জলের অক্ষরে লেখা

পর্ব : ১৩

অবন্তি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না, সকালে ঘুম ভাঙলো আফসানার ডাকাডাকিতে।

এই সুসান, ওঠো তো। অনেক বেলা হয়েছে, ওঠো।

অবন্তি ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে বললো, এত ভোরে ডাকাডাকি শুরু করেছ কেন ভাবি? কী হয়েছে?

 ভোর না, দশটা বাজে। ওঠো। তোমার জন্য না খেয়ে বসে আছি।

অবন্তি উঠে বসলো। শরীর জুড়ে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি। অবসাদ, না ক্লান্তি? না, ওসব নয়। একটা সুখের মতো ব্যথা জড়িয়ে রেখেছে তাকে, মনে হলো অবন্তির। আলসেমি করতে ইচ্ছে করছে। এর মধ্যে এরকম ডাকাডাকির কোনো মানে হয়?

বললো, তুমি খেয়ে নাও ভাবি, আমি আরেকটু ঘুমাবো।

আজকে আর ঘুমাতে হবে না। মেলা কাজ পড়ে আছে। ওঠো। ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।

কাজ! কিসের কাজ?

ও মা! আবারও ভুলে বসে আছো?

কী ভুললাম?

মহা মুশকিল। তোমার তো ঘুমই ভাঙছে না। আজকে না সবাই আসবে, দুপুরে এখানে খাবে! একটু গুছিয়ে নিতে হবে না? এখনো নাস্তার পর্বই শেষ হলো না…

ও! হ্যাঁ, তাই তো! একদম মনে পড়ছিল না। ঠিক আছে, তুমি যাও, আমি আসছি।

গোসল করা দরকার, রাতের সব চিহ্ন এখনো শরীরে লেগে আছে – এরকম এক অনুভূতি হচ্ছে অবন্তির। মন্দ লাগছে না অবশ্য। থাক আরো কিছুক্ষণ। নাস্তার পরও গোসল করা যাবে।

হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে গেল সে। বললো, ভাইয়া খেয়েছে?

হ্যাঁ, সেই কখন!

বাচ্চারা?

ওরাও খেয়ে নিয়েছে।

তুমি শুধু শুধু বসে আছো কেন?

বসে না থাকলে তো তোমাকে একা খেতে হতো।

‘আমার একা খেয়ে অভ্যাস আছে’ বলতে গিয়েও থেমে গেল অবন্তি। এর আগে এ-ধরনের কথা সে অনেকবার বলেছে, তবু ভাবি বসে থাকে। বারবার একই কথা বলা মানে তার এই অনুভূতিকে আঘাত দেওয়া।

কখন আসবে সবাই? সে জানতে চাইলো।

দুপুরের আগেই চলে আসবে। 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলো অবন্তি, তারপর বললো – কতদিন পর দেখা হবে সবার সঙ্গে! জানো ভাবি, আমার মাঝে মাঝে মনে হতো, কারো সঙ্গে আমার বোধহয় আর কোনোদিন দেখা হবে না। বাচ্চাগুলো বড় হয়ে গেল, ফুপুকে ওরা দেখলোই না। আমিও ওদের বড় হওয়া দেখলাম না …

ওসব আর ভেবো না। শুধু শুধু মন খারাপ হবে।

ভাবতে চাই না, তাও এসে যায়। বিশেষ করে দেশে আসার পর খুব মনে হয় এসব। মনে হয়, জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।

এরকম সবারই মনে হয় সুসান। কিন্তু আসলে অন্যরকম হওয়ার সুযোগ ছিল না, যেরকম হওয়ার কথা ছিল সেরকমই হয়েছে।

হয়তো … কিন্তু কিছু জীবন আছে না, মনে হয় যেন নিয়তিতাড়িত, আবার কিছু জীবন যেন নিজের হাতে তৈরি? নিয়তিতাড়িত মানুষদের জীবন সম্বন্ধে তোমার ওই কথাটি যতটা খাটে, আমার জীবন সম্বন্ধে ততটা খাটে না। আমারটা তো নিজের হাতে তৈরি।

নিজের হাতে?

হ্যাঁ, এই অর্থে যে, নিজের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত আমি নিজে নিয়েছি। কেউ চাপিয়ে দেয়নি, কারো পরামর্শও চাইনি। খুব জেদী ছিলাম তো! জেদী, স্বাধীনচেতা, একরোখা …

ছিলাম মানে কী? এখন আর নেই?

অবন্তি হেসে ফেললো, না, ভাবি নেই।

তোমাকে দেখে তো তা মনে হয় না। তা, কবে থেকে এই পরিবর্তন এলো?

কাল রাত থেকে। চোখ নিচু করে উত্তর দিলো অবন্তি।

হ্যাঁ, কাল রাত থেকেই অবন্তির প্রতিটি অভিব্যক্তি খেয়াল করছিল আফসানা – কিছু একটা যে ঘটেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই তার; কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করে জানতে ইচ্ছে করছিল না। সে চাইছিল অবন্তি নিজে থেকে বলুক। রাতের প্রসঙ্গ যেহেতু উঠেছেই, আরেকটু এগোনো যাক, ভাবলো সে।

বললো, রাত থেকে! কী এমন হলো কালকে রাতে?

তুমি তো বুঝেছ ভাবি, তাই না? চোখ নামিয়েই বললো অবন্তি।

হুম, আন্দাজ করেছি।

তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল ভাবি। কিন্তু তুমি এত ব্যস্ত আজকে …

নাস্তা শেষ করে রুমে যাও। আমি চা নিয়ে আসছি। কিছুক্ষণ গল্প করার মতো সময় আছে।

অবন্তি বাধ্য মেয়ের মতো নাস্তা সেরে রুমে গেল। কিছুক্ষণ পর আফসানা এলো দু-কাপ চা হাতে নিয়ে। দেখলো, অবন্তি বিছানায় বসে জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে আছে। চা হাতে নিলো না সে, বললো – টেবিলে রেখে তুমি আমার কাছে একটু এসো তো।

আফসানা তাই করলো আর অবন্তি দু-হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো – আমাকে একটু বকে দাও তো ভাবি। অনেক বছর ধরে বকো না।

আফসানা হাসলো – কাছে থাকো না তো, তাই বকার সুযোগ পাই না। দেশে থাকলে বকাঝকা করে ভূত ছাড়িয়ে দিতাম।

সেটাই ভালো হতো। জীবনে বকার মতো একজন মানুষ থাকা দরকার।

আফসানা অবন্তির চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো, কী হয়েছে তোমার সুসান? মন খারাপ কেন?

মন খারাপ না ভাবি। এলোমেলো লাগছে সবকিছু।

কেন? কী হয়েছে?

চা নিয়ে বসো। বলছি।

দুজনে এবার চা হাতে নিলো। অবন্তি বললো, কালকে ঋভুর সঙ্গে ছিলাম।

সে তো প্রতিদিনই থাকো। রোজ আড্ডা দিচ্ছো।

তুমি বুঝেছ আমি কী বলেছি। বোঝোনি?

কালকে শুধু তোমরা দুজন ছিলে? অংশু ছিল না?

ছিল কিছুক্ষণ।

খুলে বলো তো!

দুপুরে হঠাৎই দেখা হলো ঋভুর সঙ্গে। অথচ সকালে যখন বেরোচ্ছিলাম, তার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দিনটা নিজের মতো কাটাবো, ওদের সঙ্গে আড্ডা দেবো না।

দেখা হলো কোথায়, কীভাবে?

ঘুরতে ঘুরতে রবীন্দ্র সরোবরে গিয়েছিলাম। তখনই হঠাৎ ঋভু ফোন করলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলেও এলো।

আশেপাশে ছিল নাকি?

হ্যাঁ। কী কাজে যেন ধানমন্ডিতে গিয়েছিল।

মনে তো হচ্ছে, তোমাকে ফলো করতে করতে …

আরে না। ও জানবে কীভাবে যে ওই বৃষ্টির মধ্যে আমি বাইরে বেরোবো?

হুম, তা বটে। তুমি না জানালে তো জানার উপায় নেই।

আমি কিন্তু জানাইনি।

বুঝেছি। তারপর?

দুজনে মিলে পুরান ঢাকায় ঘুরলাম, খেলাম নীরব হোটেলে, তারপর বিকেলে গেলাম অংশুদের বাসায়। ওখানে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার পর বেরোলাম। ভেবেছিলাম, বাসায় চলে আসবো।

কিন্তু ঋভু আসতে দিলো না, তাই তো?

হুম। অনেকটা ওরকম।

ওর বাসায় গেলে?

হ্যাঁ।

হুম বুঝলাম।

অবন্তি বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। আফসানাও। তারপর নিচু কণ্ঠে বললো অবন্তি – শরীর অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। তাই না ভাবি?

হ্যাঁ দেয়। তুমি উত্তর পেয়েছো?

হুম পেয়েছি।

কী উত্তর পেলে? ঋভু তোমাকে ভালোবাসে?

হ্যাঁ।

আগেও বাসতো?

হ্যাঁ। কিন্তু …

কী?

একবার এরকমও মনে হলো, ওর খুব আক্রোশ আমার ওপর।

সেটা নাও হতে পারে। কোনো কোনো পুরুষ বিছানায় খুব আগ্রাসী হয়।

একটা কথা জিজ্ঞেস করি ভাবি?

হ্যাঁ, করো।

কিছু মনে করবে না তো?

না, মনে করবো কেন?

ভাইয়া ছাড়া আর কারো সঙ্গে কি তোমার …?

এটা জানতে চাইছো কেন?

এমনি। বলতে না চাইলে থাক।

কমবেশি সবারই একাধিক অভিজ্ঞতা থাকে সুসান।

হুম, তাই ভাবছিলাম। নইলে আমার এই ব্যাপারটা এত সহজে নিতে পারতে না।

হয়তো তাই।

শরীর এত সহজ করে দেয় সবকিছু, তবু আমরা ব্যাপারটাকে কেমন অচ্ছুৎ করে রেখেছি, তাই না?

সবসময় কিন্তু সহজ করে দেয় না সুসান। কখনো কখনো জীবনকে জটিলও করে তোলে।

কী রকম?

একটা বয়সে শরীর কেবল আনন্দ খোঁজে, তখন কিন্তু সে কোনো উত্তর পায় না, বরং জন্ম নেয় অনেক প্রশ্নের। তুমি ঋভুর কাছে উত্তর খুঁজছিলে বলে পেয়েছো। কিন্তু অল্প বয়সে যদি এই একই অভিজ্ঞতা হতো, তুমি তখন কোনো উত্তর খুঁজতেও না, পেতেও না।

অবন্তির সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল সেই লেখকের কথা। হ্যাঁ সেই সম্পর্কও তো উদ্দাম ছিল, কিন্তু তখন তো কোনো প্রশ্নের উত্তর মেলেনি! উল্টো প্রশ্ন জেগেছিল মনে – এই সম্পর্কের মানে কী? ভাবি ভুল বলেনি।

আফসানা আবারও বললো, উত্তর তো পেলে। দ্বিধা কেটেছে তো?

হ্যাঁ, সেই দ্বিধা কেটে গেছে।

তাহলে এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারো!

ওটা তো আমার একার ব্যাপার না ভাবি। ঋভুরও তো সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

তা হবে। আমার ধারণা, ঋভুও এখন সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার দ্বিধা যাচ্ছে না যে!

সেটা আবার কী?

আমরা দুজন আসলে দুই মেরুর মানুষ। হয়তো দুজনের শরীরের ভাষা মিলে গেছে বলে অনেক না-বলা কথাও জানা হয়ে গেছে, কিন্তু মনের ভাষা মিলেছে কি না বুঝতে পারছি না।

কেন এরকম মনে হচ্ছে তোমার?

বললাম না, আমরা স্বভাবের দিক থেকে দুই মেরুর মানুষ। আমি রাগী, জেদী, একরোখা, পজেসিভ। আর ও শান্ত, সমাহিত, কম্প্রোমাইজিং, উদাসীন। জানো, ওকে আমি কোনোদিনও রাগতে দেখিনি, উত্তেজিত হতে দেখিনি, ধৈর্য হারাতে দেখিনি। আমাদের মিলবে কীভাবে?

মিলবে মিলবে। একসময় যেমন ছিলে এখনো কি তেমন আছো নাকি? তখন অবুঝ ছিলে, এখন তো সবই বোঝো।

তবু … নিজের ওপর কোনো ভরসা পাই না।

হয়েছে। এসব ভেবো না তো। পজিটিভ কিছু ভাবো। এখন যাই। কাজকর্ম পড়ে আছে। তুমিও আজকে একটু হাত লাগাও না আমার সঙ্গে।

হ্যাঁ ভাবি, তুমি যাও। আমি গোসলটা সেরে আসি।

আচ্ছা। রাতে ফিরে তো গোসল করোনি। এখন করে নাও। ওসব করার পর বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে হয় না। দুষ্টুমির হাসি হেসে বললো আফসানা।

যাও ভাবি। লজ্জা দিও না।

অবন্তির চিবুক ধরে কপালে একটা চুমু দিলো আফসানা। বললো, অনেকদিন পর তোমাকে এরকম সুখী আর আনন্দিত দেখলাম। কী যে ভালো লাগছে আমার! যাও গোসল করে নাও। তারপর এসে কাজে হাত দাও। কাজ করতে করতে গল্প করবো।

হুম, ঠিক আছে। থ্যাংক ইউ ভাবি। তুমি না থাকলে খুব বিপদে পড়তাম। আমার তো কথা বলার মানুষই নেই।

হয়েছে হয়েছে। ওঠো এখন।

আফসানা চলে যাওয়ার পরও কতক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো অবন্তি। মন এলোমেলো হয়ে আছে, শান্ত হচ্ছে না কিছুতেই। কারণটাও বোঝা যাচ্ছে না। রাতে ফেরার সময়, এমনকি ফেরার পরও ফুরফুরে মেজাজে ছিল সে। শরীরে সেই ঘোর লেগে আছে এখনো। তাহলে কেন এমন লাগছে? তার কি সত্যিই নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে? এখনই? সে কি প্রস্তুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য? একবার অংশুর সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ওকে তো আর রাতের ঘটনা বলা যাবে না, বোঝানো যাবে না কেন এই হঠাৎ পরিবর্তন, কেন মনে হচ্ছে অনেক উত্তর পাওয়া হয়ে গেছে। একবার মনে হলো, ঋভুর সঙ্গে কথা বললে বোধহয় ভালো লাগবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টালো সে। ছুটির দিন, বেচারা বোধহয় ঘুমাচ্ছে। থাক এখন, পরে সুযোগ পেলে কথা বলবে।

পরে আর সুযোগ এলো না অবশ্য। দুপুরের আগেই মেজ ভাই ছাড়া সবাই চলে এলো, সে নাকি কী কাজে আটকা পড়েছে, একটু দেরি হবে আসতে। ভাবিরা মেতে উঠলো অবন্তিকে নিয়ে। বাচ্চারা ফুপুকে চেনে না, সামনাসামনি কখনো দেখেনি, তবু এক এক করে সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে আদর নিয়ে গেল। তিন ভাইয়ের ছটি বাচ্চা। একদম গুনে গুনে। যেন রেডিওতে প্রচারিত সুখী পরিবারের বিজ্ঞাপন। ওদেরকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে কী যে অদ্ভুত অনুভূতি হলো অবন্তির! ওরা বড় হয়ে গেছে, অন্তত কোলে ওঠার বয়স নেই কারো, তবু মনে হলো যেন একেকটা পুতুল ওরা, কোলে নিয়ে বেড়াতে ভারি সুখ। লোকমুখে ‘রক্তের টান’ শব্দ দুটো শুনেছে সে বহুবার, এবার যেন সেটিই অনুভব করলো।

 অবন্তির তিন ভাই। মাহমুদ রেজওয়ান ওরফে পান্থ, মাহবুব রেজওয়ান ওরফে শান্ত, মাসুদ রেজওয়ান ওরফে শুভ। বড় ভাবির নাম আফসানা সুলতানা ওরফে মিতুল, মেজ ভাবি রেবেকা শারমীন ওরফে শর্মী, আর ছোটটা ফারজানা আহমেদ ওরফে বীথি। অবন্তি উঠেছে বড় ভাইয়ের বাসায়। এখনো মেজ বা ছোট ভাই বা ভাবিদের সঙ্গে দেখা হয়নি। মেজ ভাই আর ভাবি দুজনই ঢাকার বাইরে। সরকারি চাকরি তাদের। একেক সময় একেক জায়গায় পোস্টিং। ছোট ভাই মানে শুভ আর অবন্তি পিঠাপিঠি, মাত্র দু-বছরের বড় শুভ। ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। কী এক জটিল মামলায় ফেঁসে গিয়েছিল, এখন জেল খাটছে। বীথি থাকে ওর বাবার কাছে, দুই বাচ্চা নিয়ে। মাঝেমধ্যে এখানে আসে। অবন্তি দেশে ফেরার পর মাত্র একদিন এসে দেখা করে গেছে।     

অবন্তি বুঝতে পারেনি, তার জন্য বিরাট এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। সেজন্যই মেজ ভাই যখন শুভকে নিয়ে বাসায় ঢুকলো, স্রেফ হতভম্ব হয়ে গেল অবন্তি। সে ধরেই নিয়েছিল, শুভর সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না; দুদিন পর সে চলে যাবে, আর হয়তো আসাও হবে না। শুভ ছাড়া পাবে ঠিকই, সেই দিনটিও দেখা হবে না তার। পিঠাপিঠি বলে তাদের সম্পর্ক যতটা না ভাইবোনের, তারচেয়ে বেশি বন্ধুত্বের ছিল। দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর অবন্তি সবচেয়ে বেশি মিস করতো শুভকেই। ওর অধঃপতন, পুলিশের কাছে ধরা পড়া, জেলে যাওয়া, কারাদণ্ড পাওয়া সবকিছুর জন্য তার নিজেরও কিছুটা দায় অনুভব করতো সে। মনে হতো, সে যদি দেশে থাকতো, শুভকে ও-পথে পা বাড়াতে দিতো না। কষ্ট হতো, কান্নাকাটি করতো গোপনে, তারপর একসময় সয়ে গেছে, মেনে নিয়েছে এই বাস্তবতা। 

শুভকে দেখে কী করবে বুঝতে পারছিল না অবন্তি। কতক্ষণ স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে। নিজেকে সামলাতে পারলো না, অঝোরে কাঁদতে লাগলো। শুভ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলো, আরে এত কাঁদছিস কেন? পাগলি! আমি তো ফিরে এসেছি।

জানা গেল, শুভ ছাড়া পেয়েছে দুদিন আগেই। এমনি এমনি হয়নি অবশ্য, আরো বছরখানেক সাজা খাটার কথা ছিল, মেজ ভাই তদবির করে ছাড়িয়ে এনেছে। রাজশাহী জেলে ছিল। মেজ ভাই, ভাবি, বীথি আর ওর বাচ্চারা ওকে আনতে গিয়েছিল। এ দুদিন ছিল মেজ ভাইয়ের বাসাতেই। কেউ এসব খবর অবন্তিকে জানায়নি! কোনো মানে হয়? এটা কি সারপ্রাইজ দেওয়ার বয়স? আশ্চর্য কাণ্ড সবার! কপট রাগে ফুলে রইলো সে কিছুক্ষণ,  কিন্তু বেশিক্ষণ তাও সম্ভব হলো না, ভাবিরা হাসিয়ে ছাড়লো, গাল ফুলিয়ে থাকতে দিলো না। অনেকদিন পর আজ পুরো পরিবার একসঙ্গে হয়েছে। যেন দীর্ঘদিনের এক পাষাণভার নেমে গেছে সবার বুকের ওপর থেকে, আনন্দে ভাসছে সবাই। সেও মহা উৎসাহে যোগ দিলো সেই আনন্দে। খাওয়া-দাওয়া হলো, গল্পগুজব হলো, হাসি-ঠাট্টা-তামাশা হলো, এত যে গম্ভীর বড় ভাই, সেও পিছিয়ে রইলো না সেসব থেকে। শেষ কবে এমন আনন্দের দিন এসেছিল এই পরিবারে, অবন্তির মনে পড়লো না। হয়তো সেই ছোটবেলায় দিনগুলো এমন ছিল। না, এরচেয়েও নির্মল ছিল, নির্ভার ছিল; তারপর সব হারিয়ে যেতে যেতে নিঃস্ব হয়ে গেছে প্রায় সবাই। সম্মিলিত উচ্ছ্বাস নেই, আপন ভাইবোনদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ নেই, যে-যার মতো নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, চা-নাস্তা হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এলো, তবু আড্ডা ভাঙার লক্ষণ দেখা গেল না। আফসানাকেই তখন বলতে হলো, এখন ওঠো তো সবাই। যে যার ঘরে যাও, একটু রেস্ট নাও। রাত দশটা বাজতে না বাজতে যেন বলো না, ঘুম পাচ্ছে।

আজকে কি তাহলে সারারাত আড্ডা চলবে? শান্ত বললো।

চলতে পারে, যদি তুমি জমাতে পারো।

আমার ওপর এই দায়িত্ব কেন? শুভ আর সুসান আছে না? ওদেরকে দায়িত্ব দাও।

দায়িত্ব তো তুমি নিজে থেকেই নিতে চাইলে!

আমি? আমি কখন চাইলাম?

ওই যে সারারাত আড্ডার কথা বললে! আর তো কেউ বলেনি। তার মানে, তোমার মনে কোনো পরিকল্পনা আছে।

নাহ্, তোমার আশেপাশে থাকাও বিপজ্জনক ভাবি। কখন কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দাও। আমি পালাই।

আজকে সবাই এ-বাসাতেই থাকবে, সে-সিদ্ধান্ত দুপুরেই হয়ে গেছে। থাকার জায়গার অভাব নেই। দোতলায় পান্থ-মিতুল আর তাদের দুই ছেলেমেয়ে থাকে, অবন্তিও থাকছে এখানেই। তিনতলা পুরোটাই খালি, ভাড়া দেওয়া হয়নি। শান্ত-শর্মী ঢাকায় এলে ওখানেই থাকতো, আজকে শুভ-বীথিও থাকবে। বাচ্চাদের নিয়ে সমস্যা নেই। ওরা একটা রুম পেলেই খুশি, নিজেদের মতো গল্পগুজব করে রাত পার করে দেবে।

শুভ বললো অবন্তিকে – ছাদে যাবি সুসান?

হ্যাঁ, যাওয়া যায়।

চল তাহলে। অনেক বছর ধরে যাওয়া হয় না।

অবন্তিও একটু সুযোগ খুঁজছিল শুভর সঙ্গে আলাদা কথা বলার জন্য। সব ভাই-বোন-ভাবি মিলে গল্পগুলো একরকম, আর তাদের দুজনের গল্প আরেকরকম। আগেও এমনই ছিল, দুজনের নিজস্ব একটা জগৎ ছিল।

বীথিকে বিশ্রাম নিতে বলে অবন্তিকে নিয়ে ছাদে গেল শুভ। চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সবকিছু, বললো, সব বদলে গেছে, কেবল আমাদের বাড়িটা ছাড়া।

হ্যাঁ। কী ছিমছাম ছিল সবকিছু, তাই না রে? চারতলার ওপরে বাড়িই ছিল না। এখন সব অট্টালিকা।

হুম।

তোর সঙ্গে তো কথা বলার সুযোগই হলো না। কী করবি এখন, ভেবেছিস কিছু?

না রে, ভাবিনি।

কিছুই ভাবিসনি?

না মানে, ভেবেছি অনেক। যখন শুনলাম, তাড়াতাড়িই ছাড়া পেয়ে যাবো, তখন থেকে ভাবছি; কিন্তু ভেবে কিছু বের করতে পারিনি।

এই যে এতদিন পর মুক্তজীবন, কেমন লাগছে তোর?

বুঝতে পারছি না।

এ আবার কেমন কথা?

মুক্তজীবন তো ভালো লাগারই কথা; কিন্তু মনে হচ্ছে, আমি আসলে সারাজীবনের জন্যই বন্দি হয়ে গেছি।

কেন? তা হবে কেন?

তোকে বুঝিয়ে বলি। আমি যখন জেলে গিয়েছিলাম, তখন বাচ্চা দুটো ছোট ছোট। বড়টার বয়স চার আর ছোটটা কোলে। বড়টা এখন কলেজে পড়ে, ছোটটা স্কুলে। ওরা কখনো আমাকে দেখেনি। বাবার কোনো স্মৃতি ওদের নেই। আমি আসার পর থেকে খুব একটা কথা বলেনি, কাছেও ঘেঁষেনি। আমিও বুঝতে পারছি না, কী করে ওদের সঙ্গে সহজ হবো।

এ নিয়ে এত ভাবিস না। একটু সময় লাগবে, তারপর এমনিতেই সহজ হয়ে যাবে।

না রে, আর বোধহয় সহজ হবে না। ওরা একা একা বড় হয়ে গেল, এই অপূর্ণতা কি কখনো ঘুচবে?

তা হয়তো ঘুচবে না। কিন্তু একসময় বুঝতে শিখবে, সবার জীবনেই কিছু-না-কিছু অপূর্ণতা থাকে।

হয়তো। কতদিনে যে বুঝবে! আমার তো বোঝানোর মুখ নেই। জানিস, বীথির দিকেও ভালো করে তাকাতে পারি না। মেয়েটা আমাকে তীব্রভাবে ভালোবেসেছিল। অথচ আমার জন্য কী ভোগান্তিই না হলো ওর!     

আসার পর থেকে এসবই ভাবছিস নাকি?

না, আসার আগে থেকেই ভাবছি। কীভাবে মানিয়ে নেবো, ওরাই বা কীভাবে মানিয়ে নেবে, ভাবছি। কী করবো না করবো বাকি জীবন, তাও ভাবছি। কূলকিনারা পাচ্ছি না।

আচ্ছা, তোর হয়েছিল কী, বল তো? এরকম ফেঁসে গেলি কীভাবে?

নিজের দোষেই।

সেটাই তো জানতে চাইছি। কী করেছিলি তুই?

বড়লোক হতে চেয়েছিলাম রে। খুব তাড়াতাড়ি বড়লোক হতে চেয়েছিলাম।

হঠাৎ তোর এরকম হলো কেন? আমাদের তো কখনো অভাব ছিল না। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার …

সচ্ছল, কিন্তু বড়লোক তো না। আমার মনে হয়েছিল, জীবন উপভোগ করতে হলে অনেক টাকা দরকার। এত হিসাব করে চলা যায় না।

তারপর কী করলি?

ব্যাংকে চাকরি করতাম তো, শুরুটা ওখান থেকেই। ভেতর থেকে দেখলাম, কত সহজে লুট হয়ে যাচ্ছে টাকা। যারা কখনোই টাকা ফেরত দেবে না, তাদেরকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে অকাতরে। শত শত কোটি টাকা। বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই। পুরো ব্যাপারটাই ভুয়া। অথচ যাদের সত্যিই টাকা দরকার, অল্প কিছু টাকা পেলেই চমৎকার একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ফেলবে, তারা বছরের-পর-বছর ঘুরেও লোন পাচ্ছে না।

তাতে তোর কী সমস্যা হলো? এসব দেখে মন খারাপ হতে পারে, চাকরি ছেড়ে দিতে পারতি, তোর বড়লোক হতে ইচ্ছে করলো কেন?

সেটাই তো বলছি। ওই যে যারা কোটি কোটি টাকা লোন পাচ্ছে, তারা কি এমনি এমনি পাচ্ছে? মোটেই না। একটা বিরাট অংশ কমিশন হিসেবে যাচ্ছে। পুরোটাই একটা সিস্টেম। তুমি চাও আর না চাও, তোমার কাছেও আসবে, যদি তুমি জায়গামতো বসে থাকো। আমি তখন এজিএম, একটা বড় শাখার দায়িত্ব পেয়েছি। কিন্তু লোন দেওয়া-না-দেওয়ার স্বাধীনতা আমার নেই। ওটা ওপর থেকে ঠিক হয়েই আসে। তবে, শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষরটা যেহেতু আমাকেই করতে হয়, মোটা একটা অঙ্ক আমার কাছেও আসে।

মোটা অঙ্কটা কেমন শুনি?

ধর এক কোটি টাকার একটা লোন অ্যাপ্রুভ করলে অন্তত পাঁচ লাখ টাকা আমি পাই। বেতনের দশগুণ।

ওরে বাপরে!

আরো আছে। লোন তো আর একটা না, এক কোটি টাকাও না। হাজার কোটি টাকা। বুঝতেই পারছিস!

না, বুঝতে পারছি না। মাথা ঘোরাচ্ছে।

এখনই মাথা ঘোরাচ্ছে! আর শুনবি না?

হ্যাঁ, বল, শুনি।

এসব বড় বড় করাপশন যারা করে, তারা সব ধরনের অপকর্মের হোতা। এদের যোগাযোগও সেরকম।

সেরকম মানে?

মানে রাষ্ট্রের সব ধরনের ক্ষমতাবান লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ।

হ্যাঁ, তা তো জানা কথাই। নইলে তো আর পার পেতো না।

শোন, ওটা বড় ব্যাপার না। ওদের আরেকটা জগৎ  আছে।

সেটা আবার কী?

আন্ডারওয়ার্ল্ড।

ও!

আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করে মূলত পলিটিশিয়ানরা। এরা তাদেরকে টাকা জোগায়।

তোর কি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল?

হ্যাঁ। খুব বেশি নয়, সামান্য।

তাতেই ফেঁসে গেলি!

ফেঁসে যাওয়ার কারণ ভিন্ন।

কীরকম?

তখন আন্ডারওয়ার্ল্ডে একটা পালাবদল চলছিল, মানে নেতৃত্বের পালাবদল। পুরনোদের সরিয়ে এমন একজন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন যার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড খুব শক্ত, তার সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। আমি এটা তখন জানতাম না। আমার যোগাযোগ ঘটে ওই পুরনোদের সঙ্গেই। মানে ওরাই যোগাযোগ করে। আমার কাজ সামান্যই। জিনিস এদিক-ওদিক করা।

জিনিস মানে?

আন্ডারওয়ার্ল্ডে জিনিস মানে অস্ত্র আর মাদক। মানে ড্রাগস।

তুই এগুলো এদিক-ওদিক করতি?

অস্ত্র না। মাদক। তখন কেবল ইয়াবা পপুলার হয়ে উঠছে। বিপুল পরিমাণ ইয়াবা আসছে সীমান্তের ওপার থেকে। আমি কেবল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিতাম। ব্যাংক কর্মকর্তার একটা পরিচয় তো সঙ্গে ছিল, কেউ সন্দেহ করতো না। কাজ শেষ হলেই মোটা অঙ্কের টাকা পেতাম।

তোর খারাপ লাগতো না এসব করতে?

না, লাগতো না। আমাকে তখন টাকার নেশায় পেয়ে বসেছিল। বড়লোক হতে গেলে ওসব খারাপ লাগার অনুভূতি ঝেড়ে ফেলতে হয়।

বল রাতারাতি বড়লোক হতে গেলে। কষ্ট করে, দীর্ঘ সময় নিয়ে, সংগ্রাম করে কি কেউ বড়লোক হয়নি?

হ্যাঁ হয়েছে। আমার অত ধৈর্য ছিল না।

ধরা পড়লি কীভাবে?

ওই যে বললাম, আন্ডারওয়ার্ল্ডে নেতৃত্বের একটা পালাবদল ঘটছিল। আমি যে গ্রুপের হয়ে কাজ করতাম, তাদেরই একজন ফাঁস করেছিল।

কেন?

গ্রুপ বদল করে নতুন নেতার কাছে গিয়েছিল সে। নেতার আস্থা অর্জনের জন্যই সে এই টপ-সিক্রেট ব্যাপারটা নতুন গডফাদারকে জানিয়ে দেয়।

ও! বীথি জানতো এসব?

না, কেউই জানতো না। জানলে তো করতে দিতো না।

জানলো কবে?

ধরা পড়ার পর। বুঝিস না, সরকারি ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা, এরকম একটা বিষয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে, মিডিয়ায় কী তোলপাড়ই না হতে পারে!

হুম। তারপর?

তার আর পর কী? আমার গ্রুপ চেয়েছিল, আমি যেন সব অস্বীকার করি। দেশের সবচেয়ে বড় আইনজীবীকে তারা নিয়োগ করবে।  তুই করলি না কেন?

তাহলে যে আরেকজন নিরপরাধ লোককে ফাঁসাতে হতো!

কী রকম?

জিনিসগুলো তো আমার গাড়িতে ছিল। ওরা প্রস্তাব দিয়েছিল, আমি যেন সব অস্বীকার করে ড্রাইভারের কাঁধে দোষ চাপাই। ড্রাইভারকে ওরা রাজিও করিয়েছিল। মোটা অংকের টাকা দিতে চেয়েছিল। ড্রাইভার আমার সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, স্যার, সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপায়া দেন। আপনে বাইরায়া যান। আমি দুই-চাইর বছর জেল খাটলে অসুবিধা নেই।

তুই ওদের কথা শুনলেই পারতি।

নাহ। মনে হলো, মান-সম্মান যা যাওয়ার গেছে। চাকরিও গেছে। বেরিয়ে এলেও স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরা হবে না। খামোকা নিরপরাধ একটা লোক ফেঁসে যাবে। তারচেয়ে জেলেই থাকি।

বোধোদয় হয়েছিল তাহলে?

তা হয়েছিল।

এত টাকা কামিয়েছিস, ওগুলো কী করেছিস?

বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে জমা করেছিলাম। সবগুলো অ্যাকাউন্ট সরকার বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছিল।

এই বোকামি কেউ করে? চুরি-ডাকাতির টাকা কেউ ব্যাংকে রাখে? তাছাড়া, লুটপাট তো অনেকেই করে, সবাই তো ধরা পড়ে না। তুই বোকার মতো ধরা পড়লি কেন?

বোকামি না। তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, কোটি কোটি টাকা পকেটে এসে যাচ্ছে তেমন কোনো চেষ্টা ছাড়াই, বুঝিস না কী হয়? বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়েছিল। 

শেষ পর্যন্ত কী লাভ হলো তোর, বল?

কোনো লাভ হয়নি। পুরোটাই ক্ষতি।

কথা থেমে গেল দুজনেরই। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।

দূরে কোথাও বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে, একটা শীতল হাওয়া

আসছে পুবদিক থেকে। ছাদে আলো নেই, আকাশও

মেঘে ছেয়ে আছে। দুজনেই চুপ, কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না।

অনেকক্ষণ পর দূরাগত কণ্ঠে শুভ বললো – রায় হওয়ার পর বীথি একদিন দেখা করতে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, কতকিছু জানলাম, শুনলাম; কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই, এই কাজগুলো সত্যিই তুমি করেছ কি না। আমি স্বীকার করে নিয়েছিলাম। ও অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, তুমি আমাকে এভাবে অপমান না করলেও পারতে। আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, তোমার সততাকে ভালোবেসেছিলাম। শুধু তুমি নও, তোমার পরিবারের সবাই সৎ মানুষ, আদর্শিক মানুষ। বাবা, ভাইয়ারা … তুমি আমাদের সবাইকে অপমান করলে! আমি কিছু বলতে পারিনি। ও চলে আসার সময় কেবল বলেছিলাম, আমার জন্য অপেক্ষা করো না বীথি। নিজের জীবনটাকে নষ্ট করো না। নতুন একজন সঙ্গী খুঁজে নিয়ো। ও আমার কথা রাখেনি।

অবন্তি কিছু বললো না। আবারও নীরব হয়ে রইলো দুজন অনেকক্ষণ। তারপর ফের বললো শুভ, এবার তার কণ্ঠ ভেজা ভেজা, জীবনটা অপচয় করে ফেললামরে সুসান। পুরোপুরি অপচয়!

অবন্তি শুভর হাত ধরলো, সেই হাতে সহানুভূতি, আশ^াস, ভালোবাসা। বললো, আমার একটা কথা রাখবি শুভ?

বল, রাখবো।

জানিসই তো, আমি অনেকদিন ধরে দেশের বাইরে। আমেরিকা থেকে চলে গিয়েছিলাম ইতালিতে, সেখান থেকে সুইজারল্যান্ডে। এখন ওখানেই থাকি। অপূর্ব সুন্দর একটা দেশ। শুধু দেশটাই নয়, মানুষগুলোও অসম্ভব ভালো। এই পৃথিবীর কোনো দেশ বলে মনেই হয় না। মনে হয়, এই নোংরা পৃথিবীতে ওটা যেন এক টুকরো স্বর্গ …

হুম। কিন্তু এসব কথা বলছিস কেন? আমাকে ওখানে যেতে বলবি নাকি?

আরে না। অন্য একটা কথা বলবো। ওই দেশের অধিকাংশ মানুষই খ্রিষ্টান। খুব যে ধর্ম মানে তা নয়, কিন্তু যিশুখ্রিষ্টের একেবারে মৌলিক কিছু শিক্ষা মেনে চলে। আমার মনে হয়, ওরা যে মানুষ হিসেবে এত শুদ্ধ, তার কারণ ওটাই।

শিক্ষাটা কী?

তাঁর তিনটি সূত্র। অনুতাপ, ক্ষমা, ভালোবাসা। তুই তোর ভুলের জন্য অনুতপ্ত, দেখতেই পাচ্ছি। বাকি রইলো ক্ষমা আর ভালোবাসা। বীথির কাছে ক্ষমা চাইবি, বাচ্চাদের কাছেও। ভাইয়া-ভাবিদের কাছেও। শুধু ক্ষমা চাইলেই হবে না, ক্ষমা করতেও হবে। যাদের ওপর তোর রাগ-ক্ষোভ জমা হয়ে আছে তাদেরকে ক্ষমা করে দিবি। আর সবাইকে ভালোবাসবি। দেখবি মনে শান্তি আসবে।

খুব তো বললি আমাকে। তুই নিজে সেটা পারিস?

না, পুরোপুরি পারি না, পারলে তো শুদ্ধ মানুষই হয়ে উঠতাম। আমিও তোর মতো ভুলে ভরা মানুষ। আমার জীবনও অপচয়িত জীবন। ভিন্নভাবে। তবে আমি চেষ্টা করি। অনুতাপ, ক্ষমা, ভালোবাসা – এই তিন সূত্রের মধ্যে আমি জীবনের তাৎপর্য খুঁজে পাই।

হুম বুঝলাম। কিন্তু তুই তোর জীবনটাকে অপচয় করলি কেন, বল তো? কী হয়েছিল?

সে অনেক কথা। অনেক ভুল, অনেক বোকামি, অনেক না-বোঝা। পরে শুনিস। চল এখন নিচে যাই।

নিচে নেমে নিজের রুমে গেল অবন্তি। হঠাৎই মনে হলো, সারাদিনে একবারও ঋভুর খোঁজ নেয়নি সে! এটা কোনো কথা হলো! ছি ছি, ও কী মনে করবে! এমনকি ফোনের কথাও মনে ছিল না তার। খুঁজে পেতে নিজের বালিশের নিচে পেলো ফোনটাকে। দেখলো, ঋভুর কয়েকটা টেক্সট মেসেজ। ‘কী করছো’, ‘খুব ব্যস্ত নাকি’, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে’ এই ধরনের ছোট ছোট মেসেজ। তার লজ্জা লাগলো। ফোন তো করেইনি, এমনকি মেসেজগুলোর উত্তরও দেয়নি। এবার ফোন করলো সে। ওপাশে বেজে বেজে থেমে গেল ফোন, রিসিভ হলো না।

ভাবিরা ডাকছে। ঋভুকে নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার সুযোগ পেলো না অবন্তি। গিয়ে ফের বসে পড়লো আড্ডায়। (চলবে)