দুর্লভ বিশ্রামালয়

বিশ্রামালয়ের অন্দরমহল

নগরপ্রধানের ঘুম তখনো ভাঙেনি। সুশীতল ছায়ানিবিড় কক্ষর সামনে একে একে এসে জড়ো হয়েছেন নগরের প্রধান অধিকর্তা, প্রকৌশলী, পরিকল্পক, নিরাপত্তা আধিকারিক, রাজস্বকর্তা, পরিচ্ছন্ন বিভাগের অধিপতি, জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও শলাপরামর্শকেরা।

তারা কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। ঘরজুড়ে পাথরের নীরবতা। নগরের অলিগলির টিউবওয়েলগুলোয় পানি না উঠলেও তাদের কপাল বেয়ে ঝরা পানিতে ভিজে যাচ্ছে সুবিশাল কক্ষর দামি কার্পেট। তাদের হাতে হরিণের চামড়ায় মোড়ানো ডকেট ফাইলে রয়েছে নগরসজ্জিত করার বিবিধ ফর্মুলা। সুশীতল কক্ষর হাওয়ার ঝরোকার মধ্যে তাদের কপাল বেয়ে পানি ঝরার হেতু কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না বিশ্রামালয়ের দ্বাররক্ষকের।

নগরপ্রধানের অবকাশযাপন বিশ্রামালয়ের কারুকার্যময় প্রধান ফটক পেরোলেই জিরাফের বিশাল একটা ভাস্কর্য গলা বাড়িয়ে স্বাগত জানায় আগত অতিথিদের। শুধু বিশেষ অনুমতিসাপেক্ষ এ-বিশ্রামালয়ে প্রবেশ করতে পারেন নগরের উচ্চ-নাগরিকরা। বাকি জনসাধারণ শুধু বাইরে থেকে দেখেই চোখের তিয়াস মেটান। সুউচ্চ জিরাফের পেটের নিচ দিয়ে বয়ে গেছে বৃহৎ লেক।

মার্বেল দিয়ে বাঁধানো লেকের সিঁড়ির গোড়ায় প্রহরীরা বেঁধে রেখেছে দুটো রাজকীয় নৌকা ও একটি স্পিট বোড। লেকের পানিতে মাথা তুলে খাবি খায় হরেকরকমের বিশাল বিলাসী মাছ। তাদের লেজের ঝাপটায় পানির তরঙ্গে দুলে ওঠে রাজকীয় নৌকা।

বিশাল এ-বিশ্রামালয় সুউচ্চ দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ভেতরে ছায়ানিবিড় নানা প্রজাতির গাছপালা, পাখির কলতানে মুখর থাকে সারাবেলা। লেকের ওপর তৈরি করা হয়েছে দামি কাঠ দিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভিআইপি কয়েকটি কটেজ। তাতে অন্য নগর থেকে আগত উচ্চমানবেরা অবসরযাপন করেন। নদী ও নগরের রূপ অবলোকনের জন্য লেকের ওপারে রয়েছে সুউচ্চ টাওয়ার। টাওয়ারের হাতল ধরে মাঝে মাঝে ঝুল্লু খায় বিশ্রামালয়ের গাছে থাকা বানরেরা। লেকের দু’পাশকে সংযুক্ত রেখেছে একটি ঝুলন্ত সেতু। সেতুতে পা রাখলেই বেজে ওঠে সম্মোহন সুরের ধারা।

নগরগ্রধান শৌখিন মানুষ। একটি আধুনিক নগর গড়তে যা-ই করা লাগুক না কেন, তা তিনি করতে ছাড়েন না। তার দুর্লভ বিশ্রামালয় যারা দেখেছে তারাই রাজা মাইডাসের রাজ্যের মতো এ-বিশ্রামালয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নানা প্রজাতির দুর্লভ ফুলশোভিত বিশ্রামালয়ের এক পাশে রয়েছে নগরপ্রধানের প্রাণীসমাহার। লোহার খাঁচার মধ্যে এবড়োখেবড়ো জমিতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকডজন স্বাস্থ্যবান ঘোড়া, তার পাশেই রয়েছে সিংহ ও বাঘের বাসা, মায়া ও চিত্রা হরিণের খামার, পেখম ছড়ানো ময়ূরের ঝাঁক, লাল পান্ডা, বন্য কুকুর, বিদেশি কালো ভালুক, কবুতর, সাদা হাতির বাচ্চা ও নগরপ্রধানের প্রিয় পোষ মানানো অজগর। অন্যপাশে রয়েছে দুর্লভ ফুলের বাগান, ভেষজ গার্ডেন, বার্ড হাউস, আধুনিক রেস্তোরাঁ এবং সবজি ও ফলের বাগান।

নগরপ্রধানের বিশ্রামালয়ের দরজা খোলা মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন অপেক্ষমাণ পারিষদবর্গ। আলিশান ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শান্ত-সৌম্য চেহারার নগরপ্রধান। তার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে প্রশান্তির হাসি। হরিণের চামড়ায় মোড়ানো আধুনিক সুখী নগরের ফর্মুলার ব্যাপারে আলাপ-সালাপ সেরে একে একে বেরিয়ে গেলেন তারা। কিন্তু নগরপ্রধানের কাছে কপাল থেকে ঝরে পড়া ঘামের নেপথ্যকথা কেউই বললেন না।

আমরা যখন জিগরি নগরে ফিরলাম

জিগরি নগরে ঢোকার মুখে বাঁপাশে ‘স্বাগতম’ লেখা ফলকটি চোখে পড়তেই আমরা ডানপাশে তাকালাম। দেখলাম ডানের ফলকটি আরো ডানদিকে কাত হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। ‘আমরা জিগরি নগরেই ঢুকেছি তো’ বলেই নিজের গায়ে চিমটি কেটে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। আমাদের চাওয়াচাওয়ির মাঝ দিয়ে পানির স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে ঝলমলে আলোর স্রোত। আমরা রাতে নাকি দিনে নগরে প্রবেশ করছি তা বোঝা যাচ্ছে না।

কয়েক হাতি সমান চওড়া রাস্তার দু’পাশে ঝকঝকে ফুটপাত দেখে আমাদের আনন্দ হয়। কিন্তু এ-আনন্দ আমাদের মধ্যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ছোটবেলার বিশাল বিশাল গাছ যখন ঢুকে পড়ে তকতকে রাস্তার পেটে তখন কারো কিছু যায়-আসে না। আধুনিক নগরের মানুষেরা এ-রাস্তায় তাদের দামি দামি গাড়ি ছুটিয়ে নেওয়ার সময় ফুল ভলিউমে চালিয়ে রাখে সুখী সুখী আনন্দ মিউজিক। তারা মাটির গাছগুলো কেটে রাসত্মা বানিয়েছে আর সুউচ্চ বাড়ির ছাদে লাগিয়েছে ছোট ছোট গাছ। তাদের বাড়ির দেয়ালজুড়ে সাঁটিয়ে রেখেছে বিশাল বিশাল গাছের পোস্টার।

আমরা জিগরি নগর যতই ঘুরতে থাকি, মরতে থাকে আমাদের মন। আমাদের মন খুঁজতে থাকে নগরের পুরনো রূপ। আমরা কোথাও তার চিহ্ন দেখি না। আমাদের চোখের সামনে বহুতল শপিংমল, সুউচ্চ আবাসিক ভবনগুলো দুলতে থাকে। আমাদের খেলার মাঠ, শৈশবের পুকুরগুলো আলাদিনের দৈত্য এসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। নগরের মানুষেরা সুখী হতে থাকে আর আনন্দে হাততালি দিয়ে গড়ে তোলে কংক্রিটের পাহাড়। তাদের ছেলেমেয়ে সেই পাহাড়ে ওঠে আর শরীরের বাড়তি মেদ কমানোর কসরত করে। আমাদের তখন গণিত ইশকুলের বোকা ছাত্র মনে হয়।

নগরের কতিপয় মানুষ তাদের খাবার টেবিলে গাছপালা, পুকুর, নদী ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর নকশা সাজিয়ে রাখে এবং একে একে তাদের খাবারের অংশ করে নেয়। আয়েশি খাবারের ঢেকুর তোলা বায়ু কাচের বয়ামে জমিয়ে রাখে আর নগরের শীতাতপ হলরুমে বনসাই মেলার আয়োজন করে।

রাতের বেলা পুরো নগর বিদেশ থেকে তৈরি করা ঝলমলে আলোর সঙ্গে খেলতে থাকে। আমরা সেই আলোর পোলের নিচে হেলান দিয়ে দাঁড়াই আর সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্টাই। আমাদের রিচ বাড়তে থাকে, কিন্তু কমতে থাকে কীটপতঙ্গের সংসার। আলো ঢেউয়ের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় নিশিপাখিরা বলতে থাকে – ‘আহা, কী সুন্দর আলোর নগর।’ পাখিগুলোর নিচে নামতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু বড় বড় গাছের সন্ধান করতে করতে তারা ক্লান্ত হয়ে যায়। তারা উড়তে উড়তে অন্য নগরের দিকে বাঁক নেয় এবং পাখির বদলে জিগরি নগরে নেমে আসে সুখী মানুষভর্তি উড়োজাহাজ।

হরিণের চামড়ায় মোড়ানো বাড়তি পরিকল্পনা

নগরালয়ের সুশীতল কামরায় গোল হয়ে বসে আছেন পারিষদবর্গ। তারা অপেক্ষা করছেন নগরপ্রধানের। হরিণের চামড়ায় মোড়ানো নগর সজ্জিতকরণ ফর্মুলা তারা নেড়েচেড়ে দেখার মুহূর্তে কামরায় প্রবেশ করলেন নগরপ্রধান। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন।

নগরপ্রধান রাজসিক চেয়ারে বসে বললেন, ‘আজকের সভা শুরু করুন প্রধান অধিকর্তা।’

নগরের প্রধান অধিকর্তা সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সভা শুরু করলেন এবং তার হাতে ধরা ফর্মুলা সংক্ষপ্তভাবে নগরপ্রধানকে শোনালেন, ‘মাননীয় নগরপ্রধান, আপনার সঠিক দিকনির্দেশনায় একটি আধুনিক ঝলমলে নগর গড়তে আমরা সফল হয়েছি। আমাদের নাগরিকরা এখন সুখী। তাদের প্রতিটি বাড়িতে এখন রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন ঘরে বসেই কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম। আমরা আধুনিক বহুতল শপিংপল, ফাইভ স্টার হোটেল, রেসেত্মারাঁ, বড় বড় সড়ক, গোরস্তান, ঈদগাহ, আলোকসজ্জিত উপাসনালয় নির্মাণ করেছি। আমাদের নগরের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে নগরের যেসব নদী, পুকুর, জলাশয়, মহান মনীষীদের বাড়িঘর, গ্রন্থাগার, ধর্মালয় আধুনিক নগর গড়তে যা যা আমরা ভেঙে ফেলেছি তা আবারো আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই। সেজন্য একটি নগর জাদুঘর নির্মাণের প্রস্তাব করছি। হারিয়ে যাওয়া সেইসব ঐতিহ্যের রেপ্লিকা সেই জাদুঘরে প্রদর্শিত হবে, যাতে আগামী প্রজন্ম আপনার কীর্তি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারে।’

নগরপ্রধান মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব।’

নগর প্রকৌশলী তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরলেন, ‘নগরপ্রধান মহোদয়, আমাদের নগর অনেক পুরনো। এই নগরে এখনো বেশকিছু ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘর ও মার্কেট রয়েছে, যা আমাদের নগরের সৌন্দর্য নষ্ট করছে এবং আমাদের মনেক্ষত তৈরি করছে। ওগুলো অপসারণ করে নতুন নতুন সড়ক ও মার্কেট নির্মাণ করা প্রয়োজন। শুকিয়ে যাওয়া নদীর চরগুলো আমাদের কাজে লাগানো দরকার। বিদেশিদের জন্য আমরা সেখানে রিসোর্ট নির্মাণ করতে পারি। নগরের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব কোণে ধানিজমিগুলো অধিগ্রহণ করে কোনো পরিকল্পনা করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবছি। আপনার সদয় অনুমতি পেলে কাজ শুরু করব।’

নগরপ্রধান হাসিমাখা ঠোঁট একটু বাঁকিয়ে বললেন, ‘তা নিয়ে ভাবছি। এখনই তা প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। আপনি আরো নতুনতর ফর্মুলা তৈরি করুন।’

নগর পরিকল্পক উঠে দাঁড়িয়ে ফাইলটি নগরপ্রধানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলতে থাকলেন, মহামহিম, আমাদের নগরে নতুন নতুন উড়াল সেতু, মেট্রোরেল, ট্রাম ও বিভিন্ন পয়েন্টে হেলিপ্যাড নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এগুলো করতে পারলে আমরা আরো উন্নত হয়ে উঠব। আমাদের নাগরিকদের বাড়ির ছাদে ধান ও সবজিচাষ, পশুপালন এবং অ্যাকোরিয়ামে মাছচাষের জন্য একটি বৃহৎ ট্রেনিং সেন্টার প্রয়োজন। বিদেশ থেকে দক্ষ ট্রেনার এনে আমরা নগরবাসীকে শেখাব।’

নগরপ্রধান উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘দারুণ প্রস্তাব। কাজ শুরু করুন। আগামী ছ’মাসের মধ্যে এই প্রকল্পগুলো রেডি হওয়া চাই।’

সভায় রাজস্বকর্তা, পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ কর্তা, জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং নগর অধ্যাপক কিছুই বললেন না।

কাঁচুমাঁচু করে উঠে দাঁড়ালেন নগরকবি। তিনি হাত চুলকাতে চুলকাতে বললেন, ‘মাননীয় মহান নগরপ্রধান, আমরা আমাদের প্রাচীন বৃক্ষগুলো নিধন করেছি, ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে ফেলেছি, নদ-নদী, পুকুর-জলাশয় ভরাট করে কংক্রিটের সুউচ্চ ভবন করেছি, নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ করে বহু মানুষের বাড়ি-ঘর গুঁড়িয়ে আধুনিক নগর গড়েছি। হারিয়ে যাওয়া সেই সৌন্দর্য ও মানুষের বেদনা কবিরা কবিতার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রেখেছে। আপনার গুণগান রচনা করছে। কবিদের মধ্যে অনেকেই এই সুখী নগরে অসহায় জীবনযাপন করছে। আপনি তাদের নিয়ে একটু ভাবুন। আপনার নগরালয়ে তাদের জন্য ‘হারানো ঐতিহ্যের স্বপ্ন ও সৌন্দর্য বিভাগ’ নামে একটি দফতর খুলে তাদের চাকরির সুব্যবস্থা করার আর্জি জানাচ্ছি।’

নগরপ্রধান কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘নগরে কিছু দুঃখী মানুষ থাকুক, নইলে সুখী মানুষেরা বুঝবে কেমন করে যে তারা সুখী। শুনুন কবি, প্লেটো তাঁর রাষ্ট্রে কবির কোনো জায়গা রাখেননি। আমি কিন্তু এই নগরে কবি রেখেছি। প্রতি মাসে তাদের ত্রাণ দফতর থেকে চাল, ডাল, আলু, তেল দেওয়া হবে। তারা কেউ না খেয়ে মরবে না। ওদের সুখী রাখলে আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। আপনার চেয়ারটাও থাকবে না।’

কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে নগরপ্রধান বললেন, ‘আর কারো কোনো কিছু বলার আছে?’

নগর নিরাপত্তা আধিকারিক হাত তুলে বললেন, ‘স্যার, আপনি অভয় দিলে একটি জরুরি সংবাদ জানাতে চাই।’

নগরপ্রধান মাথা নেড়ে অভয় দিলেন।

‘স্যার, আপনার বিশ্রামালয়ের তত্ত্বাবধায়ক জানিয়েছেন যে, আপনার প্রিয় অজগর গত দুদিন যাবৎ নিখোঁজ রয়েছে। তাকে খুঁজতে একটি চৌকস টিম কাজ করছে।’

নগরপ্রধান চোখ বিস্ফারিত করে নিরাপত্তা আধিকারিকের দিকে তাকালেন। উপস্থিত পারিষদবর্গ এই রকম কাণ্ড নগরবাসীর আতংকিত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করলেন।

নগরপ্রধানের মনে তখন অভিনব এক আইডিয়া উঁকি দিলো। তিনি উত্তেজিত না হয়ে পারিষদবর্গকে আগামীকাল নগরের উচ্চ-নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় ও রাজকীয় ভোজের আয়োজন করার নির্দেশ দিলেন।

রাজকীয় ভোজ ও পরবর্তী প্রকল্প

নগরের দরবার হল রাজসিক খাবারের ম ম গন্ধে ভরে উঠেছে। খাবারের টেবিলের আসনগুলোও পূর্ণ হচ্ছে ধীরে ধীরে। নগরপ্রধানের আমন্ত্রণ শিরোধার্য করেছেন নগরের উচ্চ-নাগরিকবৃন্দ। নগরালয়ের পারিষদবর্গের স্ব-স্ব ব্যস্ততা বেড়েছে। লম্বা টেবিলটায় নগরপ্রধানের আসনটা ফাঁকা রেখে একে একে বসেছেন পারিষদবর্গ। 

ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর জন্য দরবার হলের প্রধান দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন তারকাখ্যাত দুই সুন্দরী তরুণী।

নগরকবি তার ছোটখাটো একটা কবিদল নিয়ে দরবারে প্রবেশ করলেন। নগর-অধ্যাপকও তার দু-চারজন সঙ্গী নিয়ে আসনে বসলেন। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাল টকটকে একটি করে গোলাপ শোভা পাচ্ছে। কোনো কোনো কবি সেই ফুল গুঁজে রেখেছেন কানে। নিজের আসন ধরে রাখার জন্য কেউ কেউ তার আসনের ওপর রেখে গেছেন নগরপ্রধানের উপহারি গোলাপ।

বাদবাকি টেবিলের আসনে বসেছেন রাজনৈতিক সেবাদাতা, সামরিক-বেসামরিক শাসক, প্রশাসনিক উচ্চপদস্থ প্রশাসক, শপিংমলের মালিক-মালকিন, কসাই সমিতির সভাকর্তা, চেরাগ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং তার প্রতিনিধিরা, গৃহপালিত সংবাদ ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক ইজারাদার, সেলুন সমবায় সমিতির
সভাপতি-সম্পাদকবৃন্দ, পোশাক প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ, সবজি বিক্রেতা সমিতির কোষাধ্যক্ষ, পরিবহন সমিতির মালিক-শ্রমিক নেতারা, উড়োজাহাজ কোম্পানির প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি-পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।

টেবিলে টেবিলে সাজানো রয়েছে নানা পদের খাবার। ইচ্ছেমতো কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছেন আগত বিশিষ্ট অতিথিরা। প্রতিটি টেবিল ঘুরে ঘুরে দেখছেন নগরপ্রধান। কারো কারো সঙ্গে চলছে সামান্য বাক্যবিনিময়। দরবার হলের হালকা মনোরম আলোয় চলছে স্বর্গের খানাপিনা। খাবার-দাবারের মাঝখানে মৃদু মিউজিক সহযোগে ভেসে এলো নগরপ্রধানের কণ্ঠ। অনেকেই সুস্বাদু খাবার মুখে পোরার মুহূর্তে থেমে গেলেন এবং কান খাড়া করলেন নগরপ্রধানের কথা শোনার জন্য।

নগরপ্রধান বললেন, ‘সুপ্রিয় সুখী ও আধুনিক নগরের বিশিষ্ট বাসিন্দাগণ, আপনারা এই মত ও ভোজসভায় যোগ দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আপনাদের সুখের জন্য নগরে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছি, যা আপনাদের জীবনমান আরো উন্নত করবে। পাড়ায়-মহল্লায় আরো বহুতল ভবন ও শপিংমল নির্মাণ করা হবে। সড়কগুলো আরো চওড়া করলে নির্বিঘ্নে আপনাদের দামি গাড়িগুলো চলাচল করবে।’

নগরপ্রধান এবার একটু থামলেন। পারিষদবর্গের দিকে আড়চোখে তাকালেন। গলার মধ্যে কয়েক ঢোক পানি চালান করে আবার কথা বলা শুরু করলেন।

‘এই নগর কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের মডেল নগর হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন না, আমার বিশ্রামালয়ের প্রিয় অজগর এই নগরভ্রমণে বেরিয়েছে। এটা আমাদের একটা প্রকল্পের অংশ। আপনারা ঘাবড়াবেন না। ওর শরীরে জিপিএস ট্যাগ লাগানো রয়েছে। আমাদের পর্যবেক্ষক প্রতিনিয়ত তা পর্যবেক্ষণ করছেন। আপনারা একটু সাবধানে চলাচল করবেন। অজগরের কোনোক্ষতি করবেন না। আপনাদের সবার আরো বেশি সুখ কামনা করছি।’

পারিষদবর্গ ও নগরের বিশিষ্ট নাগরিকরা একে অপরের মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু কেউ কোনো বাক্য ব্যয় করলেন না।

অজগরের ভ্রমণ খতিয়ান

ভোজগ্রহণকারী বিশিষ্ট নাগরিকরা বাড়ি ফিরে পরিবারের কাছে নিখোঁজ অজগর নিয়ে গল্প ফাঁদতে থাকে। তারা বলতে থাকে, নগরপ্রধানের পোষ মানানো অজগরটি নগরভ্রমণে বেরিয়েছে। এতে নাগরিকদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। পরিবারের সদস্যরা তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, তবে কেউ বিশ্বাস করে না।

বিশ্রামালয়ের অজগর পর্যবেক্ষক দল সপ্তাহখানেক সময় পেরিয়ে গেলেও সাপের কোনো হদিস করতে পারেনি। জিপিএস ট্যাগ কোনো কারণে সঠিকভাবে কাজ করছে না বলে তারা ধারণা করে। কিন্তু একথা কাউকে জানায় না। তারা নগরের সম্ভাব্য জায়গায় অভিযান চালাতে থাকে।

পর্যবেক্ষক অভিযানী দল নগরপ্রধানের অনুমতিক্রমে নগরজুড়ে একটা সতর্কবার্তা জারি করে। মাইকযোগে সেই এলান বাজতে থাকে নগরের মোড়ে মোড়ে ও অলিগলিতে। বন্যপ্রাণী সংক্ষরণ আইনের বরাতে ফরমানে বলা হয়, ‘সম্মানিত নগরবাসী, নগরপ্রধানের পোষা অজগর নগরভ্রমণে বেরিয়েছে। ডোরাকাটা হলুদ-সাদা শরীরের অজগরটির দেহের রিংয়ের ভেতর ডায়মন্ডের মতো বেশকিছু ছোপ আর মাঝের রং ধূসর। ছোপের আশেপাশে কালচে ছোট ছোট অনেক দাগ ও ফোঁটা রয়েছে। অজগরটির চলাচলের পথ রোধ বাক্ষতি সাধন না করার আহ্বান করা হচ্ছে। কেউক্ষতি সাধন করলে জরিমানা বা জেল অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

এমন ফরমানে নগরের নাগরিকরা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং অতি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকে। ‘অজগর কেন নগরভ্রমণে বেরোবে?’ এমন প্রশ্ন তাদের মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সুখী জীবনের সঙ্গে বাড়তি আতঙ্ক নিয়ে নগরবাসী তাদের যাপন অতিবাহিত করে। ‘অজগরটি তার ভ্রমণ শেষ করল কি না’ টেলিভিশন ও খবরের কাগজে এ-সংক্রান্ত সংবাদ খুঁজতে থাকে।

দিন গড়িয়ে যেতে থাকে কিন্তু কোথাও অজগরটির খোঁজ পাওয়া যায় না। নগরে মানুষ চলাচল কমে গেলে ছোটখাটো ব্যবসায় ধস নামতে থাকে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের দোকানের মাসিক ভাড়াও তুলতে পারে না। ফলে নগরের ব্যবসায় একটা মন্দাভাব নেমে আসে।

একদিন নগরের বেশকিছু ব্যবসায়ী নগরালয়ে গিয়ে নগরপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং একটি স্মারকলিপি দিয়ে অজগরের ভ্রমণ সংক্ষপ্ত করার অনুরোধ জানায়। পরিস্থিতি বিবেচনায় নগরপ্রধান তাদের আশ্বাস দিয়ে সকলকে চায়ের আমন্ত্রণ জানান।

অনেকদিন পর নগরসীমার বিশ কিলোমিটার পূর্বে হঠাৎ জিপিএস ট্যাগের সংকেতে অজগরটির সন্ধান মেলে। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকারী দল অজগরটি পাকড়াও করার জন্য নগরপ্রধানের অনুমতি প্রার্থনা করে। তবে নগরপ্রধান অজগরকে পাকড়া করার বদলে তাকে পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দেন এবং ওই এলাকার অধিকর্তাকে ‘নগরপতির অজগর এখন গ্রাম ভ্রমণে রয়েছে ও তার কোনোক্ষতি না করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে’ – এমন একটি বার্তা প্রেরণ করার নির্দেশ দেন।

পর্যবেক্ষক দল বুঝতে পারে অজগরটি এখন ধানক্ষতের মাঝ দিয়ে উত্তরের ঝোপের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং ছোটখাটো ইঁদুর পেলে তা শিকার করে পেটে পুরছে।

বেশ কয়েকদিন ধরে পর্যবেক্ষক দল অজগরের চলাফেরা নজরবন্দি রাখছে। সাপটি কয়েক সপ্তাহে উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলেছে। তারা সাপের আপডেট সবসময় নগরালয়ের দফতরে সরবরাহ করছে। কী কারণে নগরপ্রধান সাপটিকে পাকড়াও করতে বাধা দিচ্ছেন তা তাদের মাথায় খেলছে না।

গতরাত থেকে অজগরটি কোথায় আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো আবার জিপিএসের গড়বড়ে কোনো প্রকার-সংকেত পাওয়া মুশকিল হচ্ছে। অজগরের অবস্থান এখন কোথায়, কেউ জানে না।

ক্যাফে আড্ডায় বিবিধ কেচ্ছা

ক্যাফেতে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যাটা পার করতে আমাদের ভালো লাগে। নগরের অভিজাত এলাকায় চোখে আরাম দেওয়া আলোসজ্জিত ক্যাফেতে ওয়েটার আমাদের টেবিলে কফির মগটা রেখে যায়। গরমাগরম কফির ধোঁয়া আসেত্ম আসেত্ম উপরে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ঘরে। আমরা খেয়াল করলাম, কফির ধোঁয়ার মতো নগরের অনেক খবর ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাফের টেবিলে টেবিলে।

নগরালয়ের কানওয়ালা দেয়াল আরেক দেয়ালের কানে অজগর বিষয়ক কেচ্ছা শোনায়। হয়তো আরেকটি দেয়াল গোপন সংবাদটি বলে গেছে ক্যাফের দেয়ালের কানে। নগরের অদূরে কম দামে কৃষি জমিগুলো কেনাবেচা নিয়ে দেন-দরবার চলছে এক টেবিলে। কেউ কেউ আগেভাগেই কিনে রেখেছে বিঘা বিঘা জমি।

আরেক টেবিলে কয়েকজন মানুষ বড় বড় প্রকল্প কীভাবে ওই জায়গায় বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে সাজিয়ে তুলছে তাদের পরিকল্পনা এবং এ-খবর যেন কোনোভাবেই বাইরে না যায় সে-ব্যাপারে তাদের রয়েছে অধিক সতর্কতা।

কফির মগটা হাতে নিয়ে আমরা অলস ভঙ্গিতে ক্যাফের ভেতরে পায়চারি করতে থাকি আর আমাদের শেষ জমিটুকু বাড়তি সড়কের পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়াতে কষ্ট পাই। দাদার ভিটাস্মৃতি রক্ষা করতে না পারার অক্ষমতা আমাদের পলে পলে ভোগায়। কফিতে চুমুক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরো কিছু কেচ্ছা শুনতে থাকি নগরহারা দুই এতিম।

ক্যাফের কোনার টেবিলজুড়ে বসে আছে গোটা পাঁচেক তরুণ-তরুণী। তারা নগরপ্রধানের অজগরভ্রমণকে একটি দূরদর্শী নগর সম্প্রসারণ গোপন প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করে। গ্রামের ধানিজমি, খানাখন্দ, ঝোপঝাড় নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়ে পরে নগর সম্প্রসারণ করে কয়েকগুণ বেশি দামে জমিগুলো মেগা কোম্পানির কাছে বিক্রি করবে। এতে করে ধানিজমি নষ্ট হবে এবং জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। তারা এই চালাকি রুখে দেওয়ার জন্য একটি ইশতাহার তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং কফিশপের বিল মিটিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।

এ-ধরনের সর্পভ্রমণ নগরে আগে কখনো হয়েছে কি না তা জানার জন্য আমাদের ভেতর কৌতূহল দানা বাঁধতে থাকে এবং অপেক্ষার সিঁড়িটাকে অযথা লম্বা না করে গুগল ইঞ্জিনের সাহায্য কামনা করি। ‘অজগর’ লিখতেই অনেক লিংক আমাদের সামনে আসে। আমরা তা একে একে দেখতে থাকি।

আমরা জানতে পারি, বছর-ছয়েক আগে নগরের নমিতা লাহেড়ী সকালে ঘুম থেকে উঠে তার বাড়ির ছাদের তীরের সঙ্গে একটা সাপ ঝুলে থাকতে দেখেন। তিনি সাপ দেখামাত্র চিৎকার শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে নমিতার বাড়ির পাশের লোকজন এসে হাজির হয় এবং ফায়ার সার্ভিসের কাছে সহযোগিতা কামনা করে। ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় একজন সাপুড়ে সাপটি উদ্ধার করে। সে জানায়, এটা বিষধর গোখরা সাপ। তার ধারণা, এই বাড়িতে আরো সাপের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

কিছুদিন পর সাপের ভয়ে নমিতা লাহেড়ী পরিবারসহ সেই পুরনো বাড়ি ত্যাগ করেন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই নগরের একটি প্রভাবশালী ব্যক্তি ওই বাড়িটি দখলে নিয়ে একটি সমাজসেবামূলক সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়।

নগরের পূর্বদিকে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন সৈয়দ আলী। একদিন রাতে ঘুমানোর আগে তিনি খেয়াল করেন খাটের নিচ থেকে একটি সাপ বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের পেছনে ঢুকে পড়ে। তিনি টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে পান সেখানে আরো তিনটি সাপ রয়েছে। তিনি আতঙ্কিত হয়ে তার ছোট ভাইকে ডাক দেন। লাটিসোঁটা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলসহ ঘরের অন্যান্য আসবাব সরিয়ে ফেলেন। তারা ড্রেসিং টেবিলের পেছনে গর্তটা দেখতে পান। পরে শাবল নিয়ে এসে গর্তটি খুঁড়তে থাকেন এবং একে একে সাপ বেরিয়ে এলে তারা সেগুলো মেরে ফেলেন। সব মারার পর তারা গুনে দেখেন সাতাশটি সাপ তারা মেরেছেন এবং সবই বিষাক্ত গোখরা।

কয়েক মাস পর সৈয়দ আলীর বাড়িতে রাতের বেলায় এসে হাজির হয় কয়েকজন যুবক। তারা তাকে বোঝাতে থাকে, এভাবে সাপের সঙ্গে বসবাস করা ঠিক নয়। বরং অল্প টাকার বিনিময়ে তাদের কাছে বাড়ি বিক্রির প্রসত্মাব দেয়। সৈয়দ আলী রাজি হন না। পরে যুবকেরা ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় এবং জোর করে আগে থেকে তৈরি করা দলিলে সই করিয়ে নেয়। তারা যাওয়ার সময় টাকার থলেটা ছুড়ে মারে সৈয়দ আলীর মুখের ওপর।

পরদিন সৈয়দ আলীর পরিবার নিরুদ্দেশ হয়। তারা কোথায় গেল কেউ বলতে পারে না।

আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না শুধু নগরপ্রধানের অজগর নয়, পূর্ব থেকেই অনেকগুলো অজগর নগরে ভ্রমণ করে আর সবকিছু গিলে খায়।

বিশ্রামালয়ে যেদিন জোছনা নেমেছিল

জোছনায় ফকফকা বিশ্রামালয়ের পুরো চত্বর। চাঁদ যেন নেমে এসেছে লেকের টলটলে পানির মধ্যে। আকাশে চাঁদ স্থির দেখালেও পানির মধ্যে তিরতির করে কাঁপছে। গভীর রাতে ডেকে চলেছে কয়েকটি নিশিপাখি। গাছের ডালপালার ভেতর দিয়ে মাটিতে এসে পড়েছে জোছনার ছোপ ছোপ স্নিগ্ধ আলো।

বিশ্রামালয়ে তত্ত্বাবধায়ক, অজগর পর্যবেক্ষক দল ও প্রহরীরা ঘুমের মধ্যে যে যার স্বপ্নে বিভোর। হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেছে নগরপ্রধানের। সারা সপ্তাহের কাজের ক্লামিত্ম যেন লেগে আছে তার শরীরে। মাঝে মাঝেই তার গা ছমছম করে কেঁপে উঠছে। জানালার পর্দা সরালেন নগরপ্রধান। বাইরে জোছনার আলোয় তার চোখ জুড়িয়ে গেল। ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে মাথায় নানা বিষয় এসে জট পাকিয়ে দিচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্পের ফাইলগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কখনো মুচকি হাসছেন আবার কখনো বিষাদে ডুবে যাচ্ছেন। একটা অস্থিরতা তাকে তাড়া করে ফিরছে।

বিশ্রামালয়ের গুপ্ত দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন নগরপ্রধান। গভীর রাতের ফিনফিনে বাতাস তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। নানা প্রজাতির দুর্লভ গাছের বাগানের মধ্য দিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন। অনেকদিন পর নিজেকে এমন স্বাধীন স্বাধীন লাগছে তার। এমন সুন্দর মুহূর্তে বিশ্রামালয়ের কাউকেই তিনি সঙ্গী করলেন না। কারো ঘুম ভাঙাতে চাইলেন না। সামান্য এগিয়ে একটু থামলেন। এদিক-ওদিক তাকালেন। তারপর আবার হাঁটতে লাগলেন। একা।

নগরপ্রধান হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ালেন লেকের ওপারে সুউচ্চ টাওয়ারের কাছে। পাশেই জোছনা পোহাচ্ছে কয়েকটি বিরাট বিরাট শিরীষগাছ। তিনি গাছের মাথার দিকে তাকালেন। পেছনের ঝোপ থেকে সড়সড় একটা শব্দ তার কানে এলো। সেদিকে তিনি খেয়াল করলেন না। জোছনার এমন মধুময় রূপের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে ভাবছেন তার প্রিয় অজগরটির কথা। যখন তিনি খামারের হরিণ তুলে দিতেন তার মুখের সামনে তখন অজগরটা খুশিতে তাকে পেঁচিয়ে ধরত। তিনি তার দেহে হাত বুলিয়ে দিতেন। সেইরকম অদ্ভুত এক অনুভূতি এই জোছনার ভেতর খেলা করছে তার মনের মধ্যে। শ্বাসবন্ধ মোহময় জোছনার ভেতর কেউ যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সুউচ্চ টাওয়ারের ভেতরে।

পরদিন সকালে বিশ্রামালয়ে একে একে এসে জড়ো হয়েছেন পারিষদবর্গ। তাদের হাতে হরিণের চামড়ায় মোড়ানো ডকেট ফাইলগুলো চকচক করছে। বিশাল হলরুমে বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন তারা। এমন মুহূর্তে হাসিমাখা মুখ নিয়ে কক্ষ হাজির হলেন বিশ্রামালয়ের তত্ত্বাবধায়ক। সবার উদ্দেশে জানালেন, ‘অজগরটি ফিরে এসেছে। কিছুক্ষণ আগে তাকে ধরে খাঁচায় রাখা হয়েছে। মনে হচ্ছে নগরভ্রমণে সে প্রচুর খাবার খেয়েছে, পেটটাও ফুলিয়ে এনেছে বেশ।’ পারিষদবর্গ খবরটা শুনে বেশ উৎফুল্ল। তাদের দেহ-মন চনমন করে উঠল। নগরপ্রধানকে এমন খুশির সংবাদ জানাতে বেশ উদগ্রীব তারা। কিন্তু কখন ভাঙবে নগরপ্রধানের ঘুম? বিশ্রামালয়ের কারুকার্যময় দরজা খোলার অপেক্ষা করতে করতে বিকেল গড়িয়ে এলো। নগরপ্রধানের ঘুম ভাঙল না।