নূরজাহান বেগম : এক বিজয়লক্ষ্মী নারীর সঙ্গে

প্রসঙ্গকথা

নূরজাহান বেগম। জন্ম ৪ঠা জুন ১৯২৫, চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে, নানাবাড়িতে। মুসলিম নারীসমাজের প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগম-এর সম্পাদক তিনি। অন্ধকারাচ্ছন্ন বাঙালি মুসলমান সমাজে বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও কন্যা নূরজাহান বেগম যথাক্রমে সওগাত ও বেগম নিয়ে যে-সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, তা আজ কিংবদন্তির মর্যাদা লাভ করেছে। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার অধিকারী মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ছিলেন বাঙালি মুসলমান সমাজের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। বাবার উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনা কন্যা নূরজাহান বেগমের মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ২০শে জুলাই প্রথম প্রকাশিত সচিত্র সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা নূরজাহান বেগমের মৃত্যুর পর এখনো প্রকাশিত হচ্ছে। যদিও পত্রিকাটি এখন সাপ্তাহিক থেকে মাসিকে রূপান্তরিত হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, নূরজাহান বেগম অবিভক্ত বাংলার নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। সাপ্তাহিক বেগম নিয়ে এই মহীয়সী নারীর নিরন্তর যে লড়াই তা পরবর্তীকালের নারীদের ঝুঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতাপেশায় আত্মনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছে। ১৯৫২ সালের আগস্টে নূরজাহান বেগম ভালোবেসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সঙ্গে। ইত্তেফাকের ‘কচি-কাঁচার আসর’-এর প্রতিষ্ঠাতা দাদাভাইয়ের নিরন্তর উৎসাহ ও প্রেরণা নূরজাহান বেগমকে আজীবন জুগিয়েছে জীবনসংগ্রামের সঞ্জীবনী শক্তি। এই আজীবন-উদ্যোগী নারী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জীবদ্দশায় পেয়েছেন রোকেয়া পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা। ২০১৬ সালের ২৩শে মে এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুর পর ২০১১ সালে তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় ‘একুশে পদক’। ২০০৮ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ক্যানভাসের আলোকচিত্রী রুমানা জাবীনকে সঙ্গে নিয়ে ৬৬ পাটুয়াটুলীর বেগম অফিসে এই বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি হয়েছিলাম। তিনি সেদিন প্রাণখোলা আড্ডায় আমাদের সামনে মেলে ধরেছিলেন তাঁর জীবনের আদ্যন্ত। ভবিষ্যতের পাঠকদের কথা চিন্তা করে তাই সাক্ষাৎকারটি গ্রন্থনা করা হলো।

মতিন রায়হান : আপা, কেমন আছেন?

নূরজাহান বেগম : এই তো ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?

মতিন রায়হান : জি, ভালো আছি। আপা, আপনি ব্যস্ত মানুষ। বেশি সময় নেবো না। আমরা কথা শুরু করি?

নূরজাহান বেগম : আচ্ছা, শুরু করতে পারো।

মতিন রায়হান : প্রথমেই জানতে চাই, আপনার জন্ম কখন এবং কোথায়?

নূরজাহান বেগম : আমার জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ঠা জুন, চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে, নানাবাড়িতে।

মতিন রায়হান : শুরুতেই আপনার ছেলেবেলার গল্প শুনতে চাই।

নূরজাহান বেগম : আমার বাবা সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। তিনি ছিলেন অবিভক্ত মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, সাংবাদিকতা ও সাহিত্য আন্দোলনের পথিকৃৎ। আমার মা ফাতেমা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। মা অল্প পড়াশোনা জানতেন। 

মতিন রায়হান : জি, জানি। আপনার বাবার সম্পাদিত সওগাতে লিখেই কাজী নজরুল ইসলামসহ বহু বাঙালি লেখকের লেখালেখির সূচনা ঘটে। এবার আপনার শৈশবের গল্প শুনতে চাই।

নূরজাহান বেগম : আমার কোনো ভাইবোন ছিল না। তাই আমি ছিলাম বাবা-মায়ের খুব আদরের। অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে আমার জন্ম। আমার শৈশবের অধিকাংশ সময় কেটেছে নানাবাড়িতে। মা সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন তাঁর আদরের নুরুকে। আমার ডাক নাম নুরু। বাবা-মা আমাকে নুরু বলেই ডাকতেন। নানা কিংবা দাদাবাড়িতে অভাব-অনটনের সামান্য ছোঁয়াও ছিল না। গোয়ালভরা গরু ছিল। বাড়ির অন্দরে দুধ আসতো গামলা ভরে। ছিল পুকুরভরা  মাছ। মামা-চাচারা মাছ ধরতেন। গাছের নিচে ফলফলাদি পড়ে থাকতো। খাওয়ার লোক নেই। রংবেরঙের পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকতো চারপাশ। বসন্তকালে কোকিলের কুহুতানে মন কেমন আনচান করে উঠতো। তখন কত আর বয়স, তিন-সাড়ে তিন বছর হবে। ছোট্ট বলেই মায়ের কত নজরদারি! ঝোপঝাড়ে যেন না যাই। বলতেন, এদিকে যেও না, ওদিকে যেও না, কত কী নিষেধের বেড়ি। মেয়ের একটা কিছু হয়ে গেলে কী জবাব দেবেন স্বামীর কাছে! স্বামী তো মহাব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন কলকাতায়। সওগাতই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। এতো নজরদারির পরও পরপর দুটি অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেল। একবার পুকুরে, আরেকবার খালে পড়ে গেলাম। কাছারিঘরের পাশ দিয়ে খালটি বয়ে গেছে। সওগাত নিয়ে বাবা একাই থাকতেন কলকাতায়। পূজার ছুটিতে দিনদশেকের জন্যে বাড়িতে আসতেন। নানারকম খেলনা ও জুতো নিয়ে আসতেন। তখন আমার মনে যেন আনন্দ আর ধরে না। সারাক্ষণ কাঠবেড়ালির মতো লাফিয়ে বেড়াই। সেই বয়সে কাদার মধ্যে পা ডুবিয়ে হাঁটতে কী যে মজা লাগতো! মা কিন্তু রাগ করতেন। বাবা বাড়িতে এলে মা ও আমাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইতেন। দাদি ও নানি দুজনেই বাধা দিতেন। উভয় পরিবার থেকেই বাধা। তাঁদের কথা, বউ বেপর্দা হয়ে যাবে। তখন মুসলমান সমাজে বাড়াবাড়ি রকমের রক্ষণশীলতা। সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কার। কিন্তু আমার দুবার পানিতে পড়ার সংবাদ পেয়ে কলকাতায় বাবা অস্থির হয়ে ওঠেন। এই কারণে বাবা একটা শক্ত অজুহাত পেয়ে গেলেন আমাদের কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার। বাবা বড়ো মামাকে কড়া ভাষায় চিঠি লিখে পাঠালেন যে, নুরু ও নুরুর মাকে নিয়ে আপনি অমুক দিন কলকাতায় আসবেন, আমি শিয়ালদা স্টেশনে আপনাদের জন্যে অপেক্ষায় থাকবো, অবশ্যই আসবেন। নিরুপায় হয়ে বড়ো মামা নির্দিষ্ট দিনে আমাদের নিয়ে কলকাতায় গেলেন। তখন আমার বয়স সাড়ে তিন বছর। আমাদের নিয়ে তোলা হলো ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটে। নিচতলায় সওগাত প্রেস। দোতলায় সওগাত অফিস ও আমাদের থাকার জায়গা।

মতিন রায়হান : শেষ পর্যন্ত কলকাতায় যেতে হলো!

নূরজাহান বেগম : হ্যাঁ, বাবা বাধ্য করলেন। আমি যখন কলকাতায় গেলাম তখন আমার গ্রামীণ চেহারা। মা তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দুপাশে শিংয়ের মতো বেণী বাঁধতেন। বাবা বললেন, আমার মেয়েটাকে ভূত করে এনেছো কেন? নাকে নাকফুল দিয়েছো, কান ফুঁড়িয়ে এনেছো। এসব এখানে চলে না। তাই বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন স্বর্ণবণিকের দোকানে। দাদির পরিয়ে দেওয়া নাকফুল কেটে খুলে ফেললেন। বেড়াবার কথা বলে সেলুনে নিয়ে চুল বব ছাঁটিয়ে নিয়ে এলেন। মাকে না বলে এসব করার জন্য মা মনে মনে খুব রাগ করলেন। কিন্তু তেমন উচ্চবাচ্য করলেন না। কারণ মা ছিলেন বেশ শান্ত স্বভাবের। দিনে দিনে এভাবেই আমার কলকাতার জীবন বদলে যেতে থাকে।   

মতিন রায়হান :  বাহ্, দারুণ ব্যাপার! অল্পদিনেই বাবার পছন্দের নুরু হয়ে উঠলেন। লেখাপড়ার শুরু কীভাবে?

নূরজাহান বেগম : বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের। তিনি একদিন বাবাকে বললেন, নুরুকে আমার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন। বাবা বললেন, ও তো খুব ছোট। বেগম রোকেয়া বললেন, বেবি ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিন। মা এই ব্যাপারে আপত্তি করলেন। বললেন, এতো ছোট মেয়ে স্কুলে যাবে! বাবা বললেন, আমিই ওকে স্কুলে নিয়ে যাবো। কান্নাকাটি করলে আমিই বাড়ি নিয়ে আসবো।

বাবা আমাকে একদিন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে নিয়ে গেলেন। আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো বেবি ক্লাসে। স্কুলটি ছোট। কিন্তু আমার খুব পছন্দ হলো। দোতলা বাড়ি। চমৎকার পরিবেশ। স্কুলে তিনজন আয়া। একজন খাওয়াতো, একজন ময়লা পরিষ্কার করতো আর অন্যজন বাসে উঠিয়ে দিতো। স্কুলে পড়ানো হতো খেলার মধ্য দিয়ে। দুপুরে খাওয়ার পর রেস্টরুমের ছোট ছোট খাটিয়ায় একেকজনকে শুইয়ে দেওয়া হতো। গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লে তাকে আর জাগানো হতো না। স্কুলে ভর্তির আগে আমি তো বাসায় একা ছিলাম। তখন খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতাম। স্কুলে ভর্তির কারণে

আমার নিঃসঙ্গতা দূর হয়ে গেল। শিশুদের মনোবিকাশের  সবরকম সুযোগ ছিল স্কুলে। এখানে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়ি। অ-আ মানে বাংলা লেখার হাতেখড়ি দিয়েছেন মা। বাবা দিয়েছেন ইংরেজি ও আরবি। ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো বেলতলা হাইস্কুলে। এখানে ফোর পর্যন্ত পড়ি। আবার ফিরে যাই সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে। ওখানে ফাইভে ভর্তি হই। টেন পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়ি। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিই সাখাওয়াত মেমোরিয়াল থেকেই। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করি। এই স্কুলজীবনটা আমার জীবনে সবচেয়ে সুন্দর সময়। নাচ-গান ও আবৃত্তি এই স্কুলেই শিখেছি।

মতিন রায়হান : তারপর ইন্টারমিডিয়েটে কোথায় ভর্তি হলেন?

নূরজাহান বেগম : ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলাম লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। এটা ১৯৪২ সালের কথা। কলেজে বছরে একবার নাটক হতো। আমি নাটকে অংশ নিতাম। আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম। সব রকমের খেলাধুলা হতো। খেলাধুলায়ও অংশ নিতাম। আমার অনেক খেলার হাতেখড়ি হয়েছে কলেজে। বিভিন্ন গল্পের নাট্যরূপ দেওয়ার হাতেখড়িও এখানে হয়েছে। এক ঘণ্টার মধ্যে নাটক শেষ করতে হতো। ১৯৪৪ সালে এই কলেজ থেকে আইএ পাশ করি। ১৯৪৬ সালে এই কলেজ থেকেই বিএ পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। এখানেই আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে।

মতিন রায়হান : সত্যি, এটি দুঃখজনক ঘটনা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হলে হয়তো আপনার উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ ঘটতো।

নূরজাহান বেগম : ঠিকই বলেছো।

মতিন রায়হান : আমরা জানি, আপনার বাবার সওগাত পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সওগাত অফিসে ‘সওগাত সাহিত্য মজলিস’-এর আসর বসতো। কারা উপস্থিত থাকতেন সাহিত্যের এসব আসরে?

নূরজাহান বেগম : বাবার কাছে শুনেছি, ১৯২৬ সাল থেকে সওগাত অফিসে ফরাশ বিছিয়ে সওগাত সাহিত্য মজলিশের আসর বসতো। এসব আসরে নিয়মিত আসতেন যুদ্ধফেরত হাবিলদার, কবিযশোপ্রার্থী কাজী নজরুল ইসলাম। আসতেন আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, জসীম উদ্দীন, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন, এস ওয়াজেদ আলী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, শাহাদৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, ঢাকা থেকে আসতেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল কাদির, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, চট্টগ্রাম থেকে মাঝে মাঝে আসতেন আবুল ফজল প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক-গবেষক।

মতিন রায়হান : আপনার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হলো কীভাবে?

নূরজাহান বেগম : আমার ছোট সময় থেকেই বাবার ইচ্ছে ছিল আমাকে সাংবাদিক করে গড়ে তুলবেন। বিভিন্ন ছবির বই, ম্যাগাজিন নিয়ে আসতেন আমার জন্যে। নিয়ে আসতেন বিদেশি বইও। ছবি দেখতাম। জিওগ্রাফিক্যাল ম্যাগাজিন খুব ভালো লাগতো। নানারকম আকর্ষণীয় ফুল, পাখি, প্রজাপতির ছবি থাকতো। বাবা ছবি কেটে ফাইলিং করতেন। আমাকে বলতেন, মিসরের ফাইলটা আনো তো নুরু। কামাল আতাতুর্কের ছবি দেখে ভালো লাগতো। তুরস্কের ম্যাগাজিন কেটে বাবা ছবি ফাইলিং করতেন। কখনো বলতেন, কামাল আতাতুর্কের ব্লকটা নিয়ে এসো। বাবার ফুটফরমাশ খাটতে খাটতে আমার মধ্যে সাংবাদিক হওয়ার নেশা জাগতো। তখন আমার বয়স পাঁচ-ছয় বছর।

মতিন রায়হান : বাবাই তাহলে ছোট্ট বয়সে সাংবাদিকতার নেশা তৈরি করে দিলেন?

নূরজাহান বেগম : ঠিক তাই। আমার বাবা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার মানুষ। নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। মাসিক সওগাতের প্রথম সংখ্যাতেই বাবা বেগম রোকেয়া ও মানকুমারী বসুর কবিতা ছেপে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় দেন। নারীর সৃজনশীলতায় উৎসাহ জোগাতে সওগাতে ‘জেনানা মহল’ নামে একটি আলাদা বিভাগ খোলেন। অবশ্য তখন এই বিভাগে বাঙালি মুসলমান মেয়েদের কোনো সংবাদ ছাপানো সম্ভব হয়নি। ছাপা হতো বিদেশি মেয়েদের নানা সচিত্র সংবাদ। ১৯৩০ সালে প্রথম সওগাত মহিলা সংখ্যা বের করা হয়। প্রতিবছর এরকম একটি বিশেষ সংখ্যা বের করা হতো। সওগাতের শেষ মহিলা সংখ্যা বের হয়  ১৯৪৫ সালে। পরবর্তীকালে বাবার এসব চিন্তাচেতনা ও কর্মকাণ্ড আমার মধ্যে বিশেষ প্রভাব ফেলে।

মতিন রায়হান : এবার বেগম প্রকাশের গল্পটা শুনতে চাই।

নূরজাহান বেগম : ১৯৪৬ সালে পার্কস্ট্রিটে থাকতেন কবি সুফিয়া কামাল। বাবা তাঁকে বললেন, আমি তোমাদের একটা সাপ্তাহিক কাগজ প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিই। বাবার প্রস্তাবে সুফিয়া কামাল সম্মতি জানালেন। তারপর বেগম প্রকাশের প্রস্তুতি শুরু হলো। ১৯৪৭ সালের ২০শে জুলাই প্রকাশিত হলো সচিত্র সাপ্তাহিক বেগম। উপমহাদেশের বাঙালি মুসলমানদের প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা। সম্পাদিকা করা হলো সুফিয়া কামালকে আর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা হলাম আমি। সাতচল্লিশ সালে দেশভাগ হয়ে গেলে সুফিয়া কামাল তাঁর স্বামীর সরকারি চাকরির সুবাদে ঢাকায় চলে আসেন। চার মাস পর আমি বেগম সম্পাদিকার দায়িত্ব গ্রহণ করি। ডবল ক্রাউন সাইজের বেগম-এর দাম চার আনা। বিভিন্ন বিভাগের নাম বাবা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। একপর্যায়ে সকল সম্প্রদায়ের লেখিকাদের মিলনস্থল হয়ে ওঠে বেগম। আমাদের সম্পাদনায় কলকাতায় তিন বছর বেগম প্রকাশনা অব্যাহত থাকে। প্রথম বেগম ‘ঈদসংখ্যা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। এটি বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রথম সচিত্র ঈদসংখ্যা। একই বছর প্রকাশিত হয় বেগম ‘বিশ্বনবী সংখ্যা’। এর সব লেখাই কিন্তু মেয়েদের। ১৯৪৯ সালে আরেকটি ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালের শেষ দিকে আমরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসি। ঢাকার বিজয় চন্দ্র বসুর সঙ্গে আমাদের সকল সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করা হয়। ৬৬ পাটুয়াটুলীর ‘বিজয় প্রেস’ নাম বদল করে হয়ে যায় ‘সওগাত প্রেস’। আমাদের আবাসিক ঠিকানা হয়ে ওঠে নারিন্দার ৩৮ শরৎগুপ্ত রোড।

মতিন রায়হান : তারপর তো শুরু হয়ে গেল বেগম-এর ঢাকা পর্ব। এ-সম্পর্কে কিছু বলুন।

নূরজাহান বেগম : হঠাৎ করে ঢাকায় চলে এলাম। এখানে এসে আস্তে আস্তে গুছিয়ে নেওয়া শুরু হলো। ১৯৫০ সালেই বেগম-এর প্রকাশনা শুরু করলাম। তা আজো অব্যাহত আছে। ১৯৫৪ সাল থেকে আবারো সওগাত প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

মতিন রায়হান : রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয়ের সূত্র কী? আপনাদের কখন বিয়ে হলো?

নূরজাহান বেগম : তোমাদের ‘দাদাভাই’ কলকাতায় ইত্তেহাদে কাজ করতেন। ১৯৪৮ সালে তিনি যখন শিশু সওগাতে যোগদান করলেন তখনই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। দুঃখের ব্যাপার কী, তিনি যে-বছর শিশু সওগাতে যোগদান করেন সে-বছরই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও শিশু সওগাত প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে। শিশু সওগাতে কবি আহসান হাবীবের মতো দাদাভাইও সহকারী ছিলেন।

১৯৫২ সালের আগস্টে রোকনুজ্জামান খানের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। তাঁর সঙ্গে আমার পরিণয় ছিল, ভালোবেসে বিয়ে করেছি। রোকনুজ্জামানকে বাবা ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। তারপরও বাবা এই বিয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন। একপর্যায়ে তিনিই দাদাভাই ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত জানালেন। রোকনুজ্জামান বিয়ের মধ্যস্থতা করার জন্য শেরেবাংলা একে ফজলুল হককে ধরলেন। আমার ইচ্ছের কাছে বাবা হার মানলেন। বিয়ের পর বাবার শর্ত মেনে রোকনুজ্জামান শ্বশুরবাড়িতেই উঠলেন। দাদাভাইয়ের নানা ছিলেন সাংবাদিক রওশন আলী চৌধুরী আর তাঁর নানার ভাই ছিলেন সাহিত্যিক এয়াকুব আলী চৌধুরী। 

মতিন রায়হান : আপনার কর্মজীবনে স্বামীর কেমন ভূমিকা ছিল?

নূরজাহান বেগম : আমার স্বামী ইত্তেফাকের ‘কচি-কাঁচার আসরে’র প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫৬ সালে শিশুদের মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তিনি কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার আসর প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি সকলের প্রিয় ‘দাদাভাই’ হয়ে ওঠেন। আমার কাজে তিনি খুব উৎসাহ দিতেন।

মতিন রায়হান : নারীর সামাজিক উন্নয়নে আপনি নিরন্তর চেষ্টা করছেন। আপনার কাছে এক্ষেত্রে কোন বিষয়টি প্রতিবন্ধক মনে হয়?

নূরজাহান বেগম : মেয়েদের বিয়ের সময় শুধু অর্থের দিকে না দেখে যদি পাত্র নির্বাচন করা হয়, তাহলে আমার মতো অনেক নূরজাহান সৃষ্টি হবে। আমাদের সমাজে যৌতুক একটি অভিশাপ। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণিতেই সেটা লক্ষণীয়। মেয়েদের শিক্ষিত হতে হবে, স্বাবলম্বী হতে হবে। মেয়েরা স্বনির্ভর হলে যৌতুকের মতো অভিশাপ সমাজ থেকে ক্রমশ দূর হবে।

মতিন রায়হান : আপনার ছেলেমেয়ে সম্পর্কে জানতে চাই।

নূরজাহান বেগম : আমার দুই মেয়ে। বড়ো মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন খান ও ছোট মেয়ে রিনা ইয়াসমিন আহমেদ। দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। ফ্লোরা ইংরেজিতে মাস্টার্স, বর্তমানে বেগম-এর সহকারী সম্পাদক। ফ্লোরার স্বামী ড. ফজলুর রহমান শিল্পপতি। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে গৌরব রহমান, যুক্তরাষ্ট্রে গ্র্যাজুয়েশন করছে। মেয়ে মুনিয়া খান পড়ছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। ছোট মেয়ে রিনা ইয়াসমিন, সোশিওলজিতে মাস্টার্স। রিনার স্বামী ইফতেখার আহমেদ মারা গেছে। ইফতেখার চাকরি করতো আরব বাংলাদেশ ব্যাংকে। এই দম্পতির দুই মেয়ে। বড়ো মেয়ে হৈমি আহমেদ; সে পড়ছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। ছোট মেয়ে প্রিয়তা আহমেদ, প্রিয়তা ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এ-লেভেলে পড়ছে।

মতিন রায়হান : ক্যানভাস তো ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল বিষয়ক ম্যাগাজিন। এবার এ-সম্পর্কিত দুয়েকটি প্রশ্ন করছি। আপনার পছন্দের পোশাক কী?

নূরজাহান বেগম : ছোটবেলায় ফ্রক পরতাম। ফ্রক ছাড়ার পর থেকেই শাড়ি পরি। শাড়িই আমার পছন্দ। সুতি শাড়ি।

মতিন রায়হান : আপনার প্রতিদিন কীভাবে কাটে?

নূরজাহান বেগম : নানারকম অসুখবিসুখ ধরেছে। তারপরও প্রতিদিন বেগম অফিসে আসি। এগারোটা থেকে দুটা পর্যন্ত থাকি।

মতিন রায়হান : বর্তমানে বেগম কীভাবে প্রকাশিত হচ্ছে যদি বলতেন।

নূরজাহান বেগম : বর্তমানে বেগম মাসিক হিসেবে বের করি। বেগমের স্টাফ চারজন, প্রেসকর্মী পাঁচজন। বেগম-এর গ্রাহকসংখ্যা প্রায় এক হাজার। কেউ কেউ ডোনেশনও দেন।  গ্রাহকদের ডোনেশন ও বিজ্ঞাপনের টাকা দিয়েই বেগম প্রকাশিত হচ্ছে। মাসে দুই হাজার কপি ছাপা হয়। প্রতি সংখ্যার দাম ১০ টাকা। প্রতি সংখ্যা ছাপতে খরচ পড়ে ৩০ হাজার টাকা।

মতিন রায়হান : দীর্ঘকাল ধরে এই ঐতিহ্যবাহী বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করে আসছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে কোনো পদক-সম্মাননা কি পেয়েছেন?

নূরজাহান বেগম : ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে রোকেয়া পদক পেয়েছি। ২০০২ সালে পেয়েছি অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘের স্বর্ণপদক পেয়েছি। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন আমাকে পদকসহ সংবর্ধনা দিয়েছে। তবে এখনো রাষ্ট্রীয় একুশে পদক কিংবা স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পাইনি। কিন্তু পুরস্কার-পদকই কি সব? অজস্র মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই বা কম কী?

মতিন রায়হান : আমরা সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশে কিছু বলুন?

নূরজাহান বেগম : পড়াশোনা করে প্রকৃত মানুষ হও। দেশকে ভালোবাসো, দেশের মানুষকে ভালোবাসো। বিয়ের সময় কেবল অর্থের দিকে তাকিও না, শিক্ষা ও যোগ্যতার দিকে তাকাও। মানবিক মানুষ হও।

মতিন রায়হান : আপা, ব্যস্ততার মধ্যেও আপনি আমাদের অনেক সময় দিলেন। এজন্যে আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আপনি দীর্ঘদিন আমাদের মাঝে এমন কর্মক্ষম থাকুন, এই প্রার্থনা পরম করুণাময়ের কাছে।

নূরজাহান বেগম : তোমাদেরও অনেক ধন্যবাদ। বুড়ো মানুষের এতো কথা ধৈর্য ধরে শুনলে। তোমরাও ভালো থেকো। সবার মঙ্গল হোক।

আলোকচিত্র : রুমানা জাবীন