ফুরায় না সব লেনদেন

১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ-গ্রন্থ, কালিদাসের মেঘদূত। আমি হাতে পেয়েছিলাম ষাট সালের দিকে। সংস্কৃত জানি না। স্কুল-ফাইনাল পর্যন্ত সংস্কৃত আমার পাঠ্যবিষয় ছিল, চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রচুর নম্বর মিলেছিল। ভাষাটার কিছুই না জেনে এত নম্বর কীভাবে পাওয়া যায়, সে-রহস্য এখন আমি জানি; সম্মানসহ সংস্কৃতে এম. এ. পাশ করার পরেও ওই ভাষাটির মর্মে একটুও ঢুকতে না পারা আর সাধারণ বাংলা গদ্য লিখতে গিয়ে শোচনীয় ভুল করা এখন যেভাবে সম্ভব হচ্ছে, তাতে মনে হয়, এই রহস্য আরও অনেকেই জানে। তাই, গীতা, রামায়ণ এবং মেঘদূতের স্তবকের পর স্তবক মুখস্থ থাকলেও, সে-সবই ছিল পোষা ময়নার অনর্গল কথা-বলার মতো। মূল মেঘদূত কাব্যের রসাস্বাদনের চিন্তাও কোনোদিন মাথায় আসেনি। দৌড় ছিল বড়জোর সত্যেন্দ্র দত্তের হালকা মনোহারী অনুবাদ পর্যন্ত। মন্দাক্রান্তা ছন্দের নিবিড় গম্ভীর, পরিপূর্ণ, বিষণ্ন-বিধুর ধ্বনিপ্রবাহ বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে অবিকল মিলল না বটে, কিন্তু তার একটা আন্দাজ পাওয়া গেল। বাংলা ভাষার অফুরন্ত সামর্থ্যরেও কিছু ধারণা পাওয়া গেল। বুদ্ধদেব বসু সংস্কৃত ভাষায় তেমন ব্যুৎপন্ন ছিলেন না বলেই জানি, তবে অনুবাদের কাজে নিজের কবিত্ব-ক্ষমতার সবটুকুই তিনি নিযুক্ত করেছিলেন। বাংলা নতুন কাব্যভাষায় দেড় হাজার দুহাজার বছরের পুরনো কাব্যকে পুনর্নির্মাণ করতে চাইলে শুধু কঠিন পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়। ভাষাটিকে আয়ত্ত করতে হবে, আতপ্ত নির্ঝরে স্নানের জন্য না হোক, অন্তত তার শুকনো কলকব্জাগুলো ঠিক ঠিক চিনতে হবে, কাব্যের সাম্প্রতিক প্রচলনগুলি, আধুনিককালের মুদ্রাদোষও বলতে পারি, সেসবের একরকম সংমিশ্রণ-সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে। মেঘদূত অনুবাদ করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু এসব দায়ই স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সত্যিই, অনুবাদে এত যত্ন, এত পরিমার্জন, এত আধুনিকতা, এত সচেতনতা আমরা এর আগে আর দেখিনি। দুশো পৃষ্ঠার বইয়ে অনুবাদ অংশ নিয়েছে মাত্র পঞ্চাশ পৃষ্ঠা – বাকি দেড়শো পৃষ্ঠাই ভূমিকা, মূলকাব্য-পরিচয়, অনুবাদ-সংক্রান্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ, সংস্কৃত ভাষাসংক্রান্ত নানা কথা, টীকা, এইসবে পূর্ণ। কাব্য-সাহিত্যকে এমন সর্বাত্মক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা – যেন যে-জীবনে শিল্প নেই, কী হবে সে-রকম জীবনযাপন করে? শিল্প-সাহিত্যকে এইভাবে দেখাটা যে বুদ্ধদেব বসুরই সারাজীবনের গড়ে-তোলা মৌলিক তত্ত্ব তিনি তা অনেকদিন থেকেই তাঁর কবিতা পত্রিকায় বলে আসছিলেন আর হাতেনাতে এই অনুবাদে সেটা বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। নতুন বৈশ্বিক সাহিত্য তাঁর প্রচারের বিষয় ছিল।

মেঘদূতের অনুবাদ নিয়ে আলোচনার জন্যে কিন্তু এই লেখা নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে যাবার ভূমিকা এটি। মেঘদূতের অনুবাদ একদিক থেকে বুদ্ধদেবেরও কিছু কথা জানানোর ভূমিকাই ছিল। মনে হয়, মেঘদূতের একটা সন্তোষজনক অনুবাদ করাই বুদ্ধদেবের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। একমাত্র কেন, মূল উদ্দেশ্যই ছিল না। এই অনুবাদের ভিতর দিয়ে সাহিত্যের একটা  নতুন পালারই সূচনা করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর কথায় সেই সাহিত্যের নাম হতে পারত নতুন কালের সাহিত্য, যা স্নান করে নেবে আন্তর্জাতিক সাহিত্য-ঝরনার ধারায়। পশ্চিম-জগতের হাজার বছরের সাহিত্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সহজ স্বাভাবিকতায় একালের দুঃসাহসী সজাগ সদাপ্রস্তুত ক্ষিপ্রকারিতায় তাকে সহজে চিনতে পারা যাবে। বুদ্ধদেব বসু যে সত্যি করেই দুহাজার বছরের পুরনো, মূল পাঠে প্রায় অচেনা মেঘদূতের স্বাদ পেতে ও পাইয়ে দিতে তৃষিত হয়ে উঠেছিলেন, কোনোভাবে বর্তমানের সাহিত্যে তাকে উপস্থিত ও প্রভাবশালী করে তুলতে চাইছিলেন তা আমার কিছুতেই মনে হয় না। সংস্কৃত কবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে এই অনুবাদ-গ্রন্থেই তাঁর আসল মনোভাবের পরিচয় আছে। একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, সংস্কৃত-কাব্যের সমঝদার এবং একই সঙ্গে আধুনিকতায় দীক্ষিত সৃষ্টিশীল অনুবাদক যে-মনোভাব নিয়ে মেঘদূত অনুবাদ করতে চাইতে পারতেন, বুদ্ধদেব তা করেননি। সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতায় তিনি যা করতে চাইছিলেন তা হলো আধুনিক বাংলা কবিতার পোশাকটাকে দ্বিতীয় দফায় বদলে ফেলে নতুন পোশাক দিয়ে তাকে সাজাতে কিংবা তার পুরনো খোলসটা নষ্ট কাগজের মতো কোথাও বাতিল করে এসে নতুন একটা খোলস গজিয়ে নিতে। দেখা যাচ্ছে, মেঘদূত প্রকাশের বছর তিনেকের মধ্যেই ১৯৬১ সালের গোড়াতেই বেরুল তাঁর আর-একটি অনুবাদ-গ্রন্থ : শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা। কালিদাস, শার্ল বোদলেয়ারের পরে কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হলো রিলকের অনুবাদ। মাঝখানে তাঁরই অসামান্য সম্পাদনায় বেরুল সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসমগ্র। বিষয় প্রসঙ্গ, সময়লগ্নতা ইত্যাদি যা কিছু রচনাকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে ফেলে, সেসব যদি বাদ দেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে বুদ্ধদেব এই তিনটি গ্রন্থেই বাংলা কবিতার একটি নতুন আবহাওয়ার বলয় তৈরি করে নিতে চেয়েছেন, একটিই বুদ্ধদেবীয় কণ্ঠ সেখানে শোনা যাচ্ছে। ঝকমকানো গদ্য, যুক্তিপরম্পরা, নতুন কবিতার শিল্পপ্রাণ, অঙ্গনির্মাণ, বিষয় বা বিষয়হীনতা নির্দেশ ইত্যাদি খুব কাছাকাছি এগিয়ে এসে একটি পূর্ণ বৃত্ত তৈরি করতে চাইছে।

মেঘদূত – অনুবাদ ভালো করে দেখে কিছু ভেবে উঠতে না উঠতে বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদ আমাদের হাতের মুঠোয় এসে পড়ল নতুন মুদ্রার মতো। ঝকঝকে, ঘষামাজা, ধারালো সূক্ষ্ম মাঞ্জা-দেওয়া এক টুকরো কালখণ্ড যেন! এ সময়ের নতুন কবি লেখক সাহিত্যিকরা লিখতে কেবল শুরু করেছেন, উঠানে তখনো ঢোকেননি, উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন কেবল, কোনদিকে এগোবেন তা নিয়ে ভীষণ দ্বিধায় আছেন, পরিষ্কার বুঝতে পারছেন তাঁরা এক অবসিত সময়ের সন্তান। ইতিহাসে, রাজনীতিতে যেমন, তেমনিই শিল্পে-সাহিত্যে পুরোপুরি ফুরিয়ে-যাওয়া একটা কালের তরুণ তাঁরা। নতুন কাল সৃষ্টি তাঁদের হাতে নেই, অথচ শিল্প-সাহিত্যে নতুন কালের সূচনা তো তাঁদেরই করতে হবে। একটু পিছন দিকে চাইলেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে পাষাণ-ভার পঞ্চাশের দশক। বাসি আসবাবেভরা বৈঠকখানা, গরমে-ভাপে নষ্ট হয়ে-যাওয়া খাদ্যদ্রব্য, পুরো সাহিত্যটা এলিয়ে-যাওয়া সাত-বাসি পান্তাভাতের মতো, যেন সমাজেরই সাত-বাসি বিশাল লাশে! কোনোমতে বাংলা ভাষাটিরই আইনি-উদ্ধার সম্ভবপর হয়েছে মাত্র, কিন্তু ভবিষ্যৎ কাঁপছে পচা-সুতোর ওপর। ভনভন করে মাছি উড়ে এসে বসছে রাষ্ট্র-সমাজের গোলাপি-কালো ক্ষতের রসে। প্রতিটি মানুষের গলায় দশকের শেষে পেঁচিয়ে বসবে সামরিক শাসনের কড়া রজ্জু। কোথাও কোনো আলো নেই। তিরিশের দশকের কবিদের বিদ্যুৎচ্ছটা কবেই মিলিয়ে গেছে দিগন্তের পরপারে। সেসব চোখ ধাঁধায়, মন ভোলায়, তীব্রস্বাদে মস্তিষ্ক জাগিয়ে তোলে, কিন্তু পরিণামে নষ্ট করে দেয় যকৃত, এনে হাজির করে ক্ষুধামান্দ্য এবং শেষ পর্যন্ত হরিদ্রারোগ। আশ্চর্যের ব্যাপার বিশের-ত্রিশের কবিদের উজ্জ্বল আধুনিকতা চল্লিশেই নিঃশেষিত। কোথাও কি ফাঁকি ছিল? চল্লিশের দশকের ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্র সংগ্রাম সংঘর্ষ উত্তাপ সইবার ক্ষমতার কি অভাব ছিল বিশের-তিরিশের তথাকথিত বৈশ্বিক আধুনিকতার? ঠুনকো ফানুস ছিল কি আন্তর্জাতিকতা? গোটা জনসাধারণ থেকে স্বাচ্ছন্দ্য ও বৈদগ্ধ দিয়ে আলাদা করা মুষ্টিমেয় উপনিবেশী আলোকিত মানুষদের এগোতে পারার সীমানা কি পূর্বনির্ধারিত ছিল? সুকান্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায় চল্লিশের দশকে দেখা দিতে পারেন কি কবি হিসেবেই, না চল্লিশের দশক বলেই? এই সঙ্গে এই কথাটিও বলতে হয়, যেমন করে চিরকাল বাংলাদেশের কবি মাটি নদী শস্য প্রান্তর জীবন উজিয়ে আসে, জীবনানন্দ দাশও তেমনি এসেছিলেন, তাঁকে বিশ-তিরিশ দশক দিয়ে দেগে দেবার কোনো মানে নেই। আরও বলতে হয়, বাংলা কথাসাহিত্য যে-যোগাযোগের সুতোটা ঠিক ছিঁড়ে ফেলে না, বিশ-তিরিশের কোনো মেনিফেস্টোতেও থেকে যেতে চায় না আর ইতিহাস কাল রাজনীতির প্রহারটা গা-পেতে সয়ে সমস্ত ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এগিয়ে আসে, সেজন্যেই কি পুরনো পেতলের মতো একেবারে নি®প্রভ হয়ে পড়ে না? কিন্তু তা কতোটা সময় ধরে? উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনে ইতিহাসের যখন আলো জ্বালিয়ে দেবার কথা, সেই আলো তো জ্বললোই না সাতচল্লিশের ভারত-ভাগের সময়ে, বরং যেটুকু-বা ছিল ক্ষীণ হয়ে জ্বলতে জ্বলতে যেন নিভেই গেল পুরোপুরি।

এই সময়টা আমাদের পেরুতে হয়েছে, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যও কীভাবে আটকা পড়েছে, সময়ের সেই তিক্ত স্বাদ সবাইকেই খানিক খানিক নিতে হয়েছে। তবে অঙ্গারের মধ্যেও দগদগে আগুন কিছু থাকে। একজন সতীনাথ, একজন জ্যোতিরিন্দ্র, একজন ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান বা আবু ইসহাক কিংবা কমলকুমার বা অমিয়ভূষণ চল্লিশের দশকের আগুন নিয়েই মিটিমিটি জ্বলতে থাকেন। এদিকে পঞ্চাশের দশকের পাষাণভার অনড় হয়ে চেপে বসে। কথাসাহিত্যে কবিতায় পশ্চিমবঙ্গের ছবি পূর্ব পাকিস্তান থেকে খানিকটা আলাদা বটে – কিন্তু কতোটা আলাদা। একগাদা লেখক-কবিদের নাম দুই দেশেই করা যায়, কিন্তু চেঁচিয়ে বলতে ফুসফুসে জোর পাওয়া যায় না। শক্তি, সুনীল ইত্যাদি ইত্যাদি, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ হক ইত্যাদি, তেমনিই ম্রিয়মাণ ম্যাড়মেড়ে কথাসাহিত্যের শিল্পী কয়েকজনের নাম বলা শুরু করতে-না-করতে উৎসাহ ফুরিয়ে যায়। তা-ও আবার এঁদের অনেকেরই শুরু চল্লিশে, স্ফূর্তি বিকাশ ষাটের দশকে। আদতেই বড়ো নিষ্প্রাণ, বড়ো বিবর্ণ পঞ্চাশের দশক। তখন ভয়ানক অপেক্ষা ষাটের কালের।

এখন মনে হচ্ছে বুদ্ধদেব বসুর বইদুটি, অনুবাদের নির্ভরতা সত্ত্বেও যেন ইতিহাসেরই ভীষণ দাবি। প্রচণ্ড শক্তিতে ছুড়ে-দেওয়া অগ্নিমুখ বর্শা যেন কিংবা দীপ্যমান জ্যোতিষ্ক। জ্বলতে জ্বলতে এসে পৌঁছুল শিল্প-সাহিত্যের পরিমণ্ডলে। যাঁরা সাহিত্যে কাজ করতে চাইছিলেন, সরাসরি তাঁদের মধ্যে এসে পড়ল বৈশ্বিকতা, মানুষতা, তীব্র ব্যক্তিমুখিতা যা বাংলা সাহিত্য কখনোই গ্রহণ করেনি। তিরিশের কবিরাও যা নির্দ্বিধায় গ্রহণ ও চর্চা করতে পারেননি, রবীন্দ্রনাথ তো অনেক দূরের কথা। বুদ্ধদেবের কাছ থেকেই দাবি এলো, অলজ্জ যৌনতার। তিনিই চাইলেন ব্যক্তির সমাজ-সংসার অতিক্রমের দুঃসাহস, বিশ্বস্ততা সমতার ভিন্ন সংজ্ঞা নির্ধারণের অধিকার, কল্লোল-কালেও যা সম্ভব হয়নি। সাহিত্যে এইসব কিছুরই সর্বাঙ্গীণ স্ফূর্তি চাই। পরিবার ভাঙছে, আরও ভেঙে টুকরো হয়ে যাক ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, কুসংস্কার দূর হোক, পরকীয়তা হোক না মধ্যবিত্তের মধ্যদুপুরের একান্ত চর্চার বিষয়। ঠিক এই ভাষায় কিংবা এইরকম সুনির্দিষ্ট করে বুদ্ধদেব কোথাও কিছু লেখেননি। শিল্প-সাহিত্য বলতে তিনি যাই-ই বুঝে থাকুন না, শিল্প-সাহিত্যকেই জীবনের ধ্রুবতারা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, এক ক্লান্তিহীন চর্যার বিষয়, জীবনের সঙ্গেই যা বিনিময়যোগ্য; তিনি উপেক্ষা তুচ্ছ করেছিলেন বিষয়-বৈষয়িকতা, পৃথিবীর বিপুল মনুষ্যভার, ইতিহাস রাজনীতি। তাঁর শিল্প-সাহিত্যের ভাবনাকে এইভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় বলে আমি মনে করি। আমরা সেই সময়টা পার হয়ে এসেছি – কী অসামান্য জাদুস্পর্শে বোদলেয়ারের অনুবাদ নাড়িয়ে জাগিয়ে দিয়ে গেল
শিল্প-সাহিত্যের পুরো আবহাওয়াটাকে তা এখনো মনে আছে। কানে মন্ত্র আর প্রাণে প্রাণে দীক্ষা নেবার জন্যে তরুণরা উন্মুখ হয়ে রয়েছে। বুদ্ধদেব, তাঁর কথা, কবিতা কী কাকে বলে তা জানিয়ে দেবার অসামান্য নতুন বাগ্ভঙ্গিমা, বিশেষ করে পশ্চিম-জগতের শিল্প-সাহিত্যে তাঁর বিশেষজ্ঞতা পারঙ্গমতা একেবারে বিনা প্রতিরোধে জয় করে নিল তরুণ কবি-সাহিত্যিকের হৃদয়। একটি গ্রন্থরচনায় এত যত্ন কে কবে দেখেছে? বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদে কটি-বা পৃষ্ঠা তিনি খরচ করেছিলেন? তাঁকে অনেক বেশি পৃষ্ঠা খরচ করতে হয়েছিল কবিতা নিয়ে কথা বলতে। কবিতা অনুবাদের উপলক্ষেই অবশ্য এসেছিল সেসব কথা – ভূমিকা টীকা কালপঞ্জি ইত্যাদি মিলিয়ে একটি সুবলয়িত জীবন ও কাব্য দৃষ্টিভঙ্গি। মনে হয়, বিশের-তিরিশের দশকের কবি-লেখকদের মধ্যে একমাত্র বুদ্ধদেবই কখনোই, কোনো মুহূর্তের জন্যই সাহিত্যভাবনা কাব্যভাবনা পরিত্যাগ করেননি। ফিরে গেছেন, আবার এসেছেন, কিছুদিন সাহিত্য বা অন্য ব্যবসা করেছেন, তারপর কিছু পুঁজি জমলে আবার এসেছেন সৃজনের জগতে, এমন কখনোই ঘটেনি তাঁর বেলায়। দশকের পর দশকজুড়ে অশ্রান্ত কলম চালিয়েছেন নিজেরই ভাবনাকে খুব বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করে। টানা ২৫ বছর পত্রিকা করেছেন কবিতা, লালন করতে চেয়েছেন নতুন কবিতা, নতুন কবি। যেমন চল্লিশের কবিদের, তেমনিই পঞ্চাশের বিদ্রোহীদের আর সাধারণভাবে বাংলা কবিতা নিয়ে সম্পূর্ণ লগ্নতা কখনোই ছাড়েননি।

জানি না, খুব কি ভুল কথা হয়ে যাবে যদি বলি গত শতকের ষাটের দশকে যাকে শিল্প-সাহিত্যের, বিশেষ করে সাহিত্যের, আরও বিশেষ করে কবিতার নতুন মৌলিক স্বতোদ্সারিত সাহিত্যধারা বলা হচ্ছে, যে-বিষয়ে সেই সময়ের তরুণ, আজকের প্রাজ্ঞ প্রৌঢ় বৃদ্ধ অগ্নিবাহকরা নিঃসন্দেহ হয়েছেন, সেই গঙ্গোত্রীর গোমুখ ছিল বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ারের মহাপ্রভাবশালী অনুবাদ-গ্রন্থটি? ভুল তেমন হবে বলে মনে হয় না। সমকাল তখনো চলছে, মোটামুটি নিয়মিতই বের হয় – তবু আনকোরা নতুন মুদ্রার ওপর সময়ের, তার মানে, ক্লান্তির সামান্য ছাপ কি পড়তে শুরু করেছে? সমকাল কি একটু অবসিত তখন? সাহিত্যের জন্য, শিল্প-সংস্কৃতির জন্য তার তৈরি করা পথগুলি প্রয়োজনের তুলনায় কি সংকীর্ণ হয়ে আসছে? সেখানে কি তরুণতরদের জায়গা হতে চাইছে না? পূর্বমেঘ নামে একটি ত্রৈমাসিক এই সময় বের হতে শুরু হলে সেটি স্বাভাবিক গ্রহণীয়তা পেতে থাকে বটে, তবে দেখতে পাই না তেমন প্রচণ্ড উত্তেজনা উৎসাহ, যা কণ্ঠস্বর প্রকাশিত হলে কিংবা কণ্ঠস্বরের মতো আরও কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হলে বা প্রকাশের প্রস্তাব প্রচারিত হলে দেখা গিয়েছিল। ভীষণ গুমোট, বৃষ্টিহীন দিনরাত অসহ্য খরা, নিদারুণ অসচ্ছল কৃপণ নিষ্ঠুর সময় – এ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। না, সাহিত্য-আন্দোলন নয়, আন্দোলন শব্দটা একেবারেই চলবে না – তবে সাহিত্যে শিল্পে যা হচ্ছে, হয়েছে, হয়ে আসছে, তা আর ছুঁয়ে দেখারও যোগ্য নয়। সদর্পে, সদম্ভে সেসব বাতিল করে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এক-একটি জেনারেশন নিজের নিজের পত্রিকা, নিজের নিজের রচনা নিয়ে দেখা দিতে শুরু করল। যেখানে কিছু গড়া আছে, ঠিক সেখানেই যদি কিছু গড়তে হয়, তাহলে ভাঙতেই হয়। ভাঙা হচ্ছে সৃষ্টির স্পর্ধা। এ প্রক্রিয়া শুরু করলে ভাঙায় শ্লাঘা আর আত্মগরিমা আসে, স্পর্ধার সঙ্গে সঙ্গে আসে শ্রেষ্ঠত্বের বোধ, তারপর আর কিছুই মনে থাকে না, গড়ার জন্য ভাঙা এই দায়িত্ব আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ভাঙা তখন নেশা, স্পর্ধা প্রকাশই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি।

বুদ্ধদেব বসু স্কুল খোলেননি। তিনি কাজ করতে করতে, সৃষ্টি করতে করতে, চিন্তা করতে করতে, ভাবনাগুলিকে অক্ষরে বিন্যস্ত করতে সেই কবে থেকে এগিয়ে আসছিলেন। ষাটের দশকের গোড়াতেই যেন তিনি সম্পূর্ণ পরিপক্ব হলেন। তারপরে কী ঘটে সে-কথার প্রয়োজন নেই, কিন্তু মনে রাখতে হবে ভাবুকদেরও হয়ে-ওঠার ইতিহাস আছে, তাঁদেরও ভাঙচুর আছে, হ্রাসবৃদ্ধি আছে, পথ-বিপথ আছে, এক পথ ছেড়ে দেওয়া, অন্য পথ চোখ বন্ধ করে ধরা আছে। মেঘদূতের কথা এখানে আর আনার দরকার নেই, তবে বোদলেয়ারের অনুবাদের সময় বুদ্ধদেব বসুকে আধুনিক বলে চিহ্নিত, শিল্পবিপ্লবোত্তর কালের উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ষষ্ঠ দশক পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে হয়েছিল। অনুবাদের বইটিতে এক দেড় শত বছরের একটি কালপঞ্জিও তাঁকে দিতে হয়েছিল। এই পুরো সময়টার ইউরোপের বৌদ্ধিক শৈল্পিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক বিশাল পটটিকে তিনি আমাদের সামনে ধরে দিতে চেয়েছিলেন, বোধহয় তার মধ্যে তাঁর সাধ্যমতো ধাতস্থ হতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু যে-বুদ্ধদেব এতটা সময় পিছিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি তো শূন্য হাতে শূন্য মাথায় সেখানে যাননি, তিনি নিজেও তখন হয়ে উঠেছেন। এক তৈরি হয়ে-ওঠা অনমনীয় বুদ্ধদেব বসু, তিরিশের চল্লিশের নতুন কবিতার নতুন সাহিত্যের ব্যাখ্যাতা, ঝানু পত্রিকা-সম্পাদক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশের দশকের মানুষ। নিজের ভারতবর্ষ বাংলা-র চেয়ে অনেক বেশি মজেছিলেন ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতিতে। তাঁর মতো আমাদের নতুন লেখকদের কতোটা উৎকেন্দ্রিক করে তুলেছিল জানি না – হয়তো চার-পাঁচটি দশক পার না হলে তা বোঝাও যাবে না। তবে এক ভিন্ন জগৎ থেকে আসছিল
শিল্প-সাহিত্যের অভাবনীয় সব নতুন ভাবনা, নতুন কল্পনা, নতুন সৃষ্টি। উনিশ শতকের শুরুতে বোধহয় ভারতে বাংলায় এমনই ঘটেছিল। সে যাই হোক, পঞ্চাশ-ষাটের দশকের অনুবাদক বুদ্ধদেব তো প্রায় পুরো তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন বিশের দশকেই। শিল্প-সাহিত্যের নতুন নতুন আন্দোলনগুলির সঙ্গে অন্যভাবে না হোক, অংশডাক্  হিসেবে না হোক, পাঠ অধ্যয়নের ভিতর দিয়ে তো পরিচিত হচ্ছিলেন! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে চিত্রকলা বা সাহিত্যের যে  নতুন নতুন আন্দোলন, মত বা দল এসে উপস্থিত হয়েছিল – ফিউচারিজম, কিউবিজম, ফভিজম – ইত্যাদির সঙ্গে যখনই হোক তাঁর পরিচয় ঘটেছিল এবং বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে এদের দু একটির শ্মশানভস্ম থেকে কিংবা নতুন সময়ের ভিতর থেকে উঠে-আসা নানা মতবাদ ডাডাবাদ, সুররিয়ালিজম ইত্যাদির সঙ্গেও নিঃসন্দেহে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব মতবাদ খুব বিশেষ, খুব নির্দিষ্ট, চিত্রকলা বা কবিতা-বিষয়ক, প্রধানত চিত্রকলা-বিষয়ক, অল্পকালস্থায়ী, কোনো বড়ো শিল্পীর যুক্ততার সঙ্গে জড়িত, তিনি ছেড়ে গেলেই ছত্রখান এবং প্রায় সবসময়েই সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য, অনির্দেশ্য এবং এলোমেলো। প্রায়ই বিশেষ নির্দিষ্টতা থেকে তাদের তুলে আনাই সম্ভব নয়, অনেক ক্ষেত্রেই কোনো কোনো মত ভীষণভাবে প্রকরণগত এবং একজন বিশেষ শিল্পীর সঙ্গেই জড়িত। এরা এক-একটা ঢেউয়ের মতো এসেছে, চলে গেছে, কেউ মিউনিখে প্রাধান্য পেয়েছে, প্যারিসে অনুসারী সমর্থক জোটেনি, কেউ একবারেই প্যারিসীয়। সেই কঠিন সময়ে মূল চিত্রকলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখে ওঠা যায়নি, কাব্যের অনুবাদ ইত্যাদি হয়তো ছিটেফোঁটা মিলেছে। কিন্তু একটু বিস্ময়ের ব্যাপার, বুদ্ধদেব বসুর মতো বিশের দশকের তরুণ কবিদের এসবে বিপজ্জনকভাবে উদ্দীপিত হতে বাধা হয়নি। যাকে সাধারণীকরণ করা যায় না, এক জায়গা থেকে উপড়ে এনে আরেক জায়গায় পোঁতা যায় না, তাকে বুদ্ধদেব সযত্নে লালন-পালন করেছেন আর তিন-চার দশক পরে যখন ইউরোপীয় সাহিত্যসংস্কৃতির ব্যাপকতর পরিচয় জানাতে গিয়েছেন, তখন সেখানেও তাকে ব্যবহার করেছেন, মেশানোর চেষ্টাও করেছেন জেনে বা না-জেনে। গাট্রুড স্টেইন হারানো প্রজন্ম বলে যাঁদের বর্ণনা করেছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত ফুটিফাটা ঝাঁঝরা বিশাল শরীরের হেমিংওয়ে মুভেবল ফিস্টে যাঁদের কথা লিখেছিলেন সেই যুবকেরা রক্তে রক্তে জানত একটা দশক তারা হারিয়ে ফেলেছে, নিজেরা হারিয়ে গেছে – গৃহপ্রেম পরিবার সবই – কিন্তু বিশের দশকের বাংলাদেশে বসে অসহযোগ, স্বরাজের আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মধ্যে কোনো তরুণের হারিয়ে যাবার কথা কি আদৌ থাকে?

ষাটের দশকে কি বিশের দশকই ফিরে এসেছিল? বুদ্ধদেব বসুই কি ছিলেন ভগীরথ? তবে তিনি প্রথম থেকেই অন্যরকম ভগীরথ। সমাজ, সমাজগতি, উৎপাদন, উৎপাদনের লাভালাভ, বৈষম্য-জর্জরিত মানুষ, মানুষের স্বাধীনতার বাস্তবভূমি, অন্য কথায় সমগ্র পৃথিবীজুড়ে গোটা মানুষ জাতি কেমন করে ইতিহাস তৈরি করে, সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি প্রায় ছেনি-হাতুড় দিয়ে গড়ে তোলে, মানুষের কতো রক্ত ঝরে, কতো দাম সেই রক্তের, এক অদ্ভুত সৌরভময় আশীর্বাদে বুদ্ধদেব বসু তা জানার এবং হাতে লিপ্ত হবার আঁচ থেকে নিজেকে সারাজীবন বাঁচিয়ে চলতে পারেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখকদের সংগঠনের তিনি একসময় একজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন, তা না ভুলেও আমরা আমৃত্যু এক শুদ্ধ শিল্পবাদী বুদ্ধদেব বসুকেই দেখেছি। কালিদাস অনুবাদে তাঁর একান্ত শিল্পবাদিতায় সাধারণভাবে কথা তেমন কিছু নেই, বোদলেয়ারকেও তিনি যে শুদ্ধ কবির মহত্ত্বের শিরোপাটি দিতে চাইবেন তা নিয়েও অন্তত বুদ্ধদেব বসুকে প্রশ্ন করা যাবে না। তবে এ কাজটা তিনি সরাসরিই পারতেন, কিন্তু কী কারণে তিনি ইয়োরোপীয় শিল্প-সাহিত্যের একশো সোয়াশো বছরের কঠিন জমির সন্ধান নিতে চাইলেন বোদলেয়ার অনুবাদ করতে গিয়ে, সেটা নিয়ে একটু কৌতূহল বোধ করতেই হয়। যা তাঁর ধরন নয়, ফল ফুল ফসল যা জন্মেছে তাকেই একান্ত প্রাপ্তি, চূড়ান্ত ধন হিসেবে মেনে নেওয়াটাই যাঁর জন্য স্বাভাবিক সেই তাঁকেই যে কঠিন জমিতে সেসব ফলেছে, তার মাটির প্রকৃতি, আকাশের রং আর জল-হাওয়া, ঝড় আর হাওয়ার চলাচল এইসব নিয়ে বোধহয় এই প্রথম বিশদ আলোচনা করতে দেখা গেল। ১৭৭৪ সালে গ্যেটের তরুণ হেবটরের দুঃখের প্রকাশকাল থেকে শুরু করে বোদলেয়ারের মৃত্যুর অনেক বছর পর ১৯০৪ সাল পর্যন্ত পশ্চিম ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক প্রধান ঘটনাগুলির সঙ্গে উনিশ শতকের প্রায় সব উল্লেখযোগ্য শাসক, জনশাসক, কবি লেখক দার্শনিক অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানীর নাম বা তাঁদের প্রধান ও প্রভাবশালী গ্রন্থগুলির খবর জানিয়েছেন তিনি। স্রেফ একটা তালিকা তৈরি করে দেওয়ার মতো হলেও এই কয়টি পাতার মধ্যেই ইয়োরোপীয় রাষ্ট্র, সমাজ, রাষ্ট্রনীতি কূটনীতি, বৌদ্ধিক দার্শনিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, শিল্প-সাহিত্যের বৈচিত্র্যময়, বিষম ও বিতর্কমূলক একটা চেহারা এতে ফুটে উঠেছে।

কিন্তু তারপর, এই বইয়েরই প্রথমে তিনি যে দীর্ঘ একত্রিশ পৃষ্ঠার ভূমিকা লিখেছেন শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা এবং সেই সূত্রেই আধুনিক কবিতা-বিষয়ে, সেখানে বইয়ের শেষে দেওয়া কালপঞ্জিতে ফুটে-ওঠা মহাদেশীয় শিল্প-সাহিত্যের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সুপরিসর ক্ষেত্রের দিকে একটি অঙ্গুলিনির্দেশও তো দেখা যায় না। দর্শন যেটুকু আছে, সেটি না থাকলেই বোধহয় দর্শনের মনোযোগী ছাত্র বেশি খুশি হতে পারতেন। এই বহুগ্রাহী মানুষটি নানা জিনিস চেখে দেখেছেন, অনেক পড়েছেন, বিচিত্র স্বাদে তাঁর রসনা পেয়েছে অগণন অভিজ্ঞতার তৃপ্তি। অথচ লিখেছেন তিনি একটি ব্যক্তিগত রচনা আর তাকেই দিতে চেয়েছেন তত্ত্বের চেহারা। তিনি গুরুত্বের সঙ্গে জানিয়েছেন খ্রিষ্টপূর্ব কালের
শিল্প-সাহিত্যে মৃদুহাস্য নেই, কেউ কোনোদিন তেমন করে হাসত না বলে নেই, নাকি শিল্প-সাহিত্যে তেমন করে হাসা উচিত নয় বলেই নেই, বুদ্ধদেব তা জানাননি, কিন্তু হিন্দু বৌদ্ধ শিল্পে এরকম হাসি বেশ আছে তা-ও তিনি এখানে বলেছেন; তিনি জানান, আরও একটি জিনিস শিল্পে ছিল না যুগের পর যুগ কেটে গেলেও। তার নাম বিষাদ। চিত্রকলায় কবিতায় সাহিত্যে বিষাদ নামের অনুভবের অস্তিত্ব ছিল না। তাঁর মতে এ হচ্ছে রেনেসাঁসের আবিষ্কার, বিশেষ করে চিত্রকর্মে। এক নিশ্বাসেই আবার বলেন, রোমান্টিসিজম প্রাচীন মধ্যযুগের শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে আধুনিক শিল্প-সাহিত্যের এইসব ভেদ ঘটিয়েছে। তাঁর মতে সেরা রোমান্টিক কবি বোদলেয়ার তাঁর কবিতায় এনেছেন আরও অনেক কিছু – বিষাদের সঙ্গে বিষাদের বিলাসিতা – সেসব আবার রোমান্টিক কবি শেলি বায়রন ওঅর্ডসওয়ার্থ থেকে একেবারে আলাদা, এঁদের উচ্চারণ বালখিল্য কারণ তাঁরা মানুষের দুর্গতির জন্য মানুষকে দায়ী ঠাউরেছেন, কিন্তু রোমান্টিকশ্রেষ্ঠ বোদলেয়ার বিষাদকে স্বয়ম্ভু অহেতুসম্ভব বলে মনে করেছেন, নিহিত পাপবোধজাত – আহা, বাইবেল-উক্ত সেই আদিপাপ! তারপর বিষাদ থেকে বিষাদের বিলাসিতা, তা থেকে বিতৃষ্ণা এবং বিতৃষ্ণা থেকে গভীর নির্বেদ। বোদলেয়ারের কবিতা থেকে এসব কথা তাঁর মাথায় আসতে পারে, দস্তোয়েভ্স্কির উপন্যাস পড়েও এই রকমই মনে হয় তাঁর, একই বছরে জন্মগ্রহণকারী দস্তোয়েভ্স্কি বোদলেয়ারেরই সঙ্গী। বোদলেয়ারের কবিতাপাঠ নানাভাবেই হতে পারে, বুদ্ধদেব বসুও এভাবে তাঁকে পাঠ করতে পারেন, কিন্তু তিনি যে অবিসংবাদিত নিশ্চিতির সঙ্গে তাঁর বক্তব্যকে সূত্রবদ্ধ করতে চান – রোমান্টিসিজম রেনেসাঁস আধুনিকতা ইত্যাদি জড়িয়ে কালচেতন, দর্শনচেতন একটা ইতিহাস লিখতে চান, তাকে ব্যক্তিগত আবেগ ও পছন্দ-অপছন্দের ছাপ-মারা একটা কাঁচা তত্ত্বনির্মাণ বলা ছাড়া উপায় থাকে না। রেনেসাঁসের কথা ছেড়ে দিচ্ছি – এ বিষয়ে কথা বলাটা আমাদের সকলের জন্য এখন দৈনন্দিন দায়িত্বহীনতার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে – ব্রাকহার্ট বা তাঁর মতো অন্যান্য ইয়োরোপীয় পণ্ডিতদের রচনা পড়লেই সেটা বোঝা যায়। তাই বলে রোমান্টিক-আন্দোলন নিয়েও যে সহজ তরল বালভাষণ সম্ভব, তা একমাত্র বাংলা ভাষার লেখাগুলো পড়লে বোঝা যায়। দর্শন আর তত্ত্বচিন্তায় বহুকাল ধরে এদেশে ফাঁক, আবেগ অনুভবের তলায় মাটি নেই – অভিজ্ঞতাও শক্ত হতে সময় পায় না, তার আগেই ভাবপ্রবণতা তাকে নরম তলতলে করে তোলে। রোমান্টিক-আন্দোলনের আলোচনা কোনোক্রমেই যে শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী রাষ্ট্র ও সমাজের, তার মানে রাষ্ট্রবিন্যাস, সমাজবিন্যাস, মানববিন্যাস, উৎপাদনের উৎসাদন এবং নতুন উৎপাদনব্যবস্থা স্থাপন, শহরগ্রামের ধূলিসাৎ ভাঙচুর, নতুন অর্থনীতির গড়ে-ওঠা, নতুন যুদ্ধবিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যা – পুরনোকে একেবারে ভেঙে শুইয়ে দিয়ে – এসবের গভীর জ্ঞান, বিশাল তথ্যসম্ভার, পুরো মানবসমাজের জন্য সুগভীর আগ্রহ ছাড়া সম্ভব নয় এখন তা আমার কাছে খুবই স্পষ্ট। এই দর্শনের একজন প্রধান লেখক জাঁ জাক রুশো তেমন সহজবোধ্য লেখক ছিলেন বলে মনে হয় না। মানুষের মুক্তির কথা বলতে গিয়ে মানুষের জন্য কম দুর্গতি ডেকে আনেননি তিনি। আপাতবিরোধিতায়, স্ববিরোধিতায় বহুমাত্রিক বাক্যরচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।

বুদ্ধদেব বসুর অধ্যয়নের, আগ্রহের, পঠনের দিগন্ত খুব বড়ো ছিল। কিন্তু তাঁর ইতিহাসবোধ প্রবল ছিল না, দর্শনের ভিত ছিল কাঁচা, কঠিন রসহীন যুক্তি শৃঙ্খলার পথ ছিল তাঁর ভীষণ অপছন্দের। কোনো একটা কথাকে লিখতে লিখতে ফাঁপিয়ে তোলা এবং তাকে হৃদয়মনপ্রাণ দিয়ে গ্রহণযোগ্য করে তোলা কিংবা ওই একইভাবে কোনো একটি চাইবার বিষয়কে কুষ্ঠতুল্য বর্জনীয় করে তোলার অসামান্য ক্ষমতা তাঁর ছিল। রেনেসাঁসের একটি দুটি বৈশিষ্ট্য, বিশাল রোমান্টিক-আন্দোলনের দু-একটি কথা সামনে রেখে শুধুমাত্র রচনার ক্ষমতায় তিনি অনেক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতেন যাদের যৌক্তিক পরম্পরা নিয়ে অমীমাংসেয় প্রশ্ন তোলা যায়। সন্দেহ নেই, বোদলেয়ারের বহু কবিতা নিজেকে নিজের মধ্যে রেখেই সব প্রশ্ন-থামিয়ে-দেওয়া ব্যাখ্যা করতে পারবে। কিন্তু তাই বলে সেখান থেকে একটি বক্তব্য বের করে এনে নিজের বা অন্যের জীবনের জন্য অনুসরণীয় করে তোলা চলবে না। অথচ বুদ্ধদেব ঠিক এই কাজটিই করে শিল্পের আধুনিকতার পথ বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন। এর ফলে অনেক সময় তিনি, কখনো তাঁর অনুসারীরা বহু সৃষ্টিকে প্রাদেশিকতার গ্রাম্যতার দোষে নোংরা পচা ডোবায় নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন এবং নতুন সাহিত্যের নতুন মার্কাগুলির ছাঁচ তৈরি করে ফেলেছিলেন। প্রশ্ন মোটেই বোদলেয়ারকে নিয়ে নয় – তাঁর ইতিহাসহীন ব্যাখ্যা নিয়ে। তাঁর কাব্যের উত্তুঙ্গ মহত্ত্ব নিয়ে নয়, তাঁর আত্মিক সংকট, সুমহান পতন, তীব্র জ্বালাময় নরকযন্ত্রণা নিয়েও নয় – এই সবকিছুকে সাহিত্যের উচ্চতার আধুনিকতার মানদণ্ড করার প্রাণপণ চেষ্টা নিয়েই আমাদের প্রশ্ন। কেন দুঃসহ অপমানকর দারিদ্র্য কোনো ব্যাপারই নয়? ক্ষুধিত কি মৃত্যুকালে ঈশ্বরের সর্বব্যথাহর স্বপ্ন দেখেই? আদিপাপ আছে বলেই কী কদর্যতায় ধনী দরিদ্রের সমান অধিকার? বিষাদ-বিতৃষ্ণা-নির্বেদ অন্তহীন ব্যাপ্তিতে অমরত্বে গিয়ে পৌঁছয়? অতিচেতন না হলে যখন নির্বেদের অনুভব ঘটবে না সে জন্যেই, বোদলেয়ার মজেছেন বলেই, সুরা আফিম গাঁজায় যৌনতায় মজে, দরকার হলে উপদংশের অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্বেদ থেকে অব্যাহতি পেতে হবে? মানব-নিয়তি বলে সত্যিই কি আছে? যদি থাকে, তা কি সকলের জন্যই একরকম? তাকে সকলের জন্য সত্যই বা বলতে হবে কেন? বুদ্ধদেবের সারাজীবনের রচনায় শৌখিন বিষাদ বিতৃষ্ণা নির্বেদ থাকতে পারে, সত্যিকারের বিষাদ নির্বেদ কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। তাঁকে আসক্তিভরা মানুষ বলেই তো ধারণা হয়। তাছাড়া বহু বহু কাল ধরে শিল্পের ভিতরের এবং শিল্পের বাইরের অনেক মানুষের কাছ থেকেই এরকম অভিজ্ঞতার কথা আমরা শুনেছি। হঠাৎ একালে এসে নিজের দেশকালের ইতিহাসটিকে এক অদ্ভুত বোধহীনতায় পুরোপুরি ভুলে গিয়ে এর ওপর চাপিয়ে দিলেন খুব পুরনো অবক্ষয়িত দর্শনের একটা খোলস। যেমন গোটা উনিশ শতক তাঁর কাছে প্রায় ইতিহাসশূন্য, তেমনিই একই শূন্যতায় তিনি বিশ আর তিরিশ দশকের উপার্জিত শিল্পদর্শনকেও মিশিয়ে ফেলেন তাঁর নতুন সাহিত্যভাবনার সঙ্গে।

দেরিতে এসে পৌঁছয় পশ্চিম এখানে। ইতিহাস-ধারণা, দর্শন-ধারণা, শিল্প-ধারণা বড়ো গড়িমসি করে এইসব পুবের দেশে পৌঁছতে। ইতোমধ্যে ছাই ঘটেও না কিছু এসব দেশে! শিল্প দর্শন সংস্কৃতির সমস্ত পাত্র দিনরাত বছর যুগ খালিই পড়ে থাকে, কাজেই পশ্চিম থেকে যখন যা আসে তাই নতুন। এখন অবশ্য দিনকাল বদলেছে। পশ্চিমই এখন সব ব্যবস্থা চটজলদি করে ফেলছে। কিন্তু ষাটের দশকে তো সে-রকম ছিল না। একখানি দুখানি তিনখানি বই নিয়ে বুদ্ধদেব পৌঁছলেন। বহুদিন না খেয়ে আঁত শুকিয়ে ছিল, তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের খিদে, স্বাস্থ্যকর তীব্র রুচি চনমনে হয়ে উঠেছিল। সুবিশাল বন্ধ লোহার কপাট ঝনঝন শব্দে খুলে গেল। এত এত নতুন কথা জানা যাচ্ছে, এত এত নতুন সাহিত্য, নতুন কাব্য আছে, এতসব নতুন চিত্রকলা – হায়, তখন কেই-বা জানে বোর্হেস আছেন, ফুয়েন্তেস আছেন, ইয়োসা আছেন, মার্কেস, আচিবি আছেন, শোয়েংকা আছেন, এমনকী ফকনার হেমিংওয়ে আছেন। থাকুকগে, আমাদের তেমন জানা নেই। আমরা অনেক জেনেছি বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে। কেমন সব অদ্ভুত পথে আমাদের জানা হয়ে যাচ্ছে কিউবিজম, ডাডাইজম, সুররিয়্যালিজম – জানা যাচ্ছে নতুন চিত্রকলা, নতুন কবিতাকলা। এইবার সমকাল পিছিয়ে পড়ল। পাঁচের দশকের প্রায় সব সৃষ্টি আর বাংলা সাহিত্যের অনেকটাই ভীষণভাবে প্রাদেশিক ও গ্রাম্য বিবেচিত হলো। স্পর্ধা হয়তো নতুন সৃষ্টির জনয়িত্রী। কিন্তু তা সাধারণভাবে ছড়িয়ে পড়লে – যোগ্য অযোগ্য নির্বিশেষে, যাদের সৃষ্টিক্ষমতা শুধুমাত্র ব্যবহারের অপেক্ষায় আছে, আর যাদের তা নেই, আছে শুধু প্রচণ্ড অস্থিরতা – সবাই যদি নাকচ আর স্পর্ধার তাড়নায় ছটফট করতে থাকে, তখন অস্থিরতায়, দুর্বাক্যে, তুচ্ছতায় উদ্ভটতায় শিল্প-সাহিত্যের পরিমণ্ডলটাই বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। কিছুই তো যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত হয় না এখানে, যদি হতো, তাহলে দেখা যেত অমন কঠিন কৃচ্ছ কৃপণকালেও কতো অসংখ্য ছোটবড়ো পত্র-পত্রিকা সেইসময় প্রকাশিত হয়েছিল। একমাত্র কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কোনোটিই টেকেনি অবশ্য, কোনো কোনোটি বিজ্ঞাপিত হয়েছিল মাত্র, কোনোদিনই প্রকাশিত হয়নি, বহু পত্রিকা বের হয়েছিল মাত্রই একবার, কোনো কোনোটি দুবার-তিনবার, কোনোটি এক ফর্মার, কোনোটি দু-তিন ফর্মার, কোনোটি-বা একটিই বড়ো কাগজ ভাঁজ করা। আর শুধুমাত্র সংখ্যার দিক থেকেই নয়, রচনার বিষয়ের দিক থেকে বিচিত্র কথা সেসব পত্র-পত্রিকায় সন্নিবেশিত হয়েছিল। সন্দেহ নেই, কবি ও কবিতা নিয়ে কথা সবচেয়ে বেশি। এদেশে তার তো কখনো অভাব পড়েনি, আজও নয়, সমৃদ্ধিও এখানে সবচেয়ে বেশি তবে চিত্রকলা নিয়ে আগ্রহ অনুরাগ দেখা গেল পাত্রে ধরে রাখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে চিত্রকলার নানা স্কুল, নানা রীতি-প্রকরণ এবং আন্দোলনগুলি সম্বন্ধে নতুনভাবে জেগে উঠল প্রবল আকর্ষণ। দুটি শিল্পই খুব কাছাকাছি, দুই বোনের মতো – কিন্তু আগ্রহটা বুদ্ধদেবীয় এবং যা বুদ্ধদেব ভারতবর্ষ বাংলার চিত্রকলা ভাস্কর্য ইত্যাদি থেকে ততোটা আহরণ করেননি যতোটা করেছেন ইউরোপের আঙিনা থেকে এবং ততোটা ‘ভিজ্যুয়ালি’ নয়, যতোটা পড়াশোনা করে। এখানেও দেখা গেল আগ্রহ অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, যামিনী রায়, জয়নুল, কামরুল, এস. এম. সুলতানের দিকে ততোটা নয় যতোটা ফরাসি, স্প্যানিশ, ইতালীয় আর ইউরোপের নিম্ন-অঞ্চলীয় দেশগুলির শিল্পী ও শিল্পকর্মগুলি সম্বন্ধে। এখন আর মনে পড়ছে না, তখন যেন মনে হতো বেশির ভাগ লেখাই যেন ধমক ছিল কিংবা ছিল মেনিফেস্টোর মতো – দ্বিমত বিতর্কের কোনো জায়গাই নেই। সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কবিতা চিত্রকলা চলছিল হাত ধরাধরি করে, কারণ অনেক চিত্রশিল্পীই কবি, অনেক কবিই চিত্রশিল্পী।

যে-শিল্প-সাহিত্য বুদ্ধদেব বসুকে হাতছানি দিয়ে আসছিল বিশের দশক থেকে, যে-হাতছানি দুর্বার হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ষাটের দশকে, দৃষ্টি থেকে যে-ছবি তিনি আর কিছুতেই মুছে ফেলতে পারেননি অথচ ইতোমধ্যে পৃথিবী বদলে গিয়েছিল, ষাটের দশকের দিকেই প্রায় সমস্ত উপনিবেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল উপনিবেশিকরা, সবচেয়ে প্রতাপশালী প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদী দেশ গ্রেট ব্রিটেন দ্রুত পিছনের সারিতে দাঁড়াচ্ছিল, এক অদৃশ্য অনুপস্থিত সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনা নিয়ে নতুন পৃথিবী তৈরি করতে নেমে পড়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, শিল্প-সাহিত্যে নেমে আসছিল ভয়াবহ ভাঙচুর – এইসব কিছু থেকে পিঠ ফিরিয়ে, নিজেদের একান্ত পায়ের তলায় মাটির ধস-নামা পর্যন্ত ভুলে গিয়ে ষাটের দশকের শিল্প-সাহিত্যের আলোচনার বিষয়গুলি আধুনিকতার এক মেকি খোলসে আমাদের ভিন্ন অর্থে প্রাদেশিকতা আর গ্রাম্যতার দিকেই টেনে যাচ্ছিল। ডাডাবাদের জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে, মিউনিখে, স্বাভাবিকভাবেই তা ছিল দায়িত্বশূন্য নৈরাজ্যবাদী, হিস্টিরিয়াগ্রস্ত; মোনালিসার গোঁফ লাগিয়ে দিয়ে দুকাম্প্ তার তলায় দিয়েছিলেন অশ্লীল একটা শিরোনাম। বিশ্বযুদ্ধের পরে, ১৯২২-এর দিকে ওটা মরলে আপোলিনেয়ারের একটি পুরনো ব্যবহৃত শব্দ ‘ঝঁৎৎবধষরংঃব’ নিয়ে আঁন্দ্রে ব্রেতো এখান-ওখান থেকে ডাডাবাদের ছেঁড়া-খোঁড়া দলটাকে একসঙ্গে করে সুররিয়ালিজম প্রতিষ্ঠা করেন। তার মেনিফেস্টো হলো, ‘শুদ্ধ মনোচৈতন্যভিত্তিক স্বচালিত প্রক্রিয়া যা অবলম্বন করে মৌখিকভাবে, লিখিতভাবে বা অন্য কোনো উপায়ে চিন্তার সত্যকারের ক্রিয়াপদ্ধতি প্রকাশ করা যাবে। এ হলো চিন্তার আপন নির্দেশ; যুক্তি, শিল্পভাবনা বা যে-কোনো নৈতিকতার বালাই থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।’ এই মতবাদের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ১৯২২ সালের দিকে। বিধ্বস্ত ইয়োরোপ, উদ্দেশ্যহীন লক্ষ্যহীন গন্তব্যহীন ইয়োরোপ, অর্থনীতিতে রাজনীতিতে নষ্ট ইয়োরোপ, মুসোলিনি হিটলারের মতো সভ্যতাবিধ্বংসী উন্মাদের উত্থান ঘটাতে উদ্যত ইয়োরোপের দিকে চাইলে শিল্পে-সাহিত্যে দর্শনে রাজনীতি-অর্থনীতিতে সব জায়গাতেই অসুস্থতা আর বিকার দেখতে পাওয়াই হলো স্বাভাবিক। কিন্তু আত্মবোধশূন্যতা, অন্ধঅনুকরণপ্রিয়তা, সৃজনকল্পনাচিন্তার পরিমাপহীন নিঃস্বতা আর শিল্পীর শ্রেয়বোধের অসম্ভব নিষ্ঠুরতা ছাড়া আমাদের নিজেদের ভেসে যাওয়ার কারণ তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না।

বন্দরে এসেছিল ঠুনকো ফিনফিনে কাচের তৈরি একটি আলোকিত জাহাজ। তার মাল খালাস করে যা ঘরে তোলা হয়েছিল, কিছুই তার টেকেনি। দেশের রোদ জলহাওয়া সইতে পারেনি। তবু সেসব সামনে রেখে, তাদের আদর্শ হিসেবে নিয়ে ষাটের দশকের নতুন প্রজন্ম, প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে, ভুল দেবতাদের সাধনায় অর্ধেক একটা দশক প্রায় অপচয় করে বসেছিল। আজ থেকে ঠিক চল্লিশ বছর পিছনে দৃষ্টি দিলে মনে হবে মাঠভর্তি ফসল আদৌ পুষ্ট হয়নি, পাকেনি, রং ধরেনি, টেকেনি, অকালেই ঝরে পড়েছে। যা টিকে গেছে তা দশকের তোয়াক্কা রাখেনি। দুই বাংলার সাহিত্যেই এই একই ঘটনা ঘটে গেছে। তর্কের উদ্দেশে হয়তো শামসুর রাহমান, সৈয়দ হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, শহীদ কাদরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহদের উল্লেখ হবে। এঁদের কারও শুরু ষাটের দশকে নয়, অন্যদিকে অবশ্যই উল্লেখ হবে আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহার। তখন মনে পড়বে তাঁরা গ্রহণ-লাগা সূর্যের দিকে খালি চোখে তাকাননি। শেষ ষাট থেকে তাঁদের উঠে আসা, বিকাশ পূর্ণতা মুক্তিযুদ্ধের পরে। আর রফিক আজাদ যতোই থাকুন ষাটের দশকের উন্মাদনার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, তিনি যে শেষ পর্যন্ত মাটিতে পা রাখেন, তিনি যে কৃষক হয়ে যান, তাঁর ঘন ঘন সর্দির ধাত কেটে যায় খালি-মাথায় রোদবৃষ্টিসাঁতলা বাতাসে বাংলার বুকের ভিতরে ঢুকে পড়ার আকুতিতে। আর খুব তর্ক হবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে। বুদ্ধদেব বসুর চাই আনন্দের সাহিত্য, চাই বুদবুদের সাহিত্য, চাই কবিতার মধ্যে শুধু কবিতা, আত্মপরতায় পরিপূর্ণ, দায়হীন নিছক শিল্পের কাছে নতজানু – এই মন্ত্র ইলিয়াস কতোকাল জপেছিলেন, এখন আর তা খুঁজে পেতে অসুবিধা নেই। কিন্তু এই দুরন্ত, ঋজু মেরুদণ্ডের মানুষ ও শিল্পীটিকে কোনো গণ্ডিতে বাঁধার সাধ্য কারও ছিল না। সমস্ত দায় মানুষের কাছে গচ্ছিত রেখে কবে থেকে এই শিল্পী নিজের কাজে নেমেছিলেন তা নিয়ে আলাদা গবেষণা হতে পারে। ষাটের দশক তাঁর হাঁটুরও নিচে পড়ে যায়।  

কিন্তু মোহনিদ্রা কিছুতেই ভাঙত না, আলোকিত জাহাজে পাড়ি দিয়ে বৈশ্বিকতায় পরিভ্রমণের আকাক্সক্ষার জের কিছুতেই কাটত না যদি না বাংলার মাটি মাতাল দুলতে শুরু করত, দশকের মাঝামাঝি থেকে গর্জনে গর্জনে উত্তাল করে না তুলত বঙ্গোপসাগরের জলরাশি, যদি না বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি সিক্ত হতো মানুষের রক্তে আর মুক্তিযুদ্ধ তার প্রচণ্ড থাবায় আমাদের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিত এই বাংলাদেশের মাটি আর মানুষের দিকে। ৎ

* এই লেখাটি কালি ও কলমের দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি ২০০৫/ ফাল্গুন ১৪১১) প্রকাশিত।