জগৎ জুড়ে প্রাণের মেলা

হাতেখড়ির পালা একবারে তো আর শেষ হয় না। পড়ে থাকে দ্বিতীয় অধ্যায়। সেটি গণিতের জগৎ। আমরা সবাই দুটি মাত্রায় সীমাবদ্ধ। এক, ভাষা – দুই, গণিত। অ আ শেখার পর আসে রাশি শিক্ষার পালা। তো বর্ণপরিচয় শেখার পর শুরু হলো গণিত পাঠ। এক থেকে দশ পর্যন্ত লেখা চলল। এই প্রথম সিঁড়ি ভাঙার পর এগারো থেকে কুড়ি। এভাবে একশ পর্যন্ত। খুব যত্ন করে শেখাতেন। মেজাজ খিটখিটে হলেও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। জানি না কেন। হতে পারে বড়ঘরের নাতি। মানে কুটুম্ব। দ্বিতীয়ত, বাবা একজন উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপক পদের মানুষ। আবার গ্রামে বাবাকে সবাই কবিসাহেব বলত। সুতরাং আমার ক্ষেত্রে অনেক মশলা মাখান। আর প্রথম সন্তান বলে ছিলাম কিছুটা নিরীহ ও অন্তর্মুখিন চরিত্রের। তাছাড়া খুব বাধ্য ছাত্র ছিলাম। সবকিছু দ্রুত বুঝে নিতে পারতাম, এটাও তাঁর স্নেহ লাভের একটি কারণ হতে পারে। সে যা-ই হোক মোদ্দা কথা, ভ্যাবলা বা নিরেটমাথা ছিলাম না। পরবর্তীকালে মায়ের কাছ থেকে প্রমাণপত্র লাভ করি। তিনি একদিন বলেছিলেন, তোমার অন্যান্য ভাইবোনের ক্ষেত্রে দুটি করে বই নষ্ট হতো। তুমি কিন্তু একটা বইতেই সব শিখে নিয়েছ। মায়ের মুখে কথাটা শুনে বেশ তৃপ্তি লাভ করি। প্রশংসা শুনে কে-ই বা খুশি না হয়। স্বয়ং ভগবানও নিয়ত প্রশংসাবাণী শ্রবণ চান। আমার এক প্রতিবেশী আছেন, আইনজ্ঞ – তিনি বলেন, আচ্ছা, আমাদের ছেলেমেয়েরা সবসময় বাবা বাবা করে ডাকতে থাকলে আমরা বিরক্ত হই – তাহলে ঈশ^রও বিরক্ত হবেন কি না কে জানে? আইনজ্ঞের যুক্তির কাছে আমি থ মেরে যাই। কী জবাব দেবো। আইন হলো সভ্যতার ভিত্তি। দালান-কোঠা আরাম-আচ্ছাদন মাত্র। তার ভেতরের মানুষগুলো কী আচরণ করে তা-ই সভ্যতা বা সংস্কৃতি। দুটি শব্দে বড় ধরনের পার্থক্য নেই।

তো হাতেখড়ির পরের সময়।

ঝামটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় গ্রীষ্মকালে মর্নিং স্কুল করত। অর্থাৎ সকাল সাতটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত। এই সময় দালিজের পাঠ বন্ধ থাকত। অন্য সময় সকালের দিকে যোগীন্দ্র মাস্টারমশাই পড়াতেন। আমার একমাত্র মামাতো ভাই রেজাউল করিম আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। তিনি এই বংশের একমাত্র সন্তান। থাকতেন তাঁর নানির সঙ্গে। খুবই আদরের। এই নানি হলেন আমার নানার বোন নজিমননেসা। একই ভবনের দুপাশে অবস্থান। রেজাউল দাদা ছিলেন আমাদের লিডার। আমরা তাঁর সাগরেদ। তিনি থাকতেন পুবে, আমরা পশ্চিমে। কেউ সকালের কোমল রোদ পায় তো কেউ পশ্চিমের চড়া কিরণ। পুবদিকে ছিল নারিকেলের সার। পশ্চিমে একটি বাঁশঝাড় বাড়ির শোবার ঘরের দিককে চৈত্রের ঝাঁঝ থেকে রক্ষা করত। এই ঝাঁঝকে ঝামটিয়ায় বলে ঝাঁউলি। গরমে প্রকৃতির ঝিমিয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো ঝাঁউলি। আমার কাছে শব্দটি যথোপযুক্ত মনে হয়। তবে অভিধানে জায়গা নিয়েছে কি না ঘেঁটে দেখিনি। মনে হয় কথাটা শুধু এই অঞ্চলে প্রচলিত। আমি সারা বাংলায় আর কোথাও এই শব্দের উচ্চারণ শুনিনি।

রেজাউল দাদাও যোগীন্দ্র মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র। মানে হাতেখড়িধারী। আমার এই দাদা ভালো ছাত্র। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের কোনো দাবড়ানি শুনলেই, নানি গো … নানি গো … বলে চিৎকার করে উঠতেন। আর নানি যেহেতু কাছেই ছিলেন, তাই তাঁর কানে এই আর্তধ্বনি যাওয়া মাত্র ছুটে আসতেন। আমরা বাকি সবাই কৌতুক অনুভব করতাম। নানি এসে বলতেন, মাস্টারমশাই … আমার নিধিকে মারবেন না।

মাস্টারমশাই লজ্জা পেয়ে যেতেন। বলতেন, মারিনি। হাতের ছড়িটা শুধু উঁচু করেছি। ও তো ভালো ছাত্র। তবে ভালোদেরও চাপে রাখতে হয়। না হয় নষ্ট হতে বেশি সময় লাগে না।

কথাটা আমার কানে এখনো বাজে। কী অমূল্য কথা বলেছিলেন তিনি। আমার সেই ঋষিসুলভ প্রাথমিক শিক্ষাগুরু। আজও তাঁকে নমস্কার জানাই। সেই দারিদ্র্যপীড়িত মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে পড়লে এখনো বুকের কাছটা ব্যথা করে ওঠে। জীবনে এঁরা কোনোদিন স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখেননি, কিন্তু কী যত্ন করে অন্যের সন্তানকে মানুষ করার চেষ্টা করে যেতেন।

তাঁর একমাত্র পুরস্কার ছিল : আমার হাতে যার হাতেখড়ি হবে সে বিএ-এমএ পাশ করবে। এই কথাটা বলার গর্ব তাঁর একমাত্র প্রাপ্তি।

মনে হয়, একজনের কাছে শিক্ষক চিরকাল শিক্ষক। হোক সে জীবনের যে-কোনো স্তরের। আর সবার বড় শিক্ষক হলো প্রকৃতি ও মানবসমাজ। ছোটদের কাছেও অনেক কিছু শেখার আছে। কাউকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এমনকি বৃক্ষ ও প্রাণিজগৎও আমাদের মৌল শিক্ষক। আকাশ বাতাস রৌদ্র জলাধার সবসময় আমাদের শিখিয়ে চলেছে।

আমার চারদিকে ঝামটিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল সবচেয়ে প্রিয়। মামাবাড়ির তিনতলার ছাদে গেলে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। কোথাও ক্ষেত – সবুজের টুকরো। গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালধারে বাবলার সার। আপনাআপনি বেড়ে উঠেছে। ছোট সময় এদের গায়ে সাদা লম্বা লম্বা কাঁটা থাকে। গাছে হাত দেওয়া যায় না। বড় হয়ে বৃক্ষের রূপ নিলে আর এই কাঁটা থাকে না। তখন সেটা খুব ছোট হয়ে যায়। বসন্তে গাছে গাছে হলুদ ফুল। গোল বুরুশের মতো। অনেক কালো ভোমরা জোটে। তারপর লম্বা সুঁটি ঝোলে। অনেকটা ওষুধের মিক্সচার বোতলে লাগানোর মতো কাটাকাটা। এই ফল গরু-ছাগলের খুব প্রিয় খাদ্য। ফল শুকিয়ে গেলেও সমান আকর্ষণ। অনেকে তাই ফল সংগ্রহ করে রাখে। বান এলে গরু-ছাগলকে খাওয়াবে।

ঝামটিয়ায় তালগাছ দেখার মতো। চারদিকে তালের সার। প্রায় জমির ক্ষেতের আলে তালের সার সীমানা নির্ধারণে খুব কাজে লাগে। আর ভাদ্র মাসে তাল পিঠে ও পাকান তৈরির মরশুম লেগে যায়। আবার বোশেখ মাসে তালের শাঁস খাওয়ারও ধুম পড়ে। কাঁচা তাল কেটে শাঁসে বুড়ো আঙুল ঢুকোলেই চিরিত করে রস এসে লাগত চোখে-মুখে। তারপর পুরো আঙুল প্রবেশ করিয়ে শাঁস বের করে আনা। পূর্ববঙ্গে এই বাচ্চা তালকে বলে তালকুড়। সম্ভবত কুঁড়ি বা বাচ্চা রূপের প্রকাশ। আমরা তেমন করে আলাদা কোনো নাম দিইনি। পশ্চিমবঙ্গে বাচ্চা তালের পৃথক নাম নেই।

তাল একটা আনন্দের ব্যাপার। প্রয়োজনেরও। তালকানা  হলে সংগীতজগৎ থেকে নির্বাসন।

সবচেয়ে মজার দৃশ্য হলো, বানের সময় হেলেদুলে তাল ভেসে যাওয়া। ডিঙি বা ডোঙা থাকলে অনেকে পিছু তাড়া করে। এবং বেশ কিছু সংগ্রহ করে ফেলে। না হয় শুধু হা-হুতাশ করে ভেসে যেতে দেখা। স্রোতের টানে তালের হেলতে-দুলতে যাওয়ার ঢংটা আসলে দেখতে খুব সুন্দর। তাল তাল দিয়ে দিয়ে অজানা দিগন্তের দিকে এগিয়ে চলে।

আমরা নানার ছোট পুকুরে যেটায় নিয়মিত স্নান করতাম তার ঢোকার মুখে ছিল তিনটে ত্রিভুজ আকারে দাঁড়ানো তালগাছ। এদের অদূরে একটা বাঁশঝাড়। তার পাশে আর একটা গাছ। সবচেয়ে দীর্ঘ ও তালের আকারের জন্য যে-গাছটা দাঁড়িয়ে তার নাম হাঁড়িতাল। এটা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নজিমন নানিদের বড়পুকুরের পাড় ঘেঁষে। এই গাছের এক একটা তালের আকার ছিল হাঁড়ির মতো। যেমন তার আকার তেমনি মিশকালো রঙের। হাঁড়িতাল সার্থক নাম। কেউ যদি একটা তাল কুড়িয়ে পেত, সবাইকে দেখাত। আর সবার হাতে হাতে ঘুরত তালটা। এটা একটা দেখার মতো জিনিস। পাকা বলে ঘ্রাণও বেশি। এই তাল যে পেত সারাদিন তার মন ভালো থাকত। অনেকটা সাত রাজার ধনপ্রাপ্তির মতো।

পুবদিকে খেলার ছোট মাঠের পাশে ছিল একটা ঢিবি। এই ঢিবির ওপর গোটা তিনেক তালগাছ ছিল। এর মধ্যে একটা পুরুষ। পুরুষ গাছে মোচা সাপের মতো ঝুলতে থাকে। এক সময় শুকিয়ে যায়। ঝোড়ো হাওয়ায় ঝরে পড়ে। তখন এটা জ¦ালানি। তালগাছের পুরনো শুকনো পাতাও ঝরে পড়ে। জ¦ালানি হিসেবে এরও কদর। তাছাড়া গাছের গুঁড়ি ডিঙি তৈরিতে কাজে লাগে। আমার মামাবাড়িতে একে বলত ডোঙা। তাছাড়া পুকুরঘাটের শেষ মাথায় একটা তালের ধাপ খুব মজবুত রাখত পুরো ঘাট। এর ওপর কাপড় কাচা যায়। সান-বাঁধান ঘাটের প্রায় বিকল্প। ঘাটের মর্যাদায় এর বেশ উচ্চাসন।

মামাদের ডোঙাটা বাড়ির পাশের পুকুরে ডুবোনো থাকত। এর ভেতর থাকত ডালপালা। মাঝে মাঝে পুরো ডোঙা উঠিয়ে মাছ পাওয়া যেত। ডোঙাটা বেশ মোটা ছিল। কিন্তু গাছটা ছিল সরল। তাই পেছনের ফাঁকটা ভরতে অনেক কাদা লাগত।

বান এলে আমরা ছোটরা ভয়ে ভয়ে গিয়ে উঠতাম। উঠেই বসে পড়ে দুদিকে হাত ছড়িয়ে সমতা রাখতাম। ডোঙা একটু দুললেই ভয় লাগত। একবার আমরা সংখ্যায় একটু বেশি ছিলাম। আর একটা মরা গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা লেগে উল্টে যায়। তবে মাঠের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল বলে কোনো বিপদ ঘটেনি। জল ছিল আমাদের বুকসমান। পরে জল নিষ্কাশন করে আবার ফিরে আসা; কিন্তু তখনো বুকের ধুকপুকোনি থামেনি।

তালগাছের তুলনায় ঝামটিয়ায় খেজুরগাছ ছিল কম। একটা গাছ ছিল মামাদের ছোট বাগানে পুকুরপাড় ঘেঁষে। একটু বেঁকে। পাকা খেজুরের জন্যে স্নানের সময় জলের মধ্যে হাতড়াতাম। এই গাছের খেজুর একেবারে সাধারণ। আঁটি মোটা – মেদ কম। তবে এর ঘ্রাণটা খুব ভালো লাগত। আর আমাদের সেই বয়সে এ-ই ছিল স্বর্গীয় ফল। ডাঁসা খেজুর থাকত কম … কিন্তু মিষ্টি মাখানো বলে তা-ও অমৃতসমান। পুকুরপাড়ের গাছটায় পাকা খেজুর ঢালে পড়ে জলে। ফলে স্নানের সময় খুঁজে পাওয়া খুব আনন্দের। প্রতিদিন কিছু না কিছু মিলত। তবে পাকা কাঁদি কেটে নিলে আর পাওয়া যেত না। পুকুরের জল ঘোলাটে বলে হাতড়ানো ছাড়া অন্য উপায় ছিল না।

এরপর বড় খেজুরগাছ ছিল মামাদের বড় বাগানের ঠিক সামনে। গাছটা সোজা উঠে গেছে। বেশ বলিষ্ঠ। রসকাটা হয়নি বলে মোটা-তাজা। এর খেজুর বেশ বড় এবং মোটা। স্বাদও অপূর্ব। খুব সকালে ছুট লাগাতাম পড়ে পাওয়া খেজুরের জন্য। বাগদিপাড়াটা একটু দূরে বলে ওরা প্রতিযোগিতায় যোগ দিত না। বেলা করে ওরা রোঁদ দিত। ততক্ষণে গাছতলা ফাঁকা। এদিক-ওদিক আরো কয়েকটা খেজুরগাছ ছিল তবে সেগুলো পুরুষগাছ। ফলবতী নয়।

বাঁশঝাড়ের অভাব ছিল না। তবে দূরে দূরে।

পশ্চিমে নলকূপের পাশে ছিল দুটো ইটের পাঁজা। বেশ আট-ন ফুট উঁচু। বারো-তেরো বর্গফুটের কম হবে না। ঝামটিয়ায় যারা বাড়ি করেছেন সবই নিজেদের পোড়ানো ইটে গড়া। যে দুটি পাঁজা কলের পাশে সম্ভবত মেজো নানা শেখ আনোয়ার আলীর। তাঁর বাড়ি তখনো একতলা। এই ইট পাঁজার পাশে দুটো খেজুরগাছ ছিল। পুরুষগাছ। গ্রামে বলত বাঁজা। অর্থ বন্ধ্যা। আসলে এগুলো পুরুষগাছ। ফলবতী বা স্ত্রীবৃক্ষ নয়। আসলে দখিনপাড়ায় বিএ-এমএ ভরা হলে কী হবে – বাকিরা ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত পৌঁছত খুব টেনেটুনে। গ্রামের বাকি অংশ ভূমিপুত্র। দখিনপাড়া বহিরাগত। আর ভাগ্য-অন্বেষণে যারা আসে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তারা ধনাঢ্য হয়ে ওঠে। বাকিরা ভাগ্যের ওপর দায় ছেড়ে দেয়। ভাগ্য পরিবর্তনের পরিবর্তে একই বৃত্তে ঘুরপাক। যেন ঘানিটানা কলুর বলদ। শুধু পঞ্জিকার পাতা উল্টে যায়।

দক্ষিণপাড়ার কবরস্থানে কয়েকটা খেজুরগাছের অস্তিত্ব আছে। সবগুলো ছিল পুরুষ।

ঝামটিয়ায় মুসলিম পাড়া মাত্র একটি। এটা আগেই উল্লেখ করেছি। তাই কবরস্থানও একটি। পাড়ার পশ্চিম-উত্তর কোনায়। তবে একে পশ্চিমডাঙ্গাই বলা হতো। কবরস্থান খুব একটা বলা হতো না। জানি না কেন। হয়তো কবরস্থান বললে ভীতি জাগায়। যেমন শ্মশান। তবে এই কবরস্থানকে সংক্ষেপে বলা হতো পচ্চিডাঙ্গা। মানে পশ্চিমডাঙ্গা।

বেশিরভাগ জায়গায় কবরস্থান ঘেরা অবস্থায় থাকে, কিন্তু ঝামটের পচ্চিডাঙ্গা একেবারে খোলামেলা। কোনো বাউন্ডারি নেই। তবে বেশকিছু তাল-খেজুর ও অন্যান্য গাছে জায়গাটা গরমের সময় হিমশীতল করে রাখত। এদিকে তেমন লোক চলাচল না করায় বেশ একটা প্রশান্তি বিরাজ করত। অদূরে বাগদিপাড়ার ভিটে। প্রথমে পড়ত ধাড়াপাড়া। পাশাপাশি অন্যসব পাড়া। এখানে একটা পুকুর। সবার সব কাজ। এঁটোবাসন, কাপড়কাচা, স্নান, গো-স্নান পর্যন্ত। এই পাড়ার অদূরে বাগপাড়া। তারপর দোলুইপাড়া। এর উত্তরে মাইতিপাড়া। মাঝখানে একটা অনুচ্চ মন্দির।

এদের সবাই কৃষক। দু-একজন যায় কলকাতা ভাগ্যের চাকা ফেরাতে। গ্রামের এই অংশটি দারিদ্র্যপীড়িত। দক্ষিণপাড়া দেখে এদের অবস্থা মেলান যায় না। সামনে আলো পেছনে আঁধার। সেই ছেলেবেলা থেকে এদের প্রতি আমার একটা ভালোবাসা ছিল। কেন জানি এদের আমার নিজের লোক বা আপন মনে হতো। আমার সমবয়সী কালীপদ, অরূপ, সন্তোষ, দুলাল – এরা খুব কাছের ছিল। এদের চেয়ে সামান্য বড় তিনকড়ি, বোসো, হারান, বাঁশি … এদের ওপরের সবাই ছিল দাদা। শীতলদা, পঞ্চাদা, বাঁকাদা, কুঞ্জদা … বাকি বড়রা সবাই মামা।

মানিকমামা মামাবাড়িতে সারা বছর ফাইফরমাস খাটতেন। তাঁর স্ত্রী সুধী মুখীও প্রায় আসতেন নানি-মামিকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে। বিশেষ করে মাছ কাটা ও মশলা বাঁটা। অন্যান্য গৃহস্থালি কাজেও সহযোগিতা করতেন। আমি তাঁকে মামি বলতাম। তিনি আমাকে খুব স্নেহভরে বাবো বলে ডাকতেন। বাবো স্নেহের ডাক হলেও আমি এর অর্থ উদ্ধার করতে চেষ্টা করতাম। এক তো বাবুর জায়গায় বাবো। আর বাবা না বলে বাবো। শেষেরটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হতো। সুধামামি কৃষ্ণকলি। কপালে বড় লাল টিপ আর সিঁথির সিঁদুর জ¦লজ¦ল করত। নাকে একটা সাদা নাকছাবি। ছোটখাটো চেহারা। এখনো পষ্ট দেখতে পাই পরলোকে চলে যাওয়া মামা-মামিকে। কী সুন্দর মানুষ ছিলেন এঁরা। অন্তরের স্নেহ উজাড় করে দিতেন। কোনো কার্পণ্য ছিল না।

এই মামিকে নিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ছে, যেটা আমাকে এখনো পীড়া দেয়।

অন্যান্য দিনের মতো সুধামামি এসেছেন, এদিকে বাগান থেকে একটা কলাগাছ কাটা হয়েছে। গাছ চিরে বের করা হয়েছে থোড় বা ভেতরের নরম অংশ। একে করা হয় তিন ভাগ।  একটা ভাগ কাটা হয়েছে। আর একটা কাটার পর নানি বললেন, সুধা হাতেরটা কেটে বাকিটা তুই নিয়ে যা।

দুটো অংশ টুকরো করে কাটার পর সুধামামি তৃতীয় অংশটা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমি নানির কথা শুনিনি।

মামি বের হয়ে পড়েন আমার সামনে। বলি, ওই থোড়টা নিয়েছেন কেন? মামি কপট রাগ করে বলেন, বেশ করেছি। আমার রাগ হয়ে গেল। বলি, দিয়ে দেন।

না, দেব না, বলে মামি পাশ কাটিয়ে চলতে লাগলেন। আমি আবার বলি, দিয়ে দেন।

মামি এবার কথা না বলে দিলো দৌড়।

আমি পেছনে।

দৌড়ে একেবারে কলতলা পার হয়ে যাচ্ছি। মামি এগিয়ে। ধরতে পারছি না।

তবে পিছু ছাড়ছি না। এই সময় মামি ঘুরে দাঁড়িয়ে দাঁত-মুখ খুঁচিয়ে বলে ওঠেন, নে তোর বালের সামগ্রী।

এই বলে হাত থেকে থোড়ের অংশটা ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন।

আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

কিছুক্ষণ পর থোড়টা হাতে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে। বাকুলে ঢুকেই পড়ি মায়ের সামনে। হাতে থোড় দেখে বললেন, তুমি ওটা আনলে কেন? ওটা ওকে আমরা দিয়েছি। যাও, ফেরত দিয়ে আসো।

সুধামামিকে আমি এখন কোথায় পাব!

অবস্থার গুরুত্ব বুঝে নানি এগিয়ে এলেন।

ঠিক আছে, আমি পরে সুধাকে বুঝিয়ে বলব।

আমার ঘাড় থেকে পাথর নেমে গেল। কিন্তু মনের গ্লানি আজও ভুলতে পারি না। চিন্তা করে বুঝি শ্রেণি-অবস্থান কত গভীরে প্রবেশ করে থাকে। একজন অল্পবয়সী বালকও তার সম্পত্তির অধিকার অবচেতন মনে বহন করতে থাকে। ঘটনাটা মনে পড়লে আজও লজ্জা বোধ করি।

দক্ষিণপাড়ার পশ্চিমদিকে কবরস্থান। এখানে একটি সান-বাঁধানো পুকুর আছে। পুকুরটা ছোট, কিন্তু ব্যবহার কম হওয়ায় একা একা শোভাবর্ধন করে আছে। তবে বাবা যখন গ্রামে আসতেন মানে শ^শুরবাড়ি আসতেন, পুকুরঘাট জমজমাট আড্ডার জায়গা হয়ে উঠত। বেলা নটার দিকে পুবদিক ছাপিয়ে সূর্য যখন উঁকি দিত আমি আর বাবা পশ্চিম পুকুরের দিকে রওনা দিতাম। আমি ছিলাম তোয়ালে সাবান বহনকারী বয়। বাবার টার্কিশ বড় তোয়ালে। ধবধবে সাদা। নীল বর্ডার দেওয়া। লাক্স সাবান থাকত। কখনো থাকত গ্লিসারিন সোপ। আবার কখনো চন্দন সাবান। গরিব ঘরের সন্তান হলেও বাবা ছিলেন জমিদার-সংস্কৃতির মতো সৌখিন। অথচ মানুষটি গরিবদের কত না ভালোবাসতেন। আসলে জীবন তো সুন্দরভাবে কাটানোর জন্যেই তৈরি। কাজের সময় আদুল গা। কাজ শেষে জীবনকে উপভোগ করা। এটাই তো চিরন্তন। মনে পড়ে বাবার কাছে শোনা ছাত্রজীবনে তিনি এক পয়সায় সারাদিন কাটিয়েছেন। এক পয়সার হিসাব দিতেন। আধ পয়সার ছোলাভাজা, আধ পয়সায় এক কাপ চা। আর কলকাতায় বিনা পয়সায় মিলত কলকাতা করপোরেশনের অঢেল জল। আমি নিজ চোখে দেখেছি প্রতিদিনই দু-বেলা গঙ্গাজলে কলকাতা শহরের সব রাস্তা ধোয়া হতো। কী চমৎকার ব্যবস্থাপনা।

তো পশ্চিমপুকুরের কথা। এর ঘাটে সকাল-বিকাল সব পাড়ার লোক গিজগিজ করত। বাবার কাছে আসার মনের টান তো ছিলই। আরো একটা বড় টান ছিল তিনি পঞ্চাশটার টিনের ডিবে খালি করে সবার দিকে বাড়িয়ে দিতেন। অবশ্য সবাই বয়স্ক, অর্থাৎ অ্যাডাল্ট। ছোটদের এই আসরে আসা নিষেধ।

বাবা বিশেষ করে সিগারেট পান করতেন ক্যাপস্টেন। কিন্তু গ্রামে আসার সময় আরো সব নানা ধরনের সিগারেটের টিন আনতেন। যেমন জন প্লেয়ার্স, ফাইভ ফিফটি ফাইভ ইত্যাদি। সব নাম মনে পড়ছে না।

মনে পড়ে, বাবা এই গ্রামে এলে দোতলার পশ্চিমদিকের কামরায় থাকতেন। এটা একপাশে, তাই। পশ্চিমদিক হলে কী হবে রোদের ঝাঁঝ লাগার উপায় নেই। পাশে লম্বাজাতের একটা বাঁশঝাড়। আমরা তিনতলার ছাদ থেকে দেখতাম নতুন গাছগুলো ছাদ ছাড়িয়ে আরো দশ-পনেরো ফুট লম্বা হয়ে আকাশ বিদ্ধ করত। বাচ্চা গাছগুলোর গায়ে প্রথমে কোনো পাতা থাকত না। শুধু পাবে পাবে খোলস। পরে এগুলো ঝরে পড়তে থাকে, আর বের হয়ে আসে কঞ্চি ও পাতা। কথায় বলে না, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়ো। এই কঞ্চির স্বাদ গ্রামের স্কুলে কেন শহরেও ছাত্রদেরও পিঠে পড়ত। যদিও বাংলা ভাষায় মাস্টারের হাতে বেত থাকে। এতো বেত পাবে কোথায়। অবশ্য চট্টগ্রামে আমি বেতের দেখা পেয়েছি এবং এর প্রহার থেকে বাদ যাইনি। যদিও ভালো ছাত্র ছিলাম। এক থেকে তিনের মধ্যে থাকত অবস্থান।

যে-ঘটনাটা এখনো উদ্ঘাটন করা হয়নি। খুবই মজার ব্যাপার। অবশ্য মজার ব্যাপার হলে গৌরচন্দ্রিকা বড় করতে হয়। কারণ সবার মধ্যে আগ্রহ তৈরি করা। আজকাল টিভি সিরিয়ালে দেখা যায়, বিজ্ঞাপন হিসেবে যে-চিত্র দেখানো হয় তা বাস্তবে আসতে আসতে সপ্তাহ পার হয়ে যায়। অর্থাৎ দর্শককে টেনে রাখা। এই দর্শক টানা লেখার মধ্যেও আছে। গল্প বলাতেও আছে। আসলে ঔৎসুক্য না জাগিয়ে বললে কাহিনি মাঠে মারা যেতে পারে। আমিও সেই মহাজন পথ অনুসরণ করছি।

একদিন বাবা সিগারেটের সব টিন নিয়ে কামরা থেকে বেরোনোর মুখে একটু দাঁড়ালেন। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে জোরে জোরে টান দিয়ে আমাকে, এবার তুমি একটা টান দাও।

আমি অবাক। এমনিতে ছোটদের ধূমপান নিষেধ। তার ওপর বাবার সামনে। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে বাবা বললেন, আমি বলছি তো।

এবার ভরসা পেলাম। দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব কেটে গেল।

বাবা আরো বললেন, জোরে টানবে কিন্তু … না হলে আসল মজা পাবে না।

আমি সিগারেট নিয়ে জোর টান দিলাম। আর চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে এলো। কাশতে কাশতে জান শেষ।

বাবা হালকা করে মাথায় চাপড় দিতে থাকলেন।

কাশি থামতে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগল?

খুব খারাপ। গন্ধ।

বাবা আবার এগিয়ে দিলেন।

না, আমি আর টানব না।

মনের মধ্যে সিগারেটের প্রতি একটা প্রচণ্ড বিদ্বেষ জন্মে গেল।

বাবা বললেন, ঠিক আছে, আর টানতে হবে না। চলো, পুকুরপাড়ে সবাই হয়তো অপেক্ষা করছে।

আমি বাবার পিছু পিছু সিগারেটের তাকিয়া নিয়ে চলতে থাকলাম। থেকে থেকে তখনো কাশি আসছে। আর বাবার মুখে দেখি হাসি।

মনে মনে বলি,

কেন যে লোকে সিগারেট খায়।

সেদিন থেকে সিগারেটের প্রতি আমার একটা বিদ্বেষ এসে গেল।

আজ বুঝতে পারি বাবা কেমন অভিভাবক ছিলেন।

শুধু এখনো মনে হয়, যদি তিনি পাশে থাকতেন, কত কী শিখতে পারতাম, জানতে পারতাম। আজ মা-বাবা কেউ পাশে নেই। নিজের কথা লিখতে গিয়ে তাঁদের কথা মনে হওয়ায় মনটা হাহাকার করে উঠল।