নন্দলালের চিঠির ছবি

সুশোভন অধিকারী

নন্দলালের আঁকা একখানা ছবির বই হাতে নিয়ে দেখছিলাম। বই না বলে একে ক্যাটালগ বলাই সংগত। এ-ক্যাটালগের অধিকাংশ ছবি অবশ্য কালিকলমের দ্রুত আঁচড়ে আঁকা, স্কেচধর্মী। আসলে স্কেচ জাতীয় কিছু ছবিকে এখানে নির্বাচন করে সাজানো হয়েছে। ছবিতে কালিকলমের রেখার মাঝে কোথাও রং-তুলির সামান্য ছোঁয়া থাকলেও এগুলো মূলত রেখার ছবি। আর কী আশ্চর্য সজীব তাঁর রেখার গতিময়তা, অবজেক্টের আকার বেয়ে প্রাণের বিপুল ছন্দে গড়িয়ে পড়ছে। একটু খেয়াল করলে দেখবো, নন্দলালের রেখা – সে কলমের হোক বা তুলির – অসাধারণ সব ভাস্কর্যসুলভ ফর্ম তৈরি করে। কখনো সে রেখায় তীক্ষè কঠিন ঋজু ভঙ্গি, আবার কখনো তা প্রবহমান দোলা, বালির তটের কাছে ধেয়ে আসা সমুদ্রের প্রাণচঞ্চল ঢেউয়ের মতো। এত অনায়াসে, এমন অবলীলায় অথচ এমনি অব্যর্থভাবে এসব রেখা তাঁর চিত্রপটে চলেফিরে বেড়ায় যে ছবির প্রাণ জেগে ওঠে এক লহমায়। স্বল্প পরিসরে দ্রুততর সময়ের সে ছোট ছবি হোক বা বড়, কেবলমাত্র রেখার সামান্য টানটোনে ফিগারের অমন স্কাল্পচারাল দৃঢ়তা ও আয়তন নির্মাণে নন্দলালের জুড়ি নেই। এ-কাজে তাঁর পাশাপাশি অন্য শিল্পীদের নাম করতে গিয়ে – আজকেও আমাদের দু-দণ্ড ভাবতে হয় বইকি!
আর কেবল রেখার কথাই বা ধরি কেন। কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন আসার পরে তাঁর ছবির বিষয়ভাবনাও আমূল বদলে গিয়েছিল। পুঁথি-পুরাণের নন্দলাল স্পষ্টত পা রেখেছিলেন পৃথিবীর শক্ত মাটিতে। এ-পর্বে চারপাশের এমন সাধারণ জিনিসপত্রের দিকে তাঁর দৃষ্টি পড়েছে তা বলার নয়। আমরা সকলেই জানি, এর পিছনে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শান্তিনিকেতন তথা বীরভূমের প্রকৃতির প্রভাব নিশ্চিতভাবে কাজ করেছে। ছবি আঁকার ব্যাপারে ক্লাসের অন্দরে, স্টুডিওর চার দেয়ালের মধ্যে গড়ে ওঠা পাঠচর্চার কথা বাদ দিয়ে বলতে হয় – সাধারণের কাছে ছবিকে এমন অনায়াসে হাজির করতে এর আগে কাউকে দেখা যায়নি। চিত্রকলাকে তার শৌখিনতার পাঁচিল ভেঙে তাকে একেবারে আমাদের আটপৌরে দিন-রাত্তিরের মধ্যে এনে দিয়েছিলেন নন্দলাল। আর কেউ শিল্পকলাকে এভাবে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে গেঁথে দিতে পেরেছেন কিনা জানি না। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁর ছাত্রছাত্রী বা আত্মীয়-বন্ধুদের পাঠানো চিঠিতে পোস্টকার্ডে যেসব অসাধারণ ছবি তিনি এঁকে পাঠিয়েছেন – সমগ্র বিশ্বে তার তুলনা কোথায়? পৃথিবীর আর কোনো প্রথিতযশা শিল্পী এমন অজস্র ছবি এমনি অকাতরে বিতরণ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। তাঁর শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ, নিজের সম্বন্ধে ঈষৎ অহঙ্কারমিশ্রিত কৌতুকে একদা বলেছিলেন ‘ওবিন ঠাকুর ছবি লেখে।’ কিন্তু তাঁর ছাত্রটি গুরুর সেই কথাকে একটু অন্যমাত্রায় নিজের জীবনে একেবারে সত্যি করে তুলেছিলেন – এর নজির আর কোথাও আছে কি? সেসব চিঠিতে হয়তো বা সামান্য দুয়েক লাইন অক্ষরের সারি, সামান্য দুয়েকটা শব্দ, বাকি কথা ভরিয়ে তুলেছে তাঁর ছবির রেখা। আর সেই রেখার চিত্রভাষা কেড়ে নিয়েছে প্রাপকের তথা আমাদের সমস্ত আকর্ষণ! সেই ছবি তো শুধু তাদের ওপরে তুলে সাজিয়ে রাখার নয়, এ হলো নন্দলালের জীবন-ইতিহাসের একেকটি বহমান পৃষ্ঠা। সেই পর্বে শিল্পীর আশপাশে ঘটে চলা ঘটনার প্রাণবান স্রোত – এ এক পিকটোরিয়াল ডকুমেন্টেশন। শুধু নন্দলালের জীবনের ইতিহাস নয়, এখানে আমরা পেয়ে যাই তাঁর স্বদেশ স্বকালকে ছুঁয়ে থাকা শিল্পমহালের বিস্তৃত প্রেক্ষাপট। একটু অন্যভাবে বলি, মহাত্মা গান্ধী আলাদা করে আমাদের প্রতি কোনো উপদেশ, কোনো বাণী রেখে যেতে চাননি, বলেছিলেন, ‘আমার জীবনই আমার বাণী।’ তবে মহাত্মার সেই কঠোর দৃঢ় কৃচ্ছ্রসাধন মেনে চলা কি আমাদের পক্ষে এতই সহজ? আর সেদিক থেকে বিচার করলে, মিতভাষী নন্দলালের এই সহজ সজীব ছবিমালার মধ্যেই কি তবে ছড়িয়ে আছে তাঁর শিল্পীসত্তার নিভৃত আখ্যান? শিল্পীদের জন্য রেখে যাওয়া এক নিঃশব্দ নির্দেশ? আমাদের জীবনযাপনের জন্য ভূমিকে স্পর্শ করে, মাটি ছুঁয়ে পথচলার দিকে তাঁর সুস্পষ্ট সংকেত? নন্দলালের এই ফিলোজফির কথা সরিয়ে রেখে আমরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করি, আজকে তাঁর প্রয়াণের প্রায় ৫০ বছর পরেও আমাদের জানা নেই তাঁর এই চিত্রিত চিঠির প্রকৃত সংখ্যাটি কত! আমৃত্যু তাঁর প্রিয়জনদের কাছে নন্দলাল যে অকাতরে বিলিয়ে গিয়েছেন এই অলৌকিক চিত্রামৃত – কী তার সঠিক পরিমাণ! আমরা জানি, বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন সংগ্রহে এমন কিছু চিঠি রক্ষিত আছে, কিছু আছে কলাভবনে আর দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্টের সংগ্রহালয়ে। কিন্তু এখনো এই ধরনের কতগুলি ছবি যে ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়ে গিয়েছে তা নিশ্চয় করে বলা শক্ত। তাই ‘মাস্টারমশাই’য়ের আঁকা এমন পিকচার পোস্টকার্ডের পরিমাণ আজকে, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও আমরা সঠিক অনুমান করতে পারি না।
নন্দলালের সে আলোকঝরা সময় ছাড়িয়ে এখন আমরা বহুযোজন দূরে। এমন শিল্পী আজ কোথায় যাঁদের কলম থেকে অনায়াসে নিঃসৃত হয় øেহ-প্রীতির সেই অবিরাম স্রোত! অবশ্য তার কারণও আছে। শিল্পকলা আজকে যতটা ভালোবাসার উপহার তার চেয়ে অনেক বেশি ইনভেস্টমেন্টের সামগ্রী, এবং শেয়ারবাজারের সঙ্গে তার দামের ওঠানামা চলে। শিল্পীরাও এ ব্যাপারে বেশ সচেতন, আর হবেন নাই বা কেন! তবে কি এই কারণেই øেহ-ভালোবাসার সেই স্বতঃস্ফূর্ত স্রোত আজ রুদ্ধ হয়ে এসেছে?
কিছুদিন আগেও আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে পুবদিকে তাকালে, বহুদূর পর্যন্ত খোলা ফাঁকা মাঠের মতো ছড়ানো জায়গা চোখে পড়তো। তার মধ্যিখানে ছিল এক ঘন সবুজ গাছের সারি। আকাশের প্রেক্ষাপটে সে কোনো অদৃশ্য আর্টিস্টের মোটা তুলিতে টানা একখানা জোরালো সপাট আঁচড়ের মতো। প্রকৃতির ক্যানভাসজুড়ে মেটে-সবুজ রঙের ঢেউ খেলানো উঁচু-নিচু জমির প্রান্তে একটা দগদগে ডার্ক-গ্রিনের পোঁচ ঠিক একেবারে ভ্যানগঘের ছবি! না, কেবল সাগরপারের সেই পাগল শিল্পীর কথাই বা ধরি কেন, অনায়াসেই এ হতে পারে আর এক উদাসী বাউল রামকিঙ্করের চিত্রপট! কিন্তু দেশি বা ভিনদেশি যে আর্টিস্টের ছবিই মনে হোক না কেন, আমার ছাদ থেকে দেখা সে দৃশ্যটাই ক্রমে হারিয়ে গেল। মাটি-মাখা সবুজের সে ঢেউ তোলা ভূমিতরঙ্গ বেশিদিন রইলো না, মুছে গেল অচিরে। আর সেখানে দ্রুত গজিয়ে উঠতে লাগলো বড় বড় বাড়ি। যার আড়ালে ক্রমশ গাঢাকা দিতে বাধ্য হলো সেই সজীব সবুজ ‘বনরাজি নীলা’। আরো পরে তা একেবারে নিশ্চিহ্ন। সে বৃক্ষমালিকা সযতেœ উৎপাটিত করে সেখানে আজ আসন পেতেছে নানা প্যাস্টেল শেডের চোখ ধাঁধানো অট্টালিকা। রোদ্দুরের আলোয় ঝলসে ওঠা বড়-বড় কাচের জানালা দেওয়া লম্বাটে চৌকো বাক্সসদৃশ ফ্ল্যাটের সৌধ। ঠিক যেন ফিউচারিস্ট বা কিউবিস্ট শিল্পীদের বেপরোয়া ইনস্টলেশন।
গ্রামগঞ্জের অবস্থা এমন হলে শহরের কথা না বলাই ভালো। তবু আমরা যারা শহর থেকে কিছুটা দূরে, তারা সবুজের ছোঁয়া সহজে পাই। গাছ-গাছালির সঙ্গে বুনো আগাছার মতো ঝোপঝাড় পথের পাশে নিয়তই চোখে পড়ে। কিন্তু নগরায়ণের তীব্র ঝাঁজে সবুজ হয়তো অচিরেই হারিয়ে যাবে। আমি বাস করি এক আধা শহর আধা গ্রামের মতো জায়গায়। যে-পথ দিয়ে যাতায়াত, তার আশপাশে শেয়ালকাঁটার ঝোপ, আকন্দের এলোমেলো বেড়ে ওঠা ডাল, পুষ্পিত নয়নতারার গুচ্ছ, ডুমুরের বেয়াদব চারা বা অপরাজিতার জেদি লতাগুল্ম অনায়াসে গজিয়ে ওঠে পথের ধারে। তাদের একেকটার রং একেকটার চেহারা আলাদা রকমের। শেয়ালকাঁটা গাছের টেরাভার্ট সবুজের সঙ্গে ওর বাসন্তী রঙের ফুলের মধ্যে অমন গাঢ় মেরুনের ফোঁটা, তা থেকে চোখ ফেরানো যায় না। আর আকন্দ, সে-ফুলে রয়েছে কী এক আশ্চর্য মভ মাখানো গোলাপির নরম প্রলেপ, আর তার মাঝে সরু তুলির সূক্ষ্ম কারুকাজ। কিন্তু সেসব কি মন দিয়ে দেখি। নাকি সেদিকে চোখ মেলার সময় আছে। কিন্তু আমার সময় নাই বা রইলো, প্রকৃতির কালার প্যালেটের তো কোনো বিরাম নেই। যেমন নয়নতারার ঘন সবুজ পাতার সঙ্গে তার গাঢ়-গোলাপি পাপড়ির অপূর্ব কম্বিনেশনের কোনো তুলনা হয়? বা এদের পাশে দ্রুত বেড়ে ওঠা ডুমুরের শুঁয়োওঠা সবুজ চারা বা অপরাজিতায় নীল-সবুজের খেলা – সে তো আপন মনেই চলে! কিন্তু প্রতিদিনের দৌড়ে আমাদের এপাশে-ওপাশে অতশত তাকিয়ে দেখার সময় কোথায়? এই আধুনিক জীবনে আমাদের সকলকে ফোকাসড হয়ে চলতে হবে, তা নইলে নাকি সত্যিকারের কাজ করা যায় না। কিন্তু কোনটা সত্যিকারের কাজ, তাই বা কে বলে দেবে। অবশ্য বড় হয়ে এটুকু বুঝেছি – চলার পথ, অনুভবের জগৎকে কেটে-ছেঁটে বেশ ট্রিম করে নিতে হবে। অনেকটা ছোটবেলার বাংলা ক্লাসে সারসংক্ষেপ শেখার মতো, না হলে উপায় নেই। তাই এসব অকারণ অপ্রয়োজনীয় জিনিস যা আমাদের প্রতিদিনের কোনো কাজে আসে না, তার দিকে ‘চেয়ো না চেয়ো না’, ‘চলো নিয়মমতে’। আর ছাঁচে-ঢালা একটানা পথে চলতে-চলতে আমাদের দেখার সে-চোখটাই বুঝি হারিয়ে ফেলেছি। উদাস দুপুরে ডেকে যাওয়া সেই পাখির মতো আমাদেরও বুঝি বলে উঠতে হবে ‘চোখ গেলো’। কিন্তু শিল্পীদের চোখ গেলে কী করে চলবে? তার জন্যে জগৎময় ছড়ানো দৃষ্টির বিপুল বৈভব। তাকে বাদ দিয়ে তার সৃষ্টির অর্ধেক দুয়ার রুদ্ধ। আমরা অবশ্য দেখেছি, রবি ঠাকুর তাঁর প্রথম জীবনে ‘চোখের দেখা’ আর ‘মনের দেখা’র মধ্যে কী একটা বিরোধ বাধিয়ে বারবার ‘মনের দেখা’কে এক নম্বরে ঠাঁই দিয়েছেন। কিন্তু জীবনের শেষবেলায় ছবি-আঁকিয়ের ভূমিকায় নেমে তাঁকেও মাতিয়ে দিয়েছিল চোখের দেখা। তখন আকাশ-বাতাস থেকে ভেসে আসা সুরের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল ‘আকারের মহাযাত্রা’, কবি বা গায়ক হয়ে উঠেছিলেন চিত্রী। আর এই চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ জীবনের একেবারে প্রান্তে পৌঁছে, যামিনী রায়কে একটি চিঠিতে অভিযোগ পর্যন্ত এনেছিলেন আমাদের অন্যমনস্ক হয়ে পথ চলার দিকে। সে-চিঠিতে তিনি বলেছিলেন –
পৃথিবীর অধিকাংশ লোক ভালো করে দেখে না – দেখতে পারে না। তারা অন্যমনস্ক হয়ে আপনার নানা কাজে ঘোরাফেরা করে। তাদের প্রত্যক্ষ দেখবার আনন্দ দেবার জন্যই জগতে চিত্রকরের আহ্বান। চিত্রকর গান করে না; ধর্মকথা বলে না; চিত্রকরের চিত্র বলে ‘অয়ম অহম ভো’ – এই যে আমি এই।
এ দেখায় সুন্দর বা অসুন্দরের বিষয়টা বড় নয়, এখানে ‘জীবনযাত্রার প্রয়োজন বা ভালোমন্দ বিচারের কোনো উদ্যোগ নেই’। সে যে আছে – এই কথাটাই চিত্রী আমাদের কাছে ঘোষণা করে, দৃষ্টির ভুবনে এই নিছক দেখাবার আনন্দটুকু শিল্পী অকাতরে বিলিয়ে দিতে চায়। রবি ঠাকুরের কথার রেশ টেনে বলতে পারি, প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনের ফাঁকে কত সাদামাটা জিনিস নন্দলাল তাঁর সামান্য ছোঁয়ায় অসাধারণ করে আমাদের কাছে বিলিয়ে দিয়েছেন, তার তুলনা নেই।
পোস্টকার্ডে আঁকা নন্দলালের এই ছোট ছবিগুলোর সামনে দাঁড়ানো আর আমাদের আটপৌরে জীবনে অজস্র দৃশ্যের দিকে চোখ মেলা যে একই কথা, তা মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা রাখে না। শিল্পীর পারিপার্শ্বের বিচিত্র জগৎ এক আশ্চর্য ছায়া ফেলে তাঁর ছোট্ট কার্ডের ক্ষুদ্র পরিসরে। গাছপালা, ফুলপাখি, জীবজন্তু, পোকামাকড় – কোনো কিছুই বাদ পড়ে না তাঁর দৃষ্টির সীমানা থেকে। সংক্ষিপ্ত সময়ে কলমের দুয়েকটা দ্রুত টানটোনেই ফুটে ওঠে সমগ্র ছবি, প্রবহমান প্রতিদিনের শিল্পিত ডকুমেন্টেশন। শিল্পীর তীক্ষè দৃষ্টি, যাকে বলে অত্যন্ত নিবিড় অবজারভেশন এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি না থাকলে এমনটা কখনই সম্ভব নয়। আর এই অনুভব আমৃত্যু নন্দলালের দৃষ্টি আর সৃষ্টিতে গভীরভাবে কাজ করে চলেছে। তাঁর ছবি থেকে কলমের একটা ছোট্ট আঁচড় কিংবা তুলির সামান্য একটা দ্রুত টানও সরিয়ে দেওয়া যায় না। অথচ কী অনায়াসে কী অবলীলায় প্রাণ পেয়ে ওঠে তাঁর চিত্রপট! একটা ছবির কথা এখানে বলতে হয়। আমার যাতায়াতের পথেও এই দৃশ্যটা প্রায়ই চোখে পড়ে। সে হলো, কাঁকরঢালা পথের ধারে জলা স্যাঁতসেঁতে আগাছা ঘেরা জমিতে একদল গরু-মহিষের আনাগোনা। সাদা কালো ধূসর নানা রঙের গরু-মহিষের পাল মনের আনন্দে সেই জংলা জমিতে ঘাসপাতা খেয়ে চলে। সাঁওতালপাড়ার ছেলেরা বোধহয় ওদের এখানে ছেড়ে দিয়ে যায়। আর এই গরু-মোষের দলকে ঘিরে থাকে একঝাঁক বক – যারা জড়ো হয় ওই চারপেয়ে তৃণভোজীদের গায়ে আটকে থাকা পোকামাকড়ের সন্ধানে। গাছপালার ঘন সবুজ পটভূমিকায় সাদা-কালো-ধূসর-পাটকিলে এই গরু-মোষের মাঝখানে দুধসাদা বকের কয়েকটা রঙের পোচ আমাদের চোখকে না টেনে পারে না। প্রবাহিত জীবনের এমন একটা দৃশ্য অনেক দুঃখের মধ্যেও আমাদের মনটাকে খুশিতে ভরিয়ে দিয়ে যায়। চকিতে মনে হয়, নন্দলালের আঁকা এমন কত-না স্কেচ আছে। কলমের ঋজু টান-টান আঁচড়ে সেখানে ফুটে উঠেছে মোষের দৃপ্ত জোরালো ওজনদার ভঙ্গি। আর তাদের গা থেকে পোকামাকড় খুঁটে খাচ্ছে হালকা চালের কয়েকটা বক। বকের সরু সরু পা যেন এক বিশেষ ছাঁদে হেঁটে চলেছে, সেই ছন্দের চলন ছড়িয়ে পড়ছে তাদের শরীরজুড়ে। নন্দলালের কলমের দ্রুত সপাট আঁচড়ে – ইংরেজিতে যাকে বলে ‘রানিং স্কেচ’ – সেখানেও মোষের স্বভাবের একটা বেপরোয়া বলিষ্ঠতা আর বকের ঝাঁকের আলগোছে চলার ধরনটা কী আশ্চর্য অবলীলায় ফুটে ওঠে।
এমনি আর কয়েকটা ছবির কথা পাশাপাশি এসে যায়। এদের একটা বিষয় মা-মুরগি আর তার ছোট্ট ছানাপোনার দল। শহরের একেবারে কেন্দ্রে না হলেও একটু গাঁ-গঞ্জে পথের পাশেই এ-দৃশ্য নজরে পড়বে। যেখানে মা-মুরগি দ্রুত পায়ে মাটি থেকে খাবার খুঁটে খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে। আর তার পায়ের কাছে পশমের নরম গোলার মতো তার ছোট ছোট ছানা এদিক থেকে ওদিকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। যেন কারো আঁচল থেকে অজান্তে কখন গড়িয়ে পড়েছে কতগুলো উলের বল। দম দেওয়া খেলনার মতো ত্রস্ত তাদের ভঙ্গি – সেদিকে একবার না তাকিয়ে পারা যায় না। আবার কোথাও দেখা যাবে মুরগি-গিন্নি ভারিক্কি চালে মাটিতে থেবড়ে বসে আছে, আর টুকটুকে লাল ঝুঁটিওয়ালা মোরগবাবুটি তার এপাশ-ওপাশে চড়ে বেড়াচ্ছে, কখনো ডানা ঝাপটে ধুলো ওড়াচ্ছে। এমনসব চেনাশুনো দৃশ্যের কত ছবিতে নন্দলালের চিঠিপত্রের কার্ড ছেয়ে আছে।
নন্দলালের সেই ক্যাটালগখানার পাতা ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ দেখি, তিনটে ছানাসহ এক গর্বিত ‘মুরগি-জননী’র ছবি। আর সে-ছবির নিচে কোণের দিকে, নন্দলাল লিখে রেখেছেন সামান্য দুয়েকটি কথা, সংক্ষিপ্ত কিন্তু অমোঘ। লিখেছেন ‘আমরণ – শিক্ষককেও শিখতে হবে, ছাত্রকেও শিখতে হবে – উভয়কে বাঁচতে হবে। মা নিজেও খায়, বাচ্চাকেও খাওয়ায়।’ কার্ডে আঁকা এই ছবিটির তারিখ ১৭/৪/৫৪। অর্থাৎ নন্দলালের বয়স তখন বাহাত্তর বছর, কলাভবন থেকে অবসর নিয়েছেন তিন-চার বছর আগে। কিন্তু ভাবীকালের শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য সেই চিরকালের ‘মাস্টারমশাই’ নন্দলাল এখানে লিখে রেখেছেন তাঁর অন্তরের অব্যর্থ নির্দেশ। নন্দলাল বরাবর মনে করতেন, ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও কাজের মধ্যে মগ্ন থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর কলাভবনকে কেবল নিয়মের নিগড়ে বাঁধা আর্ট স্কুল হিসেবে গড়ে তুলতে চাননি। চেয়েছিলেন গুরুশিষ্যে মিলে শিল্পের এক প্রাণময় বাতাবরণ তৈরি করতে। তিনি মনে করতেন, শিল্পের পরিবেশ সৃষ্টি করাই শিল্পশিক্ষার প্রকৃত উপায়। নন্দলাল তাঁর সারাজীবনে তো বটেই, এ ব্যাপারে নানান উপদেশও দিয়েছেন। তাঁর মৌখিক নির্দেশ ছাড়া স্পষ্টভাবে লিখেও জানিয়েছেন যে, ‘শিক্ষকদের নিজের নিজের শিল্পসৃষ্টিতে যাতে কোনো বাধা না পড়ে, এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখা’ জরুরি। কখনো বা যথেষ্ট কঠিন স্বরে উচ্চারণ করেছেন –  ‘শিক্ষকদের নিজের কাজ বন্ধ হলে শেখানোর কাজ অঙ্গহীন বা প্রাণহীনই হয়ে পড়বে।’ কিন্তু আজকের শিক্ষকেরা কতজন এই কথা মনের মধ্যে গেঁথে রাখেন। ছাত্রদের জন্য কাজের মধ্যে দিয়ে নিজেদের তৈরি রাখেন – এমন শিক্ষকের সংখ্যা আজ বোধকরি নেহাতই গুটিকয়।
আবার এ-কথাও ঠিক যে, আজ কি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে না গুরুশিষ্যের øেহ-প্রীতি-শ্রদ্ধার সেই অমল সম্পর্কটাই?
এই সিরিজের আরো দুয়েকটা স্কেচের কথা এখানে বলা যেতে পারে। একটা তো বেশ ইনটারেস্টিং বিষয় অবলম্বনে আঁকা; সাপের ব্যাঙ ধরা। তুলনায় একটু ডেকোরেটিভ ধরনের এই ছবিতে নন্দলালের সুতীক্ষè অবজারভেশন চোখে পড়বে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাঙের পিছনের দুটো পা এবং শরীরের কিছুটা অংশ সাপের মুখের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ব্যাঙের গোলাকার বড়সড় শরীরের আয়তনকে গিলতে গিয়ে সাপের হাঁকেও হতে হয়েছে যথেষ্ট প্রসারিত। খাদ্যসহ খাদকের দীর্ঘ বক্র শরীরটি লতার আকর্ষের মতো কিছুটা পাক খেয়ে উঠেছে। আকারে ছোট হলেও তুলনায় একটু ধরে আঁকা এই স্কেচটিতে বিষয় ও বিন্যাসে যথেষ্ট টেনশন তৈরি হয়েছে। একদিকে বাঁচার মরিয়া চেষ্টায় ব্যাঙ তার নিজের শরীরকে যথাসম্ভব ফুলিয়ে বড় করে তুলেছে, আর সাপও তার খাবারকে কোনোমতে ছাড়ছে না। সব মিলে বেশ একটা টানটান উত্তেজনাময় পরিস্থিতি, যেন এক রুদ্ধশ্বাস চলচ্চিত্র। কালিকলমের ছোট ছোট আঁচড়ে কী আশ্চর্যভাবে আঁকা হয়েছে অতিরিক্ত চাপে বিস্ফারিত সাপের মুখের হার না-মানা অসাধারণ ভঙ্গিটি। সাপের মাথার সেই প্রসারিত ডিটেল-ড্রয়িংটি দেখে মনে হয়, এ যেন কোনো গহনার অভিনব নকশা। কোনো স্বর্গীয় সুন্দরীর মৃণালভুজে সাজিয়ে দেওয়া এক অপূর্ব বাজুবন্ধ। সাপের ফণার গা হিম করা ভয়ানক ভাবকে নন্দলাল এখানে পৌঁছে দিয়েছেন বিশুদ্ধ সুন্দরের দরজায়। ছবিটির তারিখ একটু আগের, ১২/১০/৩৭। শুধু তাই নয়, শিল্পী এখানে কেবল ছবি এঁকেই ক্ষান্ত হননি, ছবির ওপরে কলম দিয়ে লিখে রেখেছেন তাঁর সংক্ষিপ্ত সরস মন্তব্য। সেই মুহূর্তে প্রবল ধস্তাধস্তি করে চলা ব্যাঙ আর সাপের মনের কথা। ছবির পটে গড়ে ওঠা টানটান নাটকীয় দৃশ্যে এ যেন দুই জীবনপণ অভিনেতার নিঃশব্দ স্বগতোক্তি – ‘বাঁচবি ত নড়িস না, খাবি ত ছাড়িস না’।
আর একটি ছবি। খাঁ খাঁ দুপুরের দৃশ্য, শহরের জানালা-দরজা আঁটোসাঁটো করে বন্ধ করা। পথের মোড়ে কোনো লোকজন নেই। আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে শুধু কয়েকটা পাখি, সুনসান দুপুরে সে হয়তো চিলের ঝাঁকও হতে পারে। এহেন নিস্তব্ধ দুপুরে দরজায় হেঁকে চলেছে এক ফেরিওয়ালা। তার মাথায় মস্ত ঝুড়িতে সাজানো রয়েছে পসরা। কাঁধে চাদর জড়ানো খাটো ধুতি পরিহিত সেই মাঝবয়সী ফেরিওয়ালার পায়ের কাছে লেখা রয়েছে ‘জয় নগরের মোয়া, পাটালি, নলেন গুড়।’ এ ছবির তারিখ ৯/১২/৫৫। ডিসেম্বরের আলগা শীতের নির্জন দুপুরে আগাম উৎসব উপলক্ষে ফেরিওয়ালার লোভনীয় বেসাতি। ভাবতেই মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ রেখানির্ভর ভার্টিক্যাল কম্পোজিশনের এ-ছবিতে পটের বিভাজন লক্ষ করার মতো। কয়েকটা প্রায় জ্যামিতিক আদলের ছোটবড় আয়তাকার ফর্ম তৈরি হয়েছে চিত্রপট জুড়ে। ধাপে ধাপে সেগুলো আগুপিছু করে স্পেস তৈরি করেছে। ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এই রকম, একটা দোতলা বাড়ির কোনায় এসে রাস্তাটা যেন বেঁকে গিয়েছে বাড়ির পেছনে। একটু দূরে সিঁড়ির ধাপসহ আর একটা বাড়ির সংক্ষিপ্ত আভাস। কেবল রেখার টানে অতি সহজেই ছবিতে এসেছে একটা স্পেসের বিস্তৃৃতি, তৈরি হয়েছে আশ্চর্য পারসপেক্টিভ। এই কাছে বা দূরের ব্যাপারটা ঘটেছে কেবল রেখার সপাট আঁচড়ে, কোনো টোনাল ভেরিয়েশন ছাড়াই। আর সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকেপড়া, সেই ক্লান্ত ফেরিওয়ালা দর্শকের দিকে কিছুটা পেছন ফিরে প্রায় সমস্ত ছবিজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পোস্টকার্ডে আঁকা নন্দলালের ছবিগুলোর সঙ্গে এই ছোট্ট ছোট্ট মন্তব্য আলাদা মাত্রা যোজনা করে। স্কেচের রেখার সঙ্গে এখানে মিশে থাকে রসিকতায় মাখানো নন্দলালের মনের আর একটা স্তর – যার হদিস তাঁর মূলধারার ছবিতে সেভাবে পাওয়া যায় না। অবশ্য তার কারণ আছে, এই ছবিগুলির মেজাজ অনেকটাই প্রাইভেট, এর সঙ্গে জড়ানো আছে প্রেরক আর প্রাপকের কত নিজস্ব কৌতুক, কোড-ল্যাঙ্গুয়েজের কিছু আলাদা সুর। এ-ছবির প্রাপকেরা সকলেই তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে গাঁথা। তাই এর মধ্যে ধরা আছে এক অন্য নন্দলাল।
যেমন অন্য একটি ছবিতে দুটি গুবরেপোকা তাদের খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে – সেও এক অভিনব দৃশ্য। গুবরেপোকার শক্তপোক্ত পাখনায় কালোর প্রায় কাছাকাছি ঘন বাদামি রঙের পোচ লাগানো। আর চোখের ওপর দুটো ছোট্ট লাল ডট দিয়ে লাল ও কালোর একটা বৈপরীত্য সূচিত হয়েছে। হাবেভাবে একরোখা জেদি ছটফটানি ভাব এসেছে ছবিতে। পেছনের পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে তাদের খাবার নিয়ে যাওয়ার এ-এক সচল দৃশ্য। নড়াচড়ার ভঙ্গিটাও এখানে স্পষ্ট অনুভব করা যায়। পায়ের ছটফটানি আর খাবার নিয়ে টানাটানির এমন ছবি আর কোনো চিত্রীর নজরে পড়েছে কিনা জানি না। এ বিষয়ে অন্য কারো ছবি আমাদের সেভাবে মনে পড়ে না। অবশ্য আমরা জানি, নন্দলালের এই দৃষ্টি, ভাবনা ও মেজাজ অনেকটাই দূরপ্রাচ্যের সফল উত্তরাধিকার। যা তিনি পরবর্তীকালে তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। এই বিরল ছবিটির তারিখ : ৩/১২/৫৩। এখানেও শিল্পী লিখে দিয়েছেন তাঁর সহজাত রসিকতা মাখা এক ছোট্ট মন্তব্য। প্রথিতযশা শ্বশুরমশাই তাঁর নিজেরই জন্মদিনে ছবি আঁকা এই কার্ড পাঠিয়েছেন তাঁর কনিষ্ঠ জামাতা, বিশ্বভারতীর ইঞ্জিনিয়ার শ্রী সেবক সেনকে। আর লিখেছেন, ‘সেবক, যে যন্ত্রপাতি নিয়ে এঁরা কাজ করছেন, তুমি বলতে পারবে তার নাম।’ শিল্পী শ্বশুর আর প্রযুক্তিবিদ জামাইয়ের মধ্যে এ এক নিভৃত কথোপকথন।
আবার অন্য একটা ছবিতে দেখছি, জল থেকে নিঃশব্দে ভেসে উঠেছে এক হিংস্র দাঁতওয়ালা কুমির। পাথরের ওপর প্রায় ঘাপটি মেরে বসে আছে সে। আর তার পিঠের ওপর একটা ছোট্ট চিহ্নসহ নন্দলাল লিখেছেন ‘একটা প্রকাণ্ড কুমির ওঁৎ পেতে বসে আছে’। এ ছবিটিও তাঁর জামাতা শ্রী সেনকে পাঠানো হয়েছে। যদিও নন্দলালের কলমে এমন জীবজন্তুর ছবি সহজেই প্রাপণীয়। কিন্তু এখানে লক্ষ করার মতো তার পিঠে আঁকা চিহ্নটি। যা নিঃসন্দেহে বিরল। একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, কুমিরের পিঠে আঁকা সেই ছোট্ট চিহ্নটি ব্রিটিশ পতাকার ছবি। শিল্পী এখানে কুমিরটিকে দেখিয়েছেন ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রতীক হিসেবে। নন্দলালের স্বদেশপ্রীতি আর প্রবল জাতীয়তাবোধের কথা আমরা জানি। স্বদেশিয়ানার গভীরে অবগাহিত নন্দলাল বিলেতি বর্জনের ক্ষেত্রে এমন একটা স্তরে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে তেলরং দিয়ে ছবি আঁকাতেও তাঁর বিশেষ আপত্তি ছিল। দেশি রং, দেশি আঙ্গিক ও ভাবনাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। শিক্ষক হিসেবে তাঁর ছাত্রছাত্রীদেরও সেই পথেই অনুপ্রাণিত করেছেন। শিল্পীর সেই তীব্র জাতীয়তাবাদী আদর্শের ছোট্ট চিহ্ন ধরা আছে কুমিরের এই স্কেচটিতে। ভারতবর্ষকে কীভাবে ব্রিটিশরাজ চুপিসারে গ্রাস করেছে, নন্দলালের আঁকা কুমির এখানে তারই প্রতীক। ছবির তারিখ : ১৮/১০/৪৬। অর্থাৎ সেদিক থেকে বিচার করলে, দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পূর্বে এটি অঙ্কিত।
একটি কার্ডে আঁকা হয়েছে অনেকগুলি মাছের ছবি। অধিকাংশ মাছই হয়তো আমাদের চেনা, কিন্তু নন্দলালের কলমে প্রতিটি মাছের ভিন্ন-ভিন্ন আকারগত বৈশিষ্ট্য এমন সহজে ফুটেছে – তা বলবার নয়। পুনরায় বলতে হয়, নন্দলালের তীক্ষè অবজারভেশন আর তা প্রকাশের এমন অনায়াস ভঙ্গি সহজে নজরে পড়ে না। মাছগুলো এঁকে তার পাশে নাম লিখে দিয়েছেন : ‘মৌরলা, টেঙ্গরা, চিংড়ি, ন্যাদস, পাপদা, ভ্যাদা, পারসে।’ ছবিটি মূলত বিবরণধর্মী বা পরিচয়সূচক হলেও কখনই তা বিজ্ঞান বইয়ের নি®প্রাণ অলঙ্করণ হয়ে ওঠেনি। নন্দলালের হাতে তা অবশ্য কোনোমতেই হওয়া সম্ভব নয়।
আর একটি ছবির কথা বলে শেষ করি। কনিষ্ঠ কন্যা যমুনাকে লেখা পোস্টকার্ডের পেছনে একটি ছোট্ট স্কেচ, ছোট কিন্তু ডিটেইল। একজন মোটাসোটা ভদ্রলোক যন্ত্রচালিত প্রকাণ্ড সাইকেলের আরোহী, বেশ গতি ও গর্জনের সঙ্গে ছুটেছে তার সেই দ্বিচক্র যান! আরোহীর মনোযোগী দৃষ্টি তার গাড়ির হাতলের প্রতি নিবদ্ধ। কলমের ক্রিস-ক্রস আঁচড়ে আরোহী আর যন্ত্রের ধস্তাধস্তির আবহটি এখানে বেশ স্পষ্ট ধরা পড়েছে। ছবির প্রেক্ষাপটে একটু দূরে কলাভবনের সম্মুখভাগ। ধাপে-ধাপে সেখানে উঠেছে কয়েকটা সিঁড়ি, আর দাওয়ায় ঝুলছে গোলাকার এক ঘণ্টা – যা ছিল একদা কলাভবনের নিয়মানুবর্তিতার অন্যতম বাহক। ছবির এক পাশে লেখা হয়েছে ‘কলাভবনে নতুন এনার্জি ইনট্রোডিউস করা হয়েছে।’ এ-ছবির নেপথ্যে নিশ্চয়ই কোনো গল্প লুকোনো আছে, যা আজকে অনুমান করা তেমন সহজ নয়। নন্দলালের এই কার্ডের ছবির সিরিজে এমন ছবিও চোখে পড়ে, যেখানে চিত্রী কোনো            মন্তব্য লেখেননি, এমনকি রাখেনি স্বাক্ষরটুকুও। তবে এ-জাতীয় ছবির সংখ্যা বেশি নয়। যেমন একটি ছবিতে দেখা যায়, ঘাসের ডগায় যেন এক ধ্যানমগ্ন মক্ষিকা। ক্যালিগ্রাফির ঢঙে আঁকা তুলির সরস টানে এ-সজীব মুহূর্ত ক্ষণিকের জন্য মনকে স্তব্ধ করে দেয়। সাদা কাগজের পটে সংক্ষিপ্ততর রেখার আঁচড়ে এখানে বলা হয়ে গেছে শিল্পীর অনেকটা কথা।
কিন্তু চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে আঁকা ছবির এ-মালাকে আজ কীভাবে দেখবো আমরা! এরা কি কেবল প্রকৃতির অমোঘ অনুকরণ, ফটোগ্রাফেরই নামান্তর। না, তা কখনো নয়। রবীন্দ্রনাথ একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন – ‘ফটোগ্রাফের মধ্যে সব আছে, কিন্তু আর্টিস্টের ছবিতে সব নেই’, আরো বলেছিলেন, শিল্পীর ছবিতে ‘যে ফাঁকা জায়গা থাকে সেইখানে রসজ্ঞের মন কাজ করিতে পারে।’ কবির সেদিনের কথা আজ অবশ্য তেমনভাবে খাটে না। ফটোগ্রাফের দিকেও আজকে তাকাতে হয় অন্য দৃষ্টিতে। ফটোগ্রাফ এখন আর কেবল তথ্য সরবরাহ করে না। আলোকচিত্র তার আর্টিস্টিক উচ্চতায় এক ভিন্নমাত্রায় পৌঁছেছে – যা কলাশিল্পেরই আর একটি মাধ্যমবিশেষ। কিন্তু নন্দলালের এই ছবি, এও কি শুধু খবরের জোগান দেয়। আজকের শিল্পীরা কি নন্দলালের এসব ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ‘পুরনো’ ‘সেকেলে’ বলে পাশ কাটিয়ে যাবেন? বলবেন, আধুনিক জীবনের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। সত্যিই কি আজকের জীবন থেকে সেকালের যোগ একেবারে ছিঁড়ে গিয়েছে। এর থেকে আজকের শিল্পীর গ্রহণীয় কিছুই নেই। ফুল-মাটি-গাছ-পাখি এগুলোর কোনো ভূমিকাই নেই আজকের দিনে। সে না হয় বাদ রইলো। কিন্তু ছবির সেই মূল উপাদান : রেখা আকার রং, যেগুলো বাদ দিয়ে ছবি আঁকা যায় না। তারাও কি অনাহূত পড়ে থাকবে শিল্পীর স্টুডিওর বাইরে? আমরা কি তবে এখানে নতুন আর নবীন, সাম্প্রতিক আর আধুনিক এই নিয়ে তর্কে মেতে উঠবো! শিল্প কি তবে কেবল যুক্তিতর্ক আর তত্ত্ব, অন্তরের ভালোবাসা সেখানে নির্বাসিত? সমস্ত জগৎ আজ আমাদের কোলের কাছে এসে পড়ায় পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের শিল্পকলা যেন একই ছাঁচে গড়ে উঠতে চলেছে। ক্রমশ কি মুছে যাবে দেশকাল ঘিরে শিল্পীর আইডেনটিটি? নাকি আবার গড়ে উঠবে সম্পূর্ণ এক নতুন শিল্প-আন্দোলন?