেওয়া হয় না পরীক্ষায় শূন্য পেতে পারে এই আশঙ্কায়। পরীক্ষা হলে যাওয়ার আগে দোয়া-দরুদ পড়ে কলমে ফুঁ দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের ওই চত্বরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা নেহাতই সাদামাটা, ঘটনাহীন।  পরিবার-পরিজনহীন আমরা খাকি, বুট, বেল্ট পরে ক্ষুদে সৈনিক সেজেই পরীক্ষা হলে বসি। এক এক করে পরীক্ষা দিই। নিজেদের ভেতরই জল্পনা-কল্পনা করি। এভাবেই একসময় শেষ হয় আমাদের প্রথম বোর্ড পরীক্ষা। আমাদের তখন বাঁধভাঙা ফুর্তি। শেষ পরীক্ষা দিয়ে এসে মিলন এক মজার কাণ্ড করে। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আমরা তখন মোটা-মোটা সব  টেস্ট পেপার পড়তাম।  পরীক্ষা হল থেকে ফিরে মিলন ওর ঢাউস টেস্ট পেপারের পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে বানাতে থাকে একের পর এক কাগজের অ্যারোপ্লেন। মিলনের দেখাদেখি সবাই তখন নেমে পড়ে টেস্ট পেপারের পাতা ছিঁড়ে অ্যারোপ্লেন বানাতে। আমাদের ওপর সেদিন আর চত্বরের শাসন নেই ফলে আমরা স্বাধীনভাবে হাউসের ছাদে উঠে চত্বরের আকাশকে ভরে দিই কাগজের অ্যারোপ্লেনে।

বাইশ
ম্যাট্রিকের ছুটির পর চত্বরে ফিরে এসে কেমন দাঁড়ালো আমাদের জীবন?
অনেকদিন ছুটি কাটিয়ে চত্বরে ফেরার সময় মনটা খারাপ হলো খুব। সব নিয়মকানুনের বাইরে, বাবা-মায়ের আদরে, অনেক বেলা করে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি এই ছুটি। চত্বরে ফিরতে-ফিরতে যখন ভাবছিলাম আবার সেই ভোর ৫টায় উঠে পিটি, প্যারেড, আবার সেই এক্সট্রা ড্রিল তখন মনটা বিষণœ হয়ে পড়েছিল। চত্বরের কাছাকাছি এসে এর বিশাল ফটক দেখে মনটা আরো ভেঙে  পড়ে। মনে হয়, এসে যদি দেখতাম পম্পেই নগরীর মতো কোনো আগ্নেয়গিরির লাভায় কিংবা কোনো ভূমিকম্পে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এই চত্বর, তাহলে বেশ হতো। সত্যি বলতে প্রতিবার ছুটি থেকে ফেরার সময়ই এমন মনে হতো আমার। অবশ্য চত্বরে ঢুকে সব বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যখন দেখা হতো আবার জেগে উঠতাম নতুন করে। ম্যাট্রিকের পরও তেমন হলো। অনেকদিন পর দেখা হলো সবার সঙ্গে আবার, হই-হুল্লোড়ে মেতে উঠলাম সবাই।
এই চত্বরের বালকেরা বরাবরই বোর্ড পরীক্ষায় ভালো করে। বস্তুত সবাই মেধার লড়াইয়ে টিকেই এ চত্বরে আসে, ফলে গড় মেধার চাইতে এই বালকদের মেধা থাকে ভালো। তারপর এই চত্বরের নিয়মতান্ত্রিক জীবনে দিনের একটা বড় সময় ব্যয় হয় পড়াশোনাতেই। দুপুর পর্যন্ত টানা ক্লাস, তারপর দু-দুটো প্রেপ টাইম। ফলে যারাই এই সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করে তারা ফলাফল ভালোই পায়। বরাবরের মতো আমাদের ক্লাসও ভালো রেজাল্ট করে বোর্ডে। আমাদের হাউসের রাজীব বোর্ডে হয় দ্বিতীয়। লাল হাউসের সাইফুল, সবুজ হাউসের রাশেদ এরাও মেধা তালিকায় স্থান পায়। শুধু চারজন বাদে আমাদের ক্লাসের বাকি সবাই পেয়ে যায় ফার্স্ট ডিভিশন। সবারই অনেকগুলো করে লেটার মার্ক, অনেকেরই স্টার মার্ক। আমিও মাঝারি ধরনের ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে যাই। যে চারজন সেকেন্ড ডিভিশন পায় তাদের মধ্যে ছিল আমাদের হাউসের রুমি ও মিলন। বাকি দুইজন লাল ও সবুজ হাউসের। রুমির ফলাফল অপ্রত্যাশিত ছিল না কারণ সে বরাবর ক্লাসের মেধা তালিকায় নিচের দিকেই থাকতো। কিন্তু মিলনের ফলাফল এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। ক্লাসে তার ফলাফল বরাবর ভালোই হতো। কিন্তু পরীক্ষার আগের সময়গুলোতে তার ভেতর একটি নিস্পৃহতা, উদ্যমহীনতা দেখা দিয়েছিল।
তবে ছুটি থেকে ফিরে বোর্ডে কে কোন প্লেস পেয়েছে, কে কোন ডিভিশন পেয়েছে – এগুলো নিয়ে আমরা কোনো মাথা ঘামাইনি। বহুদিন পর দেখা হয়ে এতদিনের জমা গল্প নিয়ে মেতে উঠি আমরা। সুযোগ পেয়ে এই ছুটিতে আমরা একবারও চুলে কাঁচি চালাইনি ফলে আমাদের সবার চুল হয়েছিল লম্বা, প্রায় বাবরি দোলানো নজরুল সব। কিন্তু চত্বরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেলুনে। আমাদের নাপিত ভাইরা মনের আনন্দে কাঁচি চালান আমাদের চুলে। আমাদের সবার সাধের চুলের মৃতদেহ আমরা পড়ে থাকতে দেখি সেলুনের মেঝেতে। মনে-মনে ভাবি, যে নাপিতের নাম দিয়েছে ‘নরসুন্দর’ তাকে এই চত্বরে এনে এক্সট্রা ড্রিল দেওয়া দরকার। এসময় নতুন ছড়াকার হিসেবে আবির্ভূত হয় আমাদের হাউসের কায়সার। কায়সার একটি প্যারোডি গান বানিয়ে ফেলে তখনকার জনপ্রিয় এক গান, ‘আহা একটি মেয়ে আমি দেখেছি সেদিন,  এলোচুলে জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল, বিকেলের সোনা রোদ চমকে উঠে অনুরাগে দেহখানি জড়িয়ে ছিল’-এর আদলে। সে লেখে,
আহা একটি বালক আমি দেখেছি সেদিন
বাটি ছাঁটে ওই মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল
বিকালের সোনারোদে চমকে উঠে
পাঞ্জাবি পরে সে নামাজে গেল
মিলনের সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হলে জড়িয়ে ধরি ওকে। ছুটিতে ও ছিল ঢাকায় আর আমি আরেক মফম্বল শহরে। ছুটিতে ওর সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ হয়েছিল। মিলন জানায়, পরীক্ষার ফল ভালো না হওয়াতে ওর বাবা ওকে পিটিয়েছে খুব। বলেছে, এইচএসসিতে ফার্স্ট ডিভিশন না পেলে অন্য কোথাও তো দূরের কথা সেনাবাহিনীতেও সুযোগ পাবে না সে। আর সেনাবাহিনীতে সুযোগ না পেলে তাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হবে। মিলনের বাবা চত্বরের প্রিন্সিপালকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, এইচএসসিতে মিলন যেন বিষয় হিসেবে অবশ্যই মিলিটারি সায়েন্স নেয়। বাবার আস্ফালন আর সৎমায়ের নিরুত্তাপ সংসারে ছুটি কাটিয়েছে সে। তবে মিলন জানায় এ ছুটিতে প্রাণভরে কবিতা পড়েছে সে, নতুন নতুন অনেক-অনেক টাটকা কবিতা। আবুল হাসান নামে নতুন এক কবির কবিতা আবিষ্কার করে উত্তেজিত সে। সদ্য বেরিয়েছে তার নতুন কবিতার বই। আমাকে শোনায় সে কয়েক লাইন :
অবশেষে জেনেছি মানুষ একা
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা
দৃশ্যের বিপরীতে সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর                            সাথে কোনদিন।
সেই সঙ্গে জানায়, এ-ছুটিতে আমাদের সেই ব্যালাড অব অ্যা সোলজারের রেলগাড়ির কিশোরীকে খুঁজে পেয়েছে সে। তাদের পাড়ায় নতুন আসা সে মেয়ে দেখতে নাকি ঠিক সেই রুশ মেয়েটির মতোই। তাকে দেখে মিলনের বুকের ভেতর জ্বলে উঠেছে  অচেনা এক মোমবাতি। মিলন ছুটিজুড়ে নানাভাবে চেষ্টা করেছে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের কিন্তু উপেক্ষায় চলে গেছে সেই বালিকা। দূর থেকে একটা মৃদু মৃদু কষ্ট বুকে নিয়েই ফিরে এসেছে মিলন। সে জানায়, ছুটির শেষদিকে ওদের পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে সেই মেয়ে। মিলন বলে, সেই মেয়ে এক দূরতম দ্বীপ এখন। তাকে নিয়ে সে আর ভাবে না। মিলন আবৃত্তি করে :
তুমি শুধু একদিন ব্যথা হয়ে এসেছিলে কবে
সেদিকে ফিরিনি আর, চড়–ইয়ের মত আমি ঘাস খড় পাতার                        আহ্বানে
চলে গেছি, এ জীবন কবে যেন মাঠে মাঠে ঘাস হয়ে রবে।
সত্যি বলতে এবার চত্বরে ফিরে সবাই টের পায় সবার বুকের ভেতর অমন একটা হঠাৎ জ্বলে ওঠা মোমবাতি। বিপরীত লিঙ্গ বিষয়ে তুমুল আগ্রহ তখন সবার। সবার ভেতর হরমোনের প্রাবল্য,  টেসটোসটেরনের  গুঁতোগুঁতি।

তেইশ
হরমোনের প্রাবল্যে প্রতিক্রিয়া হলো কী রকম?
প্রতিক্রিয়া তো বিচিত্র। টেসটোসটেরনের প্রাবল্যে আমাদের শরীরে কৈশোরের সেই সারল্য আর নেই। যৌবনের নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা সবাই শেভ করতে শুরু করেছি। যৌনতার ব্যাপারগুলোও মনের ভেতর খেলা করছে চোরাগোপ্তা। বিপরীত লিঙ্গবিষয়ক আকর্ষণ হয়েছে তীব্রতর। একদিন গেমসের পর রুমি জানালো আজকের নাইট প্রেপ টাইমে সবার জন্য একটি সারপ্রাইজ আছে। আমরা মহাকৌতূহলে রইলাম। তারপর সে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় আমাদের কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল খাতাটি বাড়িয়ে দিলো আমাদের দিকে। আমরা অতি সন্তর্পণে খাতাটির ভাঁজ খুলে বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম সেখানে প্লেবয় পত্রিকার একটি সংখ্যা। সেখানে অগণিত নগ্ন বিদেশি মেয়ের রঙিন ছবি। চত্বরে ঢোকার সময় আমাদের সবার সুটকেস, ট্রাঙ্ক চেক করা হয়। কিন্তু রুমি বাইরে থেকে জিনিস পাচারে পারদর্শী। সে আগে সিগারেট পাচার করেছে, এবার সুটকেসের দুই পাল্লার ফাঁকে বিশেষ কায়দা করে গোপনে নিয়ে এসেছে এই প্লেবয় পত্রিকা। প্রথমবারের মতো অমন পূর্ণাঙ্গ নগ্ন নারীর ছবি দেখলাম আমি। সেদিন প্রেপে আমাদের সবার হাত ঘুরলো মহামূল্যবান সেই কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল খাতা। আমরা অতি সতর্কতার সঙ্গে নিষিদ্ধ ইশতেহারের মতো একে-একে দেখলাম সেইসব ভিনদেশি নগ্ন নারীকে। রুমি বিশেষজ্ঞ ভঙ্গিতে সবাইকে জানালো, ছবির এই মেয়েগুলোর স্তনের নিপলের রং গোলাপি হলেও বাঙালি মেয়েদের নিপল হয় বাদামি।
সত্যি বলতে হরমোনের তোড়ে আমরা তখন বেশ নাজেহালই রইলাম কিছুকাল। আমাদের অনেকেরই ওয়েট ড্রিম হতে থাকে। স্বপ্নদোষ শব্দটি অবশ্য আমাদের শেখায় সোবহান। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই স্লিপিং ড্রেসের অংশবিশেষে গতরাতের তরল স্বপ্নের চিহ্ন দেখে বিব্রত হয়ে পড়তে থাকি আমরা। রুমিই আমাদের এর সমাধান হিসেব মাস্টারবেশনের পথ বাতলে দেয়। মাস্টারবেশনের নানা পথও বাতলে দেয় সে। এক্ষেত্রে রুমির আনা প্লেবয় পত্রিকাটি বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। আমাদের নব্য ছড়াকার কায়সার ছড়া লেখে আরেকটি,
সমুখে রূপসী যুবতীর ফটো
পাশে সাবান জল, হাত চলে অটো।
রুমি হস্তমৈথুনের একটি প্রতীকী নামও দিলো। হস্তমৈথুন থেকে  হস্তশিল্প, সেটা থেকে কুটিরশিল্প। পরে সবাই একে অন্যের কাছে খবর নিতে থাকে কুটিরশিল্পে কার কতদূর অগ্রগতি হয়েছে। একবার অবস্ট্রাকল কোর্স করতে গিয়ে হাতের আঙুল খানিকটা মচকে গেল আমাদের স্ট্যান্ড করা ছেলে কসকো রাজীবের। হাত ব্যান্ডেজ করতে হলো। রুমি ছড়ালো যে, রাজীব মাস্টারবেট করতে-করতে হাত ভেঙে ফেলেছে। আমাদের বাংলার শিক্ষক মতিন স্যার ক্লাসে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার রাজীব আঙুলে কী হয়েছে তোমার?’
রাজীব কিছু বলার আগেই রুমি পাশ থেকে বলে, ‘স্যার কুটিরশিল্প করতে গিয়ে হাত ভেঙে ফেলেছে। রাজীব তো স্যার কুটিরশিল্পে খুবই ভালো।’
স্যার বলেন, ‘তাই নাকি? সেটা তো খুবই ভালো খবর। তা কী ধরনের কুটিরশিল্পে আগ্রহ তোমার?’
রুমি বলে, ‘স্যার ও কাঠের কাজ করে। কাঠ দিয়ে নানা রকম জিনিস বানায়।’
‘তা হাত ভাঙলো কী করে?’ জানতে চান স্যার।
‘কুটিরশিল্পে তো স্যার হাতেরই কারবার সব। পেরেক মারতে গিয়ে হাতুড়িটা আঙুলে পড়েছে।’ বলে রুমি।
মতিন স্যার বলেন, ‘সাবধানে কুটিরশিল্প করবে বাবা।’
আমরা পাশে বসে হাসি চাপার চেষ্টা করি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মেয়েদের ব্যাপারে তীব্র আকর্ষণ আমাদের অথচ নেহাত দৃষ্টিসুখের জন্যও চত্বরে কোনো মেয়ে নেই। সকলে অপেক্ষা করে প্যারেন্টস ডের জন্য। অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ছাড়াও সেদিন সবার বাড়তি আকর্ষণ ক্ষুদে খাকিদের কিশোরী, যুবতী বোনদের দেখা। কোনো জুনিয়র ক্ষুদে খাকির বোন যদি অতি রূপসী হয় তাহলে রুমি সেই ক্ষুদে খাকির বিশেষ খোঁজখবর নিতে থাকে। এমনিতে তার কুশল জানতে চায়, বাড়ির সবাই কে কেমন আছে জানতে চায়। কৌশলে জেনে নিতে চায় তার বোনটির কী নাম, কোন ক্লাসে পড়ে ইত্যাদি। কিন্তু প্যারেন্টস ডে পেরিয়ে গেলে চত্বর আবার সেই খাঁ-খাঁ। ওদিকে হরমোনের গুঁতোগুঁতি তো আর আমাদের থামে না। ফলে নানা বিকল্প উপায়ে নারীস্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করে ছেলেরা।
নানা কিছুর ভেতর নারী খোঁজে। রুমি একদিন আমাদের এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে, টি ব্রেকের সময় মাঝখানে ঈষৎ উঁচু গোল যে বনরুটিটি আমরা খাই সেটি দেখতে অনেকটা নারীস্তনের মতো। আরো নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দেয় কারো কারো মধ্যে। চত্বরের নিচু ক্লাসের ফর্সা, নির্লোম, মিষ্টি দেখতে কোনো ছেলে থাকলে তাকে বিকল্প নারী ভেবে সিনিয়র ছেলেরা নানা রকম মন্তব্য করে আনন্দ নেয়। গেমসের সময় সেরকম ছেলেদের হাফপ্যান্টের নিচে বেরিয়ে থাকা ফর্সা উড়– নিয়ে যৌনাত্মক মন্তব্য করতে শুনেছি অনেককে। আমাদের ক্লাসে পিয়াল বলে একটি লাজুক ছেলে ছিল। আমরা যখন ক্লাস এইটে তখন দেখতাম তখনকার ক্লাস টুয়েলভের রহমান ভাই ওকে বিশেষভাবে খাতির করতো। তার খোঁজখবর নিতো, নানাভাবে ওকে সাহায্য করতো, ওকে ডেকে নিয়ে আলাপ করতো দীর্ঘক্ষণ। পিয়ালেরও কেমন একটি নির্ভরশীলতা ছিল কায়েস ভাইয়ের ওপর। মাঝে মাঝে কীসব নিয়ে মান-অভিমানও হতো ওদের মধ্যে। তখন আমরা ব্যাপারটা অত তলিয়ে দেখিনি, হাসিঠাট্টা করেছি। কিন্তু সেই অসম বয়সী দুজন বালকের সম্পর্কটা বস্তুত ছিল জটিল। নারীবর্জিত ওই চত্বরে ওটা ছিল বাৎসল্য, প্রেম, যৌনতার একটি মিশ্র অনুভূতির প্রকাশ। এই সম্পর্ক অবশ্য যৌন কর্মকাণ্ডেও পর্যবসিত হতো। চত্বরে সডোমির ব্যাপার ছিল একটি ওপেন সিক্রেট। এ ধরনের নারীবর্জিত প্রতিষ্ঠানে হোমোসেক্সুয়ালিটি, সমকামিতার ব্যাপার দুর্লভ কিছু নয়। মিলিটারি ব্যারাকে, জেলখানায় এসব ঘটে থাকে। আমাদের ওই চত্বরেও ঘটতো। তবে ব্যাপারগুলো গোপনই থাকতো। পিয়াল আর কায়েস ভাইয়ের মধ্যে ঘটেছিল কিনা আমরা জানি না। সন্দেহ করি ঘটেছিল। তবে আমরা যখন ক্লাস ইলেভেনে তখন ক্লাস টুয়েলভের একজনকে বহিষ্কার করা হলো ওই সডোমির অভিযোগেই। কার সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল সেসব বিস্তারিত অবশ্য আমরা জানতে পারিনি।
অবশেষে একদিন এক বালিকার আবির্ভাব ঘটে আমাদের চত্বরে।
আমরা ম্যাট্রিকের পর চত্বরে ফিরে আসার কিছুদিন পর বিদায় নিলেন আমাদের পুরনো প্রিন্সিপাল প্যাকি। নানা জাঁকজমক করে বিদায় দেওয়া হলো তাকে। আমরা তাকে ডাইনিংয়ে ফেয়ারওয়েল ডিনার দিলাম এবং তারপর সবাই তাকে ঘিরে হাততালি দিয়ে বিলাতি কায়দায় গাইলাম, ‘ফর হি ইজ এ জলি গুড ফেলা, ফর হি ইজ এ জলি গুড ফেলা, ফর হি ইজ এ জলি গুড ফেলা নো বডি ক্যান ডিনাই।’ আমরা যেন চলে গেলাম একেবারে সেই ঔপনিবেশিক আমলে। ব্রিটিশ প্রভুদের কায়দায় আমরা বিদায় জানালাম প্রিন্সিপালকে। প্যাকি চলে গেলে আমাদের চত্বরে এলেন আবদুর রশীদ নামে নতুন এক প্রিন্সিপাল। কিন্তু কথা সেটি নয়, কথা হচ্ছে, আমরা জানতে পেলাম এই নতুন প্রিন্সিপালের আমাদের বয়সী এক মেয়ে আছে। সেও আমাদের মতো কেবলই ম্যাট্রিক দিয়ে কলেজে উঠেছে। আবদুর রশীদ স্যার এসে পরিচিত হলেন আমাদের সঙ্গে। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার চাইতে আমাদের মূল আগ্রহ তার মেয়েটিকে দেখতে পাওয়া। আমরা অধীর আগ্রহে থাকলাম কখন, কীভাবে তার মেয়েটিকে দেখতে পাবো। হাউস বেয়ারা জাকির ভাই মারফত আমরা জেনে গেলাম সেই মেয়ের নাম লিপি। জাকির ভাই এও জানালেন, স্যারের মেয়ে সাইকেল চালায়। সুতরাং লিপিকে না দেখেই আমরা লিপি বিষয়ে নানা কল্পনার জাল বিছাতে লাগলাম। ‘তারে আমি চোখে দেখিনি তার অনেক গল্প শুনেছি’ ধরনের। একদিন সকালে অঙ্কের স্যার না আসাতে আমরা ক্লাসে বসে সেলফ স্টাডি করছি তখন হঠাৎ লাল হাউসের আশিক সেই দুর্লভ সংবাদটি পরিবেশন করে। সে হঠাৎ জানালার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে – ‘লিপি‘। আমাদের অসংখ্য জোড়া চোখ মুহূর্তে ঘুরে যায় জানালার দিকে। আমরা দেখতে পাই আঁটোসাঁটো গেঞ্জি গায়ে অতীব রূপসী এক মেয়ে সাইকেল চালাচ্ছে আমাদের অ্যাকাডেমিক ব্লকের সামনে। সে সাইকেল নিয়ে আমাদের অ্যাকাডেমিক ব্লকের গোল আইল্যান্ডটিকে কেবল চক্কর দিচ্ছে। আমরা সবাই একে-একে ক্লাসের জানালায় গিয়ে দাঁড়াই। আমরা ঘোরগ্রস্তের মতো মেয়েটির সাইকেল চালানো দেখি। ঘূর্ণায়মান এক প্রজাপতির মতো লাগে মেয়েটিকে। আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই তখন। গাঢ় নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে আমাদের ভেতর। মনে আছে সেই নৈঃশব্দ্যের ভেতর আশিক হঠাৎ রুমিকে জিজ্ঞাসা করে, ‘দোস্ত, লিপির নিপল কি পিঙ্ক না ব্রাউন, তোর কী মনে হয়?’
লিপির ব্যাপারে একটা গোপন প্রেম আমাদের সবার ভেতরই জেগে ওঠে। কিন্তু লিপির সঙ্গে যোগাযোগের কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য ছিল দুরূহ। লিপি এক সাইকেল আরোহী রহস্যময়ী নারী হিসেবে মাঝে-মাঝে রাস্তায় উদয় হয়ে আমাদের বুকে জলোচ্ছ্বাস তুলে আবার উধাও হয়ে যেতে লাগলো প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারের দিকে। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে তারপর একদিন প্রিন্সিপাল স্যার ঘোষণা করলেন আগামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার মেয়ে লিপি নাচবে। আমাদের ওই চত্বরের অনুষ্ঠানে এর আগে কোনো নারী অংশগ্রহণ করেনি। আমাদের মধ্যে বিপুল উত্তেজনার সঞ্চার হলো। সেই অনুষ্ঠানের আগের রাতে আমাদের একরকম নির্ঘুমই কাটলো বলা চলে। ইফতি সে অনুষ্ঠানে ইংরেজি গান গাইবে। সবার গভীর ঈর্ষা জাগলো ইফতিকে নিয়ে কারণ সবার ধারণা হলো যে, হয়তো স্টেজের পেছনে নাচের আগে লিপির সঙ্গে ইফতির কথা বলার সুযোগ ঘটবে। ইফতিও মনে মনে খুবই পুলকিত। সারাদিন আমরা উত্তেজনায় রইলাম সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের জন্য। আমরা অডিটোরিয়ামে বসে অধীর অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন দেখা দেবে লিপি। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে আর কে গান গাইলো, আবৃত্তি করলো সেগুলো আমাদের কানেই গেল না, আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন লিপি আসে। তারপর একসময় অডিটোরিয়ামে আমাদের দুসারি চেয়ারের মাঝখান দিয়ে নূপুর, চুড়ি, ঝুমকার ঝিমঝিম আওয়াজ তুলে মঞ্চে উঠলো লিপি। এ-চত্বরে এই অচেনা মেয়েলি শব্দে আমাদের বুক কাঁপলো। তারপর লিপি মঞ্চে উঠে নাচলো ‘অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে’। আমরা রুদ্ধশ্বাসে দেখলাম তা। নাচশেষে কারো সঙ্গে কথা না বলে সে চলে গেল অডিটোরিয়াম ছেড়ে। ইফতিও কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না। আমাদের সবার বুক খালি হয়ে রইল। লিপির সঙ্গে আর যোগাযোগ ঘটলো না আমাদের।
লিপি আর ফেরেনি ওই চত্বরে। আমরা জানতে পেলাম, ঢাকার কোনো এক কলেজে ভর্তি হয়ে চলে গেছে লিপি। ছুটিতে হঠাৎ আসতো লিপি এবং চলেও যেত কখন সবার অজান্তে। লিপির সঙ্গে যোগাযোগে আমরা সফল হইনি। তবে লিপি নামের সেই মেয়েটি যার সঙ্গে আমাদের কোনো কথা হয়নি কোনোদিন, চেয়ারের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া তার ওই নূপুর, চুড়ির শব্দ নারীত্বের প্রথম চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে আমাদের মনে। লিপি চলে গেলেও সবার ভেতর সে তখন জাগিয়ে দিয়ে গেছে প্রেমের বুদ্বুদ। এসময় আমাদের ভেতর পেন ফ্রেন্ড করার একটা হুজুগ ওঠে। আজকের এই ই-মেইল, মোবাইলের যুগের অনেক তরুণের কাছেই হয়তো ব্যাপারটা অচেনা ঠেকবে। পেন ফ্রেন্ড বা পত্রমিতালী করার আহ্বান জানিয়ে দেশি, বিদেশি অনেকের নাম-ঠিকানা ছবিসহ পত্রিকা, পুস্তক বের হতো সেসময়। মেয়েবর্জিত ওই চত্বরে পত্রমিতালী ছিল দূরবর্তী মেয়েসঙ্গ পাওয়ার একটি ভালো উপায়। পত্রমিতালীর নামে প্রেমপত্র চর্চার একটি উপলক্ষ ছিল সেটি। ওই খাকি চত্বরে একটি হলুদ খাম, কিংবা একটি অ্যারোগ্রাম ছিল যেন স্বপ্নরাজ্য থেকে উড়ে আসা কোনো অলীক পাখি। না, আমার কোনো পত্রমিতালী ছিল না। আমার চিঠি আসতো মায়ের কাছ থেকে। মা লিখতো, ‘বেশি রাত জেগে পড়িস না বাবা। কম্বলটা বুক পর্যন্ত টেনে ঘুমাবি আর চশমাটা বালিশের কাছে না রেখে সবসময় আলমারির ভেতর রাখবি।’ আমি ছিলাম পেঁচাচক্ষু দর্শক। দেখতাম সবকিছ্।ু পাঠক ছিলাম বালকদের প্রেমপত্রের, কখনো-কখনো সহযোগী লেখক। ইফতির ক্রিস্টিন নামে নিউইয়র্কের এক মেয়ে পত্রমিতালী ছিল। ইংরেজিতে মেয়েটিকে নিয়মিত লিখতো সে। স্ট্যাচু অব লিবার্টিসহ আমেরিকার নানারকম  পোস্টকার্ড পাঠাতো সে। রুমির ছিল শীলা নামে এক মেয়ের সঙ্গে পত্রমিতালী। দু-চার চিঠি চালাচালির পরই সে প্রেম নিবেদন করে বসে মেয়েটিকে। তার চিঠির ভাষা ইত্যাদি ঠিকঠাক  করে দেওয়ার ব্যাপারে আমি ভূমিকা রাখি। মেয়েটি তখন বন্ধ করে দেয় চিঠি লেখা। এর মধ্যে হঠাৎ ঘোষণা করা হলো আমাদের চিঠি পরীক্ষা করা হবে। খাম খুলে হাউস মাস্টারকে চিঠি দিতে হবে এবং তিনি সে চিঠি পড়ে তারপর পোস্ট করবেন। বাইরে থেকে যে চিঠি আসবে সেগুলোও পরীক্ষা  করা হবে। সম্ভবত ছেলেদের প্রেমপত্র চালাচালির খবর পৌঁছেছিল কর্তৃপক্ষের কাছে। এবার রুমি পত্রমিতালী গাইড বই থেকে তাদের কাছাকাছি এলাকায় আসমা নামে এক মেয়ের ঠিকানা খুঁজে বের করে। রুমির মায়ের নাম ছিল আসমা বেগম। সে সেই আসমা মেয়েটিকে চিঠিতে সম্বোধন করতো  ‘শ্রদ্ধেয়া মা’ বলে তারপর লিখতো ‘আমি আপনার দোয়ায় ভালো আছি। আপনি চিন্তা করবেন না।’ এরপর চত্বরের পিটি, প্যারেড, বার্ষিক ক্রীড়া ইত্যাদি বিষয়ে লিখতো সে। চিঠির দ্বিতীয় পৃষ্ঠা থেকে লিখতো, ‘আগের পৃষ্ঠায় যা কিছু লিখেছি ভুলে যাও। পত্রমিতালী গাইডে তোমার ছবির কাজল টানা চোখের কথা ভেবে রাতে ঘুম আসে না আমার’ ইত্যাদি। লেখে, ‘আমার চিঠি সবসময় পড়া শুরু করবে দ্বিতীয় পৃষ্ঠা থেকে।’ শেষে লেখে, ‘আপনার øেহের রুমি’। আসমা মেয়েটিকেও সে নির্দেশনা দেয় তাকে ‘বাবা রুমি‘ সম্বোধন করে চিঠি লিখতে। এবং প্রথম পৃষ্ঠায় ঘরবাড়ির কথা জানিয়ে দ্বিতীয় পৃষ্ঠা থেকে আসল চিঠি শুরু করতে। হাউস মাস্টারের কাছে যে অগণিত চিঠি জমা পড়তো তার সবটুকু তিনি কখনই পড়তেন না। শুরু আর শেষের কিছুটা পড়েই রেখে দিতেন। তাছাড়া খামের ওপর রুমির মায়ের নাম আসমা আহমেদই লেখা থাকতো। ফলে মায়ের বাধ্য ছেলের চিঠির আড়ালে রুমি বেশ কিছুকাল প্রেম চালিয়েছিল ভালোই। বালকেরা যখন সব প্রেমের ঘোরে মগ্ন মিলনের তখন জাগে নতুন ঝোঁক।

চব্বিশ
কী রকম ঝোঁক?
মিলন একদিন এসে আমাকে বলে, সে ঠিক করেছে এই চত্বর থেকে বেরিয়ে সে শুরু করবে সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ। সে পত্রিকায় দেখেছে, স্পেনের এক নাগরিক সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করতে বের হয়ে এসে পৌঁছেছে বাংলাদেশে। এ খবর পড়ে তার মনে হয়েছে সে খুঁজে পেয়েছে তার মুক্তির উপায়। তার মনে হয়েছে, চত্বর থেকে বেরিয়ে সে যদি বিশ্বভ্রমণে নেমে পড়তে পারে তাহলে তাকে আর সেনাবাহিনীতে যেতে হবে না, ফিরে যেতে হবে না তার বাবার সংসারে। আমি বলি, ‘বিশ্বভ্রমণ যে করবি অত টাকা পাবি কোথায়?’ মিলন হেসে উড়িয়ে দেয় আমার কথা। বলে, ‘বিশ্বভ্রমণ করতে টাকা লাগে না একটাও।’ মিলন বলে, একেক দেশে গিয়ে মাঠে কাজ করবে, কারখানায় কাজ করবে সে, সেই উপার্জন হাতে নিয়ে পাড়ি দেবে পরবর্তী পথ। যেখানে রাত হবে সেখানেই কারো বাড়িতে থেকে যাবে অতিথি হয়ে। সে আমার সঙ্গে পরামর্শ  করে সাইকেলে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বের হলে ভালো হবে নাকি পায়ে হেঁটে। এসময় মিলনের অভিনিবেশের বিষয় হয় আমাদের লাইব্রেরির এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকাগুলো। ব্রিটেনিকা দেখে-দেখে সে তালিকা করে পৃথিবীর কোথায় গিয়ে কী কী দেখবে। আমি তার সঙ্গী হয়ে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার পাতা ওলটাই। ঢুকে যাই বিবিধ, বিচিত্র সব জগতে। বিস্ময়ে দেখি ঈস্টার দ্বীপের মূর্তিগুলো, চোখ রাখি তুতেনখামেনের মমিতে, কখনো সাইবেরিয়ার স্তেপের ধুধু প্রান্তরে। লাইব্রেরি থেকে অ্যাটলাস বের করে মিলন আমাকে দেখায় কোন কোন পথে ভ্রমণ করা যেতে পারে। আমরা দুজন যখন ম্যাপের ওপর আঙুল রেখে বিশ্বভ্রমণ করছি তখন আমাদের ক্লাসের ছেলেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে চত্বরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে।

পঁচিশ
চত্বরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ধরনটা কেমন?
ক্লাস ইলেভেনে ওঠার পর চত্বরের ভেতরের নানা ভয়ভীতি তখন অনেকটাই কমে এসেছে আমাদের। শাস্তি পাবার ঝুঁকিও কম। আমাদের ওপর তখন কেবল ক্লাস টুয়েলভ। আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও তখন আর তেমন বৈরিতার নয়। অনেকটা বন্ধুত্বের। অচিরেই এই ক্লাস টুয়েলভ চত্বর থেকে বিদায় নেবে আর তখন আমরাই হব সর্বেসর্বা। ফলে আমাদের ক্লাসে অনেকে তখন থেকেই শুরু করে চত্বরে তাদের আধিপত্যের মহড়া। ক্ষমতা প্রদর্শন করে জুনিয়রদের নানাভাবে নাজেহাল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আরো একটি ব্যাপার তখন আমাদের ক্লাসের সবার মনকে দখল করে রেখেছে। এই চত্বরের নানারকম ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করে ক্লাস টুয়েলভের ক্ষুদে খাকিরা। সুতরাং নিয়ম অনুযায়ী অচিরেই আমাদের ক্লাস থেকেই নির্বাচন করা হবে হাউস ক্যাপ্টেন, গেমস ক্যাপ্টেন, কলেজ ক্যাপ্টেন ইত্যাদি। এ নিয়েই একটি চাপা প্রতিযোগিতা শুরু হয় ক্লাসের অনেকের ভেতর। শুরু হয় খাকি চত্বরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।
আমাদের ক্লাসে ছেলেদের তখন একটি বড় আলোচনা আমাদের ব্যাচে কে হবে কলেজ ক্যাপ্টেন? আমাদের তিন হাউসের ভেতর থেকে কোন হাউস থেকে কলেজ ক্যাপ্টেন হবে সেটা ছিল একটি প্রতিযোগিতার বিষয়। যে হাউস থেকে কলেজ ক্যাপ্টেন হবে সেটি সেই হাউসের একটি মর্যাদার ব্যাপার, সেই সঙ্গে চত্বরের ক্ষুদে খাকিদের সর্বময় কর্তা যদি নিজের হাউসে থাকে তাহলে তার ক্লাসে অন্যরাও বিভিন্ন সময় খানিকটা বাড়তি সুবিধার সুযোগ পায়। ফলে সবাই চাইতো কলেজ ক্যাপ্টেন হোক তাদের হাউস থেকে। আমাদের ব্যাচে কলেজ ক্যাপ্টেনের দাবিদার ছিল দুজন। আমাদের হাউজের ইফতি আর সবুজ হাউসের রবিউল। কলেজ ক্যাপ্টেন হতে হলে প্রয়োজন চত্বরের সব কর্মকাণ্ডের কিছুটা করে দক্ষতা। পড়াশোনা, খেলাধুলা, বক্তৃতা দেওয়া ইত্যাদি। ইফতি আর রবিউল এসব ব্যাপারেই মোটামুটি সমকক্ষই ছিল। তবে ইফতির বাড়তি যোগ্যতা ছিল এই যে, সে ভালো ইংরেজি জানে, গান গাইতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা ইফতির বাবা ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ফলে আমরা দেখতাম ইফতিকে শিক্ষকরা খানিকটা সমঝে চলতেন। ফলে অলিখিতভাবে এমন একটা ধারণা মোটামুটি প্রচলিত ছিল যে, ইফতিই আমাদের চত্বরের পরবর্তী কলেজ ক্যাপ্টেন। ওদিকে সবুজ হাউসের ছেলেরা প্রচার করতো রবিউলই হবে পরবর্তী কলেজ ক্যাপ্টেন। একটা চাপা উত্তেজনা ছিল এ নিয়ে। তারপর এক কাণ্ড ঘটে একদিন।
একটি তুচ্ছ ঘটনা বেশ বড় আকার ধারণ করে। একদিন ক্লাস ইলেভেনের কিছু ছেলে কলেজের গ্যালারিতে বসে টিভি দেখছিল ডিনারের পর। তখন হাওয়াই ফাউভ নামে একটি সিরিজ হতো। সেটাই দেখছিল সবাই।  নীল, লাল, সবুজ সব হাউসের ছেলেরাই ছিল। সবুজ হাউসের ছেলেরা এক কোনায় বসে কথা বলছিল বেশ। হঠাৎ ইফতি চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘ইউ শাট আপ।’ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে সবুজ হাউসের রবিউল, সে ইফতির দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে, ‘হু আর ইউ টু টেল আস হোয়াট উই আর সাপজড টু ডু?’ ইফতি পালটা বলে, ‘আই অ্যাম দ্য কলেজ ক্যাপ্টেন টু বি, ইউ শুড লার্ন হাউ টু ওবে মাই অর্ডারস।’ এটুকু বলতেই রবিউল ইফতির দিকে তেড়ে এসে ‘ড্যাম ইয়োর কলেজ ক্যাপ্টেন’ বলে ইফতিকে একটি ঘুসি মারে। পালটা ঘুসি মারে ইফতি। তখন ইফতির সমর্থনে এগিয়ে আসে নীল হাউসের অন্যরা। এই থেকে শুরু হয়ে যায় সবুজ আর নীল হাউসের ছেলেদের মধ্যে মারামারি। লাল হাউসের অধিকাংশ ইফতিকে পছন্দ করতো না ফলে তারা নেয় সবুজ হাউজের পক্ষ। আমরা অনেকে তখন হাউসেই রয়ে গেছি। দল ভারি করার জন্য গ্যালারি থেকে একজন আমাদের হাউসে এসে সবাইকে গ্যালারিতে যেতে বলে। আমরা দ্রুত সেখানে গিয়ে দেখি বেশ একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে গ্যালারিটি। আমি আর মিলন এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার স্পৃহা পাই না। চেষ্টা করি যুদ্ধ থামাতে। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে অ্যাডজুট্যান্ট এসে হাজির হন। সবাইকে প্রবল ধমকে শান্ত করেন তিনি এবং পরদিন সবাইকে অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হতে বলেন। পরদিন অডিটোরিয়ামে আমরা জড়ো হলে প্রিন্সিপাল গম্ভীর মুখে সেখানে উপস্থিত হন এবং বলেন আমরা যা করেছি তা ক্ষমাহীন অপরাধ। বলেন, এ ঘটনার একটি পুরো তদন্ত হবে। তিনি অ্যাডজুট্যান্ট এবং তিন হাউসের হাউস মাস্টারকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি করেন। তদন্ত দল একেক হাউসের সঙ্গে পৃথকভাবে বসেন, ঘটনার বর্ণনা শোনেন। শেষে প্রিন্সিপালের কাছে রিপোর্ট পেশ করেন। একদিন ইফতি আর রবিউল দুজনকে ডেকে প্রিন্সিপাল বলেন চত্বরে এরকম ন্যক্কারজনক ঘটনার সূত্রপাতের জন্য তাদের দুজনকেই চত্বর থেকে বহিষ্কার করা হবে। এ-সংবাদ শোনার পর সবার ভেতর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সবার ভেতর হঠাৎ যেন জাগে সহমর্মিতার জোয়ার। দুদিন আগেই যারা পরস্পর হাতাহাতি করে রণক্ষেত্র বানিয়ে তুলেছিল চত্বরকে, তারাই সহপাঠীকে বাঁচাতে হয়ে ওঠে একজোট। নীল, লাল, সবুজ সব হাউসের ছেলেরাই পণ করে ইফতি আর রবিউলকে চত্বর থেকে বহিষ্কার করা হলে পুরো ক্লাসই চত্বর ছেড়ে চলে যাবে। সবাই প্রিন্সিপালের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ স্বরূপ একদিন প্যারেড বয়কট করে। বিদ্যমান কলেজ ক্যাপ্টেন এসে আদেশ করেন, অ্যাডজুট্যান্ট এসে আদেশ করেন, তবু কেউ প্যারেডে যায় না।
চত্বরের পরিপ্রেক্ষিতে এটি বিরাট দুঃসাহস, রীতিমতো বিদ্রোহ। চত্বরের বাইরের রাজনীতির খবর আমরা জানতাম না, ভাষা আমরা জানতাম না, তবু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চত্বরের ভেতরই জন্ম নিয়েছিল চত্বরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভাষা। পুরো ক্লাস একসঙ্গে এভাবে বিদ্রোহ করাতে প্রিন্সিপালের পক্ষে অবস্থা সামাল দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একদিন দেখি চত্বরে এসে হাজির হয়েছেন দেশের খাকি চত্বরগুলোর প্রধান মেজর জেনারেল। তিনি আমাদের পুরো ক্লাসের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এক খাকি চত্বরে দুই ক্লাসের মারামারির ঘটনায় এত বড় একজন সামরিক কর্মকর্তা এসে হাজির হওয়াটা ছিল খানিকটা অপ্রত্যাশিত। যদিও অবশ্য কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ ওই চত্বরের পরিপ্রেক্ষিতে এটি ছিল মারাত্মক ঘটনা। আমরা বহুকাল পরে টের পেয়েছি এ ঘটনা শুধু ওই খাকি চত্বরের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, পুরো দেশের পরিপ্রেক্ষিতেও সেসময় ছিল বেশ মারাত্মক একটি ঘটনা। আমরা যখন এ কাণ্ড ঘটাচ্ছি তখন বস্তুত দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে ঘটে গেছে কিছু অভ্যুত্থানের ঘটনা। সেনাবাহিনীর ভেতর তখন অস্থিরতা। আমাদের এই ক্ষুদে সেনা চত্বরের সামান্য ওই অসন্তোষকেও তাই ভয় পেয়েছিলেন সেনাকর্তারা। সেদিনের সেই মেজর জেনারেল চত্বরে এসে অবশ্য কোনো কড়া অবস্থান নেননি। তিনি এসে আমাদের জানালেন, কাউকে চত্বর থেকে বহিষ্কার করা হবে না। তিনি পারস্পরিক বোঝাপড়া, টিমওয়ার্ক ইত্যাদির গুরুত্বের ওপর বক্তৃতা দিলেন। তবে এও বললেন, সেটাই আমাদের শেষ সুযোগ। দ্বিতীয়বার এমন কোনো ঘটনা ঘটলে পুরো ক্লাসকে চত্বর থেকে বহিষ্কার করতে কর্তৃপক্ষ দ্বিধা করবে না একটুও। বিদ্রোহ সফল হলেও এ-ঘটনার পর নীল, লাল, সবুজ হাউসের ভেতর পারস্পরিক সম্পর্ক হয়ে পড়ে শীতল। আর এর কিছুদিন পরই আমরা হারাই রুমিকে।

ছাব্বিশ
কী করে হারালাম রুমিকে?
এসময় আমাদের সব কাজেই শিথিলতা। চত্বরের প্রথম তিন-চার বছর ঘণ্টা বাজার পর কত দ্রুত প্যারেড, পিটিতে গিয়ে ফল ইন করবো ছিল সেই উৎকণ্ঠা। কিন্তু চত্বরের পঞ্চম বছরে এসে ঘণ্টা বাজলে কোনোরকম জুতার ফিতা লাগিয়ে, শেষ মুহূর্তে খাকি প্যান্টের ভেতর তড়িঘড়ি করে শার্ট গুঁজে, বেল্ট লাগাতে-লাগাতে কারো সঙ্গে গল্প করতে-করতে গিয়ে দাঁড়াই লাইনে। এসময় নামাজ ফাঁকি দিয়ে হাউসে বসে সিগারেট খায় অনেকেই। একবার হাউস বেয়ারা জাকির ভাই জানালেন, পাশের বাজারের সিনেমা হলে অলিভিয়া নামে নতুন এক নায়িকার ছবি এসেছে। এরপর পালা করে অনেকেই লাইটস অফের পর কাঁটাতার ডিঙিয়ে চত্বর পালিয়ে দেখে আসে সেই ছবি। রাজীব বা তার মতো কয়েকজন অতি পড়–য়া ছেলে বাদে সবার পড়াশোনাতেই এসময় মনোযোগ যায় কমে। টার্ম পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে অনেকেরই। স্যাররা নানাভাবে সতর্ক করতে থাকেন আমাদের। ক্লাস ইলেভেনের শেষ টার্ম পরীক্ষায় অঙ্ক খুব খারাপ হলো রুমির। সে টের পেল নির্ঘাত ফেল করবে। রুমি অনেকদিন থেকেই নানা রকম কাণ্ড করে আসছে কিন্তু ওই শেষ টার্মের পর এমন এক অপকর্ম করলো যে ওকে আর রক্ষা করা গেল না। আমাদের নতুন এক অঙ্কের স্যার এসেছিলেন মোজাফফর নামে। তিনি ছিলেন আমাদের হাউস মাস্টার। ব্যাচেলর মানুষ। তিনি আমাদের হাউসের ওপরের একটি কক্ষেই থাকতেন। রুমি জানতো স্যার অঙ্কের পরীক্ষার খাতাগুলো তার রুমে এনে রেখেছেন। রুমি এক দুঃসাহসী পরিকল্পনা করে তখন। সে সিদ্ধান্ত নেয় স্যারের রুম থেকে তার খাতাটা চুরি করে অঙ্কগুলো ঠিক করে সেটা আবার রেখে আসবে রুমে। স্যারের রুমের অতিরিক্ত একটি চাবি ছিল হাউস বেয়ারা জাকির ভাইয়ের কাছে। জাকির ভাইকে বিপুল বখশিশ দিয়ে সে চাবিটি বাগিয়ে নেয়। স্যারসহ সব ছাত্ররা যখন নামাজে সে তখন স্যারের রুমে ঢোকে খাতা চুরি করতে। দুর্ভাগ্য রুমির, সেসময় হাবিলদার মেজর শরীফ সারপ্রাইজ চেকিংয়ে হাউসে এসে ধরে ফেলে রুমিকে। প্রিন্সিপালের কাছে রিপোর্ট যায়, বেরিয়ে আসে পুরো ঘটনা। রুমির নামে নানারকম নেতিবাচক রেকর্ড আগে থেকেই ছিল প্রিন্সিপালের কাছে, তাকে সতর্কও করা হয়েছিল। আগের নানা ঘটনায় রক্ষা পেয়ে গেলেও এই ঘটনায় আর রক্ষা হলো না। এমন একটি কাণ্ড করেছে রুমি যে তার পক্ষে দাঁড়ানোরও আমাদের আর কোনো উপায় রইলো না। প্রিন্সিপাল এবার সরাসরি রুমিকে বহিষ্কার করলেন চত্বর থেকে। আর হাউস বেয়ারা জাকির ভাইয়ের চাকরি গেল। এ ঘটনায় আমরা সবাই খুব মুষড়ে পড়লাম। রুমি ছিল আমাদের অনেক আনন্দের উৎস। চোখের জলে তাকে বিদায় দিলাম আমরা। বিষণœ মনে আমরা সবাই চলে গেলাম টার্ম শেষের ছুটিতে।
ছুটি শেষে যখন ফিরে এলাম আমরা তখন ক্লাস টুয়েলভে। সেটাই ছিল ওই চত্বরে আমাদের শেষ বছর। আমরা ফিরে আসার পর ঘোষণা করা হলো, আমাদের ভেতর কে হবে কোন ক্যাপ্টেন। আমরা দেখলাম ইফতি বা রবিউল দুজনের কাউকেই কলেজ ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দেওয়া হলো না। কলেজ ক্যাপ্টেন হলো কসকো। স্যারদের একান্ত বাধ্য, হিসেবি ভালো ছাত্র আমাদের হাউসের রাজীব। ছুটি থেকে ফিরে আরো লক্ষ করলাম মিলনের বিশ্বভ্রমণের আগ্রহ উবে গেছে। বললো, ‘ওসব পাগলামি। হবে না।’ জানালো এই ছুটিতে ওর বাবা আবারও তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে দ্রুততম সময়ে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পেশা হচ্ছে সেনাবাহিনী। সুতরাং মিলন যেন মনকে সেভাবেই প্রস্তুত করে। আমি দেখতে পাই এবার ছুটির পর মিলনের অন্তর্গত অস্থিরতা বেড়েছে আরো। আমার কাছে জানতে চায়, ‘চত্বর থেকে বেরিয়ে তুই কী করবি?’ আমি ঠিক জানতাম না কী করতে চাই আমি। আমার বাবার কাছ থেকে কোনো বিশেষ নির্দেশও ছিল না। বাবা-মা কেবল বলতেন, তোমাকে মানুষ হতে হবে। মানুষ হওয়া কাকে বলে তাদেরও কোনো ধারণা ছিল বলে আমার মনে হয় না। আমিও জানতাম না মানুষ ঠিক কীভাবে হতে হয়। আমার মনে হতো এই পেঁচার চোখে পৃথিবীকে দেখতে-দেখতে যদি কাটিয়ে দেওয়া যেত তাহলেই হতো সবচেয়ে ভালো। কিন্তু ভবিষ্যতে কী ঘটবে না ঘটবে তা নিয়ে আমরা তেমন ভাবিত ছিলাম না তখন। বর্তমানেই ডুবে ছিলাম সবাই। কেবল মিলনকে দেখতাম চত্বরের পরবর্তী জীবন নিয়ে ভাবিত। সে বরাবরের মতো কবিতার ভেতর অস্থিরতার প্রশমন ঘটাতে চাইতো। বারবার ফিরে যেতো জীবনানন্দের কাছে। আবৃত্তি করতো :
মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমরাও পড়ে                                                       থাকি
বিয়োগের বিয়োগের মরণের মুখে এসে পড়ে সব
ঐ মৃত মৃগদের মত।
প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন লয়ে বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা                                                      মৃত্যু পাই
পাই না কি?
এরপর একটি বিস্ফোরণ ঘটে চত্বরে শফিক স্যার আসবার                                                            পর।

সাতাশ
কী ধরনের বিস্ফোরণ?
আমাদের পুরনো বাংলা শিক্ষক মতিন স্যার চলে গেলে আসেন শফিক আহমেদ নামে নতুন এক তরুণ বাংলা শিক্ষক। মতিন  স্যার ছিলেন নেহাতই পুরনো ধাঁচের এক শিক্ষক। তিনি কবিতার সারাংশ, বাক্যের ভাব সম্প্রসারণ ইত্যাদি পড়াতেন। ‘সাঁঝের মায়া’ কবিতায় কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন, এই ধরনের প্রশ্ন করতেন। নতুন এই শফিক স্যার আমাদের ক্লাসে এসে বললেন, সিলেবাসের যে মেজর লেখকদের লেখা আছে তিনি শুধু তাদেরই পড়াবেন। মাইনর লেখকদের লেখা তিনি পড়াবেন না। ওগুলো আমাদের নিজেদেরই পড়ে নিতে হবে। আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। ভাবলাম, এ আবার কী ধরনের কথা? মেজর লেখক, মাইনর লেখক আবার কী জিনিস? শফিক স্যার বললেন, ‘সিলেবাসে বন্দে আলী মিয়ার যে-কবিতা আছে সেটা আমি পড়াবো না, বরং রবীন্দ্রনাথ নিয়ে দুুটা ক্লাস বেশি নেব।’ তিনি সেদিন রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পটি পড়ালেন। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের কথা বলতে গিয়ে তিনি চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের আরো সব কিশোর চরিত্রের কথায়, তিনি বিভূতিভূষণের অপুর কথা বললেন, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের কথা বললেন। উল্লেখ করলেন বিশ্বসাহিত্যের নানা কিশোর চরিত্রের কথাও। বললেন চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ডের কথা, ম্যাক্সিম গোর্কির আমার ছেলেবেলার কথা। বললেন সাহিত্যের একটি চরিত্রকে দেখতে হবে পুরো দেশের, পুরো পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে। আরো বললেন, ‘যাদের কথা বললাম, এরা সবাই কিন্তু তোমাদের মতো কিশোর। আমি চাই এই লেখাগুলো পড়তে গিয়ে তোমরা ভাবো লেখক কৈশোরকে কীভাবে দেখেছেন। নিজের কৈশোরের সঙ্গে সেই ভাবনাগুলোকে মেলাও। সাহিত্য তো শুধু সিলেবাস পাশ করার ব্যাপার না। সাহিত্য আমাদের নিজেদের চিনতে সাহায্য করে। জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা বাড়ায়। তোমরা এখানে একটা খাঁচার ভেতর বড় হয়েছো আর কিছুদিন পরই তো তোমরা বেরিয়ে যাবে এই খাঁচা থেকে। গিয়ে পড়বে সত্যিকার জীবনে। এখনই তোমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জীবনকে নিয়ে ভাবার। বঙ্কিমচন্দ্র একবার লিখেছিলেন, এ জীবন লইয়া কী করিব, এ জীবন লইয়া কী করিতে হয়? কখনো নিজেকে এ প্রশ্ন করে দেখেছো?’
নতুন এই শিক্ষকের ক্লাসে ছেলেরা বিভ্রান্ত। অধিকাংশ ছেলে মোটেও পছন্দ করলো না শফিক স্যারকে। রাজীব তো বেশ ক্ষেপে গেল, বললো, ‘সিলেবাস না পড়ায়ে এইসব উলটাপালটা কথা বললে আমরা পরীক্ষা পাশ করবো কী করে?’ আমার অবশ্য ভালো লাগলো খুব শফিক স্যারের ক্লাস। মিলন ভীষণ উত্তেজিত। মিলন আমাকে  বলে, ‘এক্সাক্টলি এই প্রশ্ন নিয়েই তো সারাক্ষণ ঘুরছি মাথায়। এ-জীবনটা নিয়ে কী করবো। কী করতে হয়?‘ শফিক স্যারের ক্লাস করার পর আমাদের দুজনের মনে হলো, আমরা যেন নতুন একটি গ্রহে গিয়ে পড়লাম। সেদিন স্যার ক্লাসে যে যে লেখকের নাম বললেন, বইয়ের নাম বললেন আমরা লাইব্রেরিতে গিয়ে সেগুলো খুঁজে বের করলাম। উলটেপালটে দেখলাম। একটা একটা করে ইস্যু করে পড়বো ঠিক করলাম। আমরা দুজন গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম তার পরবর্তী ক্লাসের জন্য। পরবর্তী ক্লাসে তিনি পড়ালেন কবিতা নিয়ে। বললেন কী করে কবিতা শব্দ দিয়ে তৈরি করে মায়ার পৃথিবী। বললেন কবিতার ভেতরও থাকে জীবনজিজ্ঞাসা। আমাদের সিলেবাসে ছিল না তবু তিনি পড়ালেন জীবনানন্দের ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতাটি। সেই লাইন কটি আলাদা করে উল্লেখ করলেন বারকয়েক :
অর্থ নয় কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়,
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে।
বললেন, ‘বিপন্ন বিস্ময়’ কথাটা বোঝো? জীবনে অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতা এসবই কিন্তু শেষ কথা নয়। জীবনের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হওয়ার ব্যাপারও আছে। পৃথিবীতে, জীবনে কত কিছু আছে বিস্মিত হওয়ার। বহু মানুষ কোনো কিছু নিয়ে বিস্মিত না হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয় শুধু অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতার পেছনে। আবার বিস্ময় কোনো কোনো মানুষকে ক্লান্তও করে তুলতে পারে। যেমন এই কবিতার মানুষটিকে করেছে। কিন্তু কবি এখানে সেই ক্লান্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। কবিতার লোকটি বিস্ময়ে বিপন্ন হয়ে এক গাছা দড়ি হাতে অশ্বত্থের ডালের কাছে গেছে ঠিকই কিন্তু কবিতার শেষে দেখবে কবি কিন্তু সে-পথে যেতে চাননি, বলছেন পেঁচার সঙ্গে মিলে জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার শূন্য করতে চান তিনি।’
শফিক স্যারের এইসব কথা অধিকাংশের কাছেই দুর্বোধ্য ঠেকে। মিলন অবশ্য গোগ্রাসে গেলে স্যারের প্রতিটি কথা। হাউসে ফিরে রাতে ডিনারের পর পোর্চে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি আর মিলন শফিক স্যারের ক্লাস নিয়ে গল্প করি। মিলন বলে, ‘আট বছর আগে একদিন’ আমি অনেকবার পড়েছি। তুই পড়ে দেখবি একদিকে স্যার যেটা বলেছেন সেটা ঠিক যে, কবিতাটায় লোকটা যে আত্মহত্যা করলো জীবনানন্দ তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। কিন্তু পুরো কবিতাজুড়ে কিন্তু লোকটাকে ডিফেন্ডই করেছেন তিনি। বলেছেন, লোকটা মরে যাওয়াতে তাকে জাগিবার অবিরাম অবিরাম ভার আর সইতে হবে না। আর লোকটা গলায় ফাঁসি দেওয়ার জন্য এত গাছ থাকতে অশ্বত্থ গাছের কাছে গেল কেন? অশ্বত্থ গাছের নিচে তো বুদ্ধ বসেছিলেন। সে গাছের কাছে গিয়েই নতুন একটা জীবন পেয়েছিলেন বুদ্ধ। কবিতার ওই লোকটাও কি অশ্বত্থের কাছে গিয়ে নতুন একটা জীবন পেয়েছিল?’
পরের ক্লাসে শফিক স্যার এসে বলেন, ‘আজ আমি ক্লাস নেবো না। তোমাদের কথা শুনবো। জানতে  চাইবো তোমরা জীবনে কে কী হতে চাও, কী করতে চাও। তোমাদের মধ্যে কারা কারা ঠিক করে ফেলেছো এই চত্বর থেকে বেরিয়ে কী করবে?‘ অনেকেই হাত তোলে।
তিনি বলেন ‘আমি শুনতে চাই কে কী হতে চাও এবং কেন?‘
বেশ কজন হাত তুলে বলে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায়। সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে তারা দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারবে। সোবহান হাত তুলে বলে সে ডাক্তার হতে চায়। কারণ ডাক্তার হলে সে তার নেত্রকোনার গ্রামে ফিরে গিয়ে জনসেবা করতে পারবে। ইফতি বলে, সে আমেরিকায় যেতে চায় এবং সেখানে গিয়ে সে নাসার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। রাজীব বলে, সে শিক্ষকতা করতে চায় কারণ শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। অনেকেই হাত তোলে না। তারা বলে, তারা এখনও নিশ্চিত না কী করতে চায়। আমি আর মিলনও হাত তুলি না।
স্যার এরপর বলেন, ‘আর কিছুদিন পরই এই চত্বর থেকে তোমরা সবাই বেরিয়ে যাবে অথচ দেখো তোমরা অধিকাংশই জানো না জীবনে তোমরা কী করতে চাও, কী হতে চাও। জীবন নিয়ে তোমাদের কোনো ভিশন তৈরি হয়নি। আর যারা তোমরা তোমাদের জীবনের লক্ষ্যের কথা বললে সেগুলোও খুব মুখস্থ করা কথা, বইয়ের কথা। একজন বলছো গ্রামে গিয়ে ডাক্তারি করবে। ছয় বছর টাই পরে আর কাঁটাচামচ দিয়ে ইংলিশ ডিনার খাওয়ার পর নেত্রকোনায় গিয়ে ডায়রিয়ার চিকিৎসা করতে মন বসবে তোমার? একজন তো এদেশের খেয়ে-পরে এখন তার মেধা বন্ধক রাখতে চায় আমেরিকার নাসাতে। তুমি কি জানো সারা পৃথিবীতে আমেরিকার কী ভূমিকা, নাসার কী ভূমিকা? একজন শিক্ষক হতে চাও। শিক্ষকের তথাকথিত মহান পেশায় যেতে হলে তোমাকে অনেক ত্যাগ, মোহ ত্যাগ করতে হবে, হয়তো বা মানবেতর জীবন কাটাতে হবে। তুমি কি প্রস্তুত আছো তার জন্য? সেনাসদস্য হয়ে দেশসেবা করতে চাও অনেকে। দেশের নিরাপত্তার কথা বলছো তোমরা, কিন্তু জানো না সেনাবাহিনী দেশের রাজনীতিতে কত ভয়ানক বিতর্কিত ভূমিকাও রেখেছে। আসলে তোমরা কখনো ভালোভাবে নিজের দিকে তাকাতে চেষ্টা করোনি, নিজের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করোনি। বোঝার চেষ্টা করোনি তোমার দেশটাকে। কিছু বানানো কথা শোনালে আমাকে। তোমরা এই চত্বরে একটা বাবলের  ভেতর বড় হচ্ছো। এসব কথা বলছি কারণ যে অঢেল সুযোগ-সুবিধা তোমরা এ চত্বরে পাও তা এদেশের লাখ লাখ ছেলেরা কল্পনাও করতে পারবে না। ফলে তোমাদের কাছে প্রত্যাশা অনেক।’
স্যারের এসব কথায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় ছেলেদের মধ্যে। ক্ষিপ্ত হয় তারা। ডিনারের পর ফ্রি টাইমে তর্ক-বিতর্ক উঠে এই নিয়ে। যারা সেনাবাহিনীতে যাবে তারা বলে, ‘সেনাবাহিনী নিয়ে এভাবে কথা বলা একদমই ঠিক হয়নি স্যারের। সেনাবাহিনী কি দুএকটা বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছে তাতে কি সেনাবাহিনীর গুরুত্ব কমেছে। একটা দেশের ডিফেন্স ঠিক না করে শুধু বঙ্কিমচন্দ্র পড়লে হবে?’ তারা বলে, ‘দেশের কোথাও যেখানে ডিসিপ্লিন নাই এই খাকি চত্বর সেখানে আমাকে ডিসিপ্লিন শিখিয়েছে।’ ইফতি বলে, ‘এই খাকি চত্বর আমাকে এমবিশাস হতে শিখিয়েছে। আমার মেধা যদি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশে খাটাতে পারি তাতে অসুবিধা কী? আমেরিকা যদি এত খারাপ হবে তাহলে ওরা এত উন্নতি করলো কী করে?’ সোবহান বলে, ‘স্যার কি মনে করেন গ্রামে গরু চড়ালেই আমার জন্য ভালো হতো। টাই পরে, ইংলিশ ডিনার খেয়ে আমার চোখ গ্রামের ওই গণ্ডি পেরিয়ে অনেক বড় হয়েছে। স্যার কেন মনে করছেন আমি আবার গ্রামে ফিরে যেতে পারবো না।’ রাজীব বলে, ‘নিজে শিক্ষক হয়ে স্যার কেন আমাকে শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারে ডিসকারেজ করছেন, বুঝলাম না।’
আমি কোনো মন্তব্য করি না। স্যারের কথাগুলো নিয়ে ভাবি। মন্তব্য করে না মিলনও। আমাকে সে পরে বলে, ‘সবাই যখন তাদের জীবনের লক্ষ্যের কথা বলছিল আমার মনে হচ্ছিল স্যারকে আবুল হাসানের কবিতাটা পড়ে শোনাই।’ আমি শুনতে চাই কবিতাটি। মিলন তার প্রিয় হয়ে ওঠা নতুন কবি আবুল হাসানের কবিতাটি শোনায় আমাকে :
ক্লাস ভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে  ফুলস্কেপ সমস্ত                                                          কাগজ
আমি বাজে ছেলে, আমি লাস্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না
ক্ষমা করবেন বৃক্ষ, আপনার শাখায় আমি সত্য পাখি                                             বসাতে পারবো না
বানান ভীষণ ভুল হবে আর যেহেতু প্র“ফ সংশোধন শিখিনি
ভাষায় গলদ, আমি কি সাহসে লিখবো তবে সত্য পাখি,                                                 সচ্চরিত্র ফুল?
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ আকাঠ
সচ্চরিত্র ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখতে যাই, দেখি
আমার কলম খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে, বিষের পুতুল।
সেদিন রাতে এক কাণ্ড ঘটায় মিলন। স্যারের ক্লাসটির পর থেকে ভেতর-ভেতর খুব অস্থির ছিল মিলন। সেদিন লাইটস অফের পর মিলন বলে, অনেকদিন পর তার আবার বাইরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। বলে আজ রাতে কাঁটাতার পেরিয়ে বাইরে গিয়ে সে অন্ধকারে একা একা কিছুক্ষণ রেললাইন ধরে হাঁটবে, যেমনটা সে করেছিল আরেকবার। কাঁটাতার পেরিয়ে বেরিয়ে যায় মিলন। কিন্তু  ফেরার সময় সেদিন টহলরত দারোয়ানের হাতে ধরা পড়ে যায়। প্রিন্সিপালের কাছে রিপোর্ট করাতে তিনি পরদিন ডেকে পাঠান মিলনকে। আমাদের নতুন প্রিন্সিপাল আবদুর রশীদ। নৌবাহিনীর প্রাক্তন কমান্ডার তিনি। তিনি মিলনকে ডেকে অনেক উপদেশ বাণী শোনান। বলেন, মিলনের বাবা ইতিমধ্যেই প্রিন্সিপালকে জানিয়েছেন যে তিনি চান মিলন সেনাবাহিনীতে যাক। আর একজন সেনা কর্মকর্তার সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সেন্স অব ডিসিপ্লিন।  প্রিন্সিপাল বলেন, মিলন যা করেছে সেটা গুরুতর অপরাধ এজন্য তাকে চত্বর থেকে বহিষ্কার করা যায় কিন্তু তিনি তা করবেন না। তিনি মিলনের বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছেন এবং তিনি চান বাবার সামনে মিলন প্রতিশ্র“তি দিক যে এমন কাজ সে আর করবে না, পড়াশোনায় মনোযোগী হবে। পরদিন মিলনের বাবা আসেন এবং মিলনকে আবার প্রিন্সিপাল অফিসে ডেকে নেওয়া হয়। মিলন এসে আমাকে জানায়, ওর বাবা এসে প্রিন্সিপালের সামনেই প্রচণ্ড জোরে মিলনের গালে চড় মেরেছেন এবং বলেছেন চত্বর থেকে যদি তাকে বহিষ্কার করা হয় তবে সে যেন বাড়িতে না ফেরে। সে যেন ফুটপাতে গিয়ে থাকে, বাড়িতে তার কোনো জায়গা হবে না।
শফিক স্যার এর পরের ক্লাসে আরো বিপজ্জনক সব কথাবার্তা নিয়ে হাজির হন। স্যার এসে বলেন, ‘আমি তোমাদের একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেবো। তোমাদের সবাইকে একটা লেখা লিখতে হবে এই খাকি চত্বরের জীবনের ওপর। আমি ওই চত্বরে নতুন এসেছি। এ চত্বর নিয়ে আমি আমার কিছু পর্যবেক্ষণের কথা বলবো। তোমরা আমার পর্যবেক্ষণকে সমর্থন করতে পারো,  বিরোধিতাও করতে পারো। কিন্তু যুক্তি দিয়ে তোমার অবস্থান ব্যাখ্যা করবে।’
এরপর তিনি তার পর্যবেক্ষণের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি লক্ষ করছি এই চত্বরে তোমরা অর্ধেক সামরিক, অর্ধেক বেসামরিক, খানিকটা ইসলাম, খানিকটা ব্রিটিশ, কিছুটা বাঙালি এমনি সব বিচিত্র কায়দার মিশ্রণে একধরনের প্রশিক্ষণ পাচ্ছো। এইসব প্রশিক্ষণ তোমাদের সকল কাজের কাজি, দেশ-কালের সঙ্গে সম্পর্কহীন একধরনের চটপটে, চৌকস ছেলে হিসেবে তৈরি করছে। কিন্তু তোমাদের জিজ্ঞাসু, বিশ্লেষণী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তৈরি করছে না, যারা এই চত্বর থেকে বেরিয়ে সমাজের বিরাট মেশিনটার চাকাটাকে ঘুরিয়ে দিতে পারবে। নেতার কাজ তো সেটাই। তোমরা বরং তৈরি হচ্ছো এই চত্বর থেকে বেরিয়ে কী করে এই সমাজের বিরাট মেশিনটার নানা সুবিধাজনক জায়গায় নাট-বল্টুর মতো লেগে যেতে পারবে তার জন্য। হয়তো হবে খানিকটা চকচকে নাট-বল্টু।’
স্যার বললেন, তার এই বক্তব্যের সমর্থনে বা বিরোধিতা করে একটা রচনা লিখে তাকে জমা দিতে হবে পরবর্তী ক্লাসে। সেটাই হবে আমাদের পাক্ষিক পরীক্ষা। স্যারের এসব বিপ্লবাত্মক কথায় সবাই রীতিমতো স্তব্ধ। চত্বরে কোনো স্যারের মুখে এসব কথাবার্তা অভূতপূর্ব। খাকি চত্বর নিয়ে অধিকাংশ ছেলের একটি আত্মতৃপ্তি আছে, গর্ব আছে। স্যারের এই সব বক্তব্যে সেই আত্মতৃপ্তি আর গর্বে বিরাট আঘাত লাগে। অনেকেই বলে, রচনা লিখে স্যারের এসব কথার কড়া সমালোচনা করে স্যারকে একেবারে ধুয়ে দেবে। কেউ কেউ বলে, এই অ্যাসাইনমেন্ট তারা করবেই না। আমি স্যারের কথাগুলো নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকি। আমার অবস্থান কী হবে তাই নিয়ে ভাবি। মিলন বলে, সে স্যারের কথাগুলোকে পূর্ণ সমর্থন করে লিখবে। কিন্তু এও লিখবে চত্বরের সবাই একইরকম করে ভাবে না। এই অ্যাসাইনমেন্টের ভেতর দিয়ে সে তার নিজের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর পৌঁছে দেবে স্যারের কাছে।
কিন্তু সে সুযোগ মিলন আর পায় না। স্যারের পরের ক্লাস হওয়ার আগেই আমরা একদিন হঠাৎ জানতে পাই শফিক স্যারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শফিক স্যার নাকি আমাদের ক্লাস ছাড়া অন্যান্য ক্লাসেও এসব কথাবার্তা বলেছেন। প্রিন্সিপাল, এমনকি প্রধান চত্বর কর্মকর্তা মেজর জেনারেলের কানেও গেছে সে কথা। পরের সপ্তাহে শফিক স্যারের চাকরিচ্যুতির নোটিশ আসে। আমাদের সঙ্গে শফিক স্যারের আর শেষ দেখা হয় না।

আটাশ
এ সংবাদে কী প্রতিক্রিয়া হলো মিলনের আর আমার?
আমরা মর্মাহত হলাম। মিলন আলোড়িত হলো খুবই। শফিক স্যার চলে যাওয়ার কদিন পর মিলন এসে বলে শফিক স্যারের অসমাপ্ত কাজটি সে করতে চায়। আমি বলি, ‘কী রকম?’ সে বলে এই চত্বর নিয়ে সবাইকে প্রশ্নতাড়িত করতে চায় সে। সে কিছু প্রশ্ন তৈরি করেছে যা সে বিতরণ করতে চায় এই চত্বরের ছেলেদের ভেতর এবং তাদের উত্তর জানতে চায়। এ ব্যাপারে আমার সহযোগিতা চায় মিলন। আমি তার প্রশ্নমালাগুলো দেখতে চাই। দেখি পাঁচটি প্রশ্ন তৈরি করেছে মিলন :
১. এ চত্বরে কেন এসেছিলে তুমি?
২. এ চত্বর তোমাকে কী দিয়েছে?
৩. এমন একটা চত্বর কী আমাদের মতো দেশের জন্য আদৌ দরকার?
৪. এ চত্বর থেকে বেরিয়ে তুমি কী করতে চাও?
৫. এ চত্বরের জন্য তোমার কি কোন সুপারিশ আছে?
মিলন বলে এই প্রশ্নগুলো সবার কাছে পৌঁছে দিয়ে সে চায় সবাই তাদের এই চত্বরের জীবনটার দিকে একটু বিশ্লেষণী চোখে দেখুক, সেই সঙ্গে সবার উত্তরগুলো হাতে পেলে আমরাও জানতে পারবো এই চত্বরে বালকদের ভাবনা জগৎকে। আর যদি সুযোগ হয় কখনো চত্বর থেকে বেরিয়ে হয়তো এই ভাবনাগুলো জানাতে পারবো বাইরের পৃথিবীকেও। কিন্তু খাকি চত্বরে এরকম গবেষণা ধরনের একটি কাজ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তবু আমরা উদ্যোগ নিই। ঠিক করি কাজটা করতে হবে গোপনে যাতে চত্বরের কর্তৃপক্ষ কিছুতেই জানতে না পারে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই মূলত ক্লাস টেন এবং ইলেভেনের ছেলেদের ভেতরই এই প্রশ্নগুলো বিতরণ করবো কারণ ইতিমধ্যে চত্বর বিষয়ে তারা অনেকটাই অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। আমরা তখন চত্বরের সর্বোচ্চ ক্লাসের ছেলে ফলে চত্বরের জুনিয়র ছেলেদের কিছু আদেশ করলে নিয়ম অনুযায়ী তারা তা পালন করতে বাধ্য। আমরা ঠিক করলাম শুরু করবো ক্লাস টেনের ছেলেদের দিয়ে। তাদের আমরা ডিনারের পর ফ্রি টাইমে চত্বরের গ্যালারিতে আসতে আদেশ করবো এবং তখন দ্রুত তাদের কাছে প্রশ্নগুলো বিতরণ করে সেখানেই উত্তরগুলো লিখে দিতে বলবো। প্রিন্সিপাল বা অ্যাডজুট্যান্টের বাইরে চত্বরের সবাইকে কোথাও জড়ো হওয়ার আদেশ দিতে পারে কেবল কলেজ ক্যাপ্টেন। কলেজ ক্যাপ্টেন রাজীব আমাদের হাউসের হওয়াতে সুবিধা হয়। ব্যাপারটা রাজীবকে বুঝিয়ে বলি। রাজীব হিসেবি ছেলে, সে বলে আমাদের এইসব গবেষণার ভেতর সে নেই তবে সে ঘোষণা দিয়ে দেবে ডিনারের পর ক্লাস টেনের ছেলেদের গ্যালারিতে চলে যেতে। কথামতো রাজীব ডিনারে ঘোষণা দেয় এবং ছেলেরা হাজির হয় গ্যালারিতে। আমি আর মিলন আগেই অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং থেকে রাফ করার নামে কাগজ জোগাড় করেছিলাম এবং রাত জেগে প্রশ্নগুলো হাতে কপি করে ফেলেছিলাম। আমরা এরপর গ্যালারিতে আসা ছেলেদের প্রশ্নমালা দিই। তাদের বলি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখানে বসেই দিতে হবে এবং গ্যালারির বাইরে গিয়ে এ নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলা চলবে না। ছেলেরা এই প্রশ্নমালা পেয়ে শুরুতে বেশ হতচকিত হয়ে গেলেও পুরো ব্যাপারটির ভেতর একটি রোমাঞ্চের গন্ধ পেয়ে বেশ উৎসাহিত হয়ে ওঠে এবং মনোযোগের সঙ্গে উত্তর লেখে। আমরা তাদের উত্তরপত্রগুলো নিয়ে ফিরে আসি রুমে। দ্রুত উত্তরগুলোতে চোখ বুলাই। নানারকম কৌতূহলোদ্দীপক উত্তর। আমরা সময় নিয়ে ভালোমতো সব পড়বো এবং এর ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন লিখবো – এই ভেবে উত্তরপত্রগুলো আমার কাবার্ডে লুকিয়ে রাখি। আমাদের এই প্রথম গবেষণা প্রচেষ্টার সাফল্যে আমরা উত্তেজিত থাকি।
কিন্তু এমন একটি ব্যাপারকে ওই চত্বরে গোপন রাখা সহজ ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম জুনিয়র ছেলেরা এ নিয়ে নিজেদের ভেতর কথা বললেও কর্তৃপক্ষের কানে হয়তো দেবে না। কিন্তু আমাদের ওইসব প্রশ্নের ধরন দেখে কেউ হয়তো ভয়েই কোনো এক স্যারকে বলে দিয়েছিল পরদিন। ভেবেছিল এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সে নিজেই কোন বিপদে পড়ে কিনা। আমাকে আর মিলনকে এরপর ডেকে পাঠালেন প্রিন্সিপাল। তিনি বললেন, আমাদের প্রশ্নমালাটি তিনি হাতে পেয়েছেন এবং এই চত্বরে এ ধরনের একটি গবেষণা প্রচেষ্টার দুঃসাহস দেখে অবাক হয়েছেন তিনি। প্রিন্সিপাল মিলনকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, এর আগেই তাকে একবার সতর্ক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এ খবর এখন যদি হায়ার অথরিটির কাছে যায় তাহলে তোমাদের এখনই এক্সপেল করার অর্ডার আসবে। কিন্তু সামনেই তোমাদের পরীক্ষা আর তার কিছুদিন পরই এ ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নেবে তোমরা। সুতরাং এই শেষ মুহূর্তে আমি তোমাদের কোনো বিপদে ফেলতে চাই না। তবে এসব প্রশ্নের আনসার শিটগুলো আমার কাছে জমা দিতে হবে।’
তিনি মিলনকে তার অফিসে রেখে আমাকে হাউসে পাঠান উত্তরপত্রগুলো আনতে। আমি আর উপায়ান্তর না দেখে কথামতো আমার কাবার্ড থেকে উত্তরপত্রগুলো নিয়ে আসি প্রিন্সিপালের অফিসে। আমি উত্তরপত্রগুলো আনলে প্রিন্সিপাল অফিস বেয়ারাকে ডেকে বললেন কাগজগুলো বাগানে নিয়ে গিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে। তিনি বেয়ারাকে বলেন, ‘আই ওয়ান্ট টু সি দ্য অ্যাশেস।’
প্রিন্সিপাল আমাদের হাউসে চলে যেতে বলেন। বলেন, ‘এসব আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। ক্যাম্পাসে আর যে কটা দিন আছো কোনোরকম ঝামেলা করার চেষ্টা করো না।’
আমরা প্রিন্সিপালের অফিস থেকে ফিরে আসতে-আসতে দেখলাম অফিসের পেছনের বাগানে গবেষক হওয়ার আমাদের প্রথম চেষ্টার ফসল আগুনে দাউদাউ করে পুড়ছে।
আমি মিলনকে বলি, ‘প্রিন্সিপাল কাগজগুলো একেবারে পুড়িয়ে ছাই করতে এতো আগ্রহী হলেন কেন বুঝতে পারলাম না। আমাদের না হয় উনি উত্তরগুলো পড়তে দিলেন না; কিন্তু নিজেও তো কৌতূহলী হয়ে পড়তে পারতেন?’
মিলন বলে, ‘যাদের নিয়ে তিনি কাজ করছেন, যাদের জন্য এতো আয়োজন তাদের কণ্ঠস্বর শোনার আগ্রহ যখন একজনের থাকে না তখন বুঝতে হবে উনি সত্যের মুখোমুখি হতে চান না, উনি ভয় পান। প্রিন্সিপালের ভয় আছে ওইসব উত্তর পড়তে গেলে হয়তো এই চত্বর নিয়ে তার বিশ্বাসের ভিত নড়ে যাবে।’

ঊনত্রিশ
তারপরই তো ধীরে-ধীরে উপস্থিত হলো চত্বরে আমাদের অন্তিম মুহূর্ত?
ঠিক তাই। আমরা চত্বরে আমাদের শেষ দিনগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। উপস্থিত হলো চত্বরে আমাদের শেষ পরীক্ষা। আমরা এক-এক করে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে নামলাম। পরীক্ষার দিনগুলোতে মিলন আমাকে প্রায় বলে, ‘আমার মাথায় শুধু একটা ইমেজ ঘুরছে। আমি দেখছি, একটা বিরাট মেশিন আর আমি তাতে একটা নাট-বল্টুর মতো লেগে থেকে শুধু ঘুরছি।’
আমাদের সবার পরীক্ষা শেষ হলেও বাকি থাকে যারা মিলিটারি সায়েন্স নিয়েছিল তাদের পরীক্ষা। বাবার নির্দেশমতো মিলিটারি সায়েন্স নিতে হয়েছিল মিলনের। মিলিটারি সায়েন্সের লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার পর মিলন এসে বলে, পরীক্ষার খাতায় সে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, শুধু প্রতি পৃষ্ঠায় লিখে এসেছে তার আরেক প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ের শিরোনাম, ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই।’ আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে বলি, ‘সত্যিই বলছিস এসব?’ মিলন হাসে। আমি ধরে নিই মিথ্যা বলছে ও।
আমাদের সবার পরীক্ষা শেষ হয় একদিন। ঘনিয়ে আসে আমাদের পাসিং আউট প্যারেডের দিন। চত্বরে আমাদের শেষ প্যারেড। এই প্যারেডের মধ্য দিয়েই চত্বর থেকে বিদায় জানানো হবে আমাদের। এই ঘেরাটোপ থেকে অচিরেই মুক্ত হবো ভেবে পুলকিত থাকি। কিন্তু পাসিং আউট প্যারেডের ঠিক আগের দিন হঠাৎ খুব বিষণœ হয়ে পড়ি। এ চত্বর থেকে সত্যি সত্যি চলে যেতে হবে ভাবতেই হঠাৎ কেমন হাহাকার জাগে বুকে। সেদিন সন্ধ্যায় বরাবরের মতো বিউগল বেজে ওঠে চত্বরে।  নিয়মমাফিক চত্বরের বালকেরা সব দাঁড়িয়ে যায় স্থির হয়ে। ওই শেষ সন্ধ্যায় কোনো নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা আমাদের ছিল না। তবু আমি হাউস থেকে বেরিয়ে চত্বরের অন্য বালকদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াই। দেখতে পাই পোস্ট থেকে নেমে আসা ফ্ল্যাগের ওপারে উড়ে যাচ্ছে সেই চেনা একঝাঁক পাখি। বিউগলের সুরে ক্ষোভ, আক্ষেপ, অনুযোগ ছাড়িয়ে চত্বরের জন্য একধরনের মায়া জাগে। এই চেনা গণ্ডি, এই নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে আগামীকাল পা রাখতে হবে অচেনা আরেক পৃথিবীতে ভাবতে অসহায় বোধ করি। আমার আবার আমাদের বাড়ির সেই চরে ফেলে আসা বিড়ালটির কথা মনে পড়ে যেমন পড়েছিল এই চত্বরের প্রথম দিনটিতেও। সেদিন রাতে আমরা চত্বরের শেষ ডিনার খেয়ে পরের দিনের পাসিং আউট প্যারেডের জন্য তুমুল হই-হুল্লোড় করে শেষবারের মতো মেটাল পোলিশ আর বুট পোলিশে লেগে যাই।
ত্রিশ
এই খাকি চত্বর কি তাহলে আমার ভালোলাগার না অপছন্দের একটি জায়গা?
এর স্পষ্ট উত্তর আমার কাছে নেই। খাকি চত্বরের সাথে আমার সম্পর্কটি জটিল, ধোঁয়াটে। একদিকে মনে হয় কঠোর ওই খাকি চত্বরের ঘেরাটোপ অপহরণ করেছে আমার মধুর শৈশব। অন্যদিকে ওই চত্বরের জীবনের জন্য জাগে মধুর নস্টালজিয়া। আমি বোধহয় স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত। স্টকহোমের এক ব্যাংকের কয়জন কর্মকর্তাকে অপহরণ করে এক অপহরণকারী বন্দি করে রেখেছিল অনেকদিন। তারপর সেই অপহরণকারীর সঙ্গে যারা অপহৃত হয়েছেন তাদের ভেতর গড়ে উঠেছিল গভীর এক আত্মিক সম্পর্ক। শেষে অপহরণকারীকে যখন বিচারের মুখোমুখি করা হয় তখন যারা অপহৃত হয়েছিলেন তারাই গিয়ে দাঁড়ান সেই অপহরণকারীর পক্ষে।

একত্রিশ
তারপর শেষ দিন পাসিং আউট প্যারেড হলো কি?
হলো। খাকি, বুট, বেল্ট পরে শেষবারের মতো মার্চপাস্ট করলাম আমরা সেই চত্বরে। তারপর সেইদিনই এই ছবিটি তুললাম আমরা। পাসিং আউট প্যারেডের দিন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল চত্বর থেকে বহিষ্কৃত রুমি। ওর গায়ে কোনো খাকি ছিল না। ফলে ছবিতে রুমিই একমাত্র খাকিবিহীন। ছবিতে ওই তো রাজীব, ইফতি, সোবহান, রুমি, আমি। সবার চোখে-মুখে ভিড় করে আছে স্বপ্ন। এ-ছবিটি যখন তোলা হচ্ছে আমরা কেউ জানি না কে কোথায় গিয়ে ঠেকবো। কিন্তু এখন তো জানি কে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। যেখানে যে গিয়ে ঠেকেছে বস্তুত সেখানেই কি যাওয়ার কথা ছিল তার? মাঝের খাকি চত্বরের কয়টা বছর কি তাহলে অলীক আয়োজন? পেঁচার চোখে ছবিটির দিকে আবার ভালো করে তাকাই। দেখতে পাই বিরাট মেশিনের অগণিত নাট-বল্টু। অনেকগুলো চকচকে, কিছু কিছু মরচে পড়া। কিন্তু ছবিতে মিলন নেই।

বত্রিশ
মিলন নেই কেন?
কারণ মিলনের থাকার কোনো উপায় নেই। পাসিং আউট প্যারেডের আগের রাতে আমরা যখন সবাই মেটাল পোলিশ নিয়ে ব্যস্ত, মিলন আমাকে বলে, সে শেষবারের মতো একবার কাঁটাতারের বেড়ার ওপার গিয়ে রেললাইন বরাবর হেঁটে আসবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘একদিন পরই আমরা সব বেরিয়ে যাচ্ছি এ-চত্বর থেকে। তখন যত ইচ্ছা ওই রেললাইন ধরে হাঁটিস।’
মিলন বলে, ‘তখন তো আর এই নিয়ম ভাঙার রোমাঞ্চটা থাকবে না।’
ফলে মিলন চত্বরের শেষরাতে কাঁটাতার পেরিয়ে চলে যায় বাইরে। আমরা মেটাল পোলিশ, বুট পোলিশ শেষ করি। একসময় লাইটস অফের ঘণ্টা বাজে। পরদিন ভোরে প্যারেডে যেতে হবে বলে আমরা দ্রুত বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমি মিলনের জন্য অপেক্ষা করি। একসময় আমাদের পরিচিত রাতের ট্রেনটির চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই। মিলন আসে না। আমি জেগে অপেক্ষা করি। তারপর হঠাৎ অন্ধকারে শুয়ে বহু মানুষের হই-হট্টগোল শুনতে পাই। বাতি জ্বালিয়ে বাইরে আসি। দেখি কাঁটাতারের ওপার থেকে অগণিত গ্রামবাসী হইচই করতে-করতে এগিয়ে আসছে আমাদের চত্বরের দিকে। এক-এক করে সব হাউসের, সব রুমের বাতি জ্বলে ওঠে। সবাই বেরিয়ে আসি হাউসের বাইরে। কজন গ্রামবাসী  হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে এই চত্বরের একটা ছেলে ট্রেনে কাটা পড়েছে।