দ্বৈত প্রাপ্তির স্মারক

গওহর গালিব

লোকপুরাণ জনসমাজ ও কথাশিল্প

বিশ্বজিৎ ঘোষ

নান্দনিক
ঢাকা, ২০১২

২৮০ টাকা

বাংলা কথাসাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনা, মূল্যায়ন পুনর্মূল্যায়ন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। দুই বাংলা মিলিয়ে যে ক’জন পরিশ্রমী গবেষক তাঁদের শ্রমলব্ধ আয়াস দ্বারা বাংলা কথাসাহিত্যকে, কথাসাহিত্যের নির্যাসকে আমাদের সামনে তুলে ধরেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ড. ঘোষ মূলত প্রাবন্ধিক-গবেষক, তিনি সাহিত্য নিয়ে লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। বাংলা কথাসাহিত্য বিশেষত উপন্যাস ও ছোটগল্পবিষয়ক আলোচনা-সমালোচনা অদ্যাপি যে খুব একটা কম হয়েছে, তেমন নয়। কিন্তু দেখা জিনিসকে নতুন করে দেখানো, নতুন করে চেনানোর ক্ষেত্রে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ গবেষণাকে নিয়ে গিয়েছেন শিল্পের পর্যায়ে। লোকপুরাণ জনসমাজ ও কথাশিল্প গ্রন্থটিও বিশ্বজিৎ ঘোষের সেই পরিশ্রমেরই এক নব্যফসল। উপর্যুক্ত গ্রন্থটিতে কথাসাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমালোচক বিশ্বজিৎ ঘোষের স্বকীয়তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে পুস্তকটির ফ্ল্যাপেই : ‘বাংলা কথাসাহিত্য নিয়ে লেখা পনেরোটি প্রবন্ধের সংকলন ‘লোকপুরাণ জনসমাজ ও কথাশিল্প’। রবীন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ করে হুমায়ূন আহমেদ – বাংলা সাহিত্যের ১৩ জন শ্রেষ্ঠ কথাকোবিদের বিভিন্ন রচনার মূল্যায়ন নিয়ে বক্ষ্যমাণ গ্রন্থ। সাহিত্যে নিম্নবর্গ, লোকপুরাণ ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক নতুন ভাবনা যেমন এখানে পাওয়া যাবে, তেমনি পাওয়া যাবে শ্রেণিসংগ্রাম চেতনা, প্রান্তজনের উত্থান, মুক্তিযুদ্ধের শিল্পায়ন এবং ইতিহাস ও সাহিত্যের সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়া বিষয়ক আলোচনা।’
প্রকৃত অর্থেই অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ আলোচ্য গ্রন্থে আমাদের পঠিত অনেক সাহিত্যেরই নতুন ব্যবচ্ছেদ দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। গ্রন্থটির নাম লোকপুরাণ জনসমাজ ও কথাশিল্প হলেও এখানে যে ১৫টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে বিষয়ভিত্তিক বিভাজনে এর পরিধি অনেক বিস্তৃত। আমাদের সুবিধার্থে গ্রন্থটির প্রবন্ধগুলোকে আমরা নিম্নোক্ত শ্রেণিতে বিভক্ত করব।
এক. লোকপুরাণকে নিয়ে যে সকল প্রবন্ধে ড. ঘোষ বেশি মনোযোগী হয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো – ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা : লোকপুরাণ ও লোকসংস্কৃতি প্রসঙ্গ’, ‘সেলিনা হোসেনের ত্রয়ী উপন্যাস : প্রসঙ্গ শ্রেণিচেতনা’।
দুই. জনসমাজ বা শ্রেণিশোষণের কথা যেসব প্রবন্ধে বিশেষমাত্রায় উঠে এসেছে সেগুলো হলো – ‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নিম্নবর্গ’, ‘নজরুলের কথাসাহিত্য : প্রান্তজন কথা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম : জল ও জীবনের বিকল্প নন্দন’, ‘পদ্মার পলিদ্বীপ : পাঠোত্তর প্রতিবেদন’।
তিন. ইতিহাসকে সাহিত্যে কীভাবে প্রতিপাদ্য করা হয়েছে সে-সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন – ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত : ইতিহাসের নান্দনিক প্রতিবেদন’, ‘বিযুক্ত জীবন আর বিপন্ন বোনের আখ্যান’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প : ইতিহাস ও শিল্পের যুগলবন্দি’ প্রবন্ধে।
চার. কথাশিল্পের হাজারা নান্দনিক ডিসর্কোস নিয়ে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বাক্যব্যয় করেছেন – ‘রবীন্দ্র-ছোটগল্পেরনাট্য-চারিত্র্য’, ‘দক্ষিণারঞ্জন ও তাঁর ঠাকুরমা’র ঝুলি’, ‘পরশুরাম ও তাঁর গড্ডলিকা’, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিশোর উপন্যাস’ প্রবন্ধে।
পাঁচ. কথাসাহিত্যে নারীর দুর্দশা নিয়ে আমাদের বিবেক ও চেতনাকে অধ্যাপক ঘোষ নতুন করে নাড়া দিয়েছেন – ‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নিম্নবর্গ’, ‘মানিকের বউ : সামাজিক অভিমুখ ও বিপ্রতীপ মনস্তত্ত্ব’, ‘কাশবনের কন্যা : নারীর মুখ’ প্রবন্ধে। তবে সমাজতাত্ত্বিক অভিনিবেশ এবং রাজনৈতিক ব্যাখ্যা প্রায় প্রতিটি প্রবন্ধেই বিশেষ মাত্রা পেয়েছে।
হাঁসুলি বাঁকের উপকথা নিয়ে ইতিপূর্বে অসংখ্য সমালোচনা প্রকাশিত হলেও অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা : লোকপুরাণ ও লোকসংস্কৃতি প্রসঙ্গ’ শীর্ষক প্রবন্ধটির মনোযোগের বিষয়টি আনকোরা ও নতুন। স্মর্তব্য যে, সাহিত্যে লোকপুরাণের ব্যবহারের ইতিহাস অতিপ্রাচীন। হাঁসুলি বাঁকের উপকথায় ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর পুরাণকে ব্যবহার করেছেন অতি সতর্কতার সঙ্গে। কিন্তু ড. ঘোষ তাঁর এ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, ‘… আর কেবল মিথ বা পুরাণ ব্যবহারই নয়, এ-উপন্যাসে তারাশঙ্কর বৃহত্তর কাহার সমাজের জন্য নির্মাণ করেছেন নতুন লোকপুরাণও।’ (পৃ ৭২) অর্থাৎ মিথাশ্রিত সমাজ কীভাবে ভাঙনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ভুবনে চলে আসে সমালোচক আলোচ্য প্রবন্ধে তা-ই দেখাতে সচেষ্ট থেকেছেন। প্রবন্ধের মূল বক্তব্যে প্রবেশের পূর্বে সমালোচক পুরাণ কী, কাকে বলে, এর সংজ্ঞার্থ কী – এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন – যা অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য হবে ‘এক ভিন্ন আস্বাদ। St. Augustine, Johann Golfried Harder, নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কি, Tylor, Ruthven, Eliot, Joseph Campbell প্রমুখ মনীষীর পুরাণ-সম্পর্কিত ভাবনা, ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞার্থ অধ্যাপক ঘোষ অত্যন্ত সহজভাবে বোধগম্য পন্থায় আলোচ্য প্রবন্ধে উপস্থাপন করেছেন।
হাঁসুলি বাঁকের উপকথা উপন্যাসটিকে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বাখতিন-কথিত ‘carnival folk culture’-এর অনুসরণে বলেছেন ‘carnival folk myth’। এ-প্রসঙ্গে তিনি প্রমাণ হিসেবে উপন্যাসটিতে লোকায়ত জীবনে মিথের বিভিন্ন ছোট ছোট অনুষঙ্গ কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাও দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তাই বীরভূম অঞ্চলের কাহার ফুলের লোকসংস্কৃতি, লোকসংগীত, তাদের ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন, পূজা-অর্চনার বিভিন্ন বিষয় বিশ্বজিৎ ঘোষ এ-প্রবন্ধে উপস্থাপন করেছেন, যেগুলোর সংশ্লিষ্টতা কোনো না কোনোভাবে পুরাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ-প্রবন্ধে অধ্যাপক ঘোষ একজন নৃবিজ্ঞানীর মতোই ছিলেন তৎপর ও অনুসন্ধিৎসু।
’৪৭-পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যের বিস্তৃত ভূমিপটে সেলিনা হোসেন এক অনন্য নাম। বিরল শ্রেণির যেসকল সাহিত্যিক তাঁদের নামের সঙ্গে সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট কাল ও যুগকে ধারণ করেন, সেলিনা হোসেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এ কারণে আলোচ্যগ্রন্থে সেলিনা হোসেনকে নিয়ে সমালোচকের রয়েছে ভিন্ন ঘরানার অভিনিবেশ। মিথ, পুরাণ কিংবা প্রাচীন লোকজীবন কীভাবে শ্রেণিসংগ্রামের প্রতিপাদ্য হিসেবে সাহিত্যে স্থান পেতে পারে, তার সার্থক প্রতিবেদন বিশ্বজিৎ ঘোষ উপস্থাপন করেছেন তাঁর ‘সেলিনা হোসেনের ত্রয়ী-উপন্যাস : প্রসঙ্গ শ্রেণিচেতনা’ শীর্ষক নিবন্ধে। এখানে সেলিনা হোসেনের নীল ময়ূরের যৌবন (১৯৯০), চাঁদবেনে (১৯৮৪) ও কালকেতু ও ফুল্লরা (১৯৯২) – এই তিনটি উপন্যাস নিয়ে সমালোচক মনোযোগী ছিলেন। এখানে তিনটি উপন্যাসেরই পটভূমি প্রাচীন ও মধ্যযুগের সবিশেষ উল্লেখযোগ্য পরিপ্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ অবলম্বনে সেলিনা হোসেন রচনা করেছেন নীল ময়ূরের যৌবন, মনসামঙ্গল কাব্য ভেঙে নতুন করে গড়েছেন চাঁদবেনে এবং চন্ডীমঙ্গলের ছায়া অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন কালকেতু ও ফুল্লরা উপন্যাসটি। কী কারণে এ-তিনটি উপন্যাস পাঠক সমাজকে গভীরভাবে আলোড়িত করবে সে সম্পর্কে ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ নিজেই বলেছেন –
…মূল রচনা ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও, সেলিনা হোসেনের হাতে তা এক অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত হয়েছে। তিনটি উপন্যাসের মাঝেই শোনা যায় শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার এক অভিন্ন সুর। এ সূত্রেই উপন্যাস তিনটিকে আমরা ত্রয়ী উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছি, দেখতে চেয়েছি ওই ত্রয়ী উপন্যাসে সমকালীন শ্রেণিসংগ্রাম কীভাবে ও কোন মাত্রায় শিল্পরূপ লাভ করেছে। (পৃ ১৮৬)
উপর্যুক্ত সূত্রকে সামনে রেখেই ড. ঘোষ ‘নীলময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন – চর্যাপদের সমকালে সমাজ ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব কীভাবে বাঙালি মানসকে করে তুলেছিল অস্থির, জঙ্গল ও সংকটসংকুল। তিনি দেখিয়েছেন লোককাহিনি মনসামঙ্গলের সাহিত্যিক ঐতিহ্য এবং সমকালীন জীবন-অভিজ্ঞতা – এ দুয়ের পরস্পর অন্তর্বয়নে রচিত হয়েছে চাঁদবেনে উপন্যাসটি, যেখানে চাঁদবেনে মনসামঙ্গলের চাঁদ সওদাগরের নতুন সংস্করণ। অন্যদিকে ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত কাব্যধারা চন্ডীমঙ্গল অবলম্বনে রচিত হয়েছে কালকেতু ও ফুল্লরা উপন্যাস, যেখানে আছে শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্বের কথা, আছে শ্রেণিসংঘর্ষের কথা।
‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নিম্নবর্গ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষাপটে কীভাবে রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু গল্পে নিম্নবর্গের জীবন, দলিত মানুষের সংগ্রাম এবং অন্ত্যজ জীবনের পরাভব নির্মিত হয়েছে সে-সম্পর্কে বিশ্বজিৎ ঘোষ বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তাই এ-প্রবন্ধপাঠের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক বাংলার একটি রাজনৈতিক ডিসকোর্স সচেতন পাঠকের কাছে অলক্ষ্যেই উপস্থিত হয়। পাশাপাশি সত্যিকার অর্থে নিম্নবর্গ বা প্রান্তিক শ্রেণি কাদের বলা হয়, প্রান্তিকদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দরদ কতটুকু ছিল, সে-সময়ে জমিদারি প্রথার শোষণ ও কুপ্রভাব কী রূপ ছিল সে-সম্পর্কে সমালোচক বিশদ আলোচনা করেছেন।
‘নজরুলের কথাসাহিত্য : প্রান্তজনকথা’ প্রবন্ধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় নজরুলের অবস্থান, প্রান্তজন নিয়ে নজরুলের বক্তব্য-সংগ্রাম-কারাভোগ, তাদের প্রতি নজরুলের সমর্থন ইত্যাদি বিষয় নতুনভাবে আলোচিত হয়েছে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব ছিল ‘তলেরও তল’ (bottom of the bottom) থেকে, ফলে গরিব-গুর্বোদের প্রতি নজরুল ছিলেন কতটা সংবেদনশীল এবং এ-সংবেদনা তাঁর কবিতা ও কথাসাহিত্যে কীভাবে উঠে এসেছে এ-প্রবন্ধে বিশ্বজিৎ ঘোষ সে-সম্পর্কেই আলোচনা করেছেন। নজরুলকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার এক অভিনব প্রয়াস এ-প্রবন্ধে লক্ষ করা যায়।
নদী-তীরবর্তী মানুষের সংস্কৃতি-সংগ্রাম, শোষণ, দ্রোহ এবং তাদের পরিণতি – এসব বিষয় নিয়ে ড. ঘোষ তাঁর পঠন-পাঠন, চেনাজানা ও উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম : জল ও জীবনের বিকল্প নন্দন’ এবং ‘পদ্মার পলিদ্বীপ : পাঠোত্তর প্রতিবেদন’ শীর্ষক প্রবন্ধদ্বয়ে। আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে local colour and habitation এ দুটি উপন্যাসে কতটা সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে সে-সম্পর্কেও তিনি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ-কারণে তিতাস-তীরবর্তী মালো সমাজের স্বাতন্ত্র্য-চারিত্র্য, প্রাকৃত জীবন ও কৌমসংস্কৃতির এক বিস্তৃত প্রতিবেদন লেখক উপস্থাপন করেছেন। পাশাপাশি পদ্মা-তীরবর্তী পলিদ্বীপের মানুষগুলোর শোষণের চিত্র, অর্থনৈতিক বাস্তবতা, আত্মসচেতনতার অভাব, বিপ্লবী মানসতা, ব্রিটিশ শোষণ এবং অসহায় নারীদের বাস্তবতা সমালোচক গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে পদ্মার তীরের carnival folk culture হিসেবে পদ্মার লোকসংস্কৃতি, তাদের গান, লোকছড়া, প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার, রূপকথা ও উপকথা, লোকবিশ্বাস ও লোকক্রীড়া, আঞ্চলিক ভাষা ইত্যাদির ব্যবহার কীভাবে উপন্যাস দুটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে সে-সম্পর্কে গবেষক আলোচনা করেছেন। এ-প্রবন্ধদ্বয় পাঠে ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও আবু ইসহাককে পাঠকগণ নতুনভাবে দেখার ও জানার সুযোগ পেতে পারেন।
বিখ্যাত লেখকদের কথাশিল্পের বিভিন্ন আঙ্গিক ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ আলোচ্যগ্রন্থে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ‘রবীন্দ্র-ছোটগল্পের নাট্য-চারিত্র্য’ শীর্ষক রচনায় গবেষক দেখিয়েছেন, রবীন্দ্র-ছোটগল্পে দৃশ্যগুণ, জীবনরহস্যের পরিচয়, সংঘাত, চিত্র ও কাব্যধর্ম, সংলাপ, ঘটনার বৈপরীত্য ও নানামাত্রিক ফ্রেম, সেট ডিজাইন ইত্যাদি বিষয়। ‘পরশুরাম ও তাঁর গড্ডলিকা’ প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যে রাজশেখর বসুর স্বাতন্ত্র্য, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের যুগপৎ ব্যবহারে পরশুরামের যুগকালস্পর্শী সাফল্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অধ্যাপক ঘোষ আলোচনা করেছেন।
‘দক্ষিণারঞ্জন ও ঠাকুরমা’র ঝুলি’ শীর্ষক রচনায় নতুন করে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার এবং তাঁর কৃতিত্ব সম্পর্কে সাধারণ পাঠক আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। এ প্রসঙ্গে ড. ঘোষের মন্তব্য ‘দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারই লোকমুখে প্রচলিত রূপকথা লিপিবদ্ধ করে বাঙালি পাঠকের কাছে প্রথম উপস্থিত করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির উজ্জ্বল পথিকৃৎ। (পৃ ৪৭) এ কারণে ড. ঘোষ একধরনের দায়বদ্ধতা থেকে দক্ষিণারঞ্জনের পারিবারিক ইতিহাস, তাঁর শৈশব ও কৈশোর, তাঁর সাহিত্যিকীর্তি, লোককথা সংগ্রহে তাঁর সাধনা ও কৃতিত্ব ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। উপন্যাস যেহেতু জীবনের সমগ্রতাস্পর্শী শিল্প-আঙ্গিক সে-কারণে সমাজজীবনের অন্তর-বাহিরের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানের রূপায়ণই তার স্বধর্ম। সত্যেন যেন স্বাধীনতা ও সংগ্রামের বন্ধুর পথে ছিলেন রাজপথের সৈনিক। তাই তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম নিয়ে লেখা ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত : ইতিহাসের নান্দনিক প্রতিবেদন’ শীর্ষক আলোচনায় ড. ঘোষ দেখিয়েছেন ইতিহাসবোধ, দেশকালজ্ঞান এবং শ্রেণিসংগ্রামে চেতনা – এই ত্রিমাত্রিক প্রবণতাই সত্যেন সেনের ঔপনিবেশিক প্রতিভার মৌল শক্তি। অত্যাচারী পালরাজাদের বিরুদ্ধে শ্রেণিচ্যুত সামন্তশাসক দিবেবাকের মাধ্যমেই ঔপন্যাসিক নির্মাণ করতে চেয়েছেন তাঁর মানস-আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ। এ-উপলক্ষে সত্যেন সেনের রাজনৈতিক আদর্শ, তাঁর ইতিহাসজ্ঞান, লেখকের উপনিবেশবাদবিরোধী চেতনা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ড. ঘোষ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন আলোচ্য প্রবন্ধে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ যাবৎ যত উপন্যাস রচিত হয়েছে তার মধ্যে সর্ববৃহৎ উপন্যাস হলো জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প। উপন্যাসটির স্বকীয়তা সম্পর্কে ‘জোছনা ও জননীর গল্প : ইতিহাস ও শিল্পের যুগলবন্দি’ শীর্ষক প্রবন্ধে ড. ঘোষ মন্তব্য করেছেন, ‘জোছনা ও জননীর গল্প হুমায়ূন আহমদের দীর্ঘ পরিকল্পনা, অনেক পরিশ্রম, বিপুল পাঠ ও অনেকান্ত সাধনার ফসল।… হুমায়ূন আহমদের কৃতিত্ব এই, তিনি ইতিহাসকে দান করেছেন উপন্যাস-অবয়ব।’ (পৃ ২০২)
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবদীপ্ত চেতনা সম্পর্কে ঔপন্যাসিকের সৃজন প্রেরণা, মন ও মননের গভীর সংবেদনশীলতা, তাঁর প্রত্যাশা, অভিজ্ঞতা, ঋণ ও দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সমালোচক বিশ্বজিৎ ঘোষ আলোচ্য প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান, তাদের বাস্তবতা, মনস্তত্ত্ব, কষ্ট, হতাশা কথাসাহিত্যে কীভাবে দেখানো হয়েছে এ-সম্পর্কিত ড. বিশ্বজিৎ ঘোষের দুটি বিখ্যাত প্রবন্ধ হলো ‘মানিকের বউ : সামাজিক অভিমুখ ও বিপ্রতীপ মনস্তত্ত্ব’ এবং ‘কাশবনের কন্যা : নারীর মুখ।’ নারীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধি কতটা প্রশংসনীয়, সে-সম্পর্কেই সমালোচক আলোচ্য প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন। ড. ঘোষ দেখিয়েছেন, মানিক তাঁর গল্পে নারী মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণের সূত্রেই উন্মোচন করেছেন সমাজ-বাস্তবতার বহুমাত্রিক ছবি। অন্যদিকে নদীবিধৌত দক্ষিণ বাংলার গ্রামজীবনের প্রান্তিক নারীদের মন ও জীবন বাস্তবতা নিয়ে শামসুদ্দীন আবুল কালাম যে-কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তাকেই বিশ্লেষণ করতে ড. ঘোষ সচেষ্ট থেকেছেন ‘কাশবনের কন্যা : নারীর মুখ’ শীর্ষক প্রবন্ধে।
পাঠক হিসেবে যে-কোনো বই পাঠের আনন্দ যে-কারো কাছেই একটা প্রাপ্তির বিষয়। তবে কোনো বই যদি আনন্দের পাশাপাশি কোনো তত্ত্ব, তথ্য, ও বিশ্লেষণকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে। তবে তখন সেটি পাঠকের জন্য হয়ে ওঠে বাড়তি পাওয়া। সেক্ষেত্রে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের লোকপুরাণ জনসমাজ ও কথাশিল্প গ্রন্থটি দ্বৈত প্রাপ্তির স্মারক। গ্রন্থটি একদিকে আনন্দের উৎস এই অর্থে – ‘এখানে আলোচ্য লেখকগণ বাংলা সাহিত্যে তুমুল জনপ্রিয়, যাঁদের লেখা আমরা পড়েছি অথচ নতুন করে ভাবিনি।’ ফলে তাঁদের সম্পর্কে জানা ও সেইসঙ্গে সাহিত্যের বিভিন্ন ইজম ও অর্থ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া আমাদের জন্য হবে নতুন প্রাপ্তির। 