জি মেন্ড উয়োর কবিতা

(উৎসর্গ : শিরিণ, কল্যাণীয়াসু)

ভূমিকা ও অনুবাদ : তিতাশ চৌধুরী
[‘আমি মঙ্গোলিয়ার যাযাবরদের সন্তান। আমরা অতি প্রত্যুষে বেরিয়ে পড়তাম। শৈশবে আমি একটি ডালিতে করে পণ্যবোঝাই উটের গাড়িতে চড়তাম। উটের মন্থরগতির থপ থপ করে চলার ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সকালের সূর্যকে স্বাগত জানাতাম। সম্ভবত সে-কালেই আমার ভবিষ্যতের কবিতাগুলোর ছন্দ কেমন হবে – তা অনুভব করতাম।’ এই কথাগুলো মঙ্গোলিয়ান কবি জি মেন্ড উয়োর।
জি মেন্ড উয়ো (G Mend-Ooya) মঙ্গোলিয়ার বর্তমান প্রধান কবিকণ্ঠ। তিনি মূলত এবং প্রধানত শেকড়-সন্ধানী ও ঐতিহ্যাশ্রয়ী কবি। তাঁর কবিতায় মঙ্গোলিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। ফলে এ-কবিতাগুলো পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের কবিতা থেকে স্পষ্টত ভিন্ন। কবি বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন তাঁর কবিতাকে অনেক ক্ষেত্রেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আবার তিনি শেকড়-সন্ধানী। তাই তিনি ধর্ম-দর্শনের মতো অনবরত নিজেকে খোঁজেন, আবিষ্কার করেন স্টেপের আলো-বাতাসে। সেখানেই তিনি সহজ, অবাধ। শহরে কর্মকোলাহল তাঁকে শান্তি দেয় না, স্বস্তিতে রাখে না, তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। নিজের মধ্যে, নিজের পরিবেশের মধ্যে এবং নিজের প্রকৃতির মধ্যে তিনি সতত সুখ অনুভব করেন। তাঁর নিজেকে খোঁজার এই যে অদম্য একাগ্রতা, সেই উপাদানই তাঁর কবিতাকে গতিময় ও ছন্দমুখর করে তুলেছে। পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও তাঁর কবিতার ঐতিহ্য নির্মাণ করেছে। তাঁর কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষাও অল্প দেখা যায় না। চিত্রকল্পও তাঁর কবিতাকে ঘের দিয়ে আছে। ‘নক্ষত্রের জীবনচক্র ও মানুষের পথচলা’ কবিতাটির চিত্রকল্পগুলো অসাধারণ দ্যোতনায় ও ব্যঞ্জনায় অপূর্ব। মূলত এই কবি আপন বলয়েই অধিকতর দীপ্তিমান ও উজ্জ্বল।
কবি উয়ো প্রধানত মঙ্গোলিয়ান জীবনধারা ও সংস্কৃতিকে তাঁর কবিতার উপজীব্য করেছেন। মঙ্গোলিয়ার ভাষার যে একটি চমৎকারিত্ব আছে, সুর ও ছন্দ আছে, – আছে ধ্বনি-মাধুর্য, তাও তিনি তাঁর কবিতায় উপস্থাপন করেছেন।
উয়োর কবিতা ইংরেজি, জাপানি, হাঙ্গেরিয়ান, রুশ ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং সাহিত্যের জন্য তিনি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন।
কবি উয়ো ১৯৫২ সালে মঙ্গোলিয়ার দরিগঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭০-এ প্যাডাগুজিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৯৬ সালে মঙ্গোলিয়ান ইউনিভার্সিটি অব আর্টস অ্যান্ড কালচার থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড কালচার থেকে তিনি সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ২০০২ সালে। তিনি Arts and Culture at the Institute of International Studies, Mongolian Academy of Sciences-এর অধ্যাপক।
১৯৮০ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় – Birds of Thought নামে। এ-যাবৎ তাঁর ১৪টির মতো কাব্য, আলোচনা ও অন্যান্য গ্রন্থ বের হয়েছে। Golden Hill শীর্ষক তাঁর একটি কাব্য-ফিকশনও প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। তিনি বর্তমানে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাতরে বসবাস করছেন।
আমি এখানে জি মেন্ড উয়োর ছয়টি কবিতা অনুবাদ করেছি। এগুলো হলো : ক. ‘In search of myself’ (নিজেকে খুঁজি), খ. ‘All Shining Moments’ (সব উজ্জ্বল মুহূর্ত), গ. ‘The more I am alone’ (আমি যতটা নিঃসঙ্গ), ঘ. ‘Paradise and Swallows’ (স্বর্গ এবং দোয়েল পাখি), ঙ. ‘The Cycle of the life of stars and the way of men’, (নক্ষত্রের জীবনচক্র এবং মানুষের পথচলা) এবং চ. ‘Song of the Moon’ (জ্যোৎস্নাসংগীত কিংবা চাঁদের গান)। এই কবিতাগুলো জি মেন্ড উয়োর A Patch of White Mist কাব্যগ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে।]

নিজেকে খুঁজি

যেন শূন্য বিশ্বব্রহ্মান্ডের বাইরে বিচরণ
যেন পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে পুনর্জাগরণ
প্রত্যেকের মাঝখানে আমি যেন লুকায়িত
প্রতিক্ষেত্রেই আমার যেন পরিবর্তন ঘটছে
এবং সব কিছুতেই।

প্রতিক্ষণে-প্রতিমুহূর্তে আমি নিজেকে খুঁজি
ঘাসের শরীরে, আঙুলের কষ্টে
এবং পরিষ্কার আকাশের তাঁবুর নিচে।

আমি বন্য স্টেপ (steppe), প্রচন্ড ঝড়ের বেগে দৌড়ুই
ভবঘুরে শুভ্র মেঘলোকে পা দুটো গুটিয়ে বসি;
আমি যেন চাঁদহীন অন্ধকার রাত্রিতে একাকী একজন
আমি যেন বিভ্রান্ত পত্রগুচ্ছের কণ্ঠস্বর
আমি নিজেকে খুঁজি পর্বতের নীল কুয়াশায়
আমি পৃথিবীর শেষ বৃদ্ধটির সঙ্গে স্বর্গারোহণে যেতে চাই –
যে আমাকে সুরপূর্বক মহাকাব্যিক গল্প শোনাতে পারে।

আমি বৃক্ষপত্রালির শিরার ভেতর দিয়ে –
সূর্যালোকে প্রবেশ করি এবং শরতে আকাশে
নীড়ে ফেরা পাখিদের জন্য শোকার্ত হই
আমি বসি
এবং হাজার বছরের এক পাথুরে মানুষ আলিঙ্গন করি
আমি চকচকে নদীর জলে ডুব দিই
এবং কঠিন শিলার সঙ্গে ক্ষয়প্রাপ্ত হই।

আমরা উভয়ে নিস্তেজ চাঁদের আলোর মতো
যেন আমি যমজ কোনো নারীর উষ্ণ অশ্রুবিন্দু
এটি যেন অনন্ত সময়ের সংক্ষিপ্তসার, যখন তা প্রবাহিত হয়
আমি যেন তার ঈশ্বর, তাকে স্বাগত জানাই
মেঘের সঙ্গে আমি আমার বিষণ্ণতাকে
অনাগত শীতে লুকিয়ে রাখি
এবং পর্বতগুলোর সঙ্গে নিজ বাসভূমে আমিও বুড়িয়ে যাই।
নদীর মতো আমি ফি বছর প্রবাহিত হই
এবং লিলিফুল গাছের শেকড়সুদ্ধ আমি জঠরে ঢুকি

পৃথিবীর অগণিত স্থানে আমার অবস্থান
আমি সর্বত্র ঘুরে বেড়াই
এবং নিজেকে প্রকাশের জন্য আমি যত্রতত্র বিচরণ করি
এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হই
নক্ষত্রের এক ভিন্ন পর্যবেক্ষণে
আমার রূপান্তর ঘটে
এবং পৃথিবীর নানা মানুষের ভেতর
আমি তখন নিজেকে খুঁজি।

 

সব উজ্জ্বল মুহূর্ত

অন্ধকার থেকেই কেবল উজ্জ্বলতম আলো আসে
এবং গোধূলিকালেই রমণী সুন্দর।
সন্ধ্যাবেলায় কানের দুল উজ্জ্বল
এবং রাত্রিতে অশ্বপৃষ্ঠের গদির পেরেক।
গুমুদা ফুলগুলো সন্ধ্যায় ফোটে
ঘরমুখো অশ্বগুলোর দিনশেষে হ্রেষাধ্বনি

গোধূলি আলোর গান
মানুষের মেজাজকে উজ্জীবিত করে
বস্ত্তত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা থেকেই
অধিক আলো আসে; মেঘের ফাঁক দিয়ে
যে-সূর্যালোক – সেটিই সবচেয়ে উজ্জ্বল।
এবং কর্ম (karma) সত্যের প্রাণরস
ধূমকেতুর ছটায় আলোর অপূর্ব উদ্ভাসন
এবং একটি পুত্রসন্তানের জন্মের ভেতর দিয়েই
বিশ্বব্রহ্মান্ড আলো ছড়ায়।
আমি যতটা নিঃসঙ্গ

আমার মনে হয় পৃথিবীর আহবানেই আমি স্বর্গচ্যুত হয়েছি
আমার বিশ্বাস, আকাশের উজ্জ্বল কালপুরুষ থেকেই আগুনের সৃষ্টি,
এবং নক্ষত্রের গল্প পৃথিবীর স্বপ্ন থেকেই নেওয়া
আমি একাকী নিঃসঙ্গ, আমি কেবল নিজ সত্তা নিয়েই ভাবি।

আমি যতটা একাকী, ততটাই আমি নিজেকে স্পষ্ট দেখি।
আমি যতটা একাকী – ততটাই আমি অন্যের নিঃসঙ্গতা অনুধাবন করি।
আমি যতটা একাকী – ততটাই আমি কোনো অদৃশ্য সত্তায় মিশি
আমি যতটা একাকী – ততটাই আমি শ্রবণাতীত সংগীত শুনি
বস্ত্ত একাকিত্বের এই স্বাধীনতা আমার উপভোগের বিষয়।

একমাত্র জার (ger)*, যদিও অস্পষ্ট
কিন্তু তা স্টেপে সমতলের ওপর শাদা হয়ে দেখা দিয়েছে;
একমাত্র পাখি – যদিও স্পষ্ট, দৃশ্যগোচর, তবু মেঘমুক্ত আকাশে চক্কর খায়
একমাত্র ঘোড়া – দিগন্ত থেকে আমার দিকে ছুটে আসে।
এবং এইসব স্বর্গীয় কবিতাই আমার অভিজ্ঞতা।

আমি যতটা নিঃসঙ্গ – ততটাই আমি ঘাসের গভীরে প্রবেশ করি
আমি যতটা নিঃসঙ্গ – ততটাই আমি আমার পূর্বপুরুষের সত্তায় মিশি
আমি যতটা নিঃসঙ্গ – ততটাই আমি অনাসৃষ্টি জ্ঞানকে আহরণ করি,
আমি যতটা নিঃসঙ্গ – ততটাই আমি উজ্জ্বল শাম্ভালার (shambhala) নৈকট্যে পৌঁছুই
কারণ নিঃসঙ্গতা শক্তির ভেতরই আমি উষ্ণতাকে খুঁজি পাই।

স্বর্গ ও দোয়েল পাখি

নীল স্টেপে মরীচিকা যেন কোনো স্বর্গীয় শহর
আমার পূর্বপুরুষেরা চিরকালের সেই স্বর্গে শুধু
দোয়েল পাখি কেবল নির্জন স্টেপে উড়ে বেড়ায়
আর আমার পৈতৃক স্বদেশে আমাকে স্বাগত জানায়।

আকাশ একটা নীল কুয়াশায় ঢেকে গেছে
এবং দোয়েল পাখিগুলো একাকী কেবল
মেলে ধরা ডানায় ভর করে সুদূরের পানে ধেয়ে চলে।…
নক্ষত্রের জীবনচক্র এবং মানুষের পথচলা

হেমন্তের চাঁদের আবির্ভাব স্থানীয় পূর্বপুরুষদের স্বাগত জানালো
কেমন করে এই চাঁদটি যেন একটি কানের রুপোলি দুল? যেন জানাশোনা কেউ?
আমার মনে পড়ে – আমি যখন বিশের কোঠায়,
তখন গ্রীষ্মের শেষের পুরনো চাঁদ, কানের দুলে
পাথরের রূপ নিয়েছে – যা তোমার সুশীলতারই রূপ।

মেঘে ঢাকা নীল আকাশের শামিয়ানার নিচে
চাঁদটি যেন একাকী অনুজ্জ্বল পৃথিবীর একচ্ছত্র সম্রাট
পাথরের চুড়োয় তারাগুলো মিটমিট জ্বলে – হয়তো বা
তাদের জীবনের যৌবনের কথা ভেবে
যখন দিগন্ত নীল পর্বত অতিক্রম করে।

নক্ষত্রের জীবনচক্র এবং মানুষের পথচলা
এবং আমাদের যৌবন অবশেষে একটি পরিবার হয়ে যায়।
আমাদের স্বর্ণালি বংশধারার জন্য নীল স্বর্গকে বিশ্লেষণ করবো
এটা কি থাকবে, – বংশপরম্পরায় আমরা এ নিয়ে কি ভাবি?

আমার পুত্রবধূ আবারও কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে।
এবং আমি নাতি বিলুডির জন্য একটি শেয়াল মার্কা টুপি বানিয়েছি
স্টেপের ওপর দিয়ে আটটি ঘোড়া দৌড়াচ্ছে
শিশুর গালে একটি ছোট্ট লাল ফল – ডিম্বাকারে অাঁকা হয়েছে।

এই জিনিসগুলো একসময় হারিয়ে যায়
নদীর জলে ঝরনার স্রোত এসে কখন মিশে যায়।
সকালের সূর্যের ছটার মতো আমার শুভ্রকেশ বাতাসে ওড়ে,
রাজহংসগুলো যখন ফেরত দেওয়া হয়, তখন কি
*গঙ্গানার (ganga nuur) সম্পর্কে কোনো বৈঠক হয়?

সময় বয়ে যায় এবং উজ্জ্বল তারার মতো জ্বলে ওঠে,
বাড়ি থেকে অনেক দূরে আমি, আমার কষ্ট হয়
যখন ভাবি – আমার স্ত্রীর হাতের চা খেতে পারি না।
আমার চুল যখন কালো ছিল, আমি তখন কিছু
বই লিখি এবং সেগুলো ছিল আমার বংশধর সম্পর্কে।
সময়ের শুভ্র মেঘমালা আমাকে এখন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।…
জ্যোৎস্নাসংগীত কিংবা চাঁদের গান

চাঁদের রুপোলি জ্যোৎস্নার কালিতে
আমি কলম ডুবিয়েছি;
অনন্তের শাশ্বত উজ্জ্বলতায় তার উৎকর্ষের ছবি।

গল্প-বলা চাঁদের ছটায় আমি
আমার দৃষ্টির চৌহদ্দিতে জাল বুনেছি;
আমার সন্তানের মতো কবিতাগুলোকে
আমি রেশমি সুতা দিয়ে সেলাই করেছি।

উজ্জ্বল স্ফটিকের মতো চাঁদে
আমি আমার কঠিন হৃদয় রেখেছি;
এবং অন্ধকারে আমার কবিতা থেকে
ছুটে বেরোয় রুগ্ণ ঘোড়ার দল।

তবু জ্ঞানী চাঁদের আলোয় আমি
আমার গানের মহিমা তুলে ধরেছি
অবশেষে আমার কবিতা তার উজ্জ্বল আত্মাসমেত
*শাম্ভালার আলোতে আশ্রয় নিল।

টীকা
জার (ger) : স্থানান্তরযোগ্য আবাস।
স্টেপ (steppe) : শুষ্ক ও তৃণাবৃত এবং নিষ্পাদপ প্রান্তর।
জার (ger) : স্থানান্তরযোগ্য আবাস।
গঙ্গানার (ganga nuur) : মঙ্গোলিয়ার একটি পর্যটন স্থান, যেখানে রয়েছে গাছগাছালি,
বাহারি ফুল, নানারকম পাখি, লেক ও অন্যান্য প্রাণীর অভয়ারণ্য।
শাম্ভালা (shambhala) : বৌদ্ধদের পৌরাণিক সাম্রাজ্য।