নারীশিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও উদ্যোগের সামাজিক তাৎপর্য

আজ থেকে প্রায় একশ পঁচাত্তর বছর পূর্বে বাঙালি সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তারে ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) চিন্তা ও কর্মোদ্যোগ আরম্ভ হয়। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর তিনি বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে অনেক চিন্তা করেছেন, স্থাপন করেছেন অনেক প্রতিষ্ঠান, গ্রহণ করেছেন নানামাত্রিক উদ্যোগ। নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিদ্যাসাগর সর্বদা দেখেছেন বাঙালি নারীর স্বার্থ – বাঙালি নারীর উন্নতিকেই ভেবেছেন নিজের উন্নতি বলে। বিদ্যাসাগর যখন আগে নারীশিক্ষা চিন্তা ও কর্মোদ্যোগ নিয়েছিলেন, বাঙালি সমাজে সময়টা ছিল অনেকটা বিপ্লবাত্মক। সন্দেহ নেই, দীর্ঘ এই সময়-পরিসর পেরিয়ে বাঙালি সমাজ নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু নারীশিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও কর্মোদ্যোগ আজকের দিনেও অনেকাংশে প্রাসঙ্গিক – সময়ের এত ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁর চিন্তা প্রাসঙ্গিকতা কিংবা উপযোগিতা হারায়নি।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালি সমাজের খুব কম ব্যক্তিই নারীশিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর এবং হাতেগোনা আর কয়েকজন মানুষের অক্লান্ত সাধনায় শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করে। গোটা বিশ শতকে নারীশিক্ষা ক্রমশই সামাজিক স্বীকৃতি পাচ্ছিল। তবে নারীশিক্ষাবিরোধী সামাজিক বাস্তবতাও একইসঙ্গে ছিল ক্রিয়াশীল। একজন গবেষকদের মতে : ‘স্ত্রীশিক্ষাও একটু একটু করে বিস্তারলাভ করেছিল। স্ত্রীশিক্ষার বাস্তব অসুবিধাগুলি সবই ছিল, এ-সম্বন্ধে রক্ষণশীলদের সমস্ত বিশ্বাসও অটুট ছিল – কিন্তু, কোন বাড়িতে মেয়েকে লেখাপড়া করাতে হলে অত্যন্ত গোপনে করাতে হবে বা মেয়ের পক্ষে লেখাপড়া করাটা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ, এই ধারণাটা বাঙালির (অন্ততপক্ষে  উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালির) মন থেকে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল’ (সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, ২০১০ : ৫৫)। শিক্ষা লাভ করলে নারী পুরুষের সমকক্ষ হবে, সংসারে অশান্তি নেমে আসবে – উনিশ শতকে রক্ষণশীল সমাজের এই মনোভাব বিশ শতক পেরিয়ে একুশ শতকেও বহমান আছে। এক্ষেত্রেই ছিল বিদ্যাসাগরের যুদ্ধ। প্রকৃত শিক্ষা দিলে নারীর চেতনায় নেতিবাদী মনোভাব সৃষ্টি হয় না বলে তিনি মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি সেদিন যা শুরু করেছিলেন, একটু একটু করে আজ সে-ধারণা সম্প্রসারিত হয়েছে, পেয়েছে সামাজিক স্বীকৃতি।

শারীরিক ও প্রবৃত্তিগত পার্থক্যের কারণে নারী ও পুরুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের শিক্ষার কথা উনিশ শতকে ব্যাপকভাবে বলা হতো। কিন্তু প্রথম থেকেই এই ধারণার ঘোর বিরোধী ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে ভিন্নতা মূলত নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে প্রচলিত সামাজিক বৈষম্যেরই প্রতিফলন মাত্র। নারী ও পুরুষের মধ্যে ভিন্নধর্মী শিক্ষাভাবনার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন উনিশ শতকে শুরু করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সেই ভাবনা আজ একুশ শতকে সে-ধারণা সর্বাংশে বাতিল হয়ে গেছে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিদ্যাসাগর সেদিন একাকী যেকথা বলেছিলেন, আজ তা বাস্তব সত্যের রূপ পরিগ্রহ করেছে। সামান্য কিছু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ দিলে একথা আজ বলা যায়, বাংলা ভূখণ্ডে কারিকুলাম বা পাঠক্রমে এখন আর নারী-শিক্ষার্থী আর পুরুষ-শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা কোনো বিধান নেই। বাংলাদেশে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পূর্বেও এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যেত এমন তথ্য – সম্মিলিত মেধাতালিকা এবং মেয়েদের মেধাতালিকা। একই কারিকুলাম, একই সিলেবাস, একই প্রশ্নপত্র, অভিন্ন পরীক্ষা, অথচ পরীক্ষার ফল প্রকাশ দুভাবে। নারীশিক্ষা যে তখনো মূলস্রোতে পৌঁছাতে পারেনি – এ-তথ্য হয়তো তারই পরিচায়ক। বর্তমানে এ-ব্যবস্থার দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আর পরীক্ষার ফল প্রকাশে ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যে কোনো বিভাজন করা হয় না। এই বিষয়টাই এদেশে প্রথম ভেবেছিলেন ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

উনিশ শতকের অবরুদ্ধ প্রচল সমাজে খুব কম মানুষই ধর্মনিরপেক্ষ নারীশিক্ষার কথা ভাবতে পেরেছেন। প্রচলিত ধর্মমত নয়, বরং ব্যবহারিক বিধি এবং সদাচার সম্বন্ধীয় নিয়ম-কানুনকেই এখানে ধর্ম অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সমাজের ধারণা ছিল, শিক্ষা লাভ করলে মেয়েরা ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে – সংশ্রবহীন হয়ে পড়বে ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে। বিনয়, সুশীলতা, লজ্জা, দয়া, পতিভক্তি এবং গৃহস্থালি কাজে যত্নশীলতা – এগুলিই বাঙালি নারীর গুণ বা ধর্ম – এমনই ছিল সামাজিক বিশ^াস। শতাব্দী পরম্পরায় রক্ষণশীল সমাজ বলেছে যে, শিক্ষালাভ করলে নারীর এই গুণ বা ধর্ম অন্তর্হিত হয়। শিক্ষার আলোক থেকে নারীকে বঞ্চিত রাখার উদ্দেশ্যে রক্ষণশীল পুরুষগোষ্ঠী প্রচার করেছে বিস্ময়-জাগানিয়া তত্ত্ব : ‘… স্ত্রী ও পুরুষের শিক্ষা কখনই এক হতে পারে না। কারণ, পুরুষের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় তত ক্ষতি নেই, যতটা আছে মেয়েদের বেলায়। কারণ মেয়েদের ও ছেলেদের সামাজিক দায়িত্ব পৃথক। পুরুষের তুলনায় মেয়েদের ওপরই সংসার ও পারিবারিক নীতি রক্ষার দায়িত্ব – বিশ্বনিয়ন্তা রমণীজাতির উপরে এই গুরুভার [পরিবার রক্ষা করা] অর্পণ করিয়া তাহাদের জীবন ধন্য করিয়াছেন’ (সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, ২০১০ : ৬২)। নারীশিক্ষা সম্পর্কে সনাতন এই সামাজিক মিথ ভেঙে দেন বিদ্যাসাগর। তিনি জোরের সঙ্গেই ধর্মনিরপেক্ষ নারীশিক্ষার কথা বলেছেন। বিশ শতক পেরিয়ে একুশ শতকে এসে শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বজনীনতাকেই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে উৎসাহিত করা হয়, যা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর করেছিলেন উনিশ শতকে। এখনো কোনো-কোনো ক্ষেত্রে নারীশিক্ষার বিরোধী শক্তি একে গর্হিত কাজ বলে মনে করে। কোনো-কোনো তাত্ত্বিক এমন কথাও বলেন যে, নারীদের নির্দিষ্ট একটা পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করলেই চলে। পুরুষের মতো সবকিছু তাদের জানার প্রয়োজন নেই। কখনো-কখনো ধর্মীয় বিধানের দোহাই দিয়েও নারীদের শিক্ষা থেকে দূরে রাখা হয়। এমনও দেখা যায়, কোনো নারী শিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহী হলে তাকে

পারিবারিক-সামাজিকভাবে নিগৃহীত হতে হয়, কখনো তাকে প্রহৃত হতে হয়, কখনো-বা তার জীবনই হয়ে ওঠে বিপন্ন। উনিশ শতকে এই প্রবণতা যে আরো ভয়াবহ ছিল, তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। বিদ্যাসাগর এই প্রবণতার বিরুদ্ধেই সামাজিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন – এখানেই তাঁর প্রাগ্রসরতা। একুশ শতকের বিশ্বজনীন শিক্ষাদর্শনের মৌল প্রবণতার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলেও বিদ্যাসাগরকে একজন আধুনিক শিক্ষাচিন্তক হিসেবে অনায়াসে বিবেচনা করা যায়।

যেহেতু নারীশিক্ষার ধারণা এসেছে পশ্চিম পৃথিবী থেকে, তাই উনিশ শতকে নারীশিক্ষার প্রসঙ্গ এলেই রক্ষণশীল সমাজ পশ্চিমা সভ্যতাকে দায়ী করা হতো। নারীশিক্ষার বিরোধীরা পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে বর্জন করে প্রচল সনাতন শিক্ষার কথা বলতেন। এখানেও বিদ্যাসাগর ছিলেন ব্যতিক্রম। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের জন্য তিনি ইংরেজি শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। প্রথমে ঐচ্ছিক, পরবর্তী সময়ে ইংরেজি বিষয়কে তিনি আবশ্যিক করেন। তিনি নিজেও ইংরেজি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য শিক্ষকের কাছে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন। সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রমে তিনি ইউরোপীয় দর্শন ও সাহিত্যের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করেন। স্বপ্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিতেও বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা আয়ত্তের জন্য ছাত্রীদের তিনি বলতেন এবং সেভাবে পাঠক্রম তৈরি করতেন। সংস্কৃত কলেজে দুজন ইংরেজির অধ্যাপকের পরিবর্তে চারজন অধ্যাপক নিয়োগের জন্য ঊর্ধ্বতন মহলে প্রস্তাব পাঠান বিদ্যাসাগর। স্কুলের পাঠক্রমে তিনি

পাশ্চাত্য-দর্শন অন্তর্ভুক্ত করেন – চরিতাবলী গ্রন্থে পাশ্চাত্য লেখক-গবেষক-দার্শনিক-বিজ্ঞানীদের জীবনকথা লিপিবদ্ধ করেন এবং সে-বই পাঠ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন। একুশ শতকের শিক্ষাচিন্তকদের মতো বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে ছিলেন সমন্বয়বাদী দার্শনিক। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য – উভয় অঞ্চলের একটি সমন্বিত শিক্ষায় তিনি শিক্ষিত করতে চেয়েছেন বাংলাদেশের নারী-শিক্ষার্থীদের। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন ব্যতীত সামাজিকভাবে বাঙালি উন্নতি করতে পারবে না। তাঁর নারীশিক্ষামূলক পাঠক্রমে এই সমন্বয়ধর্মী চিন্তার প্রতিফলন লক্ষণীয়। একুশ শতকের এই সময়খণ্ডেও আমরা লক্ষ করছি নারীশিক্ষা তথা সামগ্রিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বয়ধর্মিতার ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশ্বায়নের কারণে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক অনেক দ্রুত ও সহজ হয়েছে – সমন্বয় এখন অতি সাধারণ এক বৈশিষ্ট্য। অথচ পৌনে দুশো বছর পূর্বে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে এই সমন্বয়ের কথা বলেছেন প্রাগ্রসর চিন্তার বিদ্যাসাগর। 

নারীশিক্ষা ব্যতিরেকে সমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কোনোক্রমেই সম্ভব নয় – বিদ্যাসাগরের এই ভাবনা বর্তমান সময়ের জন্যও সমান প্রাসঙ্গিক। তিনি যখন নারীশিক্ষার কথা বলেছেন, তখন নারী-শিক্ষার্থীকে স্কুলে আনার জন্য অভিভাবকদের নানাভাবে বোঝাতে হতো, রক্ষণশীলদের বিরোধিতাকে মোকাবিলা করার জন্য নানা কৌশল গ্রহণ করতে হতো। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর দশ বছর পরে ১৯০১ সাল গোটা বাংলায় মাত্র তিপ্পান্নটি উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। এইসব স্কুলে সর্বমোট এগারোশো সত্তরজন ছাত্রী পড়ালেখা করত (সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, ২০১০ : ৫১)। এই প্রবণতার এখন মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারী স্কুলে যাচ্ছে, কোনো কোনো সময়ে দেখা যায় বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়ে পরীক্ষার্থী বেশি – প্রায়শই দেখা যায় মেধাতালিকা এবং পাশের হারেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করছে। কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিকে এমন কথাও বলতে হয়, নারী-পুরুষের সমতা বিধানের জন্য আগামী পরীক্ষায় ছেলেদের আরো ভালো ফল করতে হবে। নারীরা ব্যাপক হারে উচ্চশিক্ষা লাভ করছে বলে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, সিদ্ধান্তগ্রহণে ভূমিকা রাখছে নারী।

সমাজ-প্রগতির সঙ্গে নারীশিক্ষার উন্নতি ও অগ্রগতি যে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, সে-কথা বিদ্যাসাগর আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেছেন। প্রত্যক্ষ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, নারীশিক্ষা ব্যতীত বাঙালি সমাজের কুসংস্কার দু-চার শতাব্দীতেও উৎপাটন করা সম্ভব না-ও হতে পারে (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ২৩৮)। সমাজের শিক্ষিত পুরুষদের মনেও নারীশিক্ষা সম্বন্ধে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয়-সন্দেহ তিনি দেখেছেন – তাতে ব্যথিত হলেও, কখনো তিনি বিচলিত হননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, সামাজিক এই কুপ্রথা ও অপভাবনা একদিন দূর হবে। বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখনো নারীশিক্ষা নিয়ে মানুষের মাঝে বিরাজমান আছে দ্বিধা-সংশয়-সন্দেহ। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, বিদ্যাসাগর ও তাঁর উত্তর-সাধকদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় নেতিবাচক এই সামাজিক প্রবণতার মাত্রা অনেকটা কমেছে, পরিবর্তন ঘটেছে সামাজিক মানসিকতার। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন নারীশিক্ষার পক্ষে নেওয়া হচ্ছে অনেক বাস্তবধর্মী উদ্যোগ – এ-উদ্যোগের জন্য বরাদ্দ করাও হচ্ছে অনেক অর্থ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর নারীশিক্ষা চিন্তা তথা শিক্ষাচিন্তা ও কর্মোদ্যোগ দ্বারা গতানুগতিক শিক্ষিত মানুষ সৃষ্টি করতে চাননি, তিনি চেয়েছেন প্রকৃত মানুষ সৃষ্টি করতে। তাঁর গভীর আশা ছিল, শিক্ষা যথাযথভাবে বিস্তার লাভ করলে বাঙালি একদিন কুসংস্কারমুক্ত হয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠবে। সুদীর্ঘ পৌনে দুশো বছরে তাঁর ধারণা যে বহুলাংশে সফল হয়েছে, তা স্বীকার করতেই হবে। সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করে আধুনিক ও উন্নত সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন বিদ্যাসাগরের মতো উনিশ শতকে আর কোনো বাঙালি চিন্তক ভাবেননি। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা ছিল প্রগতিশীল, বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানমনস্ক। বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা চিন্তা ও পদ্ধতি ছিল বাস্তব ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা হঠকারী

কোনো চিন্তার অনুগামী নয়। বাংলাদেশে জনশিক্ষা প্রসারের জন্য বিদ্যাসাগর যে পরিকল্পনা করেছিলেন, তাতেও ধরা পড়ে তাঁর বাস্তবভিত্তিক মনোবৃত্তি ও সৃজনশীল চিন্তার ছাপ। বর্তমানে যে-সর্বজনীন সাক্ষরতার কথা বলা হয়, বলা হয় সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার কথা, বিদ্যাসাগরের শিক্ষাচিন্তার মধ্যে সুপ্ত ছিল তার ভবিষ্যবিস্তারী বীজ। জনশিক্ষার জন্য তিনি নারীশিক্ষাকে প্রাথমিক ও শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি ভেবেছেন, নারী শিক্ষিত হলেই তার সন্তান শিক্ষিত হবে এবং প্রসারিত হবে জনশিক্ষা। জনশিক্ষা বিস্তার বা নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য বিদ্যাসাগরের সব উদ্যোগই ছিল ‘মডেল পরিকল্পনা’। এই মডেলকে ভিত্তি করে একদিন সমগ্র বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তার লাভ করবে – এটাই ছিল বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন। এ প্রসঙ্গে একজন গবেষক যা বলেছেন এখানে তা উদ্ধৃতিযোগ্য :

বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক ধারা সৃষ্টি করাই ছিল বিদ্যাসাগরের এই পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য। এক্ষেত্রে এই পরিকল্পনাটা ছিল একটা ‘মডেল পরিকল্পনা’। এই মডেলকে ভিত্তি করে একদিন গোটা বাংলাদেশে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ধারা বিস্তার লাভ করবে এটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এই শিক্ষা পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি যে একটা সুষ্ঠু ও সুস্থ প্রাতিষ্ঠানিক ধারার রূপরেখা প্রণয়ন করে গিয়েছিলেন, তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল বাঙালি সমাজে চোখ বুলালে পরিদৃষ্ট হয়। (আব্দুল মালেক, ২০১২ : ৯২)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাচিন্তার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল পাঠ্য-বিষয়কে সহজ ও সাবলীলভাবে শিক্ষার্থীর কাছে তুলে ধরা। এ উদ্দেশ্যে তিনি সহজ-সরল ও চিত্তাকর্ষক ভাষায় শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। কাজটি

তিনি যে-সময় করেন, সে-সময় পাঠ্যগ্রন্থের ধারণাই ছিল না বাঙালি সমাজে। বরং যাঁরা শিশুশিক্ষা বা পাঠ্যবই রচনা করতেন, তাঁদের ব্যঙ্গ করা হতো। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) পর্যন্ত শিশুশিক্ষা ও পাঠ্যগ্রন্থ রচনা করেছেন বলে বিদ্যাসাগরকে ব্যঙ্গ করেছেন। বিদ্যাসাগরের রচনাকে বঙ্কিমচন্দ্র ÔtranslationÕ এবং Ôcompilation of very good primerÕ বলে অভিহিত করেছেন; কখনো-বা এমন মন্তব্য করেছেন : ÔHe [Ishwarchandra Vidyasagar] is only a primer-writer … we deny that either translating or primer-making evinces a high order of genius.Õ (উদ্ধৃত : সৌমেন্দ্রনাথ সরকার, ১৯৭৬ : ৩০৩)। শিশুপাঠ্য রচনার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রই যখন এমন লেখেন, তখন অন্যদের কথা সহজেই অনুমান করা যায়। এখানেই বিদ্যাসাগরের ঐতিহাসিক অবদান। শিশুপাঠ্য রচনায় বিদ্যাসাগর অভাবনীয় পরিশ্রম করেছেন, করেছেন নানামাত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এখন যা সকল দেশেই হচ্ছে। এখন সরকারি উদ্যোগে স্বনামখ্যাত গবেষকদের দিয়ে লেখানো হয় পাঠ্যবই – সেজন্য থাকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক মঞ্জুরি। বহু গবেষকের মিলিত সাধনায়, দেশি-বিদেশি গবেষক ও শিক্ষাবিদদের পরামর্শে এখন তৈরি হয় পাঠক্রম বা কারিকুলাম আর
সে-কারিকুলামের আলোকেই রচিত হয় পাঠ্যবই। ভাবতে বিস্ময় লাগে – এই গোটা কাজটিই বিদ্যাসাগর করেছেন একক হাতে, বিরুদ্ধ এবং বৈরী সমাজ-প্রতিবেশে বসে।

শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। যে-জ্ঞান আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি করে, যে-জ্ঞান শিক্ষার্থীকে বাস্তবনিষ্ঠ হতে প্রেরণা দেয় – বিদ্যাসাগর সেইরূপ জ্ঞানসৃষ্টির স্বপ্ন দেখতেন – স্বপ্ন দেখতেন এমন একটি জ্ঞানঋদ্ধ সমাজের। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিদ্যাসাগরের, তাঁর এই মনোভাব বোঝার মতো মানুষ তখন উপনিবেশিত বাংলায় ছিল একান্তই দুর্লভ। ফলে একাই তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং এ-কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, উত্তরকালীন সমাজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সামূহিক চিন্তার যে বিপুল প্রভাব পড়ার কথা, তা হয়ে ওঠেনি। সমকালে যেমন, উত্তরকালেও তাঁকে যথার্থভাবে বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠেনি বাঙালি জাতির। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শক্তিও তাঁর কর্মপরিকল্পনায় নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। লক্ষ্য অর্জনে তিনি যেন সফল না হন – এমন ধরনের কাজ করেছে। শিক্ষা ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগর যে মানুষ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, অধিকাংশ বাঙালিই তা বুঝে উঠতে পারেননি, যাঁরা বুঝতে পেরেছেন তাঁরাও তাঁর পাশে এসে দাঁড়াননি।

বিদ্যাসাগর-গবেষক অশোক সেন প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : ÔWe have the example of a lonely soul like Vidyasagar, whose bold programmes of education and social reforms, fearless struggle against the irrational and the inhuman, and endless compassion for the poor and the distressed were largely frustrated by the absence of any wider social force to work for the relevant goals.Õ (Asok Sen, 2016 : 5)|

বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা ভাবনার একটা উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তাঁর শিক্ষক প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা। পৌনে দুশো বছর আগে বিদ্যাসাগর শিক্ষক প্রশিক্ষণের যে-উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আজ তা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও গৃহীত এক পদ্ধতি। শিক্ষকতার পেশায় প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যার অতীত।

পৃথিবীজুড়ে এখন শিক্ষক প্রশিক্ষণের কত আয়োজন। প্রশিক্ষিত শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাদানে শিশু-মনস্তত্ত্ব অনুধাবনে শিক্ষককে নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যা প্রয়োগ করে পাওয়া যায় ইতিবাচক ফল। উনিশ শতকে বাংলাদেশে এই ধারণা ছিল না – সমাজপতিরা তখন শিক্ষক প্রশিক্ষণের কথা কল্পনাও করতে পারেননি। অথচ বিদ্যাসাগর কত আগে নারী-শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কথা ভেবেছেন, স্থাপন করেছেন শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল। নারী-শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা রক্ষণশীল সমাজ সুনজরে দেখেনি। এ উদ্যোগের জন্য বিদ্যাসাগরকে অনেক ব্যঙ্গও সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু বিদ্যাসাগর কোনো কিছুতেই দমে যাননি – নিজস্ব ধারণা অনুসারেই পরিচালনা করেছেন নর্মাল স্কুল। কেবল নারীশিক্ষা নয়, সামগ্রিক শিক্ষার জন্যই বিদ্যাসাগরের এই উদ্যোগ ছিল সর্বাংশেই আধুনিক ও প্রাগ্রসর। বিদ্যাসাগরের শিক্ষক প্রশিক্ষণের ভাবনা ভিন্ন একটি কারণেও তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু বাংলা অঞ্চলে নয়, সারা পৃথিবীতেই প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে নারী-শিক্ষকের দক্ষতা পুরুষ-শিক্ষকের তুলনায় বেশি বলে স্বীকৃত। কত আগে বিদ্যাসাগর এই কথাটি বলেছিলেন, তা ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়। অশোক সেন লিখেছেন : Ô… Vidyasagar evolved the foundations of the two systems, viz. Circle System [model school] with its spread effect and Normal School System with its training effect, which later became the main agencies for the advance of primary education in this part of the country.Õ (Asok Sen, 2016 : 31)। প্রাথমিক শিক্ষা তথা নারীশিক্ষা চিন্তায় বিদ্যাসাগরের নর্মাল স্কুল ধারণা উত্তরকালে ব্যাপক প্রভাব সঞ্চার করেছে – একথা স্বীকার করতেই হবে। দেশীয় শিক্ষায় অযথা অর্থ ব্যয়েরও বিরুদ্ধাচরণ করেছেন বিদ্যাসাগর। লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডের কাছে লেখা এক চিঠিতে বিদ্যাসাগর লিখেছেন : Ô… that the present system upon which the department of Vernacular Education was conducted was a mere waste of money.Õ (উদ্ধৃতি Subal Chandra Mitra, 1975 : 34)। বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা চিন্তা ও কর্মপ্রয়াসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তিনি নারীশিক্ষাকে কেবল নগরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। তাঁর কালে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নারীদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করা কল্পনাও করা যেত না। কলকাতা শহরেই মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠায় সামাজিক বাধার কথা ইতঃপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের প্রবল বিরোধিতার কথা। কিন্তু বিদ্যাসাগর এই সামাজিক প্রবণতার বিপরীত স্রোতের মানুষ। কলকাতা শহরে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি গ্রামাঞ্চলেও বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছেন। হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং নদীয়া জেলার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গ্রামের মানুষদের বুঝিয়ে, নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে তিনি এসব বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই বালিকা বিদ্যালয়গুলির পরিচালনার জন্য যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এগুলি বিদ্যাসাগর নিজের অর্থ দিয়েই সচল রেখেছিলেন।

বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষাকে জাতীয় শিক্ষার অংশ হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। নারী শিক্ষিত হলেই শিক্ষিত হবে গোটা জাতি – এই-ই ছিল বিদ্যাসাগরের আন্তরিক বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই তিনি দুর্গম গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের জন্য নিজস্ব উদ্যোগে স্থাপন করেছেন বালিকা বিদ্যালয়। নারীশিক্ষার আলো তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন শহরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। তবে এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর তাঁর মূল কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন গ্রামাঞ্চলকেই। প্রায় সব দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাস করে গ্রামে। বাংলাদেশের জন্য এ-কথা আরো গভীরভাবে সত্য। এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে, দুর্গম এলাকায়, আদি নৃগোষ্ঠীর মানুষদের অঞ্চলে বালিকা বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। অনেক গ্রামে এখন মেয়েদের জন্য মহাবিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের গ্রামেও আছে বালিকা বিদ্যালয়। প্রসঙ্গত স্মরণ করবো, জীবনের শেষ পর্বে বিদ্যাসাগর যখন কার্মাটারের সাঁওতাল পরগনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন, তখন সেখানে সাঁওতাল মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য তিনি খুলেছিলেন একটি পাঠশালা। এই পাঠশালায় তিনি দরিদ্র কেন্দ্রবিচ্ছিন্ন সাঁওতাল বালিকাদের জীবনমুখী শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রামাঞ্চলকে নির্বাচন করে সেদিন বিদ্যাসাগর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন তার সামাজিক গুরুত্ব আজ সর্বজনস্বীকৃত।

কোনো প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা বা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো নারী বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করলে বিদ্যাসাগর তাকে নানাভাবে উৎসাহিত করতেন। যারা পরীক্ষায় ভালো ফল করত, বিদ্যাসাগর তাদের পড়ালেখায় আরো উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উপহার দিতেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চন্দ্রমুখী বসু নারী-শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথম এম.এ. উপাধি অর্জন করলে বিদ্যাসাগর তাঁকে চিঠি দিয়ে ও উপহার পাঠিয়ে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের এই মহানুভবতা নারীশিক্ষাকে সহায়তা করেছে। উত্তরকালে তাঁর এই প্রবণতা অনেক শিক্ষাচিন্তকই গ্রহণ করেছেন। এভাবে বিবেচনা করলেও বিদ্যাসাগরের এই মানস-প্রবণতার সামাজিক তাৎপর্যকে গুরুত্ববহ হিসেবে শনাক্ত করা যায়।

বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে ছিলেন সর্বসংস্কারমুক্ত এবং আধুনিক। শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি নারী-পুরুষ, বাঙালি-আদি নৃগোষ্ঠী, হিন্দু-মুসলমান – কোনো ধরনের বিভাজনকেই মান্য করেননি। নারীশিক্ষার জন্য তাঁর দৃঢ়তা, অনমনীয়তা এবং মুক্তচিন্তা উত্তরকালে অনেককেই নারীশিক্ষা তথা নারী-স্বাধীনতা চিন্তায় ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) নাম উল্লেখ করা যায়। রোকেয়ার চিন্তা ও কাজের মধ্যে বিদ্যাসাগরকে আবিষ্কার করা সম্ভব। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য সমালোচকের এই অভিমত :

নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে অনগ্রসর মুসলমান সমাজে দেখি, সাগরী-চেতনার অনুসারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে – সেই দৃঢ়তা, সেই সাহসী অনমনীয়তা, শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, সম্প্রদায়-নির্বিশেষে নারীস্বাধিকারের প্রবর্তনায়। স্মরণ করতে হয়, শেষোক্ত ক্ষেত্রে তাঁর সাহসী রচনাবলির কথা, যা উভয় সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল শিক্ষিত সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে স্মতর্ব্য, রোকেয়ার ‘ব্যাজ অফ স্লেভারি’-বিষয়ক অসাধারণ নিবন্ধটির কথা। আধুনিক চেতনা ও সেক্যুলার আদর্শের এই মহীয়সী নারীর সমগ্র জীবন নারীশিক্ষা বিস্তারে ও নারীস্বাধিকার অর্জনের লড়াইয়ে নিবেদিত। তাঁর মধ্যে দেখি অনমনীয় বিদ্যাসাগরকে। (আহমদ রফিক, ২০২০ : ১০)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণের পরে অতিক্রান্ত হয়েছে একশ বত্রিশ বছর। ১৮৭০-এর পরে বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ স্কুল বন্ধ হয়ে গেলেও, নারীশিক্ষার যে বীজটি তিনি রোপণ করেন, তা এ-সময়ে আস্তে আস্তে অঙ্কুরিত হয়েছে – মেলেছে শাখা-প্রশাখা। তবু এখনো বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন অনেকাংশে অধরাই রয়ে গেছে। নানা কারণেই অধরা বিদ্যাসাগরের শিক্ষা ও সংস্কারচেতনা, যা অশোক সেন এভাবে বর্ণনা করেছেন :

The fact of the British empire troubled intellectual upbringing in nineteenth-century Bengal. Reason for the unproductive few was mixed up with unreason for the productive multitude. This was so not merely because the toiling peasantry and workmen suffered; their deprivation has borne the cross of many other enlightenments in history. In this case, they suffered not for nothing. Reason was thereby denuded of its social significance. Vidyasagar entered this world of anomalies, while believing he entered a world of potential reason. He thus found himself wandering on a deceptive road, where reason was reduced to mimicry. Vidyasagar boldly endealvoured to improve the fruits of enlightenment, but without fully comprehending or being able to remove the primal sources of their mangling. All his milestones had been elusive. (Asok Sen, 2016 : 165)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর ছিলেন কালগঙ্গা। ‘বহমান কালগঙ্গা সমুদ্রমুখী – শিক্ষা তথা নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও উদ্যোগ বহমান কালগঙ্গার মতোই প্রবহমান’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩৬৩)। প্রসঙ্গত স্মরণ করব গোপাল হালদারের এই অভিমত : ‘… ইতিহাসের যে পরিণতির ইঙ্গিত বহন করে বিদ্যাসাগর বাঙালী সমাজে উদিত হন – সেই পরিণতি পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হয়ে ওঠাও নিয়ম – সেই ‘বহমান কালগঙ্গা’র সঙ্গে বিদ্যাসাগরের যোগ মনে-প্রাণে-কর্মে অচ্ছেদ্য। তাই, কাল যতই এগিয়ে যাক বিদ্যাসাগরকে ছাড়িয়ে যাবে না। বিদ্যাসাগর থাকবেন আমাদের সঙ্গেই সহযাত্রী ও অভিযাত্রী। গোপাল হালদারের মতে, ‘… বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন শিক্ষাগুরু হবার জন্য। – তৎকালীন সমস্ত সাফল্য-ব্যর্থতার পরেও আজ দেখতে পাই – তিনি আধুনিক জাতীয় শিক্ষার যুগেও শিক্ষাগুরু। জাতীয় শিক্ষার যে ধারা তিনি বাধামুক্ত করতে চেয়েছিলেন, আমরা দেখেছি, তা তখন সুসম্ভব হয়নি – এখনও হয়েছে বলা যায় না, – কিন্তু তা এখনও বাতিল হবার মতো নয়’ (গোপাল হালদার, ১৯৯৪ : ৩৫১)। বিদ্যাসাগরের নানামুখী চিন্তা, তাঁর নারীশিক্ষা ভাবনা এবং এ-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড বাঙালি সমাজে যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত নিয়ে এসেছিল, আমাদের সমাজে তার প্রভাব চিরপ্রবহমান। ইতিহাসের ধূসর জগৎ অতিক্রম করে বিদ্যাসাগর সবসময় সাম্প্রতিক হয়ে আছেন। এ-কথা তাঁর নারীশিক্ষা ভাবনা ও কর্মপ্রয়াস সম্পর্কেও প্রযোজ্য। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য বিদ্যাসাগরের অব্যাহত এই সাম্প্রতিকতা সম্পর্কে পবিত্র সরকারের নিম্নোক্ত উক্তি :

যাঁরা ইতিহাস নির্মাণ করেন এবং এক সময় ইতিহাস হয়ে আমাদের থেকে দূরত্বে চলে যান, তাদের মধ্যে প্রধানত দু-ধরনের লোক থাকেন। এক, যাঁদের কথা আমরা ইতিহাস বইয়ে পড়ি, কিন্তু যাঁরা ওই বইয়ের পাতাতেই সমাধিস্থ থাকেন। তাঁদের অনেকের নাম ও বিবরণ আমাদের পাঠ্য মাত্র, মুখস্থ করার এবং (পরীক্ষার পরে, বহুলাংশে) ভুলে যাওয়ার বিষয়। … আবার কিছু নাম নাছোড়বান্দার মতো আমাদের সঙ্গ ছাড়ে না। মানুষের শিশুর জীবন, বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন যেহেতু একটা ‘হয়ে-ওঠা’র সরণিতে ফেলে দেওয়া হয়, এবং সবাইকে একটা শিক্ষাগত, আর্থনীতিক এবং সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়, সেহেতু সেই সিঁড়ির শেষে অনেকগুলি প্রতিকৃতি ঝোলানো থাকে মানবশিশুর দেখার জন্য। ইংরেজি ভাষায় আজকাল যাকে ‘রোল মডেল’ বলা হয় তাঁদের প্রতিকৃতি। বাঙালি শিশুর জন্য বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতি তার একেবারে কেন্দ্রে থাকে। (পবিত্র সরকার, ২০২০ : ১১)

এ কথা সমাজ ও শিক্ষাসচেতন সকলেই স্বীকার করবেন যে, নারীশিক্ষা বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও কর্মোদ্যোগের সামাজিক তাৎপর্য ও উত্তরপ্রভাব অপরিসীম। সমাজবাস্তবতার নিরিখেই বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার চিন্তা করেছেন এবং সে-চিন্তাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য গ্রহণ করেছেন নানামাত্রিক উদ্যোগ। বাঙালি সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও উদ্যোগসমূহ সময়ের সুদীর্ঘ ব্যবধান সত্ত্বেও এখনো প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।

তথ্যসূত্র

১.        আব্দুল মালেক, ২০২২। বাঙলির সমাজচিন্তায় শিক্ষা প্রসঙ্গ, ঢাকা, বাংলা প্রকাশ।

২.       আহমদ রফিক, ২০২০। ‘নানা মাত্রায় অনন্য বিদ্যাসাগর’, কালি ও কলম (সম্পাদক : আবুল হাসনাত), সপ্তদশ বর্ষ : নবম-দশম সংখ্যা, অক্টোবর-নভেম্বর ২০২০, ঢাকা।

৩.       গোপাল হালদার, ১৯৯৪। ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, পশ্চিমবঙ্গ (সম্পাদক : দিব্যজ্যোতি মজুমদার), বিদ্যাসাগর সংখ্যা, বর্ষ ২৮ : সংখ্যা ১২-১৫, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৯৪, কলকাতা : তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ভারত।

৪.       পবিত্র সরকার, ২০২০। ‘কতটুকু আছেন, কতটুকু নেই : বিদ্যাসাগর’ কালি ও কলম (সম্পাদক : আবুল হাসনাত), সপ্তদশ বর্ষ : নবম-দশম সখ্যা,

অক্টোবর-নভেম্বর ২০২০, ঢাকা।

৫.       বিনয় ঘোষ, ২০১১। বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, কলকাতা; ওরিয়েন্ট ব্লাকসোয়ান।

৬.       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩৩৬। ‘বিদ্যাসাগর’ বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ-আশ্বিন সংখ্যা, বোলপুর, শান্তিনিকেতন, ভারত।

৭.       সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, ২০১০। অন্দরে অন্তরে : উনিশ শতকে বাঙালি ভদ্রমহিলা, কলকাতা : স্ত্রী।

৮.       সৌমেন্দ্রনাথ সরকার, ১৯৭৬। বাঙালি জীবনে বিদ্যাসাগর, কলকাতা : সাহিত্যশ্রী।

9.      Asok Sen, 2016, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones, New Delhi : Permanent Black.

10.   Subal Chandra Mitra, 1975. Iswar Chandra Vidyasagar : A Story of His Life and Work, New Delhi : Oxford University Press.