গহিনে প্রলয়

কেন যেন হঠাৎ চমকে ওঠে খাদিজা। ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু এখন তো ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা নয়। খাদিজা কিছুই বুঝতে পারে না। বুকের ভেতর থেকে অজানা ভয়ের আবহ ধীরে ধীরে তার চেতনাকে যেন আচ্ছন্ন করে দিতে থাকে। চারদিকে গভীর রাতের নিকষ কালো অন্ধকার যেন সবকিছু জুড়ে একটা কালো চাদর বিছিয়ে রেখেছে। ঘুমভাঙা পাখপাখালিরও কোনো শব্দ নেই কোথাও। শুধু মাঝে মাঝে কিছুদূর থেকে ভেসে আসছে জলের কেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজ।

খাদিজা কান পেতে রাখে। ঘুমের ঘোরের মধ্যেই অনেকটা ভূতে পাওয়া মানুষের মতো। মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকে দুঃস্বপ্নের ছায়া।

পাশে আট-নয় বছরের ছেলে রহিম নিঃসাড় ঘুমিয়ে আছে। অন্যপাশে ঘুমাচ্ছে মেরাজউদ্দিন। তার স্বামী। একটুও নড়াচড়া নেই, কেমন নির্বিবাদ, গভীর ঘুম। একটু-আধটু শব্দে ওদের দুজনার কারোই ঘুম ভাঙে না। তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাতে হয়। অথচ খাদিজার ব্যাপারটা অন্যরকম। সারাক্ষণ নানা রকম কুচিন্তা মনের মধ্যে আসে আর যায়। দুচিন্তায় মন ভারি হয়ে থাকে দিনমান।

আসলে মেয়েমানুষের স্বভাবটাই হয়তো এ রকম হয়। সংসারের সবাইকে নিয়ে তার নানারকম চিন্তাভাবনা ঘুরতে থাকে মনের মধ্যে। কাউকে বলাও যায় না, অনেক সময় নিজে নিজে সহ্য করাও যায় না।

মেঘনার পাড়ের এই গ্রামে দশ-বারো বছর আগে এসে বাসা বেঁধেছে মেরাজউদ্দিন। আগে ছিল ফরিদপুরের ভেতরে এক গ্রামে। পরের  বাড়ি কামলা খাটত। চাষাভুষার কাজ। কাছে ছিল নিজেদের কোনো রকমের মাথা গোঁজার ঠাঁই।

জমিজমা বলতে কিছুই ছিল না তেমন। বাপ এ-বাড়ি ও-বাড়ি কাজকাম করে খেত। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। মা কাজ করত কাছাকাছি এক বাড়িতে। ঝিয়ের কাজ। এভাবেই চলছিল।

হঠাৎ একদিন ডায়রিয়ায় বাপটা মরে গেল বাড়িতেই। প্রায় বিনা চিকিৎসায়।

দু-তিনদিন কান্নাকাটি করে মেরাজ চলে গেল তার কাজে আর মা পার্মান্যান্ট ঝি হয়ে রইল সেই বাড়িতেই।

ফলে কিছুদিনের মধ্যেই নিজেদের জায়গাটুকু বেহাত হয়ে গেল। কিছু টাকার বিনিময়ে পাশের বাড়ির মানুষরাই জায়গাটুকু নিয়ে গেল। উদ্বাস্তুর পর্যায়ে নেমে গেল মেরাজউদ্দিন।

বাপ-মায়ের সঙ্গে তেমন একটা গভীর সম্পর্ক কোনো দিনই ছিল না তার। এভাবে বাপ মরে যাওয়ার পরে মায়ের সঙ্গে তৈরি হলো আরও দূরত্ব।

অভাবের সংসারে আপন মানুষের সঙ্গেও খুব একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে না। কারণ সবাই থাকে পেটের ধান্দায়। জীবন বাঁচানোর কঠিন সংগ্রামে এক মানুষ আস্তে আস্তে অন্য মানুষে রূপান্তরিত হতে সময় লাগে না।

সবারই হয়তো এমনি হয়। মেরাজউদ্দিনের জীবনেও পরবর্তী সময়ে অলৌকিক কিছু ঘটেনি।

পরের বাড়ির কামলা-খাটা মানুষের নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা থাকে না।

কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হয় এখান থেকে সেখানে, নানা ঠিকানায়। সুস্থির হতে সময় লাগে।

আর সেভাবেই একদিন ভোলার মেঘনা পারের এই গ্রামে, সেই কবে এসেছিল মেরাজউদ্দিন, ঠিক মনে করতে পারে না। এক ঠিকাদারের মাটি কাটার কাজে এখানে এসেছিল তখন সে।

তারপর আবার চলে গিয়েছিল অন্যদিকে। আবার ফিরে এসেছে। কারণ এখানে একটু টান ছিল।

অতিশয় গরিব গৃহস্থ ঘরের মেয়ে খাদিজা। থাকার মধ্যে আছে একটু বসতভিটা। অতি সামান্যই।

জমিজমা বলতে কিছু নেই। খাদিজার বাপের সঙ্গে একটু-আধটু আলাপ ছিল মেরাজের, তাও কাজের মাধ্যমে। দুয়েকটা সুখ-দুঃখের কথাও হয়েছে।

মেরাজের বাপ-মায়ের কথাও হয়েছে কথা প্রসঙ্গে।

খাদিজাদের সংসারে বাবা আর মা আর সে নিজে – সবমিলিয়ে তিনজন। অভাবের সংসার। মেয়ের জন্য স্বভাবতই  দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবা-মা একদিন মেরাজের কাছে প্রস্তাবই দিয়ে ফেলল।

মেরাজ সময় নিল দুদিন। কিন্তু একদিনের মধ্যেই মনস্থির করে রাজি হয়ে গেল প্রস্তাবে।

বিয়ের সঙ্গে আরেকটি সুবিধে হলো – একটা থাকার জায়গা। একটা ঠিকানা তো হলো।

এসব সেই কবেকার কথা। সেই থেকে এই বাড়িতেই থেকে গেছে মেরাজ।

বছরদুই পরে খাদিজার বাবা-মা বছরখানেক আগে-পিছে মরে যাওয়ার পরে এই বসতভিটা মেরাজেরই হয়ে গেছে অলিখিতভাবে। এর মধ্যে জন্ম হয়েছে রহিমের। মেরাজ-খাদিজার একমাত্র – সন্তান বেশ শান্তশিষ্ট, লেখাপড়ায় ভালো।

এদিক-সেদিক কাজটাজ করে কোনোরকমে সংসারধর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল মেরাজউদ্দিন।

কিন্তু একটা সমস্যা আস্তে আস্তে যে ওদের দিকে এগিয়ে আসছিল দু-তিন বছর ধরে, সেদিকে ওদের লক্ষ ছিল না তা নয়, ছিল। কিন্তু কিছু করার ছিল না।

গত বছরের শেষ থেকে এই কয়েক মাসে তা আরও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। সারা গ্রামের মানুষ ভয় পেয়ে গেছে মেঘনার এবারের ভাঙন দেখে।

খাদিজার মনে গাঢ় হয়ে ছায়া ফেলেছে রাক্ষুসী মেঘনার উত্তাল জলস্রোত আর ভাঙনের শব্দ।

এত দ্রুত গ্রাস করছে মেঘনা তার আশপাশের জনপদ যে কাউকে কোনো সুযোগই দিচ্ছে না একটু শ^াস ফেলার।

প্রতিদিন ঝুপ ঝুপ করে বিশাল বিশাল মাটির চাঙর ডুবে যাচ্ছে মেঘনার অথই জলের গভীরে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ফসলের মাঠ। ক্ষেতখামার, মানুষের আশ্রয়স্থলটুকু পর্যন্ত।

নিরাশ্রয় হয়ে শত শত পরিবার ঠাঁই খুঁজছে নানা জায়গায়। কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলাও তো সহজ নয়।

কোথায় কে দেবে আশ্রয়?

এই প্রশ্নটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এখন খাদিজাও। কারণ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আর মাত্র কয়েকদিন, তারপরে এই আশ্রয়টুকুও আর তাদের থাকবে না। হারিয়ে যাবে জলের ঘূর্ণির অতলে।

মেরাজ বসে নেই। মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছে সে-ও। কোথাও কোনো কাজে মন বসাতে পারছে না।

রহিম সবে একটু-আধটু পড়াশোনা শুরু করেছিল একটা প্রাইমারি স্কুলে। সে-স্কুলটি এখন আর নেই। মাসদুয়েক হয় মেঘনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এক রাতে। লেখাপড়ায় মন ছিল রহিমের।

সবমিলিয়ে কিছুটা অন্যরকম ধাঁচের ছিল। কথাবার্তাও তেমন কখনো বলে না, চুপচাপ নিরিবিলি থাকে বেশির ভাগ সময়ে।

স্কুলটা মেঘনার গভীর জলে হারিয়ে যাওয়ার পরে আরো মন-মরা হয়ে গেছে রহিম। আপনমনে একা একা চলে যায় মেঘনার পাড়ে যখন-তখন।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে নদীর পাড়ে দূরের দিকে তাকিয়ে। কখনো কখনো আকাশে মেঘ জমে, বিশাল বিশাল ঢেউ জাগে মেঘনার বুকে।

প্রচণ্ড হাওয়ার দাপটে সবকিছু উড়ে যেতে চায়। কালো আকাশের বুক চিরে নেমে আসে বিদ্যুতের ফলা।

এর মধ্যে রহিম মেঘনার তীর ছেড়ে আসতে চায় না। কেমন এক নেশায় যেন পেয়ে বসেছে রহিমকে।

এ নিয়েও ভয় খাদিজার। বুঝতে পারে না কেন এমন হচ্ছে। রহিম কেন এমন মনমরা হয়ে থাকে সবসময়।

অন্যদের মতো খেলাধুলা হইচই করে না। বললেও যায় না। ঘুরেফিরে চলে আসে ঘরে বা আপন মনে চলে যায় নদীর তীরে।

একটা শিমুলগাছের মতো বিশাল গাছ আছে মেঘনার তীরঘেঁষে। গাছটির দু-পাশের মাটি এরই মধ্যে নেমে গেছে নদীগর্ভে কিছুটা দূর দিয়ে। কিন্তু গাছটিকে এখনও গ্রাস করতে পারেনি। তবে আর বেশিদিন লাগবে বলে মনে হয় না। অনেকদিনের পুরনো গাছ বলেই প্রচণ্ড শক্তিতে শেকড় দিয়ে নিজেকে যেন বেঁধে রেখেছে মাটির সঙ্গে।

খাদিজা নিজের মনের সঙ্গে দিনের পর দিন যুদ্ধ করে আর যেন পারে না। এখানে আর থাকতে চায় না।

‘চলো অন্য কোথাও যাই’ – মেরাজউদ্দিনের হাত চেপে ধরে আকুল কণ্ঠে বলে ওঠে খাদিজা।

মনের মধ্যে খালি কুডাক ডাকতাছে – আমার আর ভালো লাগে না।

কিছুটা অবাক চোখে চেয়ে থাকে মেরাজউদ্দিন খাদিজার দিকে। বলে, তুমি এমন পাগল পাগল করতাছ ক্যান?

জানি না, খাদিজা বলে, নিজের মনকে যে আগলাইয়া রাখতে পারি না, আমি কী করুম!

মেরাজউদ্দিন চারদিকে কেমন ঝাপসা দেখতে থাকে। মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকে অসীম শূন্যতা।

কোথায় যামু? অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে মেরাজউদ্দিন, আমাগো কি যাওয়ার কোনো জাগা আছে?

থাকলে কি এহনো এহানে থাহি?

আমার যে খালি ডর লাগে! আস্তে আস্তে বলে খাদিজা।

কোথাও কি যাওয়া যায় না?

না খাদিজা, আমরা আর কই যামু? মেঘনা যহন আমগোর সব গিল্যা খাইবে, আমরা তহন রাস্তার ফকির। ভিক্ষা কইরা খামু।

পোলাডার কি অইবে? হাহাকার করে ওঠে খাদিজা। ও তো বাচপে না। এই দুনিয়ায় অর কি আর জাগা অইবে।

আল্লায় দেখবো আমাগো, আর কিছু করার নাই – বলতে বলতে রাস্তার দিকে পা বাড়ায় মেরাজ।

খাদিজা তাকিয়ে থাকে কেবল। সারা দৃষ্টিজুড়ে ঝুলে থাকে অসীম শূন্যতা।

কদিনের মধ্যে আরো কাছে এসে যায় মেঘনার জল।

ভাঙন চলছে অবিরাম। বৃষ্টি-বাদলের দিন। সারা দিন-রাত বৃষ্টি ঝরে অঝোরে। মাঝে মাঝে একটু-আধটু সময়ের জন্য থামে, আবার শুরু হয়। বৃষ্টির জল পেয়ে মেঘনার বুক যেন আরো ফুলেফেঁপে ওঠে। বাড়ে ঢেউ আর স্রোতের টান।

সেই টানে ভেঙে পড়ে তীরের মাটি। এমন আর কোনো বছর হয়নি।

বিগত দশ-পনেরো বছর তো কেটে গেল মেরাজের এখানেই।

কিন্তু মেঘনার এমন রাক্ষুসে চেহারা এতদিনের মধ্যে আর কোনো দিন তার চোখে পড়েনি।

গ্রামের সবচাইতে বয়স্ক মানুষ কুদ্দুস মিয়া বলে, এবার আমাগো কপালে ভোগ আছে।

ভোগ যে আছে বোঝা গেল সেদিনই যেদিন ঢাকা থেকে লালমোহনের দিকে আসা বড় দোতলা লঞ্চটা ডুবে গেল চাঁদপুরে মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদীর মোহনায়। সে এক হৃদয়বিদারী ঘটনা।

খবরটা পরের দিনই পেয়েছিল মেরাজউদ্দিন লালমোহনে গিয়ে। মানুষরা বলাবলি করছিল। কেউ কেউ অস্থির হয়ে উঠেছিল। দুদিন পরে মেঘনার জলে ভেসে আসতে লাগল লাশ। চারদিক দিয়ে গ্রামের মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে মেঘনার তীরের নানা জায়গায়। সবার চোখ-মুখে দুশ্চিন্তা আর শোকের কালো ছাপ।

খারাপ খবর দ্রুত ছড়িয়ে যায় বাতাসের মতো। শোনা গেল, মেরাজউদ্দিনের গ্রামের মিয়া বাড়ি আর বয়াতি বাড়ির চার-পাঁচজনের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। তারা নাকি ঢাকা থেকে উঠেছিল ওই লঞ্চে। মিয়া বাড়ির সেরাজ পাগলের মতো এদিক-সেদিক খোঁজখবর নিচ্ছে। কিন্তু কোথাও কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। সেরাজকে চেনে মেরাজ। সেরাজের সঙ্গে সেও ঘুরছে নানা জায়গায়। মেঘনার তীরে তীরে হেঁটেছে মাইলের পর মাইল।

আবার বৃষ্টি নেমেছে, সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। মেঘনা উত্তাল হয়ে উঠেছে। যেন মেঘনার অতল জলের অন্ধকার থেকে ফুঁসে উঠেছে ঢেউ। সেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরের মাটিতে। 

সেরাজের সঙ্গে সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত-অবসন্ন মেরাজ সন্ধ্যার আগে ফিরে এলো ঘরে। কিন্তু ঘরে ফিরেই আরেক খবর। দাওয়ার ওপর তারই মতো শ্রান্ত-ক্লান্ত বসে আছে খাদিজা। সারা শরীর ভেজা, আলুথালু।

মেরাজকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে একেবারে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল খাদিজা হাত-পা ছড়িয়ে। চোখ-মুখ ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। জানা গেল, রহিম বাড়ি ফেরেনি এখনো। বিকেলের দিকে ঘর থেকে বের হয়ে কাছাকাছি ঘুরছিল একা একা, আকাশে তখন ঘন মেঘ ছিল। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল গাছগাছালি আর ঘরের চালার ওপর। বাড়ছিল হাওয়া। খাদিজা ভাবছিল মেরাজের কথা। সারাদিন গেছে মেরাজ তখনো বাড়ি ফেরেনি।

খাদিজা তার খোঁজেই গিয়েছিল পাশের বাড়িতে। রহিম তখন কোথায়, তার সেদিকে লক্ষই ছিল না।

ঘণ্টাখানেক পরে বাড়িতে ফিরে এসেছিল নানা দুশ্চিন্তা নিয়ে।

এসে দেখে রহিম নেই। তারপর শুরু হয়েছে রহিমকে খোঁজা। কিন্তু কোথায় রহিম? কোথাও পায়নি তাকে। ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার আবছা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে আদিগন্ত জুড়ে। হাওয়ার জোর বেড়েছে। বেড়েছে বৃষ্টিও।

বাড়ির আশেপাশে খোঁজাখুঁজি শেষ করে যখন ফিরে এসেছে খাদিজা তখন ফিরেছে মেরাজ। খাদিজা তখন মৃতপ্রায় এক মানুষের মতো যেন।

রহিমের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে গলা ভেঙে গেল দুজনারই। কোনো রকমে টলতে টলতে যেতে থাকল সামনের দিকে। কিছুদূর থেকে ভেসে আসছে মেঘনার বিশাল বিশাল ঢেউ ভাঙার শব্দ। জল আছড়ে পড়ছে একেবারে যেন গায়ের ওপর। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে আছে। মেঘনার তীর ঘেঁষে দ্রুত দৌড়ে যাচ্ছে ঢেউ ভাঙার শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত।

মেরাজ আর খাদিজার চোখে যেন অন্ধকার জমাট বেঁধে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। শরীর আর পায়ে কোনো শক্তি নেই। তীরের ফলার মতো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটা এসে বন্ধ করে দিচ্ছে দৃষ্টিসীমা। এর মধ্যেই কোনোরকমে চোখ খুলে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করল সেই গাছটিকে, যে-গাছটির নিচে সবসময় এসে দাঁড়াত রহিম। কিন্তু কোথায় সেই গাছ! চোখের ভুল নাকি! আরো কাছে গেল, আরো কিছুটা কাছে, গাছটা কোথায় গেল?

রাক্ষুসী মেঘনা কি গাছটাকেও রেহাই দিলো না শেষ পর্যন্ত।

যেন মরীচিকার মায়ার পেছনে একটু একটু করে টলতে টলতে দুটি মানুষের ছায়াশরীর এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে…

চারদিকে তখন হু-হু হাওয়ার দাপটে, কোটি কোটি বৃষ্টির ফোঁটা মেরাজ আর খাদিজাকে যেন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ঘিরে ধরেছে।

ওদিকে সর্বগ্রাসী মেঘনার অনন্ত জলরাশি বিপুল শক্তি আর ঢেউয়ের ফণা নিয়ে বারবার আছড়ে পড়ছে কূল ছাপিয়ে।

আরো দু-পা এগোল মেরাজ গায়ের ওপর লেপ্টে পড়ে থাকা খাদিজাকে নিয়ে।

আর ঠিক তখনি আবার ফিরে এলো বিশাল ঢেউয়ের ছোবল।

আচমকা প্রচণ্ড শব্দ নিয়ে পায়ের নিচের মাটি সরে গেল মেরাজের।

মাথার ওপরে আছড়ে পড়ল ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের বিস্তার। তারপর আবার … আবার …

Published :


Comments

Leave a Reply