লাল এক বালতি কাপড় নিয়ে আমলি তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। তার তুলনায় তানজুর সিঁড়িতে পা উঠছে না। তানজুদের কলেজ ছিল পাঁচতলা। হরহামেশা তিন-চারতলায় দলবেঁধে ওদের উঠতে হতো, ক্লাসে হোক কি ক্যাফেটারিয়ায় বসে আড্ডা, সবার  আগে তরতর করে সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে উঠে যেত তানজু। মলি বলতো, তুই জিন, পরি, ওদের ঘুরে বেড়াতে পা লাগে না।

তানজু অবাক হয়, নিজে নিজেই তার ছটফটানি কমে গেছে। কেউ তাকে বলে দেয়নি, তবু। এখন এই যে সিঁড়ি ভেঙে উঠছে, কোন তলায় কয়টা ঘর বা কারা কারা থাকে তার কিছুই জানে না তানজু।  এখানে তাকে কেউ হয়তো চেনে না। তবু তার পা চঞ্চল হচ্ছে না। একটা কেমন লজ্জা। বউ বউ লজ্জা। পিয়াসের বউ হয়ে এলো, ছয় মাস তো পুরো‌ হলো গত পরশু। নিজে নিজেই বুঝতে পারে তানজু, তার বিয়ে হয়ে গেছে। আগের মতো সবকিছু করা তাকে মানায় না, যেমন আমলির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সে আর সিঁড়ি ভেঙে উঠতে পারবে না।

দিনের বেলাও সিঁড়ি অন্ধকার। ছাদের দরজা খুলে ঢুকতে দমকা বাতাস, গাড়ির শব্দ, আলোর ঝলমলানি পুরুষের মতো তার ওপর হামলে পড়ল। বুক ভরে শ^াস নিল। গন্ধ চেনায় তার জুড়ি নেই। কিন্তু একটা কোনো সুগন্ধ নাকে এসে লাগলো না। তবু ভালো লাগছে। মাথার ওপর যতটুকু আকাশ দেখা যায় তাও ভালো লাগলো।

আমলি দেখে গিয়েছিল  ছাদে কাপড় শুকানোর ব্যবস্থা। সে-ই বুদ্ধি দিয়েছিল সকাল-সকাল না গেলে কাপড় শুকানোর টানানো তার সব দখল হয়ে যাবে।

বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার, মশারি – মূলত এসবই। এক পাশে তানজু ধরলো, আরেক পাশে আমলি, ক্লিপ দিয়ে দিয়ে কাপড়গুলি আটকালো। দুই তার ভরে গেছে। পিয়াসের লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি – সেগুলিও তারে ঝোলানোর ব্যবস্থা করে ফেলল।

তানজু তার দুই সেট সালোয়ার-কামিজও ধুয়ে এনেছিল। কিন্তু একবার হাতে তুলেও তার নিজের কাপড় শুকাতে দিলো না। কে না কে ছাদে উঠবে! আশেপাশে বাড়ির কোন জায়গা থেকে কার চোখ পড়বে। তানজুর কাপড় উড়তে থাকবে বাতাসে। ভেবে নেবে পরনের কাপড় তো না, তানজু নিজেই ওখানে, একটা মেয়েমানুষের শরীরই। পুরুষ মানুষের চোখ এখন চেনে,  তানজুর গোটা শরীরটা কল্পনা করে নেবে তার জামার ভেতর।

আমলি অবাক হয়ে তাকালেও আসল কথাটা তাকে বলা যাবে না। তানজু বলল, এত রোদে আমার জামার রং জ্বলে যাবে। ছাদে দেব না আমার কাপড়।

পিয়াস তো নেই, কাজে বেরিয়ে গেছে। তার এক রুমের ঘরে সালোয়ার-কামিজ একটা রশি বেঁধে ঝুলিয়ে দিতে হবে। চুলার তাপে যতদূর শুকায়। রুম একটাই আর তিন ফুটি বারান্দা। বারান্দাটা কাপড় শুকানো বা অন্য কাজে ব্যবহার করা যায় না। আমলি সেখানে শোয়। বলতে গেলে ওইটুকুই আমলির নিজস্ব ঠিকানা।

তানজুই বা আর কতটুকু জায়গা পেল! এই ঘরটাই তো। আবার দেখো, ঘরের পেটের ভেতর রান্নাঘর। রান্নাঘরটা আরেকটু দূরে নিয়ে করতে পারল না? মন খারাপ করার কিছু নেই, তার প্রথম নিজস্ব সংসার।

ছাদের খবরটা আমলি তাকে দিয়েছিল। বাড়িওয়ালার ছেলে নাকি জানতে চেয়েছিল তারা কাপড় কোথায় শুকাতে দেয়। আমলি বলেছিল ঘরের ভেতর। তখন বলেছিল তাকে, খোলা ছাদ আছে, সেখানে তোমার আপু গিয়ে কাপড় শুকাতে দিতে পারে।

আমলিকে তানজু বোকাসোকা পায়। মুখ ফুটে কথা বলে না, এই বয়সে কানে কম শোনে কি না কে জানে? সেই মেয়ে বাড়িওয়ালার ছেলে না কে তার খোঁজ পেল কোথায়? এত খবর নিয়ে এলো?

একটু রাগ হয়েছিল তাকে না জিজ্ঞেস করে ঘর ছেড়ে সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে কী কথা বলে!

এক ঘরের ভেতরেই বাস।

পিয়াস-তানজু নতুন স্বামী-স্ত্রী। কোনো কথা বা কোনো দৃশ্যই আমলির আড়ালে বলা-করা যায়!

আমলি, তানজুর একটা খেলনা হয়েছে। পুতুলের মতো একটা আস্ত মানুষকে সে পেল, তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারে, তাকে বকে, ধমকায়, কাজ শিখিয়ে দেয়। এটা তানজুর একটা বানিয়ে নেওয়া খেলা। সে সত্যি সত্যি রাগে না, বকে না। সে জীবনে কোনো মানুষকে খারাপ ভাবে দেখেনি।

আমলি ময়লা ফেলতে যায় নিচে, তখনই কারো সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে-ই ছাদে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিল। তানজু ঘরের বাইরে আসতে পারল, ছাদটা দেখল।

বলবো বলবো না করেও বলল তানজু, আমার কাপড় ছাদে দেব না রে। কে না কে উঠে ছাদে?

আমলি বলল, অসুবিধা কী?

– তোর বাড়িওয়ালার ছেলে বলছিলি ছাদে উঠে সিগারেট খায়। হা করে আমার জামার দিকে তাকিয়ে থাকবে‌।

– আপনার ভেতরের জামা-সেমিজ তো না!

– এক কথাই।

আমলির কাছে তানজুর লুকানোর কিছু নেই। সে-ই তো সব কাপড়চোপড় ধোয়। এই একটা কাজ মোটে করতে চায় না তানজু।

এই এক রুমের খোপে বেশিদিন থাকবে না তানজু। পিয়াসের সঙ্গে তার  তেমনই কথা হয়েছে। তবে যে কয়দিন আছে, আমলির সঙ্গে কিছুটা আড়াল-আবডাল করেই তাকে চলতে হবে। রাতের ঘটনার পর সকালবেলা যখন তানজু আমলির মুখোমুখি হয় প্রথমবার, লজ্জায় তখন সে আমলির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না।

পুরো খোলা ছাদ, উঁকিঝুঁকি মেরে চারপাশটা দেখে এলো তানজু। এই ছাদ নিয়ে ভয় নেই তার, ঘরে তো কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই যে, ছাদে উঠলে তাদের পড়ে যাওয়ার রিস্ক থাকবে।

তানজু আমলিকে বলল, চল নামি, রান্নার কাজ ধরি।

– আরেকটু দেখেন, থাকেন।

– কী দেখবো রে?

– কেন ছাদে থাকতে আপনার ভালো লাগছে না?

– ভালো লাগলে কী, সারাদিন এই ছাদে বসে থাকলে চলবে আমাদের?

– আরেকটু। বড় চাদর দুইটা উড়ে-টুড়ে যায় যদি, আরো দুইটা ক্লিপ লাগিয়ে দিয়ে আসি।

তানজুর মনে হলো আমলিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারও তো ছোট্ট বারান্দাটায় দিনরাত কষ্ট করে থাকতে হয়। এখন তার মতো আমলিরও ভালো লাগছে ছাদে আরেকটু বেশি সময় থাকতে।

তবে আমলিকে একটু অস্থির লাগছিল। কিছু একটা ভাবছে বা কিছুর অপেক্ষা করছে।

সিঁড়িতে কার পায়ের খসখসানি। তানজু বুঝলো তার ধারণা সত্যি। ওরা কাপড় শুকাতে দিতে ছাদে উঠবে তা বলে দিয়ে এসেছে আমলি।

তানজুর চোখে বাড়িওয়ালার ছেলেটা পড়েছে দুয়েকবার। তবে তেমন কিছু ভাবেনি, ফরফর করে কথা বলে।

তানজু যেন কেউ না, তাকে বাদ দিয়ে আমলিকে বলল, আরো সকাল সকাল আসবে, না হলে দেখবে অন্য  ভাড়াটে মেয়েরা কাপড় শুকানোর সব জায়গা দখল করে নিয়েছে।

বাড়িওয়ালার ছেলেটা, নাম রাহিদ  বা ফাহিদ, না সাদ, তানজুরা এসে নতুন যখন উঠলো, ঘর গোছানোর সময়, পরেও দুয়েকবার দেখা হলে বলেছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো।

এখনো বলল, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো।

মনে মনে বলল তানজু, অসুবিধা হলে তুই ব্যাটা কী করবি?

একটু আগেই মনে হয়েছিল রাগ করা শিখে যাচ্ছে সে। তবে এটা ভালো কথা নয়। বাইরে তা বুঝতে দেওয়া যাবে না।

তানজু বলল, না আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।

আমলিকে বলল, চল।

আগেই নেমে চলে আসতে ধরলো তানজু। আমলি আর ফালতু লোকটা কোনো কথা বলতে চায় তো বলুক। স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তার এই ছাদে কাপড়  নিয়ে ওঠা ব্যাপারটা এমনি এমনি হয়নি। আমলি আর সাদ এটা সাজিয়েছে। যা করে করুক। এখন থেকে তানজুর ভালো লাগবে না, এরকম বহু জিনিস তাকে মেনে চলতে হবে।

তানজুর পক্ষে খুবই সম্ভব একা তার সংসার সামলানো। সে সব শিখে নিয়েছে, কাটাকুটি, ধোয়াপাখলা, রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর সাজানো। স্কুলে তার যেসব বন্ধু ছিল তারা হাত-পা তুলে পটের বিবি সেজে থাকতো। আর তখন তানজু রান্না শিখত, কোন মসলার কী স্বাদ, কার সঙ্গে কী মেশাতে হয়। রুই মাছের ঝোল করতে কতক্ষণ চুলায় বসাতে হবে, শর্ষে ইলিশ করার নিয়ম। কোন ডিটারজেন্ট পাউডারে ভালো কাপড় ধোয়া হয়। বন্ধুরা বলতো তো, তুই তানজু শেষ পর্যন্ত কাজের বুয়া হবি। কাজের বুয়া না হোক, তানজুর মনের ভেতর সবসময় একটা ভাবনা থাকত – সে ভালো বউ হবে, ভালো একজন মা হবে। সেসবের জন্য তাকে বিয়ে করতে হবে। আশ্চর্য কী, বিয়ের কথায় সে কখনো লজ্জা পেত না।

তানজুরা তিন বোন। সে আবার বড়। টের পেত তানজু, একটা চাপ বাবা-মায়ের ওপর সবসময় ছিল যে, মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে।

বিয়ে বললেই আর বিয়ে হয় না। যার সঙ্গে বিয়ে হবে সে ছেলে কেমন, তার ঘরসংসার কেমন, বাবা-মা, বংশ। তারপর বিয়ে মানেই বড় একটা খরচের ধকল।

তানজু এটাও বুঝতো, তাদের সংসারে সব মেয়ে না হয়ে একটা ছেলে থাকলে ভালো হতো। সবচেয়ে ভালো হতো বড়জন যদি হতো ছেলে। তানজু যদি হতো ছেলে! কিন্তু একবার মেয়ে হয়ে জন্মে তার তো আর ছেলে হওয়ার উপায় ছিল না।

তবে তানজু দেখেছে, আজকাল মেয়েরাও ছেলেদের সমান হয়, তাদের মতো হয়। লেখাপড়া, চাকরি, আয় রোজগার, দায়িত্ব নেওয়া। মেয়েরা এখন   বড় বড় কাজকর্ম করে কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছে।

তানজু তার ছোট দুই বোনের চাওয়াটা বেশি বুঝতে পারেনি। তবে সে মেয়ে হয়েই থাকতে চেয়েছে। বুয়া বললে বুয়া, ঘরের বউ বললে বউ, বাচ্চার মা বললে মা। এসব কারণেই কি না কে জানে, বাবা তার এই বোকা মেয়েটাকে খুব ভালোবাসে। কোনো বাবাই তার মেয়েকে ভালোবাসে না? তবে তানজুর বাবা সেরা বাবা।

পিয়াসের সঙ্গে তার বাবা-মায়ের সম্পর্কটা আবার কেমন যেন!

পিয়াসকে বিয়ে করে তানজু তো শ^শুরবাড়িতে উঠলো। সেখানে দেখল পিয়াসের তেমন একটা জায়গা নেই। সেখানে গিয়ে তানজু বসবে, শোবে কোথায়?

বিয়ের আগে পিয়াস তানজুকে দেখাতে নিয়ে এসেছিল তাদের বাড়িতে। এক বেলার দেখা। তখন কিন্তু ভালো লেগেছিল পিয়াসের বাবা-মা-ভাই-বোনকে। পিয়াসের ছোট ভাইয়ের এখানকার কলেজে পড়া শেষ হয়নি, তার আগেই আমেরিকার বড় ইউনিভার্সিটির বৃত্তি পেয়ে বসে আছে। কোনো খরচাপাতি ছাড়া সেখানে পড়াশোনা শেষ করবে, তার ওপরে ডলার পাবে। লেখাপড়া শেষ করে পুরো সংসারটা উঠিয়ে আমেরিকা নিয়ে যাবে। বোনটা ছোট, সুন্দর। এক দেখায়ই বুঝেছে তানজু, পিয়াসের বোন বড় হয়ে তানজুর মতো সাধারণ মেয়ে হবে না। কত জায়গায় তাকে নিয়ে টানাটানি হবে। টানাটানি না হলে কোনো মেয়ের জীবন জীবনই নয়।

পিয়াসের বাবা বোকাসোকা না  তানজুর বাবার মতো। এক দেখায়ই বুঝেছে তানজু। ভালো চাকরি করে, ভালো আয়-রোজগার।

তানজু আর পিয়াসের বিয়ে পড়ানোর  অনুষ্ঠান হয়েছিল তানজুদের ফ্ল্যাটে। ছাদের ওপর প্যান্ডেল বেঁধে, ডেকোরেটরের গোলটেবিল, সাদা প্লাস্টিকের চেয়ার বসিয়ে খাওয়া-দাওয়া। বিয়ে করে পিয়াসের সঙ্গে চলে এলো শ^শুরবাড়ি‌। রাতে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হলো নতুন দম্পতিকে – লজ্জার মাথা খেয়ে চোখ তুলে তুলে পুরো ঘরটা পরখ করলো। অত খুঁটিয়ে বোধহয় তানজু পিয়াসকেও দেখেনি। বড়োসড়ো ঘরটা, বড় জানালা, জানালায় জবরজং রঙের পর্দা। এই পর্দায় তানজুর চলবে না। বেডরুমে থাকবে সোবার ক্রিম কালারের পর্দা। বাতির আলো আর  ঘরের পর্দা মেশামেশি হয়ে যাবে। তখন এই একই ঘর সমুদ্রের মতো বিশাল মনে হবে। আয়না লাগানো একটা স্টিলের আলমারি, যা তানজু দু-চোখে দেখতে পারে না। শোবার খাটটাও বিশাল। দেখে মনে হয়, খাট কেনার সময় মনে হয়েছে কিছু টাকা বাড়িয়ে দিয়ে ডাবল খাটের বদলে কিং সাইজ খাট একটা কিনে নিলেই হবে। চার-পাঁচজন  মানুষ একসঙ্গে শুতে পারবে। আরে বাবা, তুমি স্টেডিয়াম বানাচ্ছ নাকি যে মাথায় রাখতে হবে গ্যালারিতে কত বেশি দর্শক ধরাতে পারবে? খাটে তো থাকবে দুজন মানুষ। বড় খাট হলে গড়াতে গড়াতে স্বামী চলে যাবে উত্তর গোলার্ধে, স্ত্রী দক্ষিণ মেরুতে।  স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দানা বাঁধবে কী করে? গায়ে গা ঘেঁষে না শুলে, গায়ের গন্ধ নাকে না এলে কিছু একটা হলো?

বউভাত হলো ছোট একটা কমিউনিটি সেন্টারে। যত যা-ই হোক বিয়ের নতুন বউ সে তো আর চোখ বড় বড় করে সব খোঁজ রাখতে পারবে না, বারবার কেন কারেন্ট চলে যাচ্ছে। তখন চালু হচ্ছে ডিজেল জেনারেটর, তার ঘটরঘটর  শব্দ। প্রথমবার নিজেই তানজু একটু ভয় পেয়েছিল হঠাৎ কারেন্ট চলে যেতে। পরে খেয়াল করলো কারেন্ট যাচ্ছে আর মেয়েদের আর্তচিৎকার‌। শব্দ করে জেনারেটর চালু হলো, সিনেমার পর্দার মতো চারধার আলোয় ঝলমলে, তখন দেখল সেজেগুজে আসা মেয়ে-মহিলাদের প্রায় সবাই গলার হার বা হাতের চুড়ি চেপে ধরে আছে। বোঝা মুশকিল কোনটা আসল গোল্ড আর কোনটা সিটি গোল্ড?

পরনে ভারি শাড়ি, গাভর্তি গয়না, এত সময় ধরে পার্লার থেকে সেজে এসেছে; মোমের পুতুলের মতো এতক্ষণ বসে থাকা, বিদ্যুতের ছলাকলায় মোম যে বাহির-ভেতর গলে গলে পড়ছে। তানজুর জ্ঞান হারানোর অবস্থা বা এরকম একটা বাজে কমিউনিটি সেন্টার কেন নেওয়া হলো, এসবের জন্য একবারও পিয়াস এসে তাকে কিছু বলল না, যেন এরকমই হয়, এটাই অবাক লাগছিল তানজুর।

বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে এক রাত গিয়ে তারা দুজন থাকল তানজুদের বাড়ি। কিন্তু ফেরত যখন এলো, দেখলো বহু কিছু বদলে গেছে। তানজু নিজেদের জন্য যে ঘরটা সাজাবে-গোছাবে  ভেবেছিল, দেখলো আদতে  তা শ^শুর-শাশুড়ির ঘর, তাদের ফুলশয্যার  এক রাতের জন্য ছেড়েছিল। এখন ঘর আবার তাদের দখলে। অনিতার আরো ছোটবেলা থেকে তার নিজস্ব ঘর, বাড়ির সে রাজকুমারী বলে কথা‌। পিয়াসের যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভাই, সে তার ঘর পুরো এক বিশ^বিদ্যালয় বানিয়ে রেখেছে দেখল তানজু – বই, কম্পিউটার, কাগজপত্র। তার দেবরটি প্রফেসর না ছাত্র তা ঠিক ঠিক নির্ণয় করা মুশকিল, ঠাট্টা না, ভালো ছাত্র এই প্রথম দেখল তানজু।

ড্রইং-ডাইনিং রুমের মাঝখানে পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, ড্রইংরুমে বাদামি রঙের সোফা ছিল, এটা খুলে নিলেই বেড, তানজু যেমন চায় গা ঘেঁষাঘেঁষি  করে থাকা যাবে।

বিয়ের আগে পিয়াস এই সোফায় ঘুমাত, তখন অবশ্য মাঝখানে স্বপ্নের মতো এই মায়াবী পর্দাটা দুলতো না।নিজস্ব বিছানায় আরাম করে ঘুমিয়ে গিয়েছিল পিয়াস। কিছুক্ষণ তানজু চোখ বুঁজে পড়ে থাকার চেষ্টা করেছে। ছারপোকার কামড়, মশার কামড়, এত কামড়াকামড়ি তো ছিলই। শুধু এটাই কারণ না, আরো কিছু হয়তো ছিল, তানজু চুপ করে একা একা কাঁদছিল।

তানজু অনুভূতিপ্রবণ, তার কান্নার প্রয়োজনে কেঁদে ভাসায়, আবার হাসির সময় মন খুলে হা-হা করে হাসে। তবে সে তার হাসি-কান্নার নহরে পড়ে থাকে না, হাসি-কান্নার ভেতর থেকে তার কাজটা বের করে নেয়। প্রথম ঠিক করল এ-বাড়ির এতসব কাহিনি বাবা-মাকে বলা যাবে না। নাম্বার টু – এই বাসায় থাকা যাবে না। পিয়াসকে নিয়ে থাকার একটা জায়গা খুঁজতে হবে।

এত কিছু জানতো না তানজু। বিয়ে করে সে রোজই কিছু না কিছু জানছে ও শিখছে। বিয়ের রাতে শাশুড়ি আম্মার ঘরে, তারপরের রাতে নিজেদের বাড়িতে তানজু তার ঘরে। ওই ঘরে তানজু ও তার ছোট বোন থাকতো, বিয়ে হয়ে গেল বলে ছোট বোন এখন পুরো মালিকানা পাবে। এই দুই রাতে যা দেওয়ার কিছুটা পিয়াসকে দিয়েছিল তানজু। তার সোফা কাম বেডে শুয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তানজু, এই খোলা মাঠের ভেতর তুমি আর কিছু পাবে না। পিয়াস তুমি ভেবো না, তুমি বললেও আমি বিশ^াস করবো যে, তুমি কোনোদিন পর্ন দেখোনি। আমি শ^শুরবাড়ি এসে সানি লিওন বা মিয়া খলিফা হতে পারবো না।

রাতে রোজ বলে তানজু পিয়াসকে, দিনে মনে হয় ব্যস্ত মানুষ পিয়াস ভুলে যায়। এভাবে কাটলো কয়েক দিন।

ফিসফিস করে এক রাতে পিয়াসের কানের কাছে গিয়ে বলল, তোমার কিছু লাগবে না, ঠিক আছে। কিন্তু আমার লাগবে, তোমাকে দশদিনের আরটিমেটাম দিলাম।

নিজের মুখে বলবে কী, তানজুর মাপা হয়ে গেছে, পিয়াস বেশি কিছু জানে না, তেমন খোঁজখবরও রাখে না।

 আটদিনের মাথায় পিয়াস তার কোন বন্ধুর মাধ্যমে খোঁজ পেয়েছিল খিলগাঁওয়ের গলিতে একটা স্টুডিও রুম আছে। স্টুডিও রুম বলেনি, বলেছিল ওয়ান রুম ফ্ল্যাট।

পিয়াস বলেছিল, চলো দেখে আসি।

তানজু বলেছিল, দেখতে হবে না। তোমার বর্ণনায়ই বুঝেছি রাজপ্রাসাদ হবে। আমার কাছে বিয়েতে গিফট পাওয়া কিছু ক্যাশ আছে, সে-টাকায় চলো খাট-বিছানাপত্র, হাঁড়ি-পাতিল কিনি।

কেনাকাটাও তেমন পারে না পিয়াস। তবে তানজুও যে খুব পারে, তা বলা যাবে না। তবে দোকানি কোনো কিছুর দাম তিন হাজার টাকা চাইলে সে দুম করে তিনশো টাকা বলে ফেলতে পারে। প্রথম মনে হয় দোকানি গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে, তবে দেখা যায় সাতশো টাকায়ই রফা হয়। তানজু শিখছে আর তার সাহস বেড়ে যাচ্ছে দরাদরিতে।

মাকে এত কাহিনি তো আর বলা যায় না। তানজু গিয়ে তার মাকে বললো, আমরা আলাদা ঘর নিচ্ছি, এক রুমের ফ্ল্যাট। স্টুডিও ফ্ল্যাট মা।

– তুই একলা পারবি?

– বাবা দুই বউ একসঙ্গে বিয়ে করেছিল নাকি? এক বউ তো দেখলাম, আরেকটা কই লুকিয়ে রেখেছে?

– ধুর পাজি। ভালো কথা তোর সঙ্গে বলার উপায় নেই। আমি আগেই বলে ব্যবস্থা করে রেখেছি, গ্রাম থেকে একটা মেয়ে পাঠাতে, তোর সঙ্গে মিলে সংসারের কাজ করবে।

– লাগবে না মা।

– তুই আমার পেটে হয়েছিস না আমি তোর পেটে?

এটা মায়ের প্রিয় ডায়ালগ। আর এই ডায়ালগের পর বিচারের রায় শেষ।

পিয়াস, তার বাবা-মা ভাই-বোন সবাইকে পছন্দ করেছিল তানজু। তবে তারা পাত্রী হিসেবে তানজুকে কেন পছন্দ করল তা আল্লাহ জানে।

তানজু মনে মনে ভাবে তো বেশি, এটা নিয়েও ভেবেছিল। এটা কি হতে পারে, পিয়াসের লোকজন ভেবে রেখেছিল, এই ছেলে কোনোদিন বউ জোটাতে পারবে না। আর তার কপালে জুটল কি না তানজুর মতো একটা ভালো বউ।

তানজুকে লাগেনি, যা বলার পিয়াসই বলেছে তার বাবা-মাকে, তারা যে এ-বাড়ি ছেড়ে এখন চলে যাচ্ছে।

নতুন বাসায় পুরো ওঠার আগে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে এলো তানজু। আর তখন দেখল, মা ইতোমধ্যে আমলিকে আনিয়ে রেখেছে। হাত-পায়ে বড়, এইটুকু মেয়ে কাজ করবে কি, তার কাজই তো করে দিতে হবে।

তানজু বলল, তোর বয়স কত রে?

আমলি বলেছিল, এই বয়সে আমাদের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়।

– বা বা পাকা মেয়ে!

এইভাবে তানজু তার ঘর পেল, আমলিকে পেল, পিয়াসকে পেল।

তানজু রাতে পিয়াসকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি খুশি তো?

তৃপ্ত, খুশি পিয়াসের ঘুমিয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না।

আর তখন তানজুর মাথায় ঘুরতে শুরু করে তার আর কী কী নতুন কাজ করতে হবে?

দুই

তানজুর ঘরসংসার কেমন চলছে তার খোঁজখবর নিতে বাড়িওয়ালার ছেলেটা আসে যখন, পিয়াস বাড়িতে থাকে না। তানজুর ঘরে বসার তেমন একটা ব্যবস্থা হয়নি। রয়েছে তানজুরা শোয় সেই খাটটা। চটের একটা মাদুর টাইপ সেটা বিছিয়ে খেতে বসে। পা ভেঙে তার ওপর বসে খেতে অসুবিধা হয় তানজুর, কিন্তু দেখে পিয়াসের সেই মাদুরে দিব্যি চলে যাচ্ছে। তাই তানজুও আর অসুবিধাকে অসুবিধা মনে করে না।

খাবার ছোট একটা টেবিল কিনতে হবে। সেইসঙ্গে কয়েকটা চেয়ার। এখন তো চেয়ার নেই যে বাড়িওয়ালার ছেলেকে বসতে দেবে।

বসতে দিলেও বসত না অবশ্য, তানজু ওই ছেলের তাকানো, হাঁটাচলা, চোখ-মুখ দেখে বুঝে গেছে। সে হেঁটে হেঁটে এটা দেখে, ওটা দেখে। রান্নাঘরে ঢুকে যায়। বারান্দাটায় যেখানে আমলি তার ঘরসংসার সাজিয়ে নিয়েছে সেটাও উঁকি মেরে দেখে।

– ফ্রিজ তো নেই দেখছি।

তানজু বলেছিল, পিয়াসকে বলেছি, একটা একটা করে কিনে ফেলবে। কত কী লাগে সংসারে আগে তো বুঝিনি, হুট করে সংসার পেতে বসলাম।

– অসুবিধা নেই, আমার ঘরে দুইটা ফ্রিজ।

আমলিকে বলল, আপুর মাছ-মাংস আমার ফ্রিজে রেখে আসবে, যখন লাগবে নিয়ে আসবে। 

তানজুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, আপু আপনার জিনিস চুরি যাবে না।

– আমাদের অত বেশি কিছু এখন বাজার হয় না। আমরা দুটো মানুষ। পিয়াস তো বাইরে বাইরে থাকে, দুপুরবেলাটা কোনোদিনও খেতে আসে না।

– দুজন হবেন কেন? আপনারা তো তিনজন। মজার চোখে আমলির দিকে চোখ ঘুরিয়ে বললো, ওই তো আমলি আছে।

তানজু জানে আমলি কাজের মানুষ। রান্নার সময় এক মুঠো চাল বেশি ধরে দিলেই হয়, মাছ-তরকারি আলাদা হিসাবে আনতে হয় না।

সাদ বলল, আপনার বোন হয় নাকি?

তানজু চোখ ঘুরিয়ে আমলিকে  বকুনির মতো দিতে গেল। সব কথা জানাতে হয় নাকি? আমলি ওই লোকের সঙ্গে এত গল্প করার সুযোগ পায় কখন?

তা-ও ওই ছেলের ভুল ভাঙিয়ে দেওয়া দরকার মনে করে তানজু বলল, আমাদের গ্রামের মেয়ে, ওই

লতায়-পাতায় যা হয় আর কি!

আমলি ঢুকে গেছে রান্নার জায়গায়, ভেতরে কী যেন নাড়াচাড়া করছে। এখন শুনেও শুনবে না। কিন্তু তানজু জানে, প্রথম সুযোগেই হয়তো দৌড়ে গিয়ে সাদ ছেলেটাকে বলে দিয়ে আসবে, আমলি তানজুর বাবার দিক দিয়ে ভালোই আত্মীয়।

আমলি ছাদে শুকানোর কাপড়, সাদের ফ্রিজ থেকে মাছ আনা এই দুই কাজ নিয়ে গেছে দুই ঘণ্টার মতো হয়, ফেরার নাম নেই।

আমলি আর সাদ এই দুজনে এত কী গল্প করে? আমলি তো এলো সবে এক গণ্ডগ্রাম থেকে, সে শহরের কথা, শহরের ভাষা বোঝেটা বা কী! এটাও ঠিক, পুরুষ-নারীতে গল্প করতে বিষয় লাগে নাকি? যদিও তানজু জানে, আমলি বাচ্চা একটা মেয়ে।

তানজু মনে মনে মায়ের দূরদর্শিতার প্রশংসা করে‌। ভালো যে আমলিকে  তার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে। তানজুকে এ-বাড়িতেই থাকতে হবে। পিয়াসকে বলা যাবে না, এই বাড়ি বদলাও, এই বাড়ি ছেড়ে আবার তানজু গিয়ে উঠবে কোথায়? তার সংসারের কী হাল যাচ্ছে, তা সে তার বাবা-মাকে জানাতে যাবে না, আর পিয়াসের পক্ষে নতুন একটা ঘর জোগাড় করতে লাগবে ঠিক আবার ছয় মাস।

তানজু আরেকটু সড়গড় হোক, সংসারের হাল ভালো করে ধরতে শিখুক, যখন সে নিজে বাড়ি খুঁজতে পারবে, বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করতে পারবে, তখন ছাড়ার কথা ভাববে এই জায়গা।

এর ভেতরেই তাকে মানিয়ে চলতে হবে। এই ঘরের ভেতর বড়োসড়ো একটা বিড়াল সাইজ চিকা আছে। দিনে দু-একবার বের হয়। কোন দিক থেকে আসে, কোন দিকে যায় কে জানে!

তানজু জানে চিকাটা আছে, চিকাটা আসবে;‌ কিন্তু যখন একটা রেলগাড়ির মতো দুড়দাড় করে এসে মেইল ট্রেনের মতো না থেমে চলে যায়, তখন সে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে‌।

রাস্তা পার হয়ে মৌচাকে গিয়ে তানজু আর আমলি বাথরুমের জন্য একটা বড় লাল বালতি কিনে এনেছিল পানি ধরে রাখার জন্য‌‌। কলের পানি সবসময় থাকে না। বালতির সঙ্গে বড় একটা ছুরি কিনে এনেছিল তানজু।

আমলিকে বলেছে, ছুরিটা দিয়ে পেঁয়াজ কাটা সহজ হবে‌। কিন্তু তানজু সেটা কিনেছে চিকাটার জন্য, কেন জানি তার মনে হয়েছে চিকাটা আরো বাড়াবাড়ি শুরু করবে। তখন ছুরিটা নিয়ে তানজু ঝাঁপিয়ে পড়ে চিকাটাকে কচুকাটা করবে।

একটা ঘরেই থাকা তানজুদের, তার ভেতরে রান্নাঘর, বাথরুম‌ সারাক্ষণ ঘরের দরজা আটকে রাখা সম্ভব নয়, গন্ধে তিষ্টানো যাবে না।

সাদ যেদিন তানজুকে বলল, আপনাকে আমি ভাবি বলবো না, আপু বলে ডাকবো, তখন থেকে তানজু ঠিক করে রেখেছে সাদকে কিছুটা দূরে রাখার জন্য আমলিকে মাঝখানে রাখতে হবে।

মাঝে মাঝে মনটা কামড়ও দেয় তানজুর, আমলি সরাসরি তার ব্লাড না হলেও আত্মীয় তো। আর ওর বয়সও তেমন একটা কিছু হয়নি।

কত দিক সামলাবে সে? তার পিয়াসকে সামলাতে হয়। তার ওপর আছে পিয়াসের সংসার। পিয়াসের সংসারে তো সে আছেই। তবে তার মনে যে-সংসারের ছবিটা আছে তাকে সে-রকমের একটা সংসার সাজাতে হবে তো, তারপর সে মা হবে।

স্কুলে ফোরে না ফাইভে পড়ে তখন তানজু, টিচার জিজ্ঞেস করেছিল ছাত্রীদের, কে কী হবে বড় হয়ে?

তানজু তার উত্তর রেডি করে বসেছিল। তার কাছে আসা মাত্র দাঁড়িয়ে  সে বলেছে, আমি মা হবো।

টিচারের তানজুর কথা বুঝতে হয়তো একটু সময় লেগেছে, তারপর যখন বুঝেছে, ছাত্রীদের সঙ্গে তারও কি হাসি!

তানজু এটাই জানত শুরু থেকে, তার বিয়ে হবে, সংসার হবে, বাচ্চা হবে। বিয়েটা তার হয়ে গেছে, এখন সংসার সাজানোর পালা।

সকালবেলা নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যায় পিয়াস। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা-নয়টা। ছুটির দিনও তাই, তার নাকি ছুটি নেই। কোথায় কোথায় তার ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়। কেন যে তানজুর এখনো অভ্যাসটা হয়নি, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আগবাড়িয়ে সব কথা জিজ্ঞেস করার। তার কেন জানি মনে হয়, এরকম করলে পিয়াস তার কাছে মিথ্যা কথা বলতে শুরু করবে। সে পারতপক্ষে মিথ্যা কথা বলে না, পিয়াসের সামনে তার মিথ্যা কোনো রূপ তুলে ধরতে চায় না। মোটকথা মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে সম্পর্কটা শুরু হোক তা সে চায় না‌।

আগে তো সে শুনেছে, বিয়ের রাতে বিড়াল মারতে হয়। মানেটা হয় তো এই যে, তারপর থেকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু তানজুদের বিয়ের রাতটা এমন ভাবে এমন জায়গায় কেটেছে তারও কোনো বিড়াল মারা হয়নি, পিয়াসেরও নয়। তাদের সম্পর্কটা কবে যে একটা পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, সে কিছুটা বুঝবে  পিয়াসকে বা পিয়াসও তাকে। তবে পিয়াস তাকে কতদূর কতটুকু বুঝবে সেটা তেমন ইম্পর্ট্যান্ট নয়, তার তো পিয়াসকে বুঝতে হবে একটু একটু করে, না হলে তার সংসারটা করা হবে কীভাবে?

কবে যেন সকালবেলা পিয়াস বলছিল, শরীরটা তার ভালো লাগছে না। উঠল একটু বেলা করে। আমলি নাস্তা রেডি করে বসে আছে, তার দুলাভাই কখন বিছানা ছেড়ে ওঠে? পিয়াস উঠে প্রথমে বাথরুমটা একবার ঘুরে আসে, দাঁড়িয়ে থেকে একটু মোচড়ামুচড়ি করে, হাত-পা একটু ছোড়াছুড়ি করে। একটু ওঠবোস করে, কোমর ভেঙে উবু হয়। কোনটার পর কি তাও জানে তানজু। তারপর এক গ্লাস ভর্তি পানি খায় নিজে জগ থেকে ঢেলে। পানিটা দেওয়ার জন্য কাউকে বলবে না, তানজুকে না, আমলিকে না। জগ উল্টে দেখল একদিন পানি পড়ছে না। আমলি পানি রাখতে ভুলে গেছে। রান্নাঘরে ঢুকে খুঁজে পেতে পিয়াস পানি নিয়ে এলো।

সকাল এগারোটায় দেখল তানজু, পিয়াস বাথরুমে গেল কিন্তু ফিরে এসে আর হাত-পা ছোড়াছুড়ি করল না, বিছানার এক কোণে বসে থাকলো।

তানজু এসে বললো, তোমার শরীর খারাপ লাগছে?

পিয়াস বলল, না।

তানজু উত্তরটা শুনলো কিন্তু বিচার করতে গেল না, সত্য না মিথ্যা। ওই বিচারটায় এখনই যেতে চায় না তানজু।

তানজু বলল, খারাপ লাগলে আজ বেরিয়ো না।

তানজুর কথা মেনে নিয়েছে, এরকম ভাব দেখালো না পিয়াস। তবে সেদিনটা ঘরে থাকলো পিয়াস। দুপুরবেলা মাদুর পেতে একসঙ্গে খেতে বসলো। তার আগে পিয়াস শুয়ে-বসে ছিল। একসময় নাকের ঘরঘরানিতে মনে হলো আবার ঘুমিয়ে গেছে। আমলিকে সতর্ক করল – কোনো শব্দ করবি না। আজ রান্নার কাজের কিছুই ছাড়লো না আমলিকে‌। ভাজি-ভর্তা, ছোট ট্যাংরা মাছের ঝোল এসব করল তানজু। একবার দেখল পিয়াস শুয়ে শুয়েই তার ফোন টেপাটেপি করছে।

পিয়াসের খাবার তুলে তুলে দিচ্ছিল, বাচ্চা ছেলের মতো পিয়াস না না করছিল। এটা খাবো না, ওটা খাবো না। তানজু শুনছিল না, বেশি বেশি করে তুলে দিচ্ছিল। জোরের গলায় বলছিল, খাও সব। গলা নামিয়ে হাসি মুখে বলেছিল, না হলে আমি মুখে তুলে খাইয়ে দেবো।

তানজু খাচ্ছিল পিয়াসের সঙ্গে, কিন্তু খাওয়াটা যেন আসল কাজ না, কাজটা হলো পিয়াসকে সঙ্গ দেওয়া।

ছোট ছোট প্রশ্ন করছিল তানজু, শুঁটকির ভর্তা তুমি খাও? ঝাল হয়েছে? করল্লা কি তিতা? তুমি খাওয়ার সময় ঢকঢক করে পানি খাও কেন? খাওয়া শেষ করে একেবারে পানি খাবে।

পিয়াস কোনোটা শুনছে, কোনোটা শুনছে না।

তার মধ্যে পিয়াস একবার তানজুকে জিজ্ঞেস করল, তুমি বাসায় সারাদিন একা থাকো, খারাপ লাগে?

তানজুর একবার মনে হয়েছিল, বলে, হ্যাঁ, একবার মনে হয়েছিল বলে, না। কিন্তু তানজু তো ঠিকঠাক জানে না তার কথা। মিথ্যা সে বিনা কারণে বলতে যাবে না পিয়াসকে। সে বলল, একা কই আমলি তো সারাদিন আমার সঙ্গে।

পিয়াস বলল, তোমার বোনদের আনো, কয়েকদিন তোমার সঙ্গে এসে থাকুক।

কপালে একবার হাত দিয়ে দেখেছিল তানজু পিয়াসের – একটু গা গরম। জ্বরের মন বলে মনে হয় দুয়েকটা বেশি কথা সে আজ  শুনতে পেরেছে পিয়াসের মুখ থেকে।

তানজু বলল, রাতে তোমার কী হবে তাহলে! মুখটা লজ্জায় একটু লাল হলো মনে হয় পিয়াসের।

আজ সারাদিন তানজুর পিয়াসের ওই লজ্জা লজ্জা মুখটা মনে পড়ছিল। আজো একটু জ্বরজারি হতো। পিয়াস সারাদিন ঘরে থাকতো। দুপুরবেলা একসঙ্গে খেতে বসতো। আজ না হয় বেশি সময়ের জন্য আমলিকে ঘর থেকে বাইরে বের করে দিত। এখন আমলির এই ঘর আর বারান্দাটার বাইরে থাকার সুযোগ হয়েছে।

রান্নাবান্না শেষ হলে, গোসল সেরে এসে তানজু বলল, রান্নাঘরে না, তুই আর আমি একসঙ্গে ঘরের মধ্যে বসে খাব।

তানজু দেখলো, তরতর করে মাদুরটা ঝেরে-টেরে এনে আমলি ঘরের মাঝখানে পেতে দিয়েছে, মাথার ওপরে ফ্যানের বাতাস ভালো গায়ে লাগবে। প্লেট, গ্লাস, পাতিল, কড়াই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলো। তানজু দেখল, আমলির কাজটা পছন্দ হয়েছে।

অন্যদিন হয় না, আগে তানজুদের খাওয়া শেষ হয়, তারপর আমলি তার প্লেট নিয়ে এলে প্লেট ভরে ভাত, অবশিষ্ট তরিতরকারি থেকে রাতের জন্য রেখে যতটুকু দেওয়া যায় আমলির প্লেটে তুলে দেয়। আমলি ভাতটা খায় বেশি ।

আজ তানজু বলল, আমি তুলে দেবো না, তুই নিয়ে খা।

আজ মনে হয় আমলির হাত সরছিল না, সে প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল, না আপা, আপনি দেন।

একটা কথা মনে পড়ে হাসি পেয়ে গেল তানজুর। কবে যেন কী খুঁজতে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে তানজু, আমলি কী ধোয়া-মোছার কাজ করছিল। পেছনে যে তানজু টের পেয়ে আমলি আর নড়েচড়ে না, কথাও বলে না।

তানজু বলল, সর আমাকে ঢুকতে দে। তাও নড়েচড়ে না আমলি।

– কী হলো রে?

জোর করে তার দিকে মুখ ঘোরাতে দেখে, আমলির মুখভর্তি একটা কিছু, সে তাড়াহুড়ো করে গিলতে চেষ্টা করছে। কে জানে কোন হাঁড়ি-পাতিলের ভেতর থেকে কী চুরি করে তুলে নিয়ে মুখে ঢুকিয়েছে।

তানজু বেরিয়ে এসে বলল, যা পানি খা।

বিড়াল স্বভাব। তানজু বেশ আছে তার ঘরে বিড়াল নিয়ে, চিকা নিয়ে।

তানজুর কথাতে টের পেয়েই কি না, চিকাটা কোত্থেকে বেরোলো আর আমলির পিঠের পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল।

চিকাটাকে এখন আর তানজুও ভয় পায় না, আমলিও ভয় পায় না, ওই যা ঘেন্না হয়।

তার ভাতের প্লেট এক হাতে ঢাকতে ঢাকতে তানজু বলল, চিকা আমার ভাতের ওপর দিয়ে যেত যদি?

আমলি বলল, যেত না।

– তোকে বলেছে?

– আপনাকে আপা বেশি ভয় পায় তাই দেখেন আপনার ওদিক দিয়েও গেল  না।

– চিকাটাকে তুই মারতেও পারলি না। বড় একটা চাকু কিনে এনে দিলাম তোকে।

– চাকু দিয়ে ভয় দেখানো যায়, কাটবেন তো পেঁয়াজ।

ইঁদুর মারার কলে কি চিকা মরে, খোঁজ নিতে হবে তো। অনেক দিন তানজু ইঁদুর মারার কল চোখে দেখেনি।

তানজু বলল, আমলি তোর মাথার চুল কেমন জটা-জটা হয়ে আছে। ছোট একটা কিছু দিস, তোকে আমার চুলের শ্যাম্পু দিয়ে দেবো একটু। ভালো করে মাথা ঘষে চুল ধুয়ে নিস, চুলের জন্য কেমন পেত্নি পেত্নি লাগে।

দাঁত বের করে হাসলো আমলি।

– ওই তেল, শ্যাম্পুতে আমার চুলে কিছু হবে না, আমাকে একটা বার সাবান কিনে দেবেন।

– কোন সাবান নিবি, আমার সঙ্গে দোকানে গেলে বলবি।

– একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল কিনে দেবেন‌, আগেরটা ছিঁড়া গেছে।

– তুই যতবার ছাদে ওঠার নাম করে ছোটাছুটি করিস। ঠিক আছে কিনে দেবো, তবে তোর পায়ের স্যান্ডেল ঘরে ঢোকাবি না।

– কবুতরের বাসার খোপের মতো ঘরে ঢুকে বসে থাকতে আমার ভালো লাগে না আপা। আপনি সারাদিন থাকেন কী করে? এই বিল্ডিংভর্তি লোক। একটু আলাপ-পরিচয় করে নেন না। এর বাসায়, ওর বাসায় যেতে পারতেন। ওরাও আসবে।

– কে কেমন লোক কে জানে!

– যারা ভালো তাদের সঙ্গে মিশবেন।

– তুই সবাইকে চিনিস বুঝি?

– ভাইজানের কাছ থেকে সব ঘরের খবর জানি।

– ভাইজান আবার কে রে?

– ওই যে এই বিল্ডিংয়ের বাড়িওয়ালা।

– সাদ, বাড়িওয়ালার ছেলেটা?

– ওই একই আপা, সে-ই বাড়িওয়ালা।

– বাদ দে, যেই হোক বাড়িওয়ালা, আমাদের তাতে কী! যে এসে আমাদের হাত থেকে ঘর ভাড়া নিয়ে যাবে সে-ই বাড়িওয়ালা। মাস শেষ হলে সাদের বাবাই তো আসে টাকা নিতে।

– বাড়িওয়ালার একটাই ছেলে, সাদ ভাইজান।

– তুই বলছিলি, প্রথম যেদিন দেখলাম তোকে আমাদের বাসায়, তোর বিয়ের বয়স হয়েছে। সত্যি সত্যি তোর বিয়ে ঠিক হয়েছিল নাকি?

– হয় নাই? আমাকে বেশি বেশি বিয়ে করতে চেয়েছিল টাকাওয়ালা লোকেরা।

– বিয়ে করলি না কেন?

– ধুর সব কয়টার আগের বউ আছে।

– তুই ছাদে ওঠার নাম করে কই কই যাস কী করিস আমি জানি কিন্তু ।

– জানবেন না কেন, ভাইজানের ঘরে যাই। তার ঘরের কাজকর্ম করে দিই। আপনার ঘরে আর কতটুকু কাজ। কাজ না করলে আমার হাত-পা ব্যথা করে। গ্রামের বাড়িতে সারাদিন ধরে ঘরে-বাইরে আমার বাবা-মা যে কত খাটাতো।

– তোর ভাইজানের ঘরের কাজকর্মই করিস না আর কিছু করিস!

– কত কথা বলি। ভাইজান তো রাজা-বাদশার ছেলে। তার বাপের এত এত দোকান, বাড়ি, এত এত টাকা। বাপ মরলে সবই তো সে পাবে।

– তোর ভাইজান এই সব গল্প বুঝি শোনায় তোকে?

– আপনার কথাও জিগায়, আপনার কথা আমি কি জানি যে বলব!

– ঠিক আছে, তোরা যা বলিস বল, আমাকে নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। আর তোর এত বেশি বেশি যাওয়ারও দরকার নেই ওই লোকের ঘরে।

– আপনি না বললে যাব না।

– যাবি না কেন, যাবি। ঘরের ভেতর কতক্ষণ বন্দি হয়ে থাকবি?

রাতে যখন হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নামে পিয়াস, তানজুর ঘুম ভেঙে যায়। তানজু দেয়ালের ধারে ঘুমাতে পারে না, তার দম বন্ধ হয়ে আসে, তাকে শুতে হয় বাইরের দিকে। বেশি লাভ হবে ভেবে, দরকারের বেশি বড় সাইজের খাট কেনা হয়ে গেছে। এখন  মাথা বা পায়ের দিক দিয়ে খাট থেকে নামার উপায় নেই। তানজুর শরীর ডিঙিয়েই পিয়াসকে নামতে হবে। নামুক, ধীরেসুস্থে নামুক, না হড়হড় করে তাকে নামতে হবে।

ঘুমাতেই পারেনি তানজু। ঘুম না হলে মাথা ধরে। তার মাথা খারাপ হতেও শুরু করবে, ইতোমধ্যে আলামত দেখা গেছে।

চোখ বুজেই বলল তানজু, এতবার তোমার খাট থেকে নেমে বাথরুমে ছুটতে হলে আর পানি খেতে হলে, তোমার শোয়ার দরকার কী, চেয়ার  নিয়ে বাথরুমের কাছে বসে থাকো।

রাগ ঝেড়ে ভালোই একটা ঘুম হয়েছিল মনে হয়। তন্দ্রার ভেতরেই মনে হলো তার বিছানার এক পাশটা ফাঁকা।  হাত এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দেখল, না, বিছানায় নেই পিয়াস।

গেল কোথায় এত রাতে লোকটা? নাকি আগের রাতে অফিস থেকেই ফেরেনি মানুষটা। তাহলে তো ভালো হতো আমলিকে বারান্দা থেকে ডেকে এনে যদি মেঝেতে শুতে বলত। তার সাহসের বেলুন রাতের বেলায় ফুস। একা যদি তাকে কোনো ঘরে ঘুমাতে হয়! তখন মনে পড়ল, রেগেমেগে ঘুমের ঘোরে সে কিছু একটা বলেছিল পিয়াসকে। সে রাগে লোকটা আর বিছানায় ফিরে আসেনি। তার ধারণাই ঠিক। সূর্য ওঠার মনে হয় দেরি নেই, আলো ফুটছে। তানজু দেখল, দেয়াল ঘেঁষে  চেয়ারের ওপর বসে আছে পিয়াস। চেয়ারে বসেই ঘুমাচ্ছিল।

রাগ আরো বাড়ল তানজুর – ঢং! বউয়ের সঙ্গে রাগ করে চেয়ারে বসে আছে।

– এসো, এখানে এসে শোও। রাত তো শেষ, ঘুমাবে কখন?

পিয়াস বলল, আমার অসুবিধা হচ্ছে না, তুমি ঘুমাও।

– ঠিক আছে কাল সকালে তুমি খাটটা বাইরে ফেলে দিয়ে আসবে, কাল থেকে দুজনে দুইটা চেয়ারে ঘুমাবো।

তানজুর ইচ্ছে হচ্ছিল উঠে গিয়ে সে পিয়াসকে নিয়ে আসে, দোষটা তার,  কিন্তু আলসেমি।

বলল, আসো না প্লিজ। সরি বললাম।

পিয়াস এলো, সন্তর্পণে উঠলো। বোঝা যায় তার হাঁটু আবার খোঁচা না দেয় সেজন্য অতি সাবধান।

তানজু টের পেল, বাবুর রাগ কমেনি। বেশ খানিকটা দূরে সরে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে।

তানজু ঘুরলো, বলল, আমাকে জড়িয়ে  ধরো।

পিয়াস শুনল। তানজুর দিকে ঘুরে ওর গায়ের ওপর হাত রাখল।

– ওভাবে না, ভালো করে জড়িয়ে ধরো।

তানজুই বিছানায় পিয়াসের বুকের দিকে এগিয়ে গেল।

লোকটা ভালো করে জড়িয়ে ধরতেও পারে না।

তানজু বলল, রাগ কমেছে?

পিয়াস বলল, আমি রাগ করিনি।

তানজু পিয়াসের নাকটা মুচড়ে দিলো।

 পিয়াস চুপ।

তানজু বলল, আমি একটা লিস্ট করেছি। ঘরের অনেক জিনিস কিনতে হবে। আমার নিজেরও।

– কেন।

– তুমি কত টাকা দিতে পারবে আমি তো জানি না।

– লিস্টটা দেখিয়ো।

– একদিন গাউছিয়ায়  যাব, ওখানে মেয়েদের জিনিসপত্র সস্তায় পাওয়া যায়। আমরা বোনেরা আগে যেতাম।

– যেও, অসুবিধা কী!

– আমি রাস্তাঘাটে একা চলতে পারি না। দেখো না, পাড়ার দোকানে গেলেও আমলিকে নিয়ে যাই।

– ওখানেও আমলিকে নিয়ে যাও।

– ধুর, রাস্তাঘাট আমি ভালো চিনি না।

– নিউমার্কেটে যাওয়ার সময় আমি দূর থেকে দেখেছি মেয়েরা মেয়েরা ভর্তি গাউছিয়ায়, এর ভেতরে ঢোকা যায়?

– আমার সব কাজে তুমি একটা বাহানা তোলো। যেতে হবে না আমার সঙ্গে।

গুম হয়ে পড়ে থাকল তানজু। খাটের দুপাশে চলে গেছে দুজনে।

ঘুমিয়েছে পিয়াস বা ঘুমের ভড়ং। মনে হয় আর কথা বলতে চাইছে না তানজুর সঙ্গে।

হাতের কাছেই তো লোকটা, এক বিছানায়, এক ঘরে। তাও অনেক দিন তো হয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু তানজু ওই লোকটার  কিছুই জানে না। লোকটা কী করে? তার আয়-রোজগার কী? তার স্বপ্ন কী? তানজুর যেমন স্বপ্ন আছে – একটা নিজের সংসার, বাচ্চাকাচ্চা – সংসারটা একটু একটু সাজাচ্ছে। কোনো কাজই সহজ নয়। বোনেরা বোনেরা পুতুল যে খেলত, তাও সহজ নয়। বোনেরা বোনেরা লেগে যেত, চুলাচুলি পর্যন্ত। মা এসে পুতুল-টুতুল ছুড়ে ফেলে দিত‌ আর দুমদুম করে দিত মাইর।  তখন ব্যথা বেশি না লাগলেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদত তানজু। এখন মায়ের জন্য খারাপ লাগছিল। মাকে দেখে না, কথা হয় না। ফোনেও বেশি কথা বলতে চায় না তানজু। মা সংসারের এটা জিজ্ঞেস করবে, ওটা জিজ্ঞেস করবে। মায়ের ধারণা, তানজু সংসারের কাজ কিছু পারবে না। মায়ের কথা মনে পড়ছিল, বাবার কথা মনে পড়ছিল, বোনদের কথা, বাবার বাড়ির কথা। তবে এখন ওটা আর তার ঘরবাড়ি না, সেটার কথা সে মনে রাখতে চায় না।

এখন তানজুর যা তা ওই পাশের লোকটাকে নিয়ে। চোখের সামনে নিয়ে, চোখ বুঁজে তানজু ওই মানুষটাকে বেশি বেশি বুঝতে চায়।

তানজু পিয়াসকে দেখেছিল তার বন্ধু মিশুর বোনের বিয়েতে‌।

মিশু তার বান্ধবীদের নিয়ে স্টেজে উঠেছিল বর-কনের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছিল, আর ছবি উঠছিল। মেয়েরা মেয়েরা কথা বলবে কী কলকল করছিল। মিশু তার দুলাভাইয়ের সঙ্গে বান্ধবীদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল।

মিশুর দুলাভাই বলল, আমার সব ব্যাচেলার বন্ধুরা ওখানে, ওদের ডাকি, দেখি কে কোনটা নেয়?

মেয়েরা হইহই করে উঠলো, এসব কী, আমরা কোরবানির হাটের গরু-খাসি নাকি?

মিশুর দুলাভাইয়ের কাণ্ডকারখানা দেখে মিশুর বোন ফুলে ফুলে হাসছিল। তারপর তারা দুজনে কানাকানি করে কী বলল!

ঠিক ঠিক ফিটফাট কয়েকটা ছেলে উঠে এলো স্টেজে। ছেলেগুলি খুব মজা পাচ্ছিল। চোখ ঘুরিয়ে পাত্রী বাছাই করছিল। তানজুর খুব রাগ হচ্ছিল মিশু আর তার দুলাভাইয়ের ওপর। এত লোকজনের চোখের সামনে এসব কী? বিয়ে-শাদি একটা হাসিঠাট্টার ব্যাপার নাকি?

তখন তানজুর পিয়াসকে দেখে বুকটা ধক্ করে উঠেছিল। এই মুখটা তার এত চেনা মনে হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, স্বপ্নে অনেকবার ওই লোকটার বুকে মাথা রেখে সে ঘুমিয়েছে।

বিয়ের অনুষ্ঠানের পুরো সময়টা তানজুর চোখ খুঁজে বেড়িয়েছে মানুষটাকে। হঠাৎ খেয়াল করে দেখে সে তার বান্ধবীদের থেকে দলছাড়া হয়ে গেছে।

দুয়েকবার কি লোকটা তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল? স্টেজের ওপরেই নামটা শুনে নিয়েছিল, পিয়াস।

একসময় আর পিয়াসকে খুঁজে পেল না তানজু। চলে গেছে। কিছু না বলে, একটু দৃষ্টি বিনিময় না করে লোকটা চলে গেল। খুব অভদ্র আর নিষ্ঠুর তো লোকটা।

সে ভোলে ভুলুক, তানজু তাকে ভুলবে কেন?

মিশুকে দিয়েই তানজু পিয়াসকে খুঁজে বের করেছিল।

ফোন নাম্বার নিয়ে তানজু ফোন করেছিল, বলেছিল, আপনি পিয়াস?

– হ্যাঁ।

– আমি তানজু। আপনার বন্ধুর বিয়েতে দেখা হয়েছিল। আমার বন্ধু মিশুর বোন হলো আপনার বন্ধুর বউ।

পিয়াস হাসলো, মনে আছে, আপনি সুন্দর শাড়ি পরে ঘুরে ঘুরে ফিল্ডিং মারছিলেন, ছেলে দেখছিলেন।

– আপনাকে বলেছে?

– আমি খেয়াল করিনি বুঝি?

– আপনাকে দেখছিলাম।

– কেন?

– একদিন দেখা করেন, বলব।

দেখা হলে তানজু বলেছিল, আমি একটা খুব ভালো মেয়ে। ক্লাস সিক্সে স্কুলে টিচার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বড় হয়ে তুমি কী হবে, তোমার লাইফের এইম কী? আমি বলেছিলাম, একটা ভালো বউ হবো আর বাচ্চার মা। সবাই হাসল। আমি কিন্তু আমার মনের কথাটাই বলেছিলাম। আমাকে বিয়ে করবেন পিয়াস?

তানজু বাড়ি ফিরে বাবা-মাকেও বলেছিল, আমি পিয়াসকে বিয়ে করবো। তোমরা ব্যবস্থা করো।

মা বলেছিল, ভালো করে একটু খোঁজখবর নিই, তোর সঙ্গে মিলবে কি না?

– খোঁজ নিতে হবে না। এখন আর নতুন কী হবে? যা হওয়ার বিয়ের পরে হবে।

বিয়ের মাত্র ক-মাস গেল, ঘরের ভেতর চিকার ছোটাছুটির কথা জানে তানজু, তবে একটা বড়সড় চাকুও কিনে রেখেছে সে।