‘নবনীত’ এবং ’ননী’  বনাম ‘মাখন’

বাংলা ভাষায় শব্দ কতগুলি তাহার কোনো হিসাব  বিশেষ নাই। অভিধানের শব্দ গুনিয়া শব্দ সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা করা চলে বটে কিন্তু তাহা নির্ভরযোগ্য হইবে না। ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি ভাষায় শব্দভা-ার রহিয়াছে। অভিধান প্রণয়নকারীরা শব্দভা-ার ঘাঁটিয়া অভিধানের জন্য শব্দ চয়ন করিয়া থাকেন। বাংলা ভাষায় অনেক কয়টি অভিধান থাকিলেও শব্দভা-ার গঠনের কাজটি বাকী রহিয়াছে। সে যাহাই হউক বাংলা অভিধানের সকল শব্দের সহিত কার্যত আমাদের পরিচয় নাই, প্রয়োজন মতো আমরা অভিধান খুলিয়া দেখিয়া লই। তবে দৈনন্দিন যোগাযোগে আমরা যে সকল শব্দ ব্যবহার করি – ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে অনুমিত হয় – তাহার সংখ্যা ৩ হইতে ৪ হাজারের অধিক হইবে না। অন্যদিকে অভিধানে অনুপস্থিত অথচ বিগত দেড় শতাধিক বৎসরে বিরচিত লেখ্যসাহিত্য ব্যবহৃত বর্তমান এইরূপ শব্দের সংখ্যাও অগ্রাহ্য করিবার মত নহে।

অভিধান খুলিলে নতুন শব্দের সহিত পরিচয় ঘটে। তাহার অর্থ ও ব্যাখ্যাও জানা হইয়া যায়। পুস্তকাদিতেও হর-হামেশা নতুন শব্দের মুখোমুখি হইতে হয় যাহার অর্থ অজানা। ‘নবনীত’ এই রূপ একটি শব্দ। কী রূপে ‘নবনীত’ শব্দটির সহিত পরিচয় ঘটিল প্রথমে তাহা বর্ণনা করিব; অতঃপর শিরোনামীয় ‘ননী বনাম মাখন’ প্রসঙ্গের অবতারণা করিব। এই বর্ণনাটি প্রাসঙ্গিক কারণ লেখকের শব্দপ্রয়োগের মধ্যে ইহার অর্থের ইঙ্গিত থাকিয়া যায় যাহা কোন অভিধান সংকলয়িতার জন্য প্রণিধানযোগ্য বটে।

মালঙ্গপলস্নী নিবাসিনা শ্রীমোহিনীমোহন লাহিড়ী বিদ্যালঙ্কারেণ বিরচিত শ্রীরাধাপ্রেমামৃতং সংস্কৃত ভাষার রচিত। ইহা চারি খ– ভগবান্ যশোদানন্দন শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলাকর্মের উপাখ্যান বটে। শ্রীরামনারায়ণ বিদ্যারত্ন গ্রন্থটির সকল শেস্নাক বিশেষ সতর্কতার সহিত বঙ্গভাষায় অনুবাদ করিয়াছেন। শ্রীরামদেব মিশ্র বহরমপুরের রাধারমণ যন্ত্রে মূলসহ বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করিলে গ্রন্থটি বঙ্গভাষী পাঠকের অধিগম্য হয়। প্রকাশকাল ১৩১৪। অবিলম্বে সরস গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছিল। গ্রন্থটি সরল – বিষয়বস্ত্তর কারণে ইহা পাঠে পাঠক বিশেষ বিনোদন লাভ করিবেন তাহাতে সন্দেহ নাই। কৃশতনু উপাখ্যানে প্রথমতঃ বস্ত্রোপহরণ খ-, দ্বিতীয়তঃ ভারখ-, তৃতীয়তঃ নৌকাখ- ও চতুর্থতঃ দানখ- রহিয়াছে।

দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ ভারখ– শ্রীরাধার দধিবিক্রয় সংক্রান্ত ক্রীড়ার বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে। দধি বিক্রয়ার্থে শ্রীরাধা মথুরানগরী যাইতেছেন। দধির ভার বহনের জন্য তিনি শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করিয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণ অনুরোধ রক্ষা করিয়া ভারসমূহ স্বীয় স্কন্ধে গ্রহণ করিয়াছেন। অচিরেই শ্রীরাধা লক্ষ্য করিলেন শ্রীকৃষ্ণ অন্যান্য ভারবাহকের পশ্চাৎবর্তী হইয়া পড়িয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণের এবম্বিধ ধীরগমনে মথুরার হাটে পৌঁছাইতে শ্রীরাধার বিলম্ব না হইয়া যায় না। ফলস্বরূপ ইত্যবসরে অন্যরা মথুরা পৌঁছাইয়া ঘোল প্রভৃতি বিক্রয় করিয়া ফেলিবে। এই চিন্তায় বিচলিত হইয়া শ্রীরাধা কহিলেন, ‘হে শ্রীকৃষ্ণ! বিলম্ব করিতেছ কেন? – নবনীত ও ঘোল সুলভ পাইয়া লোকসকল ক্রয় করিয়া ফেলিলে আমার দ্রব্যসত্ত্বেও সুলভক্রেতাও দুর্লভ হইবে অর্থাৎ ক্রেতা মিলিবে না। অতএব দয়া করিয়া
মথুরানগরীতে সত্বর গমন কর, যাহাতে আমি শীঘ্র গিয়া তক্রাদি বিক্রয় করিতে পারি।’ ইহার সংস্কৃত রূপটি নিম্নরূপ :

…  ততঃ শ্রীরাধা। কিং বিলন্বসে, পরঞ্চ –

ত্রীতে জনেন সুলভে নবনীততক্রে

ক্রেতা পুনঃ সুলভ-দুর্লভ এব ভাবী

তদগচ্ছ বৎসলতয়া মথুরানগর্য্যাং,

তক্রাদিবিক্রয়ণমাশু যথাভ্যুপৈমি

ইতিপূর্বে ‘নবনীত’ শব্দটি পঠিত কোনও রচনায় দৃষ্টিগোচর হয় নাই; ফলতঃ শব্দটির অর্থ জানা ছিল না। কৌতূহলী হইয়া অভিধানের দ্বারস্থ হইলাম। ‘নবনীত’ শব্দটি মূলতঃ সংস্কৃত হইলেও শৈলেন্দ্র বিশ্বাস কর্তৃক সংকলিত সংসদ বাংলা অভিধানে (১৯৫৭ খ্রি.) ইহার নিম্নরূপ হদিশ মিলিল :

নবনী, নবনীত : বি. ননী (নবনীত কোমল)। [সং. নব + √নী + অ, নব+ √নী + ত]।

অর্থাৎ ‘নবনীত’ হইল অর্থ ‘ননী’। ‘ননী’ এবং বিশেষ করিয়া ‘ননীর পুতুল’ উভয় শব্দের সহিত আকৈশোর পরিচয় থাকিলেও ইহাদের আভিধানিক অর্থ কদ্যপি ঘাঁটিয়া দেখি নাই; প্রয়োজনও অনুভূত হয় নাই। এই সূত্রে উলেস্নখ করিয়া রাখিতেছি যে, ‘ননী’ ও ‘ননি’ উভয় বানানই বাঙ্গালার লেখকেরা নির্বিচারে তাহাদের রচনায় ব্যবহার করিয়াছেন, অভিধানসমূহেও তদ্রূপ প্রতিফলন রহিয়াছে। তবে অত্র রচনায় দীর্ঘ ঈ-কার ব্যবহারপূর্বক ‘ননী’ বানানটি ব্যবহার করা হইল।

শৈলেন্দ্র বিশ্বাস অবহিত করিলেন ‘নবনীত’র অর্থ ‘ননী’। কৌতূহল  অধিকতর কৌতূহলের জন্ম দিয়া থাকে : অভিধানে ‘ননী’ শব্দটির অর্থ কী লেখা হইয়াছে ভাবিয়া কৌতূহল হইল। অনেক ক্ষেত্রে অজানা শব্দের অর্থ সন্ধান করিতে গিয়া অভিধানে সম্পূর্ণ অধিকতর অচেনা শব্দের মুখোমুখি হইতে হইয়াছে। উক্ত সংসদ বাংলা অভিধানে যাহা পাওয়া গেল তাহা নিম্নরূপ :

ননি, ননী : বি. দুধ থেকে তৈরী স্নেহপদার্থ, মাখন। [সং : নবনীত]।

অর্থাৎ ‘ননী’ দুগ্ধ হইতে উৎপন্ন স্নেহপদার্থ মাত্র। অধিকতর যাহা প্রতীয়মান হইল তাহা এই যে ‘ননী’ এবং ‘মাখন’ অভিন্ন। এইখানেই খটকার সূত্রপাত : ননীই তবে মাখন? মাখনেরই অপর নাম ননী? নানাজনের সহিত আলোচনায় প্রতীয়মান হইল কেবল আমিই নহি যাহাকেই জিজ্ঞাসা করি না কেন ‘ননী’ ও ‘মাখনের’ অভিন্নতা লইয়া খটকার মীমাংসা হয় না। বরং যাহারা ননী ও মাখনের সঠিক অর্থ সম্পর্কে অবহিত বলিয়া ধারণা পোষণ করিতেন তাহাদের মনেও সন্দেহ জাগ্রত হইল। ব্যক্তিগত সন্দেহ পরিব্যাপ্ত হইল কিন্তু খটকার মীমাংসা হইল না। উপায়ান্তর না দেখিয়া অপরাপর অভিধানসমূহের দ্বারস্থ হইলাম। ননী ও মাখনের সম্বন্ধে বিভিন্ন অভিধানের ভাষ্য নিম্নে লিপিবদ্ধ করিতেছি।

১। শামসুজ্জামান খান : বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। প্রকাশকাল ২০১৬।

ননি = মাখন।

মাখন = দুধ থেকে প্রস্ত্তত স্নেহ পদার্থবিশেষ; ননি।

টীকা : ‘নবনীত’ শব্দটি এই অভিধানে অন্তর্ভুক্ত নাই। ‘ননী’ বানানটি বর্জন করা হইয়াছে।

 

২। সুবলচন্দ্র মিত্র : সরল বাঙ্গালা অভিধান, নিউ বেঙ্গল, কলকাতা। প্রকাশকাল ১৯০৬।

ননি, ননী = মাখন।

নবনীত = ননী, মাখন।

মাখন, মাখম = নবনীত, ননী।

 

৩। রাজশেখর বসু : চলন্তিকা, এমসি সরকার অ্যা- সন্স। প্রকাশকাল ১৯৩০।

ননি, ননী = নবনীত, মাখন।

মাখন, মাখম = দুগ্ধজাত স্নেহদ্রব্য, নবনী, butter।

নবনী, নবনীত = ননি, মাখন।

 

৪। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় : বঙ্গীয় শব্দকোষ, সাহিত্য অকাদেমি, কলকাতা। প্রকাশকাল ১৩৪১ বঙ্গাব্দ।

ননী = মাখন, তাজা মাখন।

মাখন = নবনীত, নোনী, লোণী, লোনীত, ননী।

নবনীত = দুগ্ধসারভেদ, মাখন।

 

৫। আশুতোষ দেব : শব্দবোধ অভিধান, দেব সাহিত্য কুটির প্রা. লি., কলকাতা। প্রকাশকাল ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ।

ননি = মাখন।

মাখন = নবনীত, ননি, butter।

নবনীত = ননি, মাখন।

 

৬। শৈলেন্দ্র বিশ্বাস : সংসদ বাংলা অভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। প্রকাশকাল ১৯৫৭।

ননি, ননী = দুধ থেকে তৈরি স্নেহপদার্থ, মাখন।

নবনী, নবনীত = ননি (নবনীতকোমল)।

মাখন, মাখব = দুগ্ধজাত স্নেহপদার্থবিশেষ, নবনী, নবনীত, ননি।

 

৭। কাজী আবদুল ওদুদ : ব্যবহারিক শব্দকোষ, প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরী, কলকাতা। প্রকাশকাল ১৯৫৩।

ননি, ননী = নবনীত, কাঁচা দুধের মাখন, মাখন।

মাখন = ননী, butter।

নবনীত = ননী, মাখন।

 

৮। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক : ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

ননি, ননী = কাঁচা দুধের মাখন; মাখন।

মাখন, মাখম = দুধ থেকে উৎপন্ন স্নেহ পদার্থ; ননি; নবনী; নবনীত।

নবনীত = [নবোনি, নবোনিতো] বি ননি; মাখন (বিধাতা বেহেশ্তের নবনী দিয়ে তাঁর সুকুমার দেহটি গড়েছিলেন – শেফ; সে কখন কখন ক্ষীর, সর, নবনীত আমাকে বিনামূল্যে দিয়া যায়-বচ)। – কোমল বিণ মাখনের মতো নরম ( তোমার মতো নবনীত-কোমল মাংসপি- সমষ্টির পক্ষে সেটার অনুভব একেবারে অসম্ভব না হলেও অনেকটা বৈকি – নই)।

{. নব + √ নী + অ (ড) = নবনী; . নব+নীত}

 

৯। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্: বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলা একাডেমি।

ননী = (পাওয়া যায় নাই)।

মাখম্ = মাখন।

টীকা : বোধগম্য কারণে ‘নবনীত’ শব্দটি এই অভিধানে অন্তর্ভুক্ত নাই।

 

১০। জামিল চৌধুরী : শব্দসংকেত, দে’জ বাংলা অভিধান, কলকাতা। প্রকাশকাল ২০০৯।

ননি = মাখন।

নবনীত = মাখন, ননি।

মাখন = নবনী, দুগ্ধজাত স্নেহপদার্থ।

 

১১। আজহার ইসলাম : চলতি বাংলা অভিধান, অনন্যা, ঢাকা। প্রকাশকাল ২০১১।

ননী, ননি = মাখন, cream।

নবনী, নবনীত = ননী, মাখন, cream।

মাখন = দুগ্ধ থেকে তৈরি স্নেহজ পদার্থ বিশেষ, ননী, নবনীত, নবনী, butter।

টীকা : লক্ষণীয় যে ননী’র ইংরেজী cream এবং মাখনের ইংরেজী butter লেখা হইয়াছে।

 

১২। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী : বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ভাষাবিন্যাস, কলকাতা। প্রকাশকাল ১৪১৭ বঙ্গাব্দ।

ননী = মাখন, তাজা মাখন।

মাখন =  ননি

নবনী, ননী, নবনীত = নবোদ্ধৃত, দুগ্ধসারভেদ, মাখন।

 

১৩। বিজিতকুমার দত্ত ও অন্যান্যরা : আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান, পশ্চিম বাংলা আকাদেমি, কলকাতা। প্রকাশকাল ১৯৯৯।

ননি = (<সং নবনীত) বি-মাখন [ননি থেকে ঘি তৈরী হয়]

মাখন, মাখম =  (< সং ম্রক্ষণ) বি-দুগ্ধজাত স্নেহজাত পদার্থ, নবনীত, ননী [মাখনের মতো নরম]

নবনী, নবনীত =  <সং বি-ননী, মাখন [চারিবেদ দধি বাগবত নবনীত – বৃন্দাবনদাস]

 

১৪। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস : বাঙলা ভাষার অভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। প্রকাশকাল ১৯১৭।

ননি, ননী = কাঁচা বাসী দুধের উপর ঠান্ডা লাগিয়া সর পড়িলে সেই সরজাত স্নেহ পদার্থ; দুগ্ধজাত মাখন; ঘোল মন্থনজাত তৈলময় অংশ।

[দ্রঃ – মতান্তরে কাঁচা দুধ হতে উৎপন্ন স্নেহ ‘ননী’, দধি হতে উৎপন্ন স্নেহ ‘মাখন’। কিন্তু অসমীয়া ভাষায় দুগ্ধজাত স্নেহের নাম ‘মাখন’ (হেমকোষ)। পৃ ১১৬২]

নবনী, নবনীত = দধি মন্থনজাত স্নেহ, ননী, মাখন।

মাখন, মাখম = দুগ্ধজাত স্নেহপদার্থ; নবনীত।

[দ্রঃ – মাখন কাঁচা দুধ হ’তে এবং নবনীত বা ননী দধি হ’তে উৎপন্ন হয়। পৃ ১৭৪৪]

টীকা : লক্ষণীয় অসমীয় ভাষায় মাখনের অর্থ কী কারণে প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হইয়াছে তাহা স্বতঃস্ফুট নহে।

 

১৫। শ্রীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি : বাঙ্গালা শব্দকোষ। প্রকাশকাল ১৩২২ বঙ্গাব্দ।

ননী = দধি হইতে জাত স্নেহ পদার্থ (দুগ্ধ হইতে জাত – মাখন)

মাখন = কাঁচা দুধ হইতে উৎপন্ন স্নেহপদার্থ (ননী-দই হইতে জাত)

টীকা : ‘নবনীত’ শব্দটি এই অভিধানে অন্তর্ভুক্ত নাই।

 

১৬। শ্রীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি : বাঙ্গালা শব্দকোষ, ভূর্জপত্র। প্রকাশকাল ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ।

ননী = দধি হইতে জাত স্নেহ পদার্থ (দুগ্ধ হইতে জাত মাখন)

মাখন = কাঁচা দুধ হইতে উৎপন্ন স্নেহপদার্থ (ননী-দই হইতে জাত)

 

উপর্যুক্ত তালিকায় কলকাতার জাতীয় শিক্ষা পরিষদ কর্তৃক পরিকল্পিত ও সংকলিত জাতীয় অভিধান হইতে উদ্ধৃতি প্রদান করা সম্ভব হইল না। উলেস্নখযোগ্য জগন্নাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ইহার ১ম খ- ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হইয়াছিল। পরবর্তী খ-গুলি প্রকাশিত হইয়াছিল কি-না তাহা কেহ নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারিলেন না।

যাহা হউক, এই নিবন্ধের অভীষ্ট তিনটি সমস্যার সমাধান অন্বেষণ :

সমস্যা-১ : ‘ননী’ এবং ‘মাখন’ অভিন্ন পদার্থ কি-না।

সমস্যা-২ : সংস্কৃত শব্দের নবনীত বঙ্গার্থ ‘ননী’ এবং ‘মাখন’ উভয়ই কিনা।

সমস্যা-৩ : ‘ননী’ জিনিসটি দধিজাত না-কি দুগ্ধজাত। অর্থাৎ শ্রীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয়ের প্রদত্ত ব্যাখ্যা সঠিক কি-না।

প্রথমোক্ত ১৩টি অভিধানের ভাষ্য হইতে পাঠক এমত সিদ্ধামেত্ম উপনীত হইবেন যে, ‘ননী’ এবং ‘মাখন’ এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বলিয়া তেমন কিছু নাই – কার্যতঃ যাহাই ননী তাহাই মাখন। উভয়েই বাঙলা শব্দ। তবে ননীর উদ্ভব সংস্কৃত ‘নবনীত’ হইতে আর মাখনের উৎপত্তি সংস্কৃত ‘ম্রক্ষণ’ হইতে। উৎপত্তির পার্থক্য স্বীকার করিলে সরাসরি ননী = মাখন অথবা মাখন = ননী লেখা সুবিবেচনার পরিচয় হয় না। এই স্থলে অভিধান সংকলয়িতার অনুসন্ধানী হইবার সুযোগ ছিল। ইন্দ্রজিত সরকার তাঁহার বাঙলা শব্দের উৎস সন্ধানে গ্রন্থেও কাঙিক্ষত অনুসন্ধিৎসার পরিচয় প্রদান করেন নাই।

জামিল চৌধুরী লিখিয়াছেন ননি = মাখন এবং নবনীত = মাখন, ননি। কী সূত্রে নবনীতের অর্থ মাখন এবং  ননি উভয়ই হইল তাহা কৌতূহলোদ্দীপক। শামসুজ্জামান খানের অভিধানেও ননি = মাখন এবং মাখনকে ‘দুধ হইতে প্রস্ত্তত স্নেহ পদার্থবিশেষ’ বলা হইয়াছে। রাজশেখর বসুও মাখনকে ‘দুগ্ধজাত স্নেহদ্রব্য’ হিসাবে বর্ণনা করিয়াছিলেন। তাঁহার নিকটেও ননী ও মাখনের পার্থক্য বিশেষ ছিল না।

অধ্যাপক সুকুমার সেন তাঁহার ‘বুৎপত্তি-সিদ্ধার্থ’ রচনা শুরু করিয়াছিলেন ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে; ইহার বাংলাকোষ প্রকাশিত হয় ১৯৭১-এ। ইহাতে তিনি ননী শব্দটির অর্থ লিখিয়াছেন ‘কাঁচা দুধের মাখন’। ইহাতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় মাখন ভিন্ন উপায়েও প্রস্ত্তত হইতে পারে। কিন্তু ‘মাখন’ শব্দের উৎপত্তি সম্বন্ধে তিনি বিশেষ আর কোনও উপাত্ত সংযোজন করিয়া যান নাই। কাজী আবদুল ওদুদও ননীকে ‘কাঁচা দুধের মাখন’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকও তাঁহার অভিধানে অভিন্ন ভাষ্য উপস্থাপন করিয়াছেন। ইহার অর্থ এই যে ‘ননী’ ও ‘মাখন’ সমস্থানীয় বটে, তবে ননী কাঁচা দুগ্ধ হইতে প্রস্ত্ততকৃত। কিন্তু তিনি মাখনের উৎস বর্ণনা করেন নাই।

স্মরণীয় যে, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিয়াছেন : ননী = মাখন, তাজা মাখন। কিন্তু ‘তাজা মাখন’ বলিতে কী বুঝিতে হইবে তাহা পরিষ্কার হয় নাই, বরং তাজা মাখনের বিপরীতার্থক ‘পাকা মাখন’ বা ভিন্নরূপ কোনও প্রকার মাখন আছে কি-না সেই প্রশ্ন আসিয়া যায়। মাখন কি তবে এক বিশেষ প্রকারের ননী? – এই প্রসঙ্গে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী একটি মীমাংসামূলক ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। তাঁহারা লিখিয়াছেন : ‘দুধ জমালে তা দধিতে পরিণত হয়ে যায়। সেই দধিকে মন্থন করলে একদিকে ঘোল ও অপরদিকে মাখন বেরিয়ে আসে। সেই মাখনকে অগ্নিতে পাক করলে ঘৃত পাওয়া যায়।’ – কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর কৃপায় মাখনের উৎসের সহিত ঘোল ও ঘৃতের উৎসও মুফতে লভ্য হইল।

পাঠক ইতোমধ্যে শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এবং শ্রীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি উভয়েরই অভিধানে ননী ও মাখনের উৎপত্তি সূত্রীয় পার্থক্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করিয়াছেন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙলা ভাষার অভিধান হইতে পাঠক জানিয়াছেন ‘মাখন কাঁচা দুধ হইতে’ এবং ‘নবনীত বা ননী দধি হইতে’ উৎপন্ন হয়। অতএব মাখন = ননী সমীকরণ লইয়া যে খটকার সৃষ্টি হইয়াছিল তাহার কিঞ্চিৎ অপনোদন হইবে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁহার বাঙলা ভাষার অভিধান প্রকাশ করিয়াছেন ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে; ইহাতে ১ লক্ষ ১৫ হাজার শব্দ স্থান লাভ করিয়াছে। দেখা যাইতেছে, প্রায় একশত বৎসর পূর্বে ১৯১৭-এ প্রকাশিত হইলেও পরবর্তীকালের অভিধান প্রণেতারা ইহার শরণাপন্ন হন নাই। ফলে মাখন = ননী সমীকরণটি যথাযথ না হইলেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত হইয়া রহিয়াছে। হয়তো তাহাতে উত্তমই হইয়াছে; শব্দের অর্থ করিতে গিয়া অনর্থ ঘটিয়া যায় নাই।

শ্রীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি জন্মসূত্রে ও অভিধান রচনায় শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অগ্রজ। তিনি খ্রিষ্টীয় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দেই লিখিয়াছেন, ‘ননী’র উৎস দধি’ এবং ‘মাখনের উৎস দুগ্ধ’। অনুমিত হয় শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এই দুইটি শব্দের অর্থ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অগ্রজ শ্রীযোগেশচন্দ্র রায়কেই যাচাই ব্যতিরেকে অনুসরণ করিয়াছেন। এই অনুসরণ তাঁহাকে ভ্রমাত্মক পথে পরিচালিত করিয়াছে। পাঠকের সুবিধার্থে পুনরায় শ্রীযোগেশচন্দ্র রায় মহাশয়ের বয়ান উদ্ধৃত করিতেছি। বাঙ্গালা শব্দকোষ-এ তিনি লিখিয়াছেন :

ননী = দধি হইতে জাত স্নেহ পদার্থ (দুগ্ধ হইতে জাত মাখন)

মাখন = কাঁচা দুধ হইতে উৎপন্ন স্নেহপদার্থ (ননী দই হইতে জাত)

অভিধানে ননী ও মাখনের অর্থ সুস্পষ্ট করিতে ইহাদের উৎপত্তিগত বিভেদ আবশ্যিক বটে কিন্তু বিদ্যানিধি মহাশয় এইখানে বাস্তবের বিপরীত বয়ান দিয়া ফেলিয়াছেন যাহা অদ্যাবিধ অসংশোধিত রহিয়া গিয়াছে। তাঁহার ভাষ্যে ননী দধি হইতে জাত এবং  মাখন কাঁচা দুধ হইতে উৎপন্ন। কিন্তু বাস্তব এই যে, কাঁচা দুগ্ধ মন্থন করিলে ননী লাভ হইয়া থাকে। কাঁচা দুগ্ধ মন্থন করিলে মাঠা পড়িয়া থাকে এবং ননী উৎপন্ন হইয়া ভাসিয়া উঠে। অন্যদিকে দধি মন্থন করিলে মাখন উৎপন্ন হয় এবং ঘোল পড়িয়া থাকে। এই মাখন আগুনে জ্বাল দিয়া ঘৃত প্রস্ত্তত করা হয়। এই সূত্রে পাঠকের সুবিধার্থে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী প্রদত্ত ব্যাখ্যাখানা পুনরুক্ত করা হইল। তাহাদের ভাষ্য হইল : ‘দুধ জমালে তা দধিতে পরিণত হয়ে যায়। সেই দধিকে মন্থন করলে একদিকে ঘোল ও অপরদিকে মাখন বেরিয়ে আসে। সেই মাখনকে অগ্নিতে পাক করলে ঘৃত পাওয়া যায়।’ এই বর্ণনা সঠিক। সুতরাং অভিধানের জন্য সঠিক ভাষ্য নিম্নরূপ হইবে বলিয়া প্রস্তাব করা চলে :

ননী = একরূপ মাখন যাহা কাঁচা দুধ হইতে প্রস্ত্তত স্নেহমূলক পদার্থ।

মাখন = দধি মন্থনক্রমে উৎপন্ন স্নেহমূলক পদার্থ।

সম্প্রতি টাঙ্গাইল এবং পাবনার কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ ঘোষের সঙ্গে আলোচনাক্রমে বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হইয়াছে। উপরন্তু ইহার সমর্থনে দীর্ঘকাল পূর্বে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে বিপিনবিহারী সেন কর্তৃক লিখিত একটি প্রবন্ধ হইতে উদ্ধৃতি দিতেছি। ভারতবর্ষ পত্রিকার বৈশাখ ১৩২২ (২য় বর্ষ ২য় খ- ৫ম সংখ্যা পৃষ্ঠা ৭৬৪ হইতে ৭৬৮) সংখ্যায় তিনি ‘দুগ্ধজাত খাদ্য’ শিরোনামীয় প্রবন্ধে লিখিয়াছিলেন :

মাখন – দুগ্ধের মেদময় অংশকে মাখন বলে। যাবতীয় স্তন্যপায়ী জীবের দুগ্ধ হইতেই মাখন প্রস্ত্তত হইতে পারে। মেষীর দুগ্ধ হইতে সবর্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণে মাখন পাওয়া যায়; তাহার নিম্নে ছাগদুগ্ধ। ঘোটকীর দুগ্ধে মাখনের অংশ সবর্বাপেক্ষা কম। আমরা যে সমুদায় দুগ্ধ ব্যবহার করি, তাহার মধ্যে গর্দ্দভীদুগ্ধে মাখনের অংশ সবর্বাপেক্ষা কম। সাধারণত:, দুই প্রকারে মাখন প্রস্ত্তত হইয়া থাকে। দুগ্ধ-মন্থন করিয়া যে মাখন পাওয়া যায়,তাহাকে ‘‘দুধের-মাখন’’ বা নবনীত (ননী) এবং দধি-মন্থন করিয়া যে মাখন পাওয়া যায়, তাহাকে ‘‘ঘোলের মাখন’’ বা মাখন বলে।

উপরিউলিস্নখিত শ্রীরাধার দুশ্চিন্তাজাত উক্তিটি এই স্থলে স্মরণ করিতে চাহি। শ্রীরাধা কহিয়াছিলেন : ‘হে শ্রীকৃষ্ণ! বিলম্ব করিতেছ কেন? – নবনীত ও ঘোল সুলভ পাইয়া লোক সকল ক্রয় করিয়া ফেলিলে আমার দ্রব্যসত্ত্বেও সুলভক্রেতাও দুর্লভ হইবে অর্থাৎ ক্রেতা মিলিবে না।’ ধারণা করা অসঙ্গত হইবে না যে, নবনীত ও ঘোল – এই দুইয়ের মধ্যে কিঞ্চিৎ সম্পর্ক রহিয়াছে। উভয়েরই উৎস এক বটে। ঘোল আর যাহাই হোক দুগ্ধজাত নহে, দধিজাত খাদ্য। দধি মন্থন করিলে মাখন উৎপন্ন হয় এবং যে তরল পড়িয়া থাকে তাহাই ঘোল। ঘোল দুগ্ধরূপ বলিয়া ‘দুধের সাধ ঘোলে মেটানো’ উক্তি প্রচলিত হইয়াছে। রাজশেখর বসু চলমিত্মকা অভিধানে এই রূপ ব্যুৎপত্তিই নির্দেশ করিয়াছেন। এই বিবেচনায় নবনীত শব্দটির অর্থ মাখন বলিলে সঠিক হইবে।

সার্বিক বিবেচনায় অভিধানে নির্বিচারে ‘নবনীত = ননী, মাখন’ লেখা সমীচীন হইবে না। ননী ও মাখন দুইটি ভিন্ন পদার্থ যাহাদের উৎপত্তিও নিঃসন্দেহে ভিন্ন। উৎপত্তির বিবেচনায় মাখন দধিজাত এবং ননী দুগ্ধজাত। অতয়েব শ্রীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির বাঙ্গালা শব্দকোষ প্রদত্ত বয়ান যেমন সংশোধন করা আবশ্যক তেমনি অন্যান্য অভিধানেও ননী ও মাখনকে সমার্থক গণ্য না করিয়া ভিন্ন ভিন্ন শব্দ হিসাবে উলেস্নখ করা বাস্তবানুগ হইবে। এইখানে যে বিষয়টি অমীমাংসিত থাকিয়া গেল তাহা হইল ননীর ইরেজী প্রতিশব্দ কী। অধিকতর নরম পদার্থটির ক্ষেত্রেই  ব্রিটিশরা Cream শব্দটি প্রযুক্ত করিয়া থাকে ইহা নিশ্চিত।

 

[লেখক পরিচিতি : ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, সাহিত্যিক ও গবেষক, জীবিকাসূত্রে  বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ভূতপূর্ব মহাপরিচালক।]