প্রার্থিনী : চিরায়ত নারীসত্তার স্বরূপ সন্ধান

ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে প্রতিদিনই নাটক প্রদর্শিত হয়। নানা বৈচিত্র্যময় ভিন্ন ভিন্ন নাটক। প্রসঙ্গত, নাট্যচর্চায় দেশ-সমাজের প্রতি যেভাবে দায়বদ্ধতা এসেছে শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে ততটা দেখা যায় না। সেদিন শিল্পকলার প্রবেশপথের পাশেই ঝুলছিল নানা পোস্টার। চোখে পড়লো প্রার্থিনীর বিজ্ঞাপন। আগের সন্ধ্যায় এই নাটক নিয়ে নির্দেশক ড. আইরিন পারভীন লোপার সঙ্গে কথা হয়েছে। বিজ্ঞাপন দেখে অবাক হলাম। তাতে লেখা ‘প্রার্থিনী : প্রেম-মৃত্যু ও  জীবন তৃষ্ণার নাটক’- বুঝলাম চিন্তার এক ধরনের মেটাফিজিক্যাল আবহ। কাউন্টার থেকে স্যুভেনির হাতে নিয়ে আরো বুঝতে পারলাম, বিষয়ের দিক থেকে নারীসত্তার স্বরূপ-অন্বেষণ। কৌতূহল বাড়লো। নারী প্রকৃতপক্ষে কী চায়? জীবনে তার প্রার্থনা, বা চাওয়া কী? নারী-রহস্য নিয়ে যুগে যুগে কালে কালে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। আদিম সমাজ থেকে কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিকরা নারী-রহস্য উদ্ধারে নানাভাবে তৎপর ছিলেন। নানাজনের উপলব্ধিও নানা রকম। গত পঞ্চাশ বছরে আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষমতায়নসহ নারীবাদী ডিসকোর্সও তৈরি হয়েছে। আর এ-সময়ের নাট্যকার সাধনা আহমেদের নারীসত্তা অন্বেষণের প্রাপ্তিটা কেমন তা জানতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠছিলাম। তাছাড়া নাট্যকার নিজেও একজন নারী এবং নির্দেশকও একজন নারী। আবার অভিনয়ও করেছেন নারীরা। ফলে ব্যাপক কৌতূহল নিয়ে নাট্যগৃহে প্রবেশ করলাম। নতুন নাট্যদল ‘সাধনা আর্টস এবং থিয়েটার’-এর ব্যানারে নাটকটি প্রদর্শিত হচ্ছে।

নারী চিরকালই রহস্যময়ী। বিশেষত দার্শনিক, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিকদের কাছে। ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্যে নারীকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বহুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আবার এটাও বলা হয়েছে, নারীকে ঈশ^রই বানিয়েছেন। নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে যা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তা আবার পুরুষের আনুকূল্যে। ফলে নারীর সংজ্ঞা-স্বরূপ নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও নারীরা আসলে কী চায়, তা রীতিমতো কৌতূহলের। ইউরোপে মেরি ওয়ালস্টোনক্র্যাফট, ভার্জিনিয়া উলফ, জর্জ সাদ প্রমুখের মধ্য দিয়ে সিমোন দ্য বোভোয়ারের মধ্যে সংগঠিত নারীবাদী দৃষ্টিকোণ পূর্ণাঙ্গভাবে ফুটে ওঠে। বোভোয়ার দার্শনিক রুশোর সুরে প্রথম বাক্যেই বলে ওঠেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, সমাজই তাকে নারী বানায়।’নারীর প্রকৃত চাওয়া-পাওয়া সর্বদাই অবদমিত থাকে। সমাজই তার রূপরেখা নির্ধারণ করে। বাংলাভাষায় রাসসুন্দরীর লেখার মধ্যে নারীবাদী মনস্তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলার নারী-পরিস্থিতি শিল্পনিপুণতায় তুলে ধরেছেন। নৃতাত্ত্বিক অতুল সুর তাঁর গবেষণায় তুলে ধরেছেন, নারীর প্রথম চাওয়াই হলো কামনা-ভালোবাসা। মাতৃত্ব তার পরের চেতনা। কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা কী, সমাজ কীভাবে নারী-পুরুষ বিভাজন করে – তা রীতিমতো রহস্যজনক।

স্যুভেনির পড়তে পড়তে অনুভব করলাম – প্রার্থিনী নাটকে নাট্যকার সাধনা আহমেদ অধিবাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীসত্তার স্বরূপকে সন্ধান করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌঠান ‘কাদম্বরী’চরিত্রকে উপলক্ষ করে। নারীর ভেতরের আকাক্সক্ষা-সত্তাকে ‘প্রার্থিনী’ রূপে নির্মাণ করেছেন। কাদম্বরীকে বাংলা ভাষার একজন সাধারণ পাঠকও কম-বেশি চেনেন। কাদম্বরী দেবী (১৮৫৯-৮৪) ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌঠান বা ভাবি। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মাতঙ্গিনী। কাদম্বরীর স্বামী ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকার শ্যাম গাঙ্গুলির কন্যা। মাত্র নয় বছর বয়সে ঠাকুর বাড়িতে বৌ হয়ে আসেন। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ঘরের, অশিক্ষিত এবং নিজের গায়ের রং শ্যামবর্ণ বা অনেকটা কালো বলে ঠাকুরবাড়িতে অবহেলিত ছিলেন তিনি। বয়সে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কাদম্বরীর চেয়ে দুই বছরের ছোট। নানা কারণেই কাদম্বরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি সহপাঠিতা ও বন্ধুত্বের কারণে রবীন্দ্রনাথকে নানাভাবে কাব্যচর্চায় উৎসাহ জুগিয়েছেন। এ-বন্ধুত্ব নিয়ে নানা গুঞ্জন প্রচলিত রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চার মাস পর একদিন আফিম খেয়ে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। জানা যায়, কাদম্বরীর আত্মহত্যাটি ঠাকুর পরিবার নানাভাবে ধামাচাপা দিয়েছিল।

প্রার্থিনী নাটকের ভাবনা কাদম্বরী চরিত্রকে ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও কাদম্বরীর জীবনী এই নাটকের বিষয় নয়। আত্মহত্যার পূর্বমুহূর্তে আফিমজল পান করতে গিয়ে কাদম্বরীর চোখ পড়ে সাজটেবিলের আয়নায় এবং মানসিক দোলাচলে তাকান নিজের মধ্যে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে গিয়ে যেন দেখতে পান তাঁরই ভেতরের আরেক সত্তা, যা চিরায়ত নারীরূপ-নারীর স্বপ্ন। একদিকে কাদম্বরীর দৈহিক-বাস্তব সত্তা এবং অন্যদিকে ভেতরের নারীত্ব। দুই সত্তার দ্বান্দ্বিক ঘূর্ণাবর্তে উন্মোচিত হতে থাকে নারীর বঞ্চনা, চাওয়া-পাওয়া, অস্তিত্বহীনতা, চিরায়ত নারীসত্তাসহ সে-সময়ের ইতিহাস। প্রার্থিনী রূপে নারীর চিরায়ত অবিনশ^র রূপ, নারীত্বের মনোভঙ্গি। মানবসৃষ্টির শুরু থেকে বহমান নারীসত্তা। এটা একধরনের ডিকন্সট্রাকশন। কিছুদিন আগে ভারতের আরশি থিয়েটারের মিড়িয়া শিরোনামে ডিকন্সট্রাকশন পরিবেশনার দৃশ্য এখনো আমাদের অনেকের মনে আছে, যেখানে ইউরোপিডিস, হেইনার মুলার, প্যাসোলিনির ‘মিড়িয়া’ চরিত্র অন্তঃসুরের ভেতর দিয়ে নতুন আরেক চরিত্র নির্মাণ করেছে।

প্রার্থিনী নাটকে দুটো চরিত্র। এই চরিত্রদুটির মধ্যে প্রার্থিনী চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাট্যকার সাধনা আহমেদ এবং কাদম্বরী চরিত্রে সোনিয়া হাসান।

নাটকে নারী-মনস্তত্ত্ব বা কী চিন্তা দেখিয়েছেন নাট্যকার – এমন কৌতূহল সবাইকেই তাড়িত করেছে। পিনপতন নীরবতায় দর্শক অপেক্ষা করতে থাকেন। একসময় নাটক শুরুর ঘণ্টা পড়ে। মঞ্চসজ্জা খুবই সাধারণ। মঞ্চপরিকল্পনা করেছেন কামালউদ্দিন কবির। মঞ্চের পেছনে কালো সায়াক্লোমা। টপ মঞ্চের একপাশে ওপর থেকে ঝোলানো দোলনা। আর অন্যপাশে একটি ফুলের ছড়ি ঝোলানো। অভিনেত্রী সাধনা আহমেদ মধ্যমঞ্চে এসে দাঁড়ান। নাট্যবন্দনা দিয়ে পরিবেশনাটি শুরু হয়। আবহমান বাংলা নাট্যের বন্দনারীতিকে অক্ষুণ্ন রেখে এই নাটকে নতুন আরেক নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রচলিত বন্দনায় আল্লাহ-ঈশ^র-ভগবান-প্রকৃতি থাকলেও এই নাটকের বন্দনায় প্রধান হয়ে উঠেছে নারীজাতির স্তুতি – ‘জগতের যত নারী ফোটে পারিজাত হয়ে/ জীবন-রঙ্গভূমে সৃজন অভিসার যাঁদের/ সুরভিত সেই নারীদের করি নমস্কার।’সঙ্গে সঙ্গে যারা শত্রু তাদের স্তুতিও করেন।

বন্দনার মধ্য দিয়েই প্রথম স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাট্যকারের দৃষ্টিকোণ। স্তুতির পরেই মঞ্চে আলোর পরিবর্তন হয়। এগিয়ে আসেন আরেক অভিনেত্রী সোনিয়া হাসান। কাদম্বরী চরিত্রের আবেগ তাঁর সর্বাঙ্গে। মনে তাঁর মানসিক অবসাদ; গায়ে তাঁর বিষণ্নতার বেগুনি রঙের শাড়ি; কনুই পর্যন্ত ব্লাউজের হাতা। জীবনের প্রতি তাঁর কী বিষাদ। বর্ণনা করতে থাকেন নিজের জন্মপরিচয়। মৃত্যুর আফিমজল তাঁর সামনে। কী একটা মানসিক অবসাদে দোদুল্যমান। মঞ্চে তখন আলো-আঁধারির খেলা। আলোক পরিকল্পনা করেছেন আহমেদ ইকবাল হায়দার। সে-সময় মঞ্চে আলোর ফোকাস তাঁর ওপর। এর মধ্য দিয়ে যেন মূর্ত হয়ে ওঠে প্রশ্ন, কী তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা? অন্তর্গত সত্য কী বলে? তিনি যেন আহ্বান জানাতে থাকেন তাঁর ভেতরের সত্তাকে – নারী-প্রার্থিনীকে –

মাতৃশরীরের কবোষ্ণ পথ পার হয়ে পঁচিশ বছর আগে

যখন আমার স্বর ছড়িয়েছিল পার্থিব জল ও হাওয়ায়

আঙিনা আর অন্দরে – কেমন ছিল সেই ‘আমি’?

কেমন হতে পারতো সে আজ? ভেবেছি অনেকবার।

আজ আমি নাম তার দিয়েছি ‘প্রার্থিনী’

নৈঃশব্দ্যে লুপ্ত – আমার অন্তর্গত সেই ‘আমি’

আমর্ম খোলস ভেঙে একবার এসো সম্মুখে

কাদম্বরী রূপী সোনিয়া হাসানের প্রার্থনা যেন গুঞ্জরিত হয় প্রকৃতির মর্মজুড়ে। সোনিয়া হাসানের অভিনয়ে দর্শকমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিল। সংলাপের প্রক্ষেপণ সুস্পষ্ট। স্বরের বাচনরীতি ও আবেগের ওঠানামা ছুঁয়ে গেছে দর্শকদেরও। নূপুরের শব্দে নীরবতা ভেঙে আকাশমুখো সৌন্দর্য নিয়ে প্রাসাদ প্রান্তরে আসেন প্রার্থিনী সাধনা আহমেদ। সাধনা আহমেদ এই চরিত্রের গেটআপের মধ্য দিয়ে স্বপ্নালু রঙিনতার ইঙ্গিত দেন যেন। গ্রিক জাদুর দেবী হেকটির মতো তাঁর সাজসজ্জা। পোশাক পরিকল্পনা করেছেন আইরিন পারভীন লোপা।

সাত্ত্বিক অভিনয়ে জীবন্ত হয়েছিল নারীর স্বাপ্নিক রূপ। সংলাপ প্রক্ষেপণ অত্যন্ত সাবলীল। স্বরের মডুলেশনও অনবদ্য। ভাবপ্রকাশে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। সংলাপের শ্লেষের সঙ্গে মুখের অভিব্যক্তিতে যেন অবদমিত বাসনার ভিন্নমাত্রিক শ্লেষ। দুটো চরিত্রের পারস্পরিক সংলাপে স্বর ও শব্দগত নানা বৈচিত্র্য দুই অভিনেত্রীর।

নির্দেশক কাদম্বরী দেবীর নারীসত্তা হিসেবে প্রার্থিনীকে রঙিন স্বাপ্নিক মোড়কে উপস্থাপন করেছেন। গায়ে তাঁর লাল রঙিন বসন ও সাদার মিশ্রণ। প্রেম-রোমাঞ্চ-আবেগ-সৌন্দর্য সব মিলে যেন একাকার। নূপুরের বোলে প্রার্থিনী সাধনা আহমেদ গিয়ে বসেন দোলনায়।

কাদম্বরী কী জীবনে হেরে গেছেন বলে মৃত্যু চান? ‘তুমি একটি মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছু নও’- কাদম্বরী সোনিয়া হাসান মঞ্চের সামনের আলোয় এসে এই সংলাপে তাঁর অভিনয় শুরু করেন। ‘তুমি জীবনের অধিকার ছেড়ে মরতে চাইছো কেন?’ কাদম্বরী কী উত্তর দেবে? পুরুষচালিত পরিবারের কাছে সে যে অযোগ্য, অক্ষম। সংলাপে সংলাপে প্রার্থিনী তাঁকে বোঝায় – তুমি ঠাকুরবাড়ির বউ। নারী হিসেবে তোমার গর্ব হওয়া উচিত। কিন্তু এ-বাড়িতে যোগ্য হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে কাদম্বরীকে। কিন্তু জীবনে কী চেয়েছিল কাদম্বরী? কাদম্বরী জানান – শরীরভূমিতে প্রকৃতির বুনে দেওয়া নারীত্বের শোণিতেপ্রথম ভেবেছিলাম এখানেই।

শিহরণে শিহরণে রাতভর কেঁপেছিল দেহ পুতুলবাক্স গুটিয়ে অপেক্ষা করেছিলাম হয়ে ওঠার।

কিন্তু কী হয়ে ওঠার? কাদম্বরী বলতে চান না। দু-হাত মুড়ে কাঁদতে থাকেন। কত অভিমান জমেছে কাদম্বরীর বুকে। রঙিন আলোয় জীবনের সংঘাত। চরিত্রদুটোর আলাদা আলাদা ক্লোজ ও ফোকাস লাইট এবং দ্বৈত চলনশীলে স্পটলাইটে সমস্ত মঞ্চ তখন ঘেরা। আলো-আঁধারি ইমেজ তৈরি করা হয়েছে মঞ্চে। প্রার্থিনী সাধনা আহমেদ জানান, ‘নারী হিসেবে তোমার তো সবই ছিল – মহলা, তুমি তো রাজেন্দ্রানী। তবু কেন খেদ তোমার।’ কিন্তু নারী কাদম্বরীর চাওয়া ছিল খুবই সামান্য –

জানালার পাশে একটি ছোট্ট কুসুমবৃক্ষের মতো

জলচূর্ণে সিক্ত হয়ে ফোটাবে ফুল ঋতুভর।

তাকিয়ে সেদিকে আনন্দিত হয়ে রূপকুমার –

করতে ফলবতী জলসিঞ্চনে স্পর্শ করবে প্রেমে।

এটাই কী তবে একজন নারীর প্রকৃত চাওয়া! নাকি অবচেতনীয় অবদমন, যা প্রকৃত চাওয়াকে গোপন করেছে। কাদম্বরী সোনিয়া হাসান আর কিছু চাননি।

নাটকটি বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতিতে উপস্থাপিত। দুটো চরিত্রই ঘটনা ও পরিস্থিতি বর্ণনা করেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রাভিনয়। স্বামীই নারীর অহংকার। জ্যোতিরিন্দ্র তো ছিলেন হংসরাজ। তিনি তো প্রথার মুখে তুড়ি মেরে কাদম্বরীকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েছিলেন। সেটা একজন স্ত্রীর জন্য নিঃসন্দেহে গৌরবের। তারপরও মৃত্যুকামনা কেন করবেন কাদম্বরী? কাদম্বরীর মতে, সেটা ছিল তাঁর আভিজাত্যের গরিমা। তবু কাদম্বরীর দুঃখ অশেষ –

বেঁচে কি আছি আমি! ছিলাম কখনও!

করেছি যাপন অন্যের ইচ্ছার জীবন। …

ইচ্ছা প্রকাশের নেই কোনো অধিকার

নিজেকে শুধু ছাঁচে ঢালার চেষ্টাকে যায় বলা জীবন?

নাটকটির সংলাপ কাব্যধর্মী। নাট্যকার এটিকে কাব্যনাট্য বলতে বেশি আগ্রহী। সংগীত পরিকল্পনা করেছেন তানভীর আলম সজীব। সংগীতের আবেগীয় নিনাদে সংলাপে প্রকাশ পেতে থাকে জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুরের পরনারীগমন, কাদম্বরীকে উপেক্ষা, পারিবারিক অবহেলাসহ অনেক বিষয়, কাদম্বরীর নানা আবেগ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরে স্বদেশপ্রেম, নাট্যচর্চা ইত্যাদি। কাদম্বরী প্রতিবাদের সুর তোলেন –

তার মতো করে আমায় যদি হয়ে উঠতে হয় –

তারও থাকবে না কেন হয়ে ওঠার প্রয়োজন

নাকি পুরুষজন্মে নেই কোনো পরীক্ষা অবকাশ?

দুই নারী হাঁটু মুড়ে মুখোমুখি বসেন। মধ্যমঞ্চ তখন আলোয় উজ্জ্বল। মানসিক বিষাদে ভারাক্রান্ত কাদম্বরী উঠে দাঁড়ান। স্বামী ছাড়া নারী জন্ম কী সত্যিই অর্থহীন? স্বামী যদি বহুগামী হয় তবে কি শুধু ‘স্ত্রী’ পদবি উপহার নিয়েই নারীরা সন্তুষ্ট থাকবেন? কাদম্বরী প্রচণ্ড কষ্টে পুনর্বার আফিম খেতে যান; কিন্তু প্রার্থিনী তা ছিনিয়ে নেন। প্রার্থিনী জানান – বিহারীলাল তাঁর কবিতায় কাদম্বরীকে স্থান দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সহচর। তবু কেন ক্ষোভ? শেষে নারীত্বের চাওয়া-পাওয়ার স্বরূপ যেন উন্মোচিত হয় এভাবে –

পৃথিবীর প্রথম মানবীর মতো মুক্ত – অকৃত্রিম জলাভূমি সে

নিষিদ্ধ বাগানে প্রবেশের অধিকার যার জন্মগত

যেখান থেকে সৃজিত হয়েছে মানুষের ইতিহাস।

নারীর তবে এই চাওয়া! সমাজে কাদম্বরীদেরই যত শৃঙ্খল। নিজের সঙ্গেই নিজেরা প্রতারণা করে চলেন অবিরত। নিজের প্রেমকে লুকিয়ে রাখেন, প্রকাশ করতে পারেন না। এই সমাজের নারী তো পারেন না একজনের বহ্নিশিখায় ডুবে থেকে অন্য সরোবরে ডুব দিতে।

নাটকে ফুটে উঠতে থাকে কাদম্বরীকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ-প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কাদম্বরীর কিশোরবেলার সঙ্গী। তাঁর লন্ডনের পড়াশোনা। গান-নাটক নানা প্রসঙ্গ। বিহারীলালের ‘হে যোগেন্দ্র, যোগাসনে ঢুলু ঢুলু দু নয়নে বিভোর বিহ্বল মনে কাঁহারে ধেয়াও?’ ইতিহাসের নানা ঘটনা ফুটে উঠতে থাকে। সেই বাল্মীকি প্রতিভায় রবির অভিনয়। বিহারীলালের মতো হয়ে ওঠার প্রেরণা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাহাজের ব্যবসা। এতসবের মাঝেও অস্তিত্বহীনতা যেন নারীসমাজে গভীরভাবে বিরাজমান। কাদম্বরী ক্ষোভে ফেটে পড়েন – বাঙালির স্ত্রী – সে কি আসলেই কোনো মানুষ?

প্রার্থিনী – তবু যে সহ্য হয় না উপেক্ষার অপমান। …

ভাঁড়ের মতো … প্রয়োজনের মনোরঞ্জনকারী

আর সেই চরিত্রের নামই হলো স্ত্রী।

কাদম্বরীদের মনোভঙ্গি হয়তো এমন যে, নারীরা ভালোবাসা পেলে স্বর্গের অধিকারও ছেড়ে দিতে পারে। এভাবেই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় ফুটে ওঠে নারীর চাওয়া-পাওয়া ও চিরায়ত মনস্তত্ত্ব। সবশেষে প্রেমের জয়গানের মধ্য দিয়ে নাটকটি শেষ হয়।

নাটকের মনস্তত্ত্বে নারীর স্বাধিকারের রূপটি স্পষ্ট। নারী আসলে কী চায় আর বাস্তব সমাজ তাকে কী দেয় – এ নিয়ে তার পরিতৃপ্তির জায়গাটি কী – এটাই নাটকে দেখাতে চেয়েছেন সাধনা আহমেদ। কাদম্বরী চরিত্রের বঞ্চনার মধ্য দিয়ে তিনি চিরায়ত নারীর স্বরূপকে উন্মোচিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। তা কতটুকু যৌক্তিক ও সার্থক – দর্শকই সেটা বিবেচনা করবেন।

নির্দেশক প্রসেনিয়াম ধারায় নাটকটি উপস্থাপন করেছেন। বর্ণনাত্মক ভঙ্গিমায় চরিত্রাভিনয়ের মিশেলে নাটকটি উপস্থাপিত। নির্দেশক নারীর চাওয়া-পাওয়া, অস্তিত্বহীনতা ও মর্যাদার দিকটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। নাট্যক্রিয়ার চেয়ে কাব্যিক সংলাপকে মাধ্যম করেছেন।

কাহিনিটি সরলরৈখিক। কাদম্বরীর মৃত্যুপূর্ব সময়ে আত্মচেতনায় নারীর স্বাপ্নিক মূর্তি প্রার্থিনীর আগমন। দুজনের নানা দ্বান্দ্বিক কথোপকথন ও বিমোক্ষণ। শেষে দুজনের মিলিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নাটকের পরিসমাপ্তি।

নাটকটি বৃত্তকৌশল – আদি-মধ্য-অন্ত্য – এই ধারাতে প্রবহমান। প্রথাগত ইউরোপীয় ট্র্যাজেডির মতো কোনো ট্র্যাজিক পরিণতি না থাকলেও আছে বঞ্চনা, অস্তিত্বহীনতা ও বেদনার বিচ্ছেদী সুর। প্রায় সোয়া ঘণ্টাব্যাপী সময়ে নাটকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আছে স্মৃতিচারণ, অনুভব ও উপলব্ধি।

কাদম্বরী চরিত্র নিয়ে সাহিত্য-শিল্পে নানা রকমের কাজ হয়েছে। তাতে নানা বৈচিত্র্যও আছে। নারীবাদী চিন্তা নিয়েও থিয়েটারের নানা কাজ উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে এটি একটু ভিন্ন ধাঁচের। এতে কাদম্বরীকে কেন্দ্র করে চিরকালীন নারীর মনস্তত্ত্ব খোঁজ করা হয়েছে। আলো-আঁধারি, গল্পে বাস্তবতা-পরাবাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছে।

নাটকের ব্লকিংগুলিতে বৈচিত্র্য ও স্থানিক গভীরতা সৃষ্টি প্রয়োজন। তবে কিছু কিছু সময় দোলনায় ওঠা, মধ্যমঞ্চে দুজন মুখোমুখি বসা ইত্যাদি নানা ভঙ্গিমাতে কিছুটা বৈচিত্র্য আছে। সংলাপের পরম্পরায় নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে। তবে ক্রিয়া ও দৃশ্য ইমেজ তৈরিতে আরো মনোযোগ জরুরি।

নাটকটিতে সাজেস্টিক রীতিই প্রাধান্য পেয়েছে। চরিত্রের মেকাপ ছিল উজ্জ্বল। রূপসজ্জায় ছিলেন শুভাশীষ দত্ত তন্ময়।

নির্দেশক ড. আইরিন পারভীন লোপা বলেন, ‘কাদম্বরী দেবীর আত্মহননের মুহূর্তটিকে কেন্দ্র করেই প্রার্থিনী নাটকের গল্প বিবৃত হয়েছে। নাট্যকার সাধনা আহমেদ কাদম্বরী দেবীর সত্তা হিসেবে দেখিয়েছেন প্রার্থিনীকে এবং বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার মধ্য দিয়ে কাদম্বরী দেবীর না-বলা কথাগুলি বলেছেন; ‘সেই সুরে তাল মিলিয়ে প্রার্থিনীর পোশাক পরিকল্পনা করেছি গ্রিক দেবী হেকেটির মতো করে। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বরী দেবীকে ‘হেকেটি’ বলতেন – এমনটি আমরা নানাভাবে জেনেছি। নির্দেশনার কাজটি করতে গিয়ে হৃদয়ের সবটুকু প্রেম ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কতটুকু হয়েছে সেই ভার দর্শকের ওপর রইল।’ (সু্যুভেনির)

প্রদর্শনী শেষে দর্শকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে দেখা গেছে। সাজেস্টিক রীতির সঙ্গে বাংলা নাটকের বর্ণনাত্মক কৌশলের মিশ্রণ ঘটেছে। নাটকের গল্প, চরিত্র, দর্শন, আলো-সংগীত মিলিয়ে শৈল্পিক প্রযোজনা। সরল মঞ্চবিন্যাস, সংগীতের মূর্ছনা, বাহারি আলো, সহজ চরিত্রাভিনয়ের সঙ্গে বর্ণনার মিশেলে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল নারীসত্তার রূপরেখা। কাদম্বরী যেন রবীন্দ্রনাথ-প্রাধান্য ছাড়া স্বতন্ত্র আলোয় উদ্ভাসিত এই নাটকে।

আদিম সমাজ থেকেই পৃথিবীতে নারীরা সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষিত। বঞ্চনা ও অবদমন তাদের নিত্য নিয়তি। নারীর সেই বাস্তবতা থেকে মুক্তির পদক্ষেপ হিসেবে এই নাটকের গুরুত্ব অপরিসীম। নারী-পুরুষ সমতায় পরস্পরের ভালোবাসায় সমাজ বিনির্মিত হোক – এটা আমাদের সবার চাওয়া। এ নাটকে দুটো চরিত্রের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে নারী মূল্যবোধের অভিঘাত তৈরি সম্ভব। অধিবাস্তবতার রূপেই নারীর প্রকৃত সত্য ফুটে উঠুক।