অকিঞ্চিতের ঈশ্বর

এ -গল্পে অপুই মারা গেল বর্ষার টইটম্বুর পুকুরে নাইতে গিয়ে। ওর নাম আসলে অপু ছিল না, ছিল শ্রীমান অতুল কুমার দত্ত। অতটুকু নাম অতুল, তাকে আরো ছোট করে অতু বলে ডাকতো সবাই। ওর বড় বোনের নাম দুর্গা বলে আমি অতু না ডেকে অপু ডাকতাম। ছ-সাত বছরের অপু আমার অনেক কাজে লাগতো।

‘অপু, বাবলা গাছের কাঁটাআলা ডাল ভেঙে আনিস তো আজ বিকেলে। একটা মজার জিনিস বানাবো।’

‘কী করবানে ওতা দিয়ি পিসি?’

‘এনে দিস। দেখিস তখন কী করি।’

কীসের বিকেল কীসের কী? মুহূর্তে হাওয়া। কলেজ থেকে ফিরে দেখি সারা গায়ে কাঁটার আঁচড়। বাবলার এক আঁটি ডাল সামনে নিয়ে বসে আছে আদুল গায়ে।

‘এই হাল করেছিস শরীরের? এতো আনতে বলেছি? হাঁদারাম!’ বলে ডেটল পানি দিয়ে ওর গা মুছিয়ে দিলাম। সুড়সুড়ি লাগছিল বলে সে হেসেই কুটিকুটি।

ওর মা, দিদি দুবার ডেকে গেল। সে ঠায় বসে। আমার আবিষ্কার না দেখে সে যাবে না।  

আমার ভালো রেজাল্টের চিঠি পেয়ে আমার সোনামামা মানে মেজমামা আমাকে একটা  ব্লেন্ডার মেশিন উপহার দিয়েছিলেন। প্যাকেটের মধ্যে শোলার ছাঁচ দিয়ে মেশিনটা আটকানো ছিল। ভারতের একটি সিনেমা পত্রিকায় কবে যেন আমি কাঁটাআলা ডালের সঙ্গে শোলার টুকরো গেঁথে একটা ঘরের দেয়াল সাজানো দেখেছিলাম। ঝাঁকড়া ডালটার গোড়ায় ছোট্ট একটা সুদৃশ্য টব ছিল। আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শখের কোনো কিছু চাওয়ার সাহস ছিল না। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া, ফেলে দেওয়া জিনিস নিয়ে আমরা ভাইবোনরা এটা-ওটা কত কী বানাতাম! বুবুর বিয়ের আগে একবার আব্বার ঘাড়ছেঁড়া ঘিয়ে রঙের মটকার পাঞ্জাবি কেটে বুবু আমাদের ছোট্ট গোল চায়ের টেবিলের ওয়াড় বানিয়েছিল। লাল নীল সবুজ ডিএমসি সুতো দিয়ে সূক্ষ্ম কারুকাজের ফুল-পাখি তুলেছিল ওটার ওপর। আঙুল দিয়ে স্পর্শ না করলে ওটাকে ছাপার ফুল বলে ভুল হতো। বুবুর হবু শ্বশুর বুবুকে দেখতে এসে ওই শিল্পকর্মের পরিচয় পেয়ে পাকা কথার আগেই আব্বাকে বেয়াই ডাকা শুরু করেছিলেন।  

দুর্গা এসে নারকেলের মালা কেটে চেঁছে একেবারে তেলতেলে করে দিলো। আমি ওটার গায়ে কাঁঠালের আঠা লাগিয়ে পাকা ধান বসিয়ে বসিয়ে দোচালা ঘর, কলাগাছ আর সূর্য বানালাম। আমার টব তৈরি। ঘন কাঁটাআলা একটা ভালো বাবলার ডালে শোলার ছোট ছোট চৌকোণা টুকরো কেটে গেঁথে দিলাম। দেয়ালে পেরেক ঠুকে টবসহ ওটা লটকে দিলাম। অপু আর দুর্গা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল।

‘পিসি, আমি আরো ডাল আইনে দেবনে। তুমি চার দেয়ালে অনেকগুলো লাগাবা।’

‘দূর বোকা! বেশি হলে সে ভারি বিচ্ছিরি হবে। একটাই ভালো’ – বলে অপুকে নিরস্ত করলাম।

আমাদের বাড়ির খানিক দূরেই দুর্গাদের কুঁড়ে। ওদের বাবা নেতাই দত্ত অন্যের ঠেলা চালায়। একেবারে হাড্ডিসার। ঠেলায় বসে উজান বাতাসে পা চালাতে পারে না। অপু সামনেবার স্কুলে ভর্তি হবে। দুর্গা ক্লাস ফোরে উঠে আর যায়নি। মেয়েমানুষের অত বিদ্যা দিয়ে হবেটা কী? উঠতি গড়ন। ঘরেই কাজ শিখুক। কদিন পরেই তো পরের ঘরে পাঠাতে হবে। তাছাড়া স্কুলে সময় কাটালে রান্নার খড়িকাঠি গুছাবে কে? আমাদের বাগানের শালপাতা, শিশুর ডাল কুড়িয়ে পালা মেরে না রাখলে বর্ষায় ওদের চুলো জ্বলবে? 

পরের বর্ষায় বুবুর বাচ্চা হলো। পরীক্ষার পর আমারও ছুটি। আমি রেজাল্ট বেরোনোর আগ পর্যন্ত বুবুর শ্বশুরবাড়ি এক মাসের জন্য চলে গেলাম। বোনঝির মুখ দেখার জন্য দীর্ঘ রাস্তা আমার স্বপ্নে ফুরুত করে ফুরিয়ে গেল। সেই প্রথম বাৎসল্য প্রেম অন্তরে জায়গা করে নিল। মাতৃত্বের অর্ধেক আনন্দ নিয়ে ফিরে আসতে হলো বাড়ি। একটা দেড় মাসের দেড় হাত শিশু আমাকে অসীম শূন্যতার চরাচরে নিক্ষেপ করলো।

বাড়ি ফিরে দেখি সবার মুখ অন্ধকার। আমার ভালো রেজাল্ট তাদের আনন্দ দিলো না? নাকি ভেবেছিল আমি স্ট্যান্ড করবো? অত আহামরি ছাত্রী তো আমি না। দুর্গাদের বাড়ি থেকে কান্নার সুর ভেসে আসছে। ভাই বললো, ‘তোর অপু নেই। পানিতে ডুবে মারা গেছে।’

ছুটে গেলাম দুর্গাদের বাড়ি। পথের পাঁচালীর সর্বজয়ার মতো অতুর মা মাটির পিড়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। দুর্গা ঢিবির মতো করে শালপাতা গুছিয়ে আকাশের পানে চেয়ে আছে। ঘরের মধ্যে নেতাইদার কোঁকানি।

অপু নেই? অপু বলে ডাকলে বিদ্যুৎগতিতে কেউ ছুটে এসে বলবে না –

‘পিসি কী কত্তি হবে বলোদিনি। খাজুরির কাঁটা লাগবে? ঠাকমা মুরুব্বি বানাবে না ইবার?’

‘মুরুব্বি না রে বোকা, মোরব্বা।’

‘ওই হইলু। ইবার দিদিমার বাড়ি গেলি তুমার জন্যি এট্টা মজার জিনিস আইনবো।’

‘কী জিনিসরে পাক্কু?’

‘তা বুইলি দিলি কি মজা থাকপেনে।’

অপু কী আনতে চেয়েছিল আমার জন্য? ভরা বর্ষার টইটম্বুর পুকুরে সাঁতার না-জানা ওইটুকুন অতুকে কেন সাবধানে রাখেনি ওরা? ও কি আমার জন্যই শাপলা বা পদ্মচাকি আনতে গিয়েছিল? বোনঝিকে ছেড়ে আসার কষ্ট ছাপিয়ে অপু হারানোর ব্যথায় আমার ভালো রেজাল্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন সব ফিকে হয়ে গেল।  

বিপদের ওপর বিপদ। নসিমনের ধাক্কায় ঠেলা উলটে গেলে নেতাইদার ডান পা ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেল। আমাদের বাড়ি থেকে টুকটাক সাহায্যে কোনোমতে ক’টা দিন গেল ওদের। বউদি ছেলে হারানোর দুঃখ বুকে পুষে রেখে পাডিয়া আগরওয়ালের তেলকলে দিনমজুরির কাজ করা শুরু করলো। হাতে নোয়া, কপালে ডগডগে সিঁদুর দেখেও বউটার আশেপাশে অন্য শ্রমিকরা ঘুরঘুর করতে লাগলো। দুর্গা খড়ি কুড়িয়ে আলুভাতের চুলা ধরায়। নেতাইদা ভাঙা পা নিয়ে বউদির ফেরার পথে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে। 

ভর্তি, ক্লাস, নতুন বন্ধু-বান্ধব তারপর গরমের ছুটি। অপুর স্মৃতি কবে কবে সমুদ্রের মধ্যে বিকেলের সূর্য ডোবার মতো ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল মন থেকে। একদিন হোস্টেলের ক্যান্টিনে এক পিচ্চি খালি গায়ে টেবিলে চা নিয়ে আসছিল। আমি এমন চমকেছি! যেন অবিকল অপু। ওকে খানিকক্ষণের জন্য জড়িয়ে ধরে ছিলাম। আমার বুকের মধ্যে থরথর করছিল। সেও অন্যদের দিকে তাকিয়ে ভারি অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। ক্যান্টিনের শামসু মামার ভাগ্নে। আর দেখা যায়নি তাকে কখনো।

দুর্গা বাপের মতোই ঢ্যাঙাকাঠি। গাভীর চোখের মতো কালো দুটি চোখ। বাবার অপারগতা, মায়ের তেলকলের পরিশ্রম ওর সহ্য হচ্ছিল না। একদিন পাড়ার মনোহারি দোকানে লবণ কিনতে গিয়ে ওর ফিরতে  দেরি হয়। দোকানের সঙ্গেই লাগোয়া দোকানির সংসার। দুর্গা বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে লক্ষ করে দোকানির বউ ঠোঙা বানাচ্ছে। একটা বাটিতে আটা সেদ্ধ করে রাখা। ঠোঙার ভাঁজগুলো শেখার জন্যই ওর দাঁড়িয়ে থাকা। খানিক বুঝছে, খানিক গুলিয়ে যাচ্ছে। আমার ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে বানানো হস্তশিল্প দেখে বড় হওয়া দুর্গার মাথায় ঠোঙা বানানোর পোকা ঘুরঘুর করছে। দোকানি ঠোঙায় করে লবণ দিলে ও বাড়ি ফিরে বাটিতে লবণটুকু ঢেলে ফেলে। তারপর ঠোঙার ভাঁজ খুলে আবার চারটে ভাতের আঠা দিয়ে লাগিয়ে আনন্দে নেচে ওঠে। আমার মাকে গিয়ে বলে –

‘ও ঠাকুমা, কাকা আর পিসির পুরনো খাতা থাকলি পরে আমাক দ্যাও দিনি।’ 

‘লেখাপড়া করবি আবার? তাহলে একটা নতুন খাতা কিনে দিই।’

‘আ মলো যা! নেকাপড়ার মুয়ে আগুন! তুমি দ্যাও দিকিনি কডা ছিঁড়াছুটো’। 

সেই থেকে তিন বাপে-মায়ে-ঝিয়ের ঠোঙা বানানো শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হলে আমি ওদের গল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। আর পাঁচটা হতদরিদ্র পরিবারের মতো ওরা নিজেদের নিস্তরঙ্গ জীবন চালিয়ে নিচ্ছিল।

ঠোঙার কেজি পঁচিশ টাকা। প্রতিদিন সাত-আট কেজি করে বিক্রি হয়। ওতেই তিনটে পেট চলে যায়। তেলকলে কাজ করার সময় দুর্গার মাকে খুব দেখে রাখতো যে-মজুর ছেলেটি, অনন্ত, সে এসে গাট্টি বেঁধে ঠোঙা নিয়ে যায়। ওর একটা জোড়াতালির সাইকেল আছে। সাইকেলটারও একটা ইতিহাস আছে। মাসখানেক আগে ওর মামা এসেছিল ভারতের কৃষ্ণনগর থেকে। কিছুই আনতে পারেনি ওপার থেকে। নিজেও ট্রেনে ট্রেনে চানাচুর ফেরি করে। সে কোথায় ভাগ্নের সাধ মেটাবে? ভাঙড়ি সাইকেলের দোকান থেকে জমানো ক’টা টাকার সঙ্গে মামার দেওয়া টাকা মিলিয়ে অনন্ত সাইকেলটা কিনে ফেলে। ক্যারিয়ার ছিল না। 

‘ঠুঙার বস্তা মাথায় নিয়ে সাইকেল চালাবা?’ – দুর্গা ঝাড়ি মারে।   

বুবুর বিয়ের সময় আমাদের জানালার পুরনো গ্রিল বদলিয়ে নতুন গ্রিল লাগানো হয়। পুরনোগুলো তখনো বাগানের ঝোপের মধ্যে পড়ে ছিল। একটু চলনসই একটা অনন্তের হাতে তুলে দিয়ে দুর্গা বলে –

‘ভাঙড়ির দুকানে গিয়ে কাইটি কুইটি ঝালাই করে বাইকের পাছতারে বসায়ে আনো। মাতায় করে কদ্দিন টানবা?’ 

অনন্ত অভিনব ক্যারিয়ার লাগিয়ে সাইকেল হাঁকিয়ে চেনা দোকানগুলোয় ঠোঙা নামিয়ে দিয়ে আসে। ফেরার পথে গান গায় –

‘ও মেয়ের নাম দেব কি ভাবি শুধু তাই

ও তার মনের সাথে মন বেঁধেছি তাইতো এ গান গাই আমি …’

পুজোর আগে রাতদিন একটানা কাজ করে প্রায় কুড়ি-বাইশ কেজি বাড়তি ঠোঙা বানিয়ে রাখলো দুর্গারা। দুর্গা-অনন্তকে নিয়ে নেতাইদা-বউদির স্বপ্পও দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। যেদিন বাইশ কেজি বস্তার প্রায় পুরোটাই ফেরত এনে সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে এক ঝটকায় নামিয়ে দিলো অনন্ত সেদিন কারো মুখে রা নেই। দুর্গা আমাদের বাগান থেকে শুকনো শালপাতা বস্তায় ঠেসে ভরে মাথা থেকে এক ঝাঁকিতে নামিয়ে দিলো। পাশেই ঠোঙার বস্তা।

‘ঘোরত আনলে যে বড়? দুকান পাশারি সব বোন্দ নাকি?’ ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে দুর্গা আশঙ্কায় আমসি মুখে জিজ্ঞাসা করে।

‘ছোট পলিথিন ব্যাগের কেজি একশ দশ ট্যাকা, সেখেনে ব্যাগ থাকে দুশো আড়াইশো। পঁচিশ ট্যাকায় কডা ঠুঙা পাওয়া যায়? দুকানদাররা আর ঠুঙা নেবে না বুইলি দিছে। পুরুনু লোক বুইলি আমিন ভাই আর গুপাল কাকা এক কেজি কইরি রাইখলো।’ অনন্তের হতাশাভরা গলা শুনে বউদি মাথায় হাত দিয়ে পা ছড়িয়ে দেয় মেঝের ’পরে। 

‘একন তালি আমাগের কী হবে?’ নেতাইদা ভাঙা পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে জনান্তিকে প্রশ্ন করে।

অনেকদিন পর বউদি মৃত ছেলের জন্য ডুকরে কেঁদে উঠলো।

‘ও অতু, অতুরে, তুই থাকলি আমার আইজ এ হাল হইতু না রে। কেনে তুই জলে গেলি? জলের রাক্ষস কেনে তোক টাইনি নিল। একন মায়ে-ঝিয়ের তেলকল ছাড়া কুনু গতি নেই গো।’

‘পলিথিন তো জিনিস ভালো না। সরকার পলিথিন ব্যাবার করতি নিষোদ করে’ – দুর্গার মিনমিন করে প্রতিবাদের কথায় কান না দিয়ে অনন্ত সাইকেলে প্যাডেল দিতে দিতে বলে যায় –

‘তেলকল জাগা ভালো না। আমি কারুক তেলকলে যাতি দেব না।’

পরের দিন ভোরে একটা হালকা পাতলা ব্যাগ হাতে অনন্ত সাইকেলে বেল দিয়ে দুর্গাদের উঠোনে থামে। দুর্গা রুটি বেলছিল। ওর মুখে উনুনের আগুনের আলো। দৃঢ় চিবুকে মসৃণ কাঠিন্য। চুলোর গোড়ায় গিয়ে বসে অনন্ত। পাঁজা করা শুকনো শালপাতার ঢিবি থেকে একটা পাতা তুলে নিয়ে বলে –

‘এই পাতাই আমাগের লক্ষ্মী হতি পারে।’

‘লক্ষ্মীই তো। এই পাতা না থাকলি কি হাত পা ঢুকায়ি চুলো জ্বালাতাম’ – আগুন উসকে দিয়ে দুর্গা বলে।

অনন্ত ব্যাগ থেকে বাতাসের মতো পাতলা থালা বের করে গোটা চারেক। যেন পুরনো পেতলের রং ধরে আছে থালাগুলোয়। দুর্গা হাত বাড়ালে অনন্ত বলে – ‘সাবধানে! বড় পলকা।’

শালপাতা দিয়ে তৈরি ছ’টা থালা এনেছিল কৃষ্ণনগর থেকে গেল বছর অনন্তের হতদরিদ্র মামা। উপহার হিসেবে নয়। দেখাতে। ওদেশে বিভিন্ন ধাবায়, ফুচকাওয়ালার দোকানে, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, বিয়েতেও অনেকে এখন শালপাতার থালা-বাটি ব্যবহার করে। একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়। পরিবেশবান্ধব। মাটির সঙ্গে মিশে যায়। গরিবরা কুড়িয়ে চুলো ধরায়।

‘কিন্তু এ তো কারখানার ছাঁচে ফেইলি তৈরি মনে হচ্ছে। এতো নেটোল! আমরা কিরাম কইরি বানাবো? আমাগের দেশে এতা দেকলি লোকে হাসপেনে।’ থালাগুলোয় দুর্গার আটামাখা নখ ক্ষয়ে যাওয়া আঙুল স্বপ্নের কোমল পরশ বুলাতে থাকে।

‘সে-কথা যে আমি ভাবিনি তা না। তেলকলে একটা গদার মতন পাথরের জিনিস পইড়ি আছে এক কুণায় ম্যালাদিন। অকামের জিনিস। ম্যানেজারকে বুইলি ওডা কাইল সাইকেলে বাইন্দি বাড়ি আনিছি। ওরে জগদ্দলরে! আমার কম্ম কাবাড়!’

‘ওডা দিয়ি কী হবেনে?’

ঘরের ভেতরেই একদিকে দুর্গাদের বংশপরম্পরায় পাওয়া একটা ঢেঁকি আছে। আজকাল ওটার ব্যবহার একেবারে উঠে গেছে। কালেভদ্রে বউদি কুমড়োর বড়ি দেওয়ার জন্য মাষকলাই ডাল কুটতো। এখন শীতের শুরুতে বাড়ির কাছের দোকানে বড়ি কিনতেই পাওয়া যায়। তাছাড়া পেটের দায়ে সারাদিন ঠোঙা বানালে শখের জিনিস শিকেয় ওঠে। এক বর্ষায় খড়ির অভাব হলে নেতাইদা ওটা কেটে চ্যালাকাঠ করার কথা বলেছিল। বউদি কথা কানে নেয়নি। বরং ঢেঁকিটার মাথায় সিঁদুর ছুঁইয়েছিল। ওটা তার শাশুড়ির দেওয়া উপহার। শালপাতার থালা দেখে নেতাইদা বউদিও অবাক হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস পাচ্ছিল না এদেশে ওই থালা আদৌ চলবে কি না। আমাদের গাছ থেকে শালপাতা পেড়ে, অদূরের শিরিষ গাছ থেকে একঝুড়ি কাঠি এনে ওরা হাতে হাতে গোলাকার আকৃতি করে পাতার থালা সেলাই করে রোদে শুকিয়ে রাখলো। মামার শেখানো বুদ্ধি দিয়ে অনন্ত গদার মুখে পেতলের থালা বসিয়ে ঢেঁকির সঙ্গে মুষল লাগালো, নোট বা উখলি তৈরি করলো কৃষ্ণনগরের থালার আকারে। বউদি আর দুর্গা জোরে পাড় দেওয়াতে প্রথম কয়েকটা থালা নষ্ট হলে সবাই হতাশ হয়ে পড়লো। নেতাইদা বললো –

‘মেশিনির কাজ যদি হাতে হইতু তালি আর ভাবনা ছিলু না।’

দুর্গা আশা ছাড়ে না। বলে – ‘ইবার আশানে পাড় ফেলছি। দ্যাকোদিনি হয় কি না।’

সত্যি সত্যি চমৎকার থালা তৈরি হলো। যদিও কৃষ্ণনগরের থালা অনেক মসৃণ, অনেক নিখুঁত; কিন্তু নিজেদের হাতে তৈরি থালা সামনে রেখে চারটি প্রাণীর মুখ স্বর্গীয় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। বউদি চারটি থালা পেতে কাঁচকলা ভর্তা দিয়ে সবার ভাত বাড়লো। অনন্ত দু-হাতে ভাতের থালা তুলে কপালে ঠেকিয়ে বলে উঠলো – ‘দুগ্গা, দুগ্গা।’ সবাই হেসে উঠলো। দুর্গা নতমুখী।    

মাঝে একবার সরকারের নির্দেশে পুলিশ এসে সব দোকান থেকে পলিথিন উঠিয়ে নিয়ে গেল। এক ঘণ্টার মধ্যে দুর্গাদের ষোলো কেজি ঠোঙা দোকানদাররা বাড়ি বয়ে এসে নিয়ে গেল একটু বেশি দামেই। কিন্তু কদিন পর যে কে সে-ই। আবার পলিথিন, আবার দুর্গাদের অনটন। ওরই মধ্যে অনন্ত সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে দূর থেকে শালপাতা এনে দিলো। শ-পাঁচেক থালা তৈরি হলো। ঠোঙা বানানো কমিয়ে দিয়ে ওরা থালার এবড়ো-থেবড়ো ধার কেটে সমান করতে লাগলো। দুর্গাপুজো শুরু হলে একদিন অনন্ত পুজোমণ্ডপে গোটা তিরিশেক থালা নিয়ে দাঁড়ালো। জিলিপি, পাপড়, মণ্ডা, মিঠাই, তেলেভাজার দোকানিদের থালাপ্রতি এক টাকা দরে কিনতে অনুরোধ করলো। দোকানিরা হেসে কুটিকুটি।

‘শুকনো পাতার দাম এক টাকা? তারচে তাজা কচুপাতা ছিঁড়ে আন, দশ পাতা এক টাকা।’

দোকানিরা অবাক হয়ে দেখলো শালপাতার অভিনব থালা; কিন্তু কেনার দুঃসাহস দেখালো না। মণ্ডপে আসা কিশোর-কিশোরীরা হুমড়ি খেয়ে থালা দেখতে লাগলো। কে একজন কলকাতার ঢংয়ে বললো –

‘আরে, গতবছর কলকাতায় গিয়ে আমি শালপাতার বাটিতে ভেলপুরি খেয়েছিলুম। ওদেশে শালপাতা হেব্বি চলে।’ শুনে দুর্গাদর্শনার্থী দলের কেউ কেউ এমন অনায়াসে থালা কিনে জিলাপি খেতে শুরু করলো যেন ভাবখানা তারাও প্রতিবছর পুজোয় কলকাতা যায়। সেদিন মাত্র উনিশটা থালা বিক্রি করতে পারলো অনন্ত। খুব একটা আশার আলো দেখতে পেল না।    

সামনে একটা বড় পার্বণ। মানে অষ্টমপ্রহর। সঙ্গে গরিব-দুঃখীদের জন্য তিনদিন ধরে পাডিয়া আগরওয়ালের বাৎসরিক লঙ্গরখানা। অনন্ত তেলকলের ম্যানেজারকে দিয়ে দশটা নমুনা থালা পাঠালো আগরওয়ালের কাছে। যদি লঙ্গরখানার জন্য দুশো থালা রাখেন তিনি। ম্যানেজার হেসে খুন। আগরওয়ালকে কি পাগলে পেয়েছে? তবে অনন্তর সততা আর পরিশ্রমে ম্যানেজার মুগ্ধ ছিল বলে  দোনামনা করেও সে আগরওয়ালকে হাস্যকর পাতার প্লেট দেখালো। আগরওয়াল দেখেই বললো –

‘আভি পাঁচশো পিলেট অর্ডার করো। ইন্ডিয়ামে ইয়ে পিলেট বহুত পপুলার হ্যায়। ইহা পার কিউ নেহি?’

ম্যানেজারের কাছ থেকে অগ্রিম পেয়ে অনন্ত তেলকলের কাজ একটু আগেভাগে শেষ করে সাইকেলে উঠে পড়ে। ওর পা থরথর করে কাঁপছিল। যেন ও অনন্তকাল সাইকেল চালাচ্ছে। মূকাভিনয়ের শিল্পীদের মতো এক জায়গায় দৌড়াচ্ছে। একটুও এগুতে পারছে না। এই সাইকেলটা কেনার আগে ও রোজ স্বপ্নে সাইকেল চালাতো। ওর স্বপ্নের সাইকেলের কোনো চাকা থাকতো না। চাকাহীন একটা সাইকেলে মাটির ওপর বসে যেন নৌকায় লগি মারতো। সাইকেলটা কেনার পর থেকে আর সেই স্বপ্ন দেখে না। আজ তো ওর সাইকেলে চাকা আছে, ও প্রাণপণ চেষ্টা করছে, প্যাডেলে ওর পা ঘুরছে কিন্তু দু-হাতও এগোতে পারছে না। স্বপ্নে ছাড়া এরকম হাল ওর কখনো হয় না।