দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ ও রেভারেন্ড জেমস লঙের ভূমিকা

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নদীয়া, যশোর, চব্বিশ পরগণা, খুলনা জেলা তথা নিম্নবাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা নীল কনসার্নকে ঘিরে নির্মিত হতে থাকে ইংলিশ স্টাইলে সুদৃশ্য বাসভবন, নীল কারখানা, কুঠিবাড়ি। ইউরোপ থেকে আগত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি, রবার্ট ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানির মতো বড় বড় কোম্পানি নীলচাষ ও নীল কারবারের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রতাপশালী নীলকর জেমস হিলসের বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানির সদর কুঠি স্থাপিত হয় ইছামতি তীরবর্তী মোল্লাহাটি, যার আরেক নাম মুলনাথ। এই কুঠির কাছাকাছি নদীয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম চৌবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন কালজয়ী নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩১-৭৩)। তাঁর পিতৃদত্ত নাম গন্ধর্বনারায়ণ, স্কুলে পড়ার সময় নিজেই নামটি বদলে নিয়েছিলেন। যে-পরিবারে তিনি জন্ম নেন সেই পরিবারের উল্লেখ করার মতো আভিজাত্য, বিত্ত-বৈভবের জৌলুস, বর্ণাঢ্যতা – কোনো কিছুই ছিল না। তবে দীনবন্ধুর জীবনকাহিনির ভেতর কিছুটা হলেও বর্ণাঢ্যতা, রোমাঞ্চ ও নাটকীয়তা ছিল। সত্যি বলতে কী, দীনবন্ধু মিত্র নিজেই ট্র্যাজেডি-কমেডির প্রলেপ লাগানো এক সাড়াজাগানো নাটক, যে-নাটকের দৃশ্যে দৃশ্যে রয়েছে নানা গল্প, নানা কাহিনি, আছে সাসপেন্স-ক্লাইমেক্স, যা সর্বার্থেই কিংবদন্তিতুল্য। দরিদ্রের সন্তান তিনি, কলকতার ‘বিদ্বজ্জনমণ্ডলী কিংবা অভিজাত সমাজে প্রবেশ  করার সুযোগ পাননি।’ নদীয়ার এক গ্রামের পাঠশালায় বাংলা পড়ালেখা শেখেন, তারপর বাবা কালাচাঁদ মিত্র তাঁকে জমিদারি সেরেস্তায় খাতাপত্র লেখার কাজে লাগিয়ে দেন, বাবার আদেশ অমান্য করে সেখান থেকে কলকাতায় পালিয়ে যান – সবই কেমন যেন নাটকীয়তাপূর্ণ। কলকাতার হঠাৎ আলোর ঝলকানি দীনবন্ধুর জীবনের সমীকরণ বদলে দেয়। মনের গহন-গভীরে চাপা পড়ে থাকা স্বপ্নগুলি নতুন রূপে জেগে ওঠে। স্বপ্নপূরণ ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কলকাতার এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত হয়ে। জমিদারির সেরেস্তায় খাতা লেখা থেকে গৃহকর্মীতে পদোন্নতি! গরিবের সন্তানের এছাড়া কী-ই বা করার আছে! সহায়-সম্বলহীন কিশোর দীনবন্ধু কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়ান একা একা। একদিন অ্যাংলো-আইরিশ মিশনারি সোসাইটির যাজক রেভারেন্ড জেমস লঙের (১৮১৪-৮৭) সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁর সহযোগিতায় দীনবন্ধু একটি অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হন।

আয়ারল্যান্ড থেকে আগত প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মযাজক রেভারেন্ড জেমস লঙ ছিলেন একজন বিবেকবান পাদ্রি। কলকাতার উপকণ্ঠে ঠাকুরপুকুর মিশনের প্রধান ছিলেন তিনি। প্রাচ্যবিশারদ ও বহু ভাষায় পণ্ডিত এই ধর্মযাজক ছিলেন একাধারে মানবতাবাদী, সৎ ও বিদ্যোৎসাহী। বেথুন সোসাইটি, বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, ক্যালকাটা স্কুল-বুক সোসাইটি, এশিয়াটিক সোসাইটির মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় শিক্ষাবিস্তার ও সাহিত্য বিকাশে তাঁর অবদান অতুলনীয়। লঙ সাহেবের চেষ্টায় দীনবন্ধু ভর্তি হন আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিএমএস স্কুলে। পরে হেয়ার স্কুল ও হিন্দু কলেজে পড়াশোনা করেন। বিএ পাশের আগেই পেয়ে যান ডাক বিভাগে ইন্সপেক্টর পদের ঈর্ষণীয় চাকরি। কর্মোপলক্ষে নদীয়া-যশোরের গ্রামগুলি পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেন চাষিদের ওপর নীলকর সাহেব ও তাঁদের নায়েব-গোমস্তা, পাইক-বরকন্দাজদের নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার। প্রত্যক্ষ করেন, নীলকরদের সীমাহীন শোষণে জর্জরিত বিপর্যস্ত গ্রামীণ অর্থনীতি। নীল না বুনলে চাষিদের ঘর থেকে ঘটি-বাটি, গোয়াল থেকে গরু-ছাগল কেড়ে নিত নীলকরদের লেঠেলরা। নিরাপত্তাহীন বোধ করতেন গৃহস্থ বাড়ির বউ-ঝিরা। প্রজা-রায়ত নিগ্রহের খবর ব্রিটিশ শাসকদের কাছে পৌঁছে যায়, এমনকি খোদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। প্রজাদের সুখ-সুবিধা দেখার জন্য জেলায় জেলায় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। এতেও সমস্যার সমাধান হয় না, বরং এরাও নীলকর কুঠিয়ালদের সঙ্গে মিলে অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। নদীয়া, চব্বিশ পরগণা, যশোর জেলার বিভিন্ন কনসার্নের চাষিদের দুরবস্থা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা মধুসূদন দত্তের মতো প্রতিভাধর
সাহিত্য-ব্যক্তিত্বকে দিয়ে একটি নাটক লিখিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করেন দীনবন্ধু। এ বিষয়ে তিনি অনুরোধ জানান বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে (১৮৩৮-৯৪)। ঈশ্বর গুপ্তের পত্রিকায় কবিতা লেখার সুবাদে ছাত্রজীবন থেকেই দীনবন্ধু তাঁকে চিনতেন। যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র নীলকরবিরোধী নাটক রচনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।

ডাক বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্টরূপে দীনবন্ধু বাংলার যেসব এলাকায় নীলচাষ হয় সেসব এলাকা ভ্রমণ করেন। নীলকর সাহেবদের প্রজাপীড়নের করুণ কাহিনি দেখে-শুনে তাঁর দরদি মনটা চাষিদের জন্য ক্ষুব্ধ, পীড়িত ও মর্মাহত হয় দারুণভাবে। দীনবন্ধুর মনে হয়েছে, চাষিদের কথা তুলে ধরার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের পর মাইকেল মধুসূদন দত্ত সবচেয়ে যোগ্য সাহিত্যিক – ব্যক্তিত্ব। নদীয়া-যশোরের তথা বঙ্গদেশের নীলচাষিদের দুর্দশা এবং নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের ওপর নাটক রচনা করতে অনুরোধ করা হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। দীনবন্ধুর বিশ্বাস, যিনি শর্মিষ্ঠার মতো নাটক, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই বলে সভ্যতার মতো প্রহসন রচনা করতে পারেন, তিনিই পারেন তাঁর দুর্দান্ত লেখনী দিয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে আগুন ঝরাতে, নীলচাষিদের মর্মস্পর্শী বেদনা ও দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরে পাঠককুলকে কাঁদাতে। মধুসূদন দত্ত তখন দু-হাতে ফলিয়ে চলেছেন সোনার ফসল। কিন্তু নাটক লিখতে তিনিও রাজি হলেন না। উপায়ান্তর না পেয়ে দীনবন্ধু নিজেই নাটক রচনায় হাত দেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে নাটক লেখার কাজ সম্পন্ন হয়, নতুন নাটকটির নাম দেওয়া হয়  নীলদর্পণ। এক বন্ধুর মাধ্যমে ঢাকার এক প্রেস থেকে নাটকটি ছাপিয়ে আনা হয়। নাটকটি সম্পর্কে মনোভাব জানার জন্য রেভারেন্ড জেমস লঙকে এটি পড়ে শোনানো হয়। লঙ বিদেশি হলেও এদেশের ভাষা-সংস্কৃতি বুঝতেন। জন্মসূত্রে ভারতীয় না হয়েও নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও আত্মস্থ করেছিলেন এদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও দেশাচার।

নাটকটির পাঠ শুনে ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত হয়ে লঙ সাহেব দীনবন্ধুকে কেবল জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি যা বলছে, তা সত্য! গ্রামে গ্রামে নীলকররা এমন অত্যাচার করে! তারা এত নিষ্ঠুর, এত নির্দয়, এত নীচ! তুমি এসব দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছ? মুলনাথ, লোকনাথপুর, নিশ্চিন্তপুর, রতনপুরে এই রকম বর্বরতা চলছে? সরকার বাহাদুর তো কিছুই জানেন না। পিটার গ্রান্ট সাহেবকে জানানো দরকার। তিনি অলস হলেও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয় একটি ন্যায়সঙ্গত পথ বাতলে দেবেন।’ (সেই সময়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা, বৈশাখ ১৪১৮, পৃ ৫১৯)

 দীনবন্ধু বললেন, নদীয়ায় ইন্সপেক্টরগিরি করতে গিয়ে এমন শত শত দৃশ্য তিনি নিজের চোখে দেখেছেন।

নদীয়া-যশোরের রায়ত, কৃষ্ণনগরের শিক্ষিত যুবকদের কাছ থেকে কিছু কিছু শুনেছেন। নদীয়ার রতনপুর চার্চের পাদ্রি বমভেসও নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছেন। নীলবিদ্রোহের নেতৃত্বদানের জন্য ক্রিশ্চিয়ান বমভেশ, জে জি লিংকে, ফ্রিডরিখ সুরা প্রমুখ লুথারপন্থী রেভারেন্ডের প্রতি নীলকর সাহেবরা ছিলেন ভীষণ ক্ষিপ্ত। নীলকরদের মুখপত্র ইংলিশম্যান এই নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের নিয়ে বিদ্বেষমূলক লেখা প্রকাশ করে। পাদ্রি জেমস লঙ বলিষ্ঠভাবে বললেন, ‘তুমি শিগগির নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করাও। আমি ছাপাবার ব্যবস্থা করব। তারপর সেই ইংরেজি অনুবাদ নীল কমিশনে পেশ করা হবে।’ (প্রথম আলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

লঙ সাহেব বাংলা ও ইংরেজি – দুই ভাষাতেই পারদর্শী ছিলেন। তারপরও বইটি অনুবাদ করতে চাইলেন না, কারণ এমন গ্রাম্য-বাংলা ইংরেজিতে অনুবাদ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি এমন একজন অনুবাদক খুঁজছিলেন যাঁর ইংরেজি, সংস্কৃত এবং নদীয়া-যশোরের স্থানীয় বাংলা ভাষার ওপর সমান পারদর্শিতা আছে। কিন্তু কে করবে সেই অনুবাদ? কে যশোর-নদীয়ার লোকভাষা বোঝে, আবার ইংরেজিটাও জানে ভালোভাবে? অবশেষে জেমস লঙ মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য অনুরোধ জানান। জনশ্রুতি আছে, অনুবাদকর্ম দু-রাতের মধ্যে সম্পন্ন হয়। মধুসূদনকৃত নীলদর্পণ-এর অনুবাদকর্মটি অনুবাদ-সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরল উদাহরণ। অনুবাদক মধুসূদন দত্তের ইংরেজি ভাষা ও নদীয়া-যশোরের লোকভাষার ওপর পারদর্শিতার কারণেই এটি সম্ভব হয়। ১৮৬২ সালে সিম্পকিন মার্শাল কোম্পানি নামক লন্ডনের এক প্রকাশক বইটির ইংরেজি অনুবাদ বের করে। এটি পড়ে চার্লস ডিকেন্স তাঁর অল দ্য ইয়ার রাউন্ড পত্রিকায় একটি প্রশংসাসূচক প্রবন্ধ রচনা করেন।

নীলদর্পণ নাটকটি ঢাকার বাংলা বাজারের শ্রীরামচন্দ্র ভৌমিকের প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হওয়ার পর চারদিকে হইচই পড়ে যায়। মুশকিলে পড়ে ইংরেজ সরকার। জেমস লঙ নাটকটির সারমর্ম বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের সেক্রেটারি ডব্লিউ বি সিটন কারকে অবহিত করেন। বয়সে তরুণ হলেও সিটন কার ছিলেন ন্যায়নীতিবান ও কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ, অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতেন না। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সব ঝক্কি-ঝামেলার সুরাহা তিনিই করতেন। নিরীহ-নিরপরাধ প্রজাদের ওপর অত্যাচার চালালে গণবিক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিতে পারে, এ-বিষয়েও তিনি সতর্ক ছিলেন। কারণ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বাপর ঘটনাবলি থেকে তিনি বিস্তর অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। নীলদর্পণ নাটকটি নতুন করে কোনো সমস্যা তৈরি করবে কি না – সেটা ভেবে সিটন কার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সমাধানের পথ খুঁজে না পেয়ে বিষয়টি ছোটলাট পিটার গ্রান্টকে অবহিত করেন। নাটকটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত হয়ে উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত ও চিন্তিত হন গ্রান্ট সাহেব। যদিও তিনি ‘ঘুমকাতুরে অলস স্বভাবের’ মানুষ ছিলেন ব্যক্তি জীবনে, কিন্তু অফিসার হিসেবে ছিলেন ‘অসাধারণ কর্মক্ষম মনের এবং উন্নত ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির’। নাটকটিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং গ্রামের দরিদ্র চাষিরা মিলিতভাবে নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-সংগ্রামে নেমেছে, যদি এই ঘটনা সত্য হয়, তাহলে সত্যিই এটা উদ্বেগ ও আশঙ্কার কথা। গ্রামের নিরীহ কৃষকরা যুগ যুগ ধরে জমিদার-জোতদার-মহাজনদের দ্বারা শোষিত, পীড়িত হয়ে আসছে। কিন্তু বিত্তবান-ক্ষমতাশালীরা কখনোই গরিবের পাশে এসে দাঁড়ায় না। কারণ উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের শ্রেণিস্বার্থই তো আলাদা, তাদের অবস্থান দুই মেরুতে। তারা এক হবে কেমন করে? নাটকের নবীনমাধব ও তোরাপের স্বার্থ আলাদা। তবু কেন নবীনমাধবের পরিবার তোরাপ ও ক্ষেত্রমণিদের হয়ে লড়াই করতে গেল? নীলকররা যেভাবে ধর্ষণ, লুটতরাজ, হত্যাকাণ্ড এবং শারীরিক নিপীড়নে লিপ্ত হয়েছে, তাতে সিটন কারের মনে হয়, বিপদ ধেয়ে আসতে পারে দ্রুত। অত্যাচারী ও উৎপীড়ক নীলকরদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে, নইলে সবাই মিলে আন্দোলনে নামবে – যৌথ ও সুশৃঙ্খল আন্দোলন। উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, রাঢ়ের
কোল-বিদ্রোহ, ফরিদপুরের ফরায়েজি আন্দোলন প্রভৃতি এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।

১৮৫০-এর দশকের নীলকরবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন নড়াইলের জমিদার রামরতন রায় ও তাঁর প্রতিনিধি মহেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রানাঘাটের গোপাল পালচৌধুরী, শ্যামচন্দ্র পালচৌধুরীর মতো প্রতাপশালী জমিদাররা। তাঁদের লাঠিয়াল বাহিনী নদীয়া, যশোর, ফরিদপুর জেলায় নীলকর বাহিনীকে মোকাবিলা করেছে। নীলকরবিরোধী লড়াইয়ে ‘গ্রামীণ জোতদার নেতৃত্বের উদাহরণ নদীয়ার জয়রামপুর (চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা পৌর এলাকার অন্তর্ভুক্ত) গ্রামের মালিক মল্লিক পরিবার। রামরতন, রামমোহন ও গিরিশ ত্রয়ী মল্লিক-ভ্রাতা ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্রাহ্মণ। এঁরা একসময় নীলকুঠির দেওয়ান-গোমস্তা হিসেবে কাজ করতেন এবং পার্শ্ববর্তী লোকনাথপুরের কনসার্নকে নীলের জমি ইজারা দিতেন। (দ্য ব্লু মিউটিনি, ব্লেয়ার বি ক্লিং) কিন্তু নিগ্রহের শিকার হয়ে তাঁরা একপর্যায়ে নীলকরবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে যুক্ত হন। অনুরূপ নদীয়া জেলার বাঁশবেড়িয়া কনসার্নের দুই কর্মচারী ও স্থানীয় জোতদার দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুপদ বিশ্বাসও নীলকরবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করে কিংবদন্তির নায়করূপে পরিচিতি লাভ করেন। নীলদর্পণ নাটকের ঘটনাবলিও আবর্তিত হয়েছে নিম্নবাংলার বসু পরিবারের মতো এক জোতদার পরিবারকে কেন্দ্র করে। এই পরিবারের প্রধান গোলক বসু শান্তিতে বসবাস করার জন্য নীলকরদের সঙ্গে আপস করতে চান। নীলচাষ থেকে নিজের পরিবারকে মুক্ত রাখতে নীলকরদের প্রচুর অর্থ প্রদান করতে ইচ্ছুক। কিন্তু তাঁর বড় ছেলে নবীনমাধব চান নীলকরদের উৎখাত করতে। প্রয়োজনে জানমাল সব বিসর্জন দেবেন, তবু নীল বুনবেন না। নাটকের প্রথম অঙ্কে গোলকবাবু ছেলেকে বলছেন, ‘সাহেবের সঙ্গে বিবাদ তো সম্ভব না … কাজে কাজেই কত্তে হবে না।’ তখন ছেলে নবীনমাধব বাবাকে বলছেন, ‘আপনি যেমন অনুমতি করিবেন আমি সেইরূপ করিব। কিন্তু আমার মানস একবার মোকদ্দমা করা।’ নবীনমাধব সম্পর্কে একজন কুঠিয়াল বলছেন, ‘বাঞ্চৎ বড় মামলাবাজ।’ নাটকের ঘটনায় আরো দেখা যায় যে, নীলকর জে জে উড এবং পি পি রোগ দুজনই ভয়ংকর অত্যাচারী। তারা পারিশ্রমিক ছাড়াই চাষিদের নীলচাষে বাধ্য করতো। তারা গ্রামের মানুষকে কারখানায় আটকে রাখতো, প্রহার করতো ও অত্যাচার চালাতো। নীলকর ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা বাঙালি কুমারীদের শ্লীলতাহানি, গণিকাবৃত্তি ও সন্ত্রাস সৃষ্টিতে উৎসাহ জোগাত। উৎপীড়ন ও সন্ত্রাস সৃষ্টি ছাড়াও নীলকররা বাঙালিদের সামাজিক মূল্যবোধের ওপরও আঘাত হানে। এক কৃষক রমণী এই ভেবে লজ্জায়-শরমে মরে যায়! নীলকরের স্ত্রী ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গ দিচ্ছে। নাটকে সে বলছে – বিবিরি আমি দেখিচি, নজ্জাও নেই, শরমও নেই – জ্যালার হাকিম মাচেরটক (ম্যাজিস্ট্রেট) সাহেব, কত নাঙ্গা-পাকড়ি, তোরোনাল ফিরতি থাকে, মা গো মা নাম কল্লি, প্যাটের মধ্যে হাত পা সেঁদোয় – এই সাহেবের সঙ্গি ঘোড়া চেপে ব্যাড়াতি এয়োলো। বউ মানসি ঘোড়া চাপে! কেশের কাকি ঘরের ভাশুরির সঙ্গে হেঁসে কথা কয়েলো, তাই নোকে কত নজ্জা দেলে, এতো জ্যালার হাকিম। (নীলদর্পণ)

নাটকে আরো দেখা যায় যে, নীলকরদের অত্যাচারে অনেক মানুষ উন্মাদ হয়ে গেছে কিংবা মৃত্যুবরণ করেছে। নাটকের শেষ অঙ্কের একটি দৃশ্যে দেখা যায় যে, একজন নীলকরকে ধরাশায়ী করার পর নবীনমাধব নীলকরের এক লাঠিয়ালের লাঠির প্রচণ্ড আঘাত পান। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোলক বসু একজন পক্ষপাতদুষ্ট বিচারকের বিচারে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে লজ্জায়-অপমানে কারাগারে আত্মহত্যা করেন। গোলক বসুর ছোট ছেলে বিন্দুমাধব কলকাতা থেকে এসে পরিবারের এই মর্মান্তিক পরিণতি দেখে হতবিহ্বল হয়ে যান। যদিও নাটকটির অনেক দৃশ্য স্থূলভাবে ও অতিরঞ্জিত করে লেখা, তারপরও নাটকটিতে চাষিদের প্রতি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির গভীর মমতা ও দরদ ফুটে উঠেছে। সাহিত্যসমালোচক ও গবেষক ড. ক্ষেত্রগুপ্ত নীলদর্পণ নাটক সম্পর্কে বলেন, ‘গোটা নাটকের বুক চিরে গ্রামাঞ্চলের একটা যন্ত্রণাবিদ্ধ আর্তনাদ আকাশকে স্পর্শ করেছে। এ যন্ত্রণা একজন ব্যক্তির নয়, সমগ্র গ্রামের – ভূমি সম্পর্কে লালিত একটা সুবিস্তৃত দেশখণ্ডের।’

নাটকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত হয়ে লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার পিটার গ্রান্ট সাহেব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কেউ কি নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদ করে দিতে পারবেন? যদি ভালো অনুবাদ হয়, তাহলে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এটা পড়ে নীলচাষ ও নীলচাষি-নীলকর সম্পর্কের স্বরূপ সম্যক অনুধাবন করতে পারত! সিটন কার অনেকটা অভিনয় করে বলেন, ‘পারবে, অবশ্যই পারবে। এর অনুবাদ এমন কি কঠিন কাজ! লঙ সাহেব নিজেই একজন ভালো অনুবাদক। তাছাড়া লঙ সাহেবের অনেক নেটিভ বন্ধু আছেন, যারা বাংলা ও ইংরেজি দু-ভাষায় সমান পারদর্শী।’

 অনুবাদকর্মটি বেশ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। মাইকেল মধুসূদনকে দিয়ে কাজটি আগেভাগেই সেরে রাখা হয়। কালবিলম্ব না করে ছাপানোর ব্যবস্থা করা হলো। সরকারি খরচে সিটন কার-সাহেব মুদ্রণের কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করলেন। মুদ্রিত কপি দেশে, বিদেশে ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন দফতর ও সংস্থায় প্রেরণ করা হয়। এতে নীলকর ও তাদের সুবিধাভোগীরা ক্ষেপে যায়। ইংরেজ বণিকদের সংস্থা ল্যান্ড হোল্ডার অ্যান্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ফার্গুসন কড়া ভাষায় পত্র প্রেরণ করেন বাংলা সরকারের কাছে। পত্রে জানতে চাওয়া হয় – ‘নোংরা, কুৎসাপূর্ণ ও মানহানিকর রচনাটি’ সরকারি খরচায় প্রকাশ ও বিতরণ করা হয়েছে কি না! যে-গ্রন্থে ইংরেজ জাতিকে হেয় ও অপমান করা হয়েছে, সেই গ্রন্থ ছাপানোর টাকা কে দিয়েছে? ইংরেজ সরকার, না অন্য কোনো সংস্থা? এই নাটকে, সব নীলকর সাহেবদের চিহ্নিত করা হয়েছে খুনি, ধর্ষক, ইতর, চাড়াল ও ছোটলোক হিসেবে। ইংরেজ রমণীদের সতীত্বের ওপর কলংক লেপন করা হয়েছে। নীলকরদের বউরা নাকি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে ঢলাঢলি করে বেড়ায়! এমন কুরুচিপূর্ণ সংলাপে ভরা বইকে কী নাটক বলা যায়!

নীলকরদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠনের কাছ থেকে চিঠি পেয়ে অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা বেড়ে যায় ছোটলাটের মধ্যে। স্বয়ং বড়লাট লর্ড ক্যানিং গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য বিব্রতবোধ করেন। ক্ষোভ চেপে রাখতে না পেরে সহকর্মীদের সামনে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন – কে এই কাজ করেছে, কেন করেছে? নেটিভদের এমন ধৃষ্টতা মেনে নেওয়া যায় না! পরিস্থিতি বেগতিক দেখে না জানার ভান করে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন পিটার গ্র্যান্ট। সিটন কারকেও কৌশলে বাঁচিয়ে নেওয়া হয় নীলকরদের আক্রোশ থেকে। কারণ সিটন কারের বেকায়দা মানে সরকারেরই বেকায়দা! সরকারের পক্ষ থেকে অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ল্যান্ড হোল্ডার অ্যাসোসিয়েশনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। তাতেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় না। ল্যান্ড হোল্ডার অ্যান্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নাটকের লেখক, প্রকাশক ও অনুবাদকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। কিন্তু মূল রচনার কভারপেজে যেমন, তেমনই অনুবাদগ্রন্থেও নাট্যকার, অনুবাদক ও প্রকাশকের কোনো নাম উল্লেখ ছিল না। দীনবন্ধু মিত্র ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম গোপন রাখা হয়। নাটকটির টাইটেল পৃষ্ঠায় কেবল মুদ্রাকর সি এইচ ম্যানুয়েলের নাম মুদ্রিত ছিল। মুদ্রাকর ম্যানুয়েলকে কোর্টে হাজির করানো হয়। যেহেতু নীলদর্পণের অনুবাদ নিয়ে মামলা, সেহেতু প্রকাশক হিসেবে পিটার গ্রান্ট ও সিটন কারের এগিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু তাঁরা কেউই এগিয়ে এলেন না। ম্যানুয়েলকে বাঁচানোর জন্য নির্ভয়ে এগিয়ে এলেন পাদ্রি জেমস লঙ। তিনি স্বীকার করলেন, এই গ্রন্থের রচনা, প্রকাশনা ও মুদ্রণের জন্য তিনি একা দায়ী, অন্য কেউ নন। আদালতে প্রদত্ত জবানবন্দিতে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন :

যতদিন আমি বেঁচে থাকবো, চিন্তার জন্য যতদিন মস্তিষ্ক সচল থাকবে এবং যতদিন হাতে কলম থাকবে – ততদিন পর্যন্ত আমি জনগণের সামাজিক উন্নয়নের জন্য কথা বলে যাবো। আমি খ্রিস্টান এবং এই আমার প্রকৃত ধর্ম। আমার এই চিন্তাকে অতি রাজনৈতিক বলা যেতে পারে, কিন্তু ব্যাপক অর্থে খ্রিস্টান ধর্ম নিজেও তো একটি রাজনৈতিক ধর্ম।’

(দ্য ব্লু মিউটিনি, ব্লেয়ার বি ক্লিং। ফরহাদ খান ও জুলফিকার আলী-অনূদিত নীল বিদ্রোহ : বাংলায় নীল আন্দোলন’, ঢাকা, জুন ২০১৪, পৃ ১৪০)

বিচার চলাকালে জেমস লঙ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারকদের উদ্দেশে এই কথাগুলি উচ্চারণ করলেও তাঁর এই জবানবন্দি ছিল মূলত চার্চ সোসাইটির উদ্দেশে। কারণ সোসাইটি মনে করতো যে, এক মিশনারির জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া বড়ই বেমানান, বড়ই অশোভন। কিন্তু লঙ মনে করতেন, বিপুল জনগোষ্ঠীকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করতে হলে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে মিশনারিদের সম্পৃক্ত হতে হবে। নীলকর ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে। কলকাতার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কেও তিনি খানিকটা ভর্ৎসনা করেছেন তাদের স্বার্থপরতা ও উদাসীনতার জন্য। তিনি বলেন, ‘পুরনো দিনের ফরাসি অভিজাতরা যেমন তাদের প্রজাদের প্রতি যে আচরণ করতো, কলকাতার বুদ্ধিজীবীরাও সাধারণ মানুষের প্রতি একেবারে তেমন শত্রুভাবাপন্ন না হলেও উদাসীন।’ (দ্য ব্লু মিউটিনি, ব্লেয়ার বি ক্লিং। ফরহাদ খান ও জুলফিকার আলী-অনূদিত নীল বিদ্রোহ : বাংলায় নীল আন্দোলন, ঢাকা, জুন ২০১৪, পৃ ১৪০) বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি যতই সমালোচনামুখর ছিলেন, ততই তাদের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন।

১৮৬১ সালের ১৯শে জুলাই এই মানহানিকর পুস্তকের জন্য জেমস লঙের বিচার শুরু হয়। সাক্ষ্যপ্রদানকালে আদালত প্রাঙ্গণ ব্রিটিশ কর্মকর্তা, নীলকর সাহেব, বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও জমিদারদের উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে। উপস্থিত হতেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, রানাঘাটের জয়চাঁদ পালচৌধুরীসহ স্থানীয় প্রজাহিতৈষী জমিদাররা। নীলকর ও ইংরেজ রমণীকুলকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার অপরাধে জুরিবোর্ড পাদ্রি জেমস লঙকে দোষী সাব্যস্ত করেন। ২৪শে জুলাই প্রধান বিচারপতি স্যার বার্নস পিককের সভাপতিত্বে ফুল বেঞ্চ তাঁকে এক হাজার টাকা জরিমানা ও এক মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। রায় শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান কলকাতার লেখক, জমিদার কালীপ্রসন্ন সিংহ ও দেশীয় বরেণ্য ব্যক্তিরা। ক্ষিপ্ত হয় সারাদেশের মানুষ। নিরপরাধ পাদ্রি লঙ সাজা পাওয়ায় বিষাদ ছড়িয়ে পড়ে কলকাতা, কৃষ্ণনগর, বারাসাত থেকে নদীয়া-চব্বিশ পরগণার গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত। মিশনারির কারাদণ্ড কলকাতা ও ইংল্যান্ডের জনমনকে প্রচণ্ড আঘাত করে এবং জেমস লঙের প্রতি
মানবতাবাদী-নীলকরবিরোধী দলগুলি সহমর্মী ও সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। বিশপ’স কলেজের ড. কী বলেন, স্থানীয় সংবাদপত্রসমূহ এক নূতন সুরে অভিভূত, নিপীড়িতদের স্বার্থে একজন মিশনারিকে আনন্দের সঙ্গে জেলে যেতে দেখে এঁরা বিস্ময়াবিমুগ্ধ। একটি বাংলা পত্রিকার সম্পাদক লেখেন, ‘এটাই যদি খ্রিস্টধর্ম হয়, তাহলে আমরা কামনা করি খ্রিস্টান ধর্ম সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ুক।’ (‘সি এম এস লঙ টু সি এম এস’, ৮ই আগস্ট, ১৮৬১) সোমপ্রকাশ পত্রিকার সম্পাদকও জেমস লঙ ও মিশনারিদের ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন।

লঙ সাহেবের জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন কলকাতার বিশিষ্ট জমিদার, লেখক, সাহিত্যসেবী কালীপ্রসন্ন সিংহ। স্থানীয় ভাষায় সাহিত্যচর্চায় পৃষ্ঠপোষণা প্রদানের স্বীকৃতিস্বরূপ লঙকে মানপত্র প্রদান করেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা রাজা রাধাকান্ত দেব। যেসব পত্রিকার সম্পাদক বিশেষত ইংলিশম্যান, সোমপ্রকাশ প্রভৃতি লঙের মিত্রভাবাপন্ন ছিল না, সেসব পত্রিকাও লঙের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন জ্ঞাপন করে অকুণ্ঠচিত্তে। এরা আশা প্রকাশ করে যে, ‘বাংলার মানুষের জন্য
লঙ-এর চেষ্টা ও সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদ ও রেভারেন্ড জেমস লঙের কারাদণ্ড ভারতবর্ষের সাহিত্যচর্চা ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা, যদিও এই নাটকের উদ্দেশ্য ইংরেজ সরকারকে প্রভাবিত করতে পারেনি। কিন্তু বাঙালি লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোজগতে লঙের কারাদণ্ড ও নীলদর্পণ নাটকের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই নাটক পল্লি অঞ্চলের রায়ত ও শহরের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, সোমপ্রকাশ প্রভৃতি কাগজে তৎকালীন বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা নীলবিদ্রোহের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে সমর্থন জ্ঞাপন করেন। কলকাতার বাবু ও বুদ্ধিজীবীরা চাষিদের হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। কলকাতার কালীপ্রসন্ন সিংহ, যশোরের নীল-আন্দোলনের নেতা শিশির কুমার ঘোষ, হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণনগরের ব্যারিস্টার মদনমোহন ঘোষের মতো বাঙালি বাবু শ্রেণির প্রতিনিধিরাও নীলকরবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। কলকাতার রাজনৈতিক নেতারা সরকারের কাছ থেকে অনুকূল্য-অনুকম্পা লাভের প্রত্যাশা ত্যাগ করে ইউরোপীয়দের একচেটিয়া কারবার ও ইংরেজদের কর্তৃত্ববাদকে চ্যালেঞ্জ জানান। হিন্দু রাজনৈতিক সম্প্রদায় জাতিভেদ প্রথা উপেক্ষা করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। ইন্ডিয়ান ফিল্ড পত্রিকার রাজনৈতিক সম্পাদক, রামমোহন-দ্বারকানাথের ভাবশিষ্য কিশোরী চাঁদ মিত্রের মতো উচ্চশ্রেণির প্রতিনিধিরাও বাংলার কৃষককুলের ভাগ্যোন্নয়নের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে এগিয়ে আসেন। লঙের কারাদণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রজা-রায়তদের মধ্যে যে-জাগরণ সৃষ্টি হয়, তাতে সমর্থন জানাতে গিয়ে বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীরা কৃষককুলের পরমবন্ধু ও হিতৈষী হিসেবে আবির্ভূত হন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারা বেগবান ও শক্তিশালী হয়। এই গণজাগরণকে ‘ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের পূর্বাভাস’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ব্লেয়ার বি ক্লিং। তিনি বলেন, জেমস লঙের মতো একজন বিদেশি যদি ভারতীয় কৃষককুলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারেন – সেখানে স্বদেশি বাঙালি উদাসীন থাকেন কীভাবে? নীলবিদ্রোহের সময় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় হরিশচন্দ্র মুখার্জির লেখনীতে যে-আদর্শ পরিস্ফুট হতো, সেই আদর্শ এক দশক পর ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূলধারায় প্রবেশ করে বঙ্কিমচন্দ্রের রাজনৈতিক উপন্যাস ও প্রবন্ধের মাধ্যমে।