জলকাহিনি

হরিশংকর জলদাস
আনোয়ারা সৈয়দ হক দিদি একদা আমার ওপর রুষ্ট হয়েছিলেন। আমার একটা বইয়ের নাম নিয়ে। বইয়ের নাম – লুচ্চা। ২০১২ সালের জানুয়ারির প্রথম দিক। শুদ্ধস্বরের আজিজ সুপার মার্কেটের অফিস। কী এক কারণে আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে ওই সময় ঢাকা যেতে হয়েছিল। ইচ্ছে জাগল – সস্ত্রীক টুটুলভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার। উদ্দেশ্য দুটি – গত বছরের রয়্যালটি সংগ্রহ করা এবং সামনের বইমেলায় আমার প্রকাশিতব্য গল্পের বইটির হালহকিকত জানা। ফোনেই টুটুলভাইয়ের কাছ থেকে সময়টা জেনে নিয়েছিলাম।
সেদিন দুপুর বারোটা-সাড়ে বারোটা হবে। শুদ্ধস্বরের ছোট্ট অফিসটির দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালাম। বিস্ময়ে। দেখলাম – টুটুলভাইয়ের টেবিলের পাশ ঘেঁষে বসে আছেন হকদিদি। এর আগে দূর থেকে নানা বছরের বইমেলায় বারকয়েক দেখেছি। এত কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কম আলোর কক্ষটিতে সুরভিত আলো ছড়িয়ে বসে আছেন তিনি। আমার স্ত্রী আগে কখনো দেখেনি হকদিদিকে। আমার কানঘেঁষে চাপা স্বরে সে বলেই ফেলল – এ-ত রূপসী! সাধারণত কোনো সুন্দরী নারী সহজে অন্য নারীর রূপের প্রশংসা করে না। স্ত্রীর কথা শুনে সেই দুপুরে মৃদু একটু হেসেছিলাম।
ওই দুপুরে টুটুলভাই-ই হকদিদির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। দু-একটা কথা বিনিময়ের পর হকদিদি জিজ্ঞেস করলেন, ‘শুদ্ধস্বর থেকে আপনার কী বই বেরোচ্ছে?’ আমি বললাম, ‘একটা গল্পের বই…।’
আমার মুখের কথা অনেকটা কেড়ে নিয়েই টুটুলভাই আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপার একটি উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে আমার এখান থেকে। ‘ব্যবহৃতা’ নামে।’ তারপর হকদিদির দিকে মুখ ফিরিয়েছিলেন টুটুলভাই। বলেছিলেন, ‘হরিশংকর দাদার একটি গল্পের বই বেরোচ্ছে শুদ্ধস্বর থেকে, ‘লুচ্চা’ নামে।’
নামটা শুনে চোখ কুঁচকেছিলেন আনোয়ারাদি। বলেছিলেন, লুচ্চা! আমার দিকে ফিরে বলেছিলেন, ‘এ কী নাম! আমি এ-নাম মেনে নিতে পারলাম না।’ স্ত্রীর সামনে কী আর বলি! চুপ করেই থাকলাম আমি।
একটু পরে টুটুলভাইয়ের সঙ্গে আলাপচারিতা সেরে উঠে পড়েছিলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক।
হকদিদির অভিব্যক্তি দেখে এবং কথা শুনে বেশটুকু যে বিচলিত হইনি, তা নয়; কিন্তু সেই দুপুরে অনেকটা অপরাধী ভঙ্গিতে দিদির দিকে তাকিয়ে থেকেছিলাম।
এর পরের ঘটনা ২০১৪-এর ডিসেম্বরের শেষ শুক্রবার। ওইদিন বাংলা একাডেমি চত্বরে বাংলা একাডেমির সদস্য ও ফেলোদের মিলনমেলা বসেছিল। বাংলাদেশের নানা জেলা থেকে সাহিত্যিকরা আসেন ওই অনুষ্ঠানে। একে অপরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়,
কথাবার্তা হয়। ওই সকালে আনোয়ারা দিদির সঙ্গে আমার আবার দেখা। বর্ধমান হাউসের দক্ষিণপাশের চত্বরে। চা-বিরতি চলছিল তখন। কতজন যে উপস্থিত সেই চত্বরে। চেনা-অচেনা কত মুখ! দূর থেকে আনোয়ারাদিকে দেখলাম। ইচ্ছে জাগল তাঁর দিকে এগিয়ে যাওয়ার। উদ্দেশ্য – আমার প্রতি তাঁর ক্ষোভটা কমেছে কিনা, তা পরখ করা। শুভেচ্ছা বিনিময়ের ব্যাপারটি তো আছেই।
নমস্কার বলার পর শুভেচ্ছা জানালেন তিনি। দু-একটা কথাও বললেন। সেই কথাগুলোর একটি হলো – লুচ্চা প্রসঙ্গ। দেখলাম – লুচ্চাবিষয়ক ক্ষোভ তাঁর তখনো অটুট রয়ে গেছে। অন্যদিকে সরে গেলেন আনোয়ারাদি। মনটা বিষণœ হয়ে গেল বড়। শান্তিরঞ্জন দাদা সান্ত¡না দিলেন, ‘ও কিছু না। মন খারাপ করো না। ওই দেখো – সৈয়দ শামসুল হক দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কাছে যাও। মন ভালো হয়ে যাবে।’
আমি চকিতে শান্তিদার দিকে তাকালাম। আর কোনো বড় মন খারাপে জড়াব না তো! শান্তিদা আমার শুভানুধ্যায়ী। কুমিল্লায় বাড়ি। একসময় একসঙ্গে পড়েছি, সরকারি কলেজে। তিনি তো আমাকে আর বিপদে ঠেলে দেবেন না।
সৈয়দ শামসুল হকের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। অনেকটা একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। চত্বরে সমবেত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে কী যেন গভীরভাবে ভাবছিলেন।
নমস্কার জানানোর সঙ্গে-সঙ্গে তিনি আমার দিকে চোখ ফেরালেন। এই-ই প্রথম পরাণের গহীন ভিতরের রচয়িতার এত কাছে দাঁড়ানো, চোখে চোখ রাখা। নাম বললাম আমার। চোখের কাঠিন্য সরে গেল দ্রুত। প্রশান্ত হাসলেন। বাঁ-হাতটা প্রসারিত করে আমার ডান পাশের বুকের ওপর রাখলেন। মৃদু টোকা দিয়ে বললেন, ‘জলদাস, আমি আপনার লেখা পড়ি। মনোযোগ দিয়েই পড়ি।’ সেই মুহূর্তে লুচ্চা-সংক্রান্ত বেদনার অনেকটা লাঘব হয়ে গিয়েছিল।
সৈয়দ শামসুল হক জলদাসের জলগদ্য পড়বেনই তো! তিনিও যে জলের মানুষ। আমার সাগর আছে, বঙ্গসাগর। ওঁর আছে নদী, আধকোশা। গোটাটা জীবন পরোক্ষে আর প্রত্যক্ষে জলেরই গান গেয়ে গেলেন সৈয়দ হক। ওই যে জলেশ্বরী, যাকে তিনি বারবার রূপায়িত করেছেন তাঁর গদ্যে, পদ্যে, তাও তো জলেরই আধার; নামই তো সাক্ষ্য দেয়। আর আধকোশা তো তাঁর নিজেরই নদী, জন্মভূমি কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবহমান।
ওই আধকোশা দিয়েই, ময়লা জামায় ফেরেশতারা উপন্যাসটির শুরু – ‘নদীর নাম আধকোশা’।
প্রত্যেক সাহিত্যিকের নিজস্ব এক-একটা নদী আছে। রবীন্দ্রনাথের পদ্মা, জীবনানন্দের ধানসিড়ি, মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ, অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস, সমরেশ বসুর গঙ্গা। তেমনি করে সৈয়দ শামসুল হকের আধকোশা। বারো বছর বয়সে নিজ বাসভূমি কুড়িগ্রামের জনপদটি ছেড়ে এসেছিলেন তিনি। পরবর্তী আটষট্টি বছরের জীবন ঢাকা-লন্ডনের। মাঝে মাঝে কুড়িগ্রাম গেছেন তিনি, অতিথির মতো – দু-চার-দশদিনের জন্য, স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নয়। এই আটষট্টি বছরে কুড়িগ্রামের অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেছে তাঁর। অনেক বস্তু-অনুষঙ্গকে হয়তো তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। কিন্তু একটি তটিনী আমৃত্যু তাঁর স্মৃতির মধ্যে জ্বলজ্বল করেছে, চিরপ্রবহমান থেকে গেছে। তা ওই আধকোশা নামের জলের আধারটি।
‘আধ’ বুঝলাম, অর্ধেক। ‘কোশা’ মানে কী? ‘কোশা’ আর ‘কোষা’ সমার্থক। আসল অর্থ হিন্দুদের পুজোর কাজে ব্যবহৃত তামার তৈরি
নৌকাকৃতি জলপাত্রবিশেষ। ক্ষুদ্র নৌকাকেও কোশা বলে। কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছেন – ‘শ্রীপুর নদীতে কোষা ভাসাইয়া চলেছেন ঈসা খান।’ ভারতচন্দ্র লিখেছেন – ‘কোশা চড়ি বেড়াবে উজান আর ভাটি।’ ‘আধকোশা’ দিয়ে যতই ক্ষুদ্র জলাধার বা অতিক্ষুদ্র নৌকা বোঝানো হোক না কেন, সৈয়দ শামসুল হকের গোটা জীবন জুড়েই ছিল আধকোশা নদীটি।
ময়লা জামায় ফেরেশতারা উপন্যাসের আদি ভাগটা যেন তিলোত্তমা আর সুন্দ-উপসুন্দ কাহিনির আধুনিক রূপায়ণ। পৌরাণিক তিলোত্তমা এই উপন্যাসে চম্পা। আর সুন্দ-উপসুন্দ মনিরদ্দি, জামাল, শমসের এবং আমি-তে রূপান্তরিত হয়েছে। তিলোত্তমা – সুন্দ-উপসুন্দবিষয়ক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল কোনো এক অরণ্যমধ্যে। আর চম্পাকে নিয়ে লড়াইটা সংঘটনের স্থান হিসেবে আধকোশা নদীপাড়কে সৈয়দ শামসুল হক বেছে নিয়েছেন।
তিলোত্তমাবিষয়ক কাহিনিটি এরকম। দৈত্যরাজ নিকুম্ভ। তার দুজন পুত্র – সুন্দ আর উপসুন্দ। কালে-কালে দুজনই বলশালী হয়ে উঠল। অমরত্ব অভিলাষী হলো তারা। ভাবল – অমরত্ব লাভ করতে পারলেই সুর-অসুরকে ক্রীতদাসে পরিণত করা যাবে, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালকে পদতলে আনা যাবে। অরণ্যঘেরা টিলামতন জায়গায় কঠোর তপস্যা শুরু করে দুই সহোদর। বরদাতা ব্রহ্মা। ব্রহ্মা কিন্তু সুন্দ-উপসুন্দের বাসনা-পূরণে সম্মত নন। কিন্তু দুই সহোদর নাছোড়। শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা এই বর দিতে সম্মত হলেন যে, স্থাবর-জঙ্গম কোনো প্রাণী এদের বধ করতে পারবে না। যদি কখনো এদের মৃত্যু হয়, তাহলে পরস্পরের হাতেই মৃত্যু হবে। ভীষণ উল্লসিত হলো দুই ভাই। এরা পরস্পরকে মারবে কেন? দুই ভাইয়ের উদ্দেশ্য-অভিমত-বাসনা যে এক এবং অভিন্ন। কিন্তু তিলোত্তমার কারণে অভিন্ন-হৃদয়ের দুই ভাই একদিন হানাহানিতে লিপ্ত হলো।
ব্রহ্মার কাছ থেকে বর পাওয়ার পর সুন্দ-উপসুন্দ দেবতাপীড়নে রত হলো। দেবতা-ঋষি-যক্ষ একত্র হয়ে ব্রহ্মাকে বললেন – রক্ষা করো প্রভু, প্রতাপী পীড়ক সুন্দ-উপসুন্দের কবল থেকে রক্ষা করো।
ব্রহ্মা স্বর্গের কারিগর বিশ্বকর্মাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন – এমন একজন রমণীর সৃষ্টি করো, যাকে দেখলে মুমূর্ষু পুরুষ খাটিয়া ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে, যার দর্শনে বাহাত্তুরে থুত্থুড়ে বুড়ো নিজের মধ্যে তিরিশ বছরের যুবকের যৌবনতেজ অনুভব করবে। বিশ্বকর্মা ত্রিজগতের সর্বোত্তম জিনিস থেকে তিল-তিল রূপ ও লাবণ্য সংগ্রহ করলেন এবং তিল-তিল সৌন্দর্যের সম্মিলনে নির্মাণ করলেন তিলোত্তমাকে। তিলোত্তমাকে দেখে সুন্দ-উপসুন্দ কি, স্বয়ং ব্রহ্মার মাথা ঘুরে গেল। নিজেকে সংযত করে ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে আদেশ দিলেন – সুন্দ-উপসুন্দকে প্রলুব্ধ করো।
ব্রহ্মার নির্দেশে তিলোত্তমা সুন্দ-উপসুন্দের সামনে গিয়ে নৃত্য আরম্ভ করল। দুই সহোদরের রক্তকণিকা নেচে উঠল। অঘোর কামে দুজন জর্জরিত হতে থাকল। দখলিস্বত্ব দুজনের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল। এ বলে – তিলোত্তমা আমার, ও বলে – উত্তমা আমার। কথা-কাটাকাটির পর দুই ভাইয়ের হাতে অস্ত্র উঠল এবং পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হলো। কামের বাড়া কোনো শক্তি নেই, শত্রু নেই। মানুষের প্রথম প্রতাপী শত্রু যে কাম। তিলোত্তমার রূপে মুগ্ধ কামান্ধ দুই সহোদর পরস্পরকে হত্যা করল। কামবোধ ভ্রাতৃত্বহরণকারী। তাই সুন্দ-উপসুন্দের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠল।
শমসের, মনিরদ্দিরা যুবক এবং শক্তিমান। অকাজের কাজি। টাকার লোভে অনেক অকাজ-কুকাজ করে। চম্পার বাপের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছে এই যুবকরা, চম্পার রাজাকার-মনস্ক স্বামীর হাত থেকে চম্পাকে উদ্ধার করে চম্পার বাপের বাড়িতে পৌঁছে দেবে বলে। এ ব্যাপারে যুবকরা অনেকটা সফলও হয়। রাতের আঁধারে স্বামীর বাড়ি থেকে লুণ্ঠন করে কাঁধে নিয়ে আধকোশা নদীর পাড়ে উপস্থিত হয় শমসের-মনিরদ্দিরা। চম্পা ছাড়া পেয়ে আধকোশাতে ঝাঁপ দেয় এবং সাঁতরে নদীর ওপারে ওঠে। যুবকরা তাকে অনুসরণ করে সাঁতরে নদীর বেলাভূমিতে পৌঁছায়। ভিজে কাপড়ের চম্পার শরীর দেখে, স্তনের পুরুষ্ট গড়ন দেখে শমসেররা উন্মাতাল হয়ে ওঠে। কর্তব্য ভোলে তারা, তাদের মধ্যকার সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। সহযোগী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। শমসের দলনেতা, সে সবার আগে চম্পার শরীরে থাবা বসাতে চায়, মনিরদ্দি বাধা দেয়। বলে, ‘একায় তুই নিবু? হামরা কি বানের পানিতে ভাসি আসিছি?’
শমসের বলে, ‘আগে মুঁই।’
মনিরদ্দি বলে, ‘না। আগে মুঁই।’
দুজনে চম্পার দুই হাত টেনে ধরে। এখানে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে – সুন্দ-উপসুন্দ, তিলোত্তমা। ‘আগে মুঁই, না, আগে মুঁই।’ – এ যেন সুন্দ-উপসুন্দরই সংলাপ। একজন রমণীকে দখল করার যুদ্ধ-সূচনাকারী সংলাপ। কিন্তু ময়লা জামায় ফেরেশতারা উপন্যাসের পরিণতি তিলোত্তমা-কাহিনির মতন নয়। সৈয়দ হক উপন্যাসের মাঝামাঝিতে এসে কাহিনিতে একটা মোচড় লাগান। সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনিতে তিলোত্তমা নিষ্ক্রিয় থেকেছে। দুই ভাইয়ের আত্মঘাতী লড়াইটি সে দূরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছে। হ্যাঁ, উপভোগই করেছে সে। কারণ তার উদ্দেশ্য তো ছিল দুই সহোদরের নিধন। ঈপ্সিত নিধনপ্রক্রিয়া তো উপভোগ্যই হয়।
কিন্তু সৈয়দ হকের উপন্যাসটিতে চম্পা নিষ্ক্রিয় থাকেনি বা শমসের-মনিরদ্দির দ্বন্দ্বকে উপভোগও করেনি। বরং যুক্তি দিয়ে এদের রিরংসা বিযুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে। যুক্তির কাছে কামপ্রবৃত্তি হার মেনেছে এই উপন্যাসে।
দেওয়ান পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে জামাল-মনিরদ্দিদের ভাড়া করে নিজ কন্যা চম্পাকে রাষ্ট্রবিরোধী রাজাকার সমর্থক জামাইয়ের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য। ভাড়াটে গুন্ডারা চম্পাকে লুণ্ঠন করতে সমর্থও হয়। গন্ডগোলটা বাধে যখন শমসের চম্পাকে রমণ করতে উদ্যত হয়। চম্পা যে খুব বিরোধিতা করেছে, উপন্যাসে তার কোনো চিত্র নেই। তবে এটাও ঠিক যে, এই রমণে তার সমর্থনও নেই। জামাল-নছররা ধর্ষকামীদের নিবৃত্ত করতে সচেষ্ট হয়।
উপন্যাসের প্রায় শেষের দিকে চম্পার মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রচ- একটা আবর্ত তৈরি করেন সৈয়দ হক। চম্পার মধ্য দিয়ে স্বামীহীন একজন নারীর মনোচিত্রের উদ্ভাসন ঘটান ঔপন্যাসিক। একসময় চম্পা মুক্তি পায় উদ্ধারকারী ধর্ষকামীদের হাত থেকে। তখনই চম্পার সংকটটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিসের সংকট? সংকট চম্পা এখন কোন দিকে যাবে? সে বাপের বাড়ির পথ ধরবে, না স্বামীর বাড়ি ফিরে যাবে?
শমসের বলে, ‘যেদিকে খুশি মন চায়, যাও। স্বামীর ঘরে যাবার চাও, যাও। বাপের কাছে যাবার চাও, রাস্তা তো এই দিকেই।’
দোটানায় পড়ে চম্পা। কোন পথটি তার কাছে ঈপ্সিত? পথ খোলা থাকলে কী হবে, যাওয়া তো অত সহজ নয়। পিতার টান আর স্বামীর টান – কোনটাকে বেছে নেবে চম্পা?
এই সময় চম্পা জীবনস্পর্শী কিছু কথা বলে, ‘নারীর জন্ম যে বড় অভাগীর জনম হয় ভাই। স্বামীর অধিকার তাকে মানি নিতে হয়। খারাপ মন্দ হইলেও সে স্বামী, তার পায়ের নিচে ভেস্তো, তাকে না ছাড়িয়া যাও হে! তাকে যদি ছাড়ো তবে সমাজ তোমাকে দুষিবে। তোমাকে নষ্ট কইবে। বেশ্যার চায়াও অধম তোমাকে মনে করিবে। অন্যদিকে খেয়াল করি দ্যাখো, ন্যায়-অন্যায় আছে, দ্যাশের ভালো-মন্দ আছে, দ্যাশে সেই ভালো কিসে আছে, সেটা কি মুঁই নারী বলিয়াই খেয়াল না করিবো? নিজের স্বামী যদি মানুষের দুশমন হয়, তারও বাদে কি সেই স্বামীর ঘর করা হামার কাজ হয়? আর, ঘর যদি না করোঁ তবে তো হামাকে তোমরায় কইবেন নারীজাতির কলঙ্ক রে তুই।’
চম্পার এই কথা শুনে লুণ্ঠনকারী মানে উদ্ধারকারীরা নিরুত্তর হয়ে যায়।
এই উপন্যাসে নারীদেহের সান্নিধ্যে আসা যুবকের মনোবিকলনের চালচিত্র আছে, ধর্ষণমনস্কতা আছে। আছে আবার বিবেকের দংশন। সবকিছুকে ছাপিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে শাসনক্ষমতা চলে যাওয়ার হাহাকার আছে। লাল সূর্যের অপমানের কথা যেমন আছে, তেমনি সেই সূর্যের রাহুমুক্ত হওয়ার বাসনাও ব্যক্ত হয়েছে জোরালোভাবে।
লেখক নিজেও একটা চরিত্র হয়ে উঠেছেন ময়লা জামায় ফেরেশতারা উপন্যাসে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর এদেশ চলে গেছে অপশাসকদের হাতে। তখন দেশ খরচৈত্রে পুড়ে-পুড়ে ছারখার। ফসলি মাঠ আজ ধুধু। তখন লেখক চান বাঙালির পুনর্জাগরণ, শুনতে চান – ঘরে-ঘরে দুর্গ গড়ে তোল – ঘুম-ভাঙানিয়া এই শ্লোকটি। এখন দেশ রাজাকার গোষ্ঠীর হাতে হলে কী হবে, এমন একদিন আসবে যেদিন দেশ-লুটেরারা জাহান্নামে যাবে। এ-কথা এই উপন্যাসে শুধু ঔপন্যাসিকের হয়ে থাকেনি, আপামর স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণেচ্ছু মানুষের অন্তর-ইচ্ছা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ময়লা জামায় ফেরেশতারা উপন্যাসটির সূচনা করেছেন নদীপাড়ে, উপন্যাসটি শেষও করেছেন সেই আধকোশার পাড়ে। আধকোশার পাড়ে এক বৃদ্ধ আসে ওপারে যাবে বলে। ওপারটা যেন স্বাধীনতার লাল সূর্যের দেশ, এপারটা অরাজকতায় ভরা। বৃদ্ধটি যেন এদেশের সাধারণ মানুষের প্রতীক, যে-মাৎস্যন্যায়কে অতিক্রম করে স্বদেশের পবিত্র মাটিতে যেতে আগ্রহী।
এ যেন এক নদীর কাহিনি, এ যেন এক জলের বৃত্তান্ত। জলে শুরু উপন্যাসটি, জলের কিনারা ঘেঁষে উপন্যাসটির সমাপ্তি। 