নিউইয়র্কের মিউজিয়ামে আধুনিক শিল্পকলা

আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে মিউজিয়াম দেখা

এই লেখার শিরোনাম দেখে কোনো কোনো পাঠক হয়তো বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলবেন, আবার মিউজিয়ামের কথা! আমি জানি, বিষয়টিতে অনেকেরই কোনো উৎসাহ নেই। কারো কারো কাছে মিউজিয়ামগুলো নিরানন্দ এবং নীরস জায়গা। আমার এক বন্ধু আছে যার বেড়ানোর পরিকল্পনায় কোনো মিউজিয়াম থাকে না। কখনো অন্যদের সঙ্গে যেতে বাধ্য হলে কোনো বেঞ্চে বসে ঘুমিয়ে নেয়। আর একজনকে আমি বলতে শুনেছি, অতীত ইতিহাস বা মৃতদের ব্যাপারে তার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। তবে মিউজিয়াম কিন্তু শুধুই ইতিহাস ধরে রাখার জায়গা নয়; প্রকারভেদে বর্তমানের অনেক কিছু থাকতে পারে সেখানে। আর একটি উল্লেখ করার মতো ব্যাপার : নিউইয়র্ক টাইমসের ভ্রমণবিষয়ক লেখাগুলোর মধ্যে একটি লেখা দেখলাম যার বিষয় হচ্ছে, হাসি-আনন্দের সঙ্গে মিউজিয়াম দেখা। সেই লেখাটি পড়ার আগে আমারও মনে হয়নি যে, মিউজিয়াম দেখাটাকে গুরুগম্ভীর না করে তুলে আনন্দের বিষয় করা যায়। এও জানলাম যে, এভাবে মিউজিয়াম দেখানোর জন্য বিশেষ ধরনের ট্যুর গাইডও পাওয়া যায়।

পৃথিবীর সব বড় শহরেই যে ভালো ভালো মিউজিয়াম আছে তা নয়; তবে লন্ডন, প্যারিস এবং নিউইয়র্কে বড়-ছোট বিভিন্ন আকারের এবং বিভিন্ন ধরনের অনেক মিউজিয়াম রয়েছে। এক নিউইয়র্ক শহরেই প্রায় শদেড়েক মিউজিয়াম আছে। এদের সবই সমান পরিচিত বা উল্লেখযোগ্য নয়। তবে দ্য মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্ট (সংক্ষেপে যা ‘দ্য মেট’ নামে পরিচিত), মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট (সংক্ষিপ্ত নাম ‘মোমা’), গুগেনহাইম মিউজিয়াম, হুইটনি – এগুলো যেমন বড় তেমনি বিখ্যাত।

এবারের গ্রীষ্মে আমেরিকা যাওয়ার অনেক আগেই আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইফতেখার জানিয়ে রেখেছিল যে, সে দুদিনের জন্য নিউইয়র্ক আসবে জুলাই মাসের তিন তারিখে, এবং তখন যেতে চাইবে মোমাতে। চিত্রকলায় – বিশেষ করে আধুনিক চিত্রকলায় তার অনেক আগ্রহ। সে ভ্রমণ করেছে (এবং এখনো করে) অনেক; আর পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে চিত্রকলার প্রদর্শনী। এ-বিষয়ে সে নিয়মিত লেখে এবং বই লিখেছে। আমার আগ্রহ দেখে সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে প্যারিস এবং আশপাশের বেশকিছু মিউজিয়ামের সঙ্গে, যেখানে আমি তার সঙ্গে গিয়ে অনেক খ্যাতনামা শিল্পীর চিত্রপ্রদর্শনী দেখেছি। সুতরাং তার সঙ্গে আবার মিউজিয়াম দেখতে যাওয়া আমার কাছে আকর্ষণীয় ব্যাপার বইকি। তাই বলে নিউইয়র্কে – ৪ জুলাই! সে তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। সেই দিনে নিউইয়র্কে মিউজিয়াম খোলা থাকবে?

পরিকল্পনামাফিক ৩ জুলাই বিকেলে আমরা একত্র হলাম নিউইয়র্কে – আমার বড় ছেলের বাসায়। মোমার ওয়েবসাইটে গিয়ে জানতে পারলাম, পরের দিন, অর্থাৎ ৪ জুলাই খোলা থাকবে মিউজিয়াম। নিউইয়র্কের অনেক মিউজিয়ামে সোমবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তবে দ্য মেট, মোমা, গুগেনহাইম এগুলোতে কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। বছরের দু-একটি দিন – যেমন ২৫ ডিসেম্বর – তা বন্ধ থাকে। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি আমার কাছে খুবই যুক্তিসংগত মনে হলো, কারণ ছুটির দিনগুলোতেই মানুষের অবসর থাকে এখানে-সেখানে যাওয়ার, আর সেদিনই যদি সব বন্ধ থাকে তখন লোকেরা বাড়িতে বসে থাকতে বাধ্য হবে, এবং প্রতিষ্ঠানগুলো বঞ্চিত হবে তাদের সম্ভাব্য ব্যবসা বা লাভ থেকে।

বড় বড় শহরের নামকরা মিউজিয়ামগুলোতে টিকিটের জন্য লম্বা লাইন হয়; সুতরাং বুদ্ধিমানের কাজ হলো আগে থেকে অনলাইনে টিকিট কিনে নেওয়া। আমরা সেটা করিনি বলে ঠিক করলাম, সকালে মিউজিয়াম খোলার সময় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে পৌঁছে যাব, যাতে ভিড় হওয়ার আগেই টিকিট কিনে ঢুকে পড়তে পারি। করলামও তাই। ছেলের বাড়ি থেকে মিউজিয়ামটা বেশি দূরে নয়; রাস্তায় ভিড়ও তেমন ছিল না। যখন মোমার টিকিট কাউন্টারে পৌঁছলাম, তখনো লাইন তেমন লম্বা হয়নি। দিনটি আমার জন্মদিন ছিল বলে ইফতেখার বলল, সে আমাকে টিকিটটি জন্মদিনের উপহার হিসেবে কিনে দেবে। আর তার স্ত্রী রানী বলল, ওর উপহার হবে মিউজিয়ামের রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার। সুতরাং সেদিনের মিউজিয়াম দেখা আমার জন্য বিনা খরচেই হয়ে গেল।

মিউজিয়ামে ঢোকার আগেই আমরা এক দফা ছবি তুললাম তার প্রধান ঢোকার দরজার এবং সামনের জায়গাটার। তবে ছবি তোলার আরো সুন্দর জায়গা পেলাম টিকিট কেনার পর – কাউন্টারের একপাশে খোলা চত্বরের স্কাল্পচার গার্ডেনে। চৌকোনা আয়তাকার খোলা জায়গায় কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য, যার মধ্যে রয়েছে দুটি নগ্ন নারীদেহ – একজন অর্ধশায়িত, অন্যজন একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় বসে। দ্বিতীয়জনকে দেখে মনে হয় গভীরভাবে কিছু ভাবছেন। তবে শুধু নারীদেহ নয়, ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে একটি অন্তঃসত্ত্বা ছাগল – যাকে মনে করা যেতে পারে নতুন প্রাণ এবং ধারাবাহিকতার প্রতীক। রয়েছে একটি গোলাপ, যা বারান্দার মেঝে থেকে উঠে গিয়েছে অনেক ওপরে – প্রায় দোতলার সমান ছাদে। দর্শনার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই মনে করতে পারে যে, তাদের ফুলেল সংবর্ধনা জানানো হচ্ছে।

ম্যানহাটনের যে-এলাকায় মিউজিয়ামটি অবস্থিত সেখানে জমি অতি দুর্মূল্য। সুতরাং সেখানে বিশাল এলাকাজুড়ে এর ভবন নির্মাণ বোধকরি সম্ভব হয়নি। কিন্তু কীভাবে সীমিত জমির সদ্ব্যবহার এবং তার মধ্যে একটি আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ করা যায় তার ভালো উদাহরণ মোমার এই ভবন। মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা বাড়িয়ে দিয়ে অনেক জায়গায়ই পরিসরের আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে, যা স্থপতির বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়।

 

শিল্পকর্ম : ১৮৮০ থেকে ১৯৪০

যে-কোনো বড় মিউজিয়ামে দেখার এত কিছু থাকে যে, একদিনে বা কয়েক ঘণ্টায় তার সামান্যই দেখা যায়। এ-ধরনের মিউজিয়ামে যাওয়ার আগেই আমি মোটামুটি একটা ধারণা করে নিই যে কী দেখতে চাই। ফ্লোর প্ল­্যান থেকে দেখলাম, বিভিন্ন তলায় কাল পর্যায় অনুযায়ী প্রদর্শনীর আয়োজন। ১৮৮০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত কাজগুলো ছিল পাঁচতলায়। আর একেবারে সমকালীন কাজের প্রদর্শনী ছিল দোতলায়। ইফতেখার এবং আমার, দুজনেরই আকর্ষণ মোমার ইম্প্রেশনিস্ট এবং পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের সংগ্রহ দেখা। সময়কাল অনুযায়ী সেগুলো ছিল পাঁচতলায়। সুতরাং আমরা প্রথমেই চলে গেলাম সেখানে। গিয়ে বুঝতে পারলাম যে, আমাদের মতো অনেক দর্শকেরই আকর্ষণ সেখানে। বেশি ভিড় না হলেও মোটামুটি দর্শকসমাগম হয়ে গিয়েছিল এর মধ্যে। আর হবে না কেন! সেখানে ছিল ক্লদ মোনে, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, পল সেজান, পল গগাঁ, পাবলো পিকাসো, অঁরি মাতিস – এঁদের মতো নামকরা শিল্পীর কাজের প্রদর্শনী। শুধু তাই নয়, একটি ঘরে স্থান পেয়েছে মোনের বিখ্যাত ‘ওয়াটার লিলিস’ ছবির একটি সংস্করণ, যা তিনটি বিশাল ক্যানভাস একত্র করে তৈরি এবং হলের একটি দেয়ালের পুরোটাই অধিকার করে আছে।

যাঁরা মোনে এবং তাঁর কাজ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন যে, তাঁর অনেক কাজ প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত। প্যারিস থেকে অল্প দূরে জিভার্নি গ্রামে তিনি যে বাড়ি বানিয়েছিলেন তার অনেকটা জায়গাজুড়ে ছিল নানা ধরনের গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা এক বিশাল দিঘি। সেই দিঘিতে ফুটে থাকে জলপদ্ম। দিঘির এক কোনায় একটি ছোট্ট কাঠের সাঁকো। সেই দিঘি, সাঁকো, তার পাড় ঘেঁষে বেড়ে ওঠা গাছপালা, আর পানিতে ফুটে থাকা পদ্মফুল – এসব দৃশ্য মোনের অনেক ছবিতে ধরা আছে। তাঁর – জিভার্নির – বাড়ির এক অংশে ছবি আঁকার স্টুডিও ছিল, যেখানে বসেই তিনি অনেক ছবি – বিশেষ করে সেই বিশাল আকারের ক্যানভাসের ছবিগুলো এঁকেছিলেন। তবে এটাও বলা ভালো যে, মোমাতে সেই আকৃতির ছবিগুলোর একটিই আছে। তাদের একটি বড় প্রদর্শনী আছে প্যারিসের অরানজেরি মিউজিয়ামে, যা দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। অবশ্য যাদের পক্ষে প্যারিসের সেই মিউজিয়ামে গিয়ে মোনের সেসব ছবির প্রদর্শনী দেখা সম্ভব নয়, তাদের জন্য মোমায় রাখা ছবিটি নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। আর তা দেখাই যাচ্ছিল; অন্যান্য হলের চেয়ে সে-হলটিতে ভিড় ছিল অনেক বেশি। ছবি তোলার জন্য রীতিমতো অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। আর ছবি তুলতে গিয়ে ঘটল একটি মজার ঘটনা।

এক তরুণী এসে আমাকে অনুরোধ করল তাকে মোনের সেই বড় ছবিটির সামনে একটি ফটো তুলে দিতে। কিন্তু সে-ছবিটি ঠিকমতো তুলতে আমার দু-তিনবার চেষ্টা করতে হলো, কারণ তরুণী প্রথম দুবার ছবিটা দেখে বলছিল, একটু ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। হয়তো আমি একটু নার্ভাস ছিলাম বলে আমার হাত কেঁপে যাচ্ছিল। সে যাই হোক, তৃতীয় চেষ্টার পর তরুণী তার ছবিতে সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেল। কিন্তু এসব করতে গিয়ে টের পাইনি যে, এই সুযোগে ইফতেখার তরুণীর ছবি তোলারত অবস্থায় আমার একটি ছবি তুলে নিয়েছে। সেই ছবিটি দিয়ে সে আমাকে বেশ বেকায়দায় ফেলতে পারত।

অন্য যে-ছবিটির সামনে দর্শকের ভিড় জমে গিয়েছিল সেটি হচ্ছে ভ্যান গঘের ‘স্ট্যারি নাইট’। শিল্পী যখন মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন একসময় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দক্ষিণ ফ্রান্সের সাঁ-রেমিতে এক অ্যাসাইলামে গিয়ে উঠেছিলেন। সেখানে এক ভোরে সূর্য ওঠার অনেক আগে জেগে রাতের আকাশের একটি তারা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে যে-ছবিটি তিনি এঁকেছিলেন তারই নাম ‘স্ট্যারি নাইট’। মোমার গ্যালারিতে এ-ছবিটির সামনের ভিড় দেখে আমার মনে পড়ে গেল প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামে ‘মোনালিসা’র সামনের ভিড়ের কথা। এতটা না হলেও ‘স্ট্যারি নাইটে’র ছবি তোলার জন্য ভিড় জমে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর অন্য ছবি ‘দ্য অলিভ ট্রিজ’ দেখার জন্য তেমন ভিড় ছিল না।

প্যারিস বাদে অন্য কোনো জায়গায় কেউ পিকাসোর কাজ দেখতে চাইলে আমার মনে হয় মোমার কথা বলতে হবে। কিউবিস্ট ধারার শিল্পকর্মের প্রতি এই মিউজিয়ামের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে বলে আমার মনে হয়, কারণ অনেক বছর আগে একবার এখানেই আমি দেখেছিলাম পিকাসো এবং মাতিসের যুগলবন্দি ধরনের একটি বিশেষ প্রদর্শনী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গ্যালারি থেকে এই দুই শিল্পীর অনেক ছবি এনে বিশেষ প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছিল মোমা। এখানকার স্থায়ী সংগ্রহের ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে পিকাসোর বিখ্যাত ছবি ‘লে দেমোয়াজেল দ’আভিনিও’ (সরল বাংলায় বললে দাঁড়ায় ‘অ্যাভিনিউর গণিকাগণ’)। ১৯০৭ সালে বড় ক্যানভাসে আঁকা এই ছবিটি সে-সময়ের শিল্পজগতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

ফরাসি চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর (পিকাসোর বন্ধু) অঁরি মাতিসেরও বেশ কয়েকটি ছবি রয়েছে মোমার গ্যালারিতে। দেখা গেল তাঁর বড় ক্যানভাসের ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘দ্য ডান্স’ এবং ‘দ্য মরোক্কানস’। ১৯১২ এবং ১৯১৩ সালে শিল্পী মরক্কোতে গিয়েছিলেন বারকয়েক এবং সে-সময় বেশ কয়েকটি ছবি এঁকেছিলেন – যার অন্যতম ‘দ্য মরোক্কানস’। একটি বড় ক্যানভাসে মসজিদ, ব্যালকনিতে ফুলের টব, সবজি দিয়ে স্টিল লাইফ, পাগড়িপরিহিত মরক্কোর লোকের খানিকটা অবয়ব – সব মিলিয়ে একটি সার্বিক চিত্র সৃষ্টির ভালো উদাহরণ এ-ছবিটি।

পল গগাঁ জীবনের একসময় তদানীন্তন ফরাসি উপনিবেশ তাহিতিতে গিয়ে কিছুদিন বাস করেছিলেন, এবং সেখানকার প্রকৃতি ও জীবনের বেশকিছু ছবি এঁকেছিলেন। তবে সেগুলোর মধ্যে বেশি বিখ্যাত (এবং অনেক মিউজিয়ামে দেখা যায়) ‘তাহিতির নারী’ – এই সিরিজের ছবিগুলো। তার একটি নামকরা ছবি ‘দ্য সিড অব দ্য আরিওই’ দেখা গেল মোমার গ্যালারিতে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় এক নগ্নদেহী নারী বসে আছে পাহাড় আর লেকের পটভূমিতে  – যা প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশীয় অঞ্চলের একটি সাধারণ দৃশ্য। কিন্তু ভালো করে লক্ষ করলে ছবিটির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নজরে পড়ে।

প্রথমত, নারী যেভাবে ঋজু ভঙ্গিতে গম্ভীরভাবে বসে আছে (শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চ শ্রেণির মিশরীয় নারীদের যেভাবে উপবিষ্ট দেখানো হয়, অনেকটা সেরকম) তা থেকে তাকে মর্যাদাসম্পন্ন বলে মনে করা যায়। দ্বিতীয়ত, তার বাঁহাতে একটি অঙ্কুরিত আমের আঁটি – যাকে উর্বরতা এবং নবজীবনের প্রতীক বলে মনে করা যায়। তার বাঁপাশে একটি ছোট টেবিলে আরো কয়েকটি ফল (মনে করা যেতে পারে যে সেগুলোও আম) রাখা।

ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে পারলাম যে, ‘আরিওই’ এককালে ছিল ফরাসি পলিনেশীয় অঞ্চলের কোনো এলাকার একটি গোপন ধর্মীয় গোত্র, যার সদস্যরা বিশ্বাস করত যে, তাদের দেবতার সঙ্গে বিশ্বের সেরা সুন্দরীর সঙ্গমের ফলে তাদের সৃষ্টি হয়েছে; এবং এই গোত্রে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। সুতরাং গগাঁর এ-ছবিতে আঁকা নারীকে পলিনেশীয় (বা তাহিতির) সুন্দরী বললে অতিরঞ্জন হওয়ার কথা নয়।

প্রায় সব চিত্রশিল্পীই স্টিল লাইফ ধরনের ছবি আঁকেন – বিষয়বস্তুতে থাকে ফুল এবং ফুলদানি, ফল এবং ফল রাখার পেয়ালা, সবজি, গাছ, গ্লাস, বোতল ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জড় বস্তু। কেউ কেউ মাছ, মাংস এসব জিনিসও উপস্থাপন করেন স্টিল লাইফ হিসেবে। পল সেজানের ‘মিল্ক ক্যান অ্যান্ড অ্যাপলস’ ছবিতে শুধু আপেল নয়, রয়েছে কমলা এবং বাগেট (ফরাসি লম্বাটে ধরনের রুটি) – সব একটি টেবিলের ওপরে ছড়ানো। ফলগুলোর পাশে একটি সাদা টেবিল ক্লথ ভাঁজ না করেই রাখা হয়েছে – যেন কিছুটা অযতেœই ফেলে রাখা। কাপড়টি এমনভাবে রাখা যাতে তার মাঝের জায়গাটি উঁচু হয়ে একটি ছোট পাহাড়ের ধারণা দিচ্ছে। এমনভাবে রঙের ব্যবহার করা হয়েছে যে, সব মিলিয়ে একটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের আবহও সৃষ্টি হয়েছে।

অল্প কদিন পরেই গুগেনহাইম মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলাম পিকাসোর আঁকা টেবিলের ওপর পানির জগ এবং পেয়ালায় সাজানো ফল, আর মেটে মোনের আপেল এবং আঙুর। বিষয়বস্তুতে তেমন কোনো পার্থক্য না থাকলেও সবগুলোই তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র।

পাঁচতলায় ইম্প্রেশনিস্ট এবং পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট ছবির সংগ্রহ দেখতে দেখতেই পেটের ঘড়িতে লাঞ্চের খবর পেলাম। আর আসল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে, পেট বেচারার কোনো দোষ নেই। এর মধ্যে অবশ্য আমরা একদফা কফি খেয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন খাবারের জন্য যেতে হলো চারতলার রেস্তোরাঁয়। সেখানে শুধু স্যান্ডউইচ নয়, গরম খাবারও পাওয়া যাচ্ছিল। আর সেমি-ক্যাফেটারিয়া স্টাইলের ব্যবস্থা – খাবার অর্ডার করে পয়সা দিয়ে টেবিল খুঁজে বসে যাও, খাবার তৈরি হলে টেবিলেই সার্ভ করা হবে ।

 

উত্তর-আধুনিক, সমসাময়িক?

খাওয়া সেরে এবার আমি গেলাম বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীতে। আধুনিক, উত্তর-আধুনিক, সমকালীন – এসব ধারণার সঙ্গে আমার পরিচয় ভাসাভাসা। সুতরাং বিংশ শতকের ষাটের দশক এবং তার পরের যেসব কাজ দেখলাম সেগুলোকে উত্তর-আধুনিক না সমসাময়িক বলব, সে-সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। তবে ‘আধুনিক’ হিসেবে ১৮৮০ থেকে ১৯৪০ সময়কালের যেসব কাজ দেখেছি তাদের চেয়ে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের এবং একবিংশ শতকের কাজগুলোর যে প্রকৃতিতে অনেক তফাৎ তা খুবই পরিষ্কার। শুধু কাঠামো বা ফর্ম নয়, তাদের পেছনের ভাবনা বা প্রণোদনাও যে আলাদা তা বুঝতে বিরাট বোদ্ধা হওয়ার দরকার নেই। আর তা হবে না কেন! দুটি শিল্পবিপ্লবের পর পশ্চিমাজগতে নগরায়ণ হচ্ছিল দ্রুতগতিতে। নাগরিক জীবনের টানাপড়েন আর অনিশ্চয়তা, আশা এবং নিরাশা সবই যে শিল্পীদের এবং তাঁদের কাজকে প্রভাবিত করেছে তার প্রতিফলন দেখা যায় প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলোতে।

ইম্প্রেশনিস্ট এবং পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্টরাও বাস্তব জীবনের এবং খেটে-খাওয়া মানুষের ছবি এঁকেছিলেন। ভ্যান গঘের বেশকিছু ছবির বিষয় ফসল কাটা বা ঘরে তোলা এবং শিল্পশ্রমিকদের কাজ বা কাজের পরিবেশ। সেজান এঁকেছেন জেলেদের ছবি। মেটে দেখেছি পিসারিওর আঁকা কৃষিশ্রমিকদের আলু তোলার দৃশ্য। তবে মোমায় সমকালীন শিল্পীদের কাজের মধ্যে দেখা যায় বিভিন্ন মাধ্যমের ব্যবহার; তাদের প্রকাশও অনেক বেশি তীক্ষè এবং স্যাটায়ারধর্মী। ২০১৭ সালে আঁকা মার্কিন শিল্পী কারা ওয়াকারের কোলাজ ছবি ‘ক্রাইস্ট’স এন্ট্রি ইনটু জার্নালিজম’ এ-ধরনের কাজের একটি ভালো উদাহরণ। শুধু পেনসিল আর কলম দিয়ে কাগজের ওপর আঁকা ছবি। ছোট ছোট ছবি এঁকে বড় কাগজের ওপর পেস্ট করা। এতে ধরা হয়েছে সমকালীন ঘটনাবলি থেকে বৈষম্য, বর্ণবাদ, নিপীড়ন এবং অন্যায়ের চিত্র।

আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে আমার কম যাওয়া হয় – এ-কথা স্বীকার করতে মোটেই দ্বিধা নেই। তবে যখনই এ-ধরনের কোনো প্রদর্শনীতে অথবা কোনো মিউজিয়ামের ফটোর অংশে গিয়েছি, তখনই বুঝেছি যে, শিল্পের মাধ্যম হিসেবে এটি কত কৌতূহলোদ্দীপক হতে পারে এবং মানুষের মনকে কেমন নাড়া দিতে পারে। মাধ্যম হিসেবে ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’ (কিছু ফটো একত্র) করে কোলাজ সৃষ্টি করা অনেক শিল্পীর প্রিয়; মোমাতেও রয়েছে এরকম কাজ। একটি ঘরে এরকম কোলাজের প্রদর্শনীতে ঢুকতে গিয়ে চোখে পড়ল সতর্কবার্তা : ‘এখানকার প্রদর্শনী কারো কারো জন্য অনুপযোগী হতে পারে।’ সেখানকার একটি পুরো দেয়ালে এক বিশাল কোলাজ, যাতে মানবশিশুর জন্মের বিভিন্ন পর্যায় বিধৃত হয়েছে। যৌনকর্ম থেকে শুরু করে শিশু প্রসবের দৃশ্য পর্যন্ত তাতে অন্তর্ভুক্ত। একমুহূর্ত দেখেই আমার মনে হলো যে, সতর্কবার্তাটি যথাযথ, কারণ তাতে কিছু ছবি রয়েছে যেগুলো রক্ষণশীল বা দুর্বলচিত্ত দর্শকের উপযোগী নাও হতে পারে। কিন্তু প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু যদি হয় ‘বিয়িং হিউম্যান’, তবে ‘হিউম্যান বিয়িং’-এর গোড়ায় যাওয়ার যুক্তি অবশ্যই থাকতে পারে।

রংতুলি আর ক্যামেরা বাদেও শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে তাঁদের ধ্যান-ধারণা এবং মনের ভাব প্রকাশ করেন। ভাস্কর্যের যে কত প্রকার হতে পারে তার কিছুটা নমুনা পেলাম মোমায়। সেসব কাজে কত ধরনের জিনিসই না ব্যবহার করা হয়। ভাবের রাজ্যেও কী নেই! আধ্যাত্মিকতা, মরমিবাদ, পৌরাণিক কাহিনি, বিশ্বব্রহ্মা- এবং তার সম্ভাব্য ধ্বংস ইত্যাদি কোনো কিছুই বাদ নেই। এক ঘরে ছাদ থেকে ঝুলছে বিশাল ঝাড়বাতির মতো এক জিনিস – যার মাধ্যমে শিল্পী দেখাতে চাইছেন বিশ্বব্রহ্মা- সম্পর্কে তাঁর ধারণা। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করে একেবারে সমসাময়িক কাজের বিশাল ভাণ্ডার এই মোমাতে।

এক ঘরে চলছিল একটি নির্বাক ছায়াছবি। কাছে গিয়ে তার পরিচিতি পেলাম : মার্কিন চিত্রগ্রাহক এরনি গেহরের ‘এসেক্স স্ট্রিট কোয়ারটেট’ – যাতে রয়েছে চারটি বিভিন্ন দৈর্ঘ্যরে শর্টফিল্ম। বিংশ শতকের তিরিশের দশকে ম্যানহাটনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এক ভবনের ভেতর কিছু ছোট দোকান নিয়ে গড়ে উঠেছিল এসেক্স স্ট্রিট মার্কেট। কিন্তু সত্তরের দশকে এদের অবস্থা কিছুটা খারাপের দিকে যায়; আর তখনই শিল্পী এই শর্টফিল্মগুলো তৈরি করেন। অনেক বছর বাক্সবন্দি থাকার পর বর্তমান শতকের প্রথমদিকে এগুলো পৃথিবীর আলো দেখতে পায়। আমি দেখলাম ১৯ মিনিটের ছবি ‘নুনটাইম অ্যাকটিভিটিজ’। লাঞ্চের সময় রাস্তায় লোকের চলাফেরা, কেউ কিছু জিনিস কিনছে, আবার কেউ বা লাঞ্চ খাচ্ছে স্যান্ডউইচ আর এক কাপ কফি নিয়ে। একটি নির্বাক সাদা-কালো ছবি কীভাবে জনজীবনের একটি খ-চিত্র সফলভাবে তুলে ধরতে পারে আর তা দর্শককে ধরে রাখতে পারে – এই ছবিটি তার ভালো উদাহরণ। আমার সময় থাকলে বাকি তিনটি ছবিও দেখতাম। কিন্তু আমাদের বাড়িতে ফেরার একটি সময় নির্দিষ্ট করা ছিল বলে অনেক অপূর্ণতা নিয়েই সেদিন ছাড়তে হয়েছিল মোমা।

দেখা হলো না এমন কাজের মধ্যে রয়ে গেল ‘দ্য লং রান’ শিরোনামে একগুচ্ছ কাজ – যেখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল নির্বাচিত কয়েকজন শিল্পীর পরিণত সময়ের কাজ। মোমার মতো বড় মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে ফেরার সময় প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে, বাঁধাধরা সময় নিয়ে এ-ধরনের জায়গায় যাওয়া উচিত নয়। বেছে বেছে কিছু কাজ দেখলেও সময় লাগে অনেক। তাছাড়া এমন কিছু কাজ থাকে যাদের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সময়ের অভাবে তা সম্ভব হয় না। আর তাই প্রায় সব সময়ই আমার মনে হয়, ভালো করে দেখা হলো না।