তিনি সম্পাদকদের সম্পাদক

আমার একটি বইয়ের উৎসর্গ-পাতায় আবুল হাসনাতের পরিচিতি এভাবে তুলে ধরেছিলাম : ‘সম্পাদকদের সম্পাদক’। বইটির পেছনে তাঁর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে তাঁরই আগ্রহে আমার যে আরেকটি বই বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে বেরিয়েছিল, যার বিষয়বস্তু ছিল শিল্পকলা, তার পেছনেও তো তিনিই ছিলেন অনুপ্রেরণা। সেই ১৯৭৫ সালে গণসাহিত্য পত্রিকায় কামরুল হাসানের ওপর একটা লেখা আমাকে দিয়ে না লিখিয়ে নিলে তাঁর অথবা ওই পত্রিকার কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না, হতো আমার। বাংলাদেশের শিল্পকলা নিয়ে আমার আগ্রহ তেমন ব্যাপকভাবে হয়তো জাগত না, যেহেতু লেখাটি পড়ে কামরুল হাসান তাঁর মতিঝিলের অফিসে আমাকে ডেকেছিলেন এবং পটুয়া ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলেন, তাই সেই সাক্ষাৎকার আমার জন্য ছিল একটা মোড় ফেরার ঘটনা। বাংলাদেশের লোকশিল্প সম্পর্কে এরপর আমার নতুন করে আগ্রহ জাগে। আবুল হাসনাতও লোকশিল্পের অনুরাগী ছিলেন। শিল্পকলা সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। ভারতীয় শিল্পী গণেশ হালুই ও গণেশ পাইনকে তাঁর শিল্প বিচারের মূল্য দিতে দেখেছি।

একজন সম্পাদক একজন লেখকের লেখা নিয়েই ভাবেন, লেখা তেমন ভালো না হলে ঘষে-মেজে তার মানের উত্তরণ ঘটান, ভালো লেখা দিয়ে পত্রিকা-সাহিত্য পাতা সাজান; আর সম্পাদকদের সম্পাদক লেখক তৈরি করেন। আমি নিশ্চিত, আমার এই লেখা আবুল হাসনাত-সম্পাদিত গণসাহিত্য, সংবাদের সাহিত্যপাতা বা কালি ও কলমের কোনো লেখক লিখলেও হয়তো একইভাবে শুরু করতেন, বলতেন এই মানুষটি কত যত্নে, কত আন্তরিকতায় তাঁকে লেখক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন।

আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার পরিচয় সত্তরের শুরু থেকেই, তাঁকে আমি হাসনাতভাই বলে সম্বোধন করতাম। তারপর থেকে তাঁকে পেয়েছি একজন অগ্রজ, পথপ্রদর্শক ও বন্ধু হিসেবে। সংবাদের দফতর যখন পুরান ঢাকার বংশালে ছিল, তখন থেকেই সময় পেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। দেখতাম কত অভিনিবেশ নিয়ে, সময় ভুলে, সব মনোযোগ ঢেলে দিয়ে তিনি সম্পাদনার কাজ করেছেন। তাঁর টেবিলে ভিড় তেমন থাকত না, তাঁর কাজের সময়টাকে সবাই সম্মান করতেন, কিন্তু হাসনাতভাই নিজ থকেই সময় বের করে কথা বলতেন। মিতভাষী মানুষ ছিলেন, বলার চেয়ে শুনতেই বেশি পছন্দ করতেন, তবে যখন কাজের ফাঁকে অবসর মিলত অথবা কোনো আড্ডায় যোগ দিতেন, কথা বলাটা একটু বাড়িয়ে দিতেন। আমার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কথা বলেছেন দেশের বাইরে কোথাও গেলে বা দেখা হলে – কলকাতা, শান্তিনিকেতন, দিল্লি অথবা ফ্রাঙ্কফুর্টে। আমার মনে হতো, পরিচিত পরিবেশ আর কাজের দিনে বাইরের ঘণ্টা-প্রহরগুলোতে তিনি অনেকটাই নির্ভার বোধ করতেন, আলাপের মেজাজে থাকতেন। তাঁকে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি বিদেশ ভ্রমণের আড্ডাগুলোতে। সংবাদ অফিসে একদিন সন্তোষ গুপ্তের টেবিলে বসে ছিলাম আর শুনছিলাম সম্পাদক হিসেবে হাসনাতভাইয়ের নিষ্ঠার কথা। তিনি বলছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত একটি লেখা হাসনাতভাইয়ের বেঁধে দেওয়া মানে না পৌঁছাত, তিনি সেটি নিয়েই থাকতেন। তরুণদের অনেক সময় একই লেখা দু-তিনবার লিখিয়ে নিতেন। ‘হাসনাত ডাক্তার হলে রোগীর চিকিৎসা দিয়েই তার সঙ্গ ছেড়ে দিত না’, সন্তোষ গুপ্ত হেসে বলেছিলেন, ‘সেই রোগীর সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সে লেগে থাকত।’

সম্পাদনা আমাদের দেশে কঠিন একটি কাজ। লেখকেরা সাধারণত কোনো কিছু বদলাতে চান না, ভুল বাক্য লিখলেও সেটি স্বীকার করেন না। কিন্তু হাসনাতভাই কাজটিকে সহজ করেছিলেন তাঁর পাণ্ডিত্য আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে, তাঁর কুশলতা আর নিষ্ঠা দিয়ে। যে-কথাটি অনেকেই বলতেন একটা গৌরচন্দ্রিকা জুড়ে দিয়ে যাতে অপ্রীতিকর কোনো বিষয় একটু কৌশলে বলা যায়, তিনি বলতেন সংক্ষেপে, দু-এক বাক্যে, ‘আরেকবার একটু দেখবেন?’ এবং আমার জানা হয়ে যেত এই আবার দেখাটা কেন প্রয়োজন। প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা আমাকে একদিন বলেছিলেন, হাসনাতের সংক্ষিপ্ত মন্তব্যগুলো তাঁকে লিখতে সাহায্য করত, যদিও কাজ বাড়িয়ে দিত। এটি করতে গিয়ে নতুন লেখার রসদও তিনি যে পেয়ে যেতেন, তা-ও আমাকে বলেছেন।

কালি ও কলমের সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণের আগে আমার সঙ্গে তাঁর অনেক কথা হয়েছে। তাঁর স্বাধীনতা ষোলো আনা থাকবে কি না, এ নিয়ে তিনি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁকে আশ্বস্ত করলে প্রথম দিন থেকেই তিনি কাজ শুরু করে দেন। অল্প সময়েই কালি ও কলমকে তিনি একটা অনন্য উচ্চতায় তুলে দেন। সাময়িকীটি শুধু আমাদের দেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গেও অত্যন্ত জনপ্রিয়। শিল্প ও শিল্পীকে তিনি অনেক উঁচু মানের শিল্প সাময়িকী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন তাঁর সম্পাদনা-দক্ষতা এবং শিল্পকলা বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য দিয়ে।

তবে আমরা যতটা আবুল হাসনাতের সম্পাদনা-প্রতিভা নিয়ে আলোচনা করি, ততটা তাঁর অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান নিয়ে করি না। এটি নিতান্ত দুঃখজনক। মানলাম যে সম্পাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি অন্য সব অর্জনকে আড়ালে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু তাঁর মতো বহুমাত্রিক মানুষকে একটা বাক্সে বন্দি করে ফেলাটা অন্যায়। তিনি ষাটের দশকের শক্তিশালী কবিদের একজন, শিশু-কিশোরদের জন্য অসাধারণ কিছু বই লিখেছেন, উপন্যাস ও আত্মজীবনীমূলক লেখা লিখেছেন, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের নেতৃত্বে ছিলেন, ছায়ানটের অন্যতম সংগঠক ছিলেন, ছাত্র ইউনিয়নের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী এবং এর সহসভাপতিও ছিলেন, সংগঠনটির বিকাশে তিনি বড় ভূমিকা রেখেছেন, প্রথম শ্রেণির লিগে ক্রিকেট খেলেছেন। এতগুলো সক্রিয়তা ও গুণের সমাহার খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।

কবি হিসেবে তিনি ছিলেন জীবনবাদী। আধুনিক কবিতার নিরীক্ষাধর্মিতা বা জটিলতা অথবা বিমূর্ততার পরিবর্তে প্রকাশের সাবলীলতা, বোধ-অনুভূতির তীব্রতা এবং মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ককে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। যখন শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন, কল্পনার জগৎটা উন্মুক্ত করে তাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়েছেন। ভাষাটা সহজ করে বর্ণনাকে করেছেন আকর্ষণীয়। অথচ যখন প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁর ভাষায় এসেছে চিন্তার গভীরতা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের অব্যর্থতা। তিনি শুধু শিশুসাহিত্য লিখে গেলে এই পরিচয়টিই হয়তো তাঁকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা দিত। অথবা শুধু কবিতা লিখে গেলে। তাঁর লেখা শিল্প-প্রবন্ধগুলো সংকলিত হলে এবং এই পরিচয়টি তাঁর প্রধান হলে নির্দ্বিধায় তিনি শিল্প-লেখক হিসেবে অগ্রগণ্য হতেন।

দীর্ঘদিন হাসনাতভাইয়ের সান্নিধ্যে থেকে দেখেছি, নিজের কাজ নিয়ে কথা বলতে তিনি কুণ্ঠা বোধ করতেন। নিজ থেকে কোনো দিন তাঁর লেখা পড়তেও কাউকে বলেননি, আলোচনা করা তো দূরের কথা। তাঁর একটি কবিতার বইয়ে তাঁর স্বাক্ষর নিতে চাইলে তিনি সংকোচে তা দিয়েছেন। এটি শুধু বিনয় নয়, এ এক বিরল চারিত্রিক দৃঢ়তাও বটে, যা একজন লেখককে পাঠক-সমালোচকের দিকে না তাকিয়ে নিজের মতো করে লিখে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।

কেন জানি, সম্পাদনায় যতটা সময় তিনি দিয়েছেন, অন্য লেখালেখিতে ততটা দেননি। কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে, তা হলো একটি ক্ষেত্রে তাঁর সক্ষমতাকে অন্য ক্ষেত্রে লাগানোর ক্ষমতা। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁর দৃষ্টির কেন্দ্রে ছিল মানুষ-শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষ। সমাজতন্ত্রে, কমিউনিস্ট ভাবধারায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। গণমুখী শ্রেণির শাসনে নিঃশেষ হতে থাকা মানুষের পক্ষে তাঁর অবস্থান তাঁকে জীবনের ভেতর দৃষ্টি দিতে শিখিয়েছিল। এই গভীর দৃষ্টি তাঁর সাহিত্যচিন্তাকে নির্মাণ করেছে। হাসনাতভাইয়ের চিন্তার ভেতর যে পূর্বাপরতা ও শৃঙ্খলা ছিল, তা তাঁর রাজনৈতিক ও লেখক সত্তাকে পূর্ণতা দিয়েছে, তেমনি সম্পাদক হিসেবে তাঁকে গভীরতা প্রয়াসী করেছে। তাঁর সংস্কৃতি চেতনার সর্বাগ্রে ছিল গণমানুষের, প্রান্তের সম্পৃক্ততার বিষয়টি। এটি তাঁর সাহিত্যচেতনায় প্রভাব ফেলেছে। খেলার মাঠের শৃঙ্খলা চর্চা তিনি জীবনে করেছেন। আতিশয্য বলে কোনো কিছুই তাঁর কথায় অথবা কাজে আমি দেখিনি।

হাসনাতভাইয়ের কাছে কোনো না কোনোভাবে ঋণী নন, এমন মানুষের সংখ্যা কম। এই ঋণ তাদের চিত্তবান করেছে। প্রাণে-মনে তিনি বাঙালিয়ানার চর্চা করেছেন। এই চর্চাটা যদি আমরা আরো উদার করতে পারি, সবখানে তার বিস্তার ঘটাতে পারি, তাঁর ঋণ কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিতে পারব। হাসনাতভাইয়ের তুলনা চলে বাতাসের সঙ্গে। যত দিন তিনি ছিলেন, তাঁর অভাবের প্রশ্ন আসেনি, যেন তাঁর থাকাটাই স্বাভাবিক। এখন তিনি নেই, তাঁর অভাবটা প্রতিদিন আমরা অনুভব করব।