‘চোখ খুললে যায় না দেখা/ মুদলে পরিষ্কার’ শৈশবের সোনারকাঠি যোগীন্দ্রনাথ সরকার

এ এক আশ্চর্য মানুষের ছড়ায় বাঁধা গল্পজীবন। যার জন্য এই বাংলাদেশের মানুষের শৈশব হয়ে উঠেছিল কল্পনার রঙিন ফানুসে ও আজব মজায় জমজমাট। দেড়শো বছর আগের কথা, এই মানুষটি যোগীন্দ্রনাথ সরকার। বাংলার শিশুসাহিত্যের জনক এই মানুষটি জন্মেছিলেন ১৮৬৬ সালের ২৮ অক্টোবর, আদি ২৪-পরগনার জয়নগর গ্রামে। প্রয়াণ ২৬ জুন ১৯৩৭। যতদিন বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে ততদিন তিনি থাকবেন, তাঁর ছড়া থাকবে। শিশুদের মনের জমিনে চেনা-অচেনার ছন্দে জেগে থাকবেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার। শিশুদের, শিশুর অভিভাবকদেরও মন জয় করে শিশু মনস্তত্ত্বের গভীরে গিয়ে কীভাবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিটি শব্দ ছন্দের দোলায় খেলার ছলে গল্পের মজায় শব্দ, সংখ্যার প্রাথমিক পাঠকে আনন্দময় করা যায়, সেটি যোগীন্দ্রনাথ সরকারকে পড়লে জানা যায়। শিশুপাঠ্য কি সমস্ত দুর্দান্ত মজার মজার ছড়া লিখেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার! এখনো সেই ছড়া পড়লে অবাক হতে হয়। তিনি তাঁর ছড়ার পুষ্পকরথে চাপিয়ে নিয়ে যান অজানা জগতে, যেখানে :

এক যে আছে মজার দেশ/ সবরকমে ভাল/ রাত্তিরেতে বেজায় রোদ/ দিনে চাঁদের আলো !

এই যে মজার দেশ সেখানে আবার আকাশের রং সবুজ আর গাছের পাতার রং নীল। যে রুই-কাতলা মাছেদের জলে থাকার কথা তারা ডাঙায় ঘুরে বেড়ায় আর দূর আকাশের চিল নেমে এসে সাঁতার কাটে জলে। আরো আজব সেই খেয়ালখুশির দেশের কাণ্ডকারখানা, সেখানে বেড়াল দেখে ইঁদুরেরা নয়, ইঁদুর দেখে বেড়ালেরা ভয়ে পালায়। বাস্তবে মানুষ ঘোড়ার পিঠে চেপে যাত্রা করে, যোগীন্দ্রনাথের এই ছড়ার দেশে মানুষ ঘোড়াকে পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

আজকের শিশু কি ঘুড়ি ওড়ায়? আজ ঘুড়ি হয়তো অনেক শিশুই আর ওড়ানোর যায়গা পায় না; কিন্তু বছর কুড়ি আগেও, আমাদের শৈশবেও, রঙিন কাগজে বানানো ঘুড়ি নিয়ে খুব আনন্দ হতো, কীসব নাম ছিল এসব ঘুড়ির! পেটকাটি চাঁদিয়াল এমন মজার সব নাম, আর তাদের লম্বা লম্বা লেজ, বিচিত্র তার আকার। কাচের গুঁড়োতে মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় লাটিমে জড়িয়ে আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে খেলা তখন দারুণ মজার ছিল। তখন যদিও চারদিকে খোলামেলা জায়গা ছিল, মাঠ ছিল। আজ বাড়িঘর, মলসহ আধুনিক জীবনের শখে সেই প্রান্তর উধাও। তা সেই যোগীন্দ্রনাথ সরকারের আজব দেশে এলে এই ঘুড়িরাই শিশুদের সুতোয় বেঁধে আকাশে ওড়াবে। কিছুদিন আগেও টিভিতে একটা ভোজ্যতেলের বিজ্ঞাপন দেখাত, সেই দাদু-নাতির জিলাপি খাওয়া নিয়ে খুনসুটি। আগেকার দিনে আমাদের সমাজে মেলা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন, সেখানে আবার প্রধান আকর্ষণ ছিল আড়াই প্যাঁচে বানানো রসে ডোবানো জিলাপি। যোগীন্দ্রনাথের আজব দেশে যদিও ব্যাপার-স্যাপারটা উলটো! এখানে জিলাপিই খাদক হয়ে খেতে আসবে! তবে শেষমেশ কিন্তু এই আজব দেশের রূপকারই আসল রহস্যের আবরণ খুলে ফেললেন, এই দেশটা : ‘চোখ খুললে যায় না দেখা/ মুদলে পরিষ্কার।’

এটি আসলে চোখ বুজে এক কল্পনার দেশে যাত্রা, যোগীন্দ্রনাথ সরকার সেই মজার দেশে নিয়ে যাওয়ার জাদুকরি লেখক।

ছড়া দিয়েই তো শিশুর প্রথম পাঠ, অক্ষর জানার পর পথ চলার শুরু। গোটা বাংলাদেশে শত-সহস্র ছড়া মায়েদের, ঠাকুমাদের, দিদাদের মুখে-মুখে শিশুর জন্য সংরক্ষিত ও বাহিত হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। ছন্দের পথ ছাড়া শিশুশিক্ষার অন্য পথ নেই, বিকল্প নেই। আজো আমাদের শৈশব এই জগৎটাকে চিনতে পারে, জানতে পারে যোগীন্দ্রনাথের ভাষায় :

অ – অজগরটি আসছে তেড়ে

আ – আমটি আমি খাবো পেড়ে

ই – ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে

ঈ – ঈগল পাখি পাছে ধরে।

যোগীন্দ্রনাথ সরকারের প্রাথমিক পড়াশোনা তাঁর জন্মগ্রামেই। স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য আসেন সেই সময়ের শিক্ষাজগতের কেন্দ্রভূমি কলকাতায়। ভর্তি হন সিটি কলেজে; কিন্তু সে-সময় উচ্চশিক্ষা অনেক ব্যয়বহুল ছিল। যোগীন্দ্রনাথ বা তাঁর পরিবার তাই এই বিপুল খরচ বহন করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছিলেন না। অবশেষে মেধাবী যোগীন্দ্রনাথ এমএ পড়া ছেড়ে সিটি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।

মেধাবী ও কল্পনাপ্রবণ মনের যোগীন্দ্রনাথের জীবনে এই স্কুলশিক্ষকের চাকরি এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক আনে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে পড়াতে গিয়ে তাদের কল্পনার জগতের খোঁজ পেলেন তিনি। জাগতিক বাস্তবতার সীমা ছাড়ানো এই জগৎ। তিনি আরো দেখলেন, শিশুমনের কল্পনার উপযুক্ত লেখাপত্র আমাদের বাংলা ভাষায় খুব কম, অনেকটাই বড়দের-চোখে-দেখা ছোটদের জন্য লেখাপত্র। তিনি তাই শিশুর সেই কল্পনার জগতে পাড়ি দিলেন। একাত্ম হয়ে গেলেন ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে। লিখলেন অনেক ছড়া, ছোট ছোট গল্প। এই কল্পজগতের স্রষ্টাকে নিয়ে আরো আলোচনার আগে সেই ‘কল্পজগৎ’-এর লেখালেখি করা আরেকজনকে নিয়ে কিছু কথা আলোচনা করি।

যোগীন্দ্রনাথের ত্রিশ বছর আগে ইংল্যান্ডে জন্মেছিলেন এমনই এক ‘আজব জগৎ’-এর রূপকার। তাঁর নাম চার্লস লুটুইজ ডজসন, তবে এই নামে তাঁকে চিনতে পারা সহজ নয়। ভারী ভারী অংকের বই তিনি তাঁর এই নামে লিখতেন, আর ছোটদের জন্য যখন লিখতেন তখন ছদ্মনাম নিতেন। এই নামটাই গোটা পৃথিবীতে তাঁর পরিচিতি হয়ে ওঠে, তিনিই এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের লেখক। হ্যাঁ, ইনিই লুইস ক্যারল। একাধারে গণিতজ্ঞ, দার্শনিক, গির্জার যাজক, অসাধারণ ফটোগ্রাফার, আবার পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক। লুইস ক্যারলকে বলা হয় ‘ননসেন্সের জনক’, নিজের কথায় ‘ননসেন্স ইজ রেবেলিয়ন’। কী এই ননসেন্স? যা প্রথাগত ‘সেন্স’ দিয়ে পরিমাপ বা ব্যাখ্যা করা যাবে না, অথচ তোমাকে এক অদ্ভুত জগতে নিয়ে যাবে। কল্পনার সেই জগৎ সুন্দর ও আনন্দময়। তিনি যখন স্কুলের ছাত্র, তখন থেকেই ননসেন্স লেখালেখিতে তাঁর হাতপাকানো শুরু হয়। সেই সময় তাঁরা একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতে শুরু করেন, দ্য রেক্টরি আমব্রেলা। পত্রিকাটি একটি ছাতা, বা ছাতার মতো প্রকাণ্ড একটা গাছ ছিল তাঁদের কাছে। এই কল্পবৃক্ষের ডালে ডালে, পাতায় পাতায় কবিতা, গল্প আর ছবিতে ঝকঝকে আলোর ছটা। এই পত্রিকাতেই আমরা প্রথম দেখতে পাই কাউন্টার নলেজ বা চেয়ারফুলনেস স্পাইত বা এন্যুই, জোকস বা মজার মতো শব্দের ‘ননসেন্স’ বিশ্লেষণ। ব্যক্তিজীবনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্টকে, নির্বাসিত শৈশবকে তিনি এই হিউমার বা মজার আড়ালে লুকিয়ে রাখতেন। ছোটবেলা থেকেই বিরাট সংসারের অনেকটা চাপ তাঁকেই নিতে হতো। বাসায় পাঁচ বোন ও তিনটে ছোট ভাই। বোনেদের মধ্যে মাত্র একজনের বিয়ে হয়েছিল। বাকিটা লুইস ক্যারলের দায়িত্ব ছিল প্রতিপালনের। আসলে খুব একা মানুষ ছিলেন ক্যারল, অবিবাহিত ও বন্ধুহীন। তাঁর লেখার আড়ালেও এই যন্ত্রণাকে খুঁজে পাওয়া যায়।

ক্যারলের বইগুলো আজকের শিশুরাও নিশ্চয়ই পড়েছে বা পড়বে। সেগুলো তাদের কাছে রূপকথাই মনে হবে। আজকের দিনে শিশুরা যেমন ঘরে আটকে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে তেমনি সাত বছরের এক শিশুকন্যা এলিসও একদিন এই ক্লান্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তার বোনের সঙ্গে নদীর ধারে বেড়াতে যায়। সেখানে এক খরগোশের দেখা পায় সে। সেই খরগোশের পিছু নিয়ে মাটিতে করা খরগোশের গর্তে পড়ে যায়। এর অন্যপ্রান্তে এক মজার ভিন্ন জগৎ। এভাবেই সে এক কল্পজগতে হাজির হয়, এই মজার জগৎ নিয়েই ‘মজার জগতে এলিস’। ফ্যান্টাসি বা ননসেন্সের মিশেলে এ এক অনবদ্য সৃষ্টি। ক্যারল এই মজার গল্পটি প্রথম শুনিয়েছিলেন আজ থেকে ১৫৬ বছর আগে। কয়েকজন মিলে বোটে করে অক্সফোর্ড থেকে গ্ল­াসগো যাওয়ার পথে ক্যারল বন্ধুদের এলিসের এই মজার কাহিনি শোনান। সেদিন ছিল ৪ জুলাই, এর পর থেকে এই দিনটিকে ‘গোল্ডেন আফটারনুন’ বা ‘সোনালি মধ্যাহ্ন’ বলা হয়। এই প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প আছে। একদিন ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়ার কাছে একটি বইয়ের পার্সেল আসে, যেটি ছিল একান্তই ব্যক্তিগত পার্সেল। ভিক্টোরিয়া সেই প্যাকেট খুলে দেখেন তাতে একটি গুরুগম্ভীর অংকের তত্ত্বের বই – অ্যান এলিমেন্তারি ট্রিলজি অন ডিটারমিন্যান্টস। লেখক চার্লস লুটুইজ ডজসন। বইটি মহারানিকেই উৎসর্গ করা হয়েছে। তিনি তো অবাক! পরে জানা গেল, লুইস ক্যারলের এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড পড়ে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন মহারানি যে, নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই লেখকের এরপর যে বই-ই প্রকাশিত হবে তা যেন তাঁকে পাঠানো হয়! ক্যারলই তো আসলে ছিলেন গণিতজ্ঞ ডজসন! এহেন গণিতজ্ঞের লেখা ছোটদের মজার জগতের গল্প এলিস গোটা পৃথিবীর ৯৮টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এখানে ক্যারলের সাহিত্য নিয়ে আর কিছু লিখছি না, আমাদের মূল আলোচ্য যোগীন্দ্রনাথ। তবে আরেকজন ননসেন্স রাইমের স্রষ্টা আমাদের এই বিশ্বের শিশুদের মন জয় করেছিলেন, তিনি এডওয়ার্ড লিয়ার। এখানে তাঁর কবিতার একটা উদাহরণ দিচ্ছি :

N for Newt :

ডেপুটি নবাব এক গোধিকার ছানা

দু-বেলা তাহার চাই বাদশাহি খানা।

 রাজভোগ দানাদার

বড় প্রিয় খানা তার

আর তার প্রিয় বটে নাচা আর গানা।

অথবা ÔO for OstrichÕ

এক ছিল উটপাখি সাহারায়

কেন সে ব্যস্ত সদা পাহারায়।

কেন পরে গামবুট

কেন বলে সব ঝুট

এই সব ঠিকমতো বোঝা দায়।

খোলা জানালা থেকে কিছুক্ষণ বাইরেটা দেখে এলাম আমরা, যেখানে ইংরেজি ভাষায় এমনই কল্পজগতের কথা ভাবছিলেন কবিরা, লিখছিলেন সেই আজব জগতের কল্পচিত্র। আবার আমাদের দেশের মাটিতে ফিরে আসি, যোগীন্দ্রনাথের জগতে ফিরে আসি। আমাদের অনেকেই তাঁর ‘মজার মুল্লুক’ কবিতাটি পড়েছি। আমাদের ঠাকুরদা-দিদিমাদের অনেকেরই ছোটবেলার প্রিয় ছিল খুকুমণির ছড়া। এই বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও লেখক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। তিনি লিখেছিলেন যে, তাঁকে এই ভূমিকা লেখার জন্য আহ্বান করায় ‘আহ্লাদের ও কৃতজ্ঞতার সহিত আমি এই ভার গ্রহণ করি। আহ্লাদের কারণ যে, আমি এই রূপ ছড়া-সংগ্রহের অভাব অনুভব করিতেছিলাম; কৃতজ্ঞতার কারণ, প্রকাশক মহাশয় সেই অভাব এত সত্বর পূর্ণ করিতেছেন। … শ্রীযুত যোগীন্দ্রনাথ সরকার মহাশয় সেই অভাব দূর করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছেন; তিনিই বাঙ্গালীর মধ্যে এই ক্ষেত্রে সর্ব্বপ্রথম পথপ্রদর্শক।’ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এ-কথা লিখেছিলেন সেই ১৩০৬ বঙ্গাব্দে। এই যুক্তিশাসিত বিশ্বের সীমারেখার বাইরে শিশুমনের যে-কল্পনার জগৎ সে-জগতের কথা তিনি বলেছেন সুন্দর করে, ‘প্রকৃতির কারখানা হইতে নির্ম্মিত হইয়া মানব-শিশু সদ্যঃ সংসারক্ষেত্রে প্রবেশ লাভ করিয়াছে, কিন্তু এখনও প্রকৃতির শাসন, নিয়মের শাসন তাহাকে বন্ধনে আবদ্ধ করিতে পারে নাই; যে নিয়মের প্রভাবে সেই কারখানা পরিচালিত হইতেছে, সেই নিয়মের অস্তিত্ত্বে তাহার একেবারে ভ্রুক্ষেপ মাত্র নাই। তাহার স্বাধীন মুক্ত জীবনের নিকট প্রকৃতির মূর্ত্তিও সম্পূর্ণভাবে বিশৃঙ্খল ও সংযম রহিত। তাহার নিকট জগতের খানিকটা প্রাকৃত, খানিকটা অতিপ্রাকৃত নহে, সমস্তটাই অতিপ্রাকৃত।’ এহেন ‘অতিপ্রাকৃত’ অর্থাৎ আমাদের চেনা বাস্তবজগতের গণ্ডি থেকে মুক্ত এই কল্পনার সীমাহীন জগতের যে-পরিচয় যোগীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর ছড়ায় দিয়েছেন তার স্বাদ চির অমøান। সেই কল্পজগতের বর্ণানায় তাই, ‘ওরে ও নটে শাক,/ তোর দেশে কি এই বিচার -/ ইঁদুর বেড়ালে ধ’রে খায়!/ গুন গো মা ভগবতী,/ ছাগলে গিলছে হাতী,/ পুঁটিমাছ তানপুরা বাজায়!’

আমাদের বাংলা ভাষা শিক্ষার শুরু হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় দিয়ে। প্রায় এই সময়েই যোগীন্দ্রনাথ সরকার এই ছড়া লিখেছিলেন। একশ বছরেরও অনেক আগে লেখা এই ছড়াগুলো ও মনমাতানো ছবিতে ভরা এ-বইগুলো মায়ের মুখের ভাষার মতোই মনোরমভাবে আমাদের শিক্ষা দিয়ে চলেছে।

হাসিখুশির ‘অ – অজগর আসছে তেড়ে’/ আ – আমটি আমি খাবো পেড়ে’ ইত্যাদি পড়েই অক্ষর শেখা, আমাদের শৈশবের শিক্ষা শুরু হয়। গোটা জীবনে আমরা কেউ আর এই ছড়াগুলো ভুলতে পারি না। অথবা সেই যে হারাধনের দশটি ছেলের একে একে হারিয়ে যাওয়ার দুঃখ! যা আমাদের অজান্তেই আমাদের অংকের প্রাথমিক পাঠ শিখিয়ে দেয়। আবার ‘মামারবাড়ি’র মাধ্যমে আমরা শিখে ফেলি যোগ অংক। তাঁর লেখা একটি বেশ বড় ছড়া : ‘ষোল কৈ ষলুয়ে,/ দুটো গেল তার পালিয়ে।/ তবুও ত থাকে চৌদ্দ?/ দুটো নিয়েছে বেড়াল বৈদ্য।/ তবুও ত থাকে বার?/ হারিয়ে গেল দুটো আরো।/ তবুও ত থাকে দশ?/ দুটো দিয়ে কিনেছি রস।/ তবুও ত থাকে আট?/ … জলে গেলো দুটো তার।/ তবুও ত থাকে দুই/ ঘরে আছে রোগা ছেলে,/ তার জন্যে একটা থুই।/ তবুও ত থাকে এক?/ চক্ষু খেয়ে পাতের দিকে চেয়ে দেখ!/ আমি যাই মানুষের ঝি,/ তাই একে একে হিসাব দি!/ তুই যদি হ’স ভালো মানুষের পো,/ তবে, কাঁটাখান খেয়ে, মাছখান/ আমার জন্যে থো!’ (‘ষোল কৈ’) এই ছড়াতে শুধু অংকের জ্ঞান হচ্ছে তাই নয়, মানুষের প্রতি ভালোবাসাও জন্ম নিচ্ছে। অথবা ‘তারার কথা’তে দেখি সেই অংক জানানোর কৌশল – ‘এক তারা বন্ধন, দুই তারা বন্ধন,/ তারারা কয় ভাই? তারারা সাত ভাই;/ বেঁধে ফেলি বড় ভাই।/ চন্দ্র গেলেন সূর্য্যরে বাড়ি,/ বসতে দিলেন চৌকি-পিঁড়ি/ ব’সব না আর পিঁড়িতে;/ মানুষ মরে ভাতে,/ গরু মরে ঘাসে,/ তাই, এসেছি তোমার বাসে।/ আমার কথাটি যেন থাকে,/ কালকের রৌদ্রে যেন বসুমতী ফাটে!’ এ শুধু ছড়া থাকে না, সেই সময়ের প্রতিফলনও ঘটায়। যোগীন্দ্রনাথের অনেক ছড়া আমাদের মতো আজকের শিশুরাও পড়ছে, যেমন Ñ

খোকন খোকন ডাক পাড়ি

খোকন মোদের কার বাড়ি?

আয় রে খোকন ঘরে আয়,

দুধ মাখা ভাত কাকে খায়।

অথবা,

এক যে রাজা, সে খায় খাজা,/ তার যে রাণী সে খায় ফেনী,/ তার যে বেতা, সে খায় পাঁঠা,/ তার যে বৌ, সে খায় ঘি,/ তার যে চাকর, সে খায় পাঁপড়/ আর দেয় ঘুম।/ তালগাছ পড়ে-দুম!

ছড়ার পাশাপাশি অনেক গদ্যও লিখেছেন তিনি। আমাদের সমাজের কাঠামো রক্ষা করে যে জীববৈচিত্র্য, যে ‘ইকো সিস্টেম’ বা খাদ্যচক্র তা নিয়েও একটি দুর্দান্ত গল্প লিখেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ। সেখানে দেখি, এক ছিল কুমির। তার বাপের শ্রাদ্ধ। নিমন্ত্রিত হয়ে খেতে এসেছে ব্যাঙ, ইঁদুর, বেড়াল, শেয়াল, চিতা, বাঘ আর সিংহ। কিন্তু পুরুতমশাই বানরের আর মন্ত্রপাঠ শেষ হয় না। এদিকে খিদের জ্বালায় অস্থির পশুপাখিরা। খাবারেরও কোনো আয়োজন দেখা যাচ্ছে না। খিদের জ্বালায় থাকতে না পেরে ইঁদুর ব্যাঙকে খেয়ে ফেলল। তাই দেখে রেগেমেগে ইঁদুরকে খেয়ে নিল বেড়াল। দেখতে দেখতে বেড়ালকে শেয়াল, শেয়ালকে চিতা, চিতাকে বাঘ আর বাঘকে সিংহ খেয়ে ফেলল। বাঘকে সিংহ খেতে পারবে কি না সেই তর্কে গিয়ে কাজ নেই, এসবই তো খেয়ালখুুশির জগতের গল্প ! কিন্তু এই দেখে কুমির তো মহাখুশি, বিনা আয়োজনে সবাইকে সন্তুষ্ট করা গেছে! সে তখন তার বিশাল হাঁ-এর মধ্যে সিংহকে গিলে ফেলে নিজের খিদা মেটাল! বানরটাই বেঁচে গেল, সে তো খেতে নয়, মন্ত্র পড়তে এসেছিল!

এমনসব মজা নিয়ে, শিক্ষার ভাষা নিয়ে একের পর এক ছড়া লিখে চললেন যোগীন্দ্রনাথ, যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল স্কুলের ছোট ছোট শিশুকে মজায় মজায় মাতিয়ে রাখা ও কিছুটা শিক্ষা দেওয়া। প্রকাশিত হলো একে একে হাসি ও খেলা, খুকুমণির ছড়া, ছড়া ও পড়া, রাঙা ছবি, হাসিরাশি, হিজিবিজি প্রভৃতি বাংলা ভাষার অমূল্য গ্রন্থ। অফুরন্ত কল্পনাশক্তি ও শিশুদের প্রতি অসীম ভালোবাসায় তিনি প্রচুর লিখেছিলেন। সেই সময় নানা কাগজে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর লেখায় ছিল অনাবিল আনন্দ, ছিল না ভৌতিক বা দস্যু-দানবের ভীতি-জাগানো উপস্থিতি। আমাদের চারপাশের চেনাজানা জগতের পুষি, ভুলো, বাঘার মতো জীবজন্তু, এদের আজব সব কাণ্ডকারখানা। যেখানে দুই ক্ষুধার্ত সাপ দুজনেই দুজনকে গিলে খাচ্ছে আর শেষ পর্যন্ত দুজনেই ‘ভ্যানিশ’! আবার ‘ইকড়ি-মিকড়ি চাম চিকড়ি, চামে কাটে মজুমদার, দামোদরের ছুতারের পো, হিঙুল গাছে বেঁধে থো’-এর মতো ছড়াও লিখেছেন, যেখানে সমাজের যন্ত্রণার কথাও লুকিয়ে থাকে।

বাংলা ভাষায় ননসেন্স বা আজগুবি, খেয়ালখুশির ছড়া-কবিতা-গল্প লিখে বিখ্যাত আরেকজন আবোল তাবোল-এর সুকুমার রায়। তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। কিন্তু এই ব্যাপারে পথিকৃৎ অবশ্যই যোগীন্দ্রনাথ সরকার। ঠাকুরমা/ দিদার আদরের মতো আরাম মেলে তাঁর ছড়া পড়লে। ‘ঘুমিয়ে যখন থাকি,/ মায়ের চুমো ফুটিয়ে তোলে/ আমার দুটি আঁখি’। আবার তাঁর লেখায় যে খেয়ালখুশিমতো ভাবনার জন্ম দেয় তাও এক অনাবিল আনন্দের জগতে নিয়ে যায়, যেখানে গুরুমশাই দাশুর কান ধরে টেনে টেনে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা করে দেন। এখানেই কিন্তু থামেননি যোগীন্দ্রনাথ, দাশুর সেই সুবিধার কথা বলেছেন যেখানে এই লম্বা কানটা সে বর্ষাকালে ছাতার কাজে লাগাচ্ছে, শীতকালে লেপের মতো, গরমকালে হাতপাখার মতো ব্যবহার করছে! ভাবা যায়? মজার আরো অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে তাঁর লেখায়, যেমন গদাই, যে বোঁচা নাক দেখলেই হাঁসে ব্যঙ্গ করত। তার নাক এতোটাই লম্বা হয়ে গেল যে নাকের ডগায় মাছি বসলে সেই মাছি গদার হাতের নাগালের বাইরে থাকত। সেই নাকের গুঁতোর ভয়ে লোকজন দূরে দূরে থাকত!

যোগীন্দ্রনাথ সরকারের কথা আলোচনা করাই এই নিবন্ধের লক্ষ্য। কিন্তু আর দুজনের কথা না বললে খুব অন্যায় হবে, একজন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, অন্যজন সেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। নাতি সত্যজিতের বিখ্যাত ফিল্ম সোনার কেল্লার লেখক দাদু উপেন্দ্রকিশোর। আমাদের শিশুকালেও তাঁর টুনটুনির বই আমাদের অনেকটা দখল করে ছিল। একশ বছর আগে লেখা এ-বই আজকের শিশুমনকেও আজো অনাবিল আনন্দ দেবে। শিশুদের মতো করে বই লিখে তা প্রকাশের জন্য তিনি প্রেস খুলেছিলেন, ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’। টুনটুনির বইয়ের প্রধান চরিত্র শেয়াল, বাঘ, বিড়াল, কুমির, টুনটুনি আর চড়াই পাখি; আর আছে কিছু মানুষের চরিত্র। এ-বই নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘সন্ধ্যার সময় শিশুরা যখন আহার না করিয়াই ঘুমাইয়া পড়িতে চাহে, তখন পূর্ববংগের কোনো কোনো স্থানের স্নেহরূপিণী মহিলাগণ এই সকল গল্পগুলি বলিয়া তাহাদের জাগাইয়া রাখেন। এই সকল শিশু বড় হইয়া এই গল্পগুলির মিষ্টতা ভুলিতে পারে না। আশা করি আমার সুকুমার পাঠক-পাঠিকার নিকটেও এগুলি মিষ্টি লাগবে।’ এই মিষ্টি লাগাটাই টুনটুনির বইয়ের মূল আকর্ষণ। ছোট্ট টুনটুনির প্রখর বুদ্ধির কাছে বারংবার পরাজিত হচ্ছে প্রবল ক্ষমতাশালী রাজা বা বিড়াল, নাপিত। তিনি আসলে হয়তো এই কথাই বলতে চেয়েছেন এই গল্পের আড়ালে যে, ক্ষমতা বা দেহের বল থেকেও শক্তিশালী বুদ্ধির বল। ছোটদের ক্ষুদ্র বলে অবহেলা নয়, তারাও বুদ্ধিতে পরাস্ত করতে পারে ক্ষমতার বা বলের দম্ভকে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে বলতে পারে :

নাক কাটা রাজা রে, দেখ কেমন মজা রে।

ধূর্ত নাপিতকে জব্দ করে সে গাইতে থাকবে ‘টুন-টুনাটুন টুন টুন! ধেই ধেই!’ তখন টুনটুনির এই আনন্দের ভাগীদার শিশুরাও হয়ে যাবে। আবার অন্য গল্পে দেখা যাবে যে, যে-ছাগলকে আমরা বরাবর বোকা ভাবি সে-ই কি বুদ্ধি রাখতে পারে! উপেন্দ্রকিশোরের ‘নরহরি দাস’ এমন বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে যে বাঘ ও ধূর্ত শেয়াল পুরোপুরি জব্দ তার কাছে। গুরুগম্ভীরভাবে সে বলে, ‘সিঙ্ঘের মামা নরহরি দাস/ পঞ্চাশ বাঘে মোর এক-এক গ্রাস।’ অথবা ‘দূর হতভাগা! তোকে দিলুম দশ বাঘের কড়ি,/ এক বাঘ নিয়ে এলি লেজে দিয়ে দড়ি!’ এভাবেই দুর্বলের বুদ্ধি ও কৌশলের জয় দেখা যায় তাঁর গল্পে। যে-পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন আমাদের প্রিয় যোগীন্দ্রনাথ সরকার। একবার আমাদের এই মহতী রত্নরাজির পাঠ নিয়ে দেখুক আজকের শিশু, অদ্ভুত এক জগতের, সেই খেয়ালখুশির নির্মল মজা পাবে, বড়দেরও আরাম দেবে সেই সমস্ত মজার কথা, মজার জগৎ।