দখিনা দুয়ার

এক সাধারণ গৃহস্থের বাড়িতে সিঁধেল চুরি হয়েছে। নিয়েছে সাধারণ জিনিসের সঙ্গে গৃহিণীর লুকানো মহামূল্যবান একটা বস্তু। পরদিন সকালে গ্রামের সালিশে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে চালপড়া খাওয়ানো হলো, কিন্তু কেউ ধরা পড়ল না। বিচলিত গৃহিণী ভরা মজলিশে ঘোষণা করলেন, চোর ধরা পড়লে, চুরির মাল উদ্ধার হলে, মজলিশে যত লোক আছে সবাইকে খাসির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়াবেন। এরকম একটা ঘোষণা গ্রামে শ-কান হতে সময় লাগল না। যারা দরবারে উপস্থিত হতে পারেননি তাঁরা আফসোস করতে লাগলেন। বাড়ি ফিরে কর্তামশাই তো রেগেমেগে অস্থির। কী দরকার ছিল এরকম একটা ঘোষণা দেওয়ার, ‘জানো, ব্যাকটি লোক খাওয়াইতে কত ট্যাকা লাইগবো? ট্যাকা কি তোমার বাপের বাড়ি থ্যাইকা আইবে?’

বাপের বাড়ির কথায় কর্তাগিন্নি উল্টো ফুঁসে ওঠাতে চুপসে যেতে হলো কর্তামশাই, খলিল উল্লাহ ওরফে খইল্ল্যাকে। কিন্তু পরদিন থেকে দুজনের ভেতর একটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল।

কর্তামশাই নিয়মিত মসজিদে নামাজ পড়া শুরু করে দিলেন। নামাজ পড়া যাই হোক, দোয়া করতে লাগলেন বেশি বেশি। চোর যেন কোনোভাবেই ধরা না পড়ে। ওরে বাপরে, আটান্নজন মানুষ। খাসির মাংসের সঙ্গে ডাল আর দই যদি নাও দিই, তবু ছয় হাজার টাকার নিচে কোনোভাবেই শেষ করা যাবে না। তার জন্য কমপক্ষে বিশ মণ ধান বেচতে হবে, আর তার পরিণতি হচ্ছে বছরের অর্ধেক না খেয়ে থাকা, অথবা কামলা বেচতে হবে। কামলা বেচা বাদ দিয়েছেন খলিল তাও বছর পাঁচেক হবে। যতটুকু জমি আছে তাতেই তাঁদের সারা বছর চলে যায়। এখন যদি আবার কামলা বেচতে হয়, তবে তো অপমানের শেষ থাকবে না।

আশেপাশের বাড়ির মহিলারা আরো অবাক হয়ে দেখল কৃষক গিন্নিও লুকিয়ে লুকিয়ে খুব নামাজ পড়ছেন। হা হা হা, নামাজ  তো তিনি মাঝেমধ্যে পড়তেন, কিন্তু ভালো করে জানতেন না। এক বুড়ি আসত ভিক্ষা করতে, তাকে লোক দিয়ে ডেকে এনে ভালো করে খাইয়ে-দাইয়ে নামাজের নিয়মকানুন জেনেবুঝে শুরু করলেন। সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে নামাজে যেন কোনো ফাঁক-ফোকর না থাকে। তাঁর মহামূল্যবান জিনিস চুরি হয়ে গেছে। সেটা ফিরে না পেলে চলবেই না। আর তো কোনো উপায় নেই এক আল্লাহ ছাড়া। সেই ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় ক্লাস ফাইভের উত্তরপাড়ার সিদ্দিকের দেওয়া রুমালখানাও যে চোর ঘটিবাটি, কাপড়-চোপড়ের সঙ্গে নিয়ে গেছে। এতদিন যেটা সে যক্ষের ধনের মতো লুকিয়ে রেখেছিল। কীভাবে যেন সাত বছরের বিবাহিত জীবনেও সেটা তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হয়েই ছিল। যে করেই হোক রুমাল তাঁর ফেরত চাই। দরকার হলে তিনি সারা গাঁয়ের লোক খাওয়াতেও রাজি। কিন্তু দিন যাচ্ছে রাত যাচ্ছে, সপ্তাহ যেতে বসেছে চোরের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কর্তামশায় মোটামুটি হাঁপ ছাড়তে শুরু করেছেন। কর্তাগিন্নি ইতোমধ্যে আরো আটঘাট বেঁধে নেমেছেন। পানিপড়া, তেলপড়া আর কবিরাজ বাড়ি যাতায়াত বেড়ে গেছে। এভাবে কেটে গেল পুরো দশ দিন। কর্তামশায় এখন দু-এক ওয়াক্ত নামাজ কামাই করছেন। কিন্তু গিন্নি পাঁচ গাঁও দূরের এক ফকিরের সন্ধান পেয়ে গেছেন, যার গণনা নাকি একটাও ভুল হয় না। কাল সকালেই যাবেন সেখানে। ফের দুদিন পর কর্তামশায় আবার ফজরের নামাজ আদায় করলেন, অনেকক্ষণ মোনাজাত করলেন এবং শেষে ফকিরের মৃত্যু কামনা করলেন। কিন্তু গিন্নি তাঁর পরিকল্পনামাফিক সকালে গরম ভাত রাতের তরকারির সঙ্গে আলুভর্তা করে সবার সঙ্গে খেয়ে তৈরি  হয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে ঘটল ঘটনাটা।

একমাত্র ছেলে, বয়স সাড়ে পাঁচ, বাইরে থেকে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল।

‘এই ছাড়, ছাইড়া দে, আমি ইট্টু বাইর হমু। রতনকান্দি, ম্যালা দূর, তাড়াতাড়ি বাইর হওন লাইগবো। বাজানের কাছে বাড়িত থাকবি। অ্যাসা য্যান কোনো জিনিস উল্টাপাল্টা না দেহি। চুপচাপ বইসা থাকবি। হেগো সামচুর বাপ, কই  গ্যালা। আমি কিন্তুক বাইর অইলাম।’

কিন্তু ছেলে সামচু নাছোড়বান্দা, মাকে ছাড়ছেই না।

‘মা মা, দেহ এই জিনিসটা তোমাক দিতে কইছে।’

সামচুর মুঠোর মধ্যে কিছু একটা। মাকে দিতে চেষ্টা করছে। প্রথমে গৃহিণী আমলে না নিলেও একনজর দেখে মনে হলো একটা ভাঁজ করা কাগজের টুকরা, একটুখানি বের হয়ে আছে। হঠাৎ হৃদয়ের কোথায় যেন একটু টান পড়ল, ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সামচু এইডা কী রে?’

ছেলে হাসতে হাসতে অবলীলায় উত্তর দিলো, ‘জানি না।’

এতক্ষণে মায়ের নজরে এলো, ছেলের অন্য হাতের মুঠোতে দুটি কাঠিলজেন্স। বুকটা ধড়াস করে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল বারো বছর আগের কিছু ছবি। দরজার দিকে এক নজর তাকিয়ে ছোঁ মেরে নিয়ে নিল কাগজখানা। হাঁটু গেড়ে ছেলের দু-কাঁধ ধরে চোখের দিকে তাকালো। ফিসফিসিয়ে বলল,

‘কেডা দিছেরে?’

‘চিনি না।’

‘আনলি ক্যা!’

সামচু দাঁত বের করে হাসতে হাসতে হাতের কাঠিলজেন্সের দিকে তাকিয়ে কি এক আশঙ্কায় হাতটা লুকানোর চেষ্টা করল। গৃহিণী আসমা খাতুন খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। চোখের পাতাদুটি কেঁপে গেল দুবার। ছেলের মুখের ওপর দৃষ্টি ফিরিয়ে ত্বরিত ভাবার চেষ্টা করলেন, এইটুকুন ছেলের চোখের সামনে এই মুহূর্তে মায়ের মুখের অভিব্যক্তি কী রকম হওয়া উচিত। কিন্তু ছেলের চোখের দৃষ্টিতে মায়ের মুখের অভিব্যক্তি খোঁজার কোনো আগ্রহ দেখতে পেলেন না আসমা খাতুন। ছেলের কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে থুতনি নেড়ে বললেন, ‘যাও বাবা, উঠানে খেলো গিয়া, আইজ আর পড়ব্যার বসা লাইগবো না।’

উল্লাসে হাততালি দিতে দিতে উঠানের দিকে সবেগে বেরিয়ে গেল সামচু। সম্বিৎ ফিরল আসমার। খোলা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে উঠানের এদিক-ওদিক দেখে নিলেন। নিঃশব্দে ফিরে এসে চৌকির ওপর বসে কাগজটির ভাঁজ খুলতে লাগলেন। একটা সময় ছিল, যখন এমন এক-একটি চিঠির ভাঁজ খুলতে খুলতে খুশিতে চোখ-মুখ ভেসে যেত, কিন্তু আজ অন্যরকম কিছু মনটাকে ছেয়ে গেল। কার চিঠি, কী লিখেছে, কেন লিখেছে, সে-ই কি লিখেছে? এতদিন পরে আবার কী? সে  তো নাও হতে পারে! হাতের লেখা দেখেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। চোখ আরো একবার দরজার দিক থেকে ঘুরে এসে চিঠির ওপর পড়ল। এক সেমিকোলন, চার দাড়ি দিয়ে লেখা দুই লাইনের চিঠি। সম্বোধন আর ইতির বালাই নেই, অবশ্য এগুলির যথাযথ প্রয়োগের আবশ্যকতা মরে গেছে আগেই। ‘হুনলাম তুমি রতনপুর ফকিরের বাড়ি য্যাবা। রতনপুরের আগে যে পাইকর গাছটা পাওয়া যায়, তার তলে থাকমু। জরুলি কতা আচে। না কইলেই না।’ অনেক প্রশ্নের সঙ্গে ভয়, শঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর একধরনের উত্তেজনা মাথায় ভর করলেন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে বুঝতে পারলেন যখন সে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে চেষ্টা করলেন। গ্লাসে ঢেলে পানি খেলেন। গলা ভিজলেও মনটা সায় দিচ্ছে না। ভাবতে লাগলেন, ও তো থাকবেই। দেখা হলে কী করবে, কী বলবে, কেমন করবে। এটা কি আমার সর্বনাশের শুরু, নাকি মনের কোণে জিইয়ে রাখা রুমালের মতো সব শেষের বাঁশি। একবার ভাবলেন, যাবেন না। আজ আর বের হবেন না। অন্যদিন যাবেন। আবার ভাবলেন, অন্যপথে ঘুরে যাবেন। তৈরি হয়ে না গেলে আবার সামচুর বাপরে কৈফিয়ত দিতে হবে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ কেটে গেছে বুঝতেই পারেননি। ঘরে ঢুকলেন সামচুর বাপ, ‘কি গো, বইসা আচো যে, তোমার কি শরীল খারাপ? তাইলে থাক, আইজ আর যাইয়া কাম নাই, দুপুরে লরম-খিচুড়ি পাক করো, ডিম ভাজা দিয়া খাইতে মজাই লাগবো।’

একটানে কথাগুলি বলে থামল সামচুর বাপ খলিল উল্লাহ। সম্বিতে ফিরলেন আসমা। অজান্তেই ডান হাতের মুঠোর মধ্যে চালান হয়ে গেছে চিঠিখানা। থতমত খেয়ে নামলেন চৌকি থেকে।

‘কিন্তুক সামচুর বাপ, আমি যে নিয়ত কইরা ফালাইছি।’

‘ও, তাইলে তুমি যাইবাই! তা যাও। না আমি কইছিলাম আইজ না অয় থাইক, আরেক দিন যাইও। চোর তো আর আজক্যাই মইরা যাইতাছে না।’ আসমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। চিঠিটি তিনি সামচুর হাতে দেখে ফেলেননি তো? কিন্তু তিনি তো পড়া জানেন না, দেখলেই লাভ কি। তাছাড়া তিনি তো খেয়ে উঠেই পাশের বাড়ি লোকমানের উঠানে গেলেন ক্ষেতের পরামর্শ নিতে। রাস্তার দিকে তো যান নাই। এক্ষণে সাহস ফিরে পেলেন বুকে। তারপরও মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গিয়ে পারলেন না আসমা খাতুন। অন্যদিকে ফিরে বললেন, ‘তোমার কতাও হাচা, কিন্তুক দুই-একদিনের মোদেই তো তোমার বোনাবুনি লাইগা যাইবো। তহন তো আর যাওন যাইবো না।’

ধপ করে বসে পড়লেন খলিল আধা ভাঙা একটা টুলের ওপর।

‘তাইলে কি আমি যামু তোমার লগে?’

কথাটা আসমার কান ভেদ করে মস্তিষ্কে গিয়ে ঠেকল। চোখে সরষে ফুল ভাসছে অসংখ্য। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। এলোমেলো পায়ে একটু কাছে গেলেন আসমা।

‘তুমি এত চিন্তা কইরত্যাচো ক্যা! আমি চইল্যা যাইতে পারুম, দুইজন একলগে গেলে চোর যদি দিনের বেলায় আহে?’

এক্ষণে ভালোই বুঝতে পারলেন খলিল যে, তাঁর চালাকি কোনো কাজেই আসবে না।

‘ঠিক আছে, যাইব্যাই যহন তাড়াতাড়ি বাইর অও। সামচু, আয় বাপ আমার বগলে থাক।’

আসমা খাতুন বোরকা পরে বক্র অংশ ভাঙা ডাঁটের ছাতাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আঙিনা ছেড়ে রাস্তায় পড়েই হনহন করে হাঁটা শুরু করলেন। ছাতাটা ছড়িয়ে মাথার সন্নিকটেই ধরে রেখেছেন যাতে আশেপাশের কেউ তাঁকে দেখে চিনতে না পারে। ফকিরবাড়ির কথা তো অবশ্যই কাউকে জানানো যাবে না। একটানা হেঁটে চললেন প্রায় চল্লিশ মিনিট। গ্রাম থেকে বের হয়ে প্রথমেই পড়ে হড়াতৈল, তারপর খামুল্লাপাড়ার হাট বাঁয়ে রেখে ডানে মোড় নিলে খড়মপুর। খড়মপুরের পরেই এই লক্ষ্মীপুর আর তার পরেই রতনকান্দি ফকিরের বাড়ি। এই লক্ষ্মীপুর গাঁয়ে তিনি ছোটবেলায় দু-একবার এসেছেন মায়ের সঙ্গে। কেমন যেন এক আত্মীয় ছিল মায়ের দিকের। এখন আর ভালো মনেও নেই তাঁর। হাঁটার গতি কমান আসমা। একটু সামনেই একজন বয়স্কমতো লোক ছাগলের রশি ধরে রাস্তা পার হচ্ছেন। আরেকটু কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন আসমা, ‘চাচা, রতনকান্দি যাওয়ার এইমুহে একটা ঘাটা আঁচিল না, গাঁয়ের মদ্যে দিয়া?’

‘হ, আচে তো, কিন্তুক তুমি তো মা য্যাবার পাইরবা না। এই ঘাটায় একটা আলোট আচে, হেকানে একটা বাঁশের হাঁকো আচিলো। গ্যাছে মঙ্গলবার আটের দিন ভাইঙ্গ্যা পড়চে। পানি পার অইয়া যাওয়া যায়, কিন্তু তোমার তো মা কাপড় ভিজা যাইব। তুমি এই পতেই যাও।’

এখন কী হবে? এই পথেই তো পাইকর গাছ, সিদ্দিকভাই তো দাঁড়িয়ে থাকবেন। ছাতার নিচেও মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল। লক্ষ্মীপুরের সেই আত্মীয়ের খোঁজ করবেন নাকি? দু-তিন ঘণ্টা কাটিয়ে দেরি করে গেলে সিদ্দিকভাই নিশ্চয়ই চলে যাবেন। ভাবনায় ছেদ পড়ল, লোকটি যখন বললেন, ‘খাড়ায়া থ্যাইকা লাভ নাই মা। এই পতেই যাওয়া লাগবে।’

কে জানতো এই পথে কোনো হালট আছে। সেই হালটে কোনো সাঁকো ছিল। সেই সাঁকো আবার ভেঙে গেছে, আবার পানিও আছে এবং তাতে পার হওয়া যাবে না, কাপড় ভিজে যাবে। রুমাল চুরি, মজলিশের লোক খাওয়ানো, ফকিরবাড়ি, সিদ্দিকের চিঠি, সাঁকো ভাঙা, পানিতে কাপড় না বাঁচা, এই সবকিছু যেন মহাশূন্যের গোলকধাঁধায় ফেলে দিলো আসমাকে।

অধিকতর ধীরপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন আসমা খাতুন। গ্রামের পাশ দিয়েই রাস্তা। অচেনা-অজানা জায়গায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে নানান জন নানান কথা জিজ্ঞাসা করবে। হাঁটতে হাঁটতে খোঁজার চেষ্টা করছেন অপেক্ষাকৃত গরিব কোনো বাড়ি। যেখানে উঠে  কিছুক্ষণ বসা যাবে। পানি-টানি খেয়ে এটা-ওটা বলে কিছুটা হলেও সময় নষ্ট করা যাবে। গরিব মানুষেরা অপেক্ষাকৃত ধনী মানুষদের দেখলে যথেষ্ট খাতিরযত্ন করে, অযথা কোনো প্রশ্ন করে বিরক্ত সৃষ্টি করতে চায় না। ধনী বা মধ্যম শ্রেণির বাড়িতে উঠলে হবে তার উল্টোটা।  

কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম তো প্রায় শেষ। ওরকম বাড়ি  তো চোখে পড়ল না। গ্রামের ভেতরের দিকে নিশ্চয় আছে। কিন্তু এখন কী করবেন তিনি? গ্রামের শেষ বাড়িটা পার হতেই ডানদিকে একটা মোড়। দুদিকের বাঁশঝাড় রাস্তার ওপর এসে সুড়ঙ্গের মতো তৈরি করেছে। রাস্তায় নেমে আসা কঞ্চিগুলি যাচ্ছেতাইভাবে এলোমেলো থাকার কথা, কিন্তু এখানে দেখা গেল যত্ন করে সমান্তরালে কাটা। সাজানো গেট দিয়ে কোনো অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির আগমন ভাবতেই ডানদিকে চোখে পড়ল রাস্তার সঙ্গে ফাঁকা জায়গায় একটা নতুন বাড়ি। দুখানা টিনের বাংলা ঘর। একটাতে মাটির দেয়াল তোলা হয়েছে, অন্যটাতে দেয়ালের কাজ শুরু হয়েছে। বাড়ির বউটা মাটির সঙ্গে গমের ডাঁটা ছোট ছোট করে কেটে তার সঙ্গে ধানের তুষ মিশিয়ে দেয়ালের জন্য মণ্ড তৈরি করছে। এখন আর তেমন কেউ ছনের চাল দিয়ে ঘর দেয় না। এই মাটির দেয়ালও হয়তো কোনো একদিন থাকবে না। ছোট একটা ছেলে, বয়স বারো-তেরো হবে, নতুন লাগানো গাছে বদনা দিয়ে পানি দিচ্ছে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উঠবে কি উঠবে না ভাবতে ভাবতেই সাইকেলের বেল বেজে উঠল। আঁতকে উঠে উহ্ শব্দ করে দু-পা সরে দাঁড়ালেন আসমা খাতুন। সাই করে বের হয়ে গেল সাইকেলটা। একটা দশ-বারো বছরের ছেলে, সিটটাকে বগল দিয়ে চেপে ধরে, রডের নিচ দিয়ে পা ঢুকিয়ে, কাত হয়ে বাদুরের মতো ঝুলতে ঝুলতে চালিয়ে গেল এবং নিমেষেই বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। হুটহাট শব্দে পেছন ফিরে চোখে পড়ল, গাইগরুর দড়ি হাতে একজন বাড়ি থেকে নামছেন। ওই বউটার জামাই-ই হবেন নিশ্চয়। সঙ্গে মাস দুয়েকের এঁড়ে বাছুর। আবার দু-পা সরে দাঁড়াতে হলো আসমা খাতুনকে। লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই মন নিরাশায় ছেয়ে গেল। গোমরামুখো লোকটা যে শুধু বিশ্রী চেহারার মালিক তাই নন, যথেষ্ট বদরাগী আর কঞ্জুষও বটে। হা হা হা, মুখ দেখে এতকিছু বোঝা যায়? আসমা খাতুন আবার এতকিছু বুঝতে শিখলেন কবে থেকে? আসলে তা নয়, এরকম চেহারার, বেশভুষার লোককে যে কেউ প্রথমে দেখলে এর চেয়ে বেশি কিছু বুঝে ফেলতে পারবে। কোনো রকম উচ্চবাচ্য না করে আবার হাঁটা শুরু করলেন আসমা। ধুর, যা থাকে কপালে। শেষ পর্যন্ত ছাতা তো আছেই। ছাতার আড়াল দিয়ে যদি সিদ্দিকভাইকে ফাঁকি দেওয়া যায়। একটা অচেনা মেয়েমানুষকে তো তিনি আর ডেকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাবেন না। হাঁটা শুরু করতেই ফাঁকা রাস্তায় পড়লেন। রাস্তার দুপাশে গাছপালা কিছু আছে বইকি, কিন্তু কোনো বসতি নেই। শুনেছেন, এই রাস্তা নাকি অনেকদূর গিয়ে পাকা সড়কে পড়েছে। অতদূর আর আসমা খাতুনের কখনো যাওয়া হয়নি। ফকিরবাড়ি রতনকান্দি পার হয়ে আর একটু গেলেই ছনতলা বাজার। ওই পর্যন্তই তাঁর যাওয়া। ছোটবেলায় আব্বার সঙ্গে না মামার সঙ্গে ছনতলার মেলায় গিয়েছিলেন তা আর মনে নেই। একটু বড় হলে মায়ের সঙ্গে এসেছিলেন এই লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত, তাও দু-একবার। যে-রাস্তায় হালট পড়ে সেই রাস্তায় গিয়েছিলেন মেলায়, ফিরেছিলেন একটু ঘুরে, অন্য রাস্তায়। এখন এই রাস্তাটা তাঁর পরিচিত না অপরিচিত তাও তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। শুধু মনে আছে, এই দিকে। সিদ্দিকভাইয়ের সেই পাইকর গাছ কোথায় বা আর কতদূরে আন্দাজ করতে পারলেন না।

চটি পরে হাঁটতে গিয়ে পায়ে কিছুটা ব্যথা পাচ্ছেন। এসব পরে এতদূর হাঁটার অভ্যাস নেই। সকালে কিছুক্ষণ পায়ে দিয়ে থাকা আর সন্ধ্যার পর রান্নাবান্না শেষ করে হাত-পা ধুয়ে শোয়া পর্যন্ত পরে থাকা। খুলে হাতে নেবেন কি না ভাবতে ভাবতেই একটা হোঁচট খেলেন আসমা খাতুন। ডান পায়ের চটির ফিতা খুলে আঙুল গলিয়ে বের হয়ে গেল। হাতে তুলে একটু কসরত করে ফিতার বোঁটাটা আবার চটির ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন। সামনে-পেছনে দেখে নিয়ে বাঁ-পায়েরটা খুলে এক করে হাতে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। সামনে দূরে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে, এটাই রতনকান্দি কি না বোঝার চেষ্টা করলেন আসমা খাতুন। কিন্তু এটার আগে  তো কোনো পাইকর গাছ চোখে পড়ছে না। যেটার কথা সিদ্দিকভাই বলেছিলেন। তবে কি এর পরের গ্রাম? দূরত্বের ব্যাপারটা অনুমানের চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে এখন। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে সরল চিকন সাদা ছালের কিছু বিদেশি জাতের গাছ লাগানো। তালপাতার সেপাই, রানিকে স্বাগতম জানানোর জন্য সারি করে   দাঁড়িয়ে আছে। কল্পনার ভাবনাগুলি বেশ উদ্বেলতা সৃষ্টি করে। কতদিন দেখা হয়নি আশপাশের বিচিত্র প্রকৃতি। একঘেয়ে জীবনের চলাচলে আবদ্ধ হয়ে গেছেন তিনি। নিজের বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয় না তাঁর। নিজের বাড়ি শব্দটা মনের কোনো এক কোণ থেকে উঠে হাড়ে বাতাস লাগানোর মতো শীতল একটা অনুভূতি এনে দিলো। বিয়ের পর থেকে শ^শুর আর শাশুড়ির অত্যাচারে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছেন কত দিন কত রাত তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সংসারটা ছোটই ছিল, কিন্তু সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করাতেন শাশুড়ি, কোনো সময় বসতে দিতেন না। সবচেয়ে কষ্টের সময় গেছে সামচু যখন কোলে। পোয়াতি হওয়ার পড় তো শেষের কয়েক মাস মায়ের কাছেই ছিলেন। কিন্তু সামচু হওয়ার পর মাস ঘুরতে না ঘুরতেই বাড়ি নিয়ে এলেন বুড়ি। প্রথম কয়েকদিন টুকটাক কাজের মধ্যে দিয়েই কেটে গেল। চল্লিশ দিনের দিন সামচুর চুল কেটে গোসল করিয়ে দিলেন। তাঁকে দিলেন একসেট নতুন কাপড়। লালপেড়ে সবুজ শাড়ি। আসমার খুব পছন্দের। ‘সামচুর বাপেরে জিগাইলাম, তুমি কিনছ? কইলো, না আব্বায় কিনছে। তুমি আসার আগেই আব্বায় হাট থেইকা কিন্যা রাখছিল। মনে মনে ভাবলাম, ‘যাক, জীবনে মনে হয় একটু শান্তি ফিরা আসল।’ পরদিন সকাল থেকেই শুরু হলো তাঁর সেই ভাবনার বংশনিপাত। সকালবেলাই শুরু হলো ডাকাডাকি।

‘বৌমা, সামচুরে লয়া অ্যাসো তো আমার গরে।’

সামচু তখন ঘুমায়। বললেন,

‘আম্মা, সামচু তো এহোনো গুমায়।’

‘গুমাইত্যাছে গুমাক, তুমি ওরে এহানে লয়া আহো। দেখ, সাবধান, গুম য্যান না বাঙ্গে।’

ওরে বাপরে, এরকম তো কখনো করেননি আসমা। ঘুমের বাচ্চা নিয়ে যাবেন অন্য ঘরে, কিন্তু ঘুম ভাঙবে না। তিনি একটু দোনামনা করছেন। দ্বিতীয়বার না ডাকলে যাবেন না ভাবছেন। অমনি ডাক পড়ল।

‘কী অইল, এহনো আইলা না?’

চেষ্টা করলেন দ্রুত পৌঁছাতে। সামচু একবার ক্যা করে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবলেন, বিপদ বাড়ল। শাশুড়ি দেখে বললেন,

‘ঘুম বাঙ্গাইছ নাহি? এইহানে আমার কোলের কাছে হোয়াও। আর হোনো, গর উটান জার দিয়া আইশ্যালের ছাই তুইল্যা পাকের জোগাড় করো।’

ব্যস আর কিছু মুখে বলে দিতে হলো না। তিনি সারাদিন থাকতেন সামচুকে নিয়ে। শুধু রাতে শোয়ার সময় আসমার কাছে দিতেন। দুধ খাওয়ানোর সময়টুকুতেও কাছে দাঁড়িয়ে থাকতেন। খাওয়া হয়ে গেলেই নিয়ে যেতেন। ছেলেকে একান্তই কাছে পেলেন এই তো বছরখানেক হলো, শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর। তবে শান্তির মলম দিয়ে গেছেন যন্ত্রণা আর হাহাকারের পোড়া ঘায়ে। জ্বর তখন অনেক বেশি। প্রলাপ বকছেন জ্বরের ঘোরে। আসমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন,

‘বউমা, তোমাক ম্যালা গাইল পাড়ছি, ম্যালা কষ্ট দিচি। তোমাক দিয়া হারাদিন কাম করাইচি। তুমি মনে কোনো দুক্কু লিও না। তুমি তো জানো, তোমার দাদা হশুর বাপের এক ছ্যাইলা ছিল, তোমার হশুরও বাপের এক ছ্যাইলা আর আমার সামাদও একলাই। তোমার সামচুও যে একলাই অইব তাও বুজব্যার পারত্যাছি। কিন্তু করার কিছু নাই। এই বংশের এইটাই ধারা। তুমি আছিলা বাপের ছোট ম্যাইয়া। কামকাইজ জানতা না কিছুই। ছামাদ তোমাক পছন্দ কর‌্যাছিল বইল্যা আমি গরে আনছিলাম। এই সংসারডা যে তোমাকই হামলাইতে অইব হেইডাও বুজব্যার পারত্যাচিলাম। এড্যাও এ-বাড়ির ধারা। কিন্তু …’

এটুকু বলে থামলেন আমার শাশুড়ি। কয়েক সেকেন্ড থেমে আবার বলা শুরু করলেন।

‘কিন্তু তোমার হশুর যে, আমার আগে চইল্যা যাইব হেইটা বুজব্যার পারি নাই। খলিলেক দেইখ্যা রাইখো। সামচুক বেশি মায়া দিব্যা না। যদি পারো ওক লেহাপড়া হিকাইও। এই বাড়ি আর বংশের কেচিকল থ্যাইকা ওরে বাইর কইরা দিও।’

দু-চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল, মাথাটা একদিকে কাত হয়ে গেল। ছোটবেলায় দাদির কাছে শোনা গল্পের মতো মনে হলো। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল।

‘এইহানে খাড়ায়া খাড়ায়া কী কর! কহন থেইক্যা তোমাক দেকত্যাছি। ওই যে হামনের পাইকর গাছের তলে খাড়ায়া আচিলাম।’

বাস্তবে ফিরে এলেন আসমা। চটি হাতে করে কতক্ষণ হেঁটেছেন, কতদূর এসেছেন, কিছুই মনে করতে পারছেন না। সিদ্দিকের ডাক শুনে অপলক তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। মনে পড়ে গেল কোন এক পাইকর গাছের নিচে সিদ্দিকের দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল এবং তিনি যাচ্ছেন রতনকান্দি ফকিরের বাড়ি। অদূরেই একটা মাঝারি আকারের পাইকর গাছ দেখা যাচ্ছে এবং তিনি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। পিছনে লোকজন আসছে কি না দেখতে গিয়ে দ্রুত সরে দাঁড়াতে হলো তাঁকে। ছোট ছোট দইয়ের খুঁটি ঝাঁকাভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে মধ্যবয়সী এক গোয়ালা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধান আর গমের বদলে বিক্রি করবে সারাদিন। সিদ্দিকও সরে এলো পাশে।

‘তোমাক কতদিন পর দেকলাম, অনেক হুকায়া গেচো। কেবা আচো তুমি। এতদূর যহন আইচই লও ওই গাচডার তলে ইট্টু খাড়াই। তুমি  তো আর আমার বিয়া করা বউ না, বেশিক্ষণ তো আর খাড়াইতে পারুম না। মানুষজনের যাতায়াত আচে না!’

আসমা অপলক দেখছেন সিদ্দিককে। মনের মধ্যে একে একে কাহিনির মতো ভেসে আসছে সব স্মৃতি। কতটা ভালোবাসতেন তাকে আসমা। সিদ্দিকের কতটা আশ্রয়-প্রশ্রয়ের জায়গা আসমার মনের আঙিনায় জায়গা দখল করে রেখেছে, সেটা তো তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। তার শেষ স্মৃতিটুকু ফিরে পাওয়ার জন্যই তো আজ এত দৌড়াদৌড়ি।

‘তুমি কেবা আচো!’

যেন মুখ ফসকে বের হয়ে গেল কথাটা। সঙ্গে বের হয়ে গেল বুকের ভেতর জমে থাকা বহুদিনের অভিমানটুকু।

‘আমার কতা বাদ দেও, লও গাচটার তলে খাড়ায়া ইট্টু কতা কই।’

ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ভালো দেখায় না ভেবেই দুজনে মৃদু পায়ে হাঁটতে থাকেন সামনের দিকে। আবারো নীরবতা ভঙ্গ করলেন সিদ্দিক।

‘আসমা, তুমি অয়তো আমার বেবাক খবরাখবর পাওনা। আব্বা অটাৎ মর‌্যা যাওয়ার পরে হৎ বাইয়েরা আমাক আর মাক ঠকাইচে। লেহাপড়া তো আর করব্যার পারি নাই। মাজে-সাজে কামলা-টামলা বেচি। মাক লিয়া একটা গরে থাকপ্যার দিচে। আশপাশের গাঁয়ের দুই-একজন বদলোকের হাতে পরিচয় অইচে। এহন বুজব্যার পারত্যাচি আমি খারাপ অইয়া গেচি।’

এটুকু বলে একটু থামলেন সিদ্দিক, কী জানি বাকি কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছিল কি না।

‘দুই-একদিনের মদ্যেই এই গাঁও ছ্যাইড়া টাউনের হেইপার মামাগো গাঁয়ে চইলা যামু। আসলে তোমাগো আনন্দ সুহের সমাজে আমাক মানায় না।’

পথের দিকে তাকিয়ে কথাগুলি শুনছিলেন আসমা, এইবার ছাতার ফাঁক দিয়ে মুখের দিকে তাকালেন। মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন সিদ্দিক। মুখটা দেখানোর ইচ্ছা হচ্ছিল না, নাকি চোখের পানি লুকাতে চাইছিলেন সিদ্দিক, বোঝা গেল না। গাছের নিচে চলে এসেছেন। কিছুক্ষণ নীরবতা। ভঙ্গ করলেন সিদ্দিক।

 ‘তুমি কি ফকিরবাড়ি যাইব্যাই! কি ঠেকা! হুনচি বেশি কিচু তো চুরি অয় নাই। তাছাড়া চোর দরা পড়লে  তো খরচও আচে। তুমি বাড়িত ফিরা যাও।’

বহুদিন দেখেননি সিদ্দিকভাইরে। ভালো করে চিনতে পারবেন কি না তাও বুঝতে পারছিলেন না। আজকের রুক্ষ চেহারার সঙ্গে আগের সিদ্দিকের অনেক তফাৎ। তারপরেও মনে হলো, এই মুখটাই কতদিন দেখি নাই।

‘সিদ্দিকভাই তুমি একটা বিয়া করো।’

কথাটা বলেই ছাতার আড়ালে মুখটা লুকিয়ে নিলেন। সিদ্দিকের চোখের সামনে ভেসে উঠল ভিটা-মাটিহীন কষ্টেসৃষ্টে কেটে যাওয়া একটা অনিশ্চিত জীবনের ছবি।

‘আসমা তুমি আমাক আসাইলা। বিয়া অইত্যাছে পুরুষ মাইনসের বিলাসিতা, আর মাইয়া মানইসের দায়ঠেকা। পিরথিবিতে ওইসবের কোনো মানে নাই, পেরেম বালোবাসাই সব।’

আসমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তাইলে কি সিদ্দিকভাইও সেই ভালোবাসাটাই ধরে রেখেছেন ওই কঠিন, শক্ত, চিমসে হয়ে যাওয়া বুকের ভেতরে। কিন্তু আমার তো কোনো দোষ ছিল না! যে আগুনে পুড়ছেন তিনি আজ, সেটা তিনি নিজেই জ্বালিয়েছিলেন। আজ সে আগুনে কি আমিও পুড়ছি না! তিনি তো কোনোদিনও জানতে পারবেন না, চোর আমার কি চুরি করেছে, কেন আমি ফকিরবাড়ি দৌড়াদৌড়ি করছি। আপনা-আপনিই একটা দীর্ঘশ^াস বেরিয়ে গেল।

‘সিদ্দিকভাই আমি যাই, সামচুক বাইত র‌্যাখা আচি। আর কোনোদিন দেহা অবো কি না জানি না, কোন দোষ কর‌্যা থাকলে মাপ কর‌্যা দিও।’

‘আসমা, মাপ আমার চাওয়ার কতা, কিন্তুক চামু না। তুমি সুকে আচো কি না জানন্যা, তবে মেলা বালো আচো। একখান অনোরোদ কইরব্যার ল্যাগ্যা আচি। রাইগব্যা তো।’

প্রমাদ গুনলেন আসমা। এতদিন পর দেখা করতে এসেছেন, ছেলের হাতে চিঠি দিয়ে, শুধু এইটুকু বলার জন্য তো অবশ্যই নয়। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলেও নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলেন।

‘তোমার ফকিরবাড়ি যাওনের কাম নাই, কি কইরব্যা জ্যাইনা চোর কেডা। তোমার যা আড়াইচে, তা কি আর তুমি করব্যার পাইরব্যা না? তোমার যা আচিলো তা আবার তোমারই অইবো। যেতা চোরের আচিলো না তা কুনোদিনই চোরের অইব না। তুমি বাড়িত ফিরা যাও। আমার এই কতাটা রাকো। কোনোদিন কোনো কিচু চাই নাই, আর চামুও না, শুধু আমার এই কতাটা রাকো। আমার পরতম আর হেশ বিনীত অনোরোদ।’

কথাগুলি একটানা বলে থামলেন একটু সিদ্দিক। শেষের কথাটা মনে হলো ধরা গলা থেকে বের হয়ে এলো। ট্যাঁক থেকে একটা পুঁটলি বের করলেন। লুঙ্গির ত্যানা দিয়ে পেঁচিয়ে গিট্টু মারা। আসমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

‘দরো, এইটা লেও, তয় এইহানে খুইলো না। গাটায়ও না। এক্কেবারে বাড়িত লিয়া খুইলব্যা।’

‘কী এইডা, আমি নিমু ক্যা?’

মনে হলো একটু হাসলেন সিদ্দিকভাই।

‘না না, বয়ের কিছু নাই, আর তোমাক অন্য কিচু দেওয়ার মতো সাদ্যও আমার নাই। মনে করো তোমারই জিনিস, কোতাও আড়ায়া ফালাইছিলা, আমি পাইয়া তোমকই ফেরত দিতাচি। নেও দরো।’

একপ্রকার জোর করেই আসমার হাতে ধরিয়ে দিলেন সিদ্দিক। তার  পরে আর কোনো কথা না বলে, কোনো দিকে না তাকিয়ে হনহন করে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলেন। আসমা অবাক হয়ে, বিস্ময়ভরা চোখে সিদ্দিকের গমনপথের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। যতদূর দেখা যায়, তাকিয়েই ছিলেন আসমা, কিন্তু সিদ্দিক একটিবারের জন্যও পিছনে ফিরে তাকাননি। এতক্ষণে আসমার মনে হলো, তিনি খুব ক্লান্ত, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হাতে ধরা সেই পুঁটলিটা। শক্ত কোনো বস্তু মনে হচ্ছে না। টিপে টিপে অনুমান করার চেষ্টা করলেন। টাকা-পয়সা নয় তো? কিন্তু তাই বা কেন? নাহ্, মাথা কাজ করছে না। কিন্তু খুলে দেখার তো কোনো উপায় সিদ্দিকভাই রাখেননি। ফকিরবাড়ি বাদ দিয়ে বাড়িতে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায়ও নেই। ধপ করে বসে পড়লেন গাছের বের হয়ে থাকা মোটা শিকড়ের ওপর। পানি-টানি না খেয়ে এত পথ আর হাঁটা সম্ভব নয়। কাকতালীয় ব্যপার কিনা বোঝা গেল না, একটা অল্প বয়সী মেয়ে কাকলে পিতলের ঘড়ায় করে পানি নিয়ে এইদিকেই আসছিল। মনে হয় আশেপাশের কোনো ক্ষেতে কামলাদের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। কাছাকাছি এসে ছায়া দেখে একটু দাঁড়ালো। আসমা ভাবলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তার পিপাসার কথা বুঝতে পেরেছেন। এর কাছ থেকে এক গ্লাস পানি খেলে আর কতটা কম পড়বে।

‘কোন পাড়ার মেয়েগো তুমি?’

কোনো কথা বলল না, শুধু ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছনের পাড়াটা দেখিয়ে দিলো মেয়েটি।

‘আমাক এক গেলাশ পানি খাওয়াইব্যার পারব্যা।’

পানি নিয়ে যাচ্ছে, পানি খাওয়াতে। মাঝপথে অন্য কাউকে পানি খাওয়াতে তো কোনো দোষ থাকার কথা নয়। কিন্তু আসমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটি। নাকি ভাবছে তার এক গ্লাস পানি কম পড়ে যাবে!

‘কি খাওয়াইবা না?’

ঘড়ার মুখে উপুড় করা গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো মেয়েটি। দাঁড়িয়ে দু-পা সামনে এসে গ্লাসটি হাতে নিল আসমা। ঘড়াটি কাকলে রেখেই একটু বাঁকা হয়ে গ্লাসে পানি ঢালল মেয়েটি। আসমা একটুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে আবার দু-পা পিছিয়ে গেল। বসে পানি খেতে  হয়, এখানে উপযুক্ত বসার জায়গা ওই একটাই। মুখ খুলল মেয়েটি।

‘কোন গায়ের দিদিগো আন্নে? কোন গায়ে যাইত্যাছেন?’

মুহূর্তে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন আসমা। আবারো সেই শিকড়ের ওপর ধপ করে বসে পড়লেন। ছলাৎ করে পানি একটু পড়েও গেল। কোন গায়ের কথা বলবেন এখন। সে কি সিদ্দিকভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে? যাওয়ার কথাই বা কোন গাঁয়ের নাম বলবেন। সত্যি বলবেন, নাকি মিথ্যা বলবেন? কিন্তু এগুলির কোনোটাই তাঁর মাথায় খেলছে না। তিনি শুধু ভাবছেন, চৈত্র মাসের রোদে তৃষ্ণার্ত গলায় পানিটা ঢালবেন, নাকি ফেলে দেবেন। মেয়েটা হিন্দু, হিন্দুবাড়ির পানি। কিন্তু এইটুকুন একটা বাচ্চা মেয়ের কষ্ট করে বয়ে নিয়ে যাওয়া পানি ফেলে দিলে অন্যায় হবে, অবিচারও হবে, এইটুকু তিনি বুঝতে পারলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে ধর্ম রক্ষা হবে কি করে ভেবে কোনো কূলই করতে পারছেন না।

‘তোমার নাম কি গো সোনা?’

আসমা বিষয়টি ভালোভাবে বুঝে নিতে চান।

‘চৈতালী।’

‘চৈতালী?’

গাল পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে পড়ল।

‘চৈত মাসে অইছিলাম তো, তাই ঠাকুরদাদা নাম রাকচিলো চৈতালী।’

আরো কোনো প্রশ্ন করা বিপজ্জনক হয়ে যাবে। ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তর দেওয়া মেয়েটি যে এমন সাবলীল হয়ে উঠবে ভাবতে পারেননি। কথায় কথা বাড়ে, কোন কথা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে।

‘তুমি যাইত্যাচো কোনে?’

‘ওই চড়ায়, কামলারা আল বইত্যাচে।’

‘আচ্চা যাও, ওগোরে লিশ্চয় গলা হুকাইচে।’

মনে হলো হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, সে কারো জন্য পানি নিয়ে যাচ্ছিল।

‘জল খাইবেন না?’

স্মিত হেসে চোখ বন্ধ করে ঢক ঢক করে গ্লাস খালি করে হাতে ধরিয়ে দিলো আসমা। এইটুকু মেয়ের সঙ্গে ধর্মের অজুহাতে তিনি খারাপ আচরণ করতে পারবেন না। পারলে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে দেবেন। চৈতালীর থুতনিটা নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও।’

এখানে তাঁর অজান্তেই ভেতরের মায়ের স্বরূপ কিছুটা বেরিয়ে পড়ল। কিছুদূর গিয়েই মেয়েটি  রাস্তা ছেড়ে ডান দিকের আলপথে নেমে গেল। আসমা হাঁটা শুরু করলেন বাড়ির দিকে। বাড়ি গিয়ে কী বলবেন, কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা বলতে হবে। পুঁটলির ভেতরে কী আছে? ফকিরবাড়ি যাইতে মানা করল কেন, চোরের কথা কী বলবেন … এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে নিজের গ্রামে ঢুকে পড়েছেন বুঝতেই পারেননি। পুরো সময়টাতেই তিনি ছিলেন একটা ঘোরের মধ্যে। উত্তরপাড়ার স্কুলের মাস্টারনির কথায় হুঁশ ফিরল।

‘কোনে গেচিলা বাবি, কোন থ্যাকা ফিরত্যাছো। কোনো পিরিতের মানুষ খুঁজব্যার যাও নাই তো! দেইখো আমার বাইডারে আবার বিদবা বানাইও না।’

বলেই হাসতে লাগলো।

‘কী যে কও মাস্টার আপা, ওই, আমার এক আত্মীয় মারা গেছে তো, তাই দেকব্যার গেছিলাম।’

‘ওহ হো, তা কীবাবে মরচে।’

ওহ, কেন যে মুখ ফসকে মরার কথা বের হয়ে গেল, এখন  তো হাজারটা মিথ্যা কথা বলতে হবে।

‘আপা এহন আন্নের দেরি অইয়া যাইব,  এহন যান, পরে কতা কমুনে।’

‘আচ্চা ঠিক আচে, পরে হুনমুনি।’

হনহন করে হেঁটে তিন-চার মিনিটের মধ্যেই বাড়িতে ঢুকে পড়লেন আসমা। উঠান ফাঁকা। ঘরে শিকল তোলা। একটা স্বস্তির নিশ্বাস বের হয়ে গেল আপনা আপনি। আসমা সরাসরি ঘরে না গিয়ে রান্নাঘরের মাটির কলসি থেকে ঢেলে ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন। তারপর আস্তে করে শিকল খুলে ঘরে ঢুকে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলেন। ট্যাঁক থেকে সিদ্দিকের দেওয়া পুঁটলিটা বের করে খুলতে শুরু করলেন। গিট্টুর পর গিট্টু খুলতে খুলতে চার নম্বর গিট্টু খোলার পর লুঙ্গির ত্যানার প্যাঁচ খুলতে শুরু করেছেন। বুকের ধুকপুকানি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কপাল ঘেমে চিবুক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। কৌতূহলের পরিবর্তে একরাশ ভয়-শঙ্কায় হাত কাঁপছে। ত্যানার শেষ প্যাঁচ খোলার পর যেটা বের হলো তা দেখে আসমার হৃদপিণ্ডের ভেতরে ছলাৎ করে রক্তের ঢেউ বাড়ি দিয়ে গেল। এটা কি তিনি সত্যিই দেখছেন, নাকি  স্বপ্ন? পুরোটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলেন। এতো সেই রুমাল, যেটা কয়েকদিন আগে চুরি হয়ে গেছে। এটা সেই রুমাল যেটা তিনি অতি যত্নে ভাঁজ করে রেখেছিলেন কাপড়ের ভাঁজে। এটা তাঁর ভালোবাসা। কৈশোরের স্বপ্ন। কিন্তু এটা সিদ্দিকভাইয়ের কাছে গেল কী করে? চোরেরা মালামাল সিদ্দিকভাইয়ের কাছে বিক্রি করেছে? সিদ্দিকভাই বলছিলেন, মাকে নিয়ে তিনি খুব কষ্টে আছেন। নাকি তিনিও চোরদের একজন। তিনি বললেন, আশপাশের গ্রামের দু-চারজন খারাপ মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা শুরু হয়েছে। আবার বললেন, দু-একদিনের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে মামাদের গ্রামে চলে যাবেন। এসব কথার মানে কী দাঁড়ায়? আবার যে বললেন, ‘কী অইব জাইন্যা চুরি কেডায় করছে।’ হঠাৎই মাথা হালকা হয়ে গেল আসমার, সবকিছু তার কাছে আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। সিদ্দিক ভাই-ই চুরি করতে আসমার বাড়িতে সিঁধ কেটেছিলেন। ‘ছি সিদ্দিকভাই, ছি, আমি যাকে ভালোবাসি, সে শেষ পর্যন্ত একজন চোর হয়ে গেল? তুমি এইভাবে তোমার ভালোবাসার মৃত্যু ঘটাইলা? ছি ছি ছি সিদ্দিকভাই, তোমাকে আমি ঘৃণা করি। আজ থেকে তুমি জেন আসমা মরে গেছে।’

(হা হা হা) কিন্তু এসবের কিছুই ঘটলো না, কিছুই বললেন না, কিছুই ভাবলেন না আসমা খাতুন। রুমালটি চোখের সামনে মেলে ধরতেই খুশিতে তাঁর চোখ পানিতে ভরে গেল। উদ্বেলিত হৃদয় থেকে সিদ্দিকের জন্য ঝরে পড়তে থাকল অসংখ্য শুভকামনা। তিনি তার হারানো ভালোবাসা ফিরে পেয়েছেন। সিদ্দিক তাঁর নিজের হাতে আবার নিজের ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছেন। অতি যত্নে, আদর করে রুমালটি আবার ভাঁজ করলেন।

নাই থাক জীবনে অন্য অনেক কিছু। নাই থাক জীবনে পূর্ণতা। কৈশোরের প্রেম না পেল বসন্তের বাতাস। কিন্তু গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত পার করে পৌষের প্রত্যুষে একাকী হেঁসেলপাড়ে আগুন পোহাতে পোহাতে স্মৃতির পাতা উল্টালেই, আনমনে মুচকি হাসি দিয়ে বলবে, বলবেই।

– ধুর, লজ্জা করে।