আজ চারদিন হয় আকাশ ইস্পাহানী আই হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। ভিজিটর আওয়ারে সকল পেশেন্টের আত্মীয়স্বজন আসে। আকাশের কাছে কেউ আসে না। এসময় বেডে থাকতে তার অস্বস্তি লাগে। সে বারান্দায় চেয়ারে বসে দূরের আকাশ দেখে। দূর আকাশে তাকিয়ে থাকে সত্যি, আসলে সে কিছুই দেখতে পায় না। দশ-বারো হাত দূরের দৃশ্যও সে স্পষ্ট দেখতে পায় না। ঝাপসা, কুয়াশাঘেরা। বিধাতা দিন দিন তার দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিচ্ছেন। আকাশ জন্মেছে এক চক্ষুর দৃষ্টি নিয়ে। অন্য চোখ জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন। সেই একচক্ষুর দৃষ্টিতে টান পড়েছে। বাইশ বছর বয়সে এসে সেই এক চোখের দৃষ্টি আজ অন্ধত্বের পথে।

নার্স জিজ্ঞেস করল, রোজ রোজ এখানটায় বসে কী দেখেন?

আকাশ মৃদু হেসে বলল, আমি দূরের কিছু দেখতে পাই না।

রোজই দেখি এখানটায় বসে দূরে তাকিয়ে আছেন।

তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবি।

কী ভাবেন?

প্রকৃতি, রং, মানুষজন আমার দৃষ্টি থেকে কি চিরতরে হারিয়ে যাবে? আমি কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি?

এত দুশ্চিন্তা করবেন না তো! সব ঠিক হয়ে যাবে। নিন, ওষুধ খেয়ে নিন। নার্স নমিতা আকাশের হাতে ওষুধ ও পানির গ্লাস ধরিয়ে দিলো।

কিছুক্ষণ পর নমিতা আবার ফিরে এলো, আপনার একজন ভিজিটর এসেছেন।

আমার ভিজিটর! আকাশ বিস্মিত হলো। ঢাকা শহরে তার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। তেমন অন্তরঙ্গ কোনো বন্ধুবান্ধবও নেই, যারা তাকে হাসপাতালে দেখতে আসবে। থাকার মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়ের হলে তার রুমমেট সিনিয়র ফরিদভাই হাসপাতালে ভর্তির খবর জানেন। ফরিদভাই কি?

কই?

আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখতে পাচ্ছেন না! নমিতা চলে গেল।

আকাশ আবেগাক্রান্ত হয়ে বলল, নিশি, তুমি কেন এসেছো?  তোমার না বিয়ে!

মেয়েটি বলল, স্যার, আমি নিশি না, রাত্রি।

আমি হাসপাতালে আছি জানলে কী করে?

আপনার হলে গিয়েছিলাম। ফরিদভাই হাসপাতালের ঠিকানা দিলেন।

আকাশ কিছুটা কঠিন স্বরে বলল, তুমি হঠাৎ আমার খোঁজখবর নিতে শুরু করেছো কেন ? এটা ভালো দেখায় না।

রাত্রির হঠাৎ কান্না পেল। সে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। পরে বলল, স্যার, আপনি টাকা না নিয়ে চলে এসেছেন। বাবা বলল, আপনার টাকা পৌঁছে দিতে।

রাত্রি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে সসংকোচে আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আকাশ বিস্মিত হয়ে বলল, আমার এক মাসের পাওনা বাকি। এত টাকা কেন?

রাত্রি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, স্যার, আমি হাসপাতালে আসবো শুনে ফরিদভাই বললেন, তুমি হাসপাতালে যাচ্ছো যখন, আমার টাকা নিয়ে যাও। আকাশকে দিও। ওর অপারেশনে অনেক টাকা লাগবে।

আমার অপারেশন! রাত্রির দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল আকাশ। আমার অপারেশন আমি জানি না, জানে ফরিদ ভাই?

রাত্রি আবারও অপ্রস্তুত হলো। মৃদু হেসে বলল, ফরিদভাই বললেন অপারেশন প্রয়োজন হতে পারে। তখন যদি হাতে টাকা না থাকে। তাই দিয়ে রাখলাম। ফরিদভাই এলে আপনি আলাপ করে নেবেন।

আকাশ টাকা রাখল। তারপর দূরে তাকিয়ে রইল। পাশে যে রাত্রি দাঁড়িয়ে আছে সে-কথা ভুলে গেল। রাত্রি অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিব্রত বোধ করছে। সে কি চলে যাবে? মনে হয় রাত্রি কিছু বলতে চায়।

রাত্রি বলল, স্যার, যাই।

আকাশ ঘাড় ফিরিয়ে বলল, সাবধানে যেও।

রাত্রি গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। আকাশ জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কিছু বলবে?

রাত্রি বলল, গতকাল নিশি আপুর আক্দ হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠান পরে হবে।

খুব ভালো। নিশি তার ভুল বুঝতে পেরেছে। সঠিক পথ বেছে নিয়েছে। এটা আনন্দের খবর। আকাশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল। তার চাপা দীর্ঘশ^াস পরিবেশটাকে বিষণ্ন করে তুলল। মৃদু বিষণ্ন কণ্ঠে বলল, রাত্রি, তুমি নিশির মতো ভুল করো না। নিশি ভুল সংশোধন করতে পেরেছে। ভুল সংশোধন করবে কী, অনেকে ভুলই বুঝতে পারে না। ভুল মানুষের জীবন নষ্ট করে।

রাত্রি করুণ গলায় বলল, স্যার, নিশি আপুকে আপনি ক্ষমা করে দেবেন। আপনার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনি ক্ষমা না করলে নিশি আপু কখনো সুখী হতে পারবে না।

এ-কথা বলতে রাত্রির চোখে পানি চলে এলো।

আকাশ অবাক হয়ে বলল, তুমি কাঁদছো কেন? নিশি আমাকে যে কিছু স্বপ্ন দেখিয়েছে সেই আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। হোক তা মিথ্যে, ছলনা। পৃথিবীতে বাবা-মা-ভাইবোন আমার কেউ নেই। আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। বিধাতা আমাকে এক চোখ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সেই চোখও যাওয়ার পথে। এখন আর কোনো দুঃখ আমাকে স্পর্শ করে না। নিশির ওপর আমার কোনো রাগ নেই। তুমি মন খারাপ করো না। যা হয়েছে তা সকলের জন্য ভালো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাও।

রাত্রি নীরবে চলে গেল। আকাশের দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। পোড়া চোখে কেন যে বারে বারে জল আসছে। রাত্রি বুঝতে পারে না। ওড়নায় চোখের জল মুছে রাত্রি দাঁড়িয়ে রইল। ভিজিটিং আওয়ার শেষ। দর্শনার্থীদের বিদায়ের ঘণ্টা বাজছে। রাত্রি চঞ্চল হয়ে ওঠে। আবার সে আকাশের কাছে গিয়ে দাঁড়াল –

স্যার।

আকাশ ঘাড় ফিরিয়ে অবাক হলো, তুমি এখনো যাওনি?

একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

কী কথা?

আপনি প্রায় এক বছর নিশি আপুর টিউটর ছিলেন। আপনার সঙ্গে আমার যতবার দেখা হয়েছে আপনি ভুল করে আমাকে নিশি বলে ডেকেছেন। একদিনও আপনি আমাকে রাত্রি হিসেবে চিনতে পারেননি!

আকাশ বলল, তোমরা দু-বোন প্রায় একই রকম দেখতে। যমজ বলে ভুল হয়। আমি অন্ধ মানুষ। ভুল হওয়া খুব স্বাভাবিক।

রাত্রি মøান কণ্ঠে বলল, নিশি আপুর আজ আপনার এখানে আসা এক অসম্ভব ঘটনা। আজও আপনি ভুল করলেন! আমাকে নিশি বললেন।

রাত্রি নতমস্তকে চলে গেল।

রাতের রাউন্ডে এসে ডাক্তার তাঁর চেম্বারে আকাশকে ডেকে পাঠালেন। আকাশের মন বলছে তার জন্য ভয়ংকর হতাশাজনক কিছু খবর অপেক্ষা করছে। ডাক্তারের সামনে আকাশের ফাইল। ডাক্তার বললেন, আপনার চোখের আরো অবনতি হয়েছে। ভালো চোখের নার্ভগুচ্ছ শুকিয়ে আসছে। এখনই যদি থামানো না যায়, আপনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবেন।

আকাশ ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, আমাকে বাঁচান ডাক্তার সাহেব।

ডাক্তার বললেন, এখন যেরকম দেখতে পান, এরকমই দেখতে পাবেন। এর চেয়ে ভালো কিছুর আশা নেই বললেই চলে। একটা অপারেশন করে দৃষ্টির অবনতি রোধ করা সম্ভব।

এবার আকাশের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, আপনার একটা ভালো খবরও আছে। আপনার যে-চোখটি জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন, তার  নার্ভ ও অন্যান্য অর্গান ঠিক আছে। শুধু কর্নিয়া নষ্ট। যদি কোনো ডোনার পাওয়া যায়, আপনার নষ্ট চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবেন।

ডোনার কীভাবে পাবো?

আপনি আমাদের হাসপাতালে রেজিস্ট্রেশন করে রাখেন। যখন কর্নিয়া পাওয়া যাবে, আপনাকে খবর দেওয়া হবে।

আকাশ তার বাইশ বছর জীবনে কখনো কোনো আশার বাণী শুনেছে বলে মনে পড়ে না। এই প্রথম সে আশার বাণী শুনলো। তাঁর চোখ ভালো হতে পারে। আরো বিস্ময়কর ঘটনা – যেখানে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে ডোনার পাওয়া সম্ভব হয় না, সেখানে ছ-মাসের মাথায় আকাশের ডোনার পাওয়া গেল। অতি দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কর্নিয়া সংযোজন করতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া সংযোজন না করলে কর্নিয়ার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। যথাসময়ে আকাশের চোখে সফলভাবে কর্নিয়া সংযোজন করা হলো।

ঘুমের সময়টুকু ছাড়া আকাশ চারদিন ধরে হাসপাতালের বেডে শুয়ে সিলিং দেখছে। একটা টিকটিকির সঙ্গে আকাশের ভাব হয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ টিকটিকিটি চলে আসে। টিকটিকির ডাকে আকাশ ফিরে তাকায়। তখন টিকটিকির সঙ্গে আকাশের কিছু কথা হয়।

টিকটিকি জিজ্ঞেস করে, ভিজিটিং আওয়ারে সকল পেশেন্টের ভিজিটর আসে। তোমাকে দেখতে কেউ আসে না। তুমি কি এতিম?

আকাশ উত্তর দেয়, আমি মহা এতিমরে ভাই। বাবা-মা, ভাইবোন কেউ নেই। ছেলেমেয়ে নেই। বিয়েটাও কপালে জোটেনি। প্রেমিকা নেই, বন্ধু নেই, কিছুই নেই রে ভাই।

টিকটিকি বলল, তুমি দেখছি আমার মতো।

রাত্রি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে, আকাশ টের পায়নি। রাত্রি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, বিড়বিড় করে কী বলছেন?

আকাশ সিলিংয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, টিকটিকির সঙ্গে কথা বলছি।

টিকটিকির সঙ্গে কথা বলছেন? রাত্রি বিস্মিত হয়ে আকাশকে দেখল। তারপর সিলিংয়ে টিকটিকি খুঁজল। কিছু দেখতে পেল না।

আকাশ বিষাদভরা গলায় বলল, আমার কে আছে বলো, তুমি নিশির বোন। আমার কেউ হও না।

রাত্রি কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। আহত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনে মনে বলল, হই হই, আমি তোমারই। কবে বুঝবে তুমি?

টিকটিকিটা এ-সময় শব্দ করে ডেকে উঠল। রাত্রি চমকে সিলিংয়ের দিকে তাকাল। আকাশ বলল, ও তোমাকে পছন্দ করেনি। তুমি আসাতে ও চলে যাচ্ছে। অন্যদিন ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে ও যায়।

রাত্রি সবিস্ময়ে দেখল টিকটিকিটা সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে। একসময় সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আকাশ জিজ্ঞেস করল, ফরিদভাই আসে না কেন? এতদিন হলো হাসপাতালে আছি সে একদিনও এলো না। এ-পৃথিবীতে সত্যি আমার কেউ নেই।

ফরিদভাই তার বিয়ে নিয়ে ঝামেলায় আছেন। আমাকে বলেছেন আপনার রিলিজের দিন আসবেন।

আমার চিকিৎসার খরচ চলছে কী করে?

কেন, ফরিদভাই দিচ্ছেন।

ফরিদভাই এত টাকা পাচ্ছেন

কোথায়?

ওই যে বড়লোকের মেয়ে, ফরিদভাই যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, মনে হয় তার কাছ থেকে নিচ্ছেন। ফরিদভাই আপনাকে খুব ভালোবাসেন।

আকাশের সন্দেহ দূর হয়েছে মনে হয় না। ভ্রƒকুটি করে গম্ভীর হয়ে থাকল সে। আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, কেউ কথা রাখে না।

হাসপাতাল ছাড়ার দিন আকাশকে দেখে রাত্রির চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এ কদিন হাসপাতালের নিয়মে থেকে আকাশের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আজ শেভ করেছে। ফর্সা গালে নীলাভ আভা পড়েছে। মাথাভর্তি এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল। চোখে কালো রোদচশমা। গায়ের জামাটা শুধু কুঁচকানো মলিন। তবু দীর্ঘকায় আকাশকে রাত্রির চোখে সিনেমার নায়কের মতো লাগছে। রাত্রি কথা বলবে কী, মুগ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

আকাশ অস্থির হয়ে উঠছে। বিরক্ত হয়ে বলল, ফরিদভাই আসছেন না কেন?

রাত্রি ব্যাকুল হয়ে বলল, প্লিজ, আপনি অস্থির হবেন না। আপনি একটু স্থির হয়ে বসুন। আমি দেখছি।

ফরিদভাই না এলে আমি রিলিজ হবো কী করে? তুমি ফরিদভাইকে ফোন করে আমাকে দাও। আমি কথা বলবো।

রাত্রি বারবার ফরিদভাইকে ফোন করতে লাগল।

আকাশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হলো? এত দেরি হচ্ছে কেন?

কল নট রিচেবেল।

এখন কী হবে?

দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। অ্যাকাউন্টসে আমার পরিচিত লোক আছে। দেখি কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কি না।

কিছুক্ষণ পর রিলিজ অর্ডার হাতে হাসিমুখে রাত্রি ফিরে এলো। আকাশকে বলল, ফরিদভাইকে শুধু শুধু দোষারোপ করলাম। কোনো কারণে তিনি আসতে পারেননি। কিন্তু ওনার দায়িত্ব ভুলে যাননি। অনলাইনে পেমেন্ট করে দিয়েছেন। এখন বাড়ি চলুন।

বাড়ি! আমি বাড়ি পাবো কোথায়?

মানে আমাদের বাড়ি।

আকাশ বিস্মিত হয়ে বলল, তোমাদের বাড়ি কেন? আমি হলে আমার রুমে ফিরবো।

রাত্রি করুণ স্বরে বলল, স্যার, আর মাত্র বিশদিন আপনাকে খুব নিয়ম মেনে চলতে হবে। তারপর কোনোদিন আপনাকে বিরক্ত করব না। প্রমিজ করছি। আপনার যেখানে ইচ্ছে চলে যাবেন। এ-অবস্থায় হলে গেলে আপনার চোখ বাঁচানো যাবে না। আমি মিনতি করছি আপনি আমার সঙ্গে চলুন। আমি বাসায় বলে এসেছি আপনাকে নিয়ে ফিরবো। প্লিজ, আমাকে ছোট করবেন না স্যার।

রাত্রির চোখ জলে ভরে উঠল।

আকাশ বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি

কথায় কথায় এত কাঁদো কেন?

ওড়নায় চোখ মুছে রাত্রি বলল, আর কাঁদবো না।

বিশদিন পর আকাশকে নিয়ে রাত্রি ডাক্তারের কাছে এলো। আকাশের চোখ, স্বাস্থ্য, পোশাক, জীবনের পরিপাটিবোধে বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে। ডাক্তার আকাশকে অভিনন্দন জানালেন তার চোখের দ্রুত উন্নতির জন্য। নতুন চোখে নতুন চশমায় আকাশকে ভিন্ন মানুষ মনে হতে লাগল। আগের আকাশের সঙ্গে যার কোনো মিল নেই।

ডাক্তার হৃষ্টচিত্তে বললেন, স্বামী অন্ত্যপ্রাণ এমন স্ত্রী আমি এর আগে দেখিনি। আপনি একজন সৌভাগ্যবান হাসবেন্ড।

এ-কথা শুনে আকাশ স্তম্ভিত হয়ে গেল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে রাত্রির দিকে তাকাল। রাত্রি মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

রাত্রি জিজ্ঞেস করল, স্যার, এখন কোথায় যাবেন?

আকাশ চারদিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বলল, সবকিছু নতুন লাগছে। ঝকঝকে, কী সুন্দর! পৃথিবী এত সুন্দর আগে কখনো মনে হয়নি। আমি পুরনো জীবনে ফিরে যেতে চাই না।

কোথায় যাবেন?

কোথায় যাবো জানি না। তবে ঢাকায় থাকবো না। আমার নতুন দৃষ্টি নতুন জীবন। নতুন কোথাও চলে যাবো। নতুনভাবে শুরু হোক জীবন।

দুই

বাজিতপুর হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে আকাশের নতুন জীবন শুরু  হলো। স্কুল ছুটির পর আকাশ বেরিয়ে পড়ে প্রকৃতি দেখতে। এতকাল যা সে প্রাণভরে দেখতে পারেনি, এখন তাই তাড়াহুড়ো করে দেখতে চাইছে। কোনোদিন নদীর ধারে ফসলের মাঠে, আবার কোনোদিন হাটবাজারে ঘুরে বেড়ায়। আকাশের সময় আনন্দে কাটছে। মাঝে মাঝে কখনো রাতে ঘুম না এলে রাত্রির কথা তার মনে পড়ে। মন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। মনে হয়, রাত্রির প্রতি সে একটু বেশিই নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। নিশিকে কিছু করার ছিল না। সুযোগ পেয়ে রাত্রির ওপর নিশির প্রতিশোধ নিয়েছে।

সকাল হলে রাত্রির কথা আকাশের আর মনে থাকে না।

আকাশ খুব আনন্দের সঙ্গে এক বছর পার করে দিলো। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের কাছে সে দিন দিন প্রিয় হয়ে উঠছে। আকাশ যেহেতু পরনিন্দা চর্চা অপছন্দ করে, তেমন মিশুকও নয়, বন্ধুবান্ধব তার হয়নি। নিঃসঙ্গ জীবন যাপনে তার তেমন অসুবিধা হয় না। নিজের খাবার নিজে রান্না করে। বইপত্র পড়ে। স্বচ্ছ চোখে পৃথিবী দেখার আনন্দ উপভোগ করে। বিধাতার প্রতি সে কৃতজ্ঞতা অনুভব করে।

সেদিনও রান্না চড়িয়ে চুলার পাশে বসে বই পড়ছিল। মাঝে মাঝে রান্নাটাও দেখছিল।  বন্ধ দরজায় কেউ নক করল,  আকাশ গুরুত্ব দিলো না। গত এক বছরে তার কাছে কেউ আসেনি। এ-এলাকায় তার বাসায় আসার কোনো লোক নেই। আকাশের মনে হলো, বাতাসের শব্দ কিংবা সে ভুল শুনেছে। আবার নক করল। এবার বেশ জোরে জোরে। নক শুনে মনে হচ্ছে মানুষটির ধৈর্য কম।

দরজার কাছে গিয়ে দরজা না খুলে আকাশ জিজ্ঞেস করল, কে?

দরজার ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠে বলল, এটা আকাশ আহমেদের বাড়ি? আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

আকাশ দ্বিধা নিয়ে দরজা খুলল। সবিস্ময়ে দেখল এই গরমে মুখ-মাথা চাদর মুড়ি দিয়ে একজন লোক ঢুকলো। এই রাতের বেলায় চোখে রোদচশমা। একজন রহস্যময় আগন্তুক। আকাশের মনে কিছু ভয় ও দ্বিধা সৃষ্টি হলো।

লোকটি কাতর কণ্ঠে বলল, ভাইরে, অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি। খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। ক্ষিধেও লেগেছে। আগে এক গ্লাস পানি খাওয়ান।

লোকটির কথা বলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে আকাশ তার পূর্বপরিচিত। কথায় কোনো দ্বিধা-সংকোচ নেই।

লোকটির হাতে একবাটি মুড়ি ও এক গ্লাস পানি দিলো আকাশ। লোকটি আকাশের পাশে বসে মুড়ি খেতে খেতে ও রান্না দেখতে দেখতে উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, আজকের মেন্যু কী?

আকাশ বলল, আমি একা থাকি। স্বপাকে আহার করি। অতি সামান্য আয়োজন। ডিম সিদ্ধ, আলু ভর্তা আর ভাত। আজ ডাল রান্না করতে পারি নাই।

লোকটি উৎফুল্ল হয়ে বলল, অতিউত্তম! বহুদিন খাই না।

আমার কাছে কেন এসেছেন,  কী প্রয়োজন – সেটা বলুন। আমি এখন পর্যন্ত আপনাকে  চিনতে পারছি না।

লোকটি বলল, পরিচয় না দিলে চিনবেন কী করে? আমি আপনার আত্মীয়স্বজন  না, পরিচিতও না। বলতে পারেন হঠাৎ করে একটা দুর্ঘটনায় আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়ে গেছে। সেই যোগাযোগের সূত্র ধরে আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছি।

আকাশ সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, আপনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হলো, আমি জানলাম না! সে কী করে হয়?

লোকটি এবার বিরক্ত হয়ে বলল, না বললে কিছুই বুঝতে পারবেন না। বললে সব বুঝতে পারবেন। আপনে একটা কাগজ-কলম দিন। ঠিকানা লিখে দিই। পরে ভুলে যেতে পারি। তারপর কী করে আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হলো সে-ঘটনা বলছি।

একটা খাতায় লোকটি বড় বড় অক্ষরে লিখল, ড্রাইভার হাফিজউল্লাহ,  গ্রাম : সওদাগর পাড়া, ইউনিয়ন : উল্লাপাড়া, থানা : উল্লাপাড়া, জিলা : পাবনা।

আকাশ ঠিকানায় চোখ বুলিয়ে বিস্মিত হয়ে বলল, এ-ঠিকানা নিয়ে আমি কী করবো?

এখন ঘটনাটা শুনুন। তাহলে ঠিকানার গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। আপনাকে যে ঠিকানা দিয়েছি সেটা আমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা। আমার স্ত্রী একটি মেয়ে ও একটি ছেলে নিয়ে গ্রামে থাকে। মেয়েটি বড়, এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট গাড়ি চালাই। গাড়িটা আমার নিজের। পুরানা সেকেন্ডহ্যান্ড কিনেছিলাম। আমার রুজি-রোজগারের একমাত্র পথ।

আকাশ বিরক্ত হয়ে বলল,  আপনার ফ্যামিলির গল্প কে শুনতে চেয়েছে? কী কারণে আমার কাছে এসেছেন সেটা বলেন।

হাফিজউল্লাহ মিনতির সুরে বলল,  আর পাঁচ মিনিট সময় নেবো ভাই। আমি ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে বগুড়ায় প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাচ্ছিলাম। সাভার ক্যান্টনমেন্টের কাছে লোডিং ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি অ্যাক্সিডেন্ট হলো। গাড়ি চিঁড়েচ্যাপ্টা, আমি ও প্যাসেঞ্জার স্পট ডেথ। পেপার-টিভিতে নিউজ এসেছে।

আকাশ বলল, আমি পেপার পড়ি না। টিভি দেখি না। আপনার অ্যাক্সিডেন্টের জন্য আমি দায়ী না। আমার কাছে কী কারণে এসেছেন?

 মেয়েটার দুঃখ সইতে পারছি না। মেয়েটা হইছে ওর মায়ের মতো। অল্প কথা বলে, ফর্সা সুন্দর। আমার ফ্যামিলি জানে না আমি মারা গেছি। ওরা মিসিং ডায়েরি করেছে। আপনাকে যে ঠিকানা দিয়েছি, ওই ঠিকানায় গিয়ে আমার মৃত্যু সংবাদ দেবেন। আর যদি মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

লোকটি কাঁদতে লাগল।

আকাশ ক্ষেপে গেল, আমি কেন আপনার বাড়ি যাবো?  আপনার মেয়ের বিয়ের দায় কি আমার?  আমার কাছে খবর দিতে এসেছেন কেন? আপনি নিজে ওদের খবর দিতে পারেন।

আমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি না। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। আপনি ছাড়া আমার গতি নেই। আপনার ইচ্ছা থাক বা না থাক – আমাকে দয়া করবেন।

আকাশ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, আপনি কি নেশা-ভাং করেছেন?  আমাকে একা পেয়ে ভূতের গল্প শোনাতে এসেছেন। ভেবেছেন ভয়ে আমার দাঁতকপাটি লাগবে। আমার বাড়ি ছেড়ে এক্ষুনি বেরিয়ে যান।

হাফিজউল্লাহ আকাশের ক্রোধকে কোনো গুরুত্ব দিলো না। বিচলিত হলো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইল। দৃঢ়স্বরে বলল, আমি আপনার উপকার করেছি। তাই আপনার কাছে প্রতিকার চেয়েছি। তা যখন হলো না আপনি আমার চোখ ফেরত দেন।

চোখ ফেরত দেবো? তার মানে?  আমাকে চোখ দিয়েছে ইস্পাহানী আই হসপিটাল। আপনে কোথাকার কে?

আপনি যে নতুন চোখ দিয়ে ঝকঝকে নতুন পৃথিবী দেখছেন, ওই চোখটি আমার। অ্যাক্সিডেন্টে আমার মৃত্যুর পর বেওয়ারিশ লাশের চোখ হিসেবে আমার একটি চোখ আপনাকে দেওয়া হয়েছে। আমার চোখ ফেরত নিতে এসেছি।

আকাশ সবিস্ময়ে লক্ষ করল ঘরে সাদা পোশাকের চারজন নার্স অপারেশনের আয়োজন করছে। আগন্তুক অপারেশন অ্যাপ্রোন পরেছে। গ্লাভস পরা হাতে তীক্ষè সুঁচালো দীর্ঘ গজাল ধরে আছে আকাশের চোখ তুলে নেওয়ার জন্য।

আকাশ জ্ঞান হারালো।

আকাশ থাকতো গ্রামের বাইরে লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে। এ-বাড়ির মালিক ও তার স্ত্রী একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছিল। সেই থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। আকাশ নিরিবিলি মানুষ। নির্জন হওয়ায় ও লোকজন এড়িয়ে চলায় আকাশের জন্য বরং সুবিধা হয়। আকাশের অজ্ঞান হওয়ার ঘটনাকে সবাই ভূতের প্রমাণ হিসেবে হাজির করল। আকাশের কাছে একটি ঘটনা আজও রহস্যের মতোই রয়ে গেছে। সেদিন কি সত্যি সত্যি কেউ তার কাছে এসেছিল? নাকি সম্পূর্ণ ঘটনা তার কল্পজগতে তৈরি?  ঠিকানা লিখল কে?  ড্রাইভার হাফিজউল্লাহর ঠিকানা লিখল কে?  ঠিকানাটা আকাশ সযত্নে রেখে দিয়েছে।

তিন

আকাশ ভাবছে সে ঢাকায় ফিরে যাবে। তার সাহস হলো না। অজানা আতঙ্কে বাজিতপুর হাইস্কুলের চাকরি ছেড়ে সে বান্দরবান চলে গেল। বোম উপজাতির এক নিভৃত পল্লিতে সে আশ্রয় নিল। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য সে পাঠশালা খুলে বসলো। সে বিনা পয়সায় ছাত্র পড়ায়। গ্রামবাসী তার আহার জোগায়। স্কুলঘরে সে রাতযাপন করে। একা থাকতে সে ভয় পায়। আদিবাসী এক ছাত্র আকাশের সঙ্গে থাকে। ভয়ে ভয়ে ছ-মাস কেটে গেল। আকাশের সাহস, আত্মবিশ্বাস আবার ফিরে এলো। কোনো এক রাতে ভয়ের কী ঘটেছিল, আকাশ তা ভুলতে বসেছে। আবার সে দূর-দূরান্তে একা একা চলে যায়। নিশি রাতে ঘরে ফেরে।

স্বপ্নে কী জাগরণে কিংবা দুইয়ের মধ্যকার সময়ে অল্পবয়সী একটি মেয়ে একদিন আকাশের কাছে এলো। এর আগে মেয়েটি আরো একবার এসেছিল। তাই আজ আসাতে খুব একটা অবাক হলো না। মেয়েটির চেহারা সে পরিষ্কার দেখতে পায় না কিংবা দেখলেও পরে মনে থাকে না। মেয়েটির সঙ্গে তার কীভাবে কথা হয় এও এক বিস্ময়। মেয়েটি তার সামনে এসে দূরের একটা চেয়ারে বসে। মেয়েটির কণ্ঠস্বর সে শুনতে পায় না। কিন্তু কথা বুঝতে পারে। কথাবার্তা বেশ দূর থেকে ভেসে আসে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মেয়েটি তাকে বাবা সম্বোধন করে।

বাবা, তুমি আমাদের ভুলে গেলে?  আর যে দিন চলে না। পাড়ার বখাটেদের দৌরাত্ম্য আর সইতে পারি না। নানা লোকের কুৎসিত কথায় আমার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। মা অসুস্থ। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারি না। লিটু স্কুল ছেড়ে রেস্টুরেন্টে কাজ নিয়েছে। তুমি কিছু করবে না? সব জেনেও নির্বিকার থাকবে? আমাদের মৃত্যুর অপেক্ষা করবে?

বরাবরের মতো আকাশ কোনো উত্তর দেয় না। কিংবা দিতে পারে না। অসহায় ভঙ্গিতে শুনে যায়।

বাবা, তুমি লুকিয়ে আছো কেন?  একবার মাকে দেখে যাও। মা যদি মরে যায়? আমরা কী অপরাধ করেছি? তুমি আমাদের বাঁচাবে না?

মেয়েটি কাঁদতে থাকে। আকাশের খুব মায়া হয়। মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে তার মনও কাঁদে। মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে করে। আদর করতে ইচ্ছে করে। কী এক অদ্ভুত কারণে আকাশ কিছুই করে না, কিংবা করতে পারে না। নিষ্প্রাণ  মূর্তির মতো স্থির বসে থাকে।

পরদিন আকাশ ঠিকানা বের করলো। স্পষ্ট অক্ষরে বড় বড় করে লেখা ড্রাইভার হাফিজউল্লাহ, গ্রাম : সওদাগর পাড়া, ইউনিয়ন : উল্লাপাড়া, থানা : উল্লাপাড়া, জিলা : পাবনা। এটা তার হাতের লেখা নয়। অন্য কেউ লিখেছে। সত্যিই কি ঠিকানার ওই মানুষগুলি আছে? হাফিজউল্লাহর ঘটনা ও মেয়েটির বক্তব্য কি সত্য?  কী এক অদৃশ্য কারণে তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।

আকাশ ঢাকায় ফিরে এলো। ইস্পাহানী আই হসপিটালে খোঁজখবর করে জানা গেল, তার চোখ কেউ ডোনেট করেনি। বেওয়ারিশ লাশ থেকে পাওয়া। কার অ্যাক্সিডেন্ট হয়। যাত্রীর লাশের দাবিদার ছিল। ড্রাইভারের কোনো দাবিদার পাওয়া যায়নি। তাদের টিম ড্রাইভারের রেটিনা সংগ্রহ করে সে রেটিনা আকাশের চোখে সংযোজন করা হয়। 

আকাশ পাবনায় হাফিজউল্লাহ ড্রাইভারের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। জরাজীর্ণ টিনের ঘর। একসময় বাড়ির লাজলজ্জা ঢাকার শোভন বেড়া ছিল। এখন বাড়িটি প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় আছে। কলাপাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করা হয়েছে। লজ্জা নিবারণ না হয়ে আরও প্রকট হয়ে পড়েছে। জরাজীর্ণ অবস্থা এমন যে, প্রথমেই চোখে পড়ে বাড়ির দৈন্য।

একটি কিশোরী ঘর থেকে বেরিয়ে আকাশকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাথায় ওড়না টেনে ঘোমটা দিলো। অচেনা মানুষ, কোন মতলবে ঘুরঘুর করছে?  দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। আকাশ যে কিছু জিজ্ঞেস করবে সে সময়টুকু পর্যন্ত পেল না।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটি কিশোর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে। তেরো-চোদ্দ বছরের বালক, সদ্য গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। আকাশের কাছে এসে দুর্বিনীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কারে চান?  এখানে ঘুরাঘুরি করতেছেন কেন?

এটা কি হাফিজউল্লাহ ড্রাইভারের বাড়ি?

ছেলেটি আনন্দে চমকে উঠল, আপনে আব্বার খবর পাইছেন?  আপনে কই থেকে আসছেন?  আব্বা কোথায়?

মেয়েটি দরজার আড়ালে আড়ি পেতে ছিল। আব্বার কথা শোনা মাত্র সে ছুটে এলো। মাথার ওড়না খসে পড়ল। আপনে আব্বার খবর পেয়েছেন?  ঘরে আসেন। আম্মা খুব অসুস্থ। আম্মার সামনে কথা বলেন। মেয়েটি খুশিতে ‘আম্মা আম্মা’ ডাকতে ডাকতে ঘরে ছুটে গেল।

 আকাশ বিস্মিত। সে কি স্বপ্ন দেখছে?  ঘোরের মধ্যে আছে? নাকি নেশা-ভাং করেছে?  এটা কী করে সম্ভব!  এখানে রাত্রি এলো কি করে? রাত্রির বয়স কমে গেছে। শুকিয়েছে। দুঃখ-যাতনায় চেহারা মলিন হয়েছে।

আকাশ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি কে?

আমার বোন। আব্বার কারণে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারলো না। এখন ঘরে সেলাইয়ের কাজ করে। আব্বার খবর আনছেন। এইবার আমাদের সব দুঃখ শেষ হইবে। আব্বা কেমন আছে?

আকাশ একটি চেয়ারে হাফিজউল্লাহর অসুস্থ স্ত্রীর মুখোমুখি বসে ঘামছে। ছেলেমেয়ে দুজন দুপাশে দাঁড়িয়ে। সকলে ব্যাকুল নয়নে আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই আনন্দ সংবাদের অপেক্ষায়।

আকাশ কেশে নার্ভাস কণ্ঠে বলল, আমি ঢাকা থেকে এসেছি। হাফিজউল্লাহ সাহেবের ওয়ারিশ তো আপনারা? তার কিছু টাকা আপনারা পাবেন।

মেয়েটি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, এসবের অর্থ  কী?  আব্বা কেমন আছে?  কোথায় আছে?  কী হয়েছে?

আকাশ বলল, আপনার আব্বা কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন।

এ কথা শোনা মাত্র কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো ঘর। আশার প্রদীপ যেটুকু নিভু নিভু জ্বলছিল, আকাশ এক ফুয়ে তাও নিভিয়ে দিলো। আকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে একটা গাছের ছায়াতলে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি চোখ মুছে আকাশের মুখোমুখি হলো।

মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, আমরা থানা-পুলিশ করলাম। কেউ কিছু বলতে পারলো না। আপনি জানলেন কী করে?

তুমি বিশ^াস করবে না, সে এক অদ্ভুত ঘটনা রাত্রি।

রাত্রি!  রাত্রি কে?  আমি তহুরা।

আমার ডান চোখের দিকে তাকাও। এ-চোখ তোমার বাবার চোখ। আমার চোখ নষ্ট ছিল। ঠিকমতো দেখতে পেতাম না। কার অ্যাক্সিডেন্টে তোমার বাবার মৃত্যুর পর তার একটি চোখ আমাকে দেওয়া হয়। তোমার বাবার চোখ দিয়ে আমি এখন পৃথিবী দেখছি। তোমাকে দেখছি।

তহুরা নত মাথায় কাঁদতে লাগল।

একদিন স্বপ্নে তোমার আব্বা আমাকে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে তার মৃত্যুসংবাদ দিতে বললেন। আর অনুরোধ করলেন, তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারলে উনার আত্মা শান্তি পাবে।

তহুরা বলল, আমি বিয়ে করবো না। আমার বিয়ে হলে মা-ভাই না খেয়ে মারা মরবে।

আকাশ বলল, তহুরা, চোখ মুছে আমার দিকে তাকাও।

তহুরা চোখ মুছে ডাগর চোখ মেলে তাকাল আকাশের দিকে। অবুঝ চোখ তবু জলে ভাসে।

আকাশ বলল, তোমার জন্য পাত্র ঠিক করেছি। বিয়ের পর তোমাকে মা-ভাইকে ছেড়ে যেতে হবে না।

তবে ছেলের বয়স তোমার তুলনায়

একটু বেশি। তোমার পছন্দ হবে কি না জানি না। পাত্র তোমার সামনে

দাঁড়িয়ে আছে।

তহুরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল আকাশের মুখপানে। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল, চোখের পলক পড়েছে কি পড়েনি সে বলতে পারবে না। এ কি স্বপ্ন, নাকি বাস্তব, নাকি রূপকথার গল্প? অনেক মুহূর্ত যেন অনন্ত প্রহর পার হয়ে তহুরা যখন সম্বিত ফিরে পেল, তার চোখে জল টলমল, মুখে মৃদু মধুর হাসি নিয়ে সে ছুটে পালালো আকাশের দৃষ্টিসীমা থেকে।

সেই রাতে কয়েকজন প্রতিবেশী ডেকে রেজিস্ট্রি করে আকাশ ও তহুরার বিয়ে হয়ে গেল।

বাসরঘরে তহুরা জিজ্ঞেস করল, রাত্রি কে?  তোমার প্রেমিকা?

আকাশ আঙুল তুলে তহুরাকে দেখিয়ে বলল, তুমি। আজ থেকে তুমি আমার রাত্রি।