পশ্চিমের আহ্বান : সৃজনে ও ভ্রমণে

হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় (Heidelberg University, Germany) জার্মানির আমন্ত্রণ ছিল Bader Wittenberg Fellow (visiting professor) হিসেবে অক্টোবর-নভেম্বর ২০২২-এ।

দিন কয়েক আগেই রওনা দিলাম হামবুর্গ হয়ে হাইডেলবার্গে পৌঁছাব বলে। কলকাতা-দিল্লি-দুবাই হয়ে ৫ই অক্টোবর পৌঁছলাম হামবুর্গে। চমৎকার আবহাওয়া। এয়ারপোর্টে আমার ভাইপো অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় অপেক্ষা করছিল, যে সে-দেশের চাকুরে।

বেশ কয়েক বছর পর দেখা হওয়ায় আনন্দ পেলাম প্রভূত। দু-চার মিনিট অপেক্ষার পরই এলো ওর বাড়ির পথের বাসটি। খুবই সুব্যবস্থা জার্মানির পরিবহনের। সে বাস, ট্রাম, ট্রেন যা-ই হোক। তবে পরিবহনে চড়লে মাস্ক পরাটি বাধ্যতামূলক। মাস্ক না থাকলে ড্রাইভার উঠতে নাও দিতে পারেন। মিনিট দশেক ধরে দু-পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে নামলাম নির্দিষ্ট স্টপেজে। রাস্তার দু-পাশে সারি সারি গাছ। সুদৃশ্য গাড়িগুলি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে আসছে-যাচ্ছে। রাস্তা বদলে বিপরীতের দুটি বাড়ির পরই ভাইপোর আবাস/ বাড়ি পৌঁছে রাজশ্রী আর ছোট্ট রোহনের আন্তরিকতায় হামবুর্গ পৌঁছানোর দীর্ঘ ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। আরো কিছু সময় পরই রোহনের প্রিয় খেলা ‘ট্রেন’ নিয়ে আমিও মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। ইউরোপে মাস দেড়েকের অবস্থানে আমিও ক্রমে ট্রেনের ভক্ত হয়ে গিয়েছি। হামবুর্গ জার্মানির উত্তরে অবস্থিত একটি বন্দর শহর। তাই সবসময়ই হাওয়ার প্রকোপ।

পরদিনই আমাদের লুক্সেমবার্গ (Luxemberg) যাওয়ার পরিকল্পনা জেনে আমি খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। ফ্লাইটে এক ঘণ্টা পনেরো মিনিটের পথ। অসাধারণ সুন্দর আর ছোট্ট দেশটিতে পৌঁছলাম ৬ই অক্টোবর সন্ধেয়।

লুক্সেমবার্গের পরিসীমার দেশগুলি হলো পশ্চিমে ও উত্তরে বেলজিয়াম, পূর্বে জার্মানি, দক্ষিণে ফ্রান্স। ধনী দেশটির রাজধানীর নাম লুক্সেমবার্গ সিটি। ফরাসি ও জার্মান সংস্কৃতির মিশ্রণে এই দেশ। সবাই যে ইংরেজি বোঝেন তা নয়।

অতীত ইতিহাসে অনেক কাহিনি। রোমান সাম্রাজ্যের দুর্গগুলি এখন হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত। ১৫ই মার্চ ১৮১৫ ফরাসি সাম্রাজ্য থেকে লুক্সেমবার্গের ইতিহাসের সূচনা। প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময় জার্মান সাম্রাজ্যের দখল। বৃহত্তর নাৎসি জার্মানি থেকে মুক্তি ১৯৪৪-৪৫-এ। প্রতিষ্ঠাদিবস ১লা জানুয়ারি ১৯৫৮।

পরিচ্ছন্ন, গোছানো ছবির মতো সুন্দর শহর। জনসংখ্যা আনুমানিক ৬৩৩,৬২২ (২০২১ অনুযায়ী)। অতি উচ্চ মানব উন্নয়নসূচক। জনসংখ্যা আমাদের দেশের কোনো একটি শহরের মতো। মাত্র ২৫৮৬ বর্গকিলোমিটার এর আয়তন।

দেশটির জনপরিবহনে জনসাধারণের কোনো ভাড়া লাগে না। ক্যাব ব্যক্তিগত মালিকানায় আর ভাড়াও যথেষ্ট বেশি। এখানকার মুদ্রা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা (Euro)।

অ্যাপার্টমেন্টটিতে সুব্যবস্থা, অ্যাপ দেখে অর্ডার দিতেই ভারতীয় খাবার পাওয়া গেল, বেশ সুস্বাদু। অনেকগুলি দক্ষিণ ভারতীয় সংস্থার পরিচয়ও পেলাম এ-ব্যাপারে।

পরদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বেশ ঠান্ডা উপলব্ধি করলাম। রৌদ্রোজ্জ্বল লুক্সেমবার্গ আমাদের চিত্ত অধিকার করে নিল। ছোট্ট মিউজিয়ম দেখে গেলাম ঐতিহাসিক ক্ষেত্রগুলি পরিদর্শনে। দর্শনীয় Adolphe Bridge, The Old Quarter of Luxembourg City, Echternach and its Benedictine Abbey, Castle প্রভৃতি।

শহরের ভেতর শান্ত গলিপথ আর দু-পাশের পুরনো ছাদের বাড়িঘর অসামান্য এক সৌন্দর্য আর নীরবতার সাক্ষী। সে-পথে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে চমৎকার লাগল আমার। Grand Ducal Palace – সূচনা ১৫৭২. Abbey of Neumünster সপ্তদশ শতকের তৈরি ঝঁৎব (Sure) নদীর তীরে।

সমাজদার্শনিক, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবুর্গের অসামান্য স্মারকস্তম্ভটি পরিদর্শন করলাম। একটু এগিয়ে বিপরীতে নটরডাম গির্জাটির স্থাপত্য, ভেতরে প্রাচীন রঙিন কাচের কারুকার্য দর্শনীয়। অজস্র মানুষ এসব দেখছেন। পড়ছেন সেইসব ইতিহাস। দুদিনের সফর শেষে ফিরলাম হামবুর্গ। চমৎকার শহর। দেখলাম পোর্ট বা বন্দর, বিশ^বিদ্যালয়, লাইব্রেরি। কাছাকাছি দোকানপাট দেখে এ-পথে ও-পথে ঝরাপাতার ওপর বিস্তর হাঁটাহাটি হলো। মনে হচ্ছিল, বিগত শতকের শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীর শান্ত পরিবেশটি। হলুদ-খয়েরি ‘ফল কালার’ প্রকৃতিতে অদ্ভুত এক সুন্দর রূপ তৈরি করেছে। ‘হেমন্ত’ ঋতু এখানে বেশ কিছুদিন রঙে রাঙিয়ে তোলে চারপাশ। আমার মনে হচ্ছিল, এ যেন বসন্ত। এর পরই আসবে দীর্ঘস্থায়ী শীতের কাঠিন্য।

রোদ্দুরের তাপে বসে আছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। পাশ দিয়ে গেলেই হেসে তাকান, হাত নাড়েন।

অজানা-অচেনা কিশোর-কিশোরী বললেই ছবি তুলে দিয়েছে। এমনকি ছবি তোলার আগে গলার স্কার্ফটি ঠিকও করে দিয়েছে। বিশ্ব সংস্কারের সেইসব ছবি অম্লান হয়ে আছে হৃদয়ে।

হামবুর্গের দিনগুলি শেষ হয়ে এলো, এবার যেতে হবে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দক্ষিণ এশিয়া’ (South Asia) বিভাগে এক মাসের ‘ভিজিটিং প্রফেসর’ হিসেবে যোগদানের জন্য। চর্চা হবে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য, বিশেষত রামায়ণ। রওনা হলাম হামবুর্গ স্টেশন থেকে হাইডেলবার্গের উদ্দেশে। ICE ট্রেন। সকালের-শিরশিরানি হাওয়ায় গরম কফি অনেকটাই উষ্ণতা দিলো। আপনজনদের ছেড়ে রওনা হওয়ার সময় মনটা ভারি হয়ে গেল খানিক।

ট্রেনের ব্যবস্থাদি চমৎকার আর জানালার ধারের আসনটি পাওয়ায় জার্মানির উত্তর থেকে দক্ষিণের দীর্ঘ পথে কত শহর, গ্রাম, গাছ-গাছালি, স্টেশন, কলকারখানা দেখতে দেখতে চললাম। ব্লটিংয়ের মতো শুষে নিচ্ছিলাম স্কুলজীবনে ভূগোলে পড়া সেসব উল্লেখযোগ্য স্থান। স্টেশনে ঢোকার আগে-পরের দৃশ্য আর প্রকৃতির রূপ জানান দিচ্ছিল স্থানীয় অঞ্চলটিকে বুঝে নিতে। সহযাত্রী কতজন উঠল-নামল, কত বিচিত্র পোশাক, মালপত্র, ভাষারীতি সবই লক্ষ করছিলাম। ট্রেনে উঠেই WIFI সংযোগ করে নিলাম – মাঝেমধ্যে দেশের সময় বুঝে ফোনালাপ, ছবি আদান-প্রদান চলল।

স্মরণীয় ১০ই অক্টোবর ২০২২ হেমন্তের বিকেলে নামলাম হাইডেলবার্গ স্টেশনে। অপেক্ষা করছিলেন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. চৈতি বসু। চমৎকার অর্কিড অভ্যর্থনা জানালেন। কথা বলতে বলতে দেখছিলাম চারপাশ আর অনুভব করছিলাম ওঁর আন্তরিক সাহচর্য। হাইডেলবার্গের সম্পূর্ণ সময়কালটি তিনি প্রতি মুহূর্তে নানান পরামর্শে, ব্যবহারিক প্রয়োজনে পাশে থেকে অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ করেছেন।

ট্রামে দুটি স্টপেজের পর বিসমার্ক প্লেস (Bismarckplatz) বিশ^বিদ্যালয়ের এবং আমার অবস্থানের নিকটবর্তী স্টপেজ। চমৎকার পরিবেশ। সংলগ্ন পার্কে বিসমার্কের মূর্তি, নানান বয়সী ছেলেমেয়েরা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে বাস-ট্রাম ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমার দুদিনের বাসস্থান হলো কাছেই Hotel Regina-তে। দুদিন পরে বাকি দিনগুলির জন্য স্থানান্তরিত হবো Guest House Heidelberg-এর স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে। হোটেল রেগিনায় প্রবেশের একদিকে ল্যাভেন্ডার গাছে ফুল দেখে চমক লাগল। রিসেপশনের সুবেশী মহিলা আমার পরিচয় জেনে সুন্দরভাবে অভ্যর্থনা করে ঘরটির চাবি দিয়ে সব দেখিয়ে দিলেন। ছবি আর ফুল দিয়ে সাজানো ঘর, জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম পথের উল্টোদিকেই একটি স্কুল। অরগানের আওয়াজ ভেসে আসছে, গানের ক্লাস? খুব সাজানো-গোছানো পরিপাটি হোটেলটি। জিনিসপত্র রেখে আমরা গেলাম কাছের একটি দোকানের পাঁচতলার ক্যাফেটারিয়ায়। সেখান থেকে হাইডেলবার্গ শহরের একটি ছবি পাওয়া যায় সাময়িকভাবে। চমৎকার কফির স্বাদে চুমুক দিয়ে বুঝে, চিনে নিচ্ছিলাম আশপাশ। পরে আরো বেশ কয়েকবার এখানে এসেছি ওপর থেকে পাহাড়-নদীঘেরা হাইডেলবার্গের রূপ দর্শন করতে। হোটেলের প্রাতরাশের কথাটি বলতেই হয়। এক থাইল্যান্ডের মহিলা ছিলেন দায়িত্বে। অনেক কথা আদান-প্রদান হলো। আরো কয়েকজন আমার মতোই বিদ্যাচর্চার নানা কাজে – কেউ এসেছে ইতালি, কেউ ফ্রান্স আবার কেউ পৃথিবীর অন্য প্রান্তের দেশ থেকেও – পরিচয়পর্বে ব্রেকফাস্টটি খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠল। হরেকরকম রুটি (Bread), ইউরোপের মধু ও অন্য খাবারগুলির সঙ্গে পরিচিত হলাম।

পরদিন ১১ই অক্টোবর তৈরি হয়ে সকাল ৯টায় গেলাম হাইডেলবার্গ বিশ^বিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে (South Asia Institute, SAI) যোগদানের জন্য। ১৩৮৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন এই বিশ^বিদ্যালয়টি ইউরোপের অন্যতম ঐতিহ্যমণ্ডিত গবেষণার পীঠস্থান। বিভাগের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হলাম,  দেখলাম ইতোমধ্যে আমি যে ঘরে কাজ করব সেটি নির্দিষ্ট হয়েছে, নেমপ্লেটটিও লাগানো। টেবিল, কম্পিউটার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সবই হাতের কাছে। পরিচিত হলাম হিন্দি, উর্দু, তামিল বিভাগের অধ্যাপক, গবেষকদের সঙ্গে। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক হান্স হার্ডার সেদিন জরুরি কাজে বাইরে ছিলেন। কিন্তু তাঁর নির্দেশ ছিল সবক্ষেত্রেই। তাই পেয়ে গেলাম আইডেনটিটি কার্ডটি, যেটির প্রয়োজন হবে প্রতিদিন বিশ^বিদ্যালয়ে প্রবেশের জন্য। পরের দিন এলেন বিভাগীয় প্রধান হান্স হার্ডার। এমন সুন্দরভাবে বাংলা বলেন যে বিস্মিত হতে হয়। এই বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন অধ্যাপক কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। হান্স তাঁরই প্রত্যক্ষ ছাত্র।

শহরের প্রাণকেন্দ্রে মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউট। এখানে আছে MIL (Modern Indian Language), Political Science, Economics, Anthropology বিভাগ।

রেজিস্ট্রার বা কর্মসচিব এক সন্ধ্যায় নবাগত গবেষক, অধ্যাপকদের স্বাগত জানালেন। ইতোমধ্যে আমি গেস্টহাউস হাইডেলবার্গের স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে স্থানান্তরিত হয়েছি, যার একটি বাড়ি পরেই বিশ^বিদ্যালয়। শুরু হয়েছে আমার কাজকর্ম, লাইব্রেরিতে যাতায়াত। আমার দুটি একক বক্তৃতার দিন নির্দিষ্ট হলো, বিভিন্ন বিভাগের গবেষক অধ্যাপক উপস্থিত হয়ে শুনলেন, প্রশ্ন করলেন, সব মিলিয়ে দু-ঘণ্টারও বেশি।

বক্তৃতা-শেষে খাবার খেতে খেতেও চলল তার রেশ। প্রথম বক্তৃতা ২৫শে অক্টোবর আমার স্মরণীয় একটি দিন কাটল হাইডেলবার্গ বিশ^বিদ্যালয়ে। কথা ছিল দুটি বক্তৃতার, কিন্তু হলো তিনটি। আমিও উৎসাহিত হলাম, বলাই বাহুল্য। বাকি দুটি বক্তৃতার দিন স্থির হলো নভেম্বরের ৪ তারিখ। ইতোমধ্যে ক্লাস নিয়েছি, আবারও নেব। দেশ-বিদেশের

ছেলেমেয়ে উৎসাহে-আবহে পড়ছে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, তামিল।

শ্রীলংকার তামিল অধ্যাপক মূর্তি দীর্ঘদিন জার্মানির অভিবাসী, চমৎকার আলোচনা হয় সময়-সুযোগ হলেই। নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বিশেষ ব্যস্ত দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চিপুরমের মন্দির এবং সংলগ্ন বিষয়ের গবেষণায়। ভারতের নানান বিষয়ে আগ্রহ আর আলাপ-আলোচনায় কাটছে দিনগুলি। এরই মধ্যে অক্টোবরের ২৮-২৯ সাউথ এশিয়ান ডে। দুদিনব্যাপী আলোচনা সভার অংশ হিসেবে বিস্তর অভিজ্ঞতা, মতবিনিময় আর পরিচয়পর্ব সম্পন্ন হলো।

হাইডেলবার্গ বিশ^বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটি খুবই সমৃদ্ধ। আমাদের বাংলার পত্রপত্রিকাও আছে সুন্দরভাবে রক্ষিত। অনলাইনে সেসব সকলেই দেখতে পারেন এখন।

আমার রুমটি প্রধান রাস্তার দিকে। জানালা দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা জনজীবন, দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, ট্রাম, বাস দেখে খুবই উপভোগ করি হাইডেলবার্গের জীবনধারা। সকালের আলো ফোটার আগেই আমার ঘুম ভাঙে, দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেয়ে যাই। মাঝে মাঝে দু-এক পশলা বৃষ্টি আবার ঝকঝকে রোদ্দুর দিনটিকে স্বাগত জানায়। প্রায় দিন সন্ধেয় পুলিশ সহযোগে ইরানের ঘটনার সমর্থনে মিছিল বেরোয়, গাড়িতে হর্ন বাজিয়ে, পোস্টার-প্ল্যাকার্ডসহ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়।

গেস্টহাউস থেকে কিছুটা হেঁটে গেলেই নেকার নদী। পাহাড়ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সময় পেলেই ছুটে গিয়েছি নদীর পাড়ে, বসেছি বেঞ্চে, দেখেছি ছুটির দিনে নৌকাবাইচ। বিভিন্ন রেস্তোরাঁ আমার অবস্থান থেকে দু-পা গেলেই। তুর্কি, লেবানিজ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, চিনদেশীয় নানান খাবার। ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের দোকান আর ভারতীয় জিনিসপত্রের প্রাপ্তিও লক্ষ করেছি।

প্রিয় জার্মান দম্পতি যাঁরা চিত্রকলা, ইতিহাস আর দর্শনের চর্চায় সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন, এখনো করছেন, তাঁদের সান্নিধ্যে একটি ছুটির দিন প্রভূত অভিজ্ঞতা আর আনন্দ দিয়েছে। পাহাড়ের কোলে নেকার নদীর ধারে গাছগাছালি আর শিল্পকলায় ঘেরা বাড়িটি আমার হাইডেলবার্গ পর্বের অন্যতম আনন্দের। চিত্রশিল্পের ইতিহাসকার ‘উরসুলা’ (URSULA) বিকোলম্যান আর তাঁর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক স্বামী ‘একা’ (EKA) অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বারবার তাঁর প্রসঙ্গ, তাঁর জীবন, কর্ম নিয়ে আমরা কথা বলেছি। দীর্ঘজীবন তিনি কাটিয়েছেন, তবু তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। হান্সের সঙ্গে অলোকদার সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে প্রণাম জানিয়ে এলাম একদিন। দেখলাম অলোকদা আর কবিপত্নী ট্রুডবার্টা একই সঙ্গে আছেন। স্মরণীয় সেই সময়কালটিতে চক্ররেলে ঘুরেছি হাইডেলবার্গের বিভিন্ন গ্রাম, শহর, আধা-শহর আর মানহ্যাম বিশ^বিদ্যালয়। পথে পথে নোবেল লরিয়েটদের স্মৃতিধন্য সাক্ষ্য। অপূর্ব স্থাপত্য আর চমৎকার আবহাওয়ার সংমিশ্রণে উজ্জ্বল এক একটি দিন।

হাইডেলবার্গ বিশ^বিদ্যালয়ের মডার্ন ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেসের (MIL) বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক হান্স হার্ডার (Professor Hans Harder), যিনি প্রত্যক্ষভাবে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সুযোগ্য ছাত্র, তাঁর কথা পৃথকভাবে বলতেই হয়। বাংলা, হিন্দি, উর্দু অনায়াসে বলেন, লেখেন, পড়েন আর বিভাগটিকে সযত্নে, চিন্তনে যিনি সামলে রাখেন। আমার হাইডেলবার্গের অবস্থানটিতে যাঁর সাহচর্য এবং উৎসাহ ছিল বিশেষ সহায়ক। সুরসিক অধ্যাপক হান্সকে নমস্কার জানাই।

সপ্তাহান্তে হাইডেলবার্গের পাহাড়ের ওপর পুরনো চার্চ, নদীর রেখা আর হেমন্তের প্রকৃতি, ঝরাপাতার হলুদ-খয়েরি রং অসামান্য বললেও কম বলা হয়।

নভেম্বরের বক্তৃতাও শেষ হলো। ক্রমে হাইডেলবার্গ বিশ^বিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফেলো তথা অধ্যাপনার দিনও সমাপ্ত হয়ে এলো।

৯ই নভেম্বর ২০২২ আমার জীবনের সেই স্মরণীয় মুহূর্তটি এলো, যেদিন আমি পৌঁছে গেলাম অনিতা বোস পাফের বাড়িতে। হাইডেলবার্গ স্টেশন থেকে দু-ঘণ্টার অল্প কিছু বেশি ট্রেনে যাওয়ার পর ক্যাবে পৌঁছলাম আমার বহুপ্রতীক্ষিত মুহূর্তটিতে। বাড়িতে নেতাজির ছবির পাশে উনি যখন দাঁড়ালেন আমি ইতিহাস দেখছিলাম। অনেক কথা হলো নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস এবং অনিতার মা এমিলি শেঙ্কেলের বিষয়ে। মায়ের কাছেই জেনেছেন বাবার কথা। লিখছেন সেইসব। দুপুরের খাবার একই সঙ্গে খেলাম। যত্নে-ভালোবাসায় সেসব ছবির মতো, স্বপ্নের মতো হৃদয়ে থাকবে আজীবন। নিজে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে দিলেন স্টেশনে। সন্ধেয় ফিরে এলাম হাইডেলবার্গ এক ইতিহাসকে স্পর্শ করে।

পরদিন ভোরেই ট্রেন, আমি এলাম ভিয়েনায়। হাইডেলবার্গের মধুর আর কর্মময় স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ভিয়েনার পথে রওনা হলাম। মাঝে একবার ট্রেন বদল করতে হলো। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্টেশনে স্বল্পসময় পরিচিত কলেজের ছাত্রীটি সেই কাজে সাহায্য করল যার সঙ্গে দেখা হবে না আর কোনোদিন। পথের সাথি সেই মেয়েটির জন্য অশেষ শুভকামনা আমার।

অনেক পাহাড়, কৃষিক্ষেত, ঘর-বাড়ি, দানিয়ুব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ভিয়েনায়। স্টেশনে অপেক্ষায় ছিল প্রায় তিরিশ বছর আগের শান্তিনিকেতনের জাপানি ছাত্র শোতা কামিসিমা ও তার স্ত্রী জুলি।

দীর্ঘদিন পর এই সাক্ষাৎ। দেখা হওয়া সত্যিই যেমন আনন্দের তেমনি গর্বের। আমি তখন শান্তিনিকেতনে বিশ^ভারতীর গবেষক ছাত্রী আর শোতা জাপান থেকে এসেছিল ‘বাংলা’ ভাষা পড়তে, জানতে। যোগাযোগ করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেনদা। জুলিও তখন বিশ^ভারতীর ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। এ যেন পুনর্মিলন। অনেক কথা হলো বিগত শতকের নয়ের দশকের গোড়ার। কালোর দোকান নেই জেনে দুজনেই মর্মাহত। আরো কত প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা Ñ হায়! কালের নিয়মে আরো অনেক কারণে শান্তিনিকেতন ও পৌষমেলার জন্য আমাদের মন খারাপ হয়ে থাকে। অপূর্ব শিল্প আর সৌন্দর্যের সমন্বয় ভিয়েনা। প্রাচীনত্বকে ধরে রেখেছে রঙে, রেখায়, স্থাপত্যে। শহরের নিয়মকানুনগুলি মেনে চলে সবাই। জার্মানি বা অস্ট্রিয়ায় সাদা, হালকা হলুদ আর ছাই বা ধূসর রঙের বাড়ি-স্থাপত্য চোখের আরামদায়ক। ভেতরে রং সব সাদা। তা সে স্থাপত্যই হোক, বাড়িই হোক অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

ভিয়েনার পথে পথে চোখ-জুড়োনো শিল্প সৌন্দর্য। হেমন্তের প্রকৃতির অপূর্ব পরিচয় পেলাম Vinewood

গিয়ে। পাহাড়ি পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে – দুপাশে সোনালি খয়েরি পাতার মধ্য দিয়ে রোদ্দুরের ঝিলিক অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। আবহাওয়া অনুকূল হওয়ায় অনেক মানুষ তা উপভোগ করতে পথে বেরিয়েছেন, হাঁটছেন অরণ্যপথে। করোনা-উত্তরকালে এই ভ্রমণটিতে সত্যিই স্বাভাবিক ছন্দে ফেরা হলো। শোতা IAEA (International Atomic Energy Agency)-তে দায়িত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। অফিস পরিদর্শন করলাম কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হয়ে। দাঁড়ালাম ভারতের জাতীয় পতাকার নিচে। চমৎকার মেয়ে জুলি। ভিয়েনার  দ্রষ্টব্যগুলি সহজভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিল এই সময়ের প্রাসঙ্গিকতাসহ।

মিউজিক শপে খুঁজে নিলাম পছন্দের গান, ভিডিও। অপেরা হাউজে কোনো শো দেখার সুযোগ হলো না সময়াভাবে, তবে ঘুরে দেখলাম। Hamlet চলছিল, ইচ্ছে থাকলেও দেখা হলো না। ওদের বাড়ি ভিয়েনার কেন্দ্রস্থল ছাড়িয়ে পাহাড়ের কোলে। বিস্তারিতভাবে পথঘাট, স্থানীয় জীবনযাপন শুনছিলাম। বাড়িতে গিয়ে শুনলাম পুত্র কধহব জুলির কাছে ‘জনগণমন’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’ দুটি গানই শিখেছে। এমন বাংলাপ্রীতি ওদের। নভেম্বরের শেষে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল খ্রিষ্টোৎসবের – আলোকমালা ছাড়াও পার্কে ছোট ছোট মেলা ও সন্ধেয় সেসব দেখে, স্যুপ-খাবার আস্বাদন করে দারুণ আনন্দ পেলাম। মেলার মাঠটি ভিয়েনা বিশ^বিদ্যালয়ের ভাষা শিক্ষা বিভাগসংলগ্ন। সেসব দেখা হলো। সঙ্গে ভিয়েনিজ কেক, চকোলেট তো আছেই। একদিন ভারতীয় রেস্তোরাঁয় খেলাম। পাঞ্জাবি একটি পরিবার এটি চালু করেছেন।

অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো প্রাহা বা প্রাগে গিয়ে। অস্ট্রিয়ার শেষ গ্রামের পথ ধরে ‘প্রাহা’। গ্রামটি যেন আমাদের রাঁচি-রামগড়ের মতো। টালির মতো সাদামাটা ঘরের চাল। অতি সাধারণ ঘরদোর, চারপাশ। কৌতূহলী বাচ্চা-বুড়োকেও দেখলাম। ছোটো একটি চার্চ – খুব চেনা চারপাশ। স্মৃতিকাতর হয়ে আমার বাল্যকালে বিহারের অবস্থানটি ভাবছিলাম। শহর থেকে দূরে রামগড় রাদুরাপ্পার বিহারের কোলিয়ারি অঞ্চল বারবার মনে পড়ছিল।

অস্ট্রিয়ার এই গ্রামটিতেই Pet house। পুষ্যি বেড়ালকে মাসখানেকের বন্দোবস্তের খবর নিতেই আসা। আমার অভিজ্ঞতায় এই প্রথম। যে মহিলার Pet house তিনি আমাকে খুব যত্ন করে সসম্মানে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রাগের অতি প্রাচীন প্রাসাদ দেখে আমি অভিভূত। দীর্ঘপথে অনেক ক্ষেতখামার। ফসল আর শুকনো আঙুরের খেতগুলি ভিনদেশি ছবির কথা মনে করিয়ে দিলো। চমৎকার সূর্যাস্ত দেখলাম প্রাগে। অভিজ্ঞতায় নতুন একটি দিন সংরক্ষিত হলো। শেষ দিনে ভিয়েনার Schonbrunn Palace, Painting Galary পরিদর্শন করে মুগ্ধ হলাম।

দুপুরে গেলাম আমার চির-আকাক্সক্ষার স্থানটিতে – Beethoven’s House-এ। পথঘাট, বাড়িঘর অক্ষত এখনো। এই অঞ্চলগুলি যে তখন গ্রাম ছিল সেটি বোঝা যায়। সরু সরু গলির মতো পথ, বাড়িটির আসবাব, কড়িবরগার ছাদ সবই আগের মতো রেখে অসাধারণ একটি রেস্তোরাঁয় রূপান্তরিত। কপর্দকহীন বিটোভেন শুরা আর খাবারের জন্য বিক্রি বা বন্ধক দিতেন তাঁর সৃষ্টি – এমন কাহিনি প্রচলিত সেখানে। অস্ট্রিয়ার একটি পরিবার তাঁদের ছোট্ট মেয়েটির জন্মদিন পালন করতে এসেছেন এই রেস্তোরাঁয় – এর মতো ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান আর কোথায়? সর্বত্র প্রাচীনত্বের ছাপটি অক্ষুণ্ন রেখেও কীভাবে আধুনিক পরিষেবা দেওয়া যায় তার পরিচয় পেলাম। বারবার নতমস্তকে অসামান্য স্রষ্টা বিটোভেনকে প্রণতি জানাচ্ছিলাম। হালকা সুরে বাজছিল বিটোভেনের সিম্ফনি। বিরল অভিজ্ঞতা আর সুরের মূর্ছনায় স্নাত হয়ে ছবিও তুললাম বেশ কিছু।

ভিয়েনার সফর শেষে এয়ারপোর্টে এসে যথারীতি বিদায়বেলায় দু-পক্ষেরই অপার আনন্দের সময় শেষে নিজ নিজ ক্ষেত্রে ফেরা। এই যোগাযোগ সম্ভবপর হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। বিজ্ঞানের এই প্রযুক্তি কল্যাণকাজে ব্রতী হোক। কাজের আর আনন্দের রসদ নিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়। ইউরোপের দিনগুলি হৃদয়ে অম্লান থাক।