দেবী বিসর্জন

রামপুর জমিদারবাড়ি।

সেকেলে হলেও এর গঠনশৈলী মজবুত হওয়ায় আজও টিকে আছে বেশ ভালোভাবেই। বড় পুকুর আর পাড়ের বহু পুরনো গাছপালায় জায়গাটাতে যেন অন্য এক জগত তৈরি করেছে। এ বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমে বিষ্ণু ঠাকুরের একখানা দোচালা মাটির ঘর, বহু কষ্টে শেকড় আঁকড়ে পড়ে রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা যেন নিতান্তই দায়ে পড়ে। নড়বড়ে খুঁটি আর আধপচা শন বাড়িটির দুর্দশাকে প্রকট করলেও, অর্থাভাবে সেদিকে আর তাকানো হয়ে ওঠেনি ঠাকুরমশাইয়ের। এদিকে মেয়েটাও নয় বছরে পা দিতে চলেছে। তারও বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসছে। তাই মধ্যবয়স্ক সুশ্রী কপালে অজান্তেই কিছু ভাঁজ পড়েছে। সেদিকেও নজর দেয়া হয়নি তার। সেই সকাল থেকে বিন্দি ব্যস্ত, ভারি ব্যস্ত। বিষ্ণু চাট্যুজ্যে আর অমলা দেবীর একমাত্র কন্যা সে। জন্মের সময় মায়ের মৃত্যু হওয়ায় বাবাই তার সব। ঘরের সব কাজ সে ছোট থেকেই করতে শিখেছে। তার কাজ দেখে চাট্যুজ্জে মশাই ভাবেন, ”অমলা, তুমি আমার বিন্দিমায়ের মাঝেই বিরাজ কচ্চো তা আমি বুঝি। তোমার মতোই লক্কিমন্ত হয়েচে আমার মাটা।” জমিদারবাড়ির আশপাশের বৈচিফল, বেতফল, বড় পুকুরের পানিফল সবই যেন অলিখিত দলিলে বিন্দির দখলে। সেই নিয়েই সে মহাব্যস্ত। কোন ভোরে সে কাজ সেরে চলে আসে তার ফলসংগ্রহে। কটা বৈচি আর একমুঠো বেতফল তুলে নিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে বড় পুকুরঘাটে। এসবের যেন একচ্ছত্র অধিপতি সে।

 

আশেপাশে যে দুচার ঘরে ছেলেমেয়ে আছে, তাদের এ সীমানায় ঢোকা বারণ। সবাই বলে তেনারা এখানে সর্বক্ষণ বাস করেন। তাদেরকে বিরক্ত করলে সংসারে অনর্থ ঘটবে।

তাই তারা পা বাড়ায় না এদিকে।

পূজোটা বেশ ধুমধাম করে হয় রামপুরে। বিষ্ণু ঠাকুরই পূজা করেন। তার পূর্বপুরুষরা বংশানুক্রমে জমিদারবাড়ির প্রধান পুরুত ছিলেন বটে। কিন্তু এখন জমিদারির সঙ্গে সঙ্গে সেসবও অতীত। এবারের পুজোর শেষেই মেয়েটার বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে ঠাকুরের। চোখ বোজার আগে মেয়েটার একটা গতি করে যেতে চান তিনি।

অষ্টমীর দিন আজ। সন্ধিপুজোর বিশেষ আয়োজন। দেবীপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে এ পূজা করা হয়। দুই তিথির সন্ধিক্ষণে বলেই এ পূজাকে সন্ধিপূজাও বলা হয়। প্রতিবছর অঞ্জলি দেবার জন্য শিউলি ফুল এনে দেয়ার বায়না ধরে বিন্দি, তবে এবার আর তা করেনি। সে দেখেছে, জমিদারবাড়ির পিছন দিকের পাচিলের ওপাশে বেশ বড় একখানা গাছ আছে। ফুল ঝরে মাটি একেবারে ঢেকে থাকে। সে নিজেই সেখান থেকে ফুল কুড়িয়ে আনবে। শাড়িখানা ভালো করে কোমরে পেঁচিয়ে দেয়ালের ফাটল থেকে বেরনো পাকুড় গাছের শেকড়খানা যেই না দুহাতে ধরেছে অমনি শুনতে পেলো, ”মা বিন্দি। কোতায় গেলি আমার মা?”। “বাবা পিরে এয়েচে।” এটা বুঝেই সে দেয় ছুট ঘরের দিকে। তার সাধের শিউলি সেই মাটিতেই ফের হুটোপুটি খেলো।

“কিরে মা কোতায় ছিলি এতোকন?”

_” একটু ওদিকপানে গেচিলুম বাবা। কিচু লাগবে বাবা? এনে দিতে হবে?”

_” না রে মা। তোকে দেকতে পেলুমনে তাই ডাকলুম।”

_”বাবা পূজো কত্তে যাবেনে?”

_” যাব মা যাব। চল তুইও আমার সাতেই চল। একবারে অঞ্জলি দে আসবি।”

_”চলো বাবা।”

,অঞ্জলিশেষে ফেরার পথে পথ আগলে দাঁড়ালো কেতু ঘটক। ছুঁচলো ডগার ছাতাখানা বগলে চেপে খয়েরে লাল করা দাঁতে বিগলিত হাসল।

_ পেন্নাম হে ঠাকুরমশায়।

_পেন্নাম।

_ তে কেমন আচেন বলুন, বহুদিন হলো দেকা হয়নে।

_এই তো ঠাকুর যেমন রেকেচেন। তা তোমার কি খবর কেতু?

_আমি তো বালোই আচি। ঠাকুর ঠাকুর করে আপনি যদি চান তো আরো একটু বেশি বালো তাকতে পারি।

_ঠিক বুজলেম নে। একটু খোলাসা করো তো বাপু।

টুপ করে একমুখ পানের পিক ফেলে স্বভাবসুলভ বিগলিত হাসি হেসে কেতু বললে –

_  হাতে এককানা জম্পেশ পাত্তর এয়েচে ঠাকুরমশায়। যেমন তার রূপ তেমন তার টাকা-পয়সা। একেবারে সোনার টুকরো যাকে বলে।

_ তা নাম কি তার? বয়স কত? আর বাড়ি বা কোতায়?

_ আহ ঠাকুরমশায়, পুরুষমানুষের আবার বয়ে়স দিয়ে কি হবে। নাম তার হরিশ মুকুজ্জ্যে। পাশের গ্রামের নলেন মুকুজ্জ্যের চেলে।

_সে-কি! তার তো গেলো মাসে বৌ মরেচে। আর বয়েস তো তিরিশের কম হবেনে। আমার যে একরত্তি মে। একমাত্তর মে-টাকে দোজবরে বে দেবো?

_ঠাকুরমশায় কি যে বলেন। দোজাবর আবার কি? বয়েসই বা এমন কি বেশি। সোনার আংটি আবার সোজা আর বাঁকা। গঞ্জে তার কাঠ চেয়ারের ব্যবসা আচে। বিঘত জমিজমা। এ পাত্তর হাতচারা করবেননে ঠাকুরমশায়। মে আপনার রাজরানী হয়ে তাকবে।

_ আমায় একটু বাবতে দাও কেতু। তোমায় পরে জানাবো। ঠিক আচে ঠাকুরমশায় আপনি ভাবুন। তবে দেকবেন ভাবতে-ভাবতে যেন আবার পাত্তর না হাতচারা হয়ে যায়। আসি তাহলে। পেন্নাম।

_পেন্নাম।

ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে বাড়ীর পথ ধরলেন বিষ্ণু চাটুজ্জ্যে।

 

সকালে স্নান সেরে সূর্যপ্রণাম করলেন বিষ্ণুমশাই। আজ বিজয়া দশমী। মায়ের সামনে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। আজ আর ঘরের দিকে খেয়াল করার সময় হলো না তার। বললেন, মা বিন্দি, তাড়াতাড়ি মন্দিরে চলে আসিস মা।

ঠিক আচে বাবা।

নিজের কাজ সেরে স্নান করে নিল বিন্দি। মায়ের একখানা লালপেড়ে গরদ বেশ করে জড়িয়ে পরলো। দুপায়ে মোটা করে আলতা রাঙিয়ে নোলক দুলিয়ে বেড়িয়ে পড়লো ঘর থেকে। পথে নামতেই মনে পড়ে গেল শিউলি ফুল দিয়ে অঞ্জলী দেবার কথা।

_একোনো বেশ সময় আচে। ফুলগুলো নেই (নিয়েই) আসি।

পাঁচিলে গজানো পাকুড় গাছের ডাল বেয়ে তরতর করে উঠে গেল পাঁচিলের ওপরে। তারপর একলাফে মাটিতে। মাটিতে নেমেই চোখে পড়লো রাশি রাশি শিউলি ফুল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে শাড়ির কোচর ভরে কুড়াতে শুরু করলো। নিজের আগমনী বার্তা যেন এই ফুলের সুবাসেই পাঠান মা। কি তার মাতাল করা ঘ্রাণ! প্রাণ ভরে যায়। কোচর ভরে উঠতেই বিন্দির মনে পরে যায় সময়ের কথা।

_ইস বড্ড দেরি করে ফেললুম। এখনই যেতে হবে।

পাঁচিলের ওপরে দ্রুত ওঠার জন্য দেয়ালের পাশে উঁচু করে রাখা পুরনো ইটের স্তুপের দিকে পা বাড়ায় বিন্দি। প্রথম ইটে পা রাখতেই একটা তীব্র যন্ত্রণা। আঁচল ঢেলে পরে সব ফুল। দুহাতে ডান পা চেপে ধরে লুটিয়ে পরে সে। দুচোখ তার অন্ধকার হয়ে আসে। চিৎকার করে বাবা বলে ডাকে। চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। দূরে কোথাও একটা কাক বলে, কা…. কা।।

ঠাকুরমশায় একবার এদিকওদিক তাকান।

_নাহ মেয়েটাকে চোখে পড়চেনে।

তাকে পূজো করতে হয়। উচ্চ উলুধ্বনি আর শাঁখের আওয়াজে চারপাশটা মাতোয়ারা হয়ে উঠলো। চাটুজ্জ্যে  মশাইয়ের কন্ঠে সুনিপুণ কারুকার্যে উচ্চারিত হতে থাকলো,

” ঔঁজয়তিমঙ্গলা……..”

ধীরে ধীরে চারপাশ ধোঁয়ায় আধার হয়ে এলো ঠিক বিন্দির দৃষ্টির মত। তার বড় জলতেষ্টা পাচ্ছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ওঠার ক্ষমতা তার হলো না। মায়ের কথা বড্ড মনে পড়চে। মুখটা আঁধার। গলার ভেতরটায় কেমন তেতো তেতো ঠেকছে। উঠে আসতে চাইছে সবটা।

_চারপাশের হাওয়া কি সব শুষে নিলেন পবন দেব?

শ্বাস টানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার।

সব কেমন যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে।

আরতিশেষে ধ্বনি তহচ্ছে, ” যাদেবিসর্বভূতেসু…… নমনমহ!”

 

পুষ্পবৃষ্টি শুরু হলো দেবীর বেদিতে। ওদিকে বিন্দির শ্বাস উঠেছে। মুখ ভরে গেছে ফেনায়। বিষহরী তাকে সৌভাগ্যময় মৃত্যু দিচ্ছেন। সাজ সাজ রবে চলছে এই দেবী বিসর্জনের প্রস্তুতি।

পুষ্পাকীর্ণ পায়ে ধীরে ধীরে বিসর্জন চলছে বিষ্ণু চাটুজ্জ্যের একমাত্র গৃহদেবীর।