বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না, তাঁর নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পেয়েছি। স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণে ডাক দিয়েছেন – ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের তরুণ-যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে।

পাকিস্তানি সেনারা ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানের কারাগারে। ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি।

২৫শে মার্চ একদিকে বাংলার জনগণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে; অন্যদিকে ঢাকায় কামান, ট্যাংক, মেশিনগান ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘুমন্ত জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চালিয়েছে ব্যাপক গণহত্যা। আক্রমণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলি। নির্বিচারে হত্যা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীদের। হত্যা করে তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে গণকবরে।

তাদের অপরাধ তারা গণতন্ত্র ও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। পাকিস্তানি সেনারা বস্তিগুলিতে আগুন দিয়েছে, কারণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জনসভা ও সমাবেশগুলিতে বস্তির গরিব মানুষ দলে দলে যোগ দেয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের  কারণ তিনি ৬ দফা ঘোষণা করেছেন। ’৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণ ৬ দফার পক্ষে গণরায় দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে।

পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা বিপুল ভোটে জয়ী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি নয়। তারা ভেবেছে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে এবং জনগণের ওপর ট্যাংক তুলে দিয়ে ও কামান দেগে বাংলার মানুষের আন্দোলন চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে। দমন-পীড়ন চালিয়ে তাদের কোমর ভেঙে দেওয়া যাবে।  তাই তারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যার নীলনকশা করে।

এই বর্বর-নিষ্ঠুর, নির্বিচার গণহত্যা যে বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় আরো বেপরোয়া ও মরিয়া করে তুলবে তা ভাবতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকরা। তারা ভেবেছিল নেতাকে গ্রেফতার করলে জনগণ দিশাহারা হয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টোটা। মানুষ দিশেহারা কেন হবে? নেতা তো দিকনির্দেশনা দিয়েই গেছেন। ৭ই মার্চের ভাষণে বলে গেছেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে … ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল …।’ তাই হয়েছে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়েছে।

বাংলার তরুণ-যুবারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা বুঝেছে – স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। ২৫শে মার্চের পর আতঙ্কিত মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছে। দুশো, তিনশো, এমনকি চারশো মাইল পায়ে হেঁটেও প্রত্যন্ত জেলা ও গ্রামে চলে গেছে। অনেকেই হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদিকে নেতৃবৃন্দও বিচ্ছিন্নভাবে যাঁর যাঁর জেলা থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছেন। এখন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো বলেছেনই – ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আর সারা মার্চ মাসজুড়ে চলেছে অসহযোগ আন্দোলন।

’৬৯-এর মতো ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগের দিনগুলিও আমাদের কেটেছে মিছিলে-সমাবেশে। কখনো শহিদ মিনারে সমাবেশে, কখনো রাইফেল ট্রেনিং প্যারেডে, কুচকাওয়াজে। অসহযোগ চলাকালীন ৭ই মার্চের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে আমাদের রাইফেল ট্রেনিং শুরু হলো। ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে রাইফেল ট্রেনিং পরিচালনা করা হয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের জন্য। আমরা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা এই রাইফেল ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছিলাম। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যোগ দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইউওটিসি থেকে সংগৃহীত কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে ওই ট্রেনিং হয়েছিল। ট্রেনিংয়ের অংশ ছিল কুচকাওয়াজ ও রাইফেল ট্রেনিং। ট্রেনিং শেষে সম্ভবত ২০শে মার্চ ঢাকার রাস্তায় কুচকাওয়াজে আমরা অংশ নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ থেকে প্যারেড করে আমরা নবাবপুর হয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক হয়ে আবার পূর্বের স্থানে ফিরে আসি। পরদিন সকল জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় এই প্যারেডের ছবি প্রকাশিত হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক ছবি। ছাত্রদের এই ট্রেনিং ও প্যারেড সব মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। আমরা সবাই বুঝে গিয়েছিলাম আমাদের যুদ্ধ করতে হবে।  যুদ্ধ ছাড়া দেশ স্বাধীন হবে না। কাঠের রাইফেলে তো আর যুদ্ধ হবে না। তবে, এখন বুঝি, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে এটা দারুণ কাজ করেছিল। এই ট্রেনিং ও সংবাদপত্রে এর ছবি যেমন আমাদের ছাত্রদের, তেমনি দেশবাসীকে যুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল ও সাহস জুগিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ১লা মার্চ দুপুর ১টায় রেডিওতে যখন ঘোষণা করা হলো, ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলো, তখনই স্পষ্ট বোঝা গেল, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে পাকিস্তানি শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।

সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেল। মিছিলের সেøাগান – ‘এক দ ফা, এক দাবি – স্বাধীনতা স্বাধীনতা।’ এর আগে সেøাগান ছিল – ‘৬ দফা মানতে হবে।’ ‘১১ দফা মানতে হবে।’ এখন সবাই বুঝে গেল, লড়াই করে স্বাধীনতা আদায় ছাড়া বাঙালির মুক্তির আর কোনো পথ খোলা নেই।

বিক্ষুব্ধ মানুষ। মিছিলে কারো হাতে বাঁশ, কারো হাতে বড় বড় গাছের ডাল। কেউবা একটা গাছই উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। বিক্ষোভ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা চলছিল – খেলা ফেলে বিক্ষুব্ধ দর্শক মাঠে নেমে পড়েছে। পাকিস্তানি পতাকায় আগুন দিয়ে সবাই স্টেডিয়াম থেকে রাস্তায় নেমে এসে মিছিলে শামিল হয়েছে।

সবার কণ্ঠে একটাই সেøাগান – ‘এক দফা, এক দাবি/ স্বাধীনতা, স্বাধীনতা।’

অনেকে হোটেল পূর্বাণীর সামনে ভিড় জমিয়েছে আওয়ামী লীগ কী সিদ্ধান্ত দেয় জানার জন্য। কারণ সেখানে আগে থেকে আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির সভা চলছিল।

বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো। পরদিন থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ চলছিলই। ২রা মার্চ বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হলো। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ মানুষের জনসভায় প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। আন্দোলনের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিলেন।

২৫শে মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান চললো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। সর্বত্র উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা। কোথাও পাকিস্তানের পতাকা নেই। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন ঢাকায় এসেছেন আলোচনার জন্য তখনো ঢাকায় কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে না।

আলোচনা ব্যর্থ হলো। ২৫শে মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ফিরে গেলেন। প্রেসিডেন্ট চলে যাওয়ার পরে রাত ১০টার পর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলো। ভয়ঙ্কর এই রাতের কথা তো আগেই বলেছি।

তারপর বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, অনেক রক্তের নদী পেরিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হলেন। ৬ লাখ নারী সম্ভ্রমহারা হলেন, চরম নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হলেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে তাঁর নেতৃত্বাধীনে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ও নির্দেশ বাস্তবায়ন করলেন আরেক নেতা তাজউদ্দীন আহমদ।

তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলেন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেন।

বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছাড়া যেমন দেশ স্বাধীন হতো না, তেমনি তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্ব ছাড়া বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে পারতো না।

১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধে জয়ের পর অস্থায়ী সরকার বাংলাদেশে ফিরে এলো। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেল। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরলেন। তাঁর হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করে তাজউদ্দীনের দায়িত্ব যেন শেষ হলো।

২.

বঙ্গবন্ধুকে আমি খুব কাছে থেকে তেমন দেখিনি। একবার শহিদ মিনারে সকালে বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানীকে দেখেছিলাম। তাঁরা একসঙ্গে এসেছিলেন। সেটা ১৯৫৮ সাল হতে পারে। তখন একবার ২১শে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ছিল।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে যেদিন বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেলেন আমরা জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ক্যান্টিনে বসা ছিলাম। সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, নীনা হাসেল, সোমেশ্বর চক্রবর্তী, রেজা আলী ও আমি। তখনই খবর এলো – বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন। মানিক ভাই বললেন, চলো আমরা ৩২ নম্বরে যাই। রেজা আলীর সঙ্গে একটা জিপ ছিল। রেজা ভাই গাড়ি চালালেন। আমরা ছুটলাম ৩২ নম্বরে। সে কী উত্তেজনা! সেখানে গেলাম। মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে।

আমরা নিচে থেকে একঝলক দেখলাম বারান্দা থেকে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢুকে গেলেন।

দীর্ঘদিন জেল খেটে আসায় তিনি তখন ক্লান্ত-শ্রান্ত। তখন তিনি পরিবারের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাবেন। আমরা আর অপেক্ষা করে ভিড় বাড়ালাম না। ফিরে এলাম। ২৩শে ফেব্রুয়ারি বিকালে রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ৩৪ জনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সমাবেশেই তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

’৬৯-এর গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের কারণেই পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা এই মামলা বাতিল করে তাঁদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। গণদাবির মুখে তারা কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ, মতিয়া চৌধুরী এবং বহু প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বহু বছর, বলা যায় জীবনের বড় সময়, কারাগারে ছিলেন। অন্য একদিন তাঁদেরও সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

৩.

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের কথা আগে বলা দরকার।

’৬৯-এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে বিশাল গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল তা আমাদের ইতিহাসের মাইলফলক।

ঊনসত্তর ছিল ’৭১-এর যেন ড্রেস রিহার্সাল। এই বিশাল আন্দোলন ও  গণঅভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানের পতন হয়। তবে সামরিক শাসন অবশ্য বহাল থাকে।

’৬৯-এর ১৭ই জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে একটি মিছিল বের হয়। পুলিশ টিয়ারগ্যাস ইত্যাদি ছুড়ে সে মিছিল তখনই কলাভবনে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। ১৮ তারিখেও ছাত্ররা মিছিল বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

২০ তারিখ সকালে আমরা রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের দিকের গেট থেকে মিছিল নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে দিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল ছাড়িয়ে পুরনো কলাভবন পর্যন্ত পৌঁছে যাই। পুলিশ সেখানে গিয়ে মিছিলে বাধাদান করে – টিয়ারগ্যাস ও গরম পানি ছিটিয়ে এবং লাঠিচার্জ করে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় কিছুটা। এখানে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ হয়। সেখানে একপর্যায়ে গুলিও চলে। গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন।

মিছিলের সামনের অংশ অবশ্য অগ্রসর হয়ে গুলিস্তানের কামান পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। এই কামানটি এখন ওসমানী উদ্যানে স্থানান্তরিত হয়েছে। পরদিন সংবাদপত্রে এই মিছিলের ছবি প্রকাশিত হয়।

আসাদের মৃত্যুর খবরে আমরা সবাই মর্মাহত হই। আসাদের লাশ বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে আনা হয়। পরে লাশ নরসিংদীতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আমরা বিকেলে মৌন মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করি। মিছিলের সামনে ছিল কালো পতাকা ও আসাদের রক্তমাখা শার্ট। সেই মিছিল থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়, পরদিন ছাত্ররা শহরে হরতাল ডেকেছে। ছাত্রহত্যার খবরে সারা শহরের মানুষ শোকাহত ও স্তব্ধ। সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সারাদেশে ছাত্রদের এ-আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ৬ দফার সমর্থনে ছিল এ আন্দোলন। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু ও মণি সিংহসহ সকল রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে ছিল এই আন্দোলন। ২৪শে জানুয়ারি এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এখানে একটু উদ্ধৃত করছি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটি নিবন্ধ থেকে :

প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল শেখ মুজিবের ধ্যানজ্ঞান। এ-বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের অনুকূল সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা লাভই অভীষ্ট বলে স্থির করেন। তিনি এক সময়ে আগরতলা যান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করে ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে পাঠান। নেহরু তাঁকে আপাতত এ-ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করার পরামর্শ দেন। এ-বিষয়ে তিনি কতদূর অগ্রসর হতে পেরেছিলেন, তা ঠিক জানা যায় না। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। একে ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ এবং ‘আমাদের মুক্তি-সনদ’ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সরকার এ-দাবি দমন করতে দৃঢ়সংকল্প ছিল। শেখ মুজিবও এ-দাবির পক্ষে পূর্ব বাংলার আনাচে-কানাচে সভা করতে থাকেন। এক জায়গায় সভা করার পর তিনি গ্রেপ্তার হন, জামিনে ছাড়া পেয়ে আরেক জায়গায় সভা করেন, আবার গ্রেপ্তার, জামিন ও সভা। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরো ৩৪ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্টদ্রোহের মামলা দায়ের করেন। এটাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করে। আসামিদের ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি রাখা হয় এবং তিন সদস্যের এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার শুরু হয়। মামলার প্রতিদিনের বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকলে শেখ মুজিবের জনসমর্থন বাড়তে থাকে এবং আগরতলা মামলাকে ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যা দিয়ে তা বাতিল করার দাবি প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। তখন ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে এগারো দফার আন্দোলনে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলে। এগারো দফার এক দফায় ছয় দফা মেনে নেওয়ার দাবি ছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে গুলি করে হত্যা করা হলে প্রতিবাদে দেশ ফেটে পড়ে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাজনীতিকদের এক গোলটেবিল আহ্বান করেন এবং তাতে যোগদানের জন্যে মুজিবকে পেরোলে মুক্তিদানের প্রস্তাব দেন। মুজিব সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। জানমতের চাপে শেষ পর্যন্ত আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হয়, আইয়ুবও সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে দৃশ্যপট থেকে অন্তর্হিত হন, শেখ মুজিব রূপান্তরিত হন বঙ্গবন্ধুতে।

সেদিন ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর দেখা পাইনি। তবে যুদ্ধের পর ’৭৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও সিপিবির বিশেষ গেরিলা বাহিনীর অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর কাছে সেদিন অস্ত্র সমর্পণ করা হয়। আমরা কুচকাওয়াজে অংশ নিই। আমাদের পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দ অস্ত্র সমর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে সেদিন মাল্যভূষিত করেছিলেন ছাত্রনেতা আবুল হাসনাত।

সেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখেছি।

পরে ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে বাকশাল গঠিত হলে, একদিন আমরা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পক্ষ থেকে মিছিল করে বাকশাল অফিসে গিয়ে বাকশালে যোগদান করি। সেদিন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। তারিখটা ছিল সম্ভবত ৭ই জুন। বাকশাল অফিস ছিল কাকরাইলে। এখন সেখানে ডিএফপি অফিস হয়েছে। পুরনো দোতলা বাড়িটা এখনো আছে। বঙ্গবন্ধু দোতলায় দাঁড়িয়ে সালাম গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তেমন কাছে থেকে দেখার সুযোগ না হলেও প্রসঙ্গত বলে রাখি, একবার বেগম মুজিবকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বন্ধু ও সহপাঠীরা, আমরা, একদিন স্কুল থেকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বেগম মুজিব আমাদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করেছিলেন। ছোট রাসেল পাশের ঘরের বিছানায় শোয়া ছিল।

বঙ্গবন্ধুর সব কাজে বেগম মুজিবের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি ছিলেন তাঁর সাহস ও শক্তি। তাঁর সকল কাজের সহযোগী।

৪.

মূল আলোচনায় ফিরে যাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রেষ্ঠ অবদান স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ হবে ‘সোনার বাংলা’ – স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। কিন্তু সে-স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাঁকে হত্যা করে। তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র তিন বছর আট মাস। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। দেশের মৌলিক কাঠামো গড়ে তোলায় মনোযোগী হয়েছিলেন। দ্রুততম সময়ে জাতিকে একটা সংবিধান তিনি উপহার দিয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী করার জন্য অত্যন্ত অল্প সময়ে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ব্যবস্থা করেছিলেন।

অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পাশাপাশি জাতীয় উন্নয়নের অত্যন্ত মৌলিক ভিত তৈরির জন্য তিনি ১৯৭২ সালেই কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের কাজ সমাপ্ত করে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর শিক্ষা কমিশনের সেই প্রতিবেদন আর কোনোদিন বাস্তবায়িত হয়নি। সেই প্রতিবেদন বাস্তবায়িত হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আজকের অরাজকতা আর দেখতে হতো না। কমিশন একমুখী শিক্ষার সুপারিশ করেছিল, যা আর বাস্তবায়িত হয়নি।

‘একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অতিদরিদ্র দেশের প্রারম্ভিক উন্নয়ন চিন্তায় অবকাঠামো, অর্থনীতি ও শিক্ষার কথা গুরুত্ব দেওয়া যেমন খুবই জরুরি মনে করেছেন বঙ্গবন্ধু, এর পাশাপাশি শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নের কথাও ভেবেছেন। … তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, যেখানে আধুনিক চারুকলা, নৃত্য, সংগীত ও নাট্যকলার চর্চা ও বিকাশের সুযোগ থাকবে।’১

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন।

সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি সাহিত্যিক নই, শিল্পী নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস।’

শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা বাংলাদেশে উদার, আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিল।

আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর মৃত্যুতে সেই ধারা ব্যাহত হয়।

শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব ও মনোযোগ না দেওয়ার কারণে দেশে আজ ব্যাপক সামাজিক অবক্ষয় আমরা লক্ষ করছি।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম মূল উপাদান ছিল বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের ভাবনা। তিনি তাই রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি নির্ধারণ করেছিলেন – গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন। বাকশালের যে-লক্ষ্য ছিল তা বাস্তবায়নের তিনি সুযোগ পাননি। সম্ভবত সমাজতন্ত্র অভিমুখিনতার কারণেই তাঁকে হত্যা করা হয়।

তাঁর চিন্তা ও অভিমুখিনতা বোঝা যায় তাঁর একটি ভাষণ থেকে। সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার আমার, আমাদের বেতন দেয় গ্রামের কৃষক। তাদেরকে ইজ্জত করে কথা বলবেন।’

তিনি তাঁর বহু ভাষণে বারবার দুর্নীতির অভিশাপ সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুর্নীতি থেকে বিরত থাকার জন্য আকুল আহ্বান জানিয়েছিলেন।

৫.

নারী অধিকার ও নারী উন্নয়নের বিষয়টিকেও বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে লাঞ্ছিত নির্যাতিত নারীদের বীরনারী তথা ‘বীরাঙ্গনা’ নাম দেন। নির্যাতিত ও স্বামীহারা অসহায় নারীদের সাহায্যার্থে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী পুনর্বাসন বোর্ড।

এ-সংক্রান্ত সংবাদ বাংলার বাণী ২৪শে ফেব্রুয়ারি এবং ইত্তেফাক ২৫শে ফেব্রুয়ারি গুরুত্বসহকারে পরিবেশন করে। ২৪শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায়ও এ-বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়,

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের নির্যাতিত নারীদের অবিলম্বে সর্বপ্রকার সাহায্য ও পুনর্বাসনের জন্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠন করেছেন। এ ব্যাপারে আনুমানিক দশ কোটি টাকার একটি বিস্তারিত কর্মসূচী প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছেন। গতকাল বুধবার বাসস খবরে প্রকাশ, এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী ১৩ ব্যক্তিকে নিয়ে একটি জাতীয় বোর্ড গঠন করেছেন।  … এ সংস্থা নির্যাতিত নারীদের আশু প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ডাক্তারী সাহায্য প্রদান ছাড়াও বিভিন্ন রকমের পেশাদার শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। যে সমস্ত দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, ডাক্তার, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নিরীহ মানুষ হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন তাদের মা-বোন ও বিধবাদের সাহায্যদানও এ সংস্থার আওতাভুক্ত থাকবে।২

এদিকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাবনা জেলার নগরবাড়ির উত্তরে বসন্তপুর গ্রামে যান। সেখানে বাঁধ নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করার কথা ছিল তাঁর। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মঞ্চে উঠবেন। এমন সময় বঙ্গবন্ধুর কাছে কয়েকজন নারী যেতে চাইলেন। কিন্তু তাঁদের বাধা দেওয়া হচ্ছিল।

বঙ্গবন্ধু বিষয়টি লক্ষ করলেন এবং নির্দেশ দিলেন তাঁদের আসতে দিতে। তাঁরা ছুটে এসে বঙ্গবন্ধুর সামনে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। একজন জানালেন, হানাদার বাহিনী তাঁকে লাঞ্ছিত  করেছে। তাই তাঁর স্বামী তাঁকে সংসারে নিতে চাচ্ছেন না। সমাজের মানুষও তাঁদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করছেন না। বঙ্গবন্ধু সব শুনলেন। মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিলেন। বললেন, ‘আজ থেকে পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়। তাঁরা এখন থেকে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্য তাঁরা ইজ্জত দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে তাঁদের অবদান কম নয়। বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাঁদের বীরাঙ্গনা মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে আর সেই স্বামী পিতাদের উদ্দেশে আমি বলছি যে, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা মেয়ের পিতা হয়েছেন।’

এ-বিষয়ে ২৮শে ফেব্রুয়ারি বাংলার বাণীতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিল – ‘ওরা বীরাঙ্গনা ওদের মর্যাদা দিন’। প্রতিবেদনটিতে বলা হয় – জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি আন্দোলনের সময় হানাদার বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত দু’লাখ মহিলার উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছেন। গত শনিবার পাবনার নগরবাড়িতে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দানকালে এসব লাঞ্ছিতা মহিলাদের সমাজে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার আবেদন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, লাঞ্ছিতা মহিলা ‘আমার মা, বোন, কন্যা’। তিনি এদের মধ্য থেকে বিবাহের পাত্রী বাছাই করে চারিত্রিক মহত্ত্বের প্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

বঙ্গবন্ধু তাঁদের কেবল বীরাঙ্গনা নাম দিয়েই চুপ করে বসে থাকেননি, তাঁদের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিলেন। বীরাঙ্গনারা সবচেয়ে বড় লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন স্বাধীন দেশে, নিজ সমাজে। তাই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, – ‘ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও শেখ মুজিবুর রহমান। আর ঠিকানা লিখে দাও ধানমন্ডি বত্রিশ। মুক্তিযুদ্ধে আমার মেয়েরা যা দিয়েছে তার ঋণ আমি কিভাবে শোধ করবো।’ বঙ্গবন্ধু তাঁদের দহন যন্ত্রণা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন। তাই সমস্ত নির্যাতিত মেয়ে হয়ে উঠেছিল তাঁর কন্যা আর তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বজনীন পিতা, অসহায় মানুষের নিরাপদ আশ্রয়, নির্ভরযোগ্য এক মহীরূহ। শুধু বঙ্গবন্ধু নন, বেগম মুজিবও এই সময় যোগ্য মায়ের ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসেন। ঢাকার দুটি ক্লিনিক পরিদর্শনে যান বেগম মুজিব। সেই সময়ে তিনি বলেন, ‘এই বীরাঙ্গনা রমণীদের জন্য জাতি গর্বিত। তাঁদের লজ্জা কিংবা গ্লানিবোধের কোনো কারণ নেই।’ তিনি তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন। বলেছেন – ‘আমি তোমাদের মা।’

১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। নারীর উন্নয়ন বিষয়টির প্রতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল। স্বাধীনতার পর তিনিই প্রথম সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন চালু করেন। কথা ছিল, পরে, নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে, যা আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। এখনো বিভিন্ন পর্যায়ে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে সে-প্রথাই বহাল রাখা হয়েছে। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো এতোদিনে সরাসরি নারী সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু হয়ে যেত।

৬.

বঙ্গবন্ধু গণমাধ্যমের এবং সংবাদকর্মীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল। তিনি নিজেও জীবনের শুরুর এক পর্যায়ে দৈনিক ইত্তেহাদে কিছুকাল সাংবাদিকতা করেছেন। অনেক সিনিয়র সাংবাদিক তাঁর বন্ধু ছিলেন। তিনি সাংবাদিকতার গুরুত্ব বুঝতেন। তাই তিনি ১৯৭৪-এর আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই অনুসারে সাংবাদিকদের জন্য পৃথক ওয়েজবোর্ড গঠন করেছিলেন। সাংবাদিকরা যেহেতু মস্তিষ্কের কাজ করেন, তাই তাঁদের তিনি লেবার ল’র আওতাভুক্ত না করে তাঁদের জন্য পৃথক ওয়েজবোর্ড চালু করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই নেতা, যাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশের স্বাধীনতার জন্য নেতার আহ্বানে জীবন দিতে প্রস্তুত হয়েছিল বিনা দ্বিধায়। সেই স্বাধীন দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাঁকে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে।

তারপর যাঁরা এদেশে ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। ’৭৫ থেকে ’৯৬-এ আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ করা যেত না। রেডিও-টিভিতে তাঁর নাম নিষিদ্ধ ছিল। তবু তাঁর নাম মুছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দেশব্যাপী উদযাপিত হয়েছে।

এই উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে আরো মনোযোগী হওয়া বোধকরি প্রয়োজন। তাঁর গ্রন্থগুলি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে তাঁর ভাষণগুলি রাজনৈতিক কর্মীদের ও ছাত্রদের মধ্যে পাঠের চর্চা বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে করে তাঁর আদর্শ, তাঁর স্বপ্ন এবং জীবনবোধের সঙ্গে সবাই পরিচিত ও উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তাঁর দেখানো পথে সবাই চলতে পারে – সেজন্য এটা জরুরি।

তিনি তাঁর গোটা জীবনটাই দিয়েছেন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। বাঙালিকে একটি স্বাধীন দেশ তিনি উপহার দিয়েছেন; বিনিময়ে পেয়েছেন মৃত্যু। ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। শুধু তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন বলে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান। ইতিহাসে এমন নৃশংসতার আর নজির নেই।

শোকের এই মাসে মহান এই নেতার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র

১. ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জন্মশতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি’, নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ স্মারক, সম্পাদক আবুল হাসনাত, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স।

২. নারী পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু, রঞ্জনা বিশ^াস, বাংলা একাডেমি।