প্রচারবিমুখ সম্পাদক

‘কিচ্ছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে কলম ছুঁড়ে ফেলে দিতে।’ বুদ্ধদেব বসুর প্রয়াণে এই বাক্যদুটি দিয়ে অবিচুয়ারি লেখা শুরু করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একেকটা মৃত্যু এতই মর্মবিদারক যে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাকের কবি আবুল হাসনাতের অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখে ঘোর অসময়ে চলে যাওয়াটাও তেমন, তাঁর প্রয়াণের পর খুব অভিমান হয় বিধাতার ওপর। এত তাড়াতাড়ি এমন আকস্মিক মৃত্যুর বিহ্বলতা সহজে গ্রহণ করতে পারি না আমরা। সকলেই সহমত হবেন যে, এমন রুচিশীল ভদ্রলোক আজকের দুনিয়ায় বিরল। তাঁর গভীর শিক্ষা তাঁকে নম্র বিনয়ী আর আন্তরিক করেছিল ভেতর থেকে। অগাধ পাণ্ডিত্য তাঁর আন্তরিকতাকে আরো বাড়িয়েছিল। পাণ্ডিত্য অনেক সময় মানুষকে স্নব করে তোলে। কিন্তু আবুল হাসনাত সে-ধাতুতে গড়া ছিলেন না। তাঁর ব্যক্তিত্বের উত্তাপ সূর্যের আলোর মতো মানুষকে স্পর্শ করত।

প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর মৌলিক বিশ্লেষণ তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মতো, আবার কবিতায় তিনি পেলব, তাঁর অপরিমিত জ্ঞানভাণ্ডারের ছাপ তাঁর কবিতায় সুপ্ত। ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল, কোনো একদিন ভুবনডাঙায়  এসব লেখা তিনি আমার প্রথম আলো পত্রিকার অনুষ্ঠানে পড়েছেন। অত্যন্ত প্রচারবিমুখ ছিলেন। কবি-শিল্পীদের প্রচারের আলোয় আনতে যতখানি উৎসাহী ছিলেন, আত্মপ্রচারে নিরুৎসাহী ছিলেন ততটাই। ছোটদের লেখায় তিনি যেন ছোটদের এক সহমর্মী বন্ধু। তাঁর ভাষা কাব্যিক। বাচনভঙ্গি স্পষ্ট। চিন্তায় জ্ঞানের সঙ্গে মিশত আন্তরিকতা। কয়েক মাস মাত্র আগে তাঁর আমন্ত্রণে আনিসুজ্জামানকে নিয়ে লিখেছিলাম কালি ও কলমে। জীবন কী প্রচণ্ড খামখেয়ালি যে তার কয়েক মাস পরে আবুল হাসনাতের স্মৃতি নিয়ে লিখতে হলো! পৃথিবী থেকে একজন সত্যিকার শিল্প-সমালোচক, সূক্ষ্ম রুচির কবি, নিবেদিতপ্রাণ সম্পাদক এবং আদ্যন্ত মানবিক ভদ্রলোক কমে গেল। আর ঢাকায় গিয়ে তাঁর সহৃদয় আন্তরিক আপ্যায়ন পাব না। দেখতে পাব না তাঁর অনাবিল হাসিমুখ। এসব এখন থেকে স্মৃতি হয়ে হৃদয়ের সিন্দুকে থেকে যাবে।