নতুন বীক্ষা নতুন সংজ্ঞা : নতুন কবিতার সন্ধান

কবিতার কথা শীর্ষক গ্রন্থের ‘সত্য, বিশ্বাস ও কবিতা’ নাম্নী প্রবন্ধে কবি জীবনানন্দ দাশের বলা কয়েকটি কথা দিয়ে শুরু করছি – ‘… গত তিন চার হাজার বছর মানুষের সভ্যতায় দর্শন কাজ করে গেছে, এই বারে বিজ্ঞান কাজ করবে বলে মনে হয়। … তবে দর্শনের চেয়ে গণস্পষ্ট পৃথিবীর দরবারে শুভ সত্যকে বিজ্ঞান বেশি আয়ত্ত করতে পারবে বলে মনে হয়। … কাব্য সৃষ্টির সময় বিজ্ঞান ও দর্শন নিজেদের মোটামুটি সত্যে আছে কবির হৃদয়ে, সেখান থেকে কাব্যের সত্যে একটা তারণ স্পর্শের ফলে ক্রমেই উত্তীর্ণ হচ্ছে। …’

এর ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। শুধু, প্রসঙ্গক্রমে একটি ছোট্ট ঘটনা ছুঁয়ে যাই। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদার উপরিউক্ত প্রথম বাক্যটিকে এক সাক্ষাৎকারে ‘ছেঁদো কথা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই থেকে এই কথার যোগসূত্র খোঁজার উৎসাহ বেড়েছে।

‘কবি’ বলতে আমার মতো ওল্ড স্কুলের পাঠকের কাছে যে-ইমেজ ফুটে ওঠে, তা হলো – কবির ভিশন থাকবে, বিশ্ববীক্ষা থাকবে। অবশ্য সে-ভিশন নেতাদের, বিজ্ঞানীদের, দার্শনিকদের থাকতে হবে – এমন ধারণাও ছিল একদিন। যে-ভিশনকে আধ্যাত্মিক অর্থে ‘দিব্যদৃষ্টি’, অন্যত্র ‘পরিপ্রজ্ঞা’ বলেও অভিহিত করা হয়।

বিশ্ববীক্ষা বলতে আমরা কী বুঝি, খুব গোদাভাবে বললেও এটা দাঁড়ায় যে, বিশ্ববীক্ষা হলো বাস্তবতার মূলগত দিকগুলো, যা আমাদের চিন্তা, জানা, বোঝা ও করার কারণ ও প্রভাব-স্বরূপ একগুচ্ছ বিশ্বাস। এই বিশ্ববীক্ষার উপাদানগুলো হতে পারে – জ্ঞানীয়, যা জ্ঞানের উৎস ও প্রকৃতি সম্পর্কীয় বিশ্বাসগুলো; অধিবিদ্যক, যা বাস্তবতার চূড়ান্ত প্রকৃতি সম্পর্কীয় বিশ্বাসগুলো; সৃষ্টিতাত্ত্বিক, যা মহাবিশ্ব, জীবন এবং মূলত মানুষের সৃষ্টি ও প্রকৃতি সম্পর্কিত বিশ্বাসগুলো; উদ্দেশ্যবাদী, যা মহাবিশ্বের জড় উপাদান ও তার অধিবাসীদের অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কীয় বিশ্বাসগুলো; ধর্মতাত্ত্বিক, যা ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি সম্পর্কীয় বিশ্বাসসমূহ; নৃতাত্ত্বিক, যা সাধারণভাবে মানুষের ও নির্দিষ্টভাবে ব্যক্তির প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কিত বিশ্বাসসমূহ, অর্থাৎ কোনটা ভালো ও কোনটা মন্দ, কোনটা ঠিক ও কোনটা ভুল ইত্যাদি।

যদি আমরা ধরে নিই যে, কবিতা হলো বাস্তবতা ও ভাষা এই দুয়ের সংঘর্ষে ও মিথস্ক্রিয়ায় উৎপন্ন তৃতীয় কিছু, যার নান্দনিক মাত্রা আছে, তাহলে এটা মেনে নিতে হবে যে, বিশ্ববীক্ষা ছাড়া বাস্তবতাকে সম্যক আত্মস্থ করার সম্ভাবনা কম।

এই বিশ্ববীক্ষার প্রশ্নেই কবি জীবনানন্দ দাশ ওই কথাগুলো বলেছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে। প্রসঙ্গত, কবিতার কথা বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ইংরেজি ১৯৫৫ (বাংলা ১৩৬২) সালে। বইটিতে কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আইনস্টাইন, হোয়াইটহেড প্রমুখের উল্লেখ – কেননা, ততদিনে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনেকাংশে প্রকাশিত। কবি জীবনানন্দ দাশের অন্যতম প্রিয় কবি ইয়েটসের A Vision বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৫-এ। আমরা মনে করতে পারি, ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্লাঙ্কের হাত ধরে কোয়ান্টাম তত্ত্বের সূত্রপাত হয়ে গেছে। আর, ওই বইতে New science-এর রেফারেন্স রয়েছে। আমরা জানি, ১৯২৩ সালে ব্রগলির মাধ্যমে তরঙ্গ-কণা দ্বিত্ব-র ধারণা পাওয়া গেলেও ১৯২৭-এ হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের সূত্রে সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়। A Vision-এর দ্বিতীয় সংস্করণে (১৯৩৭) তাই অনিশ্চয়তা তত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়।

তাহলে এ-কথা বলা যায় যে, ইয়েটস ও জীবনানন্দ দুজনেই কোয়ান্টাম বীক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

দুই

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, একসময়ে বিশ্ববীক্ষা ধর্মদর্শনভিত্তিক ছিল। কালক্রমে বৈজ্ঞানিক বিশ্ববীক্ষা অধিকার করল জ্ঞানের জগৎ। সেখানেও ঘটল রূপান্তর, যাকে বলা হলো আদিকল্পের সরণ তথা প্যারাডাইম শিফট। যেমন, ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যা বা নিউটনীয় পদার্থবিদ্যা থেকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এই সৃতিকে যেভাবে চিহ্নিত করতে পারি – নিয়ন্ত্রণবাদী অবস্থান থেকে যদৃচ্ছতায়, নৈর্ব্যক্তিকতা থেকে দ্রষ্টানির্ভর বাস্তবতায়, যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনিশ্চয়তায়। চলতি বিশ্ববীক্ষা অনুযায়ী বিশ্ব হলো আপেক্ষিক, বাস্তবতা হলো তা-ই যার প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম মুহূর্তে সবরকম সম্ভাবনা আছে – যা এখনো জানা যায়নি তা-ও। সময় হলো অরৈখিক আর আলো হলো যুগপৎ কণা ও তরঙ্গ। পরমাণু গঠিত হয় অদৃশ্য শক্তি দিয়ে, স্পর্শযোগ্য বস্তু দিয়ে নয়, আর পরমাণুর কোনো ভৌতিক কাঠামো নেই। দর্শক তার বাস্তবতার স্রষ্টা আর প্রত্যেকের বাস্তবতা আলাদা আলাদা। আগে যেখানে মহাবিশ্বকে এক অতিকায় মেশিনের মতো ভাবা হতো, এখন তা এক মহতী চিন্তার মতো দেখতে লাগে।

খুব সংক্ষেপে আমরা বরং নিউটনীয় বলবিদ্যা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পরিপ্রেক্ষিতগুলো তুলনা করে দেখে নিই।

নিউটনীয় বলবিদ্যা তথা ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক কিছুই পূর্বনির্ধারণযোগ্য। যদি আমরা অংশগুলো সম্পর্কে জানি, তবে অবশ্যই সমগ্র সম্পর্কে জানতে পারি। যদি প্রাথমিক দশা জানা থাকে তবে স্থান-কালের অন্য মুহূর্তের ভৌতিক দশা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। যুক্তিবিজ্ঞান ও গণিত প্রত্যেক কিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারে। আমরা যদি বুঝে থাকি মহাবিশ্বের মৌলিক প্রক্রিয়াগুলো কীভাবে কাজ করে, তবে আমরা বৃহত্তর ঘটনাবলি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। কেউ স্থান-কালের এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে যেতে পারে না মধ্যবর্তী সব ক’টা ঘাট অতিক্রম না করে। বস্তু ও তাদের ওপর ক্রিয়াশীল বলগুলো নিয়েই তৈরি এই জগৎ। বস্তু ক্ষুদ্রতর কণায় বিভাজিত হতে পারে, পরমাণু ও উপ-পারমাণবিক কণার স্তর পর্যন্ত। সব কণা ও বস্তু ওই কণাগুলোর (খুব ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ খ-গাগণিক বস্তুনিচয়) মতো একই ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুসরণ করে। এই আদিকল্পে বাস্তবতা হলো যা আমরা আমাদের পাঁচ সংবেদজ মাধ্যম দ্বারা উপলব্ধি করি বা অবেক্ষণে প্রয়াসী হই। যদি কোনো কিছু আমাদের এই অবেক্ষণের অন্তর্গত না হয়, তবে তার অস্তিত্বই নেই।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পরিপ্রেক্ষিতে, মর্মত, প্রত্যেক কিছুই শক্তি ছাড়া কিছু নয়। একটি পরামাণুর কেন্দ্রস্থ নিউক্লিয়াসের চারদিকে যে ইলেকট্রনগুলো প্রদক্ষিণ করে তারা একই সঙ্গে সম্ভাব্য কণা বা শক্তির তরঙ্গস্তূপ হিসেবে অস্তিমান হতে পারে। নিউক্লিয়াসের চারদিকে প্রদক্ষিণ করার জন্য ইলেকট্রনগুলোর নির্দিষ্ট পথ নেই। পরিবর্তে, একটি নিউক্লিয়াসের চারদিকে, বিভিন্ন কক্ষে ও খোলকে তারা ‘ইলেকট্রন মেঘ’ হিসেবে অস্তিমান। প্রথমবার শুনলে যে কারোর পক্ষেই মেনে নেওয়া কঠিন মনে হতে পারে যে, একটি ইলেকট্রন একই সঙ্গে একাধিক স্থানে থাকতে পারে। প্রত্যেক কিছু বিশুদ্ধ সম্ভাবনাময় বা সম্ভাবনার রূপে অস্তিমান। এই সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তবতায় সংকুচিত করে পর্যবেক্ষণ। আমরা পর্যবেক্ষণ করি, তাই প্রত্যেক কিছু অস্তিমান। একটি ইলেকট্রন একটি শক্তিস্তর (কক্ষ, গোলক) থেকে আর একটি শক্তিস্তরে লাফাতে পারে মাঝখানকার স্থানের মাধ্যম ছাড়াই।

বস্তুত, দুটো ঘাটের মধ্যে কিছুই নেই শূন্যতা ছাড়া, সম্ভাবনার এক ফাঁক ছাড়া। আসলে সে তার শক্তি-দশা পরিবর্তন করে নেয় – মধ্যেকার স্থানে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ধারাবাহিক অগ্রগমন ব্যতিরেকেই। তাহলে, আমরা সবাই শক্তি-সত্তা। সুতরাং, শুধুমাত্র বস্তুর (বিশেষভাবে, কণার) নিয়মই নয়, বরং তরঙ্গের নিয়মও আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমাদের অস্তিত্বের শুধু ভৌতিক আকার ও স্থানের দখলস্বত্বই নেই, বরং আমাদের সবারই আছে নিজস্ব কম্পাঙ্ক, যার সূত্রে আমরা স্পন্দিত হই। আরো এক ধাপ এগিয়ে বলা যায়, শক্তি-অস্তিত্ব হলো

প্রাথমিক অস্তিত্ব, যদিও আমরা তা নিয়মিতভাবে উপলব্ধি নাও করতে পারি। আমরা সবাই মর্মত সম্পর্কিত। আপনি ও আমি যুগপৎ অস্তিমান ও একই শক্তিক্ষেত্রে  স্পন্দিত হই। আমাদের কম্পাঙ্ক ভিন্ন হতে পারে এবং তাই আমাদের অভিজ্ঞতাও ভিন্ন হতে পারে; কিন্তু আমাদের উভয়ের অন্তস্তল (প্রকৃতপক্ষে সকলের) একই। তাহলে, আপনি কণা ও শক্তি উভয়ত অস্তিমান। সুতরাং, কণা ও তরঙ্গের নিয়ম দুই-ই আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আশ্চর্যজনকভাবে অন্তস্তলে কোনো বস্তু নেই, আছে শুধু শক্তি বা বিশুদ্ধ সম্ভাবনা।

তাহলে, বস্তুজগতে মন আর কোনো অনধিকার-প্রবেশকারী নয়, বরং সে-ই বস্তুজগতের স্রষ্টা, কর্তা … (আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, …)। একটি পরমাণু যখন স্থান পরিবর্তন করে সে তড়িৎচুম্বকীয় কম্পাঙ্ক শোষণ করে বা বর্জন করে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, আমাদের আবেগ, অনুভব, প্রজ্ঞা ইত্যাকার বিভিন্ন দশা কিন্তু বিভিন্ন তড়িৎচুম্বকীয় কম্পাঙ্কের ফল। কাজেই মহাবিশ্বের গোপন কথা জানতে হলে এনার্জি তথা শক্তি, ফ্রিকোয়েন্সি তথা কম্পাঙ্ক, ভাইব্রেশন তথা স্পন্দন দিয়েই ভাবতে হবে।

মন যেহেতু কর্তা, একই বাস্তবতায় অধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞান পরিপূরক, তাদের নিজস্বতা বজায় রেখেই। বস্তুর মৌলিক উপাদান কণা, ইলেকট্রন, কোয়ার্ক কেউই স্ব-অস্তিমান নয়। বাস্তবতা হলো অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক। আর তাই, মন বা চেতনাকে কেন্দ্র করেই মন-জড়বস্তু, বিষয়ী-বিষয়, ব্যক্তি-সমষ্টি, স্থান-কাল পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় উঠে আসছে। কোয়ান্টাম প্যারাডাইমকে বৌদ্ধিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করা যায় আবার তার অন্তর্ভুক্তও হওয়া যায়। আমরা কোয়ান্টাম বাস্তবতায় যাপন করতে পারি যখন জীবন এক স্বপ্ন, যেখানে সদ্ (রিয়াল) কিছুই নেই। বৌদ্ধমতে, আত্মপ্রকৃতিশূন্য যে-অভিজ্ঞতা, যেখানে প্রত্যেক কিছু পরস্পর সম্পর্কিত ও পরস্পর নির্ভরশীল – এখানেও তাই। আমরা বাস করি এক অংশগ্রহণমূলক মহাবিশ্বে।

তিন

কোয়ান্টাম বিশ্ববীক্ষা আমাদের মূল আলোচ্য নয়। কবিতা ও তার বীজক্ষেত্র নিয়ে যে-ভাবনা তার একটি পরিচ্ছেদ মাত্র। আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো, আজ বা আগামীর কবিতা কোন বোধির ওপর দাঁড়ানোর কথা, তার রূপরেখা খোঁজা।

শুধু জীবনানন্দ বা ইয়েটস নয়, সমসাময়িক কবিদের মধ্যে অক্তাভিও পাজের মুখে আমরা শুনি, কবিতা হলো জ্ঞানেরই প্রকার। বিজ্ঞান আর কবিতা দুই-ই পরীক্ষামূলক, যেন ল্যাবরেটরিজাত। কবি শব্দ-বাক্য দৈনন্দিন ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করেন, ভাষার ধর্ম লক্ষ করেন, ব্যবহার করেন। বিজ্ঞানী কোষ-পরমাণু মারফতে বস্তুর ধর্ম লক্ষ করেন ও ব্যবহার করেন। আরো সাম্প্রতিক কবি জন অ্যাসবেরির মতে, মানস-অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর লেখালেখি, কিন্তু তাদের সম্পর্কে নয়, বরং তাদের বাইরে। আরো প্রত্যক্ষভাবে কবি লুই বর্হেস বলেন, ‘আমার মনে হয় সব সাহিত্যই মূলত মনস্তাত্ত্বিক।’ ফার্নান্দো পেশোয়া বলেন, ‘আমি সেই কবিতায় আগ্রহী যা জ্ঞানের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়।’

এখন, আপাতত, আমরা প্রবেশ করব ইকোলজিক্যাল বা বাস্তুসংস্থানিক বিশ্ববীক্ষার চৌহদ্দিতে। এই বাস্তুসংস্থানিক বিশ্ববীক্ষাকে আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি – জ্ঞানীয় (অর্থাৎ, আমরা কীভাবে চিন্তা করি) আর আবেগগত (অর্থাৎ, আমরা কীভাবে অনুভব করি)। আমরা জানি, জ্ঞানের ধারা দুটি – একটি পশ্চিমী চিন্তায় প্রভাবশালী – যার মতে, প্রাকৃতিক জগতের সব সৎবস্তুই, মানুষসহ, অপরিহার্যভাবে পৃথক এবং … যা ক্রিয়া করে অধিযন্ত্রবাদী মিথস্ক্রিয়া পদ্ধতিতে। অন্যটি একেবারেই ভিন্ন, যথেষ্ট সরল ধারণা – প্রাকৃতিক জগতের সব সৎবস্তুই, মানুষসহ, যথেষ্ট জটিলতাপূর্ণ সর্বতোভাবে সম্পর্কযুক্ত সত্তা, যারা চলমান ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রাসঙ্গিক নেটওয়ার্কের মধ্যে যুগপৎ গঠিত ও আশ্রিত … এটা নিছক এক সম্পর্ক থাকার বিষয়মাত্র নয়, বরং সম্পর্কিত হয়ে ওঠা।

প্রথমত, ব্যক্তি-স্বার্থ ও বস্তুগত লাভ কামনা করে আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করি, আমাদের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নষ্ট করি, দেশজ জ্ঞানকে অশ্রদ্ধা করি, অতিরিক্ত পরিশ্রম করি, মানসিক চাপে আক্রান্ত হই, অন্যদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাই না, একাকী হয়ে জীবনের গভীরতর অর্থের সন্ধানে গভীর চিন্তায় মগ্ন হই। দ্বিতীয়ত, বাস্তুসংস্থানিক বিশ্ববীক্ষার আবেগগত মাত্রা আন্তঃসম্পর্কতাকে বোঝা-র থেকে অভিজ্ঞতায় পাওয়া-র দিকে যাত্রা করে। তার প্রথম চর্চা হলো জীবনের সব ক্ষেত্রে সমানুভূতি জাগিয়ে তোলা। দ্বিতীয়টি হলো, আমাদের অবশ্যই নৈতিক সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তোলার গুরুত্ব বিবেচনা করা, যাতে আমরা অদূরভবিষ্যতে যে সামাজিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে চলেছি তাকে অনুভব ও মূল্যায়ন করতে পারি। তৃতীয়টি হলো, আমাদের নৈতিক চরিত্র গড়ে তোলা, যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের দুর্দশা কমাতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি গ্রহণ করার লক্ষ্যে নিয়োজিত হবার পদক্ষেপ নিতে প্রত্যয়ী হতে পারে। চতুর্থটি হলো, আমরা নৈতিক দায়িত্বের পথে দায়বদ্ধ হতে পারি, যে-পথ হলো সহানুভূতিশীল ক্রিয়ার, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত শৃঙ্খলার – যা আমাদের দূরে সরাতে পারে পরিবেশগত ও মনোসামাজিক বিপদক্ষেত্র থেকে, যেগুলো আমরাই ক্রমাগত সৃষ্টি করছি এই জগৎকে এবং এমনকি পরস্পরকে পণ্যায়িত করার মাধ্যমে।

এই পরিস্থিতিতে স্বশক্তিকরণ প্রক্রিয়া হলো এক কুণ্ডলী যা চারটি ঘাট ছুঁয়ে যায়। প্রথমটি হলো যা কৃতজ্ঞতা থেকে আসে – যা আস্থা ও মনস্তাত্ত্বিক প্লবতার প্রসঙ্গ তৈরি করতে সাহায্য করে, যা পরবর্তী পর্যায়ে কঠিন বাস্তবকে সামলাতে আমাদের মদত জোগায়। দ্বিতীয়টি পৃথিবীর জন্য আমাদের বেদনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে – যে-বেদনা আমাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অগাধ অভিনিবেশকেও উন্মোচিত করে। এবং এই অভিনিবেশ উৎপন্ন হয় সব জীবনের সঙ্গে আমাদের আন্তঃসম্পর্কের কারণে।

তৃতীয়টি নতুন চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে – গভীরতর বাস্তুসংস্থানিক আত্ম-র মধ্যে আমাদের প্রোথিত হওয়ার মাধ্যমে বৃহত্তর সম্পদের যে-জাল তা উন্মোচিত হয়। এবং অবশেষে, অর্থাৎ চতুর্থটি হলো এগিয়ে চলা – যা আমাদের পরিজ্ঞানকে স্পষ্ট করার কাজে জড়িত যে কীভাবে আমরা আমাদের জগতের নিরাময়ের জন্য কাজ করতে পারি, ব্যবহারিক পদক্ষেপগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে, যা আমাদের পরিজ্ঞানকে সামনে এগিয়ে দেবে। যে পরিবেশগত ও সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছি আমরা তা রয়েছে প্রজ্ঞার মর্ম-সংকটে। বাস্তুসংস্থানগত বিশ্ববীক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতে আমাদের বোধের সরণ দরকার ‘জীবনের প্রক্রিয়াগত ধারার’ দিকে।

চার

আমাদের আলোচনায় এই প্রসঙ্গটি প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োজনীয় না হলেও তার ধারণা আমাদের প্রত্যাশিত কবির সমন্বয়ী পরিপ্রজ্ঞা হিসেবে উল্লেখ করতে ক্ষতি তো নেই।

আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিরবচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা ও লালন করা, এমনভাবে যাতে তাদের জীবন, ব্যবসা, অর্থনীতি, ভৌত কাঠামো ও প্রযুক্তির ধারা জীবনকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে প্রকৃতির যে অন্তর্নিহিত সক্ষমতা তাকে মান্য করে, শ্রদ্ধা করে ও তার সঙ্গে সহযোগিতা করে। এই প্রয়াসের প্রথম পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবেই হওয়া আবশ্যিক কীভাবে প্রকৃতি জীবনকে নিরবচ্ছিন্ন করে তাকে বোঝা। এটা প্রমাণ হয় যে, এর জন্য প্রয়োজন জীবনধারার এক সম্পূর্ণ নতুন ধারণা – যা গত তিন-চার দশক ধরে বিকশিত হয়েছে।

এর নাম ‘জীবনের এক প্রক্রিয়াগত দৃষ্টিভঙ্গি’ (সিস্টেমস ভিউ অফ লাইফ) – যা যুক্ত করে এক নতুন ধরনের চিন্তা – যে-চিন্তা সম্পর্ক, বিন্যাস ও পূর্বাপর সম্পর্ক ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা – যা প্রক্রিয়াগত চিন্তা (সিস্টেমস থিংকিং) বা সামগ্রিক চিন্তা (সিস্টেমিক থিংকিং) বলে পরিচিত – যা জীবনের চারটি মাত্রাকে সমন্বিত করছে : জীববিদ্যক, জ্ঞানাত্মক, সামাজিক ও বাস্তুসংস্থানিক।

জীবনের প্রক্রিয়াগত বোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিজ্ঞান হলো এই স্বীকৃতি যে, সব জীবন্ত ব্যবস্থার সংগঠনের মৌলিক প্রতিমান হলো নেটওয়ার্ক। যেখানেই আমরা দেখি জীবন, সেখানেই দেখা যায় নেটওয়ার্ককে। বস্তুত জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির যান্ত্রিক থেকে প্রক্রিয়াগত আদিকল্পে পরিবর্তনের অন্তঃস্থলে আমরা পাই রূপকালংকারের মৌলিক পরিবর্তন : জগৎকে মেশিন হিসেবে দেখা-র থেকে তাকে নেটওয়ার্ক হিসেবে বোঝা-য়।

এইসব জীবন্ত নেটওয়ার্কের অন্তরঙ্গ পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে যে, এদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, তারা আত্ম-সংঘটনী। ব্যবহারিকভাবে, এটা অটোপোইয়োসিস তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত, যা সত্তর ও আশির দশকে উদ্ভাবিত। অটোপোইয়োসিসের গোদা মানে হলো ‘আত্ম-নির্মাণ’। জীবন্ত নেটওয়ার্কগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে নিজেদের সৃষ্টি বা পুনঃসৃষ্টি করে তাদের উপাদানগুলো রূপান্তরিত বা প্রতিস্থাপিত করার মাধ্যমে। এইভাবে তারা ধারাবাহিক কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলে তাদের ওয়েবসদৃশ সাংগঠনিক বিন্যাস রক্ষা করার প্রক্রিয়ার সূত্রে। সুস্থিতি ও পরিবর্তনের এই সহাবস্থান বস্তুত জীবনের এক মূল বৈশিষ্ট্য।

জীবনের প্রক্রিয়াগত দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে ফলপ্রসূ দিকগুলোর একটি হলো বিবর্তনের নতুন বোধ, যা সে সূচিত করে। বিবর্তনকে শুধুমাত্র যদৃচ্ছ পরিব্যক্তি ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফল হিসেবে না দেখে বরং আমরা তাকে জীবনের সৃজনশীল উন্মোচন হিসেবে স্বীকার করা শুরু করেছি – চিরবর্দ্ধমান বৈচিত্র্য ও জটিলতাকে সব জীবন্ত প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য রূপে। আমরা এও উপলব্ধি করছি যে, জীববিদ্যক জীবনের শিকড় জড়জগতের গভীরে পৌঁছে যায় – ঝিল্লিবদ্ধ বুদ্বুদের পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যার গভীরে – আদি কোষেরা যারা প্রাক- জীবক্রিয়া বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল, যতক্ষণ না প্রথম জীবন্ত কোষ তার থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

জীবনের এই নতুন প্রক্রিয়াগত বোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক তাৎপর্যগুলোর একটি হলো মন ও চেতনার এক মহতী ধারণা। দেকার্তের অনুসারী হয়ে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মনকে এক অধরা সত্তা হিসেবে মনে করেছেন এবং এটা কল্পনা করতে পারেননি যে, কীভাবে এই ‘চিন্তন বস্ত’ শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত। জীবনের প্রক্রিয়াগত দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট অগ্রসরণ হলো, মনকে বস্তু ভাবার ওই কার্তেসীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিত্যাগ করা এবং উপলব্ধি করা যে, মন ও চেতনা বস্তু নয়, বরং প্রক্রিয়া।

মনের এই মহতী ধারণাটি আজ জ্ঞানের স্যান্টিয়াগো তত্ত্ব নামে পরিচিত, যে-তত্ত্বের মুখ্য পরিজ্ঞান হলো জ্ঞানের চিহ্নিতকরণ, জানার প্রক্রিয়া, জীবনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে। অবগতি হলো যে, ক্রিয়া জীবনের নেটওয়ার্কগুলোর আত্ম-সংঘটন ও আত্ম-স্থায়িত্বকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এইভাবে জীবন ও জ্ঞান অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পর্কিত। জীবনের সব স্তরে বস্তুর সঙ্গে ওৎপ্রোত এই জ্ঞান। জ্ঞানের স্যান্টিয়াগো তত্ত্ব অনুযায়ী মন ও জড়বস্তু আর দুই ভিন্ন বর্গে অন্তর্ভুক্ত নয় বলে মনে হয়, বরং তাদের দেখা যেতে পারে জীবনের অবভাসগত দুটি পরিপূরক দিকের প্রতিনিধি হিসেবে; প্রক্রিয়া ও কাঠামো। জীবনের সব স্তরে মন ও জড়বস্তু, প্রক্রিয়া ও কাঠামো অভিন্নভাবে সম্পর্কিত।

জ্ঞান, স্যান্টিয়াগো তত্ত্বে যেভাবে বোঝা, জীবনের সব স্তরে সংযুক্ত এবং তার ফলে চেতনার চেয়েও অনেক প্রশস্ত এক অবভাস – যার অর্থ সচেতন, যাপিত অভিজ্ঞতা – হলো এক বিশেষ রকমের জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া, যা এক নির্দিষ্ট স্তরের জ্ঞানীয় জটিলতায় উন্মোচিত হয়, যার জন্য প্রয়োজন এক মস্তিষ্কের ও এক উচ্চতর স্নায়ুতন্ত্রের। এই বিশেষ জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলো আত্ম-অবহিতি।

আমাদের আলোচনায় চেতনার আধ্যাত্মিকতার মাত্রাও অন্তর্ভুক্ত। আমরা খুঁজে পাই যে, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সারাৎসার জীবনের প্রক্রিয়াগত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ। আমাদের কবিও তো বলেছেন, আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে জীবচৈতন্যের জন্ম, বিশ্বচৈতন্যের মধ্যে। অর্থাৎ, বিশ্বাত্মার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করাই হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। আমরা যখন আমাদের চারদিকে জগতের দিকে চোখ রাখি, তা সে বিজ্ঞানের বা আধ্যাত্মিক চর্চার প্রসঙ্গেই হোক, আমরা খুঁজে পাই যে, আমরা বিশৃঙ্খলা ও যদৃচ্ছতার মধ্যে নিক্ষেপিত নই, বরং এক মহৎ শৃঙ্খলার, জীবনের এক জমকালো ঐকতানের অংশবিশেষ। আমরা শুধু জীবনের অণুগুলোকে পরিবেশন করি না, বরং তার মৌলিক সাংগঠনিক রীতিগুলোকেও করি – অজড় জগতের অন্যদের কাছে। বস্তুত, আমরা মহাবিশ্বের অংশ এবং এই অংশভাক হবার অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনকে গভীরভাবে অর্থপূর্ণ করে তোলে।

এখন আরো বেশি বেশি প্রকট হয়ে উঠছে যে, আমাদের সময়ের বহুমুখী ভূমণ্ডলীয় সংকট যথা শক্তি, পরিবেশ, জলবায়ুর পরিবর্তন, দারিদ্র্য ইত্যাদিকে আর বিচ্ছিন্নভাবে বোঝা যাবে না। এসব হলো প্রক্রিয়াগত সমস্যা, যার অর্থ হলো, এরা সবকটিই আন্তঃসম্পর্কিত ও পরস্পর নির্ভরশীল, আর তাদের প্রয়োজন যথোপযুক্ত প্রক্রিয়াগত সমাধান।

পাঁচ

কোয়ান্টাম ও ইকোলজিক্যাল বিশ্ববীক্ষার পর আমরা এবার প্রবেশ করব ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্ববীক্ষায়, আঠারো ও উনিশ শতকের জার্মানিতে যে-ধারণার উদয় হয়েছিল – যার মাধ্যমে আমরা জেনেছিলাম ভাষা ও ভাষীর মধ্যেকার দ্বিমুখী প্রভাবের ধারণা। ভাষাকে কোনো জাতিগোষ্ঠীর সাইকিক

 লাইফ তথা মানসজীবনের এক কিসিমের চেতনা বলে ভাবা হলো। সেই গোষ্ঠী যে-ভাষা ব্যবহার করে তার ওপর ছাপ রেখে যায়; আর, তার মাধ্যমেও তাকে চেনা যায়। কিন্তু ভাষা মানব-চেতনাকে শুধু প্রতিফলিতই করে না, বরং তাকে আকৃতও করে। জগতের অভিজ্ঞতা আমি কীভাবে পেলাম, আমার বাস্তব কীরকম – তাও নির্ভর করে ভাষীর ওপর। ভাষার চেতনের চারিদিকে তার মাতৃভাষা এক ম্যাজিক রিং বসিয়ে দেয়, প্রত্যেক সৃজনশীল বাচন একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত ওই রিংকে অতিক্রম করার এক প্রয়াস।

ভাষাকে সাধারণভাবে আমরা সামাজিক হাতিয়ার হিসেবে দেখি, যার মাধ্যমে চিন্তন ও আবেগসমূহ প্রকাশ করা হয়; এক চিহ্নতন্ত্র হিসেবেও দেখা হয়, যার মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয়। কিন্তু একে ‘সংস্কৃতির এক প্রতীকী নির্দেশিকা’ হিসেবেও ভাবা যায়।

ভাষাকে কোনো জাতিসত্তার মানসজীবনের প্রকাশ হিসেবেও ভাবা যায়, যা এক ধরনের চেতনা।

কিন্তু আমরা কি সত্যিই ভাষাকে এক নিছক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে দেখি, নাকি ওই সত্তার সৃজনশীল শক্তি হিসেবেও ভাবি?

বাস্তবিকভাবে, ভাষার আছে শব্দের নিশ্চিত অবয়ব আর এক নিশ্চিত অন্বয়, যার অর্থ হলো, তা ধারণ করে জগতের এক বিভাজন, যা বস্তুতে অন্তর্নিহিত নয়, বরং ভাষায় যথাযথভাবে বিদ্যমান। প্রত্যেক ভাষাই জগতে প্রবেশের মাধ্যম : প্রত্যেক ভাষাগোষ্ঠী গঠিত হয় তার মাতৃভাষায় বিধৃত এক সাধারণ বিশ্বদৃষ্টি দ্বারা।

বাস্তবতার সঙ্গে মানব সম্পর্কের ভিত্তি হলো অবভাস তত্ত্বের নিরিখে, প্রাকৃতিক জগৎ। এই দার্শনিক প্রস্থানবিন্দুর স্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে এই ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্ববীক্ষার ধারণার সঙ্গে।

এই প্রাকৃতিক জগতের সম্বন্ধ আছে এক বাগর্থগত কাঠামোর সঙ্গে যা ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্ববীক্ষাকে তার ভিত্তিগত পরিস্থিতিতে ব্যক্ত করে : বাস্তবতার সঙ্গে ও বিষয়ীভিত্তিক যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাত্যহিক ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে ভাষার এক সাধারণস্থানিক সম্পর্ক আছে।

আমরা যখন মাতৃভাষা তথা স্থানীয়ভাষা আয়ত্ত করি, তখন সে-ও আমাদের আয়ত্ত করে। মাতৃভাষা স্বোপার্জনের মাধ্যমে ভাষা শুধু এক ‘নিরপেক্ষ’ প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে না, বরং এক মাধ্যমও (অথবা আদিকল্প) হয়ে ওঠে, যা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সমগ্র জীবনকে প্রভাবিত করে। সেই স্বোপার্জিত ভাষা আমাদের জগৎ সম্পর্কিত পরিপ্রজ্ঞা গঠন করে। এই ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন জেগে ওঠে, তাহলে তো বিভিন্ন ভাষা একই জগৎ সম্পর্কে বিভিন্ন পরিপ্রজ্ঞা গড়তে পারে। একজন ভাষীর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের ওপর বিভিন্ন ভাষার প্রভাব এখনো এক কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন।

যদি ভাষা ধারণার নির্মাতা হয়, তবে ব্যক্তিমানুষের মনোভাবকে আকৃত করার ক্ষেত্রেও তার এক ভূমিকা আছে। যদি বাস্তবতা আমাদের-বলা ভাষার দ্বারা জ্ঞাত ও আকৃত হয়, তাহলে এক বস্তুনিষ্ঠ জগতের অস্তিত্ব প্রশ্নাতীত নয়, এবং যে-বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আমরা অর্জন করতে পারি তা বিষয়ীগত না হয়ে পারে না। আপেক্ষিকতার নীতি তাহলে নির্ধারণবাদের নীতিতে পরিণত হয়। আমরা যে-ভাষায় কথা বলি তা কি পুরোপুরিভাবে বাস্তবতার প্রতি আমাদের মনোভাবকে নির্ধারণ করে, নাকি আমরা নিছক তার অন্তর্নিহিত বিশ্ববীক্ষা দ্বারা প্রভাবিত?

আমরা স্মরণ করি বাইবেলের (জন ১:১) সেই অমোঘ বিবৃতি : ‘শুরুতে ছিল শব্দ …।’ প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে আন্দ্রেই তারকোভস্কির স্যাক্রিফাইস ছবির শেষে পুত্র যখন জিজ্ঞেস করে, ‘হোয়াই ডিভ ইট স্টার্ট উইথ ওয়ার্ডস, ড্যাড!’

তবুও ভাষাকে বলা হয় আদি বা আসল পাপ – এক মিথ্যা, কেননা শব্দ সৃষ্টি দ্যোতিত-র পরিবর্ত। বস্তুত, যেহেতু আমরা শব্দরাজি আয়ত্ত করি, আমরা কখনো বাচিক প্রতীক ও যে-বাস্তবের হয়ে তা দাঁড়ায় – এই দুয়ের ভিন্নতা বুঝতে ব্যর্থ হই। তবুও; শব্দেরা শুধু ধারণাগতভাবে যা বোঝানো হয় তা জাগাতে চেষ্টা করে এবং তার মাধ্যমে বক্তা ও শ্রোতা উভয়কেই বিকল্প অভিজ্ঞান দেয়।

ভাষা আমাদের পরিত্রাতাও। প্রতীকায়িত করার সক্ষমতা ধারণাগতভাবে আমাদের স্থান-কালে চলতে-ফিরতে দেয়। আমরা অতীতের ঘটনা মনে করতে পারি বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারি, শুধু শব্দের ব্যবহার দ্বারা। সুতরাং শব্দের প্রতি আমাদের মহতী বিশ্বাস হলো এই যে, শব্দদের আমরা ময়নাতদন্তের মতো বিবৃত অতীত বা ভবিষ্যতের অস্তিত্বের ‘বাস্তবতা’ হিসেবে অনুভব করি। যদিও আমরা অতীতকে পুনরুদ্ধার বা ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করতে পারি না, শুধু তাদের প্রতীকায়িত করতে পারি। আর, আমরা সর্বদাই বর্তমান মুহূর্তে ও স্থানে ভৌতিকভাবে থেকে যাই।

ছয়

আমরা এতক্ষণ কোয়ান্টাম ও ইকোলজিক্যাল বিশ্ববীক্ষার সূত্রে বাস্তবতা ও তার জ্ঞান আর ভাষা ও তার দর্শন নিয়ে কূটকচালি করলাম। এখন, নতুন কবিতার সংজ্ঞা বা কবিতার নতুন সংজ্ঞা (দুয়ের মধ্যে ফারাক তো আছেই, তাই ‘বা’ শব্দটির ওপর নজরটান রেখেই) তৈরি করতে যাবার আগে গোদাভাবে বুঝে নিই কী দাঁড়ালো। বিশ্ববীক্ষা যদি কবির জ্ঞানভূমির, মনোভূমির, ধ্যানভূমির ভিত্তি হয়ে থাকে তবে তাকে একটি সরল ত্রিভুজের আকারে পেশ করতে পারি –

Page 9 Chart.jpg

কোয়ান্টাম বিশ্ববীক্ষা ও ইকোলজিক্যাল বিশ্ববীক্ষা কবি-র বাস্তবতাবোধ তৈরিতে সাহায্য করে থাকলে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্ববীক্ষা সমভিব্যহারে বাস্তবতা ও ভাষার সংঘর্ষ, তথ্য মিথস্ত্রিয়া ও সমন্বয়ের সুযোগ উৎপন্ন হয় তার সৃষ্টিশীলতার নেপথ্যে।

***

১৯৭৫ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে (‘ট্রাভেলস্ ইন হাইপাররিয়ালিটি’) উমবার্তো একো এই প্রশ্নটি পেশ করেছিলেন – বাস্তুসংস্থানের সত্য কোথায় আছে? অতিবাস্তবের কূটাভাস হলো, যখন তা পুরোপুরি সদ্ বা রিয়াল নয়, তা অসদ্ বা আনরিয়ালও নয়। এই কূটাভাস বাস্তুসংস্থানের সত্য ও সম্ভাব্য অসত্যের সাপেক্ষে যথেষ্ট হতাশাব্যঞ্জক। বাস্তুসংস্থানের সত্য আবিষ্কার করা আরো বেশি কঠিন তার চেয়ে যতটা তার প্রচারকেরা আমাদের বিশ্বাস করিয়েছে – অতিবাস্তবের দুর্বোধ্য প্রভাবের কারণে ও একই সঙ্গে দুটি অতিরিক্ত কারণে ১. প্রকৃতি হলো জটিল; আর ২. প্রকৃতি সর্বতোভাবে সংস্কৃতিতে সংশ্লিষ্ট এবং সংস্কৃতিও সর্বতোভাবে প্রকৃতিতে সংশ্লিষ্ট।

তাহলে, আমাদের প্রশ্ন যদি হয়, বাস্তুসংস্থানের সত্য কি এতদূর পর্যন্ত যে, সেই সত্য সাহিত্য দ্বারা পরিবেশিত? কত ভালোভাবে সাহিত্য সেই সত্যকে সামাল দিতে পারে?

তাহলে কি বাস্তুসংস্থানের সত্য সাহিত্যে নিহিত?

***

মনে পড়ে, ইতালো ক্যালভিনোর উপলব্ধি : সাহিত্যের ভবিষ্যতে আস্থা এই জ্ঞানে নিহিত যে, এমন কিছু জিনিস আছে যা সাহিত্যই আমাদের দিতে পারে, এমন উপায়ে যা নির্দিষ্টভাবে তার-ই।

যদি ধরে নিই, কবিতা হলো এক ক্রিয়াকর্মের ফল, যার কেন্দ্রে আছে ভাষার ঐহিকতা এবং ভাষাতান্ত্রিক নিয়মের স্ফোটন।  কবিতা এই অর্থে এক বিধ্বংসী শক্তি, যা জ্ঞানাত্মক মাত্রায় কাজ করা শুরু করে।

ভাষার অনন্ত সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করে কবিতা। কবিতা মদত দেয় সংকেতের অগ্রগণ্যতাকে। কবিতা ভাষাতাত্ত্বিক সংকেতকে  ঠেলে দেয় সীমায়।

– যা অন্য কোনো মানুষিক ক্রিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়।

বাস্তব কখনো চেতনার তাৎক্ষণিক সুগম  নয়। চেতনা এই অর্থে সংকেতকদের অনিবার্য মীমাংসা।

– এইভাবে কবিতা হয়ে ওঠে ভাষা ও বাস্তবের মহৎ মধ্যবর্তী।

এর মানে এই নয় যে, তা প্রতিরূপ পরিবেশন করে। বরং চেতনায় বাস্তবের সেই মাত্রাকে সমর্থ যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সুগম ছিল না।

আমরা নিশ্চয়ই ভুলিনি যে, কবিতা এক সীমালঙ্ঘনকারী শক্তি। সাধারণ যোগাযোগের সীমাকে ভেঙে দেয়। সেটা করতে গিয়ে জগৎকে জানা-বোঝার বিকল্প মডেল উত্থাপন করে। তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়।

এই ক্ষেত্রে কাব্যভাষা অপকেন্দ্রিক প্রভাব উৎপন্ন করে (উল্টোটা কিন্তু নয়)। সংশয়াতীতভাবে কবিতা হয়ে ওঠে এক অন্তঃনিয়ন্ত্রণাধীন ক্রিয়া, যতটা তা বহির্বাচনিক বাস্তবতাসমূহের সংঘর্ষের ফল।

এই পর্যায়ে আমাদের শাস্ত্রের সংজ্ঞাকে টেনে আনলে কেউ কেউ রে … রে … করে উঠতে পারেন।

কবির সংজ্ঞা হিসেবে শাস্ত্র বলছে, ‘কবি কর্মানি ব্যাপৃয়তে সমাধি।’ অর্থাৎ, কবি বিশ্ব-চেতনার সঙ্গে নিজের চেতনাকে যুক্ত করে, তার রস আস্বাদন করে সেইটুকুকেই প্রকাশ করেন। একে কি এখনো অস্বীকার করা যায়?

সাত

সেই কবে হারীতকৃষ্ণ দেব-কে লেখা চিঠিতে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, – ‘বাংলা সাহিত্যে জ্ঞানের দিকটে আজ পর্যন্ত ফাঁকা রয়ে গিয়েছে। আর যতদিন বাংলা সাহিত্য জ্ঞানের ভাণ্ডার না হবে; ততদিন উঁচুদরের কাজ ও সমালোচনার জন্যও আমাদের দু’একটি প্রতিভাশালী লেখকের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।’

এটা না হয় ওই সময়ের আক্ষেপ! কিন্তু এই সময়ে আমরা কি তার থেকে এগোনোর উল্লেখযোগ্য নাজির হাজির করতে পারব? তবে বিশ্ববীক্ষার স্পন্দন রবীন্দ্র-পরবর্তী যেসব বাংলা কবির মধ্যে আমরা কমবেশি পেয়েছি, বলা বাহুল্য, তার মধ্যে অন্যতম জীবনানন্দ দাশ। সমসাময়িক কালে বিনয় মজুমদার, মনীন্দ্র গুপ্ত, আলোক সরকার, সুধীর দত্ত, অনন্য রায়-দের কবিতাতেও আমরা পাই সেই স্পন্দন। বিদেশি ভাষার কবিতাতেও এমন কবির সংখ্যাও বেশি নয় – যেমন, আমরা যাদের জানি, লুই বর্হেস, ফার্নান্দো পেশোয়া, জন অ্যাসবেরি, ইতালো ক্যালভিনো, … আর, কথাকার উমবার্তো একো, হারুকি মুরাকামি, …. প্রমুখ।

আজকের বাংলায় গণশিক্ষা ও অন্যান্য (যেমন বিশ্বায়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) কারণে গড় পাঠকের মান আর সংবাদ-সাহিত্যের প্রকোপে গড় সাহিত্যের প্রমাণ যে-পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেই মুহূর্তে এই ত্রিমাত্রিক বিশ্ববীক্ষায় পরিপ্রাজ্ঞ কবির প্রত্যাশা বেঢপ শোনাচ্ছে কি?

মনে হচ্ছে, একবার রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ ছুঁয়ে না গেলেই নয়। আমরা নিশ্চয়ই ভুলিনি যে, সৌন্দর্যবোধ থেকে সৃষ্টি – এটা প্রতীচ্যের ধারণা আর আনন্দ থেকে সৃষ্টি – এটা ভারতীয় ধারণা। অর্থাৎ, ‘এসথেটিকস’কে তারা ধরেন ‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’ হিসেবে, আর আমরা ‘আনন্দ-মীমাংসা’। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, সাহিত্য হচ্ছে দ্রষ্টা আমি-র প্রকাশ। এই দ্রষ্টা হলো, যে ব্যবহারিক মন দিয়ে দেখছে না, নিরাসক্ত ও শুদ্ধ মন নিয়ে বস্তুটিকে দেখছে আর বস্তুর প্রকৃত সত্তার সঙ্গে দ্রষ্টার প্রাণের মিলন ঘটছে ও বস্তুটির প্রাণরস আস্বাদন করে সে আনন্দ পাচ্ছে। এই বিশুদ্ধ দ্রষ্টার, এই বিশুদ্ধ আমি-র প্রাণের আনন্দের প্রকাশ হচ্ছে সাহিত্য। আর এক জায়গায় তিনি বলছেন, ‘ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা – ইহাই সাহিত্য।’ অর্থাৎ সাহিত্য হচ্ছে একাধারে একান্ত ব্যক্তিগত ও বিশ্বজনীন সৃষ্টি।

তাহলে আমাদের চারিদিকে ভূরিভূরি যা-সব মুদ্রিত হয়ে চলেছে তাকে কী করে সাহিত্য বলব? আমরা ভুলেই গেছি, ‘নিজ সুখাদি বিবশী কৃতশ্চ কথং বস্তুন্তরে সংবিদং বিশ্রাময়েৎ।’ নিজের চাওয়া-পাওয়া সুখ-দুঃখ দ্বারা বিবশ হয়ে থাকলে বস্তুর অন্তরে প্রবেশ করব কেমন করে? আর, বস্তুর অন্তরে প্রবেশ করতে গেলে লৌকিক বৃত্তি অর্থাৎ প্রয়োজন সাধনের মনোভাব একেবারে বর্জন না করলে কোনো উপায় নেই। ভুলে গেছি, সাহিত্যরস বাহ্য ঘটনার পরাপেক্ষী নয়। এই জন্যেই এই রস আনন্দময়।

আজ যখন সহজাত আধ্যাত্মিকতা, ভিশন বা বিশ্ববীক্ষার প্রণোদনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃজিত যে-কবিতাকে আবাহন করে এই মর্মে ব্যাখ্যা করার কথা ছিল, তার পরিবর্তে তার রূপরেখা তৈরি করে টেস্ট-টিউব বেবির মতো সেই কবিতার প্রত্যাশায় পরীক্ষাগারে জমায়েত হয়েছি। এই কি তাহলে অ্যানথ্রপোসেন্ট্রিক যুগলক্ষণ?

এই মুহূর্তে কেন জানি না মনে পড়ছে মুরাকামির গল্পের সেই চরিত্রের কথা, যে বলেছিল, এমন একটা বৃত্ত কল্পনা করো যার অনেকগুলো কেন্দ্র কিন্তু পরিসীমা নেই। সেটাই হলো জীবনের মধুরস্য মধুর অন্তঃসার। তাকে যদি কবিতা বলে ভাবি … ভাবতে ভাবতে প্রত্যাশা জন্মায়, তার রূপরেখা আঁকি … আর, ভাবি … এই প্রত্যাশা স্বপ্ন না অনুমান? [কলিখাতা পত্রিকার ‘কবিতার আঙ্গিক : কালে কালান্তরে’ সংখ্যাটির প্রকাশ অনুষ্ঠানে, ২০ জুলাই ২০১৯ তারিখে কলেজস্ট্রিট কফিহাউস ভবনের বইচিত্র সভাঘরে প্রদত্ত বক্তৃতার সম্প্রসারিত লিখিত রূপ।]