গোপেন্দ্রনাথ সরকারের রচনা-সমীক্ষা

সোহানুজ্জামান

গোপেন্দ্রনাথ সরকার  রচনা সংগ্রহ  সম্পাদনা : মাসুদ রহমান
 ঢাকা, ২০১৯ ২৫০ টাকা

কেউ কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোকেই আপাতদৃষ্টিতে ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন। অর্থাৎ, বলতে চাচ্ছি, ক্ষমতা ব্যাপারটাকে সকলে আলোচনা করতে আগ্রহী রাজনীতির সঙ্গে। কিন্তু ক্ষমতা ব্যাপারটা যে শুধু একটি নির্দিষ্ট আবর্তের মধ্যে আবদ্ধ নয়, সেটা বুঝতে পারলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্ষমতার আদান-প্রদান যে সাংস্কৃতিক জগতেও বেশ চলনসই প্রক্রিয়া এবং বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেটিও পরিষ্কার হওয়া জরুরি। সেই ক্ষমতার আদান-প্রদানের প্রক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক জগতে অসামর্থ্যবান হিসেবে বিবেচিত লোকজনও যে সামর্থ্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন; এবং সামর্থ্যবান লোকজনও যে অসামর্থ্যবান ও গুরুত্বহীন হয়ে হয়ে ওঠে – তার নিদর্শন ঢের রয়েছে। বাংলা মুলুকে এইরকম নিদর্শনের অভাব নেই।
আর সে-নিদর্শনের হিসাবকে আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিলো ‘গোপেন্দ্রনাথ সরকারকে না চেনা’র ব্যাপারটা। এ-গ্রন্থ হাতে পাওয়ার আগে পর্যন্ত আমিও পরিচিত ছিলাম না এই কবির সঙ্গে; শুধু কবি বললে ভুল হবে : একইসঙ্গে তিনি প্রবন্ধ ও ছোটগল্পও লিখেছেন। কেউ কেউ, যাঁরা বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সমালোচক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই আলোচনা পড়ার আগে কবি গোপেন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে তাঁদেরও কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় নেই; না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, প্রচলন এবং পরিচিতির ব্যাপারটি বিশেষভাবে জড়িয়ে থাকে প্রচারণার সঙ্গে। আর প্রচার তো দূরে থাক, গোপেন্দ্রনাথ জীবিতাবস্থায় একটা গ্রন্থও প্রকাশ করেননি! কিন্তু সেটা তিনি সহজেই পারতেন। এটাই মনে হয় তাঁর লেখালেখি নিয়ে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ। যেখানে ভূরিভূরি বই প্রকাশিত হওয়ার পরও মানুষজন অনেক লেখককে আমলে নেয় না, সেখানে এমন একজন লেখক, যাঁর সব লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল বহু পূর্বে, পত্রিকায়; তাকে মানুষ মনে রাখবে না, গ্রাহ্য করবে না – এটাই স্বাভাবিক।
এই সময়ের দ্রম্নতি-সমাজের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যমানের হিসাব কষতে গিয়ে আমরা গোপেন্দ্রনাথ সরকারের নাম নেব না, তার দরকারও নেই – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ এবং সাহিত্যের হিসাব মেলাতে গিয়ে যাঁর প্রয়োজন বিশেষ, তাঁকে কীভাবে আমরা বাদ দিচ্ছি, তা কেউ কি বুঝিয়ে বলবেন?
বর্তমান যে-সময়, সে-সময় তো পার করেছে বহু সামাজিক ও সাহিত্যিক আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলন যেহেতু নির্ধারণ করে দেয় সাহিত্যিক আন্দোলনের নানা দিক, তাই আলোচনায় সামাজিক আন্দোলনের কথাও বললাম। সাহিত্যের ইতিহাস পোস্ট-মডার্ন যুগও পার করে ফেলেছে। এবং আরো নতুন নতুন যুগের দ্বারপ্রামেত্ম এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি যুগের পূর্ব-যুগের আন্দোলনের প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য ছাড়া কী করে পরবর্তী যুগের আন্দোলনের হিসাব মেলানো যায়? তা আসলে কেমন হয়, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি। দেখিনি। ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আধুনিক ত্রিশের কবিরা বাদ দিয়েছেন। এবং এটাকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, আধুনিক কবিতার মূল ফারাক রবীন্দ্র-কাব্য থেকে ত্রিশের আধুনিক কবিতার দূরত্বের ব্যাপারটা। তা ঠিক আছে। মানা গেল। কিন্তু এই আলোচনা
এবং এই আন্দোলনকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য হলেও তো আমাদের দরকার রবীন্দ্রনাথকে বিবেচনায় আনা। দরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যের মৌল প্রবণতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া। যদি রবীন্দ্র-কাব্যের মৌল-প্রবণতা সম্পর্কে প্রথমে জানা সম্ভব হয়; তাহলেই পরবর্তী কাব্য আলোচনা করা সহজ হবে, বলা যায় সম্ভব হবে। নতুবা সম্ভব নয় : রবীন্দ্র-কাব্য থেকে আধুনিক-কাব্যের পার্থক্য নির্ণয় করা। তাই বলতেই হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সেকেলে, সে-কথা বলার জন্য হলেও তো নেওয়া হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। আসলেই সেটা নেওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমরা বারবারই ভুলে যাই এ-কথা। আমরা আলোচনা করতে গিয়ে করে ফেলি বিরোধিতা, আবার কাউকে তুলে দিই আসমানে। আবার কাউকে ভুলে যাই স্রেফ পেছনের মানুষ হিসেবে। কিন্তু সামনের ইতিহাস নির্মাণে যে বিশেষভাবে গুরুত্বর্পূণ পিছনের ইতিহাস – এ-কথা আমরা বারবারই ভুলে যাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আলোচনাও এই কারণে করছি; করছি গোপেন্দ্রনাথ সরকারের আলোচনায়। কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন এক কবি, যিনি পূর্ববর্তী কবিকে যেমন প্রভাবিত করেছেন, তেমনি প্রভাবিত করেছেন তাঁর সমকালীন কবিদের, এবং একইসঙ্গে তাঁর পরবর্তী কবিদের। রবীন্দ্রনাথ সমকালীন বাসত্মবতায়ও সবচেয়ে প্রভাবশালী নাম : যে নাম সেই সময়ে, এমনকি পরবর্তী বহুদিন ধরে বাংলা অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জগতে জায়মান থেকেছে। এবং এমন এক বলয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্মাণ করেছেন, সেই বলয়ে তাঁর সমসাময়িক প্রায় প্রত্যেক কবিই ধরা পড়েছেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়েছেন, আবার কেউ কেউ হয়ে গেছেন নিষ্প্রভ। নানা কারণে। এরকমই একজন লেখক গোপেন্দ্রনাথ সরকার। যিনি প্রতিভার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রকাশন-প্রচার-প্রসারের দিক থেকে একদমই পিছিয়ে পড়ে সকল গুরুত্বই হারিয়েছেন।
এইসকল আলোচনার কারণ এই যে, গোপেন্দ্রনাথ সরকারের প্রভাব-প্রতিপত্তিটা আসলে কোথায়, তা জানা। প্রথমেই বলে নেওয়া জরুরি যে, গোপেন্দ্রনাথ সরকার যে সময়ে লিখছেন, সে সময়ে মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই যুগ। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। এবং সত্যি বলতে কী, গোপেন্দ্রনাথ সরকার মূলত এই আবর্তের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছেন। কিন্তু তিনি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, তিনি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারার লেখক; এবং এই ধারায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। রবীন্দ্রানুসারী লেখকদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তেমনি বিবেচনায় আনা উচিত ছিল গোপেন্দ্রনাথ সরকারকে। কিন্তু তা হয়নি। এর জন্য গোপেন্দ্রনাথ সরকারের যেমন নিজের কিছু দোষ আছে, তেমনি দোষের দায়ভার আমাদের ওপরও কিছু পড়ে। কারণ গোপেন্দ্রনাথ সরকারের মতো লেখক আবিষ্কারের দায়িত্ব তো আমাদেরই ছিল। যেমন ফ্রানৎস কাফকার লেখা সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যাপারে সেই অঞ্চলের লোকের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বলছি না যে গোপেন্দ্রনাথ সরকার কাফকার মতো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিছু গুরুত্ব তো রয়েছেই; বিশেষ করে রবীন্দ্রানুসারী লেখকদের আলোচনার বেলায়। কিন্তু পাত্তা তিনি পাননি, বহুদিন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন এমন গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবেত্তাদেরও লেখায় কোথাও তো গোপেন্দ্রনাথ সরকারের নাম নেই! কেন নেই? এর উত্তর নেই।
রবীন্দ্রানুসারী লেখকদের মধ্যে কেন্দ্রে (কেন্দ্র বলতে কলকাতাকে বোঝানো হচ্ছে) অবস্থান করা কবিরাই এই ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবর্তী সাহিত্য-আন্দোলনে প্রামেত্মর অনেকেই রসদ জোগালেও নানা কারণে তাঁরা বাদ পড়ে গেছেন। এর পেছনে রাজনীতি যেমন কাজ করেছে, তেমনি কাজ করেছে ওই লেখক বা কবিদের নিজেদের গাফিলতিও – এই দুইয়ে মিলে তাঁরা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়েও বাদ পড়ে গেছেন, থেকে গেছেন হিসাবের খাতার বাইরে। গোপেন্দ্রনাথ সরকারও এই
কেন্দ্র-প্রামেত্মর রাজনৈতিক কারণে এবং নিজের গাফিলতিতে বাদ পড়ে গিয়েছিলেন আলোচনা থেকে। ব্যাপারটাকে সরাসরি আলোচনা করছি ঠাকুর পরিবারের আর্থিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে। ‘কার অ্যান্ড টেগোর’ কোম্পানির মূল কাঁচামালের জোগান দিয়েছে প্রান্ত; কিন্তু উৎপাদন-প্রক্রিয়া এবং মূলধন সংগ্রহ এবং তার সঞ্চয় সবই হয়েছে নগর কলকাতায়। এবং এই অর্জিত অর্থের প্রায় সবটুকুই খরচ হয়েছে কেন্দ্রে।
গোপেন্দ্রনাথ সরকার যে-সময়ে কুষ্টিয়ার মতো মফস্বলে বসে কবিতা রচনা করছেন, সে সময়কার কুষ্টিয়া কিন্তু আজকের দিনের যে কোনো মফস্বলের চেয়ে অনেক বেশি বিবর্ণ, নিষ্প্রভ, নিশ্চল। যদি বলা হয় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো এই কুষ্টিয়াতেই জমিদারি দেখাশোনার জন্য এসেছিলেন। তাহলে এ-কথা বলতে হয় যে : কেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন এবং কোন পর্যায়ে কতটা আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ে ঠাকুর এসেছিলেন; এসেছিলেন কী আসতে বাধ্য হয়েছিলেন কুষ্টিয়ার মতো এমন এক বিবর্ণ প্রামেত্ম? তার নানা কারণ রয়েছে। আর তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এই আগমন তাঁর গদ্য লেখার জন্য বেশ কাজে দিয়েছে। বিশেষ করে ছোটগল্প। কিন্তু, গোপেন্দ্রনাথ সরকার তো কবিতা লিখতেন। তাঁর জন্য এমন এক মফস্বলে বসে কবিতা লেখার ব্যাপারটা কেমন ছিল, তা ভেবে দেখার বিষয়।
কবিতা ও গদ্য – দুটো ব্যাপার আলাদা। কবিতা লেখার জন্য যে পরিবেশের দরকার হয়, গদ্য লেখার জন্য দরকার হয় ঠিক তার বিপরীত পরিবেশ। পরিবেশ এবং তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা নির্মাণ করে দেয় কবিতা লেখার ভিত্তিভূমি। তাই কলকাতার মতো কেন্দ্রে বসে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর অন্য অনুসারীরা যে-ধরনের কবিতা লিখেছেন এবং সেসব কবিতার যে বিষয়বৈশিষ্ট্য, সেদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আমেজ পেয়েছে গোপেন্দ্রনাথ সরকারের কবিতা; সঙ্গে সঙ্গে রচনাকৌশলের কথা উঠলেও বিবেচনায় আনতে
হবে রচনাকৌশলের বিষয়। কবির একান্ত মনোজাগতিক
প্রভাব-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কবিতা যে বিশেষ রূপ পায়, তা আমরা দেখতে পারি গোপেন্দ্রনাথ সরকারের কবিতায়। এদিক থেকে বিষয় ও রচনাকৌশলে বিশেষ হয়েছে গোপেন্দ্রনাথ সরকারের কবিতা; কেন্দ্রের উদারবাদী-মানবতাবাদী-রোমান্টিক কবিদের থেকে।
এসব কথা বলার আরো কারণ এই যে, গোপেন্দ্রনাথ সরকার এমন একজন কবি, যিনি প্রামেত্ম বসেও একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুসারী হয়েও কেন্দ্রের একেবারে অনুবর্তী হননি। না হয়ে নিজের মধ্যেই কেন্দ্র সৃষ্টি করেছেন, নিজের মতো করে লিখতে পেরেছেন। এবং কেন্দ্র সেই লেখা নিয়মিত প্রকাশ করেছে; অর্থাৎ, সমসাময়িক কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গোপেন্দ্রনাথ সরকারের লেখা। তাই একেবারে বিবর্ণ মফস্বলে বসে গোপেন্দ্রনাথ সরকার প্রামেত্মই নির্মাণ করেছেন কেন্দ্র; তাঁর নিজস্ব কেন্দ্র। এবং সেখানেই তিনি নির্মাণ করেছেন তাঁর কবিতা-বলয় এবং সাহিত্য-ভিত্তিমূল। কিন্তু কলকাতায় লিবারেল, রোমান্টিক; যাঁরা বিবেচিত রবীন্দ্রানুসারী হিসেবে, তাঁরা যে-সমসত্ম সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন তার প্রায় কিছুই পাননি গোপেন্দ্রনাথ সরকার; তাঁর পাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু এরকম অবস্থায় প্রোথিত থেকেও নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন গোপেন্দ্রনাথ সরকার।
ত্রিশের দশক সমগ্র বাংলা সাহিত্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ খ-ীকরণের জন্য। ‘আধুনিকতা’র বিপুল বিক্ষক্ষাভে সম্ভব হয়েছিল এই ক্ষ-ীকরণ। কলেস্নাল, কালি-কলম, প্রগতি, ধূমকেতু তখন পূর্বতন সকল সাহিত্যিক মূল্যবোধকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। গোপেন্দ্রনাথ সরকার এ-ধারাকে ধরে কবিতা লেখেননি। তিনি কবিতা বা সাহিত্য রচনা করেছিলেন এ-ধারার পূর্বতন ধারায় – রবীন্দ্র-কাব্য-বৈশিষ্ট্য, সাধুভাষারীতি, উদার-মানবতাবাদী রাজনৈতিক প্রত্যয় ইত্যাদি নিয়ে।
গোপেন্দ্রনাথ সরকার মূলত কবি; এছাড়াও কিছু গদ্য লিখেছেন – গল্প লিখেছেন কয়েকটি। তাঁর এই সমসত্ম সাহিত্যকীর্তিও
কলেস্নাল-পূর্ব সাহিত্য-প্রবণতার মধ্যেই বেড়ে উঠেছে। কিন্তু, তিনি তো কলেস্নালের উত্তপ্তকালেই কবিতা লিখেছেন! তাহলে তিনি
কেন বেছে নিলেন পূর্বতন উদার-মানবতাবাদী, রোমান্টিক
রবীন্দ্র-কাব্যবৈশিষ্ট্য? এ-কথা উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।
‘সাহিত্য’ শব্দের সঙ্গে ‘সহিত’ শব্দের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ, সঙ্গে – সমাজের, মানুষের, পরিবেশের সঙ্গে সাহিত্যের একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। সেই বিদ্যমান অবস্থাকে লেখক কখনো বাতিল করে দিতে পারেন না। এটিই স্বাভাবিক। অর্থাৎ পরিপ্রেক্ষেত-চাপে চেতনালোক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় একজন লেখকের লেখক-মানস তৈরি হয়। ফলে ঔপনিবেশিক যান্ত্রিক নগর কলকাতা থেকে বহু দূরে, কুষ্টিয়ার মতো বিবর্ণ, নিষ্প্রভ, নিশ্চল স্থানে বসে; এর চেয়ে আসলে বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না গোপেন্দ্রনাথ সরকারের। এছাড়া পড়ালেখার যে-অভিজ্ঞতা গোপেন্দ্রনাথ সরকারের ছিল, তাও একটা ক্ল্যাসিক ধারার মধ্যেই ছিল। কলেস্নালের যে প্রভাব এবং প্রতিপত্তি, যখন গোপেন্দ্রনাথ সরকার কবিতা লিখছেন, তখন ছিল একেবারে টাটকা; কুষ্টিয়ায় রপ্তানিযোগ্য তখনো হয়ে ওঠেনি, তার সময় হয়নি তখনো। আর যখন কলেস্নালের আন্দোলন চলছে, তখন তাঁর বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। ফলে লেখক-মানস যা গড়ে ওঠার দরকার, তা বহু আগেই হয়ে গেছে গোপেন্দ্রনাথ সরকারের।
সমকালীন সকল গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় গোপেন্দ্রনাথ সরকারের লেখা ছাপা হয়েছিল। লেখা ছাপা হয়েছিল প্রবাসী, ভারতী, ভারতবর্ষ, পূর্বাশা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, বসুমতী, সাধক, মানসী, যমুনা, অমৃততে। এসব পত্রিকায় যাঁরা সে-সময়ে লিখতেন তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই বিভিন্ন গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু গোপেন্দ্রনাথ সরকারের প্রকাশিত কোনো গ্রন্থ নেই। কোনো গ্রন্থ প্রকাশের আগ্রহ দেখাননি কখনো। বেঁচে থাকা অবস্থায়ও কোনো গ্রন্থ ছাপা হয়নি।
সম্প্রতি অন্তরাল-অন্তরিত গোপেন্দ্রনাথ সরকারকে জনসমক্ষক্ষ তুলে এনেছেন মাসুদ রহমান। এই যে গোপেন্দ্রনাথ সরকারকে নিয়ে এত আলাপ-আলোচনা হলো, তা সম্ভব হলো মূলত মাসুদ রহমানের কল্যাণে। মাসুদ রহমান বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, পড়ান একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখির বয়স বহুদিনের; সেই ছাত্রজীবন থেকে। আর তাঁরই কল্যাণে আমরা পরিচিত হতে পারছি গোপেন্দ্রনাথ সরকারের লেখার সঙ্গে। মাসুদ রহমানের জন্যই বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক সাহিত্য-আন্দোলের এক বিস্মৃত, কিন্তু নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ গোপেন্দ্রনাথ সরকারের লেখা ও তাঁর জীবন সম্পর্কে জানতে পারছি আমরা। যেহেতু বিগত লেখকদের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই, তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারি মূলত তাঁদের লেখার মাধ্যমেই।
এই বই সম্পাদনার বেলায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পাদিত হয়েছে, যা বই সম্পাদনার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, লুপ্তপ্রায় কবি গোপেন্দ্রনাথ সরকারের একটা প্রামাণ্য জীবনী তৈরি করা। মাসুদ রহমান সেটা বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পেরেছেন; খুব ভালো করেই করতে পেরেছেন। কবি গোপেন্দ্রনাথ সরকারের কর্মজীবন ও লেখকজীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ঘেঁটে এবং তা বিশেস্নষণ করে মাসুদ রহমান এই প্রামাণ্য জীবনী নির্মাণ করেছেন। সাহায্য নিয়েছেন নানা নথিপত্রের, লাইব্রেরির। এমনকি ছুটে গেছেন লেখকের পরিবারের কাছে; যেটা গুরুত্বপূর্ণ সহিহ জীবনী লেখার জন্য।
বই সম্পাদনার বেলায় একটা ‘বিস্তারিত ভূমিকা’র ব্যাপার থাকে। যেখানে সম্পাদক লেখক এবং তাঁর লিখিত বইয়ের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। এর ফলে সম্পাদকের ওই গ্রন্থ-নিরীক্ষা-প্রক্রিয়া যেমন বোঝা যায়; তেমনি করে, একইসঙ্গে, পাঠক ওই গ্রন্থ-পাঠ-পূর্বে ওই লেখকের, এবং ওই গ্রন্থ সম্পর্কে সাধারণ একটা ধারণা লাভ করে; যা পাঠককে গ্রন্থপাঠ এবং গ্রন্থকার সম্পর্কে জানতে বিশেষভাবে সহায়ক হয়। জীবনী নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে এই কাজটা করেছেন মাসুদ রহমান। গোপেন্দ্রনাথ সরকারের
সাহিত্য-মানসের একটা স্পষ্ট দিক চিহ্নিত করেছেন তিনি। যার ফলে গোপেন্দ্রনাথ সরকারের সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে একজন অনভিজ্ঞ ও নতুন (প্রায় সকলেই গোপেন্দ্রনাথ-সাহিত্যের নতুন পাঠক; এ প্রায় হলফ করে বলে দেওয়া যাবে) পাঠকও তাঁর সাহিত্যের মূল প্রবণতা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন। গোপেন্দ্রনাথ সরকারের সাহিত্য-পাঠ অবশ্যই সহজবোধ্য ও সুখকর হবে। সম্পাদক মাসুদ রহমান এ-কাজ করতে গিয়ে অনেকটা তুলনামূলক সাহিত্য-বিশেস্নষণ প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়েছেন। ফলে গোপেন্দ্রনাথ সরকারের সাহিত্যের মূল প্রবণতা আলোচনা আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
সম্পাদকের বেশকিছু দায় রয়েছে। সেই দায় থেকেই যদি কোনো গ্রন্থ সম্পাদিত হয় তবে সেটা হয়ে উঠবে সর্বোৎকৃষ্ট সম্পাদনা। সম্পাদকের বিশেষ কিছু দায় থাকে; থাকে বিশেষ কিছু কর্তব্য, যেগুলো সঠিকভাবে পালনের ফলেই একজন সম্পাদক যেমন বিশেষ হয়ে ওঠেন, তেমনি করে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থও বিশেষ হয়ে ওঠে।
কী বিষয় সম্পাদনা করতে হবে এবং কী সম্পাদনা করা উচিত : তা না বুঝেই হরদম বই সম্পাদনা করা হচ্ছে, আজকাল; করছে যে-সেই, যখন-তখন। এটা কেমন একটা বিচ্ছিরি অবস্থায় পৌঁছেছে আজকাল! যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাজসিংহের শখানেক সংস্করণ বাংলাদেশেই খুঁজে পাওয়া যাবে! কিন্তু সেটা কি এতই দরকার ছিল? ছিল না। তবু হলো কেন? হলো ব্যবসা আর নাম-কাটার জন্য! কিন্তু এ-কাজটা বুঝেশুনে করা উচিত। এটা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সম্পাদনা-কাজ ব্যবসার জন্য নয়। প্রয়োজন সাহিত্যিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার দিক থেকে।
মাসুদ রহমানের এই কাজটা এমনই। এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকেই এ-কাজ করেছেন তিনি। খুবই প্রয়োজন হবে রবীন্দ্রানুসারী বাংলা সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ আছে এমন পাঠকের। যেহেতু গোপেন্দ্রনাথ সরকারের লেখা যেসব পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল সেসব পত্রিকা সহজলভ্য নয়; সেখানে সেই পত্রিকা থেকে তাঁর লেখা বের করে পড়া তো আরো কঠিন কাজ! সেই দুষ্প্রাপ্য এবং কঠিন কাজকে সহজ করে দিয়েছেন মাসুদ রহমান। যদি মাসুদ রহমান আবার একটা রাজসিংহ সম্পাদনা করে একটা প্রকাশনী থেকে বই বের করতেন, ক-টাকা রোজগার করতেন; তো সেটাকে সম্পাদনা বলতাম না, বলতাম ব্যবসা করেছেন মাসুদ রহমান। কিন্তু সম্পাদনার বিষয় হিসেবে গোপেন্দ্রনাথ সরকারের লেখা একত্রিতকরণ এবং তা সম্পাদনা করায় এই সম্পাদনাই মাসুদ রহমানকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুদিন, সম্পাদনার জগতে। সম্পাদকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের
প্রাথমিক কর্মের বেলায়ও উতরে গেছেন মাসুদ রহমান; বিষয় নির্ধারণের বেলায়।
ভাষাজ্ঞান একজন সম্পাদকের প্রধান দক্ষতা এবং প্রধানতম সম্পাদকীয়-শর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সেটা মাসুদ রহমানের ছিল, খুব ভালো করেই ছিল। ব্যাপারটা মাসুদ রহমান বিশেষভাবে করে দেখিয়েছেন বিভিন্ন সম্পাদনায় ভাষা-জ্ঞানের পরীক্ষা দিয়ে; এছাড়া অন্যান্য নানা গ্রন্থ সম্পাদনা করে, গ্রন্থ রচনা করে। এছাড়া খুব কাঁচা বয়সেই ভাষা-জ্ঞানের পরিচয় মাসুদ রহমান দিয়েছিলেন, নানাভাবে; লেখালেখির মধ্য দিয়ে।
মূল পাণ্ড‍ুলিপি এবং সম্পাদিত বইয়ের পাণ্ড‍ুলিপির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার একটা ব্যাপার সম্পাদনার বেলায় সবসময়ই রয়ে যায়; এবং তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সামঞ্জস্য রক্ষা না করতে পারলে সম্পাদনা ভেসেত্ম যেতে পারে। তাছাড়া সম্পাদিত গ্রন্থের পাঠক যেমন ভুলে ভরা একটা সম্পাদিত গ্রন্থ পাঠ করবে, তেমনি করে যে-গবেষক এ-গ্রন্থ দেখে গবেষণা করবেন তাঁর গবেষণাও ভুলে ভরা গবেষণা হতে বাধ্য হবে। মূল পাণ্ড‍ুলিপির সঙ্গে সম্পাদিত গ্রন্থের সামঞ্জস্যের ব্যাপারটা মাসুদ রহমান বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পেরেছেন। মূলানুগ-পাঠের ব্যাপারটা কঠোরভাবে মেনেই সম্পাদনা করেছেন মাসুদ রহমান, যা সম্পাদনার একটা বিশেষ কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে। এবং এই কর্তব্য দায়িত্বের সঙ্গে পালন করতে সমর্থ হয়েছেন মাসুদ রহমান।
মাসুদ রহমান আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, সম্পাদিত গ্রন্থে লেখা সাজানোর বেলায় বর্ষক্রম ও সংখ্যাক্রম মেনে লেখা সাজিয়েছেন; গোপেন্দ্রনাথ সরকারের লেখা যেভাবে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, সেভাবে। এর জন্য একটা দারুণ সূচিপত্রও তিনি নির্মাণ করেছেন। এতে কবিতা, গল্প ছাড়া অন্যান্য লেখাকে শ্রেণিগতভাবে ভাগ করেছেন। এতে লেখকের লেখার একটা কালানুক্রমিক ইতিহাস সহজেই যেমন নির্ণীত হয়েছে; তেমনি নির্ণীত হয়েছে শ্রেণিগত লেখার বিষয়ও। আর এই ব্যাপারটি যে-কারো সাহিত্যচর্চার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কাল-বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় সাহিত্যের বিষয় ও প্রকরণ। আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থা নানাভাবে প্রবাহিত করে সাহিত্যের বিষয় ও প্রকরণকে।
তাই পরিশেষে বলতে হয়, মাসুদ রহমানের এই সম্পাদনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে; গুরুত্বপূর্ণ হবে সম্পাদনা-বিষয় নির্ধারণ ও ক্যারিশম্যাটিক সম্পাদনাকর্মের জন্য। আর এর মধ্য দিয়ে গোপেন্দ্রনাথ সরকারের একরকম পুনর্জীবনই লাভ হয়েছে।