নাগরিক শিল্পীর পতঙ্গ চোখে

জাহিদ মুস্তাফা 

 চেনা জগতের মাঝেই যেন অচেনা এক জগৎ খুঁজে বেড়ায় পতঙ্গ। নগরবাসীর নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, দুঃখ-দারিদ্র্য, আচার-অনাচার, আনন্দ-বেদনা অবলোকন করে তারা। পতঙ্গের চোখ দিয়ে দেখা এসব ঘটনা সমতলে সাজিয়ে তোলেন শিল্পী তাঁর কাগজে-ক্যানভাসে। তিনি সঞ্জীব দত্ত। চট্টগ্রামে জন্ম, শিক্ষাও ওখানে। ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন।

Art Work
Art Work

আশি থেকে নববই। গত শতকের উত্তাল ও ঘটনাবহুল একটি দশক। শিল্পী সঞ্জীব দত্ত এই সময়কালে গড়ে উঠেছেন। একদিকে নিজর শহরের মেট্রোপলিটন রূপ ধারণের নানা পর্যায় তিনি যেমন অবলোকন করেছেন, তেমনি সে-সময়ের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক নানা টানাপড়েন, অপরাধ-অন্তর্ঘাত তিনি দেখেছেন। এসব দেখার উপলব্ধি তাঁর মনে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে – প্রধানত সেগুলোই তাঁর শিল্পী মানস গড়েছে। আর তাঁর চিত্রপটে আমরা দেখি নাগরিক যন্ত্রণা আর নগর ভাগাড়ের সারাৎসার।

সম্প্রতি ঢাকা আর্ট সেন্টারে শিল্পী সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে গেল। ২৬ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল – ‘আমি তুমি সে ইহারা’। তাঁর প্রথম দুটি একক হয়েছে চট্টগ্রামে – প্রথমটি শিল্পকলা একাডেমী ও দ্বিতীয়টি আলিয়স ফ্রঁসেজে। প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলো সম্পর্কে শিল্পীর ভাষ্য প্রসঙ্গক্রমে তুলে ধরা প্রয়োজন। তিনি নিজ ব্রোশিওরে লিখেছেন – ‘তুচ্ছ জীবনের রূপক হিসেবে ক্ষুদ্র পতঙ্গ ফড়িংকে অবজেক্ট করে আমার প্রথম প্রদর্শনী ছিল। দ্বিতীয় প্রদর্শনীতে সেই রূপক ফড়িংয়ের সঙ্গে অবজেক্ট হিসেবে এলো পণ্যের বিজ্ঞাপনে তার ব্যবহারবিধি ও মোড়কের রকমারিতা। তৃতীয় প্রদর্শনী – ‘আমি তুমি সে ইহারা’তে রূপক ফড়িংকে বহুমাত্রিকতায় যেন অবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারি তার প্রচেষ্টাস্বরূপ এই প্রদর্শনীর সকল ছবির অবজেক্ট নির্বাচিত।’

ক্ষুদ্র পতঙ্গ ফড়িংকে বহুমাত্রিক রূপে দেখিয়েছেন শিল্পী। সমাজ পর্যবেক্ষণে এটি শিল্পীর নিজস্ব একটি পদ্ধতি। নগরবুকে তিনি যেন ফড়িংয়ের মতো উড়ে বসে, সেটির চোখ দিয়ে অবলোকন করছেন নানা দৃশ্য। বৈরী সময় ও পরিস্থিতির ভেতর নিজেকে মানিয়ে নিয়ে রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে আপস করে টিকে থাকা অস্তিত্ব নিয়ে মানুষ মাটি কামড়ে বেঁচে থাকে। তখন অনুসন্ধিৎসু মন অবচেতনভাবেই সন্ধান করে মুক্তির পথ। শিল্পীর মুক্তি তাঁর সৃজনকর্মে। সঞ্জীব দত্ত এভাবেই নিজের মনোচেতনার মুক্তি খুঁজেছেন।

তাঁর চিত্রকর্মের শিরোনাম গভীর ভাবনার উদ্রেক করে দর্শক মনে। যেমন – ‘কষ্টগুলো নদী হওয়ার আগে’, ‘বাতাসে যে কথা’, ‘ফাঁদ’, ‘চিত্রকল্প’, ‘অচিন পাখি’, ‘নির্দেশ ব্যতীত যন্ত্র করে না কাজ’, ‘বশীকরণ’, ‘সে’। এসব কাজের ভেতর রং ও রেখার প্রয়োগ এবং কৌণিক গঠন নতুন নতুন ভাবনাকে উস্কে দেয়। ক্যানভাসের পরিধির মধ্যে শিল্পী যখন সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি – তখন তিনি সেই সীমানা অতিক্রম করারও প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন – ‘ফাঁদ’ নামক চিত্রকর্মটির মূল চিত্রপটে এক নারীর শরীর ভঙ্গিমার সঙ্গে অবয়বযুক্ত হয়েছে আলাদা ছোট ক্যানভাস। ফলে চতুষ্কোণ ক্যানভাস এখানে আরো দুটি কোণ পেয়ে গেল।

চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে কথা বলা দরকার শিল্প সঞ্জীব সাহার বরাত ধরেই। সমুদ্র আর পাহাড়বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম শিল্প-সংস্কৃতিচর্চায় বাংলাদেশে ঢাকার পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে। ঢাকার শিল্প-আন্দোলনের পশ্চাদভাগে ছিল কলকাতা আর্ট স্কুলের অ্যাকাডেমিক ধারাবাহিকতা। কিন্তু চট্টগ্রামে শিল্পচর্চার আধুনিকতা এসেছে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর হাত ধরে। তিনি যদিও জয়নুল আবেদিন প্রবর্তিত ঢাকা চারুকলার ছাত্র, তথাপি তাঁর মানস গঠনে তাঁর ইউরোপে উচ্চশিক্ষাগ্রহণ এবং দেশের লোকশিল্পের প্রতি প্রগাঢ় টান সক্রিয় থাকায় চট্টগ্রামে তিনি শুরু করেছিলেন নতুন চিন্তা-চৈতন্যের শিল্পচর্চা ও শিক্ষাদান। রশিদ চৌধুরীর সেই শিল্পভাবনা ও চৈতন্যের ধারক হয়েছেন তাঁরই কতক প্রিয় ছাত্র – যাঁরা বর্তমানে চট্টগ্রামের চারুকলা অঙ্গনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে আছেন। সঞ্জীব দত্তের শিল্পের অধ্যবসায় তাঁদের হাত ধরেই। রশিদ চৌধুরী ও তাঁর ছাত্রদের কাজে লোকশিল্পীদের পছন্দনীয় রং, স্টাইল ও কনসেপচুয়াল স্বাতন্ত্র্য ঢাকার শিল্পীদের কাজ থেকে তাঁদের কাজকে আলাদা করে।

চট্টগ্রামের নগরায়ণ দেখেছেন শিল্পী সঞ্জীব। তাঁর চোখের সামনেই একে একে গড়ে উঠেছে স্কাই স্ক্র্যাপার, বড় বড় ভবন, শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট।

শিল্পী পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ হিসেবে জীবনের প্রতিটি দৃশ্যকল্প নানা স্তরে, নানা ডাইমেনশনে দেখেছেন। তা হয়তো নিজের অবচেতনে ছায়া ফেলেছে – সেই প্রভাব এসেছে সঞ্জীবের চিত্রকর্মে। ক্ষুদ্র পতঙ্গ ফড়িংয়ের ভাসমান দৃষ্টিতে নগরকে দেখা, নগরের নানাবিধ ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ে শিল্পীর কৌতূহল ও কৌতুক যেন উঠে এসেছে একেকটি চিত্রতলে।

নগরের ময়লা-আবর্জনা ঘেঁটে নানা বস্ত্ত আহরণকারী বা টোকাই নিয়ে শিল্পী রফিকুন নবী অসংখ্য কার্টুন এবং ছবি এঁকেছেন। সঞ্জীবের চিত্রকর্মেও আমরা এরকম টোকাই দেখি; কিন্তু সে তার ফড়িংয়ের রূপে চিত্রপটে এসেছে এবং তার অবয়ব, শরীর যেন স্টিলের তৈরি – অনেকটা রোবটের মতো। ‘সে’ নামে নামকরণ হয়েছে এগুলোর। ‘চিত্রকল্প’ শিরোনামে তাঁর একটি কাজ দেখলাম – এটিতে রৌদ্রবিদ্ধ দু’জন নর-নারী উপবেশনরত, তাদের মাথার উপরে বস্তার মতো একটা ঘেরাটোপ, আর তার গায়ে অসংখ্য পতঙ্গের ওড়াউড়ি। মনে পড়ে সেই শ্লোক – ‘পিপিলিকার পাখা হয় মরিবার তরে।’ এ-কাজটি যেন ভুমিকম্প, অগ্নিকান্ড কিংবা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নগরের ধ্বংসবারতা নিয়ে এসেছে।

মহানগরীর বিশাল ভবন, মার্কেট, দোকানপাট এসবে আয়নার অনেক ব্যবহার করেছেন শিল্পী। এগুলোর বিম্ব-প্রতিবিম্ব এমনকি তার ভঙ্গুরতাও ফর্মে এসেছে। তবে এসবের চেয়ে শিল্পীর ‘মানুষ ও ফড়িং’ এবং ‘কষ্টগুলো নদী হবার আগে’ শীর্ষক চিত্রকর্মগুলো ব্যতিক্রমী ও অনুভূতিপ্রবণ। প্রথম কাজটিতে বর্ণ-প্রয়োগে হলুদ-সবুজাভ পটভূমে একটি ফড়িংমানব যেন ফুলবাগান কিংবা নিসর্গের মধ্যে নিজের আরাধ্যকে খুঁজছে। দ্বিতীয় কাজটি যেন নিশ্চল স্থাণু কঠিন পাথরের বুক চিরে কান্নার আবেগকে তুলে ধরে অতলস্পর্শী কষ্টকে প্রকাশ করেছে। কাজ দুটি সঞ্জীব দত্তের অন্যরকম উন্মোচন।