শিল্পযাত্রার কিছু কথা : ১৯তম এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল

কোভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তী নিউ নরমালের সময়ে বিশে^ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের সঙ্গে দেশে দেশে ঘরে ঘরে প্রিয়জন, বন্ধু, সুহৃদ হারানোর শোককে শক্তিতে আত্মস্থ করার অবিরাম প্রচেষ্টা চলমান। সেই বাস্তবতায় আবেগ-অনুভূতির স্থান থেকে ১৯তম এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল নানা কারণে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণ। এবারের এই আন্তর্জাতিক আয়োজন মহামারি-পরবর্তী বিশে^ কোন আঙ্গিকে আবির্ভূত? বাংলাদেশের দর্শকই বা কীভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করছেন দৃশ্যশিল্পকলার আন্তর্জাতিক বিবিধতার সঙ্গে? শিল্পকলাচর্চার ভূমিকা মৌলিক চাহিদার সমান্তরালে আরো বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে কি?

অনেক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় উত্তর খোঁজার প্রয়াসে।

গত ৮ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে শুরু হয়ে ৭ জানুয়ারি, ২০২৩ তারিখে সমাপ্ত হয় চিত্রকলার এই মহাযজ্ঞ।

এবার ১৯তম এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে স্পষ্টতই দেখা  যায়, শিল্পচর্চার ধারা  এখন যতটা না দক্ষতাভিত্তিক, তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক, সামগ্রিক। ধারণাপ্রধান (কনসেপচুয়াল) কাজের এই নতুন বাস্তবতায় তৈরি হয়েছে নতুন নতুন শিল্প সম্পর্ক ও পেশা। এই আয়োজনের পেছনেও তেমনিভাবে আয়োজক কমিটি, গ্যালারি ব্যবস্থাপনা, ডিসপ্লে কমিটি, বিচারক কমিটি, কিউরেটর, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন কমিটি নানা স্তরে কাজ করেছে।

আধুনিক দৃশ্যশিল্পকলা নানা ধারায় বিভক্ত। আধুনিক (পশ্চিমের) নন্দনতত্ত্ব শিল্পকে জ্ঞানকাণ্ডের অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সঙ্গে দিয়েছে অপরিসীম সৃজন স্বাধীনতা। যদিও প্রাচ্যে ভারতীয় ৬৪-কলা শিল্পকে জীবনচর্চা হিসেবে দেখেছে পশ্চিমের আধুনিকতার বহু আগেই। কিন্তু শিল্পচর্চা জীবনচর্চার চাইতে আলাদা কোনো বিষয় নয় – এই ধারণা থেকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ দুঃখজনকভাবে দূরে চলে গেছে।

আমরা কি ইতিহাসকে আমলে নিয়ে সামগ্রিকতার পরিপ্রেক্ষিতে নিজ সংস্কৃতির নিরিখে শিল্পের সংবেদনশীলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হই?

শিল্পের ভাষা নির্মাণে শিল্পীর চিন্তাধারা, শিল্পকর্মের মাধ্যম-উপকরণ, শিল্পকর্মের উপস্থাপনরীতির সঙ্গে বদলে গিয়েছে শিল্প-প্রদর্শনীকে চিরায়ত দ্বিমাত্রিকভাবে দেখার ভঙ্গিমা। গ্যালারির অভ্যন্তরের দেয়াল, ত্রিমাত্রিক ঘর, গ্যালারির বাইরের খোলা স্থান সমস্তই শিল্প-উপকরণের সঙ্গে নিরীক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক শিল্পকলার জগতের সঙ্গে সম্পর্কবিনিময়ের উদ্দেশ্যে বৃহৎ স্বপ্ন নিয়ে ১৯৮১ সালে যাত্রা শুরু হয় এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের। কিন্তু এত বছর পরও দায়সারা গোছের একটি আয়োজন ছাড়া তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেনি এই দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী। অথচ, ২০২২ সালে শুরু হওয়া ভারতের কোচি-মুজিরিস বিয়েনাল বিশে^র শিল্প-প্রদর্শনীগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে।

এবারের এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে ১১৪টি দেশের ৪৯৩ জন শিল্পীর ৬৪৯টি বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে একক কোনো বিষয়বস্তুকে ভিত্তি করে নয়, বরং কিছু উন্মুক্ত অংশগ্রহণ, কিছু কিউরেটরিয়াল ভাবনার অংশ হিসেবে।

শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন গ্যালারি, উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের পাশাপাশি একাডেমির বাইরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে উপস্থাপন ও প্রদর্শন করা হয়েছে পারফরম্যান্স আর্ট। মাসব্যাপী এ-আয়োজনে মোট ৫১ জন পারফরম্যান্স আর্টিস্ট তাঁদের কাজ উপস্থাপন করেছেন। তার মধ্যে দুটি কিউরেটরিয়াল দলের ৩৬ জন শিল্পী একক পারফরম্যান্স করেন এবং বাংলাদেশ পারফরম্যান্স আর্ট গ্রুপের ১৫ জনের সমবেত একটি দলের পারফরম্যান্স দেখানো হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও চিলি, কঙ্গো, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো ও জাপানের শিল্পীরা তাঁদের পারফরম্যান্স আর্ট প্রদর্শন করেন এই উৎসবে। 

শিল্পীদের মধ্যে বাংলাদেশের দুজন এবার গ্র্যান্ড পুরস্কার পেয়েছেন। সুশান্ত কুমার অধিকারী তাঁদের একজন। তাঁর চিত্রকর্মের নাম ‘আত্মউপলব্ধির ভেতর বাহির’ । কাগজের ওপর টেম্পারা ও কাচের মিশ্রমাধ্যমের এ কাজে ২১টি আত্মপ্রতিকৃতিতে নিজেকে দেখছেন, পাশাপাশি দুটো আয়না স্থাপন করা হয়েছে দর্শককেও আত্মোপলব্ধির এই যাত্রায় আমন্ত্রণ জানিয়ে।

অন্যজন ইয়াসমিন জাহান। তাঁর চিত্রকর্মের নাম ‘দ্য টাইম কুড নট কিপ অ্যাট বে’। দৃশ্যত স্থাপনাধর্মী এই শিল্পকর্মটিতে নূপুর কিছু সাদা স্বচ্ছ কাপড়ে অনুভূতিজ্ঞাপক নানা শব্দ বুনন করেছেন। আপাত সরল ভাবনার ভেতর এক ধূসর জগৎ। সেখানে আশা আর নিরাশার নিরন্তর আসা-যাওয়া।

অন্যদিকে বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে হেরোল্ড স্কোলে (নেদারল্যান্ডস) পেয়েছেন গ্র্যান্ড পুরস্কার। তাঁর ‘আন্ডারলাইন’ আবার সেই চোখের ভাষা পড়তে চায়। চোখ যেন ভাষা প্রকাশের অন্যতম অঙ্গ, বোধহয় বাক্যের অনুবাদের অন্তরালে গিয়েও ভীষণ সত্য। দৃশ্য থেকে দৃশ্যে শিল্পী মনোজাগতিক নানা মুহূর্ত তুলে ধরেছেন। ফটোগ্রাফ, ড্রইং, সি-প্রিন্টের মাধ্যমে সাজানো সাদা-কালো আটটি ছবিতে চোখ ও সমান্তরালের দৃশ্যে।

সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন ফারেহা জেবা, জয়তু চাকমা, মামুর এহসান মাহতাব, মাইনুল ইসলাম প্রমুখ। এছাড়া এনা সিলভিয়া মালহাদো (পর্তুগাল) সম্মানসূচক পুরস্কার লাভ করেছেন। পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় আমলে নিয়ে বিচারকরা পুরস্কার দিচ্ছেন, সেটা প্রকাশিত হলে প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বিষয়ে সাধারণ দর্শকের কৌতূহল কিছুটা প্রশমিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো।

গ্যালারি-২-এ বাংলাদেশের বরেণ্য পঞ্চাশজন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে আয়োজিত অংশ মূলত এদেশের চিত্রশিল্পের ষাট ও সত্তরের  দশক-পরবর্তী ধারাবাহিক একটি ইতিহাসকে উপস্থাপনের প্রয়াস।

প্রথিতযশা শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার, রফিকুন নবী, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, আবুল বারক আলভী, কাজী গিয়াসউদ্দীন প্রমুখের শিল্পকর্ম উপস্থাপিত হয়েছে। ষাটের দশকের সঙ্গে আশি ও নব্বইয়ের দশকের শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। ফলে এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো কিউরেটরিয়াল ‘চিন্তা’কে ধরা যায় না। তবে বাংলাদেশের শিল্পীরা কী ধরনের কাজ করেন, সেটার একটা বিবর্তনমূলক আলোচনা চোখে পড়ে। শিল্পীদের নিয়ে বা এই গ্যালারি সম্পর্কে কোনো ধরনের বিস্তারিত তথ্য কোথাও নেই।

একই ব্যাপার লক্ষণীয় অন্যান্য গ্যালারিতেও। কোন উদ্দেশ্যে একটি গ্যালারিকে নির্দিষ্ট নকশার আওতায় ফেলা হয়েছে – তা কোথাও সুস্পষ্ট হয়নি।

শিল্পীদের শিল্পকর্ম বাছাইতে দেশি-বিদেশি বিচারক ছিলেন। কিন্তু বাছাই পর্বে কী ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়, তা উন্মুক্ত হওয়ার সময় এসেছে। বিয়েনালের আন্তর্জাতিক মান রক্ষায় এসব বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ না নিলে, এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিচর্যার সুযোগ রয়েছে, তাকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে না।

করোনাকালে শিল্পকলা একাডেমি-আয়োজিত একটি চিত্রকর্মের কর্মশালা থেকে নির্বাচন করা কিছু চিত্রকর্মের প্রদর্শন এখানে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। কারণ ভিন্ন একটি কর্মশালা বা আয়োজন থেকে কিছু শিল্পকর্ম নির্বাচন করে দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে উপস্থাপন বিষয়টি বেশ বিভ্রান্তিকর। উপরন্তু প্রদর্শনীটি যাঁরা দেখতে আসবেন, তাঁরা মূলত এই ‘দ্বিবার্ষিক আয়োজন’-এর বার্তা বা বক্তব্যই সন্ধান করবেন।

গত ১০ ডিসেম্বর লেখক অধ্যাপক নাজমা খান মজলিশের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ১৯তম এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর ‘হোম অ্যান্ড  ডিসপ্লেসমেন্ট’বিষয়ক সেমিনার শুরু হয়। দেশি-বিদেশি শিল্পী, শিল্পসমালোচক, বিচারকমণ্ডলী, পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণে একটি নির্দিষ্ট থিমে হওয়া এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিল্পী মোস্তফা জামান। এরকম একটি বিষয়কে নিয়ে এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের কেন্দ্রীয় থিম হতেই তো পারে। সরকারি অর্থ ও সহযোগিতার বিনিয়োগকে আরো কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা ভাবতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্প, সংস্কৃতি বিনিময়ের এই মঞ্চ  ঐতিহ্যগত বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি নতুন সম্ভাবনার পথ যাচাই করবে – এমনটাই প্রত্যাশা। সফলতার মান যাচাইয়ে, একটি আন্তর্জাতিক শিল্প-প্রদর্শনীর আয়োজন শিল্পীর ক্যারিয়ারের উন্নতিতে কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে তার নিরিখে অনেকটাই আয়োজনের সফলতা নির্ণয় করা যায়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এবারের ১৯তম এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে।