তিন নম্বর ফুসফুস

মোবাইল ফোন বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। এইসব ফোন ধরবার কোনো মানে হয় না। ধরলেই যে কথাবার্তা হবে তা এইরকম …

– আপনি কি শ্রী সুনীল তলাপাত্র?

– হ্যাঁ।

– আমি সোনালী মজুমদার, নিউ কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে বলছি … আপনার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলতে চাই, বলা যাবে?

– হুঁ, বলুন … একটু তাড়াতাড়ি …

– শ্রী তালপাত্র …

– তলাপাত্র …

– হ্যাঁ … দুঃখিত … তলাপাত্র … শ্রী তলাপাত্র, কনগ্র্যাচুলেশন্স, আপনার প্রোফাইল বিচার করে আমাদের ব্যাংক আপনাকে কোনো সিকিউরিটি ছাড়াই পাঁচ লক্ষ টাকার ঋণ মঞ্জুর করেছে … যা ছত্রিশটি মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে … এই ঋণের সুদ মাত্র ফোর পার্সেন্ট, চার শতাংশ … আপনি কি …

– ধন্যবাদ, আমার দরকার নেই …

অথবা বলবে …

– আমি অনন্য চৌধুরি, টুইটার মোবাইল থেকে বলছি … আপনি তো স্প্যারো মোবাইলের সার্ভিস নিয়েছেন … আমাদের এখন নতুন কানেকশনে প্রতি মাসে একশ জিবি ডেটা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে, আনলিমিটেড কল … নম্বর একই রেখে আপনাকে টুইটারের সার্ভিস দেওয়া যাবে … এই পোর্টিং করাতে কোনো ঝামেলা নেই … আপনার কানেকশন একেবারে ডিসটার্ব হবে না … শ্রী তলাপাত্র আপনি কি করাবেন? …

– ন্‌না … না, না, আমার ঠিকই চলছে …

এইজন্যই এইসব অচেনা নম্বর ধরেন না সুনীলবাবু। ফোনটা আবার বাজল। ওই নম্বর থেকেই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা অসুবিধা, ফোনটা বেজে-বেজে থেমে গেল। আবার বাজল। সাধারণত, এইসব কোম্পানি এমন অকাজের ফোন করলেও, এমন গোঁয়ারের মতো বারে বারে করে না। সুনীলবাবু টেক্সট পাঠালেন, আই ক্যানট টক রাইট নাও … আই উইল কল ইউ ব্যাক লেটার।

ফোন আসবার আগেই ডান-পা হয়ে গিয়েছিল, মেসেজ পাঠান শেষ হতেই বাঁ-পায়ের জুতোও হয়ে গেল। চৌরঙ্গি-মিডলটন স্ট্রিটের এই এলাকায় যে-কটি পালিশওয়ালা বসে, প্রত্যেকেই এক্সপার্ট। তাহলেও, এদের মধ্যেও, লছমন, লছমন দোসাদ হলো ফার্স্ট অ্যামঙ দ্য ইকুয়ালস! কুড়ি টাকা নেয় বটে, কিন্তু শেষ লপ্তে নরম কাপড় দিয়ে এমন আদর করে হাত বুলোয় জুতোর সারা গায়ে, কালো রং থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরোয়, ব্যক্তিত্বের ওজন বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ওই জুতো পরে অফিসে ঢুকলেই, সবাই না হোক, কয়েকজন অন্তত তাঁর জুতোর দিকে তাকিয়ে থাকবেই। এইখানেই লছমনের কৃতিত্ব। প্রশংসা আদায় করে নিতে জানে। এইজন্যই তো কলকাতা পুরসভার বড়কর্তা শ্রীযুক্ত সুনীল তলাপাত্র মাসে অন্তত দুবার গাড়ি চেপে এখানে আসেন পালিশ করাতে। এমন গুণী পালিশওয়ালার সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পালিশ করাতে তার মোটেই লজ্জা করে না। তিনি নিজেও বরাবর অন্যদের থেকে একটু আলাদা বলেই, পুরসভার মতো গয়ংগচ্ছ সরকারি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে সিনিওরিটিই প্রমোশনের একমাত্র মাপকাঠি, সেইখানে কাজ করেও অন্যদের থেকে দু-ধাপ এগিয়ে রাখতে পেরেছেন নিজেকে। যদিও আর ছ-মাস পরেই অবসর নিতে হবে, তবু তো আজকেই আর একটা উন্নতির চিঠি পেয়েছেন। ঠিক আছে, ছ-মাসই না হয় থাকবেন কমিশনার, তবু কমিশনারের পদ তো! চিঠি পাবার পরেই চলে এসেছেন পালিশ করাতে। 

লছমনকে পঁচিশ টাকা দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। সিটে বসেই বললেন, অফিস। তপন মনে-মনে ‘হ্যাঁ স্যার’ বলল। ও সাহেবের মেজাজ-মর্জি জানে। উনি এখন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। পার্কিং ফি দেবার জন্য গাড়িতে খুচরো টাকা-পয়সা রাখা থাকে। সেখান থেকে দশ টাকা নিয়ে পার্কিংয়ের টাকা মেটালো তপন। গাড়ি চালু হলো। সামনে-পেছনে করে, ডানদিকে কাটিয়ে লাইন থেকে গাড়ি বের করতে খুব কিছু অসুবিধা হলো না।

চৌরঙ্গি রোডে গাড়ি পড়তেই সুনীলবাবু মেসেজ পেলেন সেই অচেনা নম্বর থেকে – ‘ওকে। প্লিজ কল অ্যাট ইয়োর কনভেনিয়েন্স।’ কোনো অফিস এমন টেক্সট পাঠাবে না, অর্থাৎ ফোনটা এসেছিল কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে! কে তাকে এমন নেই-আঁকড়ের মতো খুঁজছে? করবেন-কি-করবেন-না কিছুক্ষণ এমন দোলাচলে থেকে ফোন করলেন ওই নম্বরে। দুবার রিং হতেই ওপার থেকে গলা ভেসে এলো, ‘সুনীল, শিবাজি বলছি রে … শিবাজি …’

শিবাজি … শিবাজি … অক্ষর তিনটিকে নিয়ে দশ সেকেন্ড খেলা করলেন সুনীল তলাপাত্র।

– ‘চিনতে পারছিস না? জেলা স্কুল থেকে আসা …’ 

পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় মনে পড়ে গেল। আরে শিবাজি, শিবাজি সেন! স্কুলের নামী অ্যাথলেট এবং হকি খেলোয়াড়। ‘আরে কী খবর বল? … কী করছিস তুই এখন? … কোথায় থাকিস? … বিয়ে করেছিস নিশ্চয়? ছেলেমেয়ে কটি? কী করে?’

‘উরিব্বাবা, এতো প্রশ্নের উত্তর একবারে কী করে দেব? ছেলে একটা আইটি ফার্মে কাজ করে … খুব ভালো কিছু নয় … নড়বড়ে চাকরি, যে-কোনো দিন … অন্য চাকরি খুঁজছে … আর আমার ছোটখাটো ব্যবসা … এই আর কি … বাকি, পরশু দিন, তোর বাড়ি গিয়ে বলব … তুই তো সল্ট লেকে আট নম্বর ট্যাঙ্কের উলটোদিকের দোতলা বাড়িতে থাকিস, এক বউ, স্কুলে পড়ায়, এক ছেলে মুম্বাইতে চাকরিতে ঢুকেছে, মেয়ে আমেদাবাদে, তাই তো? …’

‘হ্যাঁ, কিন্তু, তুই …’

সুনীল কথা শেষ করবার আগেই শিবাজি বলল, ‘তাহলে পরশু, রোববার সকাল দশটা নাগাদ … লুচি-আলুভাজা করে রাখতে বলবি … ঠিক আছে …’, ফোন কেটে গেল।

শিবাজিটা একইরকম আছে, যে করে হোক নিজের কথাটা প্রথমে বলবেই। একবারও জিজ্ঞেস করল না পরশু রোববার সুনীল বাড়ি থাকবে কি না, থাকলেও অসুবিধা কি না, ধরেই নিল ও যা বলবে সেইটাই মানা হবে। স্কুল ছাড়ার পঁয়ত্রিশ বছর পরে কথা হচ্ছে, তবু সেই একইরকম। প্রথম হতেই হবে ওকে। এমনকি রাস্তার ধারের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসলে প্রথম কথাটা  বেরুবে শিবাজির মুখ থেকেই  – ‘মাসিমা গো খাবার জলের জগটা কোথায়? আর হ্যাঁ, সবাইকে আলুর দম-পাউরুটি দাও তো …।’ খাবার শেষে আর কেউ মানিব্যাগ বের করবার আগেই যে শিবাজি দাম মিটিয়ে দেবে, এও সবার জানা। কখনো টাকা ফুরিয়ে গেলে পাঁচ বন্ধুকে ধরবে – ‘অ্যাই তোরা প্রত্যেকে এক টাকা করে দে তো …।’ কোনো একজন পাঁচ টাকা দিতে চাইলে নেবে না – ‘তোর থেকে এক টাকার বেশি নয় …।’ পাঁচজনের থেকে তার আলাদা-আলাদা করে এক টাকা পাওয়া চাই। ‘বুঝলি না, যা বাজার পড়েছে পাঁচ টাকা দিতে গায়ে লাগে, এক টাকা তবু সহ্য করা যায় … তোদের গায়েও লাগল না  আর আমারও পাঁচ টাকা এসে গেল।’ – এই ছিল ওর যুক্তি! সেই শিবাজি এতোদিন পরে …

স্পিড ব্রেকার টপকাতেই চটকা ভেঙে গেল। অফিস এসে গেছে। গত মাসে ঢাকা বেড়াতে গিয়ে এই স্পিড ব্রেকারের বেশ একটা জুতসই বাংলা শিখে এসেছেন সুনীল – গতিরোধক। কথাটা তো এই শহরেও চালু করা যায় – ‘সামনে গতিরোধক, সাবধান’, জায়গামতো এমন বোর্ড লাগালেই, মুখে-মুখে চালু হয়ে যাবে এই লব্জ। বিকেলের মিটিংয়ে কথাটা পাড়তে হবে। কীভাবে অবতারণা করবেন প্রসঙ্গটির? নিজের চেয়ারে বসতে-বসতে তারও হিসাব কষে ফেললেন মিস্টার সুনীল তলাপাত্র। কলকাতা শহরকে তিনি একটা নতুন কাজের শব্দ উপহার দিচ্ছেন, এ-ভেবেই হালকা আত্মপ্রসাদ হলো। বস্তুত, যে-কোনো ব্যাপারে প্রথম হলেই বেশ একটু ফুরফুরে লাগে।

স্কুলে পড়ার সময় যে-যে বিষয়ে প্রথম হলে নামডাক হয়, যেমন খেলাধুলো-নাটক-গান-আবৃত্তি, তার কোনোটাই সুনীলের জোটেনি, ওইসব শিবাজির দখলে। একেবারে শেষ মুহূর্তে উদয় হয়ে কী করে যেন ভিক্টরি স্ট্যান্ডের এক নম্বর জায়গাটা ঠিক দখল করে নেবে! বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়, যা স্কুলের ছেলেদের মুখে-মুখে স্পোর্টস, একশ মিটার দৌড়ে খুব উত্তেজনা হতো। ক্লাস ফাইভ অবধি একশ মিটারে সুনীল বরাবরের ফার্স্ট। সিক্সে কৃষ্ণনগর জেলা স্কুল থেকে এসে ভর্তি হলেন মূর্তিমান শিবাজি সেন! ওর ভর্তির পনেরো দিনের মাথায় স্পোর্টস।

যথারীতি হুইসেল বাজাতেই দৌড় শুরু। পঁচানব্বই মিটারের মাথায় আড়চোখে সুনীল দেখলেন পাশের ট্র্যাকেই শিবাজি প্রায় ধরে ফেলেছে। গতি বাড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে একটু ঝুঁকতেই শরীরের ভারসাম্য গুলিয়ে গেল। সামনে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়তে-পড়তে সুনীল দেখলেন, পাশ দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল শিবাজি। সেবার ভিক্টরি স্ট্যান্ডে এক নম্বরে শিবাজি সেন, দুইয়ে নাসিম আলি আর তিন নম্বরে শৈবাল ভদ্র। অবশ্য চারশো মিটারে কোনোরকমে মচকান পা নিয়েও তিন নম্বরের পুরস্কারটা পেয়েছিলেন সুনীল। ফার্স্ট শিবাজি। তারপর থেকে যে-কোনো দৌড়ে শিবাজিকে আর হারানো যায়নি। সবার পিছু-পিছু দৌড়ে শেষ মুহূর্তে হঠাৎ কোনো এক ঝটকায়, নতুন দমে যে কী করে সবার সামনে চলে যেত! চারশো মিটারের দৌড়েও তাই … তিনশো অবধি সুনীলের থেকে দু-ফুট পিছিয়ে, চারশোর পাক শুরু হতেই এক ফুট ব্যবধান কমিয়ে নিল, দশ সেকেন্ডের মধ্যেই গায়ে-গায়ে, ফিনিশিং লাইনের তিন ফুট আগে রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো সবাইকে ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। আশিস বলত, ওর নির্ঘাৎ একটা তিন নম্বর ফুসফুস আছে, যার ভাল্ব‌ ব্যাটা শেষ মুহূর্তে খুলে দেয়। সুনীল হাঁপাতে-হাঁপাতে শুনলেন মাঠের ধারের দর্শক চেঁচাচ্ছে – শিবাজি, শিবাজি, শিবাজি …। কেউ-কেউ রথের মেলায় কেনা তালপাতার শিঙা ফুঁকছে।

রবীন্দ্রজন্মোৎসবে নাটক মঞ্চস্থ করত স্কুলের ছেলেরা। রবীন্দ্রনাথের নাটক। একবার হলো মুক্তধারা। পুরো নাটক নয়, বাংলার মাস্টারমশাই তুলসীবাবু যে সংক্ষেপিত রূপ দিয়েছেন, সেইটাই হবে। উনিই পরিচালক। ঠিক করবেন কে কোন চরিত্র করবে। অভিনয়টা তেমন আসে না সুনীলের, ও বাদ পড়ল। শিবাজি হয়ে গেল ধনঞ্জয় বৈরাগী। ও যখন গান ধরল – আমি মারের সাগর পাড়ি দেব, বিষম ঝড়ের বায়ে/ আমার ভয়-ভাঙা এই নায়ে/ আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো – সহপাঠীরা তো বটেই, মাস্টারমশাইদেরও অনেকে অবাক। আরে! ছেলেটা তো বেশ ভালো গান করে! তুলসীবাবু এক টিপ নস্যি নাকে গুঁজে ভূগোল স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বুঝলেন প্রতুলবাবু, এই যে ওর গলাটা কেমন ভাঙা-ভাঙা, সেইজন্যই ওকে সিলেক্ট করলাম, গানটা কেমন খুলেছে বলুন …।’ প্রতুলবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘হুঁ, একেবারে বৈরাগীর গলা …।’ অঙ্কের স্যার বললেন, ‘হ্যাঁ রে এইটার তাল তো কাহারবা, তুই দাদরায় গাইছিস কেন?’ শিবাজি বলল, ‘স্যার অতো বুঝি না, আমার এক কাকু নাটক করে, ও শিখিয়েছে …।’ স্যার মাথা নাড়লেন, ‘শুনতে তো ভালোই লাগছে রে! এইভাবেই গাইবি।’

যদি স্কুলটা কো-এডুকেশন হতো, ওর দৌড় আর নাটক দেখেই প্রেমে পড়ে যেত বহু মেয়ে। নির্ঘাৎ। কিন্তু ছেলেদের স্কুল হয়েও শিবাজির প্রচুর অনুরাগী জুটে গেল। এইট-নাইনের বহু ছাত্রই ওর চ্যালা, ওরা শিবাজিদা-শিবাজিদা বলতে-বলতে নানান ছুতোয়-নাতায় ওর সঙ্গ পেতে ছুটে আসে। শিবাজি ওদের অঘোষিত নেতা। কখনো পড়া দেখিয়ে দেয়, কখনো দৌড়, হাইজাম্প, লং জাম্প প্র্যাকটিস করায়, আবার কখনো ওদের হকি খেলায় বাঁশি গলায় ঝুলিয়ে আম্পায়ার হয়ে যায়। আম্পায়ার এবং কোচ। দু-দলকেই পরামর্শ দেয়। স্কুলে ঢোকবার অল্পদিনের মধ্যেই শিবাজি স্কুলের নায়ক। থিয়েটার-সিনেমায় এমন হয়। এর আগে হিরো ছিলেন সুনীল। ওই জায়গার দখল নেওয়াতে কষ্ট যে হয়নি, তা তো নয়। ঈর্ষাও যে হয়নি একটু-আধটু, তাও বলা যাবে না। তবে স্কুলজীবনের একটা মজা, এতো ঘোড়দৌড়ের মধ্যে থাকতে হয় সারাক্ষণ, এতো হুড়ুদ্দুমের মধ্যে দিন কাটে, ঈর্ষা শিকড় গাড়বার সুবিধা পায় না, চারা শুকিয়ে যায়। সবাই সব কাজ পারে না – সুনীল এইভাবেই বুঝিয়েছিলেন নিজেকে।

অবশ্য একটা গর্বের জায়গা ছিল সুনীলের। ক্লাসে তার বরাবরের ফার্স্ট হওয়াটা কেউ আটকাতে পারেনি। শিবাজি সেখানে ফোর্থ কি ফিফথ হতো। একবার সেভেন্থও হয়েছিল। ক্লাস টেনে তো এক থেকে দশের মধ্যে ওর নামই নেই। ওই ভিক্টরি স্ট্যান্ডের এক নম্বর জায়গাটা সুনীলের জন্য বাঁধা। তারপর স্কুলে আমদানি হলো সত্তর সালে জঙ্গি রাজনীতি। সুনীল-শিবাজি-শাশ্বত-রথীন-শৈবাল সবাই জড়িয়ে গেল তাতে। শিবাজি দেয়ালে সেøাগান লিখত – ‘হ্রদে তৃষ্ণার জল পাবে কতকাল?/ সম্মুখে টানে সমুদ্র উত্তাল;/ তুমি কোন দলে? জিজ্ঞাসা উদ্দাম;/ গুন্ডার দলে আজও লেখাও নি নাম?’ এইটা যে সুকান্ত ভট্টাচার্যের, অনেকেই জানত না। ওর লেখা সেøাগান দেখে, তারা গোটা কবিতাটা পড়ল। দাড়িও রেখেছিল। বেশ চে গুয়েভারার মতো লাগত ওকে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা চে গুয়েভারা! ওর হাতে রং-তুলি এগিয়ে দিত শৈবাল। সুনীল রাজনীতির পাঠচক্র চালাতেন এইট-নাইনের ছেলেদের নিয়ে। শাশ্বত বোমা বানাতে ওস্তাদ। রথীন কোত্থেকে একটা পাইপগান জোগাড় করে নিয়ে এলো স্কুলে। সে কী উত্তেজনা! কাউকে মারবার নেই, তবু সে স্কুলব্যাগের মধ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে। ইলেভেনের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা ভণ্ডুল হয়ে গেল। সেøাগান উঠল, বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা মানছি না। ওদের রাজনীতির ঠেলায় টেস্টও নিতে পারল না কর্তৃপক্ষ। সুনীলদের পাঁচজনকে আলাদা-আলাদা করে জেরা করল পুলিশ। 

হঠাৎ একদিন খবর এলো শিবাজিকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ, ভোররাতে। ও নাকি তলায়-তলায় গ্রামেও ঘুরে এসেছে দু-একবার, গেরিলা ট্রেনিং নিতে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাটা পুলিশ পাহারায় অবশ্য ঠিকঠাক হয়েছিল। পরীক্ষার এক মাস আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল শিবাজি। বন্ধুরা নোটখাতা দিয়ে সাহায্য করেছিল ওকে। অতনু-অসিত-দীপঙ্কর সবাই দিয়েছিল। সুনীলের সঙ্গে পরীক্ষার আগে আর দেখা হয়নি ওর। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল সুনীল তলাপাত্র সেভেন্টি এইট পার্সেন্ট, হাজারে সাতশো আশি। শিবাজি স্কুলে ঢুকল অনেক পরে। 

– কী গুরু! কত পার্সেন্ট? রথীন জিজ্ঞেস করল।

– এই কত আর হবে … সাতশো একাশি …

শাশ্বত বলল, বাহ্, সেভেন্টি এইট পয়েন্ট ওয়ান … ফাটিয়ে দিয়েছ বস।

শিবাজি উচ্চারণ করা মাত্রই অবশ্য সুনীল বুঝে গিয়েছিলেন এবার আর ভিক্টরি স্ট্যান্ডে তার দাঁড়ান হলো না। ক্লাস টেনের স্কুল-পরীক্ষায় প্রথম দশের মধ্যে না-থাকা শিবাজি সেন উচ্চ মাধ্যমিকের ফাইনালে সুনীল তলাপাত্রকে সরিয়ে এক নম্বরে। এইটাই তো থাকবে, স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট আর কে মনে রাখে! সুনীলের ভেতরে-ভেতরে চিনচিন করলেও বাইরে শিবাজিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, বাহ্‌, কামাল করে দিয়েছিস। স্কুলের মধ্যে তুই-ই হায়েস্ট।

– ‘আরে ছাড় … চল চল … আজ পুঁটিরামের দোকানের লুচি ডাল …’

সবাইকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল দোকানে। ওদের পাঁচজনকে খাইয়েছিল শিবাজি। খেতে-খেতে সুনীল লক্ষ করেছিলেন শিবাজির বাঁ-চোখের তলায় কালো দাগ, চোখের ভেতরটা লাল। ডানহাতের তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, ‘কী করে হলো?’ শিবাজি হাসল, ‘ওই আর কি, জেলের আদর … পুলিশকে কে যে খবর – ।’ কথা অসমাপ্ত রেখেই শাশ্বতকে বলল, ‘সরের নাড়ু খাবি তো?’ ও হ্যাঁ-না বলবার আগেই হুকুম গেল, ‘অ্যাই পল্টু এইখানে পাঁচটা সরের নাড়ু দে …।’

সেই শিবাজি এতোদিন পরে! কেন হঠাৎ ফোন করল? কেন বাড়িতে আসতে চায়? বাড়ি ফেরার পথে সারাটা রাস্তা ভাবনাটা চুয়িংগামের মতো সেঁটে রইল মাথার ভেতর। অফিসের কাজের কথা ভেবে মনটা অন্যদিকে ফেরাবার চেষ্টা করলেও সুনীলবাবু বুঝে গেলেন রোববার না আসা পর্যন্ত, এ-সঙ্গ ছাড়বে না। যে-কাজগুলো অভ্যাসে  হয়ে যায়, নিজের নিয়মে চলল। ঠিক আটটায় বাড়িতে ঢোকা। ঢুকলেন। গা ধুয়ে, কফি খেতে-খেতে টেলিভিশনে খবর শোনা। শুনলেন। রাতের খাবারের পরে , বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি দামি সিগারেটের অর্ধেক পান করে ফেলে দেওয়া। করলেন। তারপর শুয়ে পড়া। শুলেন। শোবার আগে রবিবার সকালের লুচি-আলুর দমের ব্যাপারটা বলে দিলেন স্ত্রীকে। মালতী বললেন, ‘একটা মানুষ আসছেন এতো বছর পরে, শুধু লুচি-আলুর দম খাইয়ে ছাড়া যায় নাকি … মিষ্টি কেনা দরকার … লাঞ্চ খেয়ে যেতে বললেই তো হয়?’ অভিজ্ঞতা বলে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই, জল যেদিকে যেতে চায় যাক। হুঁ বলে দ্রুত সরে যেতে হয় এই সময়।

তখন মাঝরাত, ঘুম ভেঙে গেল সুনীল তলাপাত্রের। গুমোট কেটে গিয়ে চরাচর একটু ঠান্ডা। দূরে কোথাও বৃষ্টি হলে এমন হয়। বাথরুম ঘুরে বিছানায় ফেরবার পথে মনে হলো, শিবাজি আসছে ওর ছেলের চাকরির তদ্বির করতে। ওই যে বলল না, ছেলের চাকরি নড়বড়ে, অন্য কিছু খুঁজছে। শিবাজির বলা কথাগুলি মনে-মনে আবৃত্তি করলেন সুনীল। একদম তাই, ছেলের চাকরির ব্যাপারটাই আসল। আলোর ঝলকানির পরেই কড়কড় বাজ পড়ল হঠাৎ। ভিক্টরি স্ট্যান্ডে দাঁড়ান এক নম্বর ছেলে এইবার স্টিমারঘাটের কাদায় পড়েছে। আসছে তার ছেলের জন্য চাকরি চাইতে! ও কীভাবে পাড়বে প্রসঙ্গ? অনুমান করবার চেষ্টা করতে মজা লাগল। কাজের সুবাদে সরল-ধান্দাবাজ-গোঁয়ার-অশিক্ষিত-মাথামোটা-চতুর নানারকমের লোক তো দেখলেন সুনীল সারাজীবন। সবকটি হিসাবে ফেলে শিবাজির কথা পাড়বার জ্যামিতির আন্দাজ পেতে রুবিক কিউবের ধাঁধা মেটানোর মতোই মনোযোগ লাগে। আর ঘুম আসতে চাইল না। বারান্দায় বসে চোখের সামনে অন্ধকার ফিকে হওয়া দেখলেন পুর-অধিকর্তা। রাস্তার এ-পার ও-পার জুড়ে জেব্রা ক্রসিংয়ের দাগ ছিল কোনোকালে। এখন সব মুছে, এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুঁয়ে পড়ে আছে একটাই লম্বা সাদা লাইন। যাকে সেই অ্যানুয়াল স্পোর্টসের চুনগুঁড়ো দিয়ে টানা ফিনিশিং লাইন মনে হয়। অন্যদিনের মতো প্রাতঃভ্রমণকারীরা বেরিয়ে পড়েছে। সুনীলও ঘুরে এলেন এক পাক। শনিবার অফিস ছুটি থাকলেও উচ্চপদস্থদের কেউ-কেউ যায়। সেক্রেটারিকে অফিসে আসতে বলে অন্যদিনের নিয়মেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন। 

অফিসে যাবার একটি বিশেষ কারণও ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা দরকার তাদের অফিসে আইটি মানে ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগে কোনো লোকের দরকার আছে কি না? সেক্রেটারি জানাল, হ্যাঁ ভ্যাকেন্সি আছে। এবং সুনীল একটু চেষ্টা করলে শিবাজির ছেলের না হবার কোনো কারণ নেই। কেন বন্ধুর ছেলের জন্য এতো ভাবছেন সুনীল? বিশেষত, যে-বন্ধুর সঙ্গে তিন দশকের ওপর দেখা হয়নি? এইসব প্রশ্নের উত্তরে শিবাজির বাঁ-চোখের তলার সেই কালশিটে, চোখের সেই রক্তক্ষরণের ছবি ভাসে। একেবারে ভেতরের কোনো এক ছোট কৌটো খুলে  যত্নে লুকানো কিছু কথা বেরিয়ে পড়ে হাওয়ায় উড়তে থাকে, হাজার-হাজার বছর পরে ইজিপ্টের রাজা তুতেনখামেনের কফিন থেকে বেরিয়ে আসা ক্ষুদ্র কীটের মতো! শিবাজির চোখের ওই রক্তের দাগ, শুধু পুলিশের হাতে কেন, সুনীলের হাতেও তো লেগে আছে। যখন আলাদা-আলাদা জেরা করেছিল পুলিশ, শিবাজির গ্রামে যাবার খবর কে দিয়েছিল? ভেতরের সত্যি সুনীল যখন আজকের চেয়ারে বসা সুনীলকে এই প্রশ্ন ছুড়ে মারে, তার কিছু বলার থাকে না। আর তো কেউ জানত না রে সুনীল, শিবাজি যদি এই প্রশ্ন করে তাকে? এই রবিবার? নাঃ, এতোদিন যখন বলা হয়নি, আর বলবার কোনো মানে হয় না। বরং ওর ছেলের চাকরিটা করে দিলে অপরাধবোধ কিছু কমে। কিন্তু অত সহজে জিতে যাবে শিবাজি?

শনিবার রাতেও ভালো ঘুম হলো না। ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘুম। যখনই ভাঙে মনে হয়, শিবাজি কী করে কথাটা পাড়বে? ভিক্টরি স্ট্যান্ডের এক নম্বরে দাঁড়ান দৌড়বাজ, মুক্তধারার ধনঞ্জয় বৈরাগী, সত্তরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা চে গুয়েভারার গলায় কেমন ফুটবে মিনতির সুর? ও কথা পাড়ল আর সুনীল ঘাড় নেড়ে ব্যবস্থা করে দিলেন, খেলাটা অত সহজ করা ঠিক হবে না। আজকাল চাকরি পেতে দম বেরিয়ে যায়। কত যোগ্য লোক মুখ শুকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রথমে দেখছি-দেখব করে কাটাতে হবে দু-সপ্তাহ, এক মাস। শিবাজির গলা যখন বেশ কাতর হবে, অশ্রু চিকচিক করবে চোখের কোণায়, তখনই বরাভয়ের মুদ্রা দেখান উচিত কাজ।

অন্যদিনের মতো রবিবারের সকালে বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন সুনীল তলাপাত্র। দুটো ইংরেজি আর চারটে বাংলা – সবমিলিয়ে ছ’টা কাগজ আসে বাড়িতে। চা-সিগারেট খেতে-খেতে কাগজ পড়বার সুখের কোনো বিকল্প হয় না। তখনই গাড়িটা এসে থামল বারান্দার তলায়, রাস্তার কোণা ঘেঁষে। গাড়িটা বেশ বড়, রং একেবারে নিখুঁত নেভি ব্লু। এই রঙা সোয়েটার পরতে হতো শীতকালে। স্কুলের নিয়ম। বাঁ-দিকের দরজা খুলে একটি পা বেরিয়ে এলো। যা দেখে চমকে উঠলেন সুনীল। এইরকম একটা দামি গাড়ি থেকে যে একটা হাওয়াই চটি পরা পা বেরিয়ে আসবে, ভাবাই যায় না। এইবার আরোহী নামলেন। প্রশস্ত কপাল, চোখে চশমা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ – স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে আর উঠতি কবিরা এমন ব্যবহার করে।  লোকটি এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। ওপরের দিকে তাকাতেই খবরের কাগজে মুখ ঢাকলেন সুনীল। একতলা থেকেই হয়তো জিজ্ঞেস করবে, দাদা দুশো পাঁচ নম্বর বাড়িটা কোন দিকে কিংবা ডাক্তার তুহিন সেনের বাড়িটা কোথায়, নিউরোলজিস্ট? এতোদিন সল্ট লেকে থেকেও নিজের ব্লকের অনেককেই চেনেন না সুনীল আর তাছাড়া দোতলার বারান্দা থেকে পথনির্দেশ দিতে পুর-অধিকর্তার অহংকারে লাগে। প্রতিটি গলির মোড়ে-মোড়ে সাইনবোর্ড আছে বাড়ির নম্বর দিয়ে, খুঁজে নাও না বাপু।

কলিংবেল বাজতে দরজা খুলে যে মুখটিকে দেখলেন সুনীল, তা অচেনা। কিন্তু সেই অচেনা মুখ হাসছে। ‘সুনীল তো?’ দ্রুত মাথা থেকে পা জরিপ করতেই থই পাওয়া গেল – এই সেই লোক যে একটু আগেই গাড়ি থেকে নেমেছে; এবং এই শিবাজি। ‘আরে আয় আয়, চেহারা তো একদম পালটে গেছে, সামনের দিকের চুল নেই, যতটুকু আছে পাতলা, কত ঘন চুল ছিল! আবার খোঁচা-খোঁচা দাড়ি রেখেছিস … তোর তো চশমা ছিল না? …’, কথা বলার ফাঁকে ওর বাঁ-চোখটা দেখে নিলেন সুনীল – না লাল নেই, তবে একটা কালো টিপের মতো বিন্দু আছে। ‘… তামাটে হয়ে গেছে গায়ের রং … কী সুন্দর, ফর্সা গায়ের রং ছিল তোর … ঠিক যেন সুফি সাধক …’ সুনীল ঠিক করেই নিয়েছেন, আজ প্রথম থেকে উনি চালিয়ে খেলবেন, শিবাজিকে শুনতে হবে।

অতিথিকে সোফায় বসিয়ে অন্দরের দিকে হাঁক দিলেন সুনীল – ‘অ্যাই শুনছো … শিবাজি এসেছে … একটু গন্ধরাজ ঘোলের শরবত …।’ ইচ্ছে করেই গন্ধরাজ লেবুর কথাটা উচ্চারণ করলেন। ঘোলের শরবত খাওয়ানটা কোনো ব্যাপার নয়; কিন্তু গন্ধরাজ লেবু দেওয়া ঘোল আর ক’টা বাড়িতে পাওয়া যায়? 

খবর দেওয়া-নেওয়ার শুরুতেই নিজের কথা সাতকাহন করে বললেন সুনীল। কত কষ্ট করে সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার পড়াশুনা করেছেন। একবারেই যে বেশ ওপর দিকে জায়গা পেয়েছেন, তাও জানাতে ভুললেন না। বলতে-বলতে খেয়াল রাখছিলেন শিবাজির চোখ-মুখ পালটে যাচ্ছে কি না। ও শুধু হাসছিল। এ-হাসির কোনো চরিত্র নেই – আনন্দের না ঈর্ষার বোঝা শক্ত। তবে ওর চেহারা, জামাকাপড় দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, দীন অবস্থা, তেমন সুবিধা করতে পারেনি জীবনে। যে গাড়ি করে এসেছে, নিশ্চয়ই নিজের নয়। ওর বন্ধুভাগ্য বরাবরই ভালো, কেউ হয়তো আজকের দিনের মতো চড়তে দিয়েছে গাড়িটা। এক বন্ধুর গাড়ি চেপে অন্য বন্ধুর কাছে এসেছে ছেলের চাকরির উমেদারি করতে! ও কীভাবে ছেলের চাকরির কথাটা পাড়বে, মুখ দেখে অনুমান করবার চেষ্টা করলেন সুনীল। অনুমান করতে কিছু সুতো ছাড়া দরকার।

– আরে আমি তো এতোক্ষণ আমার কথাই বলে যাচ্ছি, তোর কথা বল? … আচ্ছা এটা তো বললি না কী করে জানলি আমি এখানে থাকি? তারপর ছেলেমেয়ের কথা …

শিবাজি হাত তুলে হেসে ফেলল, বলছি, বলছি … তুই তো বিখ্যাত লোক, কাগজে নাম বেরোয়, খোঁজ নিয়ে জানলাম তুই এখানে থাকিস …

– কিন্তু …

– বলছি, বলছি, তোর ফোন নম্বর তো গ্রিন ডায়রেক্টরিতেই আছে, ওই যে বিখ্যাত লোকদের কনট্যাক্ট নম্বর যেটায় পাওয়া যায় … আর তোকে তো পরশুই বললাম আমি ব্যবসা করি … কেবল টিভির ব্যবসা, এখানে যে তোদের কানেকশন দিয়েছে, আমার এজেন্ট, সেই বাপি-ই খবর দিলো সব … জানবি বাড়ির ঠিকেঝি আর কেবলওয়ালাদের কাছে এলাকার সব খবর থাকে … আর মাছের ভেড়ি লিজ নিয়েছি বসিরহাটের দিকে … এই তো …

সাতষট্টির ধনঞ্জয় বৈরাগী, সত্তরের চে গুয়েভারা আজ কেবলের ব্যবসা করছে, মাছের ভেড়ি সামলাচ্ছে, ভাবতেই গুড়গুড়িয়ে হাসি এলো। সত্যি বলতে, এইসব জানার দিকে সুনীলের মন নেই। কীভাবে ও ছেলের কথাটা পাড়ে, তা লক্ষ করতেই তিনি একাগ্র।

– তোর মনে আছে সুনীল, ক্লাস নাইনে বায়োলজি স্যার এক্সকারশনে যাবার ধুয়ো তুললেন … ওঁরই দায়িত্ব আমাদের টিকিট কাটবার, বালেশ্বরে থাকার ব্যবস্থা করবার … আমরা সব হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেছি … বায়োলজি স্যার সিন থেকে হাওয়া …

সুনীল হাসলেন, ‘ হ্যাঁ-হ্যাঁ … তারপর আমরা সবাই বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরে ফিরলাম …’

– ‘একদম ঠিক … আমার আগেই মনে হতো, সেই থেকে আরো মনে হয়, প্রতিটি সম্পর্কের দায়িত্ব আছে …’

তাহলে কি এই পথ ধরেই ও ছেলের প্রসঙ্গে আসতে চাইছে? বাবা হিসেবে ছেলের চাকরির খোঁজ ওর দায়িত্ব, আর তা পূরণে বন্ধুর শরণাপন্ন হয়েছে। কিন্তু সুনীল অত সহজে চাকরির ব্যবস্থা করবেন না, মন ঠিক করে ফেলেছেন। কিছুটা ঘোরাতে হবে ওকে। আবার এমনও হতে পারে, এই কথার আড়ালে লুকিয়ে আছে ওর সেই সেদিনের অভিযোগ – পুলিশ জানল কী করে আমার গ্রামে যাবার খবর? আর তো কেউ জানত না? বন্ধুতার সম্পর্ক তো এইটাই দাবি করে, অন্য বন্ধুর পাশে দাঁড়াব, দাঁড়াতে না পারি, তাকে বিপদে ফেলব না … তাই না রে বন্ধু?

সুনীল তলাপাত্র সতর্ক হলেন – ‘… বটেই তো, সেদিন কী হাস্যকর যুক্তিতে বায়োলজি স্যার স্টেশনে যাননি, জানিস তো? …’

– ‘কী একটা হাসির কথা, ঠিক মনে পড়ছে না … কী হয়েছিল রে?’

– ‘নতুন বিয়ে করেছেন, খেয়াল ছিল না ওইদিন শ্বশুরবাড়ি যাওয়া, জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খেতে …’

‘বোজো কাণ্ড’, বলেই হা-হা করে হেসে উঠল শিবাজি। সেই ধনঞ্জয় বৈরাগীর হাসি। প্রসঙ্গ পালটে যেতে সুনীল দম নিলেন একটু। কিন্তু এইটা নিশ্চিত ও ছেলের চাকরির কথা বলতেই এসেছে। ও আবার এদিক-সেদিক করতে-করতে পেনাল্টি বক্সে ঢোকবার চেষ্টা করবে।

পুরনো দিনের কথাই বলতে থাকল শিবাজি। তপেশ কীভাবে সংস্কৃত স্যার হরিচরণবাবুকে বেকায়দায় ফেলেছিল সে-কথা, ‘তোমার প্রিয় বই’ রচনা লিখতে গিয়ে মনসূর লিখেছিল হেডস্যার অধীরবাবুর কোর ম্যাথামেটিক্স-এর কথা। ‘ব্যাটা কি দুষ্টু, রচনার শেষে লিখল বইটিতে প্রচুর বানান ভুল, সরল করবার পর উত্তর যা আসে তার সঙ্গে বইয়ের শেষে দেওয়া যে উত্তর, মেলে না, স্বয়ং কেশব নাগ মশাইও ওই উত্তর মেলাতে পারবেন না, জ্যামিতির ধাঁধা স্বয়ং লোনি-ও সমাধান করতে পারবেন না, তবু বইটি আমার প্রিয়, কারণ বইটি আমাদের প্রধান শিক্ষক মহামহিম অধীররঞ্জন ভট্টাচার্যের রচনা …।’ বলতে-বলতে সেই কিশোরবেলার মতোই হেসে উঠল শিবাজি।

সুনীলও হাসলেন, তবে অভ্যাসে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না ও কীভাবে ছেলের কথাটা পাড়বে। ওর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, ঠোঁটের প্রতিটি বঙ্কিমভাব খুঁটিয়ে লক্ষ করলেন। কথা পাড়বার ধরনটি অনুমান না করা গেলেও যেভাবে লুচি-আলুর দম শেষ করল, বোঝাই গেল সকাল থেকে কিছুই খায়নি। একটু-আধটু করুণাই হলো ভিক্টরি স্ট্যান্ডের এক নম্বরে দাঁড়ান ছেলেটার ওপর। কিন্তু যতক্ষণ না ওর চোখের কোণ চিকচিক করে উঠছে –

‘বুঝলি সুনীল এই ব্যবসা করতে গিয়ে কতরকম যে মানুষ দেখলাম … শুরু করেছিলাম ছোট করে, এখন বাড়তে-বাড়তে বিরাট হয়ে গেছে … শহরের দু-তিনটে এলাকা তো বটেই, মফস্বলেরও বেশ কয়েকটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছি আমরা … আমার ফান্ডা খুব সোজা, গণতন্ত্র মেনে ব্যবসা চালাও সমবায় পদ্ধতিতে, সব ভালো চলবে … আমার অফিসের দারোয়ানও আমার ভুল দেখলে সমালোচনা করতে পারে, সেই অধিকার তার আছে …’, শিবাজির গলা রনরন করে উঠল।

সুনীল বুঝে গেলেন শিবাজি ওর বিখ্যাত তিন নম্বর ফুসফুসের ভালভ্ খুলে দিয়েছে।

– ‘বসিরহাটের ওই ভেড়িটা লিজ নেবার পরেই ভাবলাম ফিশারি ব্যাপারটা শিখতে হবে, চলে গেলাম জাপান …’

শিবাজি বলে চলল। সেই পুরনো দিনের মতো সুনীল আড়চোখে দেখতে পেলেন শিবাজি তার ট্র্যাকের পাশেই দৌড়চ্ছে।

‘… আমার এক কাকু আমাকে খুব ছোট করত, আমাদের তো তেমন পয়সা নেই, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে কোনোরকমে বি.কম পাশ করেই পড়া ছেড়ে ব্যবসা ধরেছিলাম … কাকু খুব হিল্লি-দিল্লি-লন্ডন-আমেরিকা দেখাত … ঠিক করেছিলাম, চাকরি করব না, ওতে আর ক’পয়সা হবে, ব্যবসা করব … তাতে অনেকটা স্বাধীনতা … ব্যবসা করে এই হাওয়াই চটি পরে লন্ডন ঘুরব … ঘুরে এসেছি … এই চটি পরেই ইম্পিরিয়াল মিউজিয়াম, বাকিংহাম প্যালেস সব দেখে এসেছি … এই হাওয়াই পরে গেছি অক্সফোর্ডেও …’

ফেলে আসা দিনের অভিজ্ঞতায় সুনীল বুঝলেন, শিবাজি এইবার আরো গতি বাড়াবে; কিন্তু তা হতে দেওয়া যায় না। আজ সুনীলের হাতে কালান্তক অস্ত্র – ওর ছেলের চাকরি। যার লোভ দেখালেই সব ওস্তাদি ঘরোয়া কুকুরের মতো কুঁইকুঁই করবে। পোষ্যের গলায় হাত বুলোলে যেমন ঘড়ঘড় শব্দ আসে আদরের, শিবাজির গলাও আহ্লাদে রুদ্ধ হয়ে আসবে। ওর সেই মুখ দেখতে চান সুনীল। সেই কণ্ঠস্বর শুনতে চান। কিন্তু শিবাজি একবারও ওর ছেলের কথা বলছে না কেন? আর অপেক্ষা করবার সময় নেই।

– ‘শোন শিবাজি তুই বলছিলি তোর ছেলের চাকরি থাকবে কি না ঠিক নেই, অন্য চাকরি খুঁজছে, আমি কি দেখব আমাদের অফিসে? অবশ্য অত সহজে হয় না সব কিছু … বুঝতেই পারছিস গভর্নমেন্টের চাকরি, একটু ইনফ্লুয়েন্স খাটাতে হবে -’

‘আরে না না, তোরই চাকরির ঠিক নেই, এখন রিটায়ার করবার মুখে তোকে কেউ তেমন পাত্তাই দেবে না, যেই নিচের তলার লোক বুঝে যায় এর আয়ু আর বেশিদিন নয়, সামনে স্যার স্যার বললেও পেছনে ভেংচি কাটে, একটা কাজ করতে বললে পাঁচ পাক ঘোরায়, আর যেদিন চেয়ারে থাকবি না সেদিন তো সব খতম …’, শিবাজি হেসে উঠল, ছাদ ফাটিয়ে, অবিকল সেই ধনঞ্জয় বৈরাগীর মতো, ‘আমি তো আমার ছেলেকে বলে দিয়েছি নিজে কাজ খুঁজে নাও … আমার ব্যবসাতেও ওকে ঢোকাব না, কারণ আমার এখানে আইটি জানা ছেলের দরকার নেই …।’

শিবাজি উঠে দাঁড়িয়েছে। এইবার যাবে। সুনীলের পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘একদম ভাবিস না ওকে নিয়ে, ও ঠিক নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নেবে … তুই বরং নিজের -’, কথা অসমাপ্ত রেখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল, ‘আজ চলি রে … টা-টা …।’ বলেই দ্রুত নিচে নেমে গেল। সম্বিত ফিরে পেতেই সুনীল বারান্দায় ছুটলেন, বন্ধুকে বিদায় জানাতে। বাঁ-পা বারান্দায় রাখতেই ডান-পা চৌকাঠে বেধে গেল। মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে-পড়তে রাস্তায় তাকিয়ে তলাপাত্র দেখলেন, শিবাজি ফিনিশিং লাইন পেরিয়ে গেছে।