জীবনের ঘরে মৃত্যু

ভোরের একপশলা বৃষ্টির পানি তখনো শুকায়নি, দীর্ণ হেয় জনপদে পুরো জেগে ওঠেনি কোলাহল, পাড়াগাঁর হাটের পসরা টানা ভ্যানগাড়িগুলো সারিসারি দাঁড়ানো, ছাপরা দোকান থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলা পচা টক-মিষ্টির টুকরো ধরতে কাকের ঠোঁট-নখের বেজায় পাখসাট, ঠিক তখন বাতাসে আত্মনাশের খারাপ খবরটি ঘরের দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে জনে জনে চাউর হয় – কাল রাতে অল্পবয়সী স্বামী-স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়েছে, এখন তাদের মরদেহ পুলিশের কব্জায়।

কোন উজবুক স্বামী-স্ত্রী হঠাৎ দুনিয়ার এতো আমোদ, এতো আলো-হাওয়ার ভোগ খারিজ করে গেল! ফোঁড়ের ওপর ফোঁড়, তছনছ কথা চালাচালির মধ্যে পাওয়া গেল আসল হদিস – ভাসার হাট থেকে উত্তরে বয়ারসিংহ গ্রাম, জমাট বনবাদাড়ে ভর্তি, পাশ দিয়ে গেছে হালের বিটুমিনের চওড়া রাস্তা, পিরোজপুর থেকে ছেড়ে আসা বাস দৌড়ে যায় ভিন জেলায়, কাঁহা কাঁহা মুলস্নুকে, এমনকি ঢাকার উদ্দেশে, দুপাশের গাঢ় সবুজ গাছের লম্বা পাতাগুলো নড়েচড়ে কেবল ইশারা দেয়, তার ভেতর দিকে আরো খানিক উত্তরে প্রায় হুমড়ি-খাওয়া ছাউনি, ওই দোচালা ঘরের মানুষ দুটি নিঃশব্দে নিজ হাতে জীবন সাঙ্গ করে গেছে।

এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবরে স্থির থাকার উপায় কই – আরিফ বড়ভাইয়ের পুরনো সাইকেলে প্যাডেল মেরে সোজা চলে এলো থানায়। মৃত্যুর পুলিশি তদন্ত বা জনান্তিকে কোনো ক্লু পেলে আজই মফস্বলের এই অপমৃত্যুর পাঁচালি উড়িয়ে দেবে সে ঢাকায়। থানার সদর মুখের বয়সী বটগাছের বুড়ো ডাল-পাতা বাতাসে ঝমঝম বাজনা তুলে আরিফকে বুঝি স্বাগত জানায়। রাস্তার বাঁপাশে গড়ানে ভূমি, পাশে ঘোলা পানিভর্তি লম্বা খাল, তার ওপাশে সারি সারি গাছগাছালি – নিবিড় সবুজ এখন খুব বেশি ম্লান মনে হয়।

লাশ দেখতে দেখতে আরিফ বিরক্ত। ব্যাপারটা কিছুতেই এখন তার সহ্য হয় না। কে না জানে এসব অপমৃত্যুর ডেডবডি মর্গে কাটাছেঁড়া করবে ডোম আর দেখে দেখে সুরতহাল রচনা করবে কোনো ছোকরা ডাক্তার। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট শুনে যে কেউ মাথা না-খাটিয়ে বুঝতে সমর্থ – মৃত্যু নিয়ে একটাই কারণ খোঁজা – হত্যা, না আত্মহত্যা! আজকাল গণ্ড গাঁ-গ্রামেও কোনো কারণ ছাড়া এত বেশি বেশি মরামারি বেড়েছে যে, গোটা বিষয় নিয়ে ঘেন্না ধরে যায়। ধরলে কি – ঘটনা তো ঘটনা, খবর বানাও। আজকাল কোথায় সাংবাদিক নেই? অসংখ্য পত্রিকার পেট ভরতে মানুষের কমতি নেই – নিদেনপক্ষে পরিচয় দেওয়ার জন্য আইডি কার্ড একটা পেলে ধন্য। এই তাঁরা নিজ নিজ পত্রিকায় রিপোর্ট পাঠাবেন। হাত অলস রাখলে পরদিন ঢাকা থেকে আরিফের কাছে ফোন এসে যাবে – নিউজটা আমরা মিস করেছি, ব্যাপার কী, নতুন কাউকে কি নিয়োগ দিতে হবে?

ভেতরে বিমর্ষ চেহারা নিয়ে ওসি সাহেব বসে আছেন। সাধারণত কোনো কেস না থাকলে সকাল সকাল কাজে তিনি আসেন না। কার সাধ্যি তাকে ঘুম থেকে তোলে। অতিজরুরি কিছু না হলে থানার চৌহদ্দিতে আসতে তার আগ্রহ হয় না। দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার মুখে মন্থরপায়ে এসে থানার মাঠের ছায়ায় বসে সাক্ষাতে আসা লোকজনের কথাবার্তা শোনেন। হাসি-তামাশাও মানুষটা জানে। অফিসার-ইন-চার্জ মো. ইসহাকের চেহারায় ভেসে থাকা যুবা ভাব আজো মুছে যায়নি। শ্যামলা রঙের সুঠাম লম্বা ওসিকে পুলিশি কাজে কখনো কখনো বেমানানও মনে হয়। বিচিত্র তার নিয়ম – এলাকায় ঘুরে ঘুরে দাগি চোর-বাটপাড় জোগাড় করে তাদের যার যার এলাকায় সিভিল ডিফেন্সের কাজে লাগিয়ে দেন, চুরি বা কোনো অপরাধ যদি হয় তারাই দায়ী। এই থানার দায়িত্বে আসার কিছুদিনের মধ্যে বিভিন্ন ডাকাতের নামধাম তিনি সংগ্রহ করেন। তাদের  ডাক পড়ল থানায় – ব্যাপার কী? রোজ রাতে যার যার বিছানা নিয়ে থানার বারান্দায় তাদের ঘুমাতে হবে। দিনে যে-যার বাড়ি যাও। কোনো রাতে কেউ থানায় না এলে জোর শাস্তি আছে তার। কখনো কখনো ওসির কীর্তি দেখে মনে হয়, বুঝি এই মানুষটা অন্য মানুষকে ছোট করতে পারলে পরম তৃপ্তি খুঁজে পান। সুযোগ নিয়ে সাংবাদিকদের ঠোঁট উজাড় করে ধমকান, আবার তিনিই ডেকে এনে তাঁদের গোপন তথ্য সরবরাহ করেন।

ধীরপায়ে আরিফকে ভেতরে ঢুকতে দেখে নজর জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে গম্ভীর স্বরে রম্নমে তিনি নিনাদ ছড়ান – ‘আসেন সাংঘাতিক সাহেব, আসেন।’ আরিফ জানে ওসি মো. ইসহাক সাংবাদিকদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপযোগে কখনো কখনো সাংঘাতিক বলে ডাকেন। এমন সম্বোধন শুনতে শুনতে আরিফদের কেউ আর অপমানজ্ঞান করে না। তার আলাপের ধরনই এমন।

আরিফ নিশ্চিত, ওসির মুখচ্ছবি জানান দিচ্ছে মহাবিরক্ত সে। তার মন-শরীর বুঝি নিজের ইচ্ছার বিরম্নদ্ধে দূর বাজে একটা উপজেলার স্যাঁতসেঁতে থানার রং-জ্বলা চেয়ার-টেবিল, ছাই-ছায়া রুমের নোনাধরা গন্ধের মধ্যে পড়ে আছে। প্রমোশন পেলে ওপর মহলে তার স্বাস্থ্য এখন আলো করে থাকত। করা কী! ডিউটি বলে কথা – আজকাল সর্বক্ষণ সতর্ক থাকতে হয়। হেলাফেলার উপায় নেই। জোয়ান একজোড়া মানুষের সুইসাইড এখান থেকে সেখানে, জেলা সদরেও এতক্ষণে পৌঁছে গেছে।

আরিফ হাতলভাঙা চেয়ার টেনে টেবিলের এপাশে বসতেই ওসি সাহেব লাল চোখের ফোকাস তুলে আপনমনে বলে যান – ‘মরেছিস? মরার কারণটা কারো কাছে অন্তত বলে যা। লেখাপড়া জানিস? লিখে রেখে যা। আমাদের খাটুনি কমে গেল। এখন দৌড়াও, তদন্ত করো, যাও স্পটে, জনে জনে জিজ্ঞাসা করো। পোস্টমর্টেমের ওপর কেবল নির্ভর করলে হচ্ছে না। মেরে-ধরে কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে কি না। এই ছোটলোকগুলো জন্মেছেই মরার জন্য। নিজে মরবে অন্যদেরও মারবে। আপদ সব।’

মানুষের মৃত্যু নিয়ে ওসির মুখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের এমন বয়ান আরিফ আগে শোনেনি। থানায় সে পয়লা আসছে না। খবরের ভেতরের খবর বের করার প্রয়োজনে থানার কর্তাদের সঙ্গে সখ্য তাকে রাখতে হয়। আজ হলো কী! এই অফিসের মাতবর এতো বিরূপ থাকলে কথা স্টার্ট করে সে কেমনে!

ওসি তার লোমশ হাতদুটো টেবিলে নামিয়ে স্বরের গরম এবার নিভিয়ে দেন।

– ‘ভেরি স্যাড। কতই-বা বয়স, আহ্…হা, দুই-দুটো তাজা প্রাণ, মরার ইচ্ছে হতেই তোদের অমনি গলায় ফাঁস নিতে হবে?’

দেখো কাণ্ড, একই লোক মৃত্যু নিয়ে এখন আফসোস করছে।

এক যুবক ইন্সপেক্টর বুটের আওয়াজ তুলে রুমে ঢোকে। পরনে পরিচ্ছন্ন ইউনিফর্ম, পরিপাটি চুল, কেবল পেরেশানে মুখ-গলায় ঘাম জমেছে, তার কণ্ঠে ক্লান্তিমাখা – ‘স্যার।’

ওসির উদ্দেশে স্বর পালটিয়ে সে চেয়ার ঘুরিয়ে বসে। – ‘স্যার, ইনকোয়ারি করে জানলাম পল্লী ব্যাংকে এদের লোন আছে। ঋণ শোধে হয়তো চাপ ছিল। খাওয়াই যখন জোটে না সেখানে কিস্তির টাকা দেবে কোত্থেকে। মনে হয়, ওরা লোন শোধ ফেল করেছিল। হাতে ছিল একটাই উপায় – সুইসাইড। সব ল্যাঠা শেষ।’

ওসি তার লালচে গোল চোখজোড়া দিয়ে মনে হয় কথা শুনছেন, নচেত ইন্সপেক্টর যুবকের মুখের ওপর অমন ফোকাস মেরে আছেন কেন! স্থির দৃষ্টি ধরে রাখার মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে তার কপালের ভাঁজে বিভিন্ন অর্থ উদিত হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। এবার ধীরে এমনভাবে ঘাড় নামিয়ে আনেন যেন মনে মনে ভয়ানক বিপদ গুনছেন। তার গলায় মুশকিলে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা এবার গড়াগড়ি দেয় – ‘ডেডবডি নিয়ে আবার ঝামেলা না হয়। ব্যাংক-ফ্যাংকের লোক দাবির ব্যাপারটা ভালো বোঝে। থানার সঙ্গে ফ্যাসাদ না হয়।’

মরার পর মানুষ হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে চলে যায়। যথাসম্ভব মাটির নিচে মরদেহ চালান করে সৃষ্টির সেরা জীবিত জীবরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তাহলে এই ওসি কার পক্ষে কথা বলছে? সামর্থ্যশূন্য মানুষের ঋণ ছিল, এখন তার লাশ ধরে টানাটানি করলে পাওনা চুকেবুকে যাবে? মানুষের সমসত্ম হুঁশ কি গোল্লায় গেছে? দেখো কাণ্ড, ত্যাঁদড়, পাকা খেলুড়ে ওসি আরিফের মনের কথা কেমন নির্ভুল ধরে ফেলেছে – ‘সাংবাদিকভাই, এ এমন এক পাওনা, প্রতিষ্ঠান বলে কথা, ব্যক্তিবিশেষের টাকা না, ব্যাংক, গ্রামগঞ্জের মানুষের ওপর আঙুল ঘুরিয়ে খায়।’

ওসি আর ইন্সপেক্টরের লক্ষ্যে আরিফ তাঁর চিবুক ধারালো করে – ‘এই আপনারা পল্লী ব্যাংক থেকে কখনো লোন নিয়েছেন?’

বলে কি, ঋণ, পুলিশকে আবার লোন নিতে হয় নাকি! উভয়ে নীরবে মাথা নেড়ে ঋণের ফালতু ব্যাপারটা নাকচ করে দেয়।

– ‘আপনাদের পরিচিত কেউ? আত্মীয়স্বজন কি লোন নিয়েছে?’

ইন্সপেক্টরের মেজাজ বুঝি ভেতরে ভেতরে উষ্ণ হয়ে উঠছে – বহিরাগতকে তার সাহেব থানার ভেতর অ্যালাউ করে কেন? গরম বাক্য দিয়েই তো একে নরম করা যায়। যত্তসব। সাংবাদিক বলে কথা। এখানে পোস্টিং হওয়ার পর থেকে সে দেখে আসছে স্যার এই পোকাটাকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন। গায়ে পড়ে সে কেন গোলযোগে যাবে? কোনো একটা মুখ ধরার জন্য ভাবনার ভেতর ঘোরাঘুরি করে ওসি ফের ভেসে উঠে মাথা নাড়ে। মানে লোন নিয়েছে পরিচিত এমন কারো কথা তার মনে পড়ছে না, কিংবা জানা নেই।

আরিফ এবার স্বর দৃঢ় করে তোলে – ‘যারা কোনো লোন নেয়নি তারাই পল্লী ব্যাংককে সাপোর্ট করে। বিষয় কি? গরিবের উপকার করছে। তারা জানে না, ঋণের সুদাসল তোলার নামে এদের টাইট ব্যবস্থা কত প্রকার, কত কিসিমের। লোন নিয়ে একটা গরু কিনলেন তো ঋণ শোধ না হওয়া অবধি গরুর গলার দড়িটা এতো পল্লী ব্যাংকের হাতে ধরা থাকবে।’ কৌতূহলী শ্রোতা দুজনের চোখের পলক পড়ছে না দেখে আরিফ এবার নিশ্চিত রায় দেওয়ার মতো বলে – ‘আপনাদের ঋণ করতে হয় না, পল্লী ব্যাংকের আসল চরিত্র আপনারা তাই জানেন না। যারা ঋণের জালে জড়িয়েছে, ওই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা তাদের  জন্য অসম্ভব। মানবসেবা, দারিদ্র্যবিমোচন – সব ভাঁওতা।’

ইন্সপেক্টর আরিফের উদ্দেশে এমন ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকে যে, ভাঁওতার সঙ্গে দারিদ্র্যবিমোচন ভারি শব্দের মর্মার্থ কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না। ইট-পাটকেল ছোড়ার মতো করে শক্ত শক্ত শব্দ সাংবাদিক থানার মধ্যে যদি ফেলতে থাকে তাদের জন্য তবে তা মুসিবত। আরে, এই সাংঘাতিক, দেখি আবার মুখ খুলছে। আরিফ বলে – ‘দেশে যত দিন ধরে ক্ষুদ্রঋণের তৎপরতা চলছে তাতে গরিবানা ঘুচে যাওয়ার কথা। হয়েছে কিচ্ছু? কিছুই হয়নি। যত চালবাজি। বলা হচ্ছে, দারিদ্র্য একসময় জাদুঘরে উঠবে। এমন প্রচার চরম মিথ্যা ছাড়া আর কী। ক্লাস সোসাইটি টিকিয়ে রেখে পোভার্টি নিরসন, অ্যাবসার্ড। ক্যাপিটালিজমের ব্রোকাররা নতুন নতুন ফন্দি আর কথা বাজারজাত করেই যাচ্ছে।’

ওসির মুখে হুট করে বিরক্তির সর মেখে গেছে। সে হাত তুলে আরিফকে নিবৃত্ত করে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। এই থানায় নতুন পোস্টিং নিয়ে আসা অধস্তন এক যুবক ইন্সপেক্টরের সামনে তার আশকারায় সাংবাদিক যথেচ্ছ গলাবাজি করছে। উহু, পজিশন তো খাটো হয়ে যাবে। এই সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয়ের পর বিভিন্ন কথাবার্তায় তার ধারণা হয়েছে ছাত্রজীবনে হয়তো সে বামপন্থি ছিল, এখন প্রাক্তন। এখনই তাঁকে থামিয়ে না দিলে থানার রুম বেমানান বিপ্লবী আওয়াজে ভর্তি হয়ে যাবে, যার বিন্দুমাত্র পুলিশের কখনো কোনো কাজে লাগবে না। – যত্তসব। কেউ কথা বলার সুযোগ পেলে ভাষণ একখানা দেবেই। নিজের জিভ কিছুতেই তারা সামলে রাখতে পারে না। – ‘সাংবাদিকভাই, আপনি এখন আসেন।’ ওসি মো. ইসহাক হালকা উষ্মার সঙ্গে আরিফকে থানা থেকে বিদায় করতে চান। – ‘ওবেলা আসেন। আমি নিজেই যাব ইনকোয়ারিতে। তদন্ত আর পোস্টমর্টেমের পর আত্মহত্যার কোনো-না-কোনো কারণ হয়তো পেতে পারি। নিউজ করবেন তো কোনো অসুবিধা নেই।’

এই ইঙ্গিতই আরিফের জন্য যথেষ্ট। নিউজ করার মতো ইনফরমেশন ওসি কখনো কখনো তাকে সাপস্নাই করেছেন।

 

বিকেলে, ছায়া তখনো পুরোপুরি শেষ বেলার আলো মুছে দিতে পারেনি। গাছগাছালির মগডালে দেখা যাচ্ছে পড়ন্ত রোদের খণ্ডাংশ। আশপাশের মাঠ পাড়ি দিয়ে আসা বাতাসের আরাম আমেজ জুড়িয়ে দেয় শরীর। তেমাথার ব্রিজ-লাগোয়া ধানভাঙা কলটা ভটভট শব্দ তুলে চলছে। হাটবার ছাড়া এমন মরা সময়ে থানা সদরের রাস্তাঘাট, দোকানপাটে ভিড়ভাট্টা তেমন থাকে না।

সিভিল ড্রেসে ওসি মো. ইসহাক তার মোটরসাইকেলের ওপর বসে ডান পা রাস্তায় রেখে মোড়ের মিষ্টির দোকানের এক লোকের সঙ্গে নিচুস্বরে কথা বলছেন। তার আশপাশে কেউ নেই – পুলিশ বলে কথা, তাও থানার বড়কর্তা – কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে গায়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অন্তরঙ্গ বাতচিত করবে। আরিফ রিকশা থেকে লাফিয়ে নামে। – ‘এই যে ব্রাদার, আপনি লেট। ওঠেন।’ বলে, ওসি তার লাল রঙের মোটরসাইকেলের পেছনে আরিফকে বসার ইশারা করেন। – ‘শক্ত হয়ে বসবেন। রাস্তায় পড়ে হাত-পা ভাঙবেন, আহত হবেন, দোষ হবে পুলিশের। সাংবাদিকের ওপর সাংঘাতিক পুলিশি নির্যাতন যেন শুনতে না হয়।’ হা-হা গলা ছেড়ে হেসে ওসি আশপাশ চমকে দেন।

 

ব্রিজ পার হয়ে হাওয়া কেটে উত্তরের রাস্তায় মোটরসাইকেল এগিয়ে যায়। আজকাল ইউনিয়নে বিটুমিনের ঢালাই রাস্তায় গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের যুবকরা তাদের মোটরসাইকেলে যেতে যেতে হেঁড়ে স্বরে গান ধরে বাতাস পীড়ন করে। শহর-গ্রাম এখন একাকার, আকাশ থেকে ঘরে ঘরে উড়ে আসছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিনোদন। পাকা রাস্তা দিয়ে হাত ঘুরে ঘুরে শহরের নেশা চালান হয়ে পাড়াগাঁর পেটে ঢুকে ছেলেপেলেদের বুঁদ করে রাখছে।

ইউনিফর্ম পরা না-থাকলে মো. ইসহাককে চলন্ত অবস্থায় থানার ওসি হিসেবে পরিষ্কার ধরা যায় না। আরিফের জন্য এটা বেশ স্বস্তির – পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে তো থানার মানুষের পেছনে তাকে দেখে তাদের ভুরু বাঁকা করার সুযোগ হচ্ছে না। ভালো ভালো। আরিফ এর আগে ওসির সঙ্গে গোপালপুর গেছে। সংখ্যালঘু পরিবারের এক মেয়ে মুসলমান এক যুবকের প্রেমে উধাও হলে এলাকায় দারুণ উত্তেজনা ছড়ায়। ওসির নির্দেশে ব্যাপক পুলিশি টহলে ধান্দাবাজ, কলহ-করা মানুষগুলো ফণা নামিয়ে ফেলে। ওই সময় আরিফকে সঙ্গে নিয়ে মো. ইসহাক গ্রাম চষে ছিলেন। সাম্প্রদায়িক উসকানিতে ভাটা পড়ে এলে কোনো খারাপ খবরই তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে না। মো. ইসহাক চাইছিলেন – তার এই কৃতিত্ব সাংবাদিকরাই প্রিন্ট মিডিয়ায় চাউর করুক।

 

মঘিয়া পার হয়ে ভাসা গ্রামের উঁচু কালভার্ট থেকে নিচে নেমে মোটরসাইকেল থামিয়ে দেন ওসি। এমন ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ার কারণ চারপাশে চাহনি দিয়ে আরিফ ধরতে পারে না। দেখা গেল, গায়ে ময়লা গেঞ্জি, হাঁটু অবধি লুঙ্গি তোলা চুপসানো চোয়ালের এক কাবু যুবক পাশের ঝোপ ফুঁড়ে এসে হাজির। লোকটি কি আগাম জানত এ-সময় থানার ওসির আগমন ঘটবে। আশ্চর্য!

– ‘সালামুলাইকুম, আইসেন স্যার, ভেতরে আইসেন, বইবেন।’ গাছপালার আড়ালে পড়া কোনো ঘরে বসার আহবানে সাড়া না দিয়ে মো. ইসহাক মোটরসাইকেলের স্টার্ট বন্ধ করেন। মানুষ নামের এই খোসাকে নিয়ে তিনি গোটানো পায়ে তফাতে এগিয়ে যান। স্বর নিচু রেখে কী সব বলাবলি হয়, যার বিন্দুমাত্র আরিফের কানে আসে না। আদৌ সে ধরতে পারে না – এই ওসি আদতে কোন কিসিমের লোক! কখনো রেগেমেগে জ্বলে উঠছে, দুর্ব্যবহারও করছে, হ্যাঁ অমন উলটাপালটা তার আচরণ অবশ্যই বাজে; আবার ভাই ভাই খাতিরে কাছে টেনে সুব্যবহার করছেন – এক মানুষের দুর্বোধ্য স্বভাব।

মো. ইসহাক ফিরে আসেন। জঙ্গলে মানুষটা উধাও হয়ে যায়। মোটরসাইকেলের হ্যান্ডেলের ওপর কনুই রেখে খবর শোনানোর মতো করে ওসি বলেন – ‘জার্নালিস্ট, নিজের থেকে এখনো সুইসাইড সম্পর্কে কোনো ইনফরমেশন আমাকে আপনি দিতে পারেননি। দাঁড়াল কী! আপনার কাছে কোনো তথ্য নেই। সম্ভবত আপনি খোঁজারও চেষ্টা করেননি। পুলিশের ওপর নির্ভর করছেন। ঠিক না?’

আরিফের মুখে কোনো কথা জোগায় না। ওসি তো ঠিকই বলছেন।

– ‘সাংঘাতিক সাহেব শোনেন, জমিলা ও আবদুল সুইসাইড করা ওই মানুষদুটোর কবর এতক্ষণে হয়ে গেছে। গলায় ফাঁস দিয়েই মরেছে। কিন্তু ডেডবডি দাফন করার কোনো মানুষই পাওয়া যায়নি। থানায় ইউডি আনন্যাচারাল ডেথ ফাইল করে আমরাই দক্ষিণের গোরস্তানে রেখেছি, আদমসন্তান বলে কথা। পল্লী ব্যাংক বলেন, বাপ-চাচা, ভাই-বেরাদর বলেন কেউই আসেনি। আসবে কোত্থেকে। থাকলে তো আসবে। সাবজেক্ট হচ্ছে একটা – হঠাৎ অল্পবয়সী স্বামী-স্ত্রী দুজন মরতে গেল কেন?’

মোটরসাইকেলে মো. ইসহাক ফের স্টার্ট দেন। সোজা-চওড়া রাস্তা ছেড়ে এবার কিছুটা সরুপথে যাত্রা শুরু। এ-অঞ্চলে দুপাশের গাছপালা, ঝোপঝাড় লতাপাতার ছাউনি এতো বেশি বেশি ও ঘন যে, আড়ালের ঘর-দরজা ধরা যায় না। আরে, জনমনুষ্যি কি সব গায়েব হয়ে গেছে? নাকি আত্মহত্যার ঘটনায় থানা-পুলিশের ভয়ে মুখগুলো গোপন হয়ে গেছে। চায়ের ছাপরা একটা পাওয়া গেল। এমন অজায়গায় বসবাসের অনুপযোগী ভুতুড়ে খণ্ডে চায়ের ছাপরা হয় কী করে! দেখো অবস্থা, চায়ের সামান্য সরঞ্জাম, কাপ-কেটলি সব আছে, অথচ উনুন জ্বলছে না। আরো পরে নাকি আড্ডাবাজ কাস্টমার আসবে, তখন পানি ফুটবে। ছাপরার মাঝবয়সী এক লোক তার কাঁচা-পাকা দাড়ির মধ্যে আঙুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জোর পায়ে আসার চেষ্টা করে। ছাপরায় এতক্ষণ বসে থাকতে থাকতে তার কোমর বুঝি জমে গেছে। আবার মোটরসাইকেলের স্টার্ট বন্ধ করেন ওসি। ছাপরার মানুষটার ঘাড়ে হাত রেখে তিনি কলাগাছের ঝাড়ের ভেতর ঢুকে যান। সত্যি সত্যি কোনো জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে কি থানা সদর লোকালয় ফেলে এখানে সে এসেছে, নাকি ঘোরের মধ্যে একা একা ভাঙাচোরা কিছু ছবি জোড়া দিয়ে মানুষ-এলাকা-গাছপালা-আকাশ-বাতাস তৈরি সে করছে – কোনটা? না, তার পাশে, এই তো স্পর্শের মধ্যে ওসির মোটরসাইকেল, সামনে-পেছনে চাকা, ধুলোও লেগে আছে দেখা যাচ্ছে।

মো. ইসহাক দ্রুত ফিরে মোটরসাইকেল স্টার্ট দেন। তার চোখ-মুখ দেখে মনে হলো হঠাৎ তিনি গম্ভীর হয়ে গেছেন, তার মধ্যে নতুন কোনো ভাবনার উদয় হয়েছে। আচমকা মোটরসাইকেল থেকে নেমে আসে সে – ‘অবাক হচ্ছেন, না? এসব গরিব-গুর্বো রাস্তার লোকগুলোই হচ্ছে আসল, আমার ইনফরমার। এদের কাছে যত খবর আছে তা আপনার-আমার কাছে নেই। আচ্ছা, জার্নালিস্ট সাহেব, আপনি কি জানেন – এই থানার কোন কোন এলাকায় সারারাত চায়ের ছাপরা খোলা থাকে। খদ্দেরও আসে।’

আরিফ দম দেওয়া কলের পুতুল হয়ে মাথা নাড়েন – সত্যি, এমন কিছু তার জানা নেই। মো. ইসহাক এবার ধমকে ওঠেন – ‘ধুর মিয়া, আপনি কিসের জার্নালিস্ট? নিজের এলাকার খবর রাখেন না। পারেন কেবল লম্বা লম্বা থিওরি আওড়াতে। এই থানার দায়িত্বে আসার আগে আরো তিন জায়গায় আমার পোস্টিং ছিল। আপনার মতো গ্রাম্য সাংবাদিক অনেক দেখেছি। এতো কম জানাশোনা মানুষগুলো কী করে সাংবাদিক হয়? আপনাদের সাংঘাতিক বলি কি খামোকা।’

আরিফের মুখের রক্ত সরে যেতে থাকে। ভেতর থেকে সে নিভে আসছে। তাকে মানসিকভাবে শায়েস্তার জন্য ওসির বুঝি আরো কথা আছে।

– ‘এই মোটরসাইকেলের তেল পুড়িয়ে সারারাত পেট্রল দিই। যখন যেদিন পেছনে কনস্টেবল একজন থাকে। দিনে থানার ডিউটিতে আসতে দেরি হয় কি খামোকা। এই যাদের পয়লা আপনি দেখলেন তাদের সঙ্গে আমার দেখাদেখি রোজ। এলাকার শয়তান-টয়তান দমনে আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ার্ক আমাকে করতে হয়। এদের দিয়ে করি। আচ্ছা, বলেন তো, গোটা থানায় চুরি-ডাকাতি আছে? বলেন?’

নিজের কৃতিত্ব আদায় করতে ওসি হতভম্ব আরিফকে এমন চাপের মধ্যে ফেলে দেন যে, হ্যাঁ-না-আছে-নেই – কোনো উত্তরই তার মুখে আসে না।

চায়ের ছাপরার ওই মানুষটা থেকে জানা ইনফরমেশন ওসি আরিফের কাছে পেশ করেন – ‘জানেন, আবদুল ছিল এতিম। ওর বাপ-মা মরেছে, না ওকে ছোটকালে ছেড়ে গেছে তা কারো স্মরণে নেই। এলাকার অবস্থাপন্ন এক লোক, এখন ঢাকাবাসী, তার দয়ায় তার জায়গায় দোচালা তুলে সে মাথা গুঁজে ছিল। আবদুলকে দিয়ে জায়গার দখলস্বত্ব কায়েম রাখা আর কি! গ্রামে তো কাজ নেই –  অভাব। ক-বছর ধরে আবদুল ধান কাটতে দক্ষিণে যায়। এবারের মৌসুমে গেলে ফুটফুটে বউ একটা তার জুটে যায়। পরিষ্কার করে কেউ তার বিয়ের বিষয় নিয়ে কিছু জানে না। কানাকানি আছে, ফর্সা সুন্দরী মেয়েটা পালিয়ে এসে আবদুলকে বিয়ে করেছিল। কারো কারো ধারণা, যে-মহাজনের ধান কাটতে দূর মুলস্নুকে সে গিয়েছিল বউটা ওই বাড়ির মেয়ে ছিল। আবদুলকে মনে ধরলে মাইল মাইল পাড়ি দিয়ে এসে পড়ে সে। মেয়েটির বাড়ির কেউ, আত্মীয়স্বজন কোনোদিন খোঁজ নিতে আসেনি। এলে তো অচেনা মুখের সঙ্গে কারো না কারো দেখা হতো। জানা গেছে, পল্লী ব্যাংকের লোন নিয়ে হাঁস-মুরগির খামার একটা শুরু করেছিল মাত্র, কিন্তু মড়ক লেগে হাঁস-মুরগি সব শেষ। লোন হয়ে গেল গলার কাঁটা।’ ওসি নিজেই এবার প্রশ্ন রাখেন – ‘কিন্তু গতকাল সন্ধ্যার আগে আগে এরা বাইরে কেন গিয়েছিল? এরা যখন যায় চায়ের ছাপরায় তখন নাকি বসা ছিল বাপ-বয়সী একজন। দুজনকে অবেলায় একসঙ্গে কোথাও যেতে দেখে তার কৌতূহল হয় – অসময়ে তোরা কই যাতিছিস। ছোট্ট একটা উত্তর আসে – পল্লীর অফিসে। জবাব শুনে ছাপরার মানুষ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে – বলে কী! পল্লী ব্যাংকে এখন কি যাওয়ার সময়? সত্যি বলবি না, বেশ বলিস না। মানুষজন ওই সময় নয় ভুল বুঝেছিল, এই দুজনের মরার খবর কেমনে জানাজানি হলো। কোল-কুঁজো হাড্ডিসার এক বুড়ি সকাল সকাল এসেছিল আবদুলের ছাউনির পেছনের অংশে হাজামজা পুকুরের উঁচু পাশ থেকে থানকুনির পাতা কুড়োতে। বুড়ির নাতির আমাশয় – বেটে খাওয়াবে। ঘরের দরজা হাট করা দেখে বুড়ি কচি বউটার সঙ্গে দু-চারটে আলাপ জুড়ে নেওয়ার জন্য ভেতরে ঢুকে দু-দুটো মানুষকে শূন্যে অমন ঝুলন্ত দেখে ত্রাহি চিৎকার তুলে মানুষ জড়ো করে ফেলে। ভীত মানুষজন থেকে চৌকিদার, চৌকিদার থেকে ইউনিয়ন মেম্বার, তারপর থানা-পুলিশ সব একাকার হয়ে যায়। মৃত্যুর কারণ কেউ বলতে পারেনি। সবাই অবাক। যাদের কোনো শত্রু নেই, ছাই ফেলার মতো ছটাকখানেক নিজস্ব জায়গা নেই, কারো সাতে-পাঁচে নেই, আত্মীয়-বান্ধব নেই তো রেষারেষি নেই, এই তাদের এমন হঠাৎ মরার সাধ হলো কেন?’

 

ধোঁয়া উড়িয়ে মোটরসাইকেল ফিরে চলেছে। ধূমল আকাশ থেকে সন্ধ্যা নেমে চারপাশের দখল নিচ্ছে। রাস্তার উঁচু-নিচু-ভাঙা অংশ চোখের আলোয় উপযুক্ত দেখা যাচ্ছে না। ভাবনা উপর্যুপরি খনন করেও আরিফ কিছুতেই নিজের গভীর থেকে জেগে উঠতে পারছে না। ওসি মো. ইসহাকের সঙ্গে বেরিয়ে আজকের তার অজানা কা-কারখানা জ্ঞাত হয়ে কিংবা দুটি প্রাণের আকস্মিক আত্মহত্যার গুপ্ত কারণের খোঁজাখুঁজি তার বোধ-বুদ্ধিতে বুঝি গিঁট এঁটে দিয়েছে।

– ‘জার্নালিস্ট ভাই।’

সামনে থেকে ওসির স্বর বাতাসে ভেঙে ভেঙে উড়ে আসে – পরিষ্কার বোঝা যায় না। আরিফকে তাই মুখ এগিয়ে ওসির কানের কাছে খানিক চেঁচাতে হয় – ‘কিছু বলছেন?’ ওসিও কণ্ঠ উঁচুতে নিয়ে যায় – ‘কেসের কিছু বুঝেছেন?’

আরিফ চুপ করে থাকেন। ঘটনার ভেতরে অবধি না পৌঁছে মন্তব্য করা তার মানায় না। মোটরসাইকেল ব্রেক কষে। টিনের ছাউনির কয়েকটা দোকানের পর ডানপাশে ইট-বিছানো সরু পথ গড়িয়ে গেছে নিচে, তার ওমাথায় একতলা দালান, সামনে বেড়া দেওয়া ছোট ফুলের বাগান – পল্লী ব্যাংক কার্যালয়, কচুয়া শাখা। মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখে মো. ইসহাক, থানার বড়কর্তার প্রভাব ছড়ানো ভঙ্গিতে এগিয়ে যান। পায়ের চাপে ইটের ফাঁক নড়েচড়ে ওঠার কারণে তার গটমট চাল উচিত-রকম ফুটে উঠতে পারছে না। অফিসের দরজায় ঢাউস একটা তালা ঝুলছে। মো. ইসহাক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। আরিফকে ওসির নাগালের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে। গরজ কি তার কম – রিপোর্ট লেখার জন্য পলকমাত্র ইঙ্গিতও যেন বাদ না যায়। এই পুলিশকর্তা তাঁকে সঙ্গে না নিয়েও তো বের হতে পারতেন। মওকা যখন পেয়েছে আঠা হয়ে তাকে সেঁটে থাকতে হবে।

– ‘আদাব স্যার।’ কাঁধের পেছনে হাঁপিয়ে-পড়া স্বর শুনে দুজনেই ঘুরে দাঁড়ায়। – ‘আমি ধলাই মৃধা স্যার। এহানের দারোয়ান। আপনেরে ঢুকতে দেইখে দৌড়ে আইছি।’ ধলাই বড় দারোগার নেক-নজরের আশায় মুখে একপ্রস্ত হাসি ধরে হাত কচলাতে থাকে। ভাবখানা, আঙুলের চামড়া খুলে দারোগাকে উপহার দিতে পারলে সে বুঝি কৃতার্থ হয়ে যাবে।

ওসি খপ করে ধলাই মৃধার রংনিশ্চিহ্ন আধময়লা হাফশার্টের কলার চেপে হিড়হিড় করে টেনে রাস্তায় নিয়ে আসেন। লিকলিকে এই মানুষটাকে এবার নোংরাজ্ঞান করে পাশের রেইনট্রির বাকল খসা গোড়ার কাছে নিয়ে আসেন।

ধলাই মৃধা একে তো হিন্দু, তার ওপর থানার বড় সাহেবের হাতের মুঠোয় ধরা অবস্থায় সে নিজের মেরুদণ্ড হারিয়ে কেন্নো হয়ে যায়।

– ‘ব্যাটা, সত্যি কথা বলবি।’

ওসির অমন রুক্ষ কণ্ঠের অর্ডার শুনে দুহাত জোড় করে ধলু ঘাড় গড় করে রাখে। প্রয়োজনে নিজের মুণ্ডু ওসির পায়ের কাছে নামিয়ে এনে তার জুতোর ধুলো পর্যন্ত মুছে দেবে। দণ্ডদানের কর্তার সামনে সে তো পোকামাকড় মাত্র। আর সত্যি কথা বলতে হবে! ডজন ডজন সত্যি, আজকের সত্যি, কালকের সত্যি, ভবিষ্যতের সত্যি, চৌদ্দগুষ্টির হারানো-ফুরানো সত্যি বমি করে দিতে সে বাধ্য। তার দুর্বল গলা থেকে রিনরিনে স্বর দারোগার দুই কদমের সামনে পড়ে জমে যায় – ‘কন স্যার, কী কতি হবে, কন স্যার।’ আ-হা-হা, দারুণ জ্বরের মতো কাঁপুনি দেখি বুকের খাঁচা ধরে কণ্ঠ বেয়ে ওপরে উঠে আসছে।

– ‘তুই তো ডিউটি করিস। হয়তো দেখেছিস, কাল সন্ধ্যার দিকে তোদের অফিসে কি অল্পবয়সী দুজন স্বামী-স্ত্রী এসেছিল?’

এই কথা! স্যার বলে কী? রোজ কতজন, কত ভাঙা-মচকানো-চুপসানো সাদা-কালো, সবল-দুর্বল মাইয়ে-পুরম্নষ লোনের টাকা জোগাড়ে আসছে, আর আসছে। লোনের আশায় কেউ কেউ অফিসের চেয়ার-টেবিলের নিচেও গড়াগড়ি দেয়, কিস্তির টাকা দিতে না পেরে কতজন কেঁদে-কেটে মাফ চেয়ে অফিস জল করে ফেলছে – এর আবার মিথ্যে কী।

ওসির উদ্দেশে ধলাই মৃধা নজর তুলে দিতে গেলে দেখো অবস্থা, তার দৃষ্টি খসে খসে আসে। বাধ্য হয়ে হাতের মধ্যে নিজের হাত নিয়ে আবার সে কচলাতে থাকে – ‘হ্যাঁ স্যার, কাইল অবেলায় দুডো ছেমড়া-ছেমড়ি আইছিল, স্বামী-স্ত্রী কি না তা কতি পারব না। তয় স্যার, সত্যি কতা কই – ওই যে ইউনুস মিয়া, আমাগো সাহেব, শালা অ্যাটটা আসত্ম বদমাশ, মাইয়েছেলে দেখলি খালি ছোঁক ছোঁক করে। কিস্তি না দিতি পারলি তো কতাই নেই। শালা মাইয়ে ছেলের গায়ে গিয়ে পড়ে। অফিসে তহন কেউ ছিল না। তা আমারে কয় বাইরে তুই ঘুরে আয়। আমি গেলাম। পেছনে চাইয়ে দেহি, ওই পুরুষডাও বাইরে আইসে দাঁড়াইছে। একা এদিক-ওদিক ঘুরে আইসে দেহি – মানুষ দুডো নেই। সাহেবেও নেই। দরজায় তালা।’

ইউনুস মিয়া পল্লী ব্যাংকের আঞ্চলিক প্রধান। কাকে লোন দিতে হবে, কার কাছ থেকে কী উপায়ে সুদ আদায় করতে হবে, কর্মচারীদের কাকে কোন কাজে কোন এলাকায় পাঠাতে হবে ক্ষমতার গরমে একাই সে সিদ্ধান্ত নেয়। মেয়েদের জড়ো করে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে প্রায়ই সে ক্লাস করে। তার ওপর খবরদারি করার মতো পল্লী ব্যাংকের এই কার্যালয়ে কেউ নেই।

ওসি ধলাই মৃধাকে ছেড়ে দেয়। – ‘কী বুঝলেন সাংবাদিকভাই?’

আরিফের উদ্দেশে হাঁক তুলে পকেটের রুমাল বের করে ঘাড়-গলা-মুখের ঘাম মোছে সে। ঘটনার গোপন সুড়ঙ্গের ও-মাথায় বিন্দু বিন্দু আলো দেখা যাচ্ছে বুঝে ওসির কণ্ঠ উপচে পড়ে – ‘ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান।’

আরিফের কান কোনো বাক্য বা শব্দ গ্রহণ করার মতো নেই। খুবই চঞ্চলতার এক তোড় টের পায় সে বোধের অতলে। তবে কি অবেলায় দেখা করতে বলে কিস্তির টাকা পরিশোধ না-করা বাবদ…? নিজের ভাবনাকে এবার কাপড় পরাতে চায় আরিফ। লজ্জায়-অপমানে অক্ষম স্বামী; আর অতিসাধারণ আলাভোলা বউ – দুজনেই নোংরা দুনিয়া একযোগে বাতিল করে গেছে। ঘটনা উলটেপালটে, ছিঁড়ে-খুঁড়ে আলোড়িত সত্য এখন বের করার ন্যায্য দায়িত্ব কেবল তার; সেখানে দারোগা বলো, থানা বলো, পুলিশ-মর্গ-পোস্টমর্টেম কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই।