তারেক মাসুদ তাঁর লোকচলচ্চিত্র

সাজেদুল আউয়াল

কেন শিরোনামে ‘লোকচলচ্চিত্র’ বলা, শুধু চলচ্চিত্র নয়? এ-প্রশ্নের উত্তর পেলে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র নির্মাণ-ভাবনার দিশা পাওয়া যাবে, কিছুটা হলেও। আমার প্রস্তাব হচ্ছে যে, আমাদের লোকশিল্পীদের শিল্পকর্মে স্থানীয় যেসব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য-চিহ্ন-এষণা-ভাবাদর্শ-রূপকল্প ইত্যাদি থাকে, তা তারেকের চলচ্চিত্রগুলোতেও লক্ষণীয়। আমার এই প্রস্তাবটিকে বৈধতা দেওয়াই বর্তমান রচনার প্রধান অভিপ্রায়।
তারেক মাসুদ তাঁর জীবনের প্রথম অংশ কাটিয়েছেন গ্রামীণ পরিবেশে। এই পর্যায়ে তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়, যশোরের গোপেরডাঙ্গায়, বোয়ালমারীর বাহিরদিয়ার মাদ্রাসায় পড়েছেন। মাদ্রাসাজীবন ও লোকজীবনের নানা অনুষঙ্গ তাঁর স্মৃতিসত্তায় গেঁথে গিয়েছিল। এটা হচ্ছে লোকসমাজ, লোকসংস্কৃতি ও প্রকৃতির সঙ্গে তারেক মাসুদের প্রথম ইন্টারঅ্যাকশন। এই পর্যায়ে তিনি লোকগান, নৌকাবাইচ, পুঁথিপাঠ, চৈত্রসংক্রান্তি তথা চড়ক পূজা, সূচিকর্ম, চিত্রাঙ্কন, মাটির তৈরি পশুপাখি, গ্রামীণ মেলা, বাহাস, বাতাসা প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হন।
দ্বিতীয় ইন্টারঅ্যাকশন ঘটে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সময়ে। সুলতান বৃহদার্থে লোকচিত্রকর। তাঁর চিত্রকর্মের একটা বড় অংশজুড়ে আছে বাংলার বৃহত্তর কৃষকসমাজের নানা লোকজ প্রসঙ্গ-উপাদান। এই প্রসঙ্গ-উপাদানগুলো তারেক মাসুদকে আকৃষ্ট করেছিল। নিজেরই ফেলে আসা শৈশবের সাংস্কৃতিক জীবনের একটা বর্ধিত রূপ খুঁজে পান তিনি সুলতানের চিত্রকর্মের মধ্যে। সেই গ্রামীণ ল্যান্ডস্কেপ, মানুষ, কৃষিকর্মে ব্যস্ত কৃষক, জীবজন্তু, গাছগাছালি, তৈজসপত্র, নানারকম অলংকার পরা কৃষাণী ইত্যাদি তারেকের ভাববলয়কে পাকড়াও করে ফেলে। এসময় তারেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়ন করছেন, কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকত চারুকলা ইনস্টিটিউটে। প্রধানত শিল্পী সুলতানের চিত্রকর্মের মধ্যে।
তৃতীয় ইন্টারঅ্যাকশনের সময় তিনি আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিধিবদ্ধ ছাত্র নন। তিনি তখন আমেরিকা প্রবাসী। উল্লেখ্য, শিল্পী সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরিতে (১৯৮২-৮৯) তিনি এতই আচ্ছন্ন হয়েছিলেন যে, তাঁর ইতিহাস বিভাগ থেকে মাস্টার্স করা হয়ে ওঠেনি, স্নাতক করেছিলেন শুধু। সম্ভবত তাঁর আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তেমন একটা উৎসাহ ছিল না। আমেরিকা বাসকালে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন নাগরিক-লয়ার লেভিনের তোলা ফুটেজের সন্ধান পান। এই ফুটেজে তারেক সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে গান করা একদল শিল্পীর সাক্ষাৎ পান। শিল্পীরা গণসংগীত এবং লোকগানের সুরে ও কথায় মুক্তি-অন্বেষু মানুষকে উজ্জীবনের প্রেরণা দিচ্ছেন। তারেক তৃতীয়বারের মতো লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশনে জড়িয়ে পড়েন। এই ইন্টারঅ্যাকশন না হলে, আমার বিবেচনায়, তারেক মাসুদ দেশে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতেন না, আমরাও চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদকে পেতাম না।
চতুর্থ ইন্টারঅ্যাকশন ঘটে সম্প্রতি, তাঁর চলে যাওয়ার আগের ক’বছরে। এসময় তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের লোকজ উৎসব, নানা ধরনের পার্বণ-মেলা এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিভিন্ন দিবস (একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ প্রভৃতি) নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে জড়িত ছিলেন। কি প্রামাণ্যচিত্র, কি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, কি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র – সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, জীবনের নানা পর্যায়ে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে তাঁর ইন্টারঅ্যাকশনের রিপ্রোডাক্টিভ ইমেজই চিত্রায়িত হয়েছে।

দুই
তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রকর্মে কীভাবে আমাদের লোকসংস্কৃতির নানা ইমেজ চিত্রায়িত হয়েছে, তা নির্ণয়ের জন্য তাঁর চলচ্চিত্রগুলোকে নানা শ্রেণিতে বিভক্ত করে দেখাটা জরুরি। তাঁর চলচ্চিত্রগুলো আমরা এভাবে বিভক্ত করতে পারি : প্রামাণ্যচিত্র – নিজের জন্য : আদম সুরত (১৯৮৯), আহ্ আমেরিকা (১৯৮৫), গণতন্ত্র মুক্তি পাক (১৯৯০), ইউনিসান (১৯৯২), মুক্তির গান (১৯৯৫), মুক্তির কথা (১৯৯৯), কানসাটের পথে (২০০৮)। প্রামাণ্যচিত্র – অন্যের জন্য : সোনার বেড়ি (১৯৮৭), শিশুকণ্ঠ (১৯৯৭), অন্য শৈশব (২০০২), নিরাপত্তার নামে (১৯৯৮), নারীর কথা (২০০০)। স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিধর্মী চলচ্চিত্র – নিজের জন্য : সে (১৯৯৩ – যৌথভাবে শামীম আখতারের সঙ্গে), স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিধর্মী চলচ্চিত্র – অন্যের জন্য : নরসুন্দর (২০০৯)। পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র – মাটির ময়না (২০০২), অন্তর্যাত্রা (২০০৬ – ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে) এবং রানওয়ে (২০১০)। অসমাপ্ত চলচ্চিত্র – কাগজের ফুল (পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র) ও নামকরণ না করা উৎসবভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র।

তিন
প্রামাণ্যচিত্র – নিজের জন্য
আদম সুরত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের ওপর নির্মিত তারেকের নিজস্ব এষণামন্ডিত চলচ্চিত্রকর্ম। এটি লোকসংস্কৃতির সঙ্গে তারেক মাসুদের দ্বিতীয় পর্যায়ের ইন্টারঅ্যাকশনের ফসল। শিল্পী সুলতানের চিত্রকর্মের মধ্যে যে গ্রামীণ সমাজচিত্র অাঁকা হয়েছে, আজীবন বাউন্ডুলে তারেক মাসুদ সেসব চিত্রকর্মের মাঝে যেন নিজেকেই ফিরে পান। তাই সবকিছু ফেলে তিনি দীর্ঘ সাত বছর শিল্পী সুলতান ও তাঁর চিত্রকর্মের চিত্রায়ণ করে চলেন। শিল্পী সুলতানের চিত্রকর্মের প্রতি অনুরক্ত হওয়ার পেছনে মনীষী আহমদ ছফা-রচিত ‘অভিনব উদ্ভাসন’ শীর্ষক একটি রচনা তারেককে প্রাণিত করেছিল। আদম সুরত তিনি ১৬ মি.মি. ক্যামেরায় চিত্রায়ণ করেছেন, যার চিত্রগ্রাহক ছিলেন আশফাক মুনীর মিশুক। দৈর্ঘ্য ছিল ৫৪ মিনিট। প্রাথমিক অবস্থায় এর নাম ছিল The Rebel Angel। পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তন করে রাখেন আদম সুরত (The Inner Strentgh)। নাম পরিবর্তনের প্রেরণা সম্ভবত তারেক পেয়েছিলেন সেলিম আল দীন-রচিত ও ঢাকা থিয়েটার-প্রযোজিত কেরামত মঙ্গল নাট্যযজ্ঞটি দেখে। ওই নাটকে আদম সুরত প্রসঙ্গটি ছিল।
আদম সুরত কিন্তু সুলতানের জীবনবৃত্তান্ত নয়, বরং তাঁর চিত্রকর্মের সারাৎসার উদ্ঘাটনের একটি সেলুলয়েডীয় চেষ্টা; তাঁর চিত্রকর্মের বিষয়বস্ত্তর স্বরূপ অন্বেষণ। সুলতানের চিত্রকর্মের বিষয়বস্ত্তর একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে বাংলার কৃষকসমাজের চাষবাস, তাঁদের সংস্কৃতি-উৎসব, ঘর-গেরস্থালির নানা প্রসঙ্গ। কৃষকতাই, আমার বিবেচনায়, সুলতানের কাছে মানবীয়তারূপে গণ্য হয়েছিল। আমার এমন ধারণা তাঁর সঙ্গে ১৯৭৬ থেকে মেলামেশা, তাঁর চিত্রকর্ম অধ্যয়ন এবং তাঁর সঙ্গে নড়াইলের পুরবাড়ীতে অবস্থান করে জন্মেছে। সুলতান নিজে পশ্চিমা বিশ্বের জীবনযাপন পদ্ধতি পরিহার করে জীবনের একপর্যায়ে বাংলার কৃষকসমাজের মধ্যে নিজেকে গুঁজে দেন।
এক অর্থে, সুলতান বাংলার লোকসংস্কৃতির কাছেই নিজেকে ফিরিয়ে আনেন। সেই বয়সে এই কৃষকতা, গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির নানারূপ তারেকসহ আমাদের অনেককে আলোড়িত করেছিল। আমি নিজেও ১৯৮০-৮১ সালের দিকে ‘The Insider’ শীর্ষক একটি চিত্রনাট্য লিখে সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু করা হয়নি। কারণ সেই সময় হঠাৎ আমার মা মারা যান। মিশুক ছিল আমার ক্যামেরা-সঞ্চালক। পরে শুনলাম মিশুককে ক্যামেরা-সঞ্চালক করে তারেক সুলতানের ওপর ফিল্ম বানাবে। ফলে আমি আর এ বিষয়ে এগোইনি। তারেক, বলতে গেলে কোনো লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়াই শুটিং শুরু করে দিয়েছিলেন। এখানেই আমরা যাঁরা ছবি করব করব বলে ভাবি, তাঁদের সঙ্গে তারেকের তফাৎ এবং এটা একটা মারাত্মক তফাৎ।
যা-ই হোক, সুলতান যেমন তাবৎ বিশ্ব ভ্রমিয়া অবশেষে নিজ দেশের লোকসংস্কৃতি বলয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারেকও ঢাকা শহর ভ্রমিয়া অবশেষে সুলতানের দেখানো পথ ধরে বাংলার লোকসংস্কৃতির কাছেই ফিরে গিয়েছিলেন। ৫০ মিনিট দৈর্ঘ্যের আদম সুরত প্রামাণ্যচিত্রে শিল্পী সুলতানের আত্মকথন ও ধারাভাষ্যের সঙ্গে স্থান পেয়েছে শিল্পীর অাঁকা চিত্রকর্ম। এসব চিত্রকর্মে কোথাও অাঁকা হয়েছে বাংলার কৃষক জমিতে মই দিচ্ছেন, ধানের চারা রোপণ করছেন, পাকা ধান কেটে অাঁটি বেঁধে মাথায় করে বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, গরু দিয়ে ধান মাড়াই করছেন, উঠানে কৃষাণী ধান শুকাচ্ছেন ইত্যাদি। আবার কোথাও অাঁকা হয়েছে অল্প বসনের কৃষকের পেশিবহুল হাতে ঢাল, সড়কি, বর্শা। বাস্তবে আমাদের কৃষকরা কিন্তু এমন পেশিবহুল নন; কৃষাণীরা এমন স্বাস্থ্যবতী নন।
আসলে শিল্পী সুলতান তাঁদের কৃষকতা তথা শ্রমিকতাকে মহীয়ান করে দেখাতে চেয়েছেন, এঁরাই মৃত্তিকালগ্ন মানুষ, এঁরাই আমাদের আহারের দানা জোগায়। প্রয়োজনে এঁরা হয়ে ওঠে দ্রোহী। এঁদের দেহকেই তাই ক্যানভাসজুড়ে স্থান করে দেন সুলতান, প্রকৃতিকে রাখেন স্নেহময়ী অন্নদাত্রী হিসেবে, পাশে। স্পেচুলা টেকনিকে অাঁকা বাংলার বৃহত্তর লোকসমাজের প্রধান বাসিন্দা কৃষকসমাজের দৈনন্দিন কাজকর্মকে গরীয়ান করে দেখিয়েছেন শিল্পী সুলতান তাঁর শেষপর্বের চিত্রকর্মে। এখানে মানুষ ও প্রকৃতিই মুখ্য এবং পূজনীয়। তাঁর অাঁকা মানুষরা বলশালী এবং সুখী। আবহমান মানুষের-কৃষকের শক্তিমত্তার মিলন ঘটেছে সুলতানের চিত্রকর্মে।
তরুণ তারেক মাসুদকে শিল্পী সুলতানের এই মানবিক দর্শন আলোড়িত করেছিল। নিজেও এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে এই দর্শনের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হন; নিজে মানুষপন্থী হয়ে ওঠেন। বলা বাহুল্য, এই মানুষপন্থী দর্শন আমাদের লোকসংস্কৃতির ভাবজগতের সবচেয়ে বড় খুঁটি। তারেক মাসুদের পরবর্তী চলচ্চিত্রকর্মগুলোর মধ্যেও দেখব যে, এই মানবদরদি দর্শনটি চলচ্চিত্রগুলোর বক্তব্যের কাঠামোটিকে ডমিনেট করছে।
শিল্পী সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে তারেককে লোকসংস্কৃতির নানা মাত্রার সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত মেলা, লোক উৎসব, গানের আসর, রথযাত্রা, নৌকাবাইচের আয়োজন – সবকিছুর দৃশ্যধারণ করতে গিয়ে শৈশবের মতো পরিপূর্ণ যৌবনেও তাঁকে লোকসংস্কৃতির নানা উপাদানের কাছে ফিরতে হয়েছে। যদিও এসব ফুটেজের ব্যবহার আদম সুরতে তেমনভাবে করাই হয়নি। কিন্তু লোকসংস্কৃতির এসব অনুষ্ঠান তাঁর মানসে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল এবং এদের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে তাঁর নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রকর্মে, পরবর্তীকালে। তাঁর মানস অবশ্য ওই সময়ই পরিপূর্ণভাবে লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতি অভিমুখী হয়ে উঠেছিল। যে কারণে তিনি The Rebel Angel নাম পরিবর্তন করে আলোচ্য প্রামাণ্যচিত্রের পুনঃনামকরণ করেন আদম সুরত।
তারেক মাসুদের পরবর্তী দুটি প্রামাণ্যচিত্র আহ্ আমেরিকা ও গণতন্ত্র মুক্তি পাক তাঁর জীবনদর্শনের বিভিন্ন দিকের পরিচায়ক। ১৬ মি.মি.-এ তৈরি ৩০ মিনিটের আহ্ আমেরিকাতে ১৯৮৫ সালে ওপি ওয়ান নামক মার্কিন ইমিগ্রেশন ভিসা পাওয়ার জন্য লটারিতে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে বাংলাদেশে যে উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল, তার নেতিবাচক দিকটি প্রকাশ পেয়েছে। এটি যৌথভাবে তারেক মাসুদ এবং তাঁর বন্ধু ইফতেখার হোসেন নির্মাণ করেন। স্বভূমি, স্বজাতি এবং স্বসংস্কৃতির চেয়ে বড় কিছু নেই – এ দর্শনই ব্যক্ত হয়েছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতে। গণতন্ত্র মুক্তি পাক অ্যানিমেশন ফিল্ম। তারেক মাসুদ এতে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
তারেক মাসুদ-নির্মিত সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য প্রামাণ্যচিত্র হচ্ছে সুপার সিক্সটিন ফরম্যাটে তৈরি ৭৮ মিনিট দৈর্ঘ্যের মুক্তির গান। নিজস্ব অর্থায়নে নিজের আন্তর গরজে নির্মিত চলচ্চিত্র। এটিকে প্রামাণ্যচিত্র বলা হলেও বস্ত্তত এটি সংগীতবহুল আখ্যানধর্মী কাজ। অনেকটা চলচ্চিত্র আঙ্গিকে ‘কেচ্ছা’ বলেছেন তারেক মাসুদ। সেজন্যেই তিনি একে ‘প্রামাণ্যচিত্র’ না বলে ‘প্রামাণ্যগল্প’ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। কেচ্ছা বলার ধরনটি আমাদের লোকসংস্কৃতির একটি আঙ্গিক। এই আঙ্গিকটিই সচেতনভাবে তারেক মুক্তির গানে ব্যবহার করেছেন। এর বিষয়ের বড় একটা জায়গাজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ থাকলেও এতে কিন্তু সরাসরি যুদ্ধদৃশ্য তেমনভাবে নেই। আছে লোকগান ও গণসংগীত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রসঙ্গ। তখনকার রাজনীতিসচেতন সাংস্কৃতিক কর্মীরা গান দিয়ে একদিকে যেমন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর মনোবল বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা জুগিয়েছেন। আর এসব গানের মধ্যে লোকগানের প্রাবল্য ছিল বেশি, যেমন – ‘এই না সোনার বাংলা’, ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুঃখ গান গাহিয়া’ ইত্যাদি।
মুক্তির গান নির্মাণ করতে গিয়েই তৃতীয়বারের মতো লোকসংস্কৃতির সঙ্গে তারেক মাসুদের ইন্টারঅ্যাকশন হয়। এর আঙ্গিক ও বিষয়ের মধ্যে লোকসংস্কৃতির উপাদান থাকার কারণে একে লোকচলচ্চিত্র বলা অযৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না। মুক্তির গানের সিকুয়াল হিসেবেই মুক্তির কথা তৈরি করেছেন তারেক মাসুদ। এখানে যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁরা বৃহত্তর লোকসমাজের বাসিন্দা। পুরুষ এবং নারী উভয়েই কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থা ও মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী অবস্থা নিয়ে। তাঁদের স্বপ্নভঙ্গের কথা বলেছেন ৮২ মিনিট দৈর্ঘ্যের মুক্তির কথায়। মুক্তির কথা তারেক মাসুদকে বাংলার বৃহত্তর লোকসমাজের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তারেক যে ভবিষ্যতে এদেশের নিষ্পেষিত নারী-পুরুষের জীবনের কথক হয়ে উঠবেন, সেই দায়িত্ব ইতিহাস তখনই তাঁকে দিয়ে দেয়। কানসাটের পথে নির্মাণ করে তারেক সেই দায়িত্ব পালনও করেন। এই প্রামাণ্যচিত্রটি তারেক তাঁর নিজের জন্যই তৈরি করেছেন, অর্থাৎ নিজের দেশের মানুষের প্রতি, বিশেষত নিজের দেশের কৃষকসমাজের একটি মৌলিক চাহিদা তথা বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর দাবিকে যৌক্তিক ভিত্তি দিয়ে প্রামাণ্যীকরণের তাগিদ থেকেই তৈরি করেছেন।

চার
প্রামাণ্যচিত্র : অন্যের জন্য
এদেশের লেখক-শিল্পীদের নসিবই এরকম যে, তাঁদের জীবনের নানা পর্যায়ে টিকে থাকার জন্য ‘অন্যের জন্য’ (দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থা, দাতা সংস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি) অর্থের বিনিময়ে প্রচারণামূলক কিছু কাজ করতে হয়। চলচ্চিত্র করিয়েরাও এর বাইরে থাকতে পারেন না। অর্থ নিলে তাঁর সঙ্গে যাঁরা অর্থ দিচ্ছেন, তাঁদের এজেন্ডাটিও আসে। ফলে চলচ্চিত্রকার স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্রকর্মটির থিম, বিষয়, গল্প, চরিত্রায়ণ, বক্তব্য ইত্যাদি নির্ধারণ করতে পারেন না সবসময়। তারেক মাসুদও বেঁচে থাকার দায়ে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন। তার মধ্যে সোনার বেড়ি একটি। এটি ভিডিও ফরম্যাটে তৈরি। এর বিষয়বস্ত্ততে নারী নির্যাতনের কিছু চিত্র তুলে ধরে এর প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। লক্ষণীয় যে, এর নামকরণে তারেক লোকসমাজে প্রচলিত এমন একটি স্বর্ণালংকারের নাম ব্যবহার করেছেন, যা নারীরা কোমরে-হাতে-পায়ে পরেন। তারেকের চলচ্চিত্রকর্মে লোকসংস্কৃতির প্রভাব কোনো-না-কোনোভাবে পড়েছে।
ইউনিসেফের আর্থিক সহযোগিতায় ৩০ মিনিট দৈর্ঘ্যের শিশুকণ্ঠ নির্মাণ করেছেন তারেক ও ক্যাথরিন একসঙ্গে মিলে। বেটাকম-এসপি ফরম্যাটে তৈরি এই চলচ্চিত্রে কর্মজীবী শিশুরা নিজেদের সার্বিক অবস্থা নিজেরাই স্বকণ্ঠে বয়ান করেছে। শিশুকণ্ঠের সিকুয়াল হিসেবে ব্রিটিশ প্রযোজনা সংস্থা জিংগু (Xingu) ফিল্মসের অর্থায়নে বেটাকম-এসপি ফরম্যাটে তাঁরা নির্মাণ করেছেন ৫০ মিনিট দৈর্ঘ্যের অন্য শৈশব। এতেও ঢাকা শহরের কর্মজীবী শিশুদের অবস্থা চিত্রিত হয়েছে। দুজনে মিলেই আবার ২৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের নিরাপত্তার নামে শীর্ষক আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন ব্রিটিশ টেলিভিশন এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের যৌথ প্রযোজনায়, ডিভিক্যাম ফরম্যাটে। এর বিষয়বস্ত্তও নারী এবং তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সরকারি প্রয়াস। এই প্রয়াসের উদ্যোগ কতটা নিরাপত্তার নামে জেলে রাখা নারীদের জন্য শুভকর – এ প্রশ্নই মুখ্য হয়ে উঠেছে প্রামাণ্যচিত্রটিতে। এরপর তাঁরা ২৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের নারীর কথা তৈরি করেন বেটাকম-এসপি ফরম্যাটে, যাতে মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীরা যেভাবে অংশ নিয়েছেন এবং অবদান রেখেছেন, সেই বিষয়টি নারীদের কথাতেই চিত্রজুড়ে প্রাধান্য পেয়েছে।
অন্যের অর্থায়নে বা প্রয়োজনে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করলেও তাঁরা কিন্তু বরাবরই মানুষ (বিশেষত শিশু ও নারী) ও তাঁদের ঘিরে যে সমস্যাগুলো সমাজকাঠামোতে বিরাজ করছে, সেসব নিয়ে চিন্তামূলক প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন। এগুলো তৈরি করতে গিয়ে যে-অভিজ্ঞতা তাঁরা অর্জন করেছেন, আমার বিবেচনায়, সে-অভিজ্ঞতা তাঁদের স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রে শিশু ও নারীচরিত্র চিত্রণে সহায়ক হয়েছে। ‘মানুষ’ হয়ে উঠেছে তাঁদের চলচ্চিত্রের বিষয়বস্ত্তর কেন্দ্রবিন্দু। সে অর্থে তাঁরাও, বিশেষ করে তারেক মাসুদ সমাজের মানবতাবাদী প্রসঙ্গটি দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।

পাঁচ
স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র : নিজের জন্য/অন্যের জন্য
স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র সে তারেক মাসুদ ও শামীম আখতার যৌথভাবে নির্মাণ করেছেন। এটি ৩৫ মি.মি.-এ তৈরি ১০ মিনিটের চলচ্চিত্র। ক্যামেরা-সঞ্চালক ছিলেন বেবী ইসলাম। এতেও ‘মানুষ’ কাহিনির কেন্দ্রে অবস্থান করছে। তারেক তাঁর ব্যক্তিজীবনে দেখেছেন, তাঁর মাকে সমাজ-সংসারে অধস্তন অবস্থানে; নারীদের নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়েও দেখেছেন, তাঁরা নানাভাবে আমাদের সমাজকাঠামোতে অবহেলিত, নির্যাতিত। ফলে ‘নারী’ তাঁর স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য – উভয় ধরনের চলচ্চিত্রে অনেকটা স্পেস ধরে অবস্থান করে। তারেক আসলে নারীচরিত্রকে কাহিনির ভেতর একটা বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে তাঁর ব্যক্তিজীবন, সংসার-সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাঁর অবস্থা ও অবস্থানকে চলচ্চিত্র আঙ্গিকের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন।
সেতে দেখা যায়, এক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী তাঁর ছেলেকে নিয়ে মামার সঙ্গে পুরান ঢাকায় থাকে। একদিন বিদেশে অবস্থানরত স্বামী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় নিজের ছেলের সঙ্গে স্বামীর তথা বাবার ক্রস হয়। বাবা চিনতে পারে না। ছোট্ট ছেলেটিও তাকে চেনে না। কারণ, তাঁর মা-বাবার মধ্যে সম্পর্ক নেই বহুকাল। তা ছাড়া ছেলেটি হওয়ার সময় সে মনে হয় দেশেই ছিল না। একথা-সেকথার পর ছেলের জন্য বাবা কিছু টাকা দিতে চায় (বাবা এক আত্মীয়ের কাছ থেকে শুনে এসেছে যে, ছেলেটির হার্টের অসুখ হয়েছে), কিন্তু নারীটি নেয় না। একসময় বাবা উঠে চলে যায়। ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করে : লোকটা কে মা? মা বলে : কেউ না, বাবা। এখানেই শেষ হয় চলচ্চিত্রটি।
লক্ষণীয়, তারেক-শামীম নারীকে কোথাও ছোট করে দেখাতে রাজি হননি। এঁদের পরবর্তী চলচ্চৈত্রিক প্রয়াসেও কোথাও নারী নত হয়নি – না পুরুষের কাছে, না সমাজের কাছে। নারীটি ‘কেউ না’ উচ্চারণ করে এবং ১০ মিনিটের চলচ্চিত্রটিতে অধিকাংশ সময় নীরব থেকে এমনভাবে পুংলিঙ্গবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, যা শত সংলাপের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করা সম্ভব হতো না। আসলে এখানেই এই চলচ্চিত্রমাধ্যমের প্রকৃত ক্ষমতাটি প্রকাশ পেয়েছে।
নরসুন্দর অন্যের জন্য তথা রামরুর (রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট) জন্য নির্মাণ করেছেন তারেক মাসুদ। এক্ষেত্রেও অর্থের সঙ্গে এজেন্ডা সঙ্গী হয়ে এসেছে। এজেন্ডা বা রামরুর মূল কাজকে গুরুত্ব দিয়ে কাহিনি, চরিত্র, বক্তব্য দাঁড় করাতে হয়েছে তারেককে। ফলে একেবারে স্বাধীনভাবে বিষয় নির্বাচন করা নির্মাতার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। রামরু চেয়েছে, বাংলাদেশে আটকেপড়া বিহারিদের বর্তমান অবস্থাকে চলচ্চিত্রমাধ্যমে প্রকাশ করতে। এটা করতে গিয়ে তারেক এই বিহারিদের একাংশ অতীতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল, সেই কাহিনি বেছে নিয়েছেন। কাহিনিতে দেখা যায়, এক মুক্তিযোদ্ধা রণক্ষেত্র থেকে তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। পাকিস্তানি আর্মিরা তার খোঁজে তার বাসায় আসে। সে টের পেয়ে পালিয়ে এক সেলুনে আশ্রয় নেয়, যে সেলুনের সবাই বিহারি। আর্মিরা তাকে না পেয়ে তার বাবাকে আহত করে। মা এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে যায়। এদিকে দাড়ি গজানো মুক্তিযোদ্ধা সেলুনে শেভ করার জন্য বসে পড়ে। কিন্তু তাকে ভীতসন্ত্রস্ত দেখে সেলুনের নরসুন্দররা অাঁচ করতে পারে যে সে মুক্তিবাহিনীর কেউ হবে। এরই মধ্যে আর্মিরা সেলুনে মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে এলে নরসুন্দররা বলে – না, এখানে কোনো মুক্তি আসেনি। গল্পটি এ-পর্যন্তই।
এইচডিভি ফরম্যাটে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিধর্মী এই চলচ্চিত্রটিকে তারেক বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে পলিটিক্যাল থ্রিলার ধরনের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি।’ কথাটা ঠিকই আছে, যদি আমরা এর কাহিনিতে স্থিত ঘটনাখন্ডগুলোর প্রচন্ড গতির দিকে তাকাই এবং মিশুক মুনীরের ক্যামেরা সঞ্চালনে ক্ষিপ্রতার কথাটি বিবেচনা করি। এছাড়া এর সেলুনের দৃশ্যখন্ডগুলো সংঘটনের ক্ষেত্রেও তারেক নিরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন। সেলুনের ভেতর তিনি অনেকগুলো অতিরিক্ত আয়না সংস্থাপন করেছিলেন, যার ফলে একটি শটের মধ্যে অনেকগুলো মুখ একসঙ্গে পাওয়া গেছে; প্রতিটি শটের মধ্যে উত্তেজনা, উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে মুখগুলোর উৎকণ্ঠা-উদ্বেগের মধ্য দিয়ে। এই অর্থে একে থ্রিলার বলা যায়। কিন্তু যে পলিটিক্যাল ইস্যুটি কাহিনির ভেতর দিয়ে নির্মাতা সামনে এনেছেন, তা কতটা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য – এ প্রশ্ন থেকেই যায়। সেলুনের বিহারি নরসুন্দররা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চল্লিশ বছর পরও এদেশে রিফিউজি হয়ে আছে, এটা সত্য। তাই বলে তাদেরকে কেন কাহিনিতে মহীয়ান করে দেখাতে হবে? কেন ভীতসন্ত্রস্ত মুক্তিযোদ্ধাটিকে নিয়ে ওরা হাসিঠাট্টা-তামাশা করবে? করুণা করবে? আজকের বিহারি রিফিউজিরাও একসময় বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহায্য করেছিল, এটা জানান দেওয়ার জন্য? এটাই কি তাহলে নরসুন্দরের প্রধান বক্তব্য? আসলে অর্থের উৎসই বক্তব্যের প্রবাহটি নিয়ন্ত্রণ করে, নির্মাতার বিবেক নয় – এ সত্যটিই তারেকের নরসুন্দর প্রমাণ করে গেল।
তারেক মাসুদ চার মিনিট দৈর্ঘ্যের ইউনিসান অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রটি ‘মুম্বাই স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্র উৎসবে’র জন্য উৎসব কমিটির অনুরোধে উৎসবের ‘থিম চলচ্চিত্র’ হিসেবে ইউম্যাটিক ডিভিও ফরম্যাটে নির্মাণ করেছিলেন। এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রে পরস্পর বিচ্ছিন্ন এক জোড়া মানব-মানবীর পুনর্মিলনের কাহিনি বলা হয়েছে, যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়োজনীতার প্রসঙ্গটি মুখ্য হয়ে উঠেছে। এখানেও তারেকের ‘মানুষ’ ও তাদের প্রতিবেশসংক্রান্ত ভাবনা প্রাধান্য পেয়েছে।
ছয়
পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র
তারেক মাসুদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ৯৮ মিনিট স্থিতিকালের মাটির ময়না। এটি ৩৫ মি.মি. ফরম্যাটে তৈরি। এর কাহিনি ও বক্তব্য প্রত্যক্ষভাবে নরসুন্দরের মতো ফান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। তবে অপ্রত্যক্ষভাবে কাহিনির কাঠামো চরিত্রায়ণ কিছুটা যে-সূত্র থেকে এটা নির্মাণ করার জন্য প্রাথমিক ফান্ড পাওয়া গিয়েছিল, তার এজেন্ডা বা শর্তাবলির সঙ্গে সম্ভবত কিছুটা জড়িত। ১৯৯৯ সালে মাটির ময়নার চিত্রনাট্য ফরাসি সরকারের প্রতিযোগিতামূলক গ্রান্ট ‘সাউথ ফান্ড’ থেকে অনুদান পায়। এই ফান্ডের অন্যান্য শর্তের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে, চিত্রনাট্যটিতে যুদ্ধকালীন সময়ে নারী ও শিশুরা কী অবস্থার মধ্যে পড়ে, তার একটা উপস্থাপন থাকতে হবে। মাটির ময়নায় তা আছে। তবে শুধু যে এর জন্যই চিত্রনাট্যটি অনুদান পেয়েছিল তা নয়, শুদ্ধ চিত্রনাট্য হিসেবেই এটি সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রের মধ্যে স্থিত নানামুখী দ্বন্দ্ব ধারণ করেছিল, বিশেষ করে গ্রামীণ লোকসমাজের মধ্যে যুদ্ধকালীন সময়ে নারী ও শিশুরা কী রকম অসহায়ত্বের শিকার হয়, সেই প্রসঙ্গ ছিল।
মাটির ময়নায় তারেক তাঁর নিজের শৈশবের কাহিনিটিই ধরতে চেয়েছিলেন। তাঁর বাবা-মা-বোন ও মাদ্রাসার বন্ধুরা চরিত্র হয়ে এসেছে। এর শুরুটা তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রসঙ্গ দিয়ে হলেও তা ধীরে ধীরে ওই সময়ের (১৯৬৯-৭১) নানা ঘটনা, যেমন – ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের শুরু, সেই সূত্রে মাদ্রাসাপড়ুয়া ছাত্র আনু তথা তারেকেরই মাদ্রাসাজীবনের টানাপড়েন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র (বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠার আন্দোলন – সবকিছুকেই জড়িয়ে ধরে।
এই চলচ্চিত্রে বস্ত্তত তিন জোড়া পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্বমূলক ধারণার উপস্থিতি লক্ষ করা যায় – নারী-পুরুষ বা ঘর-বাহিরবিষয়ক দ্বন্দ্ব, প্রকৃতি-প্রতিষ্ঠানবিষয়ক দ্বন্দ্ব ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বনাম ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। এই তিন জোড়া দ্বন্দ্বই মাটির ময়নার মূল প্রসঙ্গ।
এই মূল প্রসঙ্গগুলো শক্ত বৌদ্ধিক যুক্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য উপসঙ্গ হিসেবে তারেক লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান ব্যবহার করেছেন। এসবের মধ্যে লোকগান, ধর্মীয় বাহাস, নৌকাবাইচ, গ্রামীণ মেলা, বাতাসা, স্থানীয় ভাষা ও উচ্চারণ, নকশিকাঁথা, মাটির তৈরি পাখি, সূচিকর্ম, চিত্রকর্ম, পুঁথিপাঠ প্রভৃতি অন্যতম।
মাটির ময়না নামটিই নেওয়া হয়েছে মেলা বা আড়ংয়ের প্রধান আকর্ষণ মাটির তৈরি পশুপাখির সম্ভার থেকে। কাহিনিতে মাটির তৈরি ময়নাটি কিনেও আনা হয়েছে গ্রামীণ মেলা থেকেই। এতে যে লোকগান বা বাউলসংগীত ব্যবহার করা হয়েছে, তাও এ-অঞ্চলে মুসলমান সমাজের মধ্যে বহুকাল ধরে প্রচলিত উদার যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করছে। চলচ্চিত্রটিতে নারী ও পুরুষ গায়েনরা যে ‘পালটাপালটি’ গান করে, তা বস্ত্তত বাহাসের পর্যায়েই পড়ে, যার মধ্য দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাই করা হয় এবং এই চর্চা শহরে কম লক্ষ করা গেলেও গ্রামীণ সমাজ-বাস্তবতায় কিন্তু এর চল এখনো কম নয়। এই পালটাপালটি গান নারী-পুরুষ তথা ঘর-বাহির দ্বন্দ্বটিকে ঘনবদ্ধ করার প্রয়োজনেই ব্যবহার করেছেন তারেক।
মাটির ময়নার শুরুতে দেখা যায়, কাজি সাহেব তাঁর ছেলে আনুকে মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন। কেন পাঠাচ্ছেন? ধর্মের নামে ছেলেকে উৎসর্গ করবেন বলে! তারেক এই উৎসর্গ করার বিষয়টির ধর্মীয় উপাদানটি তুলে ধরেছেন পুঁথিপাঠের আসরে, যেখানে হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালন করার স্বার্থে নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্ত নিজ পুত্রকে কোরবানি দিচ্ছেন। অ্যালোপ্যাথি এবং হোমিওপ্যাথি-বিষয়ক দ্বন্দ্বটিও গ্রামীণ সমাজের একটি প্রপঞ্চ, গ্রামীণ সমাজে এখনো অ্যালোপ্যাথির চেয়ে হোমিওপ্যাথিকেন্দ্রিক চিকিৎসার কদর বেশি। তাছাড়া কট্টর মুসলমানরা অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসাদি-ওষুধপথ্যকে ইহুদি-নাসারাদের উদ্ভাবন বলে দূরে সরিয়ে রাখতেও চায়।
নৌকাবাইচ গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। একেও ব্যবহার করেছেন তারেক ভাষা ও ধর্মকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বটি খোলাসা করতে। আনু তার কাকার সঙ্গে নৌকাবাইচ দেখে ফিরে এলে বাবা ‘নৌকাবাইচ’কে হিন্দুয়ানি কাজ বলে তা থেকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দেন। নৌকাবাইচ উপলক্ষে যে মেলা বসে, সেই মেলা থেকে ওরা যে বাতাসা কিনে এনেছিল, তাকেও কাজি সাহেব তথা আনুর বাবা ‘বেদাতি জিনিস’ বলে তাচ্ছিল্য করেন। এসব বেদাতি কাজ থেকে ছেলেকে রক্ষা করা এবং আল্লাহর রাস্তায় ছেলেকে সঁপে দেওয়ার জন্য বাবা আনুকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন।
আনুর মা গুনগুন করে গ্রামীণ গান গাইলে ও সূচিকর্ম করলেও কাজি সাহেব এগুলো ‘নাজায়েজ’ বলে মন্তব্য করেন। আনুর মা বাউল গান শুনতে যান তাঁর স্বামীর অগোচরে। গানের কথাও চলচ্চিত্রটির মূল সুরকে সাপোর্ট করে : ‘পাখিটা বন্দি আছে দেহের খাঁচায়/ ও তার ভবের বেড়ি পায় জড়ানো, উড়তে গেলে পড়িয়া যায়।’ গানের শেষ স্তবকটি এরকম : ‘মাটির তৈরি ময়না বলে, ক্যানে তয়লে মনটা দিলে, না দিলে জোর যদি ডানায়।’ লোকসংস্কৃতির একটি আঙ্গিক হচ্ছে বাউল গান, তারেক এই গানকে ব্যবহার করেছেন আনুর মাকে মদদ দেওয়ার জন্য। নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বটিকে তীক্ষ্ণ করার জন্য তারেক ‘বিচার গানে’র দৃশ্য দেখিয়েছেন। এই বিচার গানও লোকসংস্কৃতির অংশ।
‘আনু’ নামটিও বাংলা সংস্কৃতির ভেতর থেকেই জন্ম নিয়েছে। মাদ্রাসার বড় হুজুর ‘আনু’ নাম শুনেই ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে ওঠেন, তিনি এই নামের মধ্যে বাঙালিয়ানার গন্ধ পান। কারণ, আরবিতে এই নামের কোনো অর্থ হয় না। কেরোসিনের কুপি, বাসনকোসন, ঘর-দরজা-জানালা, জংলি ফুল, চরিত্রদের লেবাস – সবই গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির চিহ্নবাহক। বস্ত্তত তারেক মাসুদ তাঁর শৈশবে লোকসংস্কৃতি ও লোকসমাজের সঙ্গে প্রথম জীবনে যে ইন্টারঅ্যাকশনে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রায় সবকিছুর উপস্থিতিই মাটির ময়নায় দেখতে পাওয়া যায়। চিত্রকর সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে যেসব গ্রামীণ মেলা-পার্বণ-উৎসব তারেক দেখেছিলেন, তারও কিছু এসেছে মাটির ময়নায়। এই সূত্রে মাটির ময়নাকে তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য লোকচলচ্চিত্র বলা যেতে পারে।
অন্তর্যাত্রা ডিজিটাল ফরম্যাটে তৈরি করে ৩৫ মি.মি.-এ ট্রান্সফার করা হয়েছে। তারেক ও ক্যাথরিন দুজনে মিলেই পরিচালনাকর্মটি সম্পন্ন করেছেন। তারেক এর চিত্রনাট্যের জন্য ২০০৩ সালে রটরডাম উৎসবের গ্রান্ট পেয়েছিলেন। এর কাহিনিতে এক প্রবাসী পরিবারের মানসিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে ‘দেশ’ ধারণাটি বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। একটি পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্বমূলক ধারণাকেই এর কাহিনিতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর সেটি হচ্ছে দেশ বনাম প্রবাস। এতে কখনো অভিবাসীদের আত্মপরিচয়ের সংকট প্রাধান্য পেয়েছে, কখনো নিজ দেশের স্থানীয় আদি-সংস্কৃতির প্রতি টান প্রকাশ পেয়েছে, আবার কখনো মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে বড় হওয়া নানা প্রজন্মের মধ্যকার দ্বন্দ্ব স্থান পেয়েছে।
এই চলচ্চিত্রে মাটির ময়নার মতো লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতি ব্যাপকভাবে উপস্থিত না থাকলেও এতে তারেক যখনই সুযোগ পেয়েছেন, স্থানীয় তথা লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান যুক্ত করেছেন। এ-কাজটি করেছেন কখনো দেশ, কখনো বিদেশবিষয়ক ধারণাকে সামনে আনার জন্যই। শুরুতেই দেখা যায়, সোহেল কম্পিউটারে চ্যাট করছে। টেলিফোনে বাবার (রফিক) মৃত্যুসংবাদ আসে, তখন সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা ও ইংরেজিতে তাঁরা কথাবিনিময় করে। দেশ ও বিদেশ প্রসঙ্গটি বা দ্বন্দ্বটি ভাষায় প্রকাশ পায় প্রথম। ভাষা স্থানীয় তথা লোকসংস্কৃতির প্রথম উপাদান। এই প্রথম উপাদানটি অন্তর্যাত্রার শুরুতেই স্থান পেয়েছে।
এরপর মা-ছেলে ঢাকায় আসে রফিকের কুলখানিতে অংশ নেওয়ার জন্য। মা তাঁর ভাইয়ের কাছে ওঠে। ভাই তাঁদের পৈতৃক বাড়িতেই থাকে, বাড়িটি দেশভাগের পর তাঁদের বাবা কোনো এক দাশগুপ্তের কাছ থেকে কিনে রেখেছিল। দাশগুপ্তের পুরনো কেয়ারটেকার লক্ষ্মণ দাস আর তুলসীবেদিটি এখনো এই বাড়িতে আছে। লক্ষ্মণ দাসের সংলাপে প্রাচীন শ্লোক শোনা যায়, যাতে বর্ণহিন্দু আর চাড়ালের মধ্যকার বিভাজনটি প্রকাশ পায়। শ্লোকও কিন্তু লোকসংস্কৃতির একটি আঙ্গিক। লক্ষ্মণ দাসের কণ্ঠে কীর্তনাঙ্গের গান ব্যবহার করা হয়েছে। কীর্তনের কথা ও সুরে আমাদের প্রবহমান লোকসংস্কৃতির লোকজ ধারাটি প্রকাশ পায়।
ভাইয়ের কাছ থেকে ট্রেনে করে মা-ছেলে যখন সিলেটে দাদার বাড়ি যাচ্ছিল, তখন সোহেলের শ্রুতিকোণ থেকে চা বাগানের শ্রমিকদের গাওয়া দেশোয়ালি গান শোনা যায়। দাদার বাড়িতে পৌঁছে সোহেল গভীর রাতেও চা বাগানের শ্রমিকদের বাসস্থান থেকে ভেসে আসা করুণ সুরের গান শুনতে পায়। এই গানের ভাষা ও সুর শ্রমিকরা ব্রিটিশ আমলে উড়িষ্যা থেকে সিলেটে আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। তারেক ও ক্যাথরিন যে সচেতনভাবে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে তাঁদের অধিকাংশ চলচ্চিত্রের বক্তব্যের প্রবাহটিকে শাণিত করতে চেয়েছেন, তা উপর্যুক্ত পর্যালোচনা থেকে কিছুটা স্পষ্ট হয় বইকি।
তারেক মাসুদ তাঁর সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র রানওয়েতেও লোকসংস্কৃতির সাহায্য নিয়েছেন নিজের বলার বিষয়কে স্পষ্ট করার জন্য। আসলে তারেক লোকসংস্কৃতির নানা উপাদানকে সিনেম্যাটিক কোড হিসেবেই ব্যবহার করেছেন, যখন সেখানে প্রয়োজনবোধ করেছেন, সেখানে। রানওয়ের কাহিনি ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে উগ্র মুসলিম মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিকাশের প্রক্রিয়াটি ঘিরে আবর্তিত। সেসময় দেশের বিভিন্ন সিনেমা হল, আদালত ও বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের দ্বারা বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এটি এই চলচ্চিত্রের মূল কাহিনিপ্রবাহ। এই প্রবাহকে ঘিরে বয়ে চলে গ্রামীণ সমাজকাঠামোতে চরম দারিদ্রে্যর কারণে ঢাকা শহরের উপান্তে আশ্রয় নেওয়া গরিব পরিবারের দারিদ্রে্যর কাহিনি, পোশাক শ্রমিকদের বেতন নিয়ে ভোগান্তি, কাজের সন্ধানে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের কারণে দেশে ফেরা এবং ভিনদেশে কষ্ট করার কাহিনি, দারিদ্র্য থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ক্ষুদ্রঋণ নেওয়া ও পরিশোধের ক্ষেত্রে বিলম্বের কাহিনি।
রানওয়ে তারেক ও ক্যাথরিনের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত চলচ্চিত্র। কোনো ফান্ড তাঁরা এর জন্য নেননি। তাঁদের নিজেদের একটি জমি বিক্রি করে তাঁরা এ-চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন। ফলে একেবারে স্বাধীনভাবে বিষয়বস্ত্ত বেছে নিয়ে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন মূল প্রসঙ্গ জঙ্গিবাদকে ঘিরে। ডিজিটাল ফরম্যাটে তৈরি এ-চলচ্চিত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ, দেশীয় রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক অবস্থা একটি মাদ্রাসাপড়া সহজ-সরল অভাবী ছেলেকে কীভাবে উগ্রপন্থী করে তোলে এবং এর ফলে তাঁর নিজের জীবনে, পরিবারে এবং সমাজ-রাষ্ট্রে কী ধরনের বিপর্যয়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিস্তার ঘটায় – সেসব বিষয় দেখানো হয়েছে। ছেলেটি অবশ্য একসময় তাঁর ভুল বুঝতে পেরে মায়ের কাছে ফিরে আসে। এরকম একটি পজিটিভ নোট দিয়ে চলচ্চিত্রটি শেষ হয়।
ছেলেটির পরিবার নদীভাঙনের কবল থেকে বাঁচার জন্য ঢাকায় এসে এয়ারপোর্টের কাছে গ্রামীণ পরিবেশে বসতি স্থাপন করে। গ্রামীণ পরিবেশ ও শহুরে পরিবেশের মধ্যে বৈপরীত্য স্থাপন করেই নির্মাতারা তাঁদের কাহিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এবং এই এগিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই নানা প্রকার লোকজ উপাদান ব্যবহার করেছেন। স্থানচ্যুত হয়ে আসা ছেলেটির পরিবারের সব সদস্য ও তাঁদের মতো অন্যরাও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। আবার জঙ্গি কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িতরা নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলেছে। পূর্বে বলা হয়েছে যে, আঞ্চলিক ভাষা বৃহদার্থে লোকসংস্কৃতির একটি বেসিক উপাদানই।
ছেলেটির পরিবার যে পরিবেশে থাকে, তার মধ্যেও লোকজ আবহ পাওয়া যায়। জলাশয়, ভেসাল (মাছ ধরার একধরনের জাল), গোয়ালঘর, গ্রামীণ তৈজসপত্র, জলচৌকি, হাঁস, বেড়া, গুলতি, তাইমুমের মাটির ঢেলা ইত্যাদি সবই লোকেশনে ছিল। এই লোকেশনের কোনো দৃশ্যখন্ডের সঙ্গে যখনই কোনো আবহসংগীত বেজেছে, তা বাজানো হয়েছে দেশীয় যন্ত্রে। এসব যন্ত্রও লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।
ছেলেটি নিজের ঘরে ফিরে আসার পরের দিন খুব সকালে উঠানে এসে জলচৌকির ওপর বসে এবং তার আশপাশে ঘটে চলা কিছু ঘটনাখন্ড দেখে। সে দেখতে পায়, বিকেলের সোনালি আলোয় ঘাসফুলের ওপর ফড়িং এসে বসছে, ভেসালের জালে আটকে থাকা পানিতে সোনালি আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, জালে ধরা পড়া কিছু ছোট মাছ লাফাচ্ছে, উঠানের মাঝখান দিয়ে পিঁপড়ার দল সারি বেঁধে যাচ্ছে, ঝিঙে ফুল বাতাসে দুলছে, মা দুধ দোয়াচ্ছে। সব দৃশ্যখন্ডই ছেলেটির পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখানো হয়েছে এবং আলাদাভাবে এ দৃশ্যগুলোর কোনোই মূল্য নেই। কিন্তু যখনই দৃশ্যগুলোকে ছেলেটির জীবনের বর্তমান কনটেক্সটের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হবে, তখনই আলাদা দৃশ্যখন্ডগুলো অর্থবহ হয়ে উঠবে। আমাদের মননে এই প্রতীতি জন্মাবে যে, দৃশ্যগুলো ছেলেটির মনের আনন্দের বার্তাবহ। এটাই আসলে ‘ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ’ বা ‘মন্তাজ অব অ্যাট্রাকশন’ যা নির্মাতাদ্বয়ের সিনেম্যাটিক পারসেপশনের পরিচায়ক। চলচ্চিত্রের ভাষার ওপর চরম দখল না থাকলে এরকম মুহূর্ত তৈরি করা সম্ভব নয়। যেসব উপাদান ব্যবহার করে দৃশ্যখন্ডগুলো নির্মিত হয়েছে, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার সবই লোকজ উপাদান। এসব উপাদান ব্যবহার করে নির্মাতাদ্বয় ছেলেটিকে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে এনেছেন, যে প্রকৃতির মাঝে ছেলেটি নিজেকে ফিরে পায়, পূর্বের অবস্থায়। চলচ্চিত্রে প্রকৃতি নানাভাবে আসে – কখনো নিষ্ঠুর-অনুর্বর রূপে, কখনো মানুষের সুখ-দুঃখের প্রতি দারুণ উদাসীনরূপে, আবার কখনো উর্বরা-আশ্রয়দাত্রীরূপে। ছেলেটির ক্ষেত্রে এখানে প্রকৃতি আশ্রয়ের প্রতীকরূপে এসেছে।
রানওয়ের শেষ দৃশ্যখন্ডটিতেও লোকজ ভাবনার ব্যবহার লক্ষণীয়। এ দৃশ্যে দেখা যায়, মা দুধ দোয়ানো শেষ করে বাটিতে করে দুধ নিয়ে ছেলের কাছে আসে এবং দুধ দিয়ে ছেলের মুখ ধুইয়ে দেয়। আমাদের লোকসমাজে একটি আচার আছে যে, কাউকে বা কোনো কিছুকে পরিশুদ্ধ করতে হলে নারকেলের পানি অথবা দুধ দিয়ে তা ধুইয়ে দেওয়া। লোকসমাজের এই বিশ্বাসটি ব্যবহার করে ছেলেটিকে পরিশুদ্ধ করা হয়। এটি একটি সিনেম্যাটিক কোড। একে ডিকোড করলে ওপরে বলা কথাগুলো বেরিয়ে আসবে। চলচ্চিত্রটি শেষ হয়ে গেলে টাইটেল কার্ডগুলো স্ক্রল করার সময় লোকসুরে একটি গান বয়ে চলে। গানের কথাতেও লোকগানের আমেজ পাওয়া যায় : ‘আগে যদি জানতামরে ময়না/ উড়িয়া যাবি/ মায়ের ক্রন্দন পিছে থুইয়া/ গেলি লক্ষ্মীর চরে/ মনে মনে জানতামরে ময়না/ ঘরে আইবা ফিরে’ ইত্যাদি। তারেক ও ক্যাথরিন আসলে শহুরে সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিকে দাঁড় করিয়েছেন। দানবতুল্য বিমানের বিরুদ্ধে গুলতিকে অস্ত্র করেছেন। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন আচার-উপাদানকে ব্যবহার করেছেন।

সাত
অসমাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র/ প্রামাণ্যচিত্র
তারেক মাসুদের চতুর্থ পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রের নাম রাখা হয়েছে কাগজের ফুল। এটি মাটির ময়নার প্রিকুয়াল, অর্থাৎ আগের পর্ব যা অচিত্রায়িত রয়ে গেছে। লক্ষণীয় যে, কাগজের ফুল নামটির মধ্যেই লোকসংস্কৃতির প্রলেপ আছে, যেমনটা ছিল মাটির ময়না নামের মধ্যে। তারেকের আরেকটি অসমাপ্ত কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ-মেলা নিয়ে নির্মিতব্য প্রামাণ্যচিত্রটি। এ-চিত্রটি নির্মাণের সময়ই তারেক ব্যাপকভাবে লোকসংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, যাকে আমরা এরই মধ্যে তাঁর লোকসংস্কৃতির সঙ্গে চতুর্থ ইন্টারঅ্যাকশন বলে শনাক্ত করেছি। উল্লিখিত দুটি অসমাপ্ত চলচ্চিত্রকর্মে তারেক লোকসমাজ, লোকভাবনা ও লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান কীভাবে, কোন অর্থ উৎপাদনে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, তা ক্যাথরিনের যোগ্য তদারকি, পরিচালনা ও সম্পাদনার ভেতর দিয়ে একসময় প্রকাশ পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
তারেক, শামীম আখতার ও ক্যাথরিন মাসুদ বিরচিত চলচ্চিত্রগুলোর নাতিদীর্ঘ পর্যালোচনার নিরিখে বলা যায়, তাঁদের চলচ্চিত্রকর্ম ‘অন্য চলচ্চিত্র’ পর্যায়ভুক্ত। এতে ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ প্রসঙ্গ আছে। সামাজিক উপযোগিতার দিকে লক্ষ রেখেই তাঁরা চলচ্চিত্রমাধ্যমকে তাঁদের বক্তব্য প্রকাশের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁরা চলচ্চিত্র নির্মাণের সব ফরম্যাটই ব্যবহার করেছেন। আশু লক্ষ্য, প্রয়োজন ও অর্থবলই তাঁদের বাধ্য করেছে বিভিন্ন ফরম্যাট বেছে নিতে। তাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো তাঁদের হয়েই কথা বলেছে, তাঁদের বক্তব্য পেশ করেছে। সে-সূত্রে তাঁদেরকে, বিশেষ করে তারেক মাসুদকে অত্যর (Auteur) চলচ্চিত্রকার বলতেই হবে। তিনি আরেক অকাল প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের (২৬ জানুয়ারি, ১৯৩৮-২০ জানুয়ারি, ১৯৮৯) যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন।
তারেক চলচ্চিত্রমাধ্যমেই তাঁর জীবনদর্শন ও বিশ্ববীক্ষার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর মানস আবৃত ছিল মার্কসবাদ, বিজ্ঞানচেতনা, ধর্মচেতনা এবং লোকসংস্কৃতির ভেতরকার মূল তিনটি উপাদান : মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাব দ্বারা। ‘মানুষ’ই তাঁর সব চলচ্চিত্রকর্মের কেন্দ্রে অবস্থান করেছে। তাই তাঁর বক্তব্য সবসময় মানবদরদি হয়ে উঠেছে। তারেক বোধহয় মধ্যপন্থী মনোভাবের চলচ্চিত্রস্রষ্টা, যাঁর কাছে চরম বা পরম বলে কিছু নেই। এক্ষেত্রে তিনি সহিষ্ণুতার সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করতেন বলে প্রতীয়মান হয়। এই সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি কিন্তু আমাদের চিরায়ত লোকসংস্কৃতির একটি বড় দিক। তারেক এদিকটিকেই লোকসংস্কৃতি, লোকসমাজ ও লোকদর্শনের নানা উপাদানে সজ্জিত করে তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয়, চরিত্র ও বক্তব্যের রূপায়ণে ব্যবহার করেছেন। এসব দিক বিবেচনা করে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রকর্মকে, আমাদের প্রারম্ভিক প্রস্তাব অনুযায়ী ‘লোকচলচ্চিত্র’ পর্যায়ভুক্ত করা যায়, আংশিকভাবে হলেও। 