জাপানজয়ী বাঙালির অনুপম আখ্যান

পিয়াস মজিদ

আবুল আহসান চৌধুরীর (১৯৫৩) গবেষণাকুশলতার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন ধরা রইল বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল : এক বাঙালির জাপান জয় গ্রন্থে। উনিশ শতকের সমাজ ও সাহিত্য, ফোকলোর, সংবাদ-সাময়িকপত্র, আধুনিক সাহিত্য, আঞ্চলিক ইতিহাস, সংগীত-সংস্কৃতি, ভাষা-আন্দোলনের দলিলপত্র ইত্যাদি তাঁর গবেষক-আগ্রহের প্রিয় এলাকা। এছাড়া লালন সাঁই, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, মীর মশাররফ হোসেন, জলধর সেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেনের মতো রেনেসাঁস-ব্যক্তিত্বদের নিয়ে তাঁর রচিত এবং সম্পাদিত গ্রন্থাবলি আমাদের চেনা-পরিচিত গবেষণাছকের বৃত্ত ভেঙে অনুসন্ধান ও উদ্ঘাটনের নব নব চূড়া স্পর্শ করেছে।

আলোচ্য গ্রন্থে লেখকের বিনীত ‘নিবেদন’ –

এক অসাধারণ মেধাবী কীর্তিমান বাঙালি বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পালকে পাঠকের সমুখে তুলে ধরার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত ও আনন্দিত। দৈশিক ও বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে ড. রাধাবিনোদ পালের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানা আজ বিশেষ জরুরি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রসার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়, মানবিক মূল্যবোধের নিদারুণ অবক্ষয়, দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক আগ্রাসন, বিশ্বশান্তি যখন সুদূরপরাহত – এই প্রতিকূল সময়ে বিরূপ বিশ্বে বিবেকী বিচারক ড. রাধাবিনোদ পালের জীবনবাদী জ্ঞানের শিক্ষা, নির্ভীক সিদ্ধান্ত, দৃঢ় উদ্যোগ, কঠোর ব্রত আমাদের প্রেরণা ও পাথেয় হতে পারে।

লেখক-কথিত ‘প্রেরণা ও পাথেয়’র রসদ আমরা সংগ্রহ করতে পারি দুই পর্বে বিন্যস্ত এই বইয়ের ‘কার্যকারণ : পটভূমি’, ‘জন্ম ও ছন্দহীন পৃথিবী’, ‘গড়ে ওঠার কাহিনি’, ‘জীবনস্বপ্নের রূপায়ণ’, ‘মানুষ যে-রকম’, ‘সায়াহ্নের বিষাদগাথা’, ‘মহাযুদ্ধের বিচার-মহাকাব্য তাঁর’, ‘স্বাগত : সূর্যোদয়ের দেশে’ এবং ‘উত্তরকাল : স্মরণ-বিস্মরণ’ শীর্ষনামা পরিচ্ছেদসমূহ থেকে। পরিশিষ্টাংশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘টোকিও ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল : ভিন্নমতের রায়ে’র নির্বাচিত অংশ এবং দুর্লভ আলোকচিত্রমালা ও অন্যান্য তথ্যদলিলের একগুচ্ছ প্রতিচিত্র।

কে এই রাধাবিনোদ পাল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আটাশজন জাপানি রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে মিত্রশক্তির পক্ষে নিযুক্ত জাপানের সুপ্রিম কমান্ডার মার্কিন জেনারেল ম্যাক আর্থারের ঘোষণা অনুযায়ী নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের আদলে টোকিওতে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ গরষরঃধৎু ঞৎরনঁহধষ ভড়ৎ ঃযব ঋধৎ ঊধংঃ)। এই ট্রাইব্যুনালের বহুদেশীয় বিচারকদের মধ্যে ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল, যিনি মিত্রশক্তির একতরফা জাপানবিরোধী মনোভাবের বাইরে গিয়ে বিচারের রায় প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যায়ানুগ ভিন্নমতের উদাহরণ সৃষ্টি করে জাপানিদের কাছে ‘ন্যায়বিচারের বিরল প্রতিপোষক’ হিসেবে স্মরিত হয়ে আসছেন। শুধু এই ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে নয়,

বিশ্ববিচার-ইতিহাসেও বাঙালি বিচারক রাধাবিনোদ পালের এই ঐতিহাসিক রায় এক অনন্য সংযোজন হিসেবে বিবেচিত।

১৯৪৬-এর ২৭ এপ্রিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিযুক্ত হন ড. রাধাবিনোদ পাল। বিচারক নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই তিনি এই বিচারকার্য ঘিরে ঘনিয়ে ওঠা সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধির বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি বিচারকার্যে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত গোপনীয়তা রক্ষার সন্দেহমূলক শর্ত প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ শপথ নিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করেন। এ-সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য বিচারক হিসেবে রাধাবিনোদের ব্যতিক্রমী আইনি বলশালিতার বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটন করে –

জাপান সম্পর্কে মিত্রশক্তির প্রধান প্রতিভূ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার ছিলেন জেনারেল ম্যাক আর্থার। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ গরষরঃধৎু ঞৎরনঁহধষ জাপানের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে যে বিচার-আসর বসায় তার মূল কলকাঠি ছিল ম্যাক আর্থারের হাতে। এই বিচারকে ন্যায়ানুগ, আইনমাফিক, নিরপেক্ষ ও যুক্তিসিদ্ধ মনে করেননি ট্রাইব্যুনালের অন্যতম বিচারক ড. রাধাবিনোদ পাল। তাই তিনি ট্রাইব্যুনালের রায় সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে আলাদাভাবে একক রায় প্রদান করেন। তিনি আইনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জাপানকে নির্দোষ বলে সাব্যস্ত করেন এবং মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের বিচারকে প্রহসন বলে আখ্যা দেন। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, ব্রিটিশ-উপনিবেশ ভারতের এক বিচারকের কতখানি আইনি প্রজ্ঞা, স্বাধীন চিন্তা, মানসিক দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষ বিচারবুদ্ধি থাকলে এমন উজানে যাত্রা সম্ভব! (পৃ ৫৭)

ভিন্নমতের উপর্যুক্ত রায় কেবল বিষয়বস্তুর দিক থেকেই দৃষ্টান্তস্থানীয় নয়, পরিসরের দিক থেকেও এক অনন্য রেকর্ডের অধিকারী। সাইক্লোস্টাইলে বৃহৎ কয়েকটি খ-ে সমাপ্ত এই রায়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৩০৪, মতান্তরে ১২৩৫, যা এপ্রিল ১৯৫৩-তে কলকাতার সান্যাল অ্যান্ড কোম্পানি থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। আমরা মনে করি, যখন আদালতে বাংলায় রায় লেখার প্রণোদনা তৈরি হচ্ছে তখন ড. রাধাবিনোদ পালের এই যুগান্তকারী

রায়-পুস্তকটিও বাংলায় অনূদিত হওয়া প্রয়োজন, যে-রায়ে সূচিবদ্ধ আছে রাধাবিনোদের এমন সাহসী যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য –

আদালত যদি রাজনীতির মধ্যে শিকড় গাড়িয়ে বসে, তবে ন্যায়বিচারের যতই মুখোশ পরানো হোক না কেন তখন ন্যায়বিচার শুধু বলশালী পক্ষের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে পরিণত হয় মাত্র।

আবুল আহসান চৌধুরী প্রায় মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছেন এই মহীরুহপ্রতিম মানুষটির আদিঅন্ত। তাঁর লেখা থেকে জানতে পারি খ্যাতকীর্তি আইনজ্ঞ রাধাবিনোদ পালের জন্মনিবাস বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার হিসনা নদীর-তীরবর্তী শালিমপুর গ্রামে, আজ থেকে একশো বত্রিশ বছর পূর্বে, ১৮৮৬-তে। মায়ের অদম্য উৎসাহে, বৈরী পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, রাজশাহীতে স্কুল-কলেজে পড়াশোনাশেষে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন। নিজেকে প্রস্তুত করেছেন ভবিষ্যতের এক বিবেকী বাঙালি বিচারক হিসেবে। শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে তাঁর দৃঢ় মনোবল এবং অশেষ জ্ঞানানুরাগ যে ক্রিয়াশীল ছিল অনন্য আলকেমিরূপে লেখক তার মূল্যায়ন করেছেন এভাবে –

জীবনের প্রথম পর্বে রাধাবিনোদের চলার পথ আদৌ মসৃণ ছিল না, তার আংশিক বিবরণ আমরা দিয়েছি – আর যা অনুক্ত রইলো তাও কম দুঃখের কম বেদনার কম কষ্টের নয়। এদিক দিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে উত্তরকালে উচ্চপ্রতিষ্ঠিত খুব কম বাঙালির জীবনকেই রাধাবিনোদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ধাপে ধাপে তিনি উঠেছেন সাফল্যের ঈর্ষণীয় শিখরে – আইনের জগতে নীতি, আদর্শ, মেধা ও প্রজ্ঞার স্থায়ী ছাপ ফেলেছেন – অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি।   (পৃ ২৯-৩০)

তাঁর নিজের গোত্রের মানুষের হিতসাধনার্থে ‘নিখিল বঙ্গীয় কুম্ভকার সম্মিলনী’ গড়ে তোলার তথ্য নিম্নবর্গের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে রাধাবিনোদ পালের নিরন্তর কর্মপ্রয়াস প্রমাণ করে। ড. আবুল আহসান চৌধুরী বিস্মৃতির অতল থেকে রাধাবিনোদকে উদ্ধারের জন্য নিজে এই গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি রাধাবিনোদের ভগ্নি কৃষ্ণমোহিনীর দৌহিত্র গুণী বিজ্ঞানী ড. মনোজ কুমার পালকে প্রাণনা দিয়ে প্রণয়ন করেন দুটো স্মৃতি ও মূল্যায়নগদ্য ‘ড. রাধাবিনোদ পাল প্রসঙ্গে’ এবং ‘স্মৃতির আলোকে ড. রাধাবিনোদ পাল’। এ দুই স্মৃতিগদ্য আলোচ্য মানব-মহানের প্রতিকৃতি অঙ্কনের প্রয়োজনে বহু জরুরি তথ্যের জোগান দেয়। যেমন –

ময়মনসিংহে চাকুরিজীবন থেকে শুরু করে বরাবর ওঁর বাড়িতে একই সময়ে একাধিক আত্মীয়-অনাত্মীয় ছাত্র থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আমার বাবা, আমার নিজের তিন মামা, দাদুর এক মাসীর দুই ছেলে, তাঁর মামাতো বোনের দুই ছেলে, কাকার ছেলেরা – এঁরা বিভিন্ন সময়ে ওঁর বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করেছেন। অনাত্মীয়দের সংখ্যা নিরূপণ করা শক্ত। ওঁর বীডন স্ট্রীটের বাড়িতে আমি থাকাকালীন অন্তত তিনজন অনাত্মীয় ছাত্রের কথা মনে পড়ে। দাদু তাঁর ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিয়েছিলেন তাঁরা যেন এইসব আশ্রয়ার্থী ছেলেদের সবসময় তাঁর পরিবারভুক্ত মানুষ হিসেবে দেখেন। (ড. মনোজ কুমার পালের ‘স্মৃতির আলোকে ড. রাধাবিনোদ পাল’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত, পৃ ৩১)।

এর মধ্য দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব হয় যে, নিজে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকে লেখাপড়া করে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে তিনি বিস্মৃত হননি তাঁর আত্মীয়পরিজনকে এবং সাধারণ মানুষকে। তাই অনেকেরই শিক্ষাজীবনের নেপথ্যে আলোর সলতে হয়ে কাজ করেছেন নীরবে-নিভৃতে।

আবুল আহসান চৌধুরী গবেষণাকর্মকে কেবল বিবরণ দাখিলের ফর্দ হিসেবে বিবেচনা করেন না, তাই তাঁর সরবরাহকৃত তথ্যে বহুকৌণিক মাত্রা যোগ হয় আনুষঙ্গিক উপাত্ত-সমাবেশে। এই যেমন ১৯৪৪-৪৬ কালপর্বে তাঁর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন-সংক্রান্ত তথ্য পরিবেশনের পাশাপাশি এই পদ থেকে পদত্যাগের চাঞ্চল্যকর ঘটনাও তুলে ধরেছেন আইনজীবী বিশ্বনাথ বাজপেয়ীর লেখার সূত্র ধরে। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন রোধ করতে গিয়ে অভিযুক্ত পরীক্ষার্থীর হাতে পরীক্ষা পরিদর্শকের ছুরিকাহত হওয়ার ঘটনায় উপাচার্য রাধাবিনোদ পাল ঘটনাস্থলে এলে তাঁর গাড়িতে ইট ছুড়ে মারা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই পদের সম্মান ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করে আকস্মিকভাবেই উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি, যাকে আইনজীবী বাজপেয়ী তাঁর ‘উৎ. জধফযধ ইরহড়ফব চধষ : অং ও ৎবসবসনবৎ’ প্রবন্ধে ‘ডড়ৎশবফ রিঃয পষধংংরপ ফরমহরঃু ধহফ যড়হড়ঁৎ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। একই সঙ্গে আবুল আহসান চৌধুরী রাধাবিনোদ পালের প্রতি তাঁর আইনচর্চার ক্ষেত্র কলকাতা হাইকোর্টের অন্যায় আচরণের উল্লেখ করতে ভোলেননি –

আইনশাস্ত্রে যাঁর গভীর ও প্রগাঢ় জ্ঞান ও অধিকার, যাঁর অসামান্য আইনি প্রজ্ঞা ও মেধা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত – কলকাতা হাইকোর্ট বিচারক হিসেবে তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন করেছে এমন কথা বলা যাবে না। তাঁকে দুই দফায় হাইকোর্টে বিচারক নিযুক্ত করা হয় বটে, তবে দুইবারই এই নিয়োগ ছিল অস্থায়ী। তৃতীয়বার আবার তাঁকে অস্থায়ী বিচারক নিয়োগের প্রস্তাব দিলে প্রবল আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন ড. পাল তাতে কোনোক্রমেই সম্মত হননি।

(পৃ ৩৪-৩৫)

এই সংক্ষিপ্ত অথচ মহার্ঘ্য জীবনীগ্রন্থে আবুল আহসান চৌধুরী রাধাবিনোদ পালের রচনাসূত্রেরও সন্ধান দিয়েছেন আমাদের। ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ঐরহফঁ চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ খধি রহ ঃযব ঠবফরপ ধহফ চড়ংঃ-ঠবফরপ ঞরসবং চৎরড়ৎ ঃড় ঃযব ওহংঃরঃঁঃবং ড়ভ গধহঁ’ শীর্ষক যে গবেষণা-অভিসন্দর্ভের জন্য ডক্টর অব ল’ উপাধি অর্জন করেন তাঁর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে আইন এবং অন্যান্য বিষয়ে রচিত তাঁর গ্রন্থ এবং প্রদত্ত বক্তৃতার শিরোনাম ও সূত্র উল্লেখ করে আবুল আহসান চৌধুরী আমাদের মনে এই আশা জাগিয়েছেন যে, রাধাবিনোদের জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে তাঁর সম্পাদনাতেই প্রকাশিত হতে পারে – ড. রাধাবিনোদ পাল রচনাবলি, যা আইন বিষয়ে উৎসুক পাঠকের পাশাপাশি জ্ঞানান্বেষু যে কাউকে ন্যায়-ভাবনায় দীপান্বিত করবে।

জাপানিদের প্রতি মিত্রশক্তির একতরফা অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধ স্রোতে দাঁড়িয়ে যে কেবল তিনি ন্যায়পরতার পরিচয় দিয়েছেন শুধু তাই নয়, ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও জীবনের ছোটখাট ক্ষেত্রে কীভাবে তিনি ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন সে-কথা তুলে এনেছেন লেখক –

ভাইস-চ্যান্সেলর থাকাকালে ড. পালের এক ছেলে আইএসসি পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে দুই নম্বরের জন্যে ফেল করে। ওই বিষয়ের পরীক্ষক ড. পালকে তাঁর  ছেলের কথা বলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুই নম্বর জেনারেল গ্রেস দেওয়ার অনুরোধ জানান। বিষয়টি স্বজনপ্রীতি ও নীতিবিগর্হিত বিবেচনায়

ভাইস-চ্যান্সেলর ড. পাল সরাসরি তা নাকচ করে দেন। (পৃ ৪১-৪২)

আমরা এই অনন্য আখ্যানপ্রায় গ্রন্থ থেকে রাধাবিনোদের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার এবং সংগীত সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ প্রদানের কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য পাই, দৈশ্বিক এবং বৈশ্বিক পরিসরে ক্রমগুরুত্ববান হয়ে ওঠার পরও পারিবারিক দায়িত্ব পালন এবং পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির প্রতি স্মৃতিসত্তার টান অনুভব করা এক সহৃদয় মানুষের মানবিক মূর্তি সাকার হতে দেখি এবং সর্বোপরি যে-কোনো অবস্থায় ‘ঝরসঢ়ষব ষরারহম ধহফ যরময ঃযরহশরহম’-এর মর্ম শতভাগ পালনের ইতিবৃত্ত জানতে পারি।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কাঁকিলাদহ গ্রামে যেমন গত শতকের ত্রিশের দশকে অবসরযাপনের জন্য বাড়ি, বাগান, দিঘি তৈরি করেন রাধাবিনোদ পাল, তেমনি জন্মগ্রাম শালিমপুরের সম্পত্তির স্বত্ব ছোট কাকা এবং ছোট পিসিকে প্রদান করেও নিয়মিত সংস্কার এবং বাসোপযোগী ও পুনর্নির্মাণ করেন তিনি। এসবই ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের কাদামাটিজলের প্রতি তাঁর অমোচ্য টানের প্রকাশ। লেখকের ভাষায় –

মানুষ হিসেবে রাধাবিনোদ ছিলেন স্মৃতিতাড়িত। মাটি আর মানুষের কাছে গভীর ঋণ ও দায়বদ্ধতা ছিল তাঁর। জীবনে সাফল্যের শিখরে উঠেও মাটির স্পর্শবিচ্যুত হননি। শিকড়ের টান গভীরভাবে আজীবন অনুভব করেছেন মর্মে মর্মে। (পৃ ৪৯)

লেখকের মতো আমরাও মনে করি, বাংলাদেশে বর্তমানে অবহেলায় পড়ে থাকা আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান এই বিবেকী বাঙালি বিচারকের স্মৃতিচিহ্নসমূহের সংস্কার ও

যথাযথ সংরক্ষণ প্রয়োজন।

‘স্বাগত : সূর্যোদয়ের দেশে’ পরিচ্ছেদে এক বাঙালির হৃদয়িক জাপান জয়ের বৃত্তান্ত ধরা আছে। ১৯৬৭-র ১০ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু-উত্তর জাপানের সর্বমহলের প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি এখানে আমরা পাই নভেম্বর ১৯৭৪-এ তাঁর সম্মানে প্রতিষ্ঠিত ‘পাল-শিমোনাকা মেমোরিয়াল হল’-এর দেয়ালে ড. পালের হস্তাক্ষরে বাংলার বৈষ্ণব কবির কালজয়ী বাণী ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ প্রতিস্থাপনের অনন্য তথ্য। এছাড়া ১৯৯৭ এবং ২০০৫-এ টোকিওতে তাঁর প্রতিকৃতি এবং স্মৃতিফলক প্রতিষ্ঠার আনুপূর্ব বিবরণ আমরা পাই। স্থাপিত প্রতিকৃতির পাশে মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত রায়ের স্মরণীয় অংশ উদ্ধৃত করে জাপান এক বাঙালি বিচারকের প্রতি প্রদর্শন করেছে দুর্লভ সম্মান।

‘উত্তরকাল : স্মরণ-বিস্মরণ’ পরিচ্ছেদে ড. আবুল আহসান চৌধুরী সঙ্গতই বলতে চেয়েছেন বাঙালির বিস্মৃতি-বিলাসের শিকার হয়েছেন রাধাবিনোদ পালও। লেখকের ক্ষুব্ধ ভাষ্যে বিষয়টি উঠে আসে এভাবে –

তাঁর নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা, তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণা, তাঁর নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণ, তাঁর কর্মস্থল বা বাসস্থানের কাছাকাছি তাঁর নামে কোনো সড়কের নামকরণ, তাঁকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ, তাঁর একটি প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ রচনা ও প্রকাশের উদ্যোগ এখনো গ্রহণ করার সুযোগ আছে। অবশ্য আমরা হারিয়েছি তাঁর অতিক্রান্ত জন্মশতবর্ষ ও মৃত্যুর অর্ধশতক উপলক্ষ্যে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ এবং তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণের উপযুক্ত সুযোগ। এ-প্রসঙ্গে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের কল্যাণ-উন্নতি-শিক্ষার জন্যে সারাজীবন যে

অর্থ-শ্রম-সময় দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘নিখিল বঙ্গীয় কুম্ভকার সম্মিলনী’ – তাঁরাও কোনো কর্তব্য পালন করেননি। তাঁর

জন্ম-মৃত্যুদিন কারো উদ্যোগে পালিত হয়ে থাকে কিংবা তাঁর সম্পর্কে সংবাদ-সাময়িকপত্রে কোনো খবর রচনা প্রকাশিত হয় – এমন তথ্য আমাদের অজানা। জানি না এ-যাবত তাঁর সম্পর্কে কোনো স্মারক-ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়েছে কীনা! ড. পাল যেখানে জন্মেছিলেন, সেই স্থান এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত। সেখানেও যে উল্লেখ করার মতো কোনো কাজ হয়েছে, এমন কথা বলা যায় না।       (পৃ ৭২)

আমরা বলতে চাই বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল সম্পর্কে বিস্মৃতি মোচনের উল্লেখযোগ্য কাজটি তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশে বিশিষ্ট গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরীর হাতেই শুরু হলো; তাঁর রচিত বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল : এক বাঙালির জাপান জয় গ্রন্থের মধ্য দিয়ে।