ফিকে জোছনা কিংবা রংজ্বলা চাঁদ

বিয়েটা ভেঙে গেল তিন মাসের মাথায়। তিন মাস পুরোও হলো না মনে হয়। তবে এটি খুব বড় কোনো সংবাদ নয়। তেমন কেউ মনেও রাখেনি বিষয়টি। যারা আগ বাড়িয়ে এসব বিষয় ঘাঁটাঘাঁটি করে তারাও ক্রমশ থেমে গেল। আর কাঁহাতক! এমন তো হতেই পারে। হয়েই থাকে। পাচুলির নিজেরই ভরসা ছিল না। কেননা, এমন ঘটনা সে বহু দেখেছে। একটি-দুটি নয়। তার আরো বিয়ে হবে। আবারো ভাঙবে সে-বিয়ে। ও নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাবে না। দিনদুই হয়তো দু-কথা জিজ্ঞেস করবে কেউ। তবে বিয়ে ভাঙা নিয়ে কথা আছে। ঠিক ভাঙল কি? বোঝা গেল না। কারণ তালাক হয়নি। তালাকের কথা কেউ শোনেওনি। আবার ফেলে যাওয়ার সময় নোনা কাউকে বলেও যায়নি কিছু। সকালে বের হয়ে গেল নোনা। তারপর আর আসে না। আসেই না। কোনো খবরই নেই। পাচুলি আজ খোঁজে, কাল খোঁজে, তারপরও খোঁজে। নোনা কোথাও নেই। পাওয়াই গেল না। পাচুলি চুপচাপ। সে ভুলতেই বসেছিল নোনাকে। তার অতীত ইতিহাস। কিন্তু হঠাৎ খবর আনল রনা। সে পাড়ায় মুদিদোকান চালায়। ছোট্ট টংদোকান। দোকানের টুকটাক জিনিস কিনতে কৃষ্ণপুর, রামচর, পালর্দি যায়। তেমনি একদিন নোনার সঙ্গে দেখা। কৃষ্ণপুর বাজারে। কলঘরে কাজ নিয়েছে। শুধু কাজই নেয়নি, একটি বউও জুটিয়ে ফেলেছে নোনা। বউ দেখেছে রনা। কালো চেহারা। পাচুলির চেয়েও কালো। শুকনো মতোন মুখ। আগে বিয়ে হয়নি। রনার সঙ্গে অবশ্য বউটির কথা হয়নি। ধানছাঁটাই কলে চাল মাড়াইয়ের কাজ করে সে। একই কলে কাজ করে দুজন। নোনা কথা বলার সময় ভারি খোশমেজাজেই আলাপ করল। আগ বাড়িয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করল। কিন্তু পাচুলির কথা একবারও তুলল না। শেষ পর্যন্ত রনাকেই তুলতে হলো, তা কী ব্যাপার নোনা, পাচুলির কথা তো কিছু বললি না। ওপাট একেবারেই চুকিয়ে ফেলেছিস নাকি?

সে তো কবেই। ও আর কতদিন থাকে বল!

এ-কথাই পাকাপাকি?

তেমনই ধরে নে। পাচুলির কাছে তো আমার পাওয়ার কিছু নেই। এখানে বেশ আছি। দুজনেই খাটিপিটি। দিন চলে যায়।

আর ওদিকে দিলি তো মেয়েটার সর্বনাশ করে।

নোনা নড়েচড়ে বসে। তারপর বলে, সর্বনাশ মানে? যতদূর জানি, ওর পেটে আমার কোনো বাচ্চা নেই। দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারছে।

ওভাবে বলিস না নোনা। পাচুলি তোর বিয়ে করা বউ।

নোনা দাঁতে জিব কাটে। বলে, ছি ছি রনা! ও-কথা আর বলিস না। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে আবার বউ থাকে কেমন করে?

তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? তুই তো আর ছেড়ে দিসনি। সবাই জানে, তোরা বিয়ে ভাঙিসনি এখনো। তোরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলি।

পছন্দ করেছিলাম এ-কথা ঠিক। বিয়ে তো সবাই পছন্দ করেই করে। পছন্দ না হলে তো আর বিয়ে করতাম না।

তালাকও তো হয়নি।

এ আবার কেমন কথা? বউ ছেড়ে আসব তা কি ঢোল পিটিয়ে জানাতে হবে সবাইকে? ছেড়ে দিয়েছি, দিয়েছি।

এরপর আর কথা থাকে না। রনা আর কিছু বলে না ও-বিষয়ে। দুপুরে খেয়ে যাওয়ার জন্য তাকে বেশ সাধাসাধি করেছিল নোনা। রনা খেয়ে আসত; কিন্তু হাতে সময় ছিল না। কৃষ্ণপুরে আরো কিছু কেনাকাটা বাকি ছিল তার। সেগুলো দিনে দিনে সেরে ফেলা চাই। সেরে ফেললও ঠিক। কিন্তু বেশ দেরি হলো। তার ইচ্ছে, নোনার সংবাদটি পাচুলিকে দিনে দিনেই দিয়ে দেয়। পারল না। ফিরতে রাত হয়ে গেল। মধ্যরাত। পাচুলির সঙ্গে দেখা হলো পরদিন সকালে। রনা আফসোস করল। পাচুলির মধ্যে অবশ্য কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ভেবেছিল, সব শোনার পর পাচুলি কান্নাকাটি করবে। কিন্তু তেমন কোনো নজিরই দেখা গেল না। রনা মনে মনে ভারি হতাশ হয়। পাচুলি যেন শুনেও শুনল না। বলল, তুমি দেখছি ভারি দুঃখ পেয়েছ। অথচ আমার মনেই নেই।

বলিস কী! সত্যি মনে নেই?

সত্যি না তো কি মিথ্যে? তোমার কাছে মিথ্যে বলে আমার কোনো লাভ আছে?

তা অবশ্য নেই।

শোনো, আমার জন্য মনে হয় তোমার ভালোই টান আছে। সে-সুবাদে একটা কাজ করো।

কী কাজ?

একশ টাকা ধার দাও।

তুই আমাকে ডুবানোর তালে থাকিস না পাচুলি। সেদিনও নিলি একশ। ফেরত দেবার নাম নেই।

তোমার যে কী কথা! একশ টাকায় কি আর এক সপ্তাহ চলে?

কাজবাজ কিছু কর।

দু-বাড়িতে ঝিগিরি করতাম। তা বাড়ির কর্তারা যে কত কিছু চায়! শেষে ছেড়েই দিলাম একটা। আর একটা এখনো আছে। তবে তোমার ব্যাপার আলাদা।

কীরকম?

টাকা নিয়ে ফেরত করতে পারব না। শোধ দেব গায়েপায়ে।

ওসব কথা বলিস না পাচুলি। অধর্ম হবে। মহাপাপের কথা। তওবা কর।

তা করব। কিন্তু তোমার চলবে কেমন করে? কত রাত একা একা থাকবে? আর একটা শরীরের স্বাদ না পেলে চলবে কেন?

মুখে যা আসে তা-ই বলছিস। ভাগ এখান থেকে। পাপের কথা বলিস না। শুনতে চাই না।

তা না হয় না-ই বললাম। তবে আমাদের মতো মেয়েদের গতি আমার ভালোই জানা আছে। হয় কারো বিয়ে করা বউ, নয়তো সোজা লাইনে।

আবার পাপের কথা! পাচুলি ওসব বলিস না। থাম! তোকে ভয় পাই।

আমি কাউকে ভয় পাই না। এমনকি গভীর রাতে আমার ঘরে টোকা পড়লেও না। একদিন তো হাতই ধরে বসেছিলাম। শুধু নয়নার মা সঙ্গে থাকে বলে ঘরে ঢোকে না ওরা।

রনা এবার অবাক হয়। পাচুলির সঙ্গে তার প্রচুর কথা হয়। অনেক কিছু জানে সে। কিন্তু এ-কথা সে কখনোই জানতে পারেনি। রনা বিড়বিড় করে কী কী যেন বলে। পাচুলি বুঝতে পারে না। হয়তো দোয়া-কালামই পড়ছে। কে জানে!

দুই

নোনা ফিরে এসেছে। এটি কোনো বড় খবর নয় পাচুলির কাছে। কেউ কেউ অবশ্য বেশ মজা পাচ্ছে। অতি আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে। হাসাহাসি করছে। সব কথাই পাচুলির কানে যায়। যারা বলছে তারাও লুকিয়ে বলছে না। পাচুলির কানে তোলাই উদ্দেশ্য। পাচুলি চুপ করে থাকে। কিছুই বলে না। কানে তুলো দিয়েছে সে। তার কিছুতেই কিছু যায়-আসে না।

কিন্তু সমস্যা এখানে নয়। নোনা তার কলঘরের বউটিকে ত্যাগ করেনি। বরং তাকে সঙ্গে নিয়েই এসেছে। বউটিকে এক নজর দেখেছেও পাচুলি। কথা হয়নি। ইচ্ছে করেই কথা বলেনি সে। ওখানে দাঁড়ায়ইনি।  লোকজন এমনিতেই হাসাহাসি করছে। বেহায়ার মতো সে ওই মহিলার সঙ্গে কথা বললে তাতে আরো হাসির খোরাক হতো। এসব ব্যাপারে অবশ্য পাচুলি যে খুব কেয়ার করে তাও নয়। তবু দ্রুত সরে পড়ল সে। কী দরকার!

দুদিন পরই আসল মতলব জানতে পারল পাচুলি। কী সংবাদ? না, নোনা ঘরে তুলতে চায় পাচুলিকে। ওদিকে কলঘরের বউয়ের কোলে এক বছরের একটি বাচ্চা আছে। নোনা শখ করে নাম রেখেছে তারা মিয়া। তবু পাচুলিকে তার চাই। নোনা এখন তেমন কথাই বলে বেড়াচ্ছে। বেশ কয়েকজনকে এরই মধ্যে ধরেছে সে। তাদের মাধ্যমে এ-কথা ফিরছে জনে জনে। পাচুলিকে বোঝাতেও চাইল কেউ কেউ। কিন্তু তার মন গলানো গেল না। পাচুলি অবশ্য তেমন রাগও হলো না। দুটি কটু কথাও বলেনি। তাতেই নোনা ভারি ভরসা পেল।

কথাটি রাষ্ট্র হতে সময় লাগল না। নোনা নানাভাবে চেষ্টা করছে পাচুলিকে ঘরে তোলার। বিষয়টি ভালো লাগল না গণ্যমান্য লোকদের। পাচুলি তাদের মেয়ে। নোনাও তাদেরই ছেলে। তাদের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ে করে ফেলে গিয়েছিল নোনা। তারপর আর খোঁজখবর নেয়নি। আবার পাচুলি তার বউ নয় – এমন কথাও বলে বেড়িয়েছে নোনা। এ বিয়ে টেকে না। নোনা না ছাড়লেও ছাড়াছাড়ি তাদের হয়ে গেছে। বিয়ে যেহেতু নেই, পাচুলি সহজভাবে আর নোনার ঘরে যেতে পারবে না। এ অন্যায়। তারা এটি হতে দিতে পারেন না।

তিন

নোনাকে ডাকানো হলো। ডাকানো যে হবে তা আগেই টের পেয়েছিল সে। সরে পড়তে পারত। তাতেও কেউ কিছু বলত না। কিন্তু সে সরে পড়েনি। সুতরাং নোনা প্রস্তুত। সে এসে দাঁড়ায় সবার সামনে। মাথা নিচু করে। কারো দিকে চোখ তুলে তাকায় না। সবাইকে সালাম দেয়। কেউ বোধহয় সালামের উত্তর দেন না। কেননা, সালামের উত্তর শোনা যায় না কারো মুখে। হাত তুলে ইশারাও করেন না কেউ। গণ্যমান্যদের একজন জিজ্ঞেস করেন, এসব কী শুনছি নোনা?

কী?

তুই নাকি পাচুলিকে ঘরে তুলতে চাস? সত্যি নাকি?

সত্যি।

গণ্যমান্যরা সবাই একটুক্ষণ চুপ। তারপর একজন বললেন, এটা কি ঠিক হবে?

ভুল তো কিছু করছি না। পাচুলি আমার বিয়ে করা বউ।

বিয়ে করা তো বটেই। তোর ঘরে বউ আছে।

তা আছে। তবে এ-ব্যাপারে বউয়ের অনুমতিও আছে।

আছে নাকি?

আছে। চাইলে দশজনের সামনেই তাকে হাজির করাতে পারি। বলেন তো নিয়ে আসি। সে নিজের মুখেই দশজনের সামনে বলুক।

গণ্যমান্যদের একটু একটু করে মেজাজ খারাপ হয়। তাদের মধ্য থেকে ওই লোকই বলেন, থাক থাক। নিয়ে আসার গরজ দেখাতে হবে না। বউকে মারধর করে স্বীকার আদায় করে নিয়েছিস, তাই বল।

আপনারা মুরুব্বি। তবু বলি, ঘরের বউকে আমি মারধর করিনি। মেরে তাকে রাজিও করাইনি। সে-ই বরং পাচুলিকে ঘরে আনার কথা বলল।

গণ্যমান্যরা আবার একটু নড়েচড়ে বসেন। পরস্পরের দিকে তাকান। একটু হালকা হাসিও খেলে যায় কারো কারো ঠোঁটে। কিন্তু জেরা থামে না। বলেন, সে আপনা থেকেই সতীনের ঘর করতে চাইল?

তাকে আমি পাচুলির সব কথা বললাম। কিছুই বাদ দিইনি। তারপরই সে বলল, আমি অন্যায় করেছি। বিয়ে করা বউকে বাইরে ফেলে রাখা অন্যায়।

আর অমনি তোর জ্ঞান ফিরে এলো?

নোনা এ-কথার কোনো জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে থাকে। গণ্যমান্যরাও উত্তরের অপেক্ষা করেন না। একজন বলেন, তা এবার পাচুলিকে ঘরে তুলে ঘরেরটাকে তাড়াবি। এই তো?

না। দুজনই থাকবে।

গণ্যমান্যদের একজন বলেই বসেন, বাহ, কোমরে তো বেশ জোর দেখা যায়।

এ-স্থূল কথাটিতে ভিড়ের মধ্যে একটু হাসি উঠল। গণ্যমান্যদের কেউ কেউ যোগ দিলেন সে-হাসিতে। জেরা চলতে থাকল, পাচুলি কী বলছে?

সে এখনো কিছু বলছে না। তবে আমি তার সঙ্গে অন্যায় করেছি। তার জন্য কিছু রাগ তো থাকবেই।

বেশ ভালোভাবে কথা বলছিস দেখছি। কিন্তু আমরা তো জানি, পাচুলির এ-ব্যাপারে কোনো মত নেই। তারপরও যদি মত দেয় সেক্ষেত্রে হিলা করতে হবে। মুখে তালাক না বললেও তালাক তোদের হয়ে গেছে।

হিলা করতে রাজি হলো না নোনা। কারণ তার মনেই হয় না পাচুলি তার বউ নয়। বরং এ-কথাই সত্যি, পাচুলি তার বউ। বিয়ে করা বউ। যেমন তারা মিয়ার মা। বিয়ে করে বউয়ের খবর নেয়নি তো কী হয়েছে?

এখন তো সে ভুল বুঝতে পেরেছে। নোনা একটু চিন্তিত হয়। চুপচাপ থাকে। তারপর ঠিক করে পাচুলির কাছে সে যাবে। ওর মতামত নিজ কানে শোনা দরকার। তার বিশ্বাস পাচুলি তাকে ফিরিয়ে দেবে না, দিতে পারে না।

চার

পাচুলির শরীরে ব্যথা। কেমন ধরনের তৃষ্ণা তার। পানির তেষ্টা পায় খুব। কেমন ধরনের ব্যথা। বুঝতে পারে না সে। পুরো ঘটনা মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তার চোখ বুঁজে আসছে। কিছুই ভাবতে পারছে না সে। ভাবতে চায় না। ব্যাপারটিতে একসময় আনন্দ ছিল। কিন্তু এবার আনন্দ রইল না। বরং মন ও শরীরে ছেয়ে গেল তিক্ততা। ঘৃণা ফুটে উঠল মনে। সর্বাঙ্গ ঘিরে। আবার মনে করতে চাইল সব। পারল না। দু-চোখজুড়ে ঘুম তার। কেবলই ক্লান্তি। পানির তেষ্টার কথাও মনে রইল না পাচুলির।

বেশ তাত লাগে পাচুলির চেহারায়। বেলা হয়েছে কম নয়। সূর্য ওঠার আগে পাচুলি ঘুম থেকে জাগে রোজ। রোজকার ঘটনায় আজ ছেদ পড়ল। পাচুলির খেয়ালও নেই সূর্য কখন উঠেছে। সে উঠে বসতে চায়। কিন্তু শরীরজুড়ে সেই ব্যথা টের পায়। বিছানায় পড়েই থাকে কিছুক্ষণ। ঘুম নয়, চোখ বুজে থাকে সে। বেশ জোছনা ছিল গতরাতে। গাছের ছোপ ছোপ ছায়া পড়ে জোছনার আড়ালে। তারই মাঝে একটি ছায়া ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে পাচুলির কাছে। ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে কাশি দেয়। তারপর ডাকে পাচুলিকে। নোনা এসেছে। পাচুলি বুঝতে পারে। ব্যাটাছেলে হারামি। ফুঁসলে মন নিয়েছিল। বিয়ে করেছিল। তারপর তাকে একা ফেলে গিয়ে নিকাহ করেছে কোনো এক ধানকুড়ানিকে। এখন এসেছে নাঁকিকান্না কাঁদতে। সতীনের ঘর করতে হবে তাকে। ফুঁসলিয়ে আবার ঘরে তোলার মতলব। তোকে আর বিশ্বাস কী? আবার তিনদিনের নাগর হবি। ছেড়ে যেতেও বাধবে না। ওই ঘরে ছেলে দিয়েছিস। তারা মিয়া। বেটির কপাল, এখনো মা-ছেলেকে ত্যাগ করিসনি। করতে কতক্ষণ? আচমকা একদিন ফুরুত। তখন তোকে আর পায় কে? তারপর ধরবি আবার কোনো ধানকুড়ানি, কি অন্যকিছু। তোকে বিশ্বাস করি কোন মুখে। মন নিয়েছিলি তার মর্যাদা তুই রাখিসনি। তোকে বিশ্বাস নেই। পুরো পুরুষ জাতটাকে নয়। তোদের কথা আর বালির বাঁধ সমান। দূর হ এখান থেকে। রাস্তা মাপ।

নোনা চুপ করে থাকে। পাচুলি শুধু বলে, আর বসে থেকে কাজ নেই। ভাগো এখান থেকে। নয়তো চিৎকার করে লোক ডাকব। তারা বিচার করবে তোমার। আমাকে কষ্ট দিয়েছ তুমি। ব্যাটাছেলে হারামি কোথাকার

নোনা উঠে পড়ে। পাচুলি তার কথায় রাজি হয় না। কোনো কথাই শুনল না। তার চোখে জল। পাচুলি তা খেয়াল করে। কিছু বলে না। ও জল নয়, ছলনা। পাচুলি ঘরের ঝাঁপ বন্ধ করে।

ব্যাটাছেলে দাঁড়িয়ে থাকে একটু। কী যেন ভাবে। তারপর অতি ধীর কদমে এগোতে থাকে সামনে। পাচুলি সব দেখে তার বেড়ার ফাঁক দিয়ে। একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার। কিন্তু সে অবাক। নোনার ছায়াটির সামনে আরো দু-তিনটে ছায়া। পাচুলি বোঝে এরাই রাতে আসে। ঘরে টোকা দেয়। তারা বেশ জেরা করে নোনাকে। অনেকক্ষণ ধরে তা চলে। একটু রাগারাগিও হয়। পাচুলি চিন্তিত হয়। এরা আবার অকারণে মারধর করবে না তো নোনাকে? করলে করুক। সে কী করতে পারে? কিন্তু নোনাকে কেউ মারধর করে না।

রাত বাড়ে। জোছনা আরো ফিকে হয়। দূরে গাছের আড়ালে ঝুলে থাকে চাঁদ। রংজ্বলা চাঁদ। গাছের ছায়ার ছোপ ছোপ দাগ আরো আবছা হয়। তার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে বেশ কয়েকটি ছায়া। পাঁচ-ছয়টির কম নয়। পাচুলির ঘরে টোকা পড়ে। কিন্তু টোকার শব্দ তার কানে পৌঁছে না। সে ঘুমে অচেতন। শব্দ আর একটু বড় হয়। এবার চোখ খোলে পাচুলি। তারপর তাকায় বিছানার পাশে। না, নয়নার মা নেই আজ। কাল বিকেলেই সে গেছে মেয়ের বাড়ি। থাকবে দুদিন। তার গা ছমছম করে ওঠে। কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।

ছায়াগুলো এরই মধ্যে বেড়া কেটে ঘরে ঢুকে পড়েছে। পাচুলি একটি চিৎকার করে মাত্র। সে-চিৎকার কারো কানে পৌঁছে না। শুধু ছায়াদের একটি হাত তার মুখ চেপে ধরে। আরেকজন বলে, চুপ মাগি। তোর নখরামি বহু দেখেছি। আজ বাগে পেয়েছি।

তাকে চিৎ করে শুইয়ে ফেলা হয়। জোর করে ধরে রাখা হয়। মুখে চাপা পড়ে এবার দুটি হাত। শরীরের কাপড় চলে যায় কোথায়! তারপর ছায়াগুলো পালাক্রমে উঠে বসে তার দেহে। একের পর এক। তারপর কী হয় কোথায় শেষ কিছুই মনে নেই পাচুলির।

এবার ভালো করে চোখ মেলে পাচুলি। হঠাৎ খেয়াল হয় তার শরীরে কাপড় নেই। সব এলোমেলো হয়ে আছে বিছানায়। তার চোখে পানি জমে। কাপড় টেনে এনে শরীর ঢাকতে চায়। এবার আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল পাচুলি।

পাঁচ

রনার বারবার মনে হয়েছে তার কিছু একটা করা উচিত। সে সেটি করেছে। নিজ বিবেচনা মতোই করেছে। কারো সঙ্গেই পরামর্শে যায়নি। থানার বড়বাবুর পায়ে ধরে কেঁদে পড়েছিল রনা। এমন কান্নাকাটি দেখে বড়বাবুর অভ্যাস আছে। তারপরও রনার ঘটনা শুনে বড়বাবু চারজন পুলিশ পাঠাবেন বলে ঠিক করলেন। নিজে যাওয়ার চিন্তা করেননি। তাছাড়া আজ একটু অফিসেই থাকার ইচ্ছে তার। গত সাতদিনেও নিজ চেয়ারে বসতে পারেননি তিনি। তবে সামান্য সময় মাত্র। বড়বাবু তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন। কেন বদলালেন তা বলা মুশকিল। রনার বলার মধ্যেই হয়তো কিছু ছিল। কিংবা হতে পারে লোকটির কান্নাকাটি দেখে তার মন গলে গেল। মায়া হলো। তিনি রওনা দিলেন। সঙ্গে আরো চারজন পুলিশ।

পুলিশ আসার খবর পাচুলির কানে গেছে। তাতে পাচুলির কান্না আরো বাড়ে। রনা থানায় গেছে এ-কথা সে জেনেছে সকালেই। আসলে রনা ভেবেছিল বিষয়টি চাপা থাকবে। কিন্তু তা চাপা থাকেনি। কীভাবে যেন প্রকাশ হয়ে গেল। সবাই জানল না। কেউ কেউ জানল। যাদের জানা দরকার তাদের কেউ বাকি নেই। তারা নিজেদের মতো বুদ্ধি পাকালো। এ নিয়ে বসে থাকা উচিত নয়। পালানোও যাবে না। আগে সহজ অস্ত্র ব্যবহার করা দরকার। না হলে দেখা যাবে। পালাতে হলে পালানো যাবে। পাচুলিকে পাওয়া গেল ঘরেই। ওই ঘটনার পর সে একবার নিজের জীবন দিয়ে ফেলার চিন্তা করেছিল। দেয়নি। তবে ঘরের বাইরেও যায়নি একবার।

তার ঘরের সামনে এসে ডাক পড়ে, পাচুলি, ও পাচুলি।

হারামির বাচ্চারা এলো? পাচুলি গা করে না। সে আবার গালি দেয়, বেজন্মার বংশ, কুত্তার জন্ম।

লোকটি দ্বিতীয়বার ডাক দেয় না। সোজা ঘরে ঢুকে যায়। পাচুলির সামনে দাঁড়ায়। বলে, পাচুলি, এসব কী শুনছি? থানাপুলিশ করছিস কেন? কাজটা কি ঠিক হলো?

পাচুলি জবাব দেয় না। লোকটি একটু অপেক্ষা করে। তারপর বলে, কাজটা ভালো হলো না। আমরা নিজেরাই মিটমাট করে ফেলতে পারতাম। তুই তো দশজনকে ডাকলিও না। হাজার হোক নোনা তো এককালে তোর স্বামীই ছিল। বেচারা একটা অন্যায় না হয় করেই ফেলেছে। তার জন্য থানাপুলিশ করবি?

পাচুলির চোখ কঠোর হয়ে ওঠে। গতরাতের ছায়াগুলোর একটি ছায়া এ-লোকটি। নিজেকে আর সামলাতে পারে না। পাচুলি চিৎকার করে বলে, হারামির বাচ্চা, ভাগ এখান থেকে। তোরা বাপের পয়দা না। কুত্তার জন্ম।

ও, দেমাগ এখনো যায়নি তাহলে! কিন্তু রাতে আমরা সবাই দেখেছি নোনা তোর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বেজন্মা কোথাকার। এখান থেকে যাবি তুই?

লোকটি কিন্তু এ-কথার পাল্টা কিছু বলে না তখনই। একটু থামে। তারপর বলে, বেশি রাগ দেখাবি না শালির মাগি। তোকে সাফ কথা বলার জন্য এসেছি। দারোগা এলে সোজা বলবি তোর ঘরে সে-রাতে নোনা এসেছিল। যদি এর হেরফের করিস তাহলে একটা দিনও সময় দেব না। তোর নোনা আর ওই মাগির পুত রনা দুটোকেও শেষ করে ফেলব। একেবারে জানে শেষ। বুঝলি? তারপর তোর ব্যবস্থা করব। এমনিতেও তোর নাঙ নোনার জন্য ব্যবস্থা পাকাচ্ছি। শালা খুবই বেড়েছে। এখন তুই ঠিক কর দারোগাকে কী বলবি।

লোকটি আর দাঁড়ায় না। পাচুলিও কিছু বলে না। তার কেবলই কান্না পায়।

ছয়

পুলিশ প্রথমে একটু চা খায়। বাজারের ছোট দোকানটিতেই তারা বসে। রনাই দৌড়াদৌড়ি করে। আরো কেউ কেউ এগিয়ে আসে। তাকে সাহায্য করে। থানা থেকে পুলিশ এসেছে – এ-খবর শুনে ভিড় জমে। খবর শুনে নোনাও এসেছে। পাচুলির এমন সর্বনাশের সময় সে যদি কোনো কাজে লাগে। তবে সে দাঁড়িয়েই আছে। তার কোনো কাজ আপাতত সে দেখছে না। কী করতে হবে তাও বুঝতে পারছে না। কেননা, রনা তাকে কিছু করতে বলছে না। একাই সব করছে। কে একজন ছুটল

ডাব আনতে। তাদের ধারণা, দারোগা  সাহেব এখানে বসবেন কিছুক্ষণ। কিন্তু তারা বসে না। বরং একটু তাড়াহুড়ো করেই উঠে পড়ে। আগে ভিকটিমের কাছে যাওয়া দরকার। দেরি করার মানে হয় না।

দারোগার সামনে আনা হলো পাচুলিকে। সে এর আগে পুলিশ দেখেছে। এদের মেজাজ সাধারণত খারাপ থাকে। মুখ খারাপ করে কথা বলে। অল্পেই রেগে যায়। কিন্তু এ-দারোগা বেশ শান্তভাবে কথা বলে। পাচুলির মুখে আঁচলচাপা দেয়া। তাকে ধরে এনেছে নয়নার মা আর নোনার বউ। দারোগা সাহেব জিজ্ঞেস করেন, তোমার নাম পাচুলি?

পাচুলি আস্তে করে জবাব দেয়, জি।

ভয় পেও না। সবকিছু খুলে বলো।

পাচুলি চুপ। কিছুই বলে না সে। দারোগা বলেন, শোনো। কোনো ভয় নেই তোমার। এখানে রনা কিছু নাম বলেছে। তুমিই নাকি জানিয়েছো ওকে। এখন তোমার কাছ থেকে নামগুলো শুনতে পেলে আমার কাজ এগিয়ে নিতে সুবিধে হয়।

পাচুলির কান্না আসে। হাউমাউ করে কাঁদে আবার। দারোগা কান্নার সুযোগ দেয় তাকে। বেশ একটু কাঁদে পাচুলি। তার কান্না একটু ধাতস্থ হলে দারোগা বলে, তুমি কাকে কাকে চিনেছো? নাম জানো তাদের?

পাচুলি মাথা নাড়ায়। সে জানে। দারোগা নড়েচড়ে বসে। বলে, বেশ। তুমি নিজের মুখে এবার নামগুলো বলো। তাহলেই আমি কাজ শুরু করতে পারি। তার আগে অবশ্য তোমার ডাক্তারি পরীক্ষার দরকার হবে। সে দেখা যাবে। বলো, নাম বলো।

পাচুলি নিচু স্বরে বলে, নোনা।

নোনা পাশেই দাঁড়ানো ছিল। প্রথমে নামটি খেয়াল করতে পারে না সে। যখন খেয়াল করে একটু থতমত খাবার জোগাড় হয় তার। নামটি শুনে আকাশ থেকে পড়ল সে। রনাও অবাক। এ কী নাম বলছে! সকালে যখন তার সঙ্গে দেখা হলো, আলাপ হলো, পাচুলি তো নোনার কথা বলেনি। পাচুলি যাদের কথা বলেছে তাদের নামই সে দিয়েছে দারোগার কাছে। তাহলে? দারোগা জিজ্ঞেস করে, নোনা কে? কোথায় থাকে?

লোকজন ভিড়ের মধ্য থেকে নোনাকে ধরিয়ে দেয়। দারোগা অবাক হয়। এ ধরনের অপরাধী কি পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে? থাকার কথা নয়। কিন্তু এখানে ভিকটিমের সাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য। অপরাধ প্রমাণ-অপ্রমাণ করবেন আদালত। দারোগা বলে, আর কাউকে চিনেছো?

পাচুলি মুখে আঁচলচাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। দারোগা তাকে আবার একই প্রশ্ন করে। পাচুলি মাথা নাড়িয়ে বলে, না।

হাতের কাছে পাওয়া নোনাকে নিয়েই পুলিশ রওনা দেবে। তারা উঠে দাঁড়ায়। দারোগা পাচুলিকে বলে, একবার থানায় আসতে হবে তোমাকে। কিছু কাজ করতে হবে। একটা মেডিক্যাল রিপোর্টও লাগবে। থানায় জমা দিতে হবে।

নোনা কিছুই বলে না। কারো দিকে তাকায় না। পাচুলিও তাকায় না নোনার দিকে। দারাগা নোনাকে বলে, হাঁট শালা।

এবার পাচুলি মুখ খোলে, দারোগা সাব।

বলো।

নোনাকে মারধর করবেন না।

দারোগা অবাক হয়। বলে, তুমি আর কিছু বলবে? ভয় নেই। সব বলো। আমি তোমার পাশে আছি।

না। বলার কিছু নাই আর। আমার একটাই অনুরোধ।

অনুরোধ রাখব। আর কিছু বলার থাকলে বলো।

না। বলার কিছুই নাই।

দারোগা আর অপেক্ষা করে না। তারা এগোতে থাকে। তাদের পেছনে একদঙ্গল মানুষ। রনা রয়েছে সঙ্গে। দারোগা সাহেবকে এগিয়ে দেওয়া দরকার। সেজন্যই তার আসা। তবে তার ভালো লাগছে না কিছুই। সে রয়েছে নোনার পাশে। নোনা একটি কথাও বলছে না। মাথা নিচু করে আছে। একবার পেছন ফিরে ধানঝাড়নি বউটিকেও দেখল না। পাচুলিকে তো নয়ই।